বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০০৩

নৃত্য

আমার পড়ার টেবিলের সামনে একটা বড় জানালা আছে। জানালাটা আমার খুব প্রিয়। বাড়ির সামনের খোলা উঠোনটা আর ওপরের বিরাট, বিস্তৃত আকাশের একটুকরো এখানে আটকে গেছে। মনে হয় কেউ যেন টলটলে নদীর মাঝখানে ঘের দিয়ে তার অনেকটা জল আটকে ফেলেছে। কী যে ভাল লাগে! আমরা যখন প্রথম এই বাসায় উঠি তখন ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামানোর আগে আমি বাসায় ঢুকে এই ঘরটার দখল নিয়েছিলাম, দাদা আর নৃত্যর আগে। নৃত্য আমার ছোট বোন। ওর এই নামটা বাইরের সবাইকে বলা হয়। তারপরেও অনেকেই এটাকে ‘নিতু’ বানিয়ে ফেলে। যখন ও একদম ছোট, মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়স, মা ওর মাথায় ছোট ছোট দুটো নরম শিংয়ের মতো ঝুটি বেঁধে দিত। তখন ওকে বাইরের কেউ নিতু বললে ও খুব রাগ করতো। গাল ফুলিয়ে বলতো, “আমার নাম নৃত্য। নয়ে ঋ-কার, ত-য়ে য-ফলা, ‘নৃত্য’। আমাকে কেউ নৃত্য বলবে না।” শুধু আমি যদি ওকে নিতু বলে ডাকতাম, ও রাগ করতো না।


সেই নৃত্য আর দাদার আগেই আমি এই ঘরে ঢুকে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলাম, “এটা আমার ঘর, এটা আমার ঘর।”


হাতের বড় বাক্সটা মেঝেতে ধপ্‌ করে রেখে মা বলল, “আচ্ছা বাবু এটা তোর ঘর, এখন জিনিসপত্র নামাতে বাবা আর দাদার সাথে হাত লাগা। তাড়াতাড়ি কর।”


পুরো দুপুর ঘর গুছিয়ে বিকেলে আমি, দাদা আর নৃত্য বাইরে ঘুরতে বের হলাম। আমাদের বাসার চারপাশে গাছগাছালি। উঠোনটা পেরিয়ে একটা লাল লোহার গেট, তার বাইরে ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ভট ভট করে ছুটে চলা দু-একটা মোটর সাইকেল ছাড়া আর শোনা যায় রিকশার টুংটাং শব্দ। কত নিঝুম থম্‌ ধরা দুপুরে জানালার পাশে বিছানায় শুয়ে আমি রিকশাগুলোর টুংটাং শুনতাম! কেমন মজার ব্যাপার, রিকশার টুংটাং শুনে মনে হতো ওগুলো যেন অনুনয়-বিনয় করে বলছে – আমার সাথে চলো, চলো না। সেই অনুরোধের সুর আমাকে কেমন উদাস করে দিতো। আর এমন সময় নৃত্য চুপিচুপি এসে ধুপ করে আমার বিছানায় লাফিয়ে পড়তো।
“বাবু, কী কর তুমি? কী ভাবো?” ওর প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগেই আরো গাদা গাদা প্রশ্ন শুরু হতো।


“বাবু, তোমার নীল কলমটা একটু দাও না? তুমি ঐ ... ঐ বাসার ইলাকে চেনো? ও আমার কাছে কলমটা চাইলো যে?”


“বাবু, তুমি কালকে বেড়াতে যাবা? বন্ধুদের সাথে? কখন যাবা? আচ্ছা, যাও, অসুবিধা নাই, কিন্তু আমার জন্য একটা পেন্সিল আনবা রাবার বসানো।”


“বাবু... ?”


অবিশ্রান্ত, অনন্ত। অবিরল প্রশ্ন করে চলে নৃত্য। কোনো প্রশ্নই যেন উত্তর চায় না। যেন এই প্রশ্নগুলো করা পর্যন্তই ওর দায়িত্ব শেষ। উত্তর তুমি দিলে, কি দিলে না, তাতে কিছু আসে যায় না। আর কী অদ্ভুত! ওর সব প্রশ্ন শুধু আমাকে। জ্ঞান হবার পরে কেউ কোনো অজ্ঞাত মন্ত্রবলে ওর মনে জানিয়ে গেছে যে আমিই তার সকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বসে আছি।


