বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০০৮

ডাহুকপ্রেম

চলে যাবার আগে একটা ডাহুক বুকের ওমে, হাত মেলে
আমার জন্যে প্রার্থনা করেছিলো খুব।
আমি মুখ তুলতেই ঝাপ্টে তুমুল-
সে চলে গেছে।
চলে গেছে।


খুঁজতে যাই নাই- লাভ নাই জেনে;
মৃত হবার আগে ডাহুকেরা শাপ দিয়ে গেছে- অভিশাপ!


আমাদের রাতগুলো, দীর্ঘ আর দিনগুলো ঘামে ক্লান্ত হবে।


আমাদের শয়ন আর রমণগুলো, ক্লান্ত মিনার হয়ে ধ্বসে যাবে।


আমাদের নিটোল শৈশবস্মৃতি, জড়ানো ক্যাসেটের ফিতেয় লাশ লাশ হয়ে যাবে।


ডাহুক জানে না তার শাপে একঘুম ভেঙে জেগে গেছি
বাসা-দরজা খুলে গেলে পর্দায় কী আড়াল করে?
রোদ আর ডানা ভেঙে বসেই আছি
প্রবল চাপে পিষে যাবার আগে, মিশে যাবার আগে, শুধু, ডাহুকের একটা পালক চাই।

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০০৮

সায়াহ্নে শুয়োরের শীৎকার

সায়াহ্ন একটা কলসমুখ ব্যেপে উছলে গেলে দেখা যাক
তার নিচে কতটা লাল গোলাপাভা
গলনের সূত্রমতেই
তাপহর-; শোক হয়ে থাকে।
সিঁড়িঘর থেকে উত্থানে উন্মুখ সাতটা শুয়োর
তাদের রোঁয়া ফুলিয়ে
কাটা-নাকে রঙ মেখে দুদ্দাড় উঠে আসে।
আমাদের চলন স্থবির জেনেই শুয়োরপাল
খুব সহজে বিছানা-ঘর-রাজধানী চরে
সাম্রাজ্যে প্রসব করে।
প্রসব-আনন্দে প্রকাণ্ড শিশ্নধারী নেতাগণ
ব্লাডসাপ্লাইয়ে শক্ত খুঁটি আমাদের মুখে বুলিয়ে দেয়।

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০০৮

কবিতাপাঠের বায়োপ্‌সি

ইদানীং কবিতা বেশ রক্তে ঢুকে যাচ্ছে। অথবা রক্তে আগেই ঢুকে গিয়েছিল কোনও এক অসতর্ক মুহুর্তে, এখন নালী জুড়ে তার চলন টের পাচ্ছি। সেই চলনে অস্থিরতা নেই। এলিয়েন বস্তু শুনেছি- শরীর বেশিদিন টিঁকতে দেয়না, বের করে দেয়। আর বের করে দিতে না পারলে তার রিঅ্যাকশন শুরু হয় জ্বর-জারি, ইনফেকশন, অ্যালার্জি এসবের মধ্যে দিয়ে। তবে আশার কথা আমার শরীর এখনও কবিতাকে অতটা উটকো ভাবছে না। হয়তো কালের সাথে তার সহনশীলতাও বেড়েছে!


দীর্ঘ উপক্রমণিকার কারণ বলে নিই, এটা আসলে সততই আমার মধ্যে খেলা করছে। লেখালেখি গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছি অনেকটা সময় পরে এসে। সেখানে গুরুত্বটুকু প্রথমে শুধুই আত্মকেন্দ্রিক শখ বা সুখবিলাসজাত ছিল। কিন্তু যেহেতু ক্রিয়ার অপর পিঠেই প্রতিক্রিয়া জন্মায় ঈস্টের মতোন, সেহেতু আমার লেখাতেও নানান অনুভব তৈরি হয় আর আমার কাছে ফিরে আসে। তখন আসলে একটা আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়। ক্রমশ টের পাই, কবি আমি ছাড়িয়ে ব্যক্তি আমি জায়গা করে নিচ্ছি। সেটা পাঠককেও হয়তো আরো স্বচ্ছতা দিচ্ছে।


তবে এই মিথস্ক্রিয়ার মাঝে আমি এটাও টের পাই একটা ভিন্নসুর জেগে ওঠে। হয়তো মানব বৈচিত্র্যের কারণেই। সেখানে নিজের মতটাই প্রকাশ করার মাধ্যমে অংশ নিতে পারি। কবিতার ভাষা নিয়ে ফরহাদ উিদ্দন স্বপনের একটা পোস্ট দেখলাম। সেখানে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনায় আমি খেয়াল করিনি আগে বলে অংশ নিতে পারিনি। তবে সেই লেখাটিই কিছু কথা আমার ভেতর থেকে বের করে আনছে। সেগুলো একে একে বলি।


প্রথমেই লেখক-পাঠকের যোগাযোগের ক্ষেত্রটি নিয়ে কিছু কথা বলি। আমি যখন লেখক, তখন একটা কবিতা আমার হাত দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে অনেক জন্ম-প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যায়। সেটা এক এক কবির এক এক রকম। সেই প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ, সৃজনশীল লেখালেখির প্রতিটা ক্ষেত্রেই হয়তো তা খাটে। তবে অনেক জাদু দেখে যেমন মনে একটা প্রশ্ন জাগে জাদুর পেছনে রহস্যটা কী, তেমনি কবিতাপাঠের পরেও পাঠক হিসেবে অনেকেরই হয়তো মনে আসে, লেখক এই কবিতা কী ভেবে লিখেছেন? তার চিন্তা আর মস্তিষ্কে কী রসায়ন চলেছে? শব্দ আর পংক্তিগুলো দিয়ে তিনি কী বুঝিয়েছেন? এই স্বভাবিক প্রশ্নগুলোকে আমি একটু ভিন্ন চোখে দেখি।


আমি যেকোনও কবিতাকে মনে করি একটা চশমা-র মতোন। সে চশমার মধ্য দিয়ে কবি কিছু একটা দেখেছেন, লিখেছেন। সেই লেখাটি আমি পাঠক যখন পড়বো, আমি একটা বা ভিন্ন ভিন্ন কিছু দৃশ্য পাবো। আমার মধ্যে একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটা কতটুকু কবির সাথে মিললো, তা আমি কখনোই বিচার করতে যাবো না। তার পিছনে কারণ বহুবিধ। কবির চিন্তার পাটাতন আর আমার চিন্তার পাটাতন এক হবার কোন কারণ বা সুযোগ নাই। আবার আমার দেখনভঙ্গি কবির চেয়ে স্বতন্ত্র হোক এটাও আমি চাইবো।


এই দেখাটা জরুরি। বা এই মনোভাবটা কবিতার উদ্দেশ্য পূরণে পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি। পাঠকের উদ্যোগ এক্ষেত্রে লেখকের চাইতেও বেশি।


সমসাময়িক একটা বিষয় চলে আসে। কোন কবিতাকে বিচার করার বা পাঠ করার ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি বিভাগ করে ফেলিঃ ভালো, খারাপ, মন্দ, নতুন, ফালতু, চমৎকার, অপ-, কু- ইত্যাদি নানান বিশেষণ, প্রত্যয় যোগ করে। এটা নিয়ে এখানে একটা মোটামুটি তোলপাড়ও চলেছে কিছুদিন আগে। তবে সেটা অন্য কথা।


এখানে এই বিভাগকরনের বিপক্ষে অনেককিছুই বলা যায়। আবার পক্ষেও অনেক কিছু টেনে আনা যায়। তবে আমি এই স্বতস্ফূর্ত শ্রেণীবিভাগের কারণটি বের করতে একটু তৎপর হই। জিজ্ঞাসার পেছনে উত্তরটা অনেকটাই এসে পড়ে এরকম যে আমরা কোনকিছু, সেটা যে রচনাই হোক না কেন, তাকে বিশেষায়িত করতে পারলে স্বস্তিবোধ করি। একটা ফরম্যাট দাঁড়িয়ে গেছে বা দাঁড় করানো হয়েছেঃ গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, ছড়া এরকমের কিছু প্রধানভাগ; অণু-পরমাণু-বড়-ছোট এরকম শব্দ প্রধানভাগের আগে জুড়ে দিয়ে সেকেন্ডারি ভাগ; তারপরেও আরো নানা রকম ভাগ করা হচ্ছে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে।


কবিতার জন্যে সেই ভাগ দশকভিত্তিক, শতকভিত্তিক হয়ে থাকে। রোমান্টিক, আধুনিক, উত্তরাধুনিক এরকম হয়ে থাকে। আবার নানা মতবাদ ভিত্তিকও হয়ে থাকে। এতোদূর যারা পড়ে ফেলেছেন, তারা যেমন, তেমনি আমি নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছি। সংজ্ঞাভারে মাথা নুয়ে আসছে, কাঁধ ব্যথা করছে, চোখ জ্বলছে এবং কান ভোঁভোঁ করছে। আর সব পাঠকের মতোন আমিও এই সবকিছু জঞ্জাল হিসেবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাই। কী দরকার অনর্থক বিভক্তির? একটা কবিতা, তা সে যেমনই হোক না কেন, যার দ্বারাই লিখিত হোক না কেন, সেটা শেষপর্যন্ত একটা কবিতাই! সেই কবিতার কোনও বাস্তব উপযোগ নাই, কর্মসম্পাদনে সহায়কও নয় কবিতা। নেহায়েত কোনও গূঢ় "পেছনের কথা" না থাকলে সেটা আদৌ কোন অর্থবোধকও হয় না।


তাহলে আমি একজন পাঠক হিসেবে কি কবিতাপাঠ করতে পারি? যদি পারি, তাহলