বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার



ছাইদানির মানচিত্রে খয়েরিদাগেরা বলে তুমি সেখানে শুয়েছিলে পরতে পরতে
তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার


বিছানায় ফিরে যাবার সময়ে তোমার চোখেও কয়েকটি মৃত্যু জমে থাকে
তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার


সেখানে বিষন্ন বালিশ কেঁদেছিল তিনযুগ জেগে থাকা বিনিদ্রতায়
শীত রাতের কুয়াশা শাল গায়ে খুব মোলায়েম ব'সা ছিল রোদে


সূর্যে আগুন ধরে গেলে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো
বই-মলাটের ভাঁজে ভাঁজে তখনও জেগে থাকে অলস জন্ম-কোষ


তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার




***


[উইলকো'র একটি গান শুনে...]

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

ইন্টারভিউয়ের টেবিলের ওপাশে আমি

"'আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন - কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;-"
এরকমই লিখেছিলেন জীবনবাবু
কলম-নিবের প্যাঁচানো কালো কালো সাপ
সর্পিল ধমনীপথেই সর্‌সর্‌ নেমে গেছিলো।


আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকিনি ব'লে
জানতে পারিনি কতটা ছোবল কতটা অভিশাপ
মেখেছিল জীবনবাবু'র আস্তিন।


এখন এখানেও শীতঘুম-ভাঙা
প্রকাণ্ড বুভুক্ষু সাপ! তিনটা! চারটা! শতশত!
রোমরন্ধ্র ছিড়ে খুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে মাংসে...


আমি নীলবিষের পুলকানন্দ কুড়িয়ে নিতে থাকি
(এবং এহেন গ্রহণে কোনও লজ্জা লাগে না আমার!)
তাই বলে প্রথাগত প্রাচীন সর্পদল মাথা হেলে
আমার বেশর্‌ম নগ্নত্বকে মানচিত্র উল্কি এঁকে দিতে কুণ্ঠাও করে না।


| | তাঁদের চোখে জীবনবাবু অনেক ভালো লোক ছিলেন | |
আহারে! লোকটা অযথা অসময়ে অকালে
তাঁদের বেকার শীতঘুমে পাঠিয়েই মারা গেলেন?


বিশেষণ-ক্লান্ত সাপ, শেষে, মাথা নেড়ে
পরবর্তী রিফ্লেক্সে সটান ছোবল হানে
করোটির ঠিক জ্যা-বরাবর মাঝখানে
ফুঁসে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে বলে,
তুমি একটা চূড়ান্তরকম ফাউল্‌!

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

পুরোনো জন্ম এবং নতুন মৃত্যু


প্রথম খণ্ড


গাড়ীটা চলছিল অনেক জোরে। জানালা খোলা। আমি অনেকদিন চুল কাটাইনি। তুমুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল বারবার। আমি ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম না। আমার চোখ ঢেকে যাচ্ছিল ঝাপ্টায়, বার বার!


আমরা দুই ভাই এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে যাচ্ছি। ড্রাইভিং সীটে আমার খালাতো ভাই। বিস্রস্ত মুখে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বিপজ্জনকভাবে কয়েকটা গাড়িকে এদিক ওদিক করে পাশ কাটালো।


"আস্তে!" "সামলায়ে চালা!"- আমি একটু সচকিত হই!


"আর শালার বাইঞ্চোৎ দুনিয়া!" "আস্তে চালায়া কী লাভ?" - আরো কয়েকটা কুৎসিত জন্মসংক্রান্ত গালি বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে।


দ্রুত মোড় ঘুরে আমরা আরেকটা রাস্তায় ঢুকে পড়ি। ফাঁকা রাস্তা- ঘড়িতে কোয়ার্টজ বলছে দশটা বেয়াল্লিশ।


"বাড়ি চল! আর কত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি?"- আমার স্বরে হতাশা আর ক্লান্তি ঝরে পড়ে। শেষ কিছু সময় ধরে আমরা এখানে ঘুরছি। প্রায় ফাঁকা রাস্তাগুলোয় গাড়ির গ্যাস পুড়িয়ে চর্কির মতো, আর ওর মাথার ভেতর যেভাবে হিরোশিমা ভেঙে পড়ছে সেটা বুঝতে পেরে আমি থমকে থাকি! এখানে আমার কিছু বলার নাই।


দ্রুত ছায়াবাজি সামলে একটা বিকট ট্রাকের হর্ণ এবং ফ্ল্যাশলাইট আমাদের ঝলসে দেয়ার সাথে সাথেই ঘটাং করে ব্রেকহুইলটা ভেঙে গেল। ওর মুখ একচিলতে হাসি ঝিকিয়ে উঠল আর আমি দেখলাম বুলেট-মোশনে আমরা গাড়িসমেত আইল্যাণ্ডে আছড়ে পড়লাম। জ্ঞান হারানোর আগে তূর্য কাতর কণ্ঠে হেসে দিল না কঁকিয়ে উঠল সেটা আমি টের পাইনি।


---- ---- ---- ---- 


দ্বিতীয় খণ্ড


স্বচ্ছ গ্লাসে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ভেতরে জমানো আইসক্রিম একটু একটু গলনের সূত্র মাপছে। টুং করে গ্লাসের গায়ে একটা টোকা দিল সুমাইয়া। দুয়েকফোঁটা পানি তার নখাগ্র ছুঁয়ে নেমে আসছিল। আলতো ঝাঁকিতে তারা নিচে রাখা টিস্যুতে আশ্রয় নিল। টিস্যুমাতার কোল ছাপিয়ে বিন্দুদ্বয় ব্যাপিত- অভিস্রবিত! সুমাইয়া নখ ঘষে মুছে নিতে নিতে দু'ঠোঁটে টেনে নিলো স্ট্র! ঘোলাটে স্ট্রয়ের ভেতর দিয়ে চকোলেট উঠছে ক্রমশ!


ঘড়িতে সময় দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। সুমাইয়ার গায়ে শীতল শীতাতপ একটা পরশ বুলিয়ে দিলে সে একটু কেঁপে ওঠে কি? পাশে রাইয়ান বসে ছিল। আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে সে সুমাইয়াকে। তপ্ততার সূত্র তখন খেলতে শুরু করে। ইতস্তত বিক্ষেপ অভিক্ষেপ এপাশ ওপাশে দোলনাক্রান্ত-শৈশব বিস্মৃত হয়। সুমাইয়াও উষ্ণ হতে চায়!


তিনমিনিট পরে আবছা জ্ঞান ফিরলে তূর্যও উষ্ণ রক্তপাত টের পায়। আস্তিন ছাপিয়ে রক্ত ছুটছে ট্রাউজার ছাপিয়ে গরম স্রোত নামছে। সম্বিত ফিরে পেতেই পাশ ফিরে আমাকে দেখল ও। আমার পা দুটো দুমড়ে বেঁকিয়ে উপরের দিকে উঠে এসেছে পেটের কাছাকাছি। মুখ ঈষৎ হা। হাত দুটো সরানো। বুক জুড়ে চাপ চাপ রক্ত। গাড়ির উইন্ডশীল্ডের ফাটলে বিকিরিত হয় দূরান্তগামী হেডলাইট।


রক্তে যেন প্লাবন বইছে সুমাইয়ারাইয়ানের। তারা মিশে যেতে থাকলে সে টের পায় প্লাবন নামছে দুই পা জুড়ে। তূর্যের শরীরেও রক্ত বইছে। আমি দর্শক হয়ে যেতে যেতে টের পাচ্ছি তূর্য ঠা ঠা করে হেসে দিচ্ছে। সুমাইয়ার চাপা শীৎকারের সাথে ওর গোঙানি মিশে যাচ্ছে হাইওয়েতে।


---- ---- ---- ---- 


তৃতীয় খণ্ড


সাদা আলোর বেশ কিছু প্রকার আছে। হলুদাভ, নীলাভ অনেকগুলো শেডে সাদারঙ মেলে রাখা যায়। এখন যেমন নীলচে সাদা আলো জ্বলে আছে এখানে। দেয়ালের টাইলসগুলোকেও সেই আলোতে নীল মনে হচ্ছে। ফ্রস্টেড গ্লাস বন্ধ। শীতাতপের ঘন বিজবিজে শব্দের সাথে সহচর শব্দ হচ্ছে আরেকটাঃ পর্যায়বৃত্তিক বিপ্‌-বিপ্‌-বিপ্‌... । সেসময়ে দস্তানাবৃত অপরিচিত দু'হাত তূর্যের বাদামী জীবাণুনাশক মাখানো লোমহীন-ত্বকহীন পা থেকে পায়ের টিস্যুগুলো কেটে ফেলছিল। তীব্র সাদা আলোটাও সেখানে হা করে রাখা হাড়মাংসের পাশে ছটফট করছিল। 


কালো হয়ে যাওয়া মরা টিস্যুগুলোকে ডাক্তারের কেটে ফেলা খচাখচ- সে দেখতে পারছিল না, কারণ চোখে সাদা গজ্‌ খুব শক্ত করে আঁটা। নাকেমুখে কয়েকগণ্ডা নল, অ্যানেস্থেটিকে ফুসফুস আর মস্তিষ্ক ভরা। ঘি'রঙা-দস্তানাতে রক্ত মিশতে থাকে, যেভাবে সুমাইয়ার ফর্শা উরুতে রক্ত মিশছিল। তূর্যের শরীরে ছোপ ছোপ শ্লেষা মিশেছিল তখনও! চিল-চিৎকার দিয়ে সে পৃথিবীকে জানাচ্ছিল তার ইশতেহার। ক্ষুদ্র হাত-পা অব্যবহৃত চলনে তৎপর! সুমাইয়া ক্লান্ত হেসে দিচ্ছিল। রাইয়ানের ঢেকে রাখা মুখে শুধু চোখের ঝিলিক দেখে সে বুঝে নিচ্ছিল যে তার সন্তান ঠিকঠাক জন্মেছে। 


এখানে দস্তানা-সমূহ তূর্যের পা ড্রেসিং করে দিতে ব্যস্ত। আরও দু'দিন পরে তার শরীর জুড়ে লেন্সবাচক-চোখ স্থির হলে শিশু-তূর্য আর তরুণ-তূর্য ফ্রেমজুড়ে মাখামাখি হয়ে যায়। 


কেন্দ্রে শুধু সুমাইয়ার হাসিটুকু অমলিন চেয়ে থাকে। 


---- ---- ---- ----
(সমাপ্ত)

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০০৮

সেলাই#২

ফোরসেপ হাতে তুমি আমাকে কাটছিলে চারবার এদিক ওদিক কৌণিক পোচে ভূখণ্ড কেটে ফেলে জোড়াতালি কাঁটাতার মেখে সেখানে চড়ুইয়ের ঘর বসানো বাড়ি থেকে সূর্যরশ্মি তীর্যক উড়ে এসেছিল। তোমার নখের ভেতর চুলের ভেতর মরাত্বকের ভেতর জন্মজ ডাক ছেড়ে কাঁদা ত্রিরাত্রবয়সী বালিকা আমার কানে চিৎকার পৌঁছে দিল বলে ধাতব টিনের বিছানায় উপুড়মুখী শুয়ে থাকা তোমাকে দেখে আমিও পাশে নগ্ন-উন্মুল ঊর্ধ্বাকাশ মাপি আর ফাটল ফাটল বেছে ফেলি উকুনের গুষ্টি বাছার মতোন। অ্যামোনিয়াগন্ধ সেসময়ে মাঝখানে অভিলম্ব ধরে ঝুলে থাকা শিরদাঁড়ায় জমে যাচ্ছিল।

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

স্মৃতিভ্রষ্টতার উল্টোযাত্রা

এটাই প্রারম্ভের অন্ত অথবা অন্তিমের আরম্ভঃ এরকম ঘোষণায় সচকিত হয় রোমকূপ। সামনে জীবন নাই, আশা নাই, সুর নাই, নারী নাই। নেশা নাই, কবিতা নাই, তোমার দুচোখ নাই। তার থেকেও তীব্রশরীর, স্তন আর নাভিমূল নাই, তোমার মধুকূপী বাহু নাই, রীডসুলভ আঙুল নাই। প্রথাগত শূন্যতার চাইতেও বেশি কিছু, অনেক কিছু জীবন ছাড়িয়ে যার ছায়া পড়তে পারে, আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। সংখ্যারেখার প্রমাণবিন্দু হারিয়ে গেলে খুব বিপন্ন লাগে। যেমন বিপন্ন লাগে সময়-ঘড়ি হারালে। যেমন বিপন্ন লাগে মাংস স্বাদের গন্ধ হারালে।


আরম্ভ হলেই শেষ হবে, জানা কথা। তাহলে কোন কিছু শুরু করতে আমি এতো উদযাপন করি কেন? উদ্বোধনের প্রগলভ উচ্ছ্বাসে আমি সময় অপচয় করি, অর্থ আর শ্রম ব্যয় করি, যদিও জানি সামনে এরকম কিছু নাই- কিছু থাকবে না। এই ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার মতো অমোঘ নিয়তিতে সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে আর আমার খেলার মাঠ জুড়ে বিষন্ন কাক বসে র'বে।


চিকন কণ্ঠে তুমি গাইছো। একটু কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে গলা। ওটা পেরিয়ে যাই আমি, ও কিছু না। গানটা সুন্দর লাগছে, কান দিয়ে ঢুকে বুকে পৌঁছে যাচ্ছে। আপাত নির্বাক আমি একটু আগে বলছিলাম, একটা গান শোনাও না। তুমি লাজুক হাসছিলে, ধুর! আমি গান পারি নাকি? আমি বললাম, খুব পারো। গাও, আমি শুনবো। তুমি শুরু করতেই আমি জড় হই, স্থির হই। কাঁপনগুলো থেমে আসে। বোধসমূহ তাবৎ জামাকাপড় সাজসজ্জা খুলে ঘুমুতে যায় আলো নিভিয়ে।


অনেকক্ষণ পরে, কখন আমার খেয়াল নেই, তোমার গান হয়তো অনেক আগেই থেমে গেছে। গান থামিয়ে তুমি আমাকেই দেখছিলে হয়তো। আমি সম্বিত ফিরে পাওয়ায়, সেটা হারানোর লজ্জায় বিব্রত হই। ভালোবাসা প্রকাশিত হলে লাজুক লাগে মনে হয়! আমি শশব্যস্ত হয়ে ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে চেষ্টা করি। কী আশ্চর্য! এই নিশুতিতে ঘুঘু কোত্থেকে আসবে? "ঘুঊঊঊ ...ঘুঊঊঊ ..." আমি চমকে তাল সামলে বুঝতে পারি কোথাও আসলেই ঘুঘু ডাকছে। গভীর বিষন্ন সুরে ডাকছে। সেই ডাকের পশ্চাতে একটা বিমর্ষ হাহাকার জেগে উঠতে থাকে। দূরত্ব বাড়লে আমাদের প্রিয় মুখের উত্তাপ কি ধীরে ধীরে কমতে থাকে? আমরা কি স্মৃতি প্রখর নই? কেনইবা আমাদের প্রতিদিন দেখা লাগে, ছোঁয়া লাগে, খুঁজে নেয়া লাগে প্রাণান্ত-আত্মাদের!


গায়ের গন্ধ খুব মাতাল করে দিতে পারে। নাসা ফুলিয়ে ফুলিয়ে আমি যে সুবাস পাই তা নিউরণে ঢুকে কী প্রলাপ শুরু করে দিতেছে, আমার স্রোতবহা রক্তে নাচন ধরিয়ে দিচ্ছে! সেখানে কণিকার ভাঁজে ভাঁজে রূপায়িত ঘুঙুর বেঁধে ঝুন ঝুন, রুন ঝুন করে তোমার ত্বক-সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি গাঢ় হয়ে আসি, ঘন আর নিবিড় করে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। তাপ পরিবাহে আটানব্বুই ডিগ্রীর তীব্রতার আঁচে আমরা জড়লাল হয়ে উঠি! দূরত্ব কমে গেলে তোমার বুকের ভাঁজে একটা নরম তিল জন্মে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি দূরে যেতে চাই না। আমি চোখের আড়ালে যেতে চাই না। ইন্দ্রিয়-বিপন্ন হয়ে আমি খুঁড়ে খুঁড়ে গোপন বিষন্নতাগুলো লুকিয়ে রাখতে চাই।


তুমি সেকথা জানো। খুব ভালো করেই জানো বলেই হেসে দাও খিল খিল করে। চুলের শীর্ষমুখী কাঁপন থেকে থরে থরে মুক্তার মতো হাসি ঝরে পড়তে থাকে। আমি তোমার সাথে নিবিড় হয়েও বিস্তারী-অস্থিরতা লুকাতে পারি না।


-"মাত্র তো একটা সপ্তাহ!"
-"মাত্র?"
-"আহা! তুমি অবুঝ হলে আমি কোথায় যাই?"
-"কোথাও যাওয়া লাগবে না। থাকো।"
-"আমার দায় তুমি বুঝো না? দিনগুলোকে কঠিন করে দিও না।"
-"কেন নয়? আমি কীভাবে থাকবো অনুভব করো তুমি!"
-"করছি বলেই, করবো বলেই তো ফিরে আসবো!"
-"কবে?"
-"এই তো, সাত দিন। কষ্টে কাটবে দিনগুলো!"


আমি ম্রিয়মাণ ক্ষোভে সরে যেতে থাকি দূরবর্তী বাতিঘরের মতো। ছলাৎ শব্দে পাড়ভাঙা বিষাদ এলোমেলো বয়ে যেতে থাকে তথৈবচ উদ্দেশ্যহীন। শরীর শীতার্ত আগ্রহে স্বেদকণা শুকিয়ে নোনাদাগ ধরে রাখে। আজ মনে হয় তিন দিন-তিন রাত হলো, আমি দেখি নাই তোমাকে। অবসর মুহূর্তের ক্লান্তি জ্যাকেটের বোতামে লেগে থাকে। যেমন অনেক সময় বাতি নেভানোর পরেও আলোর রেশ চোখে লেগে থাকে। বাইরে কুয়াশা ছিটকে দেউড়ি পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। আবছায়া আলোতে দেখি ছেঁড়া পৃষ্ঠার মতো হালকা দোলনে শিশিরকণারা দুধসাদা বিছানায় শুয়ে পড়ছে। আমি ধীরপায়ে তাদের সরিয়ে গুটিসুঁটি মেরে শুয়ে থাকি জামাকাপড় না ছেড়েই। গ্রাফাইট কণার গন্ধ জড়িয়ে থাকে লিনেনের প্রান্তে। ঘুম এসে ভেঙে ভেঙে যায় এই বিভ্রমে যে আমি চলন্ত ট্রেনে আছি, যেটাতে করে রোজ ফিরি। আমার উল্টোদিকে ব'সে থাকা ভাবলেশহীন মুখব্যক্তি চোখ মেলে দেখেই আমি চমকে উঠি। লোহার হাতলের স্পর্শও আমাকে শিহরিত করে। ট্রেনেই আছি তাহলে! শাটলের মতো দ্রুততায় তুমি সরে সরে যাও। আমি দুঃস্বপ্নের ছোবল ভেঙে জেগে উঠি। গলা শুকিয়ে কাঠ! অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে সিঙ্ক পর্যন্ত গিয়ে পানি খাই ঢকঢক করে। রেখে দেয়ার সময়ে গ্লাস বড়ো শব্দ করে টাইল্‌সে!


আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আর কখনোই দেখা হবে না আমার। যেদিন শেষ দেখেছি সেটাই তোমার আমার শেষ দেখা ছিল। ফ্ল্যাশের আলোতে চোখ ঝলসে গেলে তারাবাজি হচ্ছিল চোখে, ফুটি ফুটি তারা জ্বলে নিভে উঠছিল। সয়ে নিতে নিতে তুমি হেসে নির্বাক ফটোফ্রেম হয়ে গেলে। দ্বিমাত্রিক তলের নিষ্ঠুরতায় তাকিয়ে আছো! ঈষৎ হেলানো তোমার মাথা। চুলগুলোও ঢেউ খেলিয়ে সরে আছে। ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ধরে আছো। আর চোখের তারায় দুষ্টুমি। আমি ক্যামেরার ফ্ল্যাশের সাথে বিন্দু বিন্দু তোমাকে বেঁধে নিয়েছিলাম।


পীতাভ ঝলকে তুমি আটকে আছো তেইশে। তেইশ পেরিয়ে আমি অনেকদূর চলে গেছি। দূরত্ব বাড়লেও টান কমে না কেন? নাকি কমে যায়? জ্যামিতি ভালো বুঝি না বলে ক্লাশের স্যারেরা খুব বকতো। মারও খেয়েছি কম না। তারপরেও আমি কিছুতেই দুই বিন্দুর দূরত্ব বের করতে পারতাম না। বারবার ভুল হয়ে যেত। আরও কতো কতো ভুল হয় আমার! হিসেবে ভুল, সময়ে ভুল, স্মৃতিতে ভুল। এখানে জলজ চোখ ছেড়ে তুমি শুষ্ক হয়ে গেছো- জানার পরেও আমি প্রক্রিয়াজাত করতে পারি না। ক্রমশই আমার মনে হতে থাকে,"এই তো, সাত দিন। কষ্টে কাটবে দিনগুলো।" বলে তুমি উঠে গেছো। তোমার শরীরগন্ধী উষ্ণতা এখনও পড়ে আছে এখানে কয়েকবিন্দু। আমি দু'হাতে সেগুলো কুড়িয়ে মুঠোবন্ধ করতে থাকি। করতলে তখনও ঘুঘুর ধুকপুকানি শোনা যায়!

সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

শীতঃ জন্মশোক পর্ব

অরূপাক্ষ ছেড়ে শহরকামী আমি
বহুদিন;
হলুদ ধূলোর মতো কুয়াশা আমার জন্যে
অনেকটা পথ পদছাপ খুঁজে এসেছিলো,
জড়ানো বিষাদ ফেলে।


ফর্সা আলো ছিঁড়ে এসে আমি
মিহি আঁধার খুঁজে পেতে থাকি।


নিচে কালো-পাথর রাজপথ রেখে
চতুর্ধা চিহ্নশাখায় অকস্মাৎ
গাড়িহীন নৈঃশব্দ্যে
বিপন্ন ঝুলন্ত লাল ট্র্যাফিক সিগন্যালে
পুরোনো ধূলো-কুয়াশা কিছু-
দেখতে পাই।


বিভ্রম ভেবে মুখ ফেরালেই
কাঁধের ওপরে এক বাক্স সূর্য
হেসে দেয়।

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৮

দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং!!

রাত নামলে নিশাচর সকল প্রাণিদের মাঝে একটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। যেমন করে দিবাচর প্রাণিরা সকালে সূর্যকে মানে, উনি উঠে গেলেই তারা বিছানা-বালিশ ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপরে বিমূঢ় ত্বকে পানি ঝাপটা দিয়ে জেগে ওঠে। জেগে ওঠার ক্ষণ থেকেই তাদের বোধসমূহ সজাগ হতে থাকে। শৌচ শেষ করে নাশতার পরে ধূমায়িত চা খেতে খেতে সকল পাপ ঘাড়ে নিয়ে জাগতিক বোধেরা ফিরে আসে।


সেরকম ভাবে নিশ্চয়ই নিশাচর প্রাণিরা জেগে ওঠে। সূর্য ডোবার সাথে চাঁদের সময়কাল মিলে না অনেক সময়। রাত আসে যখন, সন্ধ্যা ফুরানোর পরে, প্যালেট থেকে আরো একপোঁচ গাঢ় অবাস্তব বিমর্ষ আঁধার চারপাশে বুলিয়ে দিলে, রাত নেমেছে নিশ্চিত হওয়ার পরে তারা জেগে ওঠেন। তাদের জেগে ওঠা দিবাচরদের মতো এতো সশব্দ হয় না। অনেকটা সরীসৃপের মতো নিস্তব্ধতায় একটা সাড়া পড়ে যায়। একটু পরে, টের পাওয়া যায়, নগরের জনপদ ছাপিয়ে, রাস্তার জ্বলজ্বলে চৌকস গাড়ি-হেডলাইট মাড়িয়েও নিশাচরেরা জেগে উঠতে থাকেন।


রাত বাড়তে শুরু করলে নিশাচরদের প্রাত্যহিক আলাপ শুরু হয়। তাদের আলাপে দিবাচরদের মতো সরলীকরণ থাকে না। সকালের মানুষেরা যেমন সরাসরি কথা বলে, সরাসরি হাসে, কাঁদে, ঝগড়া করে, নিশাচরেরা তেমন করতে পারেন না। রাতে আলোকিত করার মাধ্যমগুলো হয় ঝাপসা নাহয় অতি উজ্জ্বল। নিশাচরদের চোখ তাতে পুরোপুরি কখনোই মানিয়ে নিতে পারে না। ক্রমশ অভিযোজনের চেষ্টায় রত চোখে সবকিছু ঠিকঠাক ঠাহর করা যায় না। বৈদ্যুতিক আলো সেকেণ্ডে পঞ্চাশবার জ্বলে ওঠে আর নিভে যায়। এতো দ্রুততার সাথে কাজ করলেও নিশাচরদের চোখে এই আলোর অনবরত ওঠানামায় একটা ঢেউমূলক সরণ ঘটে। চোখের বাইরে সবকিছুকে তারা কর্ণিয়ায় গেঁথে নিতে পারে না। আর যেখানে বৈদ্যুতিক আলোরহিত, সেখানে তারা আধোঅন্ধকারে ঠাহর করতে শুরু করে। দেখার ক্রিয়াটার সাথে ঠাহর মিশলে একটা তেলজল মিশ্রণ তৈরি হয়। প্রতারক স্মৃতি তাদেরকে ভ্রষ্ট করে।


এহেন পরিস্থিতিতে নিশাচরদের কথা জড়ানোকুটিল বহুবিধ মাথাওয়ালা হয়ে ওঠে। কথার লেজের মুখও খোলা থাকে অনেকগুলো। র‌্যাটলস্নেকের জান্তব সর্‌সর্‌ শব্দ করে লেজের ছিন্নমাথাগুলো নড়ে চড়ে শূন্যে। অন্য নিশাচরেরা সেকথার লেজে পাড়া দিয়ে কখনো কখনো নতুন কথা বাঁধে শক্ত গিঁট দিয়ে।


তারপরে দিবাচরদের ঘুমানোর সময় আসে। তারা খেয়ে দেয়ে মশারি টাঙায়, দাঁত ব্রাশ করে, একটু টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়। তারপরে হাই তুলতে থাকে। একটা সময়ে কাঁথাচাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। তখন নিশাচরেরা হেসে হেসে দিবাচরদের ঘুমিয়ে পড়া দেখে। শিশুদের ঘুম দেখে যেমন করে নব্যপিতামাতারা স্নেহের হাসি হাসেন, সেরকম একটুকরো হাসি ক্ষয়াজ্যোৎস্নার মতোন তাদের চোয়ালে লটকে থাকে। এইরকম জীবন তারা কবে কতো আগে কয়েকমৃত্যু আগে ছেড়ে এসেছে! কয়েকজীবন পরের একজোড়া নিশাচর-চোখে তারা চেয়ে থাকে।


তারও কিছু পরে ওদের ভুলে তারা আবার কথার গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগে বাঁধা কথার সুতোরা অনেকসময়ে হারিয়ে যায়। নিশাচরেরা তাতে খুব একটা উদ্বিগ্ন হয় না। রাতে চলাচল কম হয় প্রাণিদের, এরকম বহুমাথা আর সর্পলেজী কথার সুতোয় অন্যকেউ ভুলেও পা মাড়াবে না। পথের পাশে পড়ে রইলেও বাকিরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যাবে। তাই হারানো কথামালা নিয়ে ব্যস্ত হয় না এরা। বরং দেখা যায় নতুন কথার প্রতি তাদের অনেক মনোযোগ, অখণ্ড মনোযোগ।


আরো কিছু পরে নিশাচরদের মাঝে কেউ একজন জোরে শব্দ করে হেসে ওঠেন। শব্দের তীব্র সাইরেন ঠাশ ঠাশ করে দেয়াল ভেঙে দেয়, রেলিঙে হেলান দিয়ে রাখা চৌকি বা কাঠের স্তুপগুলো প্রতিধ্বনির মতো গুড়িয়ে পড়তে থাকে। রেজোনেন্সের মতো শব্দের ঢেউ অনুনাদ-চূড়া-খাদ মাড়িয়ে আসতেই থাকে, আসতেই থাকে। কোনও কোনও দিবাচরের ঘুম সেই শব্দে ভেঙে যায়। তারা চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠে পানি খায়, বুকে মাথায় ঝাপটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে মশারির পেটে।


নিশাচরদের দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি ঘুম-চটে-চেয়ে-থাকা দিবাচর-চোখদের থাকে না। এটা অনেক আগে থেকেই জানে নিশাচরেরা। এজন্যে তাদের হাসির শব্দের অনুরণন চলতেই থাকে। প্রস্তর-গড়া-জনপদ-বস্তির চল্‌টা-ওঠা রাস্তায় সেই হাসিগুলো কথাগুলো মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে। উপরে বিবিক্ত আকাশে এ-ক-ফোঁ-টা আলোও বাকি থাকে না। রাত কতটা গভীর হলো বুঝে উঠতে কোনও এক নিশাচর মুখ তোলে। অন্য-অনেক সর্পিলেরা তাকে নিশ্চিন্ত করেঃ "আরে! দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং!"



বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৮

উৎসব কোলাজ

করতল থেকে মুখ মুছে যায় রেখা মুছে যায়
জ্বলজ্বলে মার্বেল ভাস্কর্য হয়ে শরীর ছাপিয়ে উঁচুতে-
আরও উঁচুতে উঠে যায়, এহেন বিদারী-চিৎকার
আটশতেক বিল্ডিঙ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক!


রঙহীন ক্যানভাস থেকে নেমে দুয়েকফোঁটা বিষাদ-
রিয়ার-ভিউ মিররে চল-ছবি হয়ে যায় ইচ্ছে অবাধ-


প্যালেটে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া শীতঋতু জেগে
মালসায় মাখে ভাপ মাতামহীর বলিরেখা ছেড়ে
আছড়ে পড়া ঘাসজমিনে মেলে রাখা নিবিড় উৎসব
ঘূর্ণায়মান লাটিমে জড়ো হয় তুমুল বান্ধব!


এখানে জীবন মৃত্যু সকাল সন্ধ্যা নাই, নাই,
অবিচল নিশ্চুপ ছায়াহীন সময় স্থির
সূর্যনির্ভর সময় মাপতে আমার অনাগ্রহ যারপরনাই
এখানে ওখানে ছায়া সরে যায়; ধারণা পাই
সমান্তরালে বিশ্বে তখন সকলে করেছে ভীড়।


রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

সুপারভাইজার ও অনন্যার চোখ


সুপারভাইজার


সুপ্রিয় যাত্রীবৃন্দ, আপনাদের শুভেচ্ছা!
এখানে সোহাগ ভলভো সার্ভিসে আমাদের পথচলায়
আমি মোকাদ্দেস আলি, আপনাদের সাথেই আছি
এখানে আপনাদের দেয়া হবে একটি হেডফোন
সাথে কুকি-বিস্কুট এবং পানীয়
সেগুলো পেয়ে আপনারা বিগলিত হবেন
এবং ভাববেন, "এযাত্রায় খুব দাঁও মেরে দিলুম!"




অনন্যার চোখ


...ক্রমশ কীটচলনের ফলে আমার মাথার ভিতরে নাগাসাকি ঝরে পড়তে থাকে বলে আমি চোখ মেলে নির্লিপ্ত মনিটরে ফোটন খুঁজি, পিক্সেল ভেঙে ভেঙে দুইশছাপ্পান্ন রং ঢুকে পড়ে ইন্দ্রিয়পথে; সেখানে তাদের ইগলু-ঘরের পাশে রোম রোম পেতে ধূসর জর্নাল পৃষ্ঠা উন্মোচনের গাঢ়বিষাদের আয়নার ওপাশে অনন্যার চোখে ঝিলিক বুলায়। রুঝ মুছে গেলো কিনা বুঝে ওঠার জন্যে অনন্যা একবার তাকিয়েছিল পারদলেপা তলে, সেজন্যেই ফ্রেমের মাঝখানে তার গোলাপি ঠোঁট তিরতিরিয়ে গোপন কথাগুলো বলে ফেলে অকপটে। খানিকপরের বিকশিত চর্চিত লালাভ শরীর আমার মনিটর পেরিয়ে এলে আমি কপাট বন্ধ করে দিই...

শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

~যাত্রাপথে~মাত্রাছাড়া~কথার্মালা~


রাস্তারপাশে নীল নীল সাদা আলো কিছু কিছু
জ্বলে ছিল নিভে নিভে ছিল জ্বলে
পেরিয়ে গেলেই সাঁই সাঁই টানে
এদিক ওদিক দুলতে দুলতে
সামনে পড়লো হলুদ কমলা আলোর মিছিল
জোনাক পোকার চেয়েও শীতল অথবা
উষ্ণপ্রবাহ নিয়ে
আলোরা জ্বলছে
নিভছে জ্বলছে নিভছে ডুবছে ভাসছে হাসছে
আমি দেখে দেখে চোখের পলক ফেলতে পারি না
চেয়ে থাকি দূরে নজর কেড়েছে
তা'রা জেনে গেছে মুগ্ধ বালক জীবন ফে'লে
ছুটে আসবেই মোহের টানেতে কেটে কেটে পানি
কেটে যাবে দিন রাত নেমে যাবে ধু ধু মাঠব্যাপী
সেখানে শেফালি ঝরে ঝরে ঘাস সেজে নেবে রূপ
অপরূপ তার সেই ঘাসেদের পথ ধরে আলো চুপ!


আমি দেখে দেখে অবাক বিভুঁই
হঠাৎ বুঝেছি এ হলো শুধুই
ভ্রান্তি মায়ায় জড়ানো শৈত্য
বুক থেকে নেমে হৃদকণা ছেড়ে
আমার শরীরে শীতের নৃত্য।

বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

সনদবিহীন আত্মজ


ঙ.
...শশাঙ্ক নামে একটা ছেলে জন্মেছে একটু আগে। ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ডের ঘোলাটে পর্দাঢাকা কেবিন থেকে তার চিল-চিৎকার ভেসে আসছে। ফিনাইলধোয়া ঘরে জীবাণুমুক্ত তোয়ালেতে সে জড়ানো। রোগ-জরা তাকে এখন ছুঁতে পারবে না। আরো অনেক অনেক দিন পরে সে পঙ্কিল হবে, তার আগে এখন অন্তত সে নিষ্পাপ, সরল, নির্মল আগমনের পরে কাঁদছে। শশাঙ্কের মা, একটু আগে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন চুপচাপ। মৃত্যুর একটু আগে তিনি একবার শশাঙ্ককে কোলে নিয়ে তার নরোম মাথায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলেছেন।...




ঘ.
...গত কিছুদিন ধরে শরীরটা কেমন খুলে খুলে যাচ্ছে। এমন ক্লান্ত লাগে! বসতে কষ্ট কষ্ট উঠে হাঁটতে কষ্ট। বেশি সময় একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। পা দুটোও ফুলে গেছে। আমি একটা সময়ে কী সুন্দর তন্বী ছিলাম। পাতলা ছিপছিপে ছিলো শরীরটা। এখন কেমন ভারি হয়ে গেছি। আমার ভেতরে বাবুটা নড়াচড়া করে। ও আসছে। আর ক'টাদিন পরেই। ও এলে আমি ওকে বুকে চেপে বড়ো করবো। ছেলে আসছে আমার। ওর সাথে এতদিনে কতো কতো কথা বলেছি! কীভাবে কীভাবে সময়টা চলে গেল! শশাঙ্ক! শশাঙ্ক নাম রাখবো ওর। কী সুন্দর তেজস্বী নামটা! শুনলেই রক্তের মধ্যে চিন্‌ চিন্‌ করে ওঠে। মনে হয় মৌর্যসম্রাট সাঁই সাঁই করে তরবারি ঘুরাচ্ছে আর বীরের মতো এগিয়ে আসছে!...




গ.
...আমার ভেতরে একটা বাবু জন্মাচ্ছে একটু একটু করে। আমি ওর জন্যে দিনরাত জেগে থাকি বা ঘুমিয়ে থাকি। ওর সাথে কথা বলি বা অভিমান করি। বাবুটার জন্যে আমার কেমন কেমন করে! গত পাঁচ-ছয়মাস ধরে এই বাবুটা আমার মধ্যে জন্মেছে, বড়ো হচ্ছে. আজকাল খুব দাপাদাপি করে। ফুলে ওঠা পেটের টানটান চামড়ার নিচেই শুয়ে আছে। ওর কি এখনও চোখ ফুটেছে? ও কি স্বপ্ন দেখা শিখেছে? কিসের স্বপ্ন দেখে ও? নিশ্চয়ই স্বর্গের স্বপ্ন দেখে ও। সেই স্বপ্ন দেখে মুখে হাসিও ফুটে ওঠে আমার বাবুটার।...




খ.
...এটা খুব বিরক্তিকর একটা রুটিন হয়েছে! রোজ সকালে উঠেই গা গুলানো বমি আসে। চেষ্টা করেও আটকানো যায় না। তারপরে নাশতা করার আগ পর্যন্ত মুখটা টকে থাকে। সেই স্বাদে আরো বমি হবে বলে মনে হতে থাকে। বিচ্ছিরি! সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ হয়ে থাকে। এ কেমন যন্ত্রণায় ফেঁসে গেলাম! সামনের দিনগুলোয় আরো কী কী ভোগান্তি হবে ভাবতেই শিউরে উঠছে গায়ের লোম। বাচ্চা জন্ম দেয়া কতো কষ্টের! যাদের কাছে শুনেছি সবাই বলেছে, সবাই সুযোগ পেয়ে খালি ভয় দেখায়।...




ক.
...আমি হাতে টেস্টের কাঠিটা ধরে বসে আছি। এটা কীভাবে সম্ভব! অবিশ্বাস্য লাগছে নিজের কাছেই। এভাবে তো আমি চাইনি। এভাবে করে কি হয় কোন কিছু? ভয় হচ্ছে খুব। আমি এখন কী করি! এখন কোনভাবেই বাচ্চা নেয়া যাবে না। আরো অন্তত দুইবছর। আমার ক্যারিয়ারের পুরা বারোটা বেজে যাবে। তারওপর বাচ্চা মানুষ করবে কে? কাজ দেখবে কে? আমার কেমন দিশেহারা উদভ্রান্ত লাগছে! ইস্‌! আরেকটু কেয়ারফুল হলেই হতো। কেন যে... ...




০.
কোন গল্প নয়। কোন সত্যকাহিনী নয়। একটা মানুষ আর তার অপত্য-মানবের কথা। টুকরো টুকরো কথা, যে কথাগুলোর কোন মূল্য নেই পৃথিবীর কাছে। সর্বসম ঘূর্ণনে পৃথিবী নশ্বর সত্য বুকে নিয়ে ঘুরছে। সবই বিনাশ হবে একদিন। পৃথিবীচারী মানুষও সেকথা জানে, জানে বলেই আরো আরো নতুন প্রাণ নিয়ে আসে এখানে। নারীদের গর্ভে বীরপ্রসব ঘটে। তারপরে সেই বীর, পুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠে। পেছনে নারীটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যান, বেঁচে থাকলে, কিংবা মরে গিয়েও তাঁরা হারিয়ে যান। পৃথিবীর কিছু যায় আসে না তাতে। তবে তাঁরাও বড়ো অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান, যেন আর কারো স্বীকৃত সনদের কোনও দরকার নাই।

সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০০৮

শীতের শুরুতে আর বছরের শেষে জমে থাকা কথারা কম্বলের ওম পোহাতে চায়

শুরুঃ
শুরু বলে আদৌ কিছু নেই। সেখানে পেছোতে পেছোতে আমরা একেবারে পিছনে গিয়েও একটা আদি সুতো পাই, যার মাথায় আরো অন্য সুতোর লেজ বাঁধা থাকে। এই আপ্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিলে আমরা অনায়াসে হাল ছেড়ে দিতে পারি। তখন বাকি থাকে যেকোনও একটা শুরু বেছে নেয়া। যেকোনভাবে ঠেলা দেয়ার মতো একটা কথা বলতে শুরু করে দিলে পরের কথা গুলো এমনি এমনি চলে আসবে। এদেশে মানুষের অভাব নাই, কথারও অভাব নাই। পথে ঘাটে, রুলারে টানা মার্জিনের মতো ফুটপাতে বসে থাকা কালো ঝর্ণাকলমের ফোঁটার মতো ভিক্ষুকও কথা বলে, ঘুরে ফিরে একই স্বরে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। আমরা সেসব কথা শুনেও না শোনার চেষ্টা করি। এরকম আরো অনেক প্রচেষ্টা চলে আমাদের। বাবা-মায়ের কথা না শোনার, শিক্ষকের কথা না বুঝার, বাড়িওয়ালার কথা তোয়াক্কা না করার, অফিসে বসের কথা গা থেকে ঝেড়ে ফেলার হাজারো নিয়ত প্রচেষ্টা আমাদের ক্লান্ত করার বদলে এহেন কাজে আরো চৌকস করে তোলে। বোকাবাক্স খুলে দেখি না অনেকদিন আমরা, কিংবা সবসময়েই খোলা থাকে ওটা। সেখানে নানারকম রঙিনকথার সাথে শাড়িশিফনমালাদুল মিশিয়ে মিশিয়ে সিদ্দিকা কবীর'স রেসিপির মতো গুলিয়ে ঘুলিয়ে খাওয়ানো হয়। আমরা সেটা খেয়ে ঠোঁটে জিব টেনে শব্দ করি। আহ!! কী চমৎকার স্বাদু রান্না খেলাম! রাঁধুনির হাতে জাদু আছে। এরকম উপ-প্রশংসা শুনে কোনো কোনো রাঁধুনি বড়ো খুশি হয়ে পড়েন, গরমে রেখে দেয়া মাখনের মতো গলতে গলতে তরল হয়ে যান। সেই তরলকেও আমরা মাখিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি, ক্রমশঃ। ধীরে ধীরে আমাদের নেতি-অস্তির পথ ঝাপসা হয়ে আসে। ধীর প্রক্রিয়া টের পাওয়া কঠিন হয়, যেরকম ধীরে ধীরে শুয়োরবৎ কিছু পিশাচ আমাদের ঘর-আঙিনা দখল করে নিচ্ছিলো যা আমরা টের পাইনি বা টের পেলেও তোয়াক্কা করি নাই। এখন তাদের অস্তিতে মাথা দুলাই, তাদের নেতিতে ঘাড় নাড়ি। ও হ্যাঁ, আমরা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলা শিখেছিলাম। শিশুর সরলতায় সত্য বলে বকুনি খেয়েছি। চড়, থাপ্পড় দিয়ে দিয়ে বড়োরা শিখিয়েছে সত্য বলতে হয় না। বইয়ে ভুল লেখা ছিল। সদা সত্য কথা 'বলিবে'র জায়গায় 'লুকাইবে' হবে, বুঝেছো সোনামণি? তাই অভ্যাস হয়ে গেছে সত্য মুখের ওপরে না বলার। যেমন এখানে আমরা জামাত-শিবিরকে অপছন্দ করি, বিএনপিকে অপছন্দ করি, আওয়ামীলীগকে অপছন্দ করি, জাপা-এর উঃ, দঃ, এরশাদ-রওশন সব উপদলগুলোকেও অপছন্দ করি। রাজনীতিবিদের প্রশংসা কারো মুখে শুনলে আমাদের জানতে ইচ্ছা করে লোকটি এই রাজনীতিবিদের কাছে কী উপকার উপঢৌকন পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা লোকগুলোকে দেখেও সন্দেহ হইতে থাকে। আটত্রিশ বছর আগে এই মাসে স্বাধীনতা এসেছে সেটা নিয়ে প্রতি শীতেই সকল মিডিয়াপেপার গরম হয়ে ওঠে। দিকে দিকে দিগগজেরা গজিয়ে ওঠেন। কেন? স্মরণ ভালো, শিক্ষা কি তার থেকে জরুরি নয়? সেই স্মরণের কীই বা দরকার যেটা আমাদের পূর্বপিতাদের হত্যার, খুনের প্রতিশোধ নিতে দেয় না। এহেন ক্লীব স্মরণের কোন দরকার নাই। ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চের কোন দরকার নাই। দেশগড়া বলতে সবাই কী বুঝে? দালান ইমারত গায়ে গায়ে লাগায়ে তৈরি করতেছি, অথচ আমরা খেয়াল করি না যে চলাচলকারী মানুষগুলো কত নির্জীব, হতাশ, নষ্ট, ভ্রষ্ট। ভ্রষ্টতার পথ ধরে টাকা এসেছে, নোংরামি এসেছে। বিদেশি যৌনতা এসে বেডরুম, ওয়েবক্যাম, মোবাইল, থ্রিজিপি ফরম্যাট হয়ে যাচ্ছে। তার থেকেও উগ্রতার লেবাসে ধর্মরাজনীতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। এইডস নিয়ে আমাদের প্রেজুডিস আর ভয় অনেক বেশি ছিলো। হয়তো সেটাই দরকার। রাজাকার নিয়ে ভয় কম থাকায় এখন আটত্রিশ বছর পরে কী অবস্থা হয়েছে দেখা যাচ্ছে। এরকম আরো আরো আলোচনা আর কথা বার্তা আমরা বলতে থাকি কিন্তু কথার সুতো শেষ হয় না, শেষ করা সম্ভব হয় না।

বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০০৮

সেলাই

এখন চোখের ওপরে খড় দিয়ে তৈরি সুতো আর শাবল দিয়ে তৈরি সুঁই দিয়ে কেউ একজন আমার চোখ সেলাই করে দিচ্ছে। চোখের দু'পাতারা চিরে গিয়েছিলো জন্ম-মুহূর্তে। তারপরে চেরাফুটোয় গলগলিয়ে রঙ ঢুকেছে, আলো বাতাস পিতা মাতা সহোদরা ঢুকে গেছে এবং মেডুলায় তাদের কাদালেপা ঠাণ্ডাঘর বানিয়েছে। সে চোখচেরা গুহামুখেই প্রবল প্রতাপী তরুণীর শাদা শাদা স্তন আর যোনি ঢুকে গেছে সাথে করে কুষ্ঠভিখারিনীর গলিত হাত আর নখ, জটামাখা চুল।
সে চোখচেরাকে আজ শাবলসুঁইয়ে কেউ কড়কড় করে সেলাই করে দিচ্ছে, কোনার এক টুকরো ফাঁক এখনও বাকি। সে উপবৃত্তাকার ফাঁক দিয়ে সূর্যগ্রহণের আলো প্রবেশ করে- শেষ আলো। তারপরে শেষ একপোচে সাঁ করে আলো বন্ধের কান্নার তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে। আমি থরথরানো দু'হাত তুলে সেলাইকর্তার লোমশ ধাতব হাত চেপে ধরিঃ ওরে মাগো! এবারে ক্ষান্ত দে! আমার দু'চোখ বুজে গেছে চিরতরে! আমি আর কোন রঙ-রূপ-রস-গন্ধ-শোভা দেখবো না!

বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০০৮

ইন্দ্রিয়াবেগ ট্র্যাফিকিং




১.


... ... এ-খা-নে কো-ন-ও র-ঙ নে-ই কে-ন-না স-ব আ-লো মু-ছে গে-ছে অ-থ-বা স-ব আ-লো জ্ব-লে আ-ছে যে-হে-তু আ-লো-তে স-ব র-ঙ মে-শা-নো সে-হে-তু ধ-রে নি-তে পা-রি স-ব- র-ঙ মি-শে গে-ছে অ-থ-বা মু-ছে গে-ছে ... ...


প্রায়ালোকিত বিছানা জুড়ে তুমি
স্টীলশরীরে পড়ে আছো
একটু মুচড়ে হাত কিংবা পা,
অথবা টানটান করেই!


আমি ঢেউ দেখি,
নৌকা দেখি,
পাল দেখি,
স্রোত দেখি,
ছই দেখি,
নৌকোজমা কুয়াশা দেখি,
ছইঘেরা মেঘ দেখি,
আঁধারের অভাবে আমি সংশয়ে পড়ে যাই।


হাত বাড়ালেই তীব্র ধারালো ধাতবে
কেটে ছড়ে যেতে থাকে রোমকূপ
কাটাক্ষতে বইতে থাকে ভায়োলেট-মেঘ


নিবিড় হলে ইন্দ্রিয় খুব বিপন্ন হয়, ইন্দ্রিয়োর্ধ্ব স্পর্শ জমে ওঠে হীনমাছির নীলচোখ ঘিরে
বস্তুত আমি নীলমাছির পুঞ্জাক্ষি প্রেফার করতে শিখি
বস্তুত আমি ঝাঁঝাঁলো লাল বুদবুদ ভালোবাসতে শিখি
সেখানে তোমার চিহ্নমাত্র নেই!


অনায়াসে ঠেলে দিতে থাকো পর্যাবৃত্তে যেভাবে তোমাকে দেখেছিলো
আদিগন্ত চেনামাঠ দু'খানা বেতার-টাওয়ার-শিশ্ন মাথায় নিয়ে।
আমি দূরে যেতে যেতে ক্রমশই ক্ষীণ এবং ভারি হতে থাকি
অভিস্রবণ বড়ো ক্লান্তপ্রকৃয়া মনে হয়!


শেষেঃ
গহ্বর থেকে চোখ খুলে ফেলি;
আঙুলগুলোও একে একে, টেনে টেনে;
ত্বক ফেলে দিলে হলুদাভ মেদ আর লালরঙ মাংস চেয়ে থাকে পলকহীন;
বাকি দুই - সীসা ঢেলে বন্ধ করে দেয়ার পর
আমি ধীরে ধীরে হিমায়িত ভাগাড়গামী রথে কর্ণকে সারথি করি


মৃত্যুর চেয়ে গাঢ় কোন গান, চুমুর চেয়ে ঘন কোন গলনে জ্বলতে থাকে তোমারারামার চারিপাশ।


২.


বাঁশিবাদক সুর থামিয়ে থমকে দিলে ঘোর কেটে যাওয়া
থতমত আমি দৃষ্টি অনুসরণ করি,
দৃষ্টির শেষরেখায় জ্বলন্ত টিউবের নিচে
সারবাঁধা মানুষের সামনে দিয়ে
এক রূপসী আগুন ছুটে আসে।


আগুনের গায়ে শাদা-শামুক মালা লেগে থাকে,
আগুনের পায়ে সূক্ষ্ণহিল বর্শা গেঁথে থাকে,
আগুনের শরীরে কোমল ধোঁয়ামেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার ভয়ে আটকে থাকে,
আগুনের লম্বা পায়ের ঝুল-বরাবর আমি আমার গলনাঙ্ক লেখা রাখা দেখি।
মুহূর্তেই আমার কাছে আগুন,
দুমড়ে মুচড়ে নীলখাম-প্রেমপত্র হয়ে যায়।
মুহূর্তেই সে সর্‌সর্‌ করে ময়াল সাপের মতো,
ইনহেলারে পাফ্‌ নেয়ার মতো,
চুমুকে ব্ল্যাক কফি জিহ্বায় টানার মতো,
এমনকি আরো অনেক আশ্লেষ-গ্রহণের মতো
আমার চুল-ত্বক-ময়লা শরীর ভেদ করে ঢুকে পড়তে থাকে।


আমি আগুন খুলে খুলে দেখি-
বাদামী শরীরে পোশাক খুলে খুলে নিবিড় হই।
আগুনের আভরণ খসে গেলে বাদাম-ত্বক চর হয়ে জেগে ওঠে।
চরের বালিতে আমি ব্রাস্ট্র্যাপের আইল পাই,
সেখানে দুতিন-বিঘা জমিন কেনা নিয়ে
আমি পান-খাওয়া দালালের সাথে বচসা বাঁধিয়ে দিই!
আগুন আমাকে টেনে টেনে তার ভিতরে নিতে থাকে,
আরো গভীরে
আরো গভীরে
আমি গলে গলে যেতে থাকি।
সেখানে নিমগ্ন চৈতন্যের জল এসে পাড় ভিজানো তাল ঠুকে ঠুকে
চরের জমিন ভিজিয়ে দেয়।


এখানে বাদামে চিরহরিৎ তিল জেগে থাকে
এখানে নৌকায় কালোকাঠে খাঁজ, খাঁজ পলি জমা হয়
এখানে প্লাবিত-উপকূল জুড়ে আমি জমিহারা আর্তনাদ গুনি।


সবশেষে ঘনোচাঁদঘোনোকাশফুলঘনোবাঁশবন প্যান্টিলাইনের চেয়ে গাঢ় হয়ে জেগে থাকে।

শনিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০০৮

অতিক্রান্ত বিকেলস্মৃতি


ক্লাশ শেষ হবার ঠিক তিন মিনিটের মাথায় দু'চারটে বেঞ্চ আর
মাঝে জমিয়ে রাখা খাতাপত্তর ব্যাগ
দু'চারজন সহপাঠীর কলরোল সরিয়ে
মোটাসোঁটা ফটোকপি-বইয়েরা
স্যারের নোটাকার পথ্যসকল
ছড়ানো কলম- পোড়ানো হৃদয় ছাপিয়েও
অমিতলাবণ্য কাছাকাছি চলে আসে
তাদের জন্যে বিকেল ফুরোতে ফুরোতে
কোমল গান্ধারের সলতে জ্বেলে দেয়
অমিশুক দারোয়ান খটখটে হেঁটে যাবার কয়েক মিনিট পরঃ
অমিতলাবণ্য পুনর্জন্ম নেয়।


সেখানে আদতে লাবণ্যের ওড়না থেকে
নরোম-রোদ্দুর-গোলানো-মাঘ ঝরে পড়েছিলো জানি
বলে আমি চুপচাপ চোখ মেলে থাকতে ভালোবাসি।
বেঞ্চ আর অমিতের ঝুল ফতুয়া, আমার সাথে নিনির্মেখ ঘিয়েরঙা ওড়নার প্রতীক্ষা করে!

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০০৮

জ্বরতপ্ত স্পন্টেনিউয়্যিটিতে সেলফোন বা আমার চোখ

ভোর হইতে যাইতেছে। আমি জানালার পাশে একটা জংধরা জালি টপকে বাইরে তাকায়ে অদ্ভুত লালাভা দেখতেছি। মাথায় সবকিছু ছিঁড়াছিঁড়া থট্‌ শুক্রাণুর মতোন খসমান লেজ নাড়ায়ে চলতেছে। এগুলারে টোপে ধরা যায় না। সূঁচালো জালে ধরার চেষ্টা করি।


১.
একটা হালকা জিনিশ শুরুতেই! স্পন্টেনিয়াস লেখালেখির একটা প্রচেষ্টা চালাইতেছি। দেখি ঠুক ঠুক করে কামার সাহেব কিরাম বেতের সোফা বানাইতে গিয়া চেয়ার বানায়ে ফেলেন! সেখানে নিচের চার লাইন বান্ধছি। কেমন হইলো!! 




"তোমার জন্যে নীলচে তারার একটুখানি আলো
দিতে পারলে বড়ো বেশি লাগতো আমার ভালো
কিন্তু তুমি ফুঁক মাইরা কেন নিভায়ে দিলা?
নিভে যাওয়া বাতি হাতে মনটা আমার বিলা!"






২.
খুবই নিম্নমানে বা উচ্চমানে অবস্থানের শখ হয় কখনও কখনও। সেখানে থাকতে হলে কী কী ক্রিয়াপালন বা শর্তপূরণ করতে হয় জানি না। সেজন্যে আমারও ওসব স্থানে যাওয়া হয় না। তবে কেউ যখন নিম্নে থেকে আমার দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টি ফেলে আমি তার কৃতিত্বটুক চেটে-পুটে-গিলে খাই। আবার কেউ যখন উচ্চ থেকে আমারে করুণা করে থুতু ফেলে দেয়, তার প্রতি ভক্তি উথলায়ে দুধের বলগ আসার মতোন চুলা ভিজায়ে দিয়ে বের হতে থাকে। মাঝখানে থেকে আহা!! আমি কতো সুখ সুখ কুসুম লাভ করি!




৩.
জ্বরতপ্ত অবস্থাটা খুব মোহনীয়। আমি পাতলা কাঁথা মুড়ে শুয়ে নিজের ওমে গরম হতে থাকি। গত দু'দিন এরকম কেটেছে। তারপরে আমি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে চামড়া থেকে তাপ পামোলিভ সাবানে ঘষে তুলে ফেলেছি। তারপরে টাইলস বেয়ে সাবানের ফেনায় সওয়ার হয়ে জ্বরকণার চাদর যখন চুঁয়ে চুঁয়ে স্যুয়ারেজে চলে গেলো, আমি হাহাকার করে উঠেছি। দৌড়ে হালকা ভেজা শরীরেই আমি কাঁথাটা আঁকড়ে ধরি, আঁতিপাতি করে খুঁজি।


নাহ্‌! আমাকে ছেড়ে সে মাদক ঘোর চলে গেছে।




৪.
এখানে জেগে থাকার আগেই নোনতা বিস্কুট মিশিয়ে র'চায়ের মগ ব'সে থাকে/
এখানে র'চায়ের মগের পাশে আমার চল্টাওঠা সেলফোন ব্লিঙ্ক করে/
এখানে ব্লিঙ্কের সাথে ঘরের লাইট জ্বলে জ্বলে জেগে থাকে/
লাইটের আলো বাইরে আঁধারে দু-একটা তক্ষককে হিংস্র করে দেয়/


নোনতা বিস্কুট-র'চা-সেলফোন-লাইট-তক্ষক-
এসবকিছু ফেলে আমি কীভাবে তোমার জন্যে চোখ খুলে হাতে নিয়ে রক্ত গোলাপ-
জেগে থাকি?






ফুটনোটঃ কিসুই হয় নাই, কিসুই হবে না, কিসুই হস্যে না!






সাথে এক্টু যোগ করিঃ গাই ফওক্‌স-কে মনে পড়তেছে। লোকটাকে কেউ চিনে না সেভাবে। কিন্তু তাকে নিয়ে একটা নার্সারি রাইম আছে। শিশুদের আমরা দেশদ্রোহিতার শাস্তি শিখাইতে এইটা আউড়াইঃ


রিমেমবার রিমেমবার, দ্যা ফিফথ অব নভেম্বার
গানপাউডার, ট্রীজ্‌ন অ্যাণ্ড প্লট।
আই সি নো রিজ্‌ন, হোয়াই গানপাউডার ট্রীজ্‌ন
শ্যুড এভার বি ফরগট!

রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০০৮

অপ্রস্তুত ব্যস্ততা ভেদ করে আসা শব্দেরা

গুলশান


দুপুরে গুলশান গনগনে খুব
সাদা-কালো-শ্যামলা কোমল আগুন
চলাচল করে আইল্যান্ড আর ফুটপাতে।
বৃন্ত ছেড়ে পরিধিজুড়ে
ঘনোঘাম কণা জমে, সারি সারি রাশি
তারপরে তারা খুব চুপচাপ চেয়ে থাকে।
শীতাতপ-কাঁথা গায়ে কাচের ওপাশে আমি
রোদফাটা গুলশান দেখি।
---


অনুসন্ধান


আয়নাগলনের সাথে স্ফটিকের সম্পর্ক নেই,
যেভাবে শুদ্ধতম শ্লোকের সাথে মেলে না কামার্ঘ্য মেশানো শীৎকার;
সেখানে মেঝে ফুঁড়ে প্রকাণ্ড ফলা ঢুকে গেলে
তার মাথার খাঁজে আমি গোলাপখণ্ড খুঁজি।


বীতরাগ মানেই তো নিবিড় হওয়া নয়?


খুলে রাখা ঘুঙুর দেখে,
আরব্য-রজনী-শেষের কিছু ক্লান্তি পাই।
ত্বকাত্বক সীমানাতে জমে থাকা ঘামকণা
একটু একটু শীতল হয়ে যায়।
সেখানে বেহুলা কিংবা শাহারজাদী কেউ উপস্থিত ছিলো না।

মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০০৮

এই শহরে আমার পথে মগ্ন হয়ে যায় বাসের শিস

এই যে ঢাকা শহরে হেঁটে চলে বেড়াই, দিন যায়, মাস যায়, গরমের দিনগুলো পেরিয়ে শীতের বাতাস আসে। তারও আগে বৃষ্টি ঝুম করে দারুন ভিজিয়ে যায়। সিক্ত নগরীও একসময় শুকিয়ে ওঠে। তারপরে আবার কুয়াশা কেটে চরাচরে উৎসব জমে ওঠে। এরকম দিনাতিপাতে খেয়াল থাকে না কখন বেড়ে উঠছি। বয়েসের কোঠা একটা একটা ধাপ পেরুচ্ছে। সেখানে ধাপে ধাপে কতমুখঃ চেনা-অচেনা-সাদা-তামাটে-কালো-কালিমাখা। এইসব মুখের ভীড়েও কাউকে চিনে ফেলি স্বজন মনে করে। কাউকে দু'চোখে ঘৃণা করি শত্রু ভেবে। এভাবেই দিন কাটাই। ঘুড়িওড়া দিন শেষে টের পাই, বয়েস বাড়ছে। যেসব সময় পিছনে ফেলে এসেছি সেসব কেমন বিবর্ণ হয়েও জ্বলজ্বল করছে। ফিরে তাকালে হাসিমাখা কিংবা কান্নাভেজা দু' চোখ দেখি। পুরোনো আমি'র সেই দু'চোখ আমাকে মাঝে মাঝে সাহস দেয়ঃ "এই দেখো, পুরোনো আমাকে ফেলে তুমি কতো কতো পথ এগিয়ে গেছো! সেখানে তোমার ত্বকে ভাঁজের সাথে জমেছে স্মৃতিরা।" আবার মাঝে মাঝে সেইমুখটাই আমার দিকে তাকিয়ে ঠা ঠা হেসে দেয়ঃ "কী অদ্ভুতভাবে তুমি ব্যর্থ হচ্ছো! এতকিছু শিখেও বুঝে উঠলে না জীবনের মানে!"


শহরের কথা বলছিলাম। কিছু কিছু রাস্তা এখানে আমার হাতের তালুর মতো আপন মনে হয়। এমনও হয়েছে, দিনে দু'তিনবার করে একই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছি। আজকে যেমন ফিরে আসছিলাম, সোজা শাহবাগ থেকে ক্যান্টনমেন্ট। রাত ঘড়িতে নয় ছুঁই ছুঁই। রেডিয়াম জানিয়ে দেয় খুব বেশি বাকি নেই, নিশুতি রাত নেমে আসবে এই জরাক্লান্ত শহরটাতে। রাস্তার আলোগুলো আরও ম্লান হবে আর ঢাউস পেতনি-র মতো সিটিবাসগুলো ভাঙাচোরা বাম্পার আর চটে-থেবড়ে যাওয়া বডি নিয়ে নিঃশব্দ হবে। আমি মোড় থেকে একটা মিশুক নেই। সিএনজি পেলাম না। ওরা আসার পরে এই মিশুক কেমন জানি দত্তক-নেয়া সন্তানের মতো হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকলেও কাছে ডাকি না। সিএনজি-কে খুঁজি। এখন যেমন, না পেয়ে অগত্যা! উঠে পড়ে টের পেলাম কী অবহেলায় মিশুকটা দিনে দিনে পাশের বারডেমের বহুমূত্র রোগীর মতো শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। গিয়ার বদলাতে গেলে অদ্ভুত ঝাঁকুনি দেয়। পিঠের পেছনে ফোমটাও চিমশে গেছে বলে আমাকে শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে হয়। বাস্তবতার কঠোর চাপে ওটা প্রায় বেঁকে গেছে বলে এখন সোজা করতে অস্বস্তি হয়, টের পাই।


চারপাশে ডাইনিগুলো খেদিয়ে আমাদের ড্রেনের কাছে নিয়ে যায়। দীর্ঘ বন্ধ্যাকালীন জ্যামে বসে বসে আমি ফুটপাতের দ্রুতগামী মানুষ দেখি। কাজ শেষে সবাই ফিরছে। কতো কতো দূর এরা এভাবেই হেঁটে যাবে। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম, যেতে হতো- যখন কিছুই পেতাম না রাত বেড়ে গেলে, তখন পায়ের জোর বেড়ে যেতো কোন কারণে। একটু পরে, বেশ একটু পরে আমরা দাড়িয়ে থাকাদের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে দাহ্য-গ্যাসোলিনের ইঞ্জিনের পাশে এসে যাই। সিগন্যাল ছাড়ে অনেকক্ষণ পরে। ওপাশে অসহায় বন্ধ্যাদের ফেলে আমার মিশুক আবার গুঙিয়ে এগুতে থাকে।


বাতাসটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সামনে শীতে অনেকগুলো মানুষ মারা যাবে। পেপারে লিড হবে সেটা। তারপরে পেছনের পাতায় যাবে, সেখান থেকে ভিতরে ময়লাটে পাতায় স্থান পাবে কারণ আর কোন খবর নেই এই দেশে। শীতে কুঁকড়ে মানুষস্বরূপ প্রাণীদলের মরে যাওয়াতে পেপারকাটতি, মানবাধিকার-সংগ্রামীদের উদ্যোগ এসবই সার। এরপরে আর কিছুনাই- এটাই বড়ো সত্য! তারপরে বসন্ত এসে গেলে আমরা অপরাধবোধের জোয়াল নামিয়ে রেখে হাঁপ ছাড়বো।


এখন আমার মিশুক বেগবান! এঁকেবেঁকে ছুটছে, যদিও বৈমাত্রেয় সিএনজি টপকে যায়, কুৎসিত প্রতিবেশী কালো কিংবা হলুদ ট্যাক্সি টপকে যায়। রাস্তার মাঝখানে কয়েকটা ম্যানহোল, ওগুলোর চারপাশে একটা সিমেন্টের বর্ডার দেয়া। আমার মিশুক ওগুলো টপকে যাবার সময়ে জোরে ঝাঁকুনি খায়। মসৃণ ত্বকের ওপরে জড়ুল!! আমি সামনের জংধরা রডটা শক্ত করে ধরে থাকি। পথে সার্ক ফোয়ারার বিষন্ন গোলক দেখি। গোলকের গায়ে হেডলাইট-টেললাইট-স্ট্রিটলাইট পড়ে পড়ে কী মোহময় ছবি আঁকছে। এই শহরেও সুন্দর জন্ম নেয় তাহলে! চুপচাপ দু'সেকেন্ড বেঁচে থাকে। তারপরে কর্কশ হর্ন-ধোঁয়া-ধুলোয় ওদের মৃত্যু হয়। আমি ঐ জীবন্ত সৌন্দর্যের জীবনকাল দেখি, কিন্তু শেষকৃত্যে সঙ্গী হতে পারি না।


বিজয় সরণি পেরিয়ে নাখালপাড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাই। এখানে রাস্তা ফাঁকা-প্রায়। ঠাণ্ডাটা গায়ে লাগছে এখন। আরো কয়েকটা জড়ুল পড়ে পথে। মিশুকওলা একটু আগে র‌্যাঙগস-ভবনের সামনে তার হাতের কড়াপরা তালু দেখাচ্ছিলো। সারাদিন খ্যাপ মেরে, গরমে রাবারের হাতল মসৃণ করে ফেলেছে, সেখানে তার হাতও কালশিটে পড়ে মসৃণতর হয়ে গেছে। দেখে আমার ত্বকেও চর পড়ে যায়!! তোবড়ানো গালের লোকটা অনেক বেশি ভাড়া চেয়েছে, নিরুপায় হয়েই উঠেছি। তবে সেসব কিছু ছাপিয়ে ওঠে অন্যকিছু। আমার খুব তাঁর কাঁধে হাত রাখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। রডের পাশেই তো! তার আগেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলো। আবার ঝাঁকুনিতে সামলে বা বেসামলে নিই আমি।


ঢোকার মুখে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবেন? উত্তর দেই স্বাভাবিকভাবে। এই পাহারা, কড়াকড়িতে সন্ত্রস্ত হয়ে যাই, অপরাধী লাগে আর হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো সংকুচিত হতে থাকি। বাসার কাছাকাছি এসে ডিরেকশন দেই। মিশুক থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় পৌঁছে গেলে টের পাই গত একঘন্টায় শরীরে কয়েক পরত ধুলো আর ময়লা জমেছে। আমার শহরের ধুলো। চকিতে শহবাগ থেকে বাসা অবধি পথ মনে ভেসে ওঠে! ডাইনি বাসকে বৃদ্ধ-পিতামহের মতো মনে হয়। অনাত্মীয় ট্যাক্সি কিংবা প্রিমিও গাড়ীগুলোকেও অতো বেশি পর মনে হয় না! শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে রাখতে এখন বেশ আরামও পাই। তখনই টের পাই এই শহরটা আমাকে কীভাবে মায়ায় বেঁধে ফেলছে। শিকড়ের সন্ধান জানি না, তবে আমি পিচমেশানো শহরের মাটিবিহীন জমিনে নিজের কিছু ত্বকছায়া পড়ে থাকতে দেখি।

রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০০৮

ত্রয়ী ২

শিশিরের ট্রেন
বিকেলবেলাঃ ঠিক পাঁচটা বাজার একটু আগে
শিশিরের ট্রেন থামে;
স্টেশন গার্ড সবুজ পতাকা মৃদু দুলিয়ে দিলে-
ঘাসেরাও শিশিরের ওয়েটিং রুম হয়ে যায়।




মুখবন্ধে সুরাইয়া
প্রচ্ছদের শক্ত মলাট থেকে দু'পাতা উল্টে
সাদা জমিনে কয়েকটা লাইন;
বেশি নয়- কতগুলো মুঠোভরা শব্দে লেখক
পরিচয় ঘটালেন সুরাইয়ার সাথে- আমাদের,
শব্দগুলো জমে জমে সুরাইয়াকে গড়ে তোলে
আর সেখানে কলমের নিব সুরাইয়ার শরীরে ঘষা খেয়ে যায়।




চিত্রকলপো
সবুজ কাঠের নিচে প'ড়ে আছো তুমি
পাশে কয়েকটা জোনাক কিংবা শামুক
স্থবির হয়ে তোমাকে দেখেঃ
এই চিত্রকল্প মাথায় এলে-
আমি পোশাক খুলে তোমার পাশে শুয়ে পড়ি।


তোমাকে আর আমাকে কেউ দেখতে পাবে না আর।

বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০০৮

ডাহুকপ্রেম

চলে যাবার আগে একটা ডাহুক বুকের ওমে, হাত মেলে
আমার জন্যে প্রার্থনা করেছিলো খুব।
আমি মুখ তুলতেই ঝাপ্টে তুমুল-
সে চলে গেছে।
চলে গেছে।


খুঁজতে যাই নাই- লাভ নাই জেনে;
মৃত হবার আগে ডাহুকেরা শাপ দিয়ে গেছে- অভিশাপ!


আমাদের রাতগুলো, দীর্ঘ আর দিনগুলো ঘামে ক্লান্ত হবে।


আমাদের শয়ন আর রমণগুলো, ক্লান্ত মিনার হয়ে ধ্বসে যাবে।


আমাদের নিটোল শৈশবস্মৃতি, জড়ানো ক্যাসেটের ফিতেয় লাশ লাশ হয়ে যাবে।


ডাহুক জানে না তার শাপে একঘুম ভেঙে জেগে গেছি
বাসা-দরজা খুলে গেলে পর্দায় কী আড়াল করে?
রোদ আর ডানা ভেঙে বসেই আছি
প্রবল চাপে পিষে যাবার আগে, মিশে যাবার আগে, শুধু, ডাহুকের একটা পালক চাই।

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০০৮

সায়াহ্নে শুয়োরের শীৎকার

সায়াহ্ন একটা কলসমুখ ব্যেপে উছলে গেলে দেখা যাক
তার নিচে কতটা লাল গোলাপাভা
গলনের সূত্রমতেই
তাপহর-; শোক হয়ে থাকে।
সিঁড়িঘর থেকে উত্থানে উন্মুখ সাতটা শুয়োর
তাদের রোঁয়া ফুলিয়ে
কাটা-নাকে রঙ মেখে দুদ্দাড় উঠে আসে।
আমাদের চলন স্থবির জেনেই শুয়োরপাল
খুব সহজে বিছানা-ঘর-রাজধানী চরে
সাম্রাজ্যে প্রসব করে।
প্রসব-আনন্দে প্রকাণ্ড শিশ্নধারী নেতাগণ
ব্লাডসাপ্লাইয়ে শক্ত খুঁটি আমাদের মুখে বুলিয়ে দেয়।

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০০৮

কবিতাপাঠের বায়োপ্‌সি

ইদানীং কবিতা বেশ রক্তে ঢুকে যাচ্ছে। অথবা রক্তে আগেই ঢুকে গিয়েছিল কোনও এক অসতর্ক মুহুর্তে, এখন নালী জুড়ে তার চলন টের পাচ্ছি। সেই চলনে অস্থিরতা নেই। এলিয়েন বস্তু শুনেছি- শরীর বেশিদিন টিঁকতে দেয়না, বের করে দেয়। আর বের করে দিতে না পারলে তার রিঅ্যাকশন শুরু হয় জ্বর-জারি, ইনফেকশন, অ্যালার্জি এসবের মধ্যে দিয়ে। তবে আশার কথা আমার শরীর এখনও কবিতাকে অতটা উটকো ভাবছে না। হয়তো কালের সাথে তার সহনশীলতাও বেড়েছে!


দীর্ঘ উপক্রমণিকার কারণ বলে নিই, এটা আসলে সততই আমার মধ্যে খেলা করছে। লেখালেখি গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছি অনেকটা সময় পরে এসে। সেখানে গুরুত্বটুকু প্রথমে শুধুই আত্মকেন্দ্রিক শখ বা সুখবিলাসজাত ছিল। কিন্তু যেহেতু ক্রিয়ার অপর পিঠেই প্রতিক্রিয়া জন্মায় ঈস্টের মতোন, সেহেতু আমার লেখাতেও নানান অনুভব তৈরি হয় আর আমার কাছে ফিরে আসে। তখন আসলে একটা আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়। ক্রমশ টের পাই, কবি আমি ছাড়িয়ে ব্যক্তি আমি জায়গা করে নিচ্ছি। সেটা পাঠককেও হয়তো আরো স্বচ্ছতা দিচ্ছে।


তবে এই মিথস্ক্রিয়ার মাঝে আমি এটাও টের পাই একটা ভিন্নসুর জেগে ওঠে। হয়তো মানব বৈচিত্র্যের কারণেই। সেখানে নিজের মতটাই প্রকাশ করার মাধ্যমে অংশ নিতে পারি। কবিতার ভাষা নিয়ে ফরহাদ উিদ্দন স্বপনের একটা পোস্ট দেখলাম। সেখানে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনায় আমি খেয়াল করিনি আগে বলে অংশ নিতে পারিনি। তবে সেই লেখাটিই কিছু কথা আমার ভেতর থেকে বের করে আনছে। সেগুলো একে একে বলি।


প্রথমেই লেখক-পাঠকের যোগাযোগের ক্ষেত্রটি নিয়ে কিছু কথা বলি। আমি যখন লেখক, তখন একটা কবিতা আমার হাত দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে অনেক জন্ম-প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যায়। সেটা এক এক কবির এক এক রকম। সেই প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ, সৃজনশীল লেখালেখির প্রতিটা ক্ষেত্রেই হয়তো তা খাটে। তবে অনেক জাদু দেখে যেমন মনে একটা প্রশ্ন জাগে জাদুর পেছনে রহস্যটা কী, তেমনি কবিতাপাঠের পরেও পাঠক হিসেবে অনেকেরই হয়তো মনে আসে, লেখক এই কবিতা কী ভেবে লিখেছেন? তার চিন্তা আর মস্তিষ্কে কী রসায়ন চলেছে? শব্দ আর পংক্তিগুলো দিয়ে তিনি কী বুঝিয়েছেন? এই স্বভাবিক প্রশ্নগুলোকে আমি একটু ভিন্ন চোখে দেখি।


আমি যেকোনও কবিতাকে মনে করি একটা চশমা-র মতোন। সে চশমার মধ্য দিয়ে কবি কিছু একটা দেখেছেন, লিখেছেন। সেই লেখাটি আমি পাঠক যখন পড়বো, আমি একটা বা ভিন্ন ভিন্ন কিছু দৃশ্য পাবো। আমার মধ্যে একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটা কতটুকু কবির সাথে মিললো, তা আমি কখনোই বিচার করতে যাবো না। তার পিছনে কারণ বহুবিধ। কবির চিন্তার পাটাতন আর আমার চিন্তার পাটাতন এক হবার কোন কারণ বা সুযোগ নাই। আবার আমার দেখনভঙ্গি কবির চেয়ে স্বতন্ত্র হোক এটাও আমি চাইবো।


এই দেখাটা জরুরি। বা এই মনোভাবটা কবিতার উদ্দেশ্য পূরণে পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি। পাঠকের উদ্যোগ এক্ষেত্রে লেখকের চাইতেও বেশি।


সমসাময়িক একটা বিষয় চলে আসে। কোন কবিতাকে বিচার করার বা পাঠ করার ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি বিভাগ করে ফেলিঃ ভালো, খারাপ, মন্দ, নতুন, ফালতু, চমৎকার, অপ-, কু- ইত্যাদি নানান বিশেষণ, প্রত্যয় যোগ করে। এটা নিয়ে এখানে একটা মোটামুটি তোলপাড়ও চলেছে কিছুদিন আগে। তবে সেটা অন্য কথা।


এখানে এই বিভাগকরনের বিপক্ষে অনেককিছুই বলা যায়। আবার পক্ষেও অনেক কিছু টেনে আনা যায়। তবে আমি এই স্বতস্ফূর্ত শ্রেণীবিভাগের কারণটি বের করতে একটু তৎপর হই। জিজ্ঞাসার পেছনে উত্তরটা অনেকটাই এসে পড়ে এরকম যে আমরা কোনকিছু, সেটা যে রচনাই হোক না কেন, তাকে বিশেষায়িত করতে পারলে স্বস্তিবোধ করি। একটা ফরম্যাট দাঁড়িয়ে গেছে বা দাঁড় করানো হয়েছেঃ গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, ছড়া এরকমের কিছু প্রধানভাগ; অণু-পরমাণু-বড়-ছোট এরকম শব্দ প্রধানভাগের আগে জুড়ে দিয়ে সেকেন্ডারি ভাগ; তারপরেও আরো নানা রকম ভাগ করা হচ্ছে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে।


কবিতার জন্যে সেই ভাগ দশকভিত্তিক, শতকভিত্তিক হয়ে থাকে। রোমান্টিক, আধুনিক, উত্তরাধুনিক এরকম হয়ে থাকে। আবার নানা মতবাদ ভিত্তিকও হয়ে থাকে। এতোদূর যারা পড়ে ফেলেছেন, তারা যেমন, তেমনি আমি নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছি। সংজ্ঞাভারে মাথা নুয়ে আসছে, কাঁধ ব্যথা করছে, চোখ জ্বলছে এবং কান ভোঁভোঁ করছে। আর সব পাঠকের মতোন আমিও এই সবকিছু জঞ্জাল হিসেবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাই। কী দরকার অনর্থক বিভক্তির? একটা কবিতা, তা সে যেমনই হোক না কেন, যার দ্বারাই লিখিত হোক না কেন, সেটা শেষপর্যন্ত একটা কবিতাই! সেই কবিতার কোনও বাস্তব উপযোগ নাই, কর্মসম্পাদনে সহায়কও নয় কবিতা। নেহায়েত কোনও গূঢ় "পেছনের কথা" না থাকলে সেটা আদৌ কোন অর্থবোধকও হয় না।


তাহলে আমি একজন পাঠক হিসেবে কি কবিতাপাঠ করতে পারি? যদি পারি, তাহলে তা কতটা দরকারি? বা কবিতা নিজে আমাকে কতটা তার পাঠক হিসেবে গ্রহণ করবে সেটাও আনুষঙ্গিক প্রশ্ন। আমি মনে করি একজন গল্প বা প্রবন্ধপাঠকের চেয়ে কবিতা পাঠককে অনেক বেশি মাত্রাসম্পন্ন হতে হয়। সেখানে তার জন্যে কিছু সংবেদনশীলতা স্বভাবতই কবিতা দাবি করে। সেকারণেই কোনও দ্রুত প্রকরণেও যেতে চাইনা। ঘুরে ফিরে সেই প্রথম কথাটুকুর কার্যকারণ বের করে ফেলতে পারি। শরীরে মননে আসলেই কবিতা বিস্তারী ভালোবাসার মতোন ছড়িয়ে পড়ছে।


***
[ছাড়া ছাড়াভাবে কিছু কথা বেশ অনেকদিন বা কিছুদিন ধরে জমেছে। সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত না করলে অস্বস্তিবোধ... এবং ক্রমান্বয়ে অস্থিরতা। সে অস্থিরতার গলা টিপতেই এই লেখা!]

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০০৮

রেট্রোস্পেকটিভ

শায়িত বিলবোর্ডে শুয়ে আছে সে
ক্লান্ত শরীরেও কী তীব্র জ্বলে দু'চোখ
আর একভেদী ঝলক জেগে থাকে।


ব্যানার ঝুলানো বারান্দায় কেউ নেই নেই
ভেতরে নীলাভ কৌণিকালো চোঙা ফুঁড়ে বিপ্লব-
কিংবা শয়তান মেখে উৎকট।
দস্‌তয়ভোস্‌কি তলোস্‌তয় প্রমুখ
হেঁটমাথা, হাতের কড়েতে গুনে নেন
লোহা চেয়ারে ফেলে রাখা টিকেটসংখ্যা।


ঘন্টাকতক পরে শীতাতপ থামিয়ে
চোঙা নিভে সাধারন আলো জ্বেলে দিলে
পেছনসারি থেকে দু'জোড়া পায়রা
ডানাঝাপ্টে উড়ে যায়।


ফিরে তাকানোয় খানিক ক্লান্তি, খানিক মরাশ্বাস মিশে যেতে পারে।

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০০৮

একটা সন্ধ্যা আমাদেরও ছিল

বিকেল পড়ে আসার আগেই সুবাসিত রিংটোন
আহ্বানে আনন্দ ছিলো, স্বর শুনে আগ্রহ আমার
কাজেরাও ছুটি নিতে চায়-


সন্ধ্যার কোনও রাগ নেই আমার ওপরে,
জেগে উঠেও সে বেশ অমায়িক- হেসে দেয়
আমি শহরটাকে মুড়ে নিই বাদামি প্যাকেটে
সাথে নীলফিতে রিবন আর হলদেরাঙাফুল।


ওপাশে দোকান পসরা পেরিয়ে একটু এগিয়ে আমি
বহুচেনা কারও কারও দেখা পাই
গতি-মন্থরতা, স্থবিরতা প্রায়শই আরাম দেয়


হাসি আর কণ্ঠসুরে ক্রমশ
পরকীয়া, সুশীলতা, ক্লান্তি আর তীব্রতা
নিরূপিত হতে থাকে,
সময় হিসেবে রাত ঘন হয়
আমরাও কিছুটা গাঢ় হই ধীরে।


ফিরে এসেও জেনেছি ওখানে কাঠের বেঞ্চ, প্রভূত বিস্ময় নিয়ে জেগে আছে।

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০০৮

ইশকুল, ফ্লুরোসেন্ট ও রোদসঙ্গম;

ফ্লুরোসেন্ট


স্টেডিয়াম পেট চিরে দুজন বেরিয়ে এলাম
তুমিয়ামি বেশ গাঢ় হয়ে হাঁটি
পা মেলেনা, মাঝের দুরত্বটাও বাড়ে, কমে
তবে রচিত-পথ
ফ্লুরোসেন্ট সৌরভ মেখে তীর্যক দাঁড়িয়ে
সেখানে রিকশাও রূপবতী হয়ে যায়।






ইশকুল


সারবাঁধা দেশলাই-সব,
স্কুলগামী ভ্যানে চড়ে ঝাঁকি খেতে খেতে
ভাঙাচোরা মিউনিসিপ্যাল্‌টি পেরিয়ে,
কাশবন ঘিরে বসে পড়ে।
ঘাসেরাও সেখানে মাথা-উঁচু করে
শতবর্ষী বটের গায়ে চকবোর্ড থেকে
কষ্ট করে লেখাগুলো তোলে,
গুটি গুটি পিঁপড়া-অক্ষরে।






রোদসঙ্গম;


রোদ হেসে দৌড়ে কপাটি দিয়ে
মেঘের সাথে
শুয়ে পড়লে
অভিমানে নদ খুব জোরালো আওয়াজে জেগে ওঠে
উদ্দাম সঙ্গমে
মেঘের শরীরে
টান টান সুখ
জমা পড়ে
গ্রীকাক্ষর সন্তর্পণে এলোমেলো হয়ে যায়।

শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০০৮

আজ কোন কবিতা লেখা হবে না আমার

আজ কোন কবিতা লেখা হবে না আমার।


প্রকাণ্ড বাসর ভেঙে নববধূ বেরিয়ে আসা অলক্ষুণে!


তারাজ্বলা রাত নেমেছিল
সাথে ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ অথবা মঠের পণ্ডিতও বসে ছিল হয়তো
সবার অলক্ষ্যে বিশ পেরুনো শরীর নিয়ে সে
চলে গেলো নদীধারে


সেখানে জানালা-গলা রোদ ঘুমিয়ে ছিল
সাথে মর্ষকামী বিড়াল আর হাতুড়ে হৃদয়
নিয়ে জেলে বসেছিল
প্রত্যেকের কোলে রাখা নিজস্ব চাঁদ
নিজস্ব রঙমেশা শায়িত প্রভাত


কিন্তু এমন চলে যাওয়াতে
আমার কেন ঘুম হবে না?
কেন ফিরে যেতে যেতেও স্মৃতি জ্বলবে অহর্নিশ।
প্রস্থান তো কখনও স্মরণরহিত নয়-
কাঁধ ছুয়ে রাত বিদায় নিলেও
চারপাশের বাস্তব তাকে ঘিরে রবেই


আমি অনেক দূরে থেকেও বুঝে নিতে পারি
জমাটালো ভাঙনমূলক অযথাই।


***
[লেখাটি জীবনানন্দ-স্মরণে ক্ষণিক চিন্তার ঢেউয়ে রচিত]

বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০০৮

ক্রমশ নির্মীয়মান দৃশ্য কিংবা চরিত্রের গল্প

আচ্ছা, আচ্ছা।


আসো এইবার একটা গলপো বানাই আর পড়ি, পড়ি আর বানাই। আমি কদ্দুর ধরে রাখতে পারবো তার থেকেও বড়ো দায় তুমি, তোমরা কদ্দুর টেনে যেতে পারবা, বা কদ্দুর এক জায়গায় আটকে দাঁড়িয়ে পেনিট্রেইট করতে পারবা। তার মানে আমি এখানে চতুর শকুনির মতো প্যাসিভ-অ্যাগ্রেসিভ ভেক নিলাম। শুরু থেকেই সব খেলা তোমার। র‌্যাকেট-ব্যাট, জুতো-মোজা পরিয়ে তোমাকে নামিয়ে দিলাম। আমি খালি মাঠের কিউরেটর।


লোকে বলে গলপের শুরুতে খুব আকর্ষণীয় করতে হয়। বিজ্ঞাপিত করে দিতে হয়, মোড়কে মুড়িয়ে দিতে হয় শরীরকে। আর চিন্তা শেষটুক নিয়ে। মোড়ক খুলেই শিশুসুলভ আমরা জানতে চাই উপহারের ভিতর-সংবাদ! তো ঠিকাছে, শুরুটা আকর্ষণীয় করে দি। জনপদ অনেক বড়ো বিস্তৃত। তারচে' ছোট্ট বাসা অনেক ঘনোগহীন। ঢাকা শহরের গলি ঘুপচিতে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে তোমাকে একেবারে ফেলোপিয়ানের সফর করালাম, সেখানে একটা ডিম্বাশয়-সম বাসা। বাইরেটা রুক্ষ- ভিতরে টাইলস, ঝকঝকে তকতকে আরামের নীড়।


তো, এখন ক্যারেক্টার বানাতে হবে। হুঁ হুঁ বাবা, এবারে আমি আর কিউরেটর হয়ে থাকতে পারবো না। বাসা না হয় সিভিল কিম্বা আর্কি-পাশ কেউ বানালো, পেটমোটা ভুঁড়িওলা বাড়িওলাও বানায়ে দিলাম- কিন্তু চরিত্র, জলজ্যান্ত মানুষগুলো ক্যাম্বায় বানায়? পাঠকেরা একমতে পৌঁছুতে পারবে না জানি (কারণ বৈচিত্র্যময়তায় বন্দী আমরা!)। সেখানে কিউরেটর ঠিক করে দিক পিচের প্রকৃতি, তাই না?


গলাখাঁকারি দিয়ে নিই- প্রথমে একটা পুরুষ বানাই। হ্যাঁ পুরুষ, কারণ নারী বানানো এতো সোজা নয়। তাছাড়া পুরুষ পাঠকরা পূর্বানুমান করে নিবে যে আমি নারীকেন্দ্রিক গলপো বানাচ্ছি, সেখানে শিশ্ন নেতিয়ে পড়ার মতো বিপন্নতা বা সজাগ হবার মতো উচ্ছ্বাস তৈরি হতে পারে। তাতে গলপো পুরোপুরি লিঙ্গানুগ-বিধেয়তে আটকে যাবে বলে আমি পুরুষই বানালাম। এখন নাম দিতে হইবেক। এই তো মামু (এটা খুবই নিরীহ সম্বোধন! কোনও পাঠক নিজেকে অফেন্ডেড ভাবতে পারে, ইচ্ছা করেই। তাতে পরের গলপো তাহার ভাগিনা-রচিত ধরে নিতে সমস্যা হইলেও আমার কিছুই করার নাই।), আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলে! নামকরণে আমি খুবই কাঁচা। গলপো বানানো না হয় কোন না কোনওভাবে তোমাগো ঘাড়ে চাপাইছি, নাম তো আর তোমরা দিবা না। ঠিকাছে ঠিকাছে, আমি তাহলে আগ-বাড়ায়া ঠিক করে ফেলি যে মূল চরিত্রের একটা "আমি"। তাতে বিবিধ লাভঃ কোন নাম দেয়ার ঝামেলা হলো না, নিজের স্ব-রতিমূলক স্বভাবটাও বেশ খেলাইতে পারলাম, আর তোমরাও নিজেদেরকে "আমি"-স্থলে বসিয়ে বসিয়ে স্বাদ নিতে পারবা!


এবারে একঘেঁয়ে সুর ছেড়ে একটু তালবদল করি। একটা নারী চরিত্র নিয়ে আসি। তবে তাকে আর নামহীন রাখা যাবে না। সেখানে বরং নাম দেয়াটাই গলপের জন্য লাভবাচক। কী নাম দেয়া যায়? একটা নামে তো অনেক কিছুই বুঝে নেয়া যায়- সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সঙ্গতি বা সামর্থ্য, অনেক সময় কোন সময়ের চরিত্র সেটা দশক ধরে বলে দেয়া যায়। তবে পাঠকেরা বিরক্ত হবার আগেই একটা টেনে-রাখা নাম দিতে হবে, লৌহবাচক কোন কিছুকে চৌম্বকবল যেভাবে টানে- সেরকম। আচ্ছা নাম দিলাম "ঐন্দ্রিলা"। বাহ বাহ বেশ নাম। নামের মধ্যেই মেয়েটির কামনা, বাসনা, চাহনি, চুল সব ভেসে উঠছে, না? বেশ দারুন মেয়েটি। চোখ মুখ বাদ দিলাম, শরীরে আসি, বায়বীয় অনুভূতি উড়ে গেলে শুন্যস্থানই গুরুত্বপূর্ণ! শরীরের কথায় ৩৪২৬৩৬ চলে আসে। শরীরে ঝুলানো উঠে উঠে আসা সালোয়ার চলে আসে। শরীরে শিফন ওড়না আর রূপালি স্কার্ফ চলে আসে। শরীরে এমন কি খয়েরি কাঠের বালা, গোলাপি লিপস্টিক, অন্তর্বাস চলে আসে। শুধু আদিঅকৃত্রিম শরীরটাই আসে না। পরত পরত লেবাস-রূপবর্ধক-শ্যাম্পু-জেল-মেকাপে শরীরত্বক ঢেকে যায়। আমি ত্বকও খুলে ফেলতে চাই ঐন্দ্রিলার। ত্বকের নিচে মাংস, হাড়ের নিচের মজ্জাও ফেলে দিতে চাই। তারপরে কিছু কি বাকি থাকবে? মন? মনন? হৃদয়?


এবারে গলপো জমতে গিয়ে ঝুলে গেল। ওফ্‌, আবারও সেই পুরোনো হৃদয়ভিত্তিক আলোচনা। তবে আমরা গলপে ঢোকার সময়েই ঠিক করেছি এতে বায়বীয়তার বর্জন ঘটাতে হবে। সেজন্য আমরা আমি-কে বেশ নপুংসক করে দিই। সারাজীবনে সে কিছুই পায় নাই, কিছুই ঘটায় নাই। অর্জন আর কীর্তি বাদ দিলে কিছুই থাকে না আমাদের। তাহলে নপুংসক কাউকে চেনা যাবে অবয়ব দিয়ে। মুশকিল হলো "আমি"-র তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য অবয়ব নাই। কিন্তু তাহার রিপু আছে। প্রবল প্রতাপী পরিষ্কার রিপু। রিপুসকল তাকে দোলায়, গলায়, এমনকি জমাট বাঁধতেও সাহায্য করে!


আমার সাথে ঐন্দ্রিলার দেখা করানোর জন্যে কোনও বিদঘুটে কাকতালীয় ঘটনার আমরা অবতারণা না ঘটাই! ধরে নেই আমরা একে অপরকে চিনি। কোন না কোন বন্ধু-সমাবেশ-আড্ডা বা চেনা-পরিচিত আত্মীয়ের বাসায় তাদের দেখা হয়েছে, টুকটাক কথা হয়েছে। এমন মাপবিশিষ্ট চুল-চর্ম নারীর সাথে অর্জনহীন আমার এভাবে 'দেখা হইলো', আবার 'কথাও হইলো' এটা অবাস্তব লাগতে পারে। তাই কথা হওয়ার ঘটনাটা বলিঃ আমার আসলে একটা আড্ডা বা আত্মীয়ের বাসায় বসে থাকতে থাকতে বোরিং লাগতেছিলো, বারান্দায় গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বাইরে দেখছিলাম ১৭তলা নিচে মানুষেরা কেমন পিলপিলিয়ে হাঁটছে, চারপাশে তাদেরকে রিকশা আর গাড়িগুলো ছেঁকে ধরছে। ফেলোপিয়ানে চলাচলকারী শুক্রাণুসব! দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম বারান্দায় আমি ছাড়াও আরেকজন এসেছে। মুখ-চেনার কারণে মুখে একটা স্মিতহাসি ঝুলিয়ে দিলো সে। আমিও ক্যাচ ধরে রিটার্নে আরেকটা লোফা বল ঠেলে দিলাম।


পরস্পর কয়েক মুহুর্ত চুপ থাকলে সে হয়তো বুঝতে পারে আমি নীরব থাকবো ভেবে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু সে সম্ভবত শোরগোল এড়িয়ে এখানে এসেও নৈঃশব্দ্য পছন্দ করছে না। কথা শুরু হলেও ঠিক গতি পাচ্ছিলো না, দায়সারা সামাজিকতার টুংটাং সেরে আমরা আবার নীরব হয়ে পড়তে পড়তেই ঐন্দ্রিলার ফোন বেজে উঠলো। ঈষৎ গাঢ়স্বরে তার কথাগুলো শুনে আর কথা বলার সময়ে তার সন্তর্পণে চুল কানের-পেছনে-ঠেলে-দেয়া দেখে আমি একটু সিদ্ধান্ত নেই যে ফোনের ওপাশে তার হৃদয়পুরের মানুষ।


এমন হঠকারী চকিত সিদ্ধান্ত আমি প্রায়ই নিয়ে থাকি। এবং দ্রুত নিয়ে ফেলা সিদ্ধান্তে অনড় থাকার প্রবল চেষ্টা করতে করতে আমি অন্যান্য সম্ভাব্য সিদ্ধান্তগুলোর ফলপ্রসূতা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। ঐন্দ্রিলার বেলাতেও তাই ঘটলো। আমি টের পাচ্ছিলাম যে যেহেতু আমি এই মঞ্চে নপুংসক এবং নিতান্তই ধীরজ, সেহেতু সুন্দরী এবং কমনীয় বাক-উৎসাহী নারীটিকে একজন সাথী দিতে হবে। তাকে একই সাথে পৌরুষোদ্দীপ্ত এবং চৌকস এবং সন্দেহপরায়ণ হতে হবে। ফোনালাপ হুট করেই শেষ হওয়াতে আমার চিন্তায় বাধা পড়ে। একটু বিব্রতমুখে ঐন্দ্রিলা তাকালে আমি জিজ্ঞেস করি, "কোন ঝামেলা?" সাথে একটু অতি অমায়িক মুখোশ বজায় রাখতে, "অবশ্য সমস্যা হলে বলার দরকার নাই।"


এটা যে একটা ফেইক লাইন সেটা অন্তত ঐন্দ্রিলা জানে। যত সমস্যাই হোক সেটা আমার সাথে সে এখন ভাগ করবে কারণ বারান্দায় অনুজীবেরা ছাড়া আর একটা মানিপ্ল্যান্ট ছাড়া জীবিত বস্তু নাই।
"আসলে একটু সমস্যা হয়েছে। আমার বয়ফ্রেণ্ড আজকে আসতে পারছে না তো, তাই বলেছিল যেন আমি না যাই। কিন্তু আমার বন্ধুটি রাগ করবে ভেবে এসেছি। এখন ..."


ঠোঁটের ঈষৎ বেঁকে যাওয়া-টা টের পেলাম কথা বলা টাউন-বাসের মতোন থেমে যাওয়াতে। স্বরে অস্বস্তি।
বললাম, "ঠিকাছে, তো এখন চলে যান। বয়ফ্রেণ্ডের রাগ ভাঙান।"
"ও আসলে এরকম কখনো করে না, আজকে কী যে হলো!"
প্রগলভ মেয়েটা কি আমাকে ফ্রয়েড ঠাউরেছে? নাকি তার কাউন্সেলর? একটু ঠেশ দিয়ে বললাম, "কী-ই আর হবে! জেলাসি, অভিমান। বড়োজোর সন্দেহ বা রাগ! গিয়ে কথা বলেন, ঠিক হয়ে যাবে।"
ঐন্দ্রিলার ইতস্তত ভাব তবুও যায় না! "আপনি যদি একটু পৌঁছে দিতেন!"
"আমি?"
"আপনার সমস্যা হলে দরকার নেই।"
বাহ! আমার কথার এতো ত্বরিত ফেরত! মেয়েটা শার্প আছে।
আড্ডা ভালো দিচ্ছিলাম না। এমন আত্মীয়ও নয় যে অনেক রাত পর্যন্ত হা হা হে হে করে থাকতে হবে। আমি এই ঐন্দ্রিলার কথায় ঘুরে দাঁড়িয়ে সাথে যেতে উদ্যত হলাম। পথে বেরিয়ে রিকশা না সিএনজি কী নিবো জিজ্ঞেস করলে ঐন্দ্রিলার চকিত জবাব, "সিএনজি নেন"। আরো একটু ভাঙলো আগল, নাকি?


এই সিএনজি-তে উঠে আমাদের মধ্যে বেশ সহজিয়া কথোপকথন হতে থাকে। কী ভালো লাগে, কী খারাপ লাগে এগুলো পেরিয়ে আমরা ব্যক্তিগত হই। দূরত্ব বজায়ে রেখে কাছে আসার চেষ্টা করি।
আমার দেশের বাইরে যাবার ইচ্ছা নাই,
ঐন্দ্রিলা খুব ইলিশ-সর্ষে ভালবাসে,
আমি ঘুমকাতুরে এবং অলস,
ঐন্দ্রিলা এমবিএ করবে সামনে বছর।
এরকম নানা অপ্রয়োজনীয় তথ্যাদি আমাদের মাঝে চলাচল করতে থাকে ঐ ঘেরাটোপের সিএনজিতে। বাইরের গুমোটেও ফাঁকা রাস্তার বাতাসে আমার ফতুয়ার প্রান্ত আর ঐন্দ্রিলার ওড়না সামলাতে কষ্ট হয়।


তো, সেই ওভামসদৃশ বাসা ছেড়ে আমরা ঢাকার জরায়ু পেরিয়ে অনেকটা বাইরে উত্তরার দিকে চলে এলাম। সেখানে বড়োরাস্তা ছেড়ে ছোটরাস্তা, তারপর গলি, এদিক ওদিক, ডানে, ডানে, সামনে বামে করে করে আমরা একটা মেটাল দরজা লাগানো বাসায় এসে পৌঁছালাম। রাত বেড়ে দশটার কাছাকাছি। ঐন্দ্রিলার বয়ফ্রেণ্ডপ্রবর এখানে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। ওর সাবলীল সরণে আমি টের পাই যে এখানে যাতায়াত নিয়মিত । ভালো ভালো, যাতায়াত থাকতেই পারে। সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলা উঠতে হবে কারণ বাড়িওলা লিফট বানায়নি। এহেন নিষ্ঠুরতা আমার উপরে আর দেখাতে চায় না ঐন্দ্রিলা। তাই আমাকে ট্রু-ফল্‌স অপশন দেয়। বলে, "আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন।"
আমি জানি আমি যাবো না। আমার নপুংসক রিপুকুল আমাকে এখান থেকে যেতে দিবে না। যদিও ওগুলো না থাকলে এই এতরাতে শহর ঠেলে আমি অ্যাদ্দুর আসতাম না। বলি, না ঠিকাছে, আপনাকে তো ফিরতে হবে।"
"ওমা! আমাকে তো ও-ই পৌঁছে দিবে। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম।"
আমি বিরক্তিটুকু ঢেকে বলি, "আর ধুর এটা কোনও ব্যাপার না! চলেন দেখি।"
এভাবে বলার পরেও ঐন্দ্রিলা বারবার সাধাসাধি করতে থাকে। শেষে ভদ্রতার মুখোশ পরে আছি বলেই আমি বলি ঠিকাছে, আমি ফিরে যাচ্ছি। পরে জানায়েন কী হলো।"


যাহোক ঐন্দ্রিলা ভিতরে চলে যাবার পরেও আমি সিএনজি নিয়ে একটু দূরে গলির লেজে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি মেয়েটা কখন বের হয়! ঔৎসুক্যের চাইতেও উদ্বিগ্নতা সচল ছিলো বেশি। অপেক্ষার সময়টাকে আরেকটু দ্রুত কাটানোর জন্যেই হাতে সিগারেট আসে, লাইটার ধোঁয়া মিশিয়ে ফেলে আমি ওটা শেষ করেছি কি করি নাই, দেখি লোহার গেট ঠেলে ঐন্দ্রিলা বেরিয়ে আসছে। দ্রুত কোনও সম্মিলন শেষ হলে একটা চোরা-শঙ্কা জেগে ওঠে। আমি এগিয়ে দেখি ঐন্দ্রিলা লাশ হয়ে গেছে। চেহারা সাদাটে। খুব জোর থমথমে ঝড় চোখে জমে আছে। ওর পদক্ষেপে জড়ানো-তাল। "কী হয়েছে?"- এটা জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর ফেরত পাইনা আমি। বাকরহিত ঐন্দ্রিলাকে আমার আর পছন্দ হয় না। তারপরও, যেহেতু এই অর্থোডক্স রাতটা তার কারণে বদলে যাচ্ছে তাই আমি তৎপর হই। সিএনজিতে টেনে বসিয়ে দিই। ওর বাসার ঠিকানাটা জানতাম। তাই বলি, "ধানমণ্ডি চলেন।" পাশে ঐন্দ্রিলা কাঠ হয়ে বসে থাকে। মৃদু ঝাঁকুনিতেও তার সাড় আসে না। আমি দুয়েকবার চেষ্টা করি পুনরায় "কী হয়েছে?" শব্দগুচ্ছ ঠেলে দিয়ে। কিন্তু অভিমানী বিড়ালের মতোই ঐন্দ্রিলা মুখ ঘুরিয়ে নেয় । পাশে এরকম নিরুত্তর বসে থাকা ঐন্দ্রিলা রেখে আমি ফেরার পথে বাইরে চোখ রাখি। রাত এগারো ছুঁই ছুঁই, এয়ারপোর্ট রোডের পাশে খিলক্ষেত দেখে মনে হয় রেচননালী নিয়ে বৃক্ক পড়ে আছে। হঠাৎ লোডশেডিঙের ঝাপ্টায় টের পাই আবছা তীব্র আলো জ্বেলে আকাশে চাঁদ জেগে আছে।


মুহুর্তেই সব মিথ্যা হয়ে যায়। এই গলপো বানানো, চরিত্র বানানো, পটভূমি বানানো সব। এই আমি, এই ঐন্দ্রিলা, এই ফোনের ওপাশে তার পৌরুষ-বন্ধু সব। এমনকি মায় এই সিএনজিসুদ্ধা রাস্তাঘাটও কর্পুরের মত উবে যেতে থাকে। এই সন্ধ্যাটা আর রাতটা খালি জেগে থাকে। সেখানে ঐন্দ্রিলা আর আমি পাশাপাশি বিযুক্ত আর নির্বাক হয়ে ছুটে যেতে থাকি।

মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০০৮

পতিত নক্ষত্রদলও আমাদের চেয়ে একাকী


জারিত রূপোরঙা জলবুকে নদী, স্থির,
বিষন্ন সার্চলাইট পরশ বুলিয়ে খোঁজে পতিত নক্ষত্রদল
সচকিত পানসি থেকে
ঢেউদোলা আলো নিয়ে
চিকন চিৎকারে মাঝিপুত্র চিরে দেয় বাতাসের দেহ
উজানে স্মৃতি জমিয়ে
আমি ইস্টিমারে সুখেদের জমা রাখি।


জাতশোক ভুলে যাবার আগেই
নিদ্রাহীন সারেঙ
অবলীলায় তোমার মুখ তুলে আনে
নীলোসাদা আলোর মতন গাঢ় হয়ে জ্বলছো তুমি
আমি গালে শিশির মেখেও জেনে যাই,
কুয়াশা কাটলে এজীবন পুরোনো স্বপ্নের মতো
তোমাকে ভুলে নিভে যাবে।


পেছনে ফেনার দাগ মুছে যায়
মীনশরীর-
ফেনা জমছে নখাগ্রে আমিষগন্ধী নেলপলিশের মতো,
একাকী প্লাস্টিকের চেয়ার আর তার পাশে আমি বসে থাকি -


রাত
ঘন
হলে
দূরে
গভীরে
নিবিড়
হলো
বন


পানসি, শুশুক আর ধ্রুবতারাটি
আমাদের মতোই একাকী
সেখানে স্তুপাকার আলো- রঙিন আঁধারে
আমরা একা একা নিজেদের ঘিরে থাকি।