নৃত্য আমাকে নাম ধরেই ডাকে। মায়ের মুখে শুনে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে। আর দাদাকে আমি ‘দাদা” বলি বলে ও-ও তাই শিখেছে। দাদা আমাদের দু’জনের চেয়ে বড়। একটু চুপচাপ। দাদার মাথার চুলগুলো সবসময় এলোমেলো হয়ে থাকে। আমি একবার চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে ঠিক করে দিয়েছিলাম। চিরুনি রেখে ফিরে এসে দেখি আবার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে দাদা নির্বিকারচিত্তে বই পড়ছে।


এই মফস্বল শহরটা আমাদের খুব প্রিয়। বিশেষত আমার আর নৃত্যের। সকালে বাবার সাথে আমরা দুজন বের হই। আমার কলেজের লাগোয়া স্কুলেই নৃত্য পড়ে। আমরা দু’জন যখন হেঁটে হেঁটে যেতে থাকি তখনও নৃত্য অনর্গল প্রশ্ন করে চলে। আর একটু পরপর বলে, “ওহ্‌ হো, বাবু, তুমি একটু আস্তে হাঁটো তো। তুমি কি ঘোড়া, যে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছ?” গুটি গুটি পায়ে কেমন টুকটুক করে হাঁটে নৃত্য। হাল্কা নীল পোশাক আর দুধসাদা রিবনের দুটো ঝুঁটিতে ওকে দেখলেই মনে হয় যেন কোন অপ্সরী পথ ভুলে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে।



আমাদের জীবনটা খুব শান্ত আর নিবিড় ছিল। মা, বাবা, আমি, দাদা আর নৃত্য। মফস্বলে বড় কোনো ঘটনা ঘটতো অনেকদিন পরপর। প্রতিবার পুজোয় আমাদের খুব মজা হতো। এই পাড়াতে আমরাসহ বেশ কয়েকটা পরিবার আছে হিন্দু। আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্রতিমা বানাতাম। ছোট্ট থাকতে নৃত্য খালি বলতো, “বাবু দেখো, দুর্গামার মুখটা একদম আমার মতো না?” কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, এখন ওকে সেই কথা বললে কেন জানি ও খুব লজ্জা পায়। আর এটা নিয়ে প্রতিবছরই পুজোর সময় আমি আর দাদা মিলে ওকে খুব জ্বালাই।


তবে গত কয়েকমাস ধরে চারপাশের লোকজন আর পরিবেশটা খুব বদলে গেছে। আমি খেয়াল করেছি যে দুপুরের সেই রিকশার আওয়াজগুলো কমে গেছে। বরং মোটর সাইকেলের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সামনে নির্বাচন আসছে বলে মুশকো মুশকো গুণ্ডা চেহারার লোকজন সেই মোটর সাইকেল দাবড়ে বেড়ায় সারা শহর জুড়ে। সেদিন তো কলেজ থেকে ফেরার পথে আমার প্রায় গায়ের উপরই উঠিয়ে দিয়েছিল। আমি জোরে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলাম। দেখি পেছনে বসা লোকটা কটমট চোখে আমাকেই দেখছে। দাদাও একদিন বলছিল তাদের এনজিও-তে কী জানি গোলমাল বেঁধেছে। দাদা একটা এনজিওর ফিল্ড অর্গানাইজার। মাঠপর্যায়ের লোকদের একত্রিত করে। তাদের ওখানে ওরা নির্বাচনের ভোট আর চাঁদা চাইতে হাজির হয়েছিল। বেশ উত্তপ্ত অবস্থা। মা ভয় পেয়ে দাদাকে নিষেধ করলো এসবে না জড়াতে।
কয়েকদিন পরই নির্বাচন হয়ে গেল। সবাই ভেবেছিল ক’দিনের এই শোরগোল এর পরেই থেমে যাবে। আমরা আবার আগের জীবনে ফিরে যাব। রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে যে পোস্টার সাজানো রঙিন অবস্থা, তাও কয়েকদিনের মধ্যেই আটপৌরে হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যি সত্যি তা হলো না। প্রথমে চার-পাঁচ দিন তো খুব হৈ-চৈ চললো। তারপর ব্যান্ডপার্টি এনে মহাধুমধাম, স্কুলের মাঠে রাতভর গানবাজনা হলো।


এর কিছুদিন পরে এক বিকেলবেলা। আমি বেরোচ্ছিলাম বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। এমন সময় কয়েকজন লোক লোহার গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। চার – পাঁচজনের মধ্যে সেই কটমট করে চেয়ে থাকা লোকটাকেও দেখলাম। একজন বললো, “রমাপদ বাবু আছেন? একটু কথা বলব।’’ আমি তাদের বারান্দায় বসতে বলে ভেতরে বাবাকে ডাকতে গেলাম। এর মাঝে দেখি দাদা বেরিয়ে এসেছে। বলল, “বাবা ঘুমুচ্ছে। আপনারা আমাকে বলুন। কী ব্যাপার?”


কটমটে চেহারার লোকটা বলল, “উনি হইলে ভালো হইতো। যাউকগা, আপনে বড় পোলা? আইচ্ছা, দেহেন, ইলেকশানে আমাগো পার্টি জিতেছে। আমরা হেভি খুশি। আপনেরাও খুশি। এই খুশির জন্য আমরা কয়দিন আমোদ ফুত্তি করুম। তাই চান্দা চাইতে আইছি। না করবেন না ভাই। আর হ, এই চান্দা মাসে মাসেই দিবার লাগবো, বুঝছেন নি?”


দাদা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, কিন্তু লোকটার কথা শেষ হলেই বেশ জোরে বলে উঠল, “আমরা এতদিন এখানে আছি। কখনো এসব কাজে কাউকে চাঁদা দেই নাই। আপনাদেরও দিব না। আপনারা আসতে পারেন।” এই ফাঁকে একজন ঐ কটমটে লোকটার কানে কানে কী যেন বললো। শুনে লোকটা বলল, “আইচ্ছা, আপনেই তাইলে এনজিউর সেই পাবলিক। সেইদিন তো খুব ফাল পাড়তাছিলেন! অহন তাইলে ডাবল চান্দা দিবেন। দেন, তাড়াতাড়ি দশ – পনরো হাজার যা আছে বাড়িতে বাইর করেন।”


দাদা পুরো হতবাক হয়ে বলল, “আরে, এ দেখি রীতিমতো ছিনতাই! মগের মুল্লুক নাকি? পেয়েছেন কী? বেরোন। বাড়িতে এসে হুজ্জোত করছেন।”
এর মাঝে শোরগোল শুনে বেশ লোক জমে গেছে। সবাইকে জড়ো হতে দেখে দাদা জোর পেয়ে গেলো। বলতে গেলে একরকম ঠেলেই লোকগুলোকে বের করে দিলো। যাবার আগে অবশ্য তারা বলে গেল দেখে নিবে। কীভাবে দেখবে সেটা নিয়ে আমি বা দাদা বা ওখানকার অন্য কেউই তখন খুব একটা ভেবে দেখলাম না।


পরেরদিন দুপুরে আমি কলেজ থেকে ফিরছি। ফেরার পথে নৃত্য স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা একসাথে ফিরি। আমি স্কুলগেটে যাওয়া মাত্রই দারোয়ান দৌড়ে এলো – “ভাইজান, আপামুনিরে একটা মাইক্রোতে ধইরা নিয়া গেছেগা...” – বলে লোকটা হাউমাউ করে আরো কী কী সব বলতে লাগল। আমার মাথায় আর কিছু ঢুকছিল না। মনে হচ্ছে কেউ কানের মধ্যে উত্তপ্ত গলিত সীসা ঢেলে দিয়েছে। আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দুপুরের তীব্র, প্রচণ্ড রোদ চারিদিকে ঠা ঠা করে হাসছে। আমি বাসায় দৌড় দিলাম। পৌঁছে দেখি মা ছাড়া কেউ নাই। দাদা, বাবা দুজনেই অফিসে। আমি মাকে কিছু না বলেই দৌড়ে বের হয়ে এলাম। দাদাকে দরকার, খুব দরকার। আমি অপেক্ষা না করে ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম দাদার এনজিও অফিসটার দিকে। দুপাশের দোকানপাট, গাছপালা সব কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমি দৌড়াতেই থাকলাম, দৌড়াতেই থাকলাম, দৌড়াতেই থাকলাম।




************************************************


পুনশ্চঃ এখন অনেক রাত। কালকের মধ্যেই জমা দিতে হবে... । শেষ করে দেই... । এরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দেখি গল্পটা আমি শেষ করে ফেলেছি। প্রায় দু’বছর আগের কথা। মানুষ আসলে ভুলে যায়, সব কিছু ভুলে যায়। একটা হিন্দু মেয়েকে এভাবেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ তার বড়ভাই লোকগুলোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। তিনদিন পর মেয়েটা ফেরত এসেছিল। তারপর সে আর বেশিক্ষণ বাঁচেনি। বাসার স্টোররুমের ইঁদুর মারা বিষটাই তার শেষ ভরসা হলো। আমি গল্পে মেয়েটাকে মারতে পারলাম না। বারবার আমার ছোটবোনের চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখে। মেয়েটাকে আমি কিভাবে মারি?


(সমাপ্ত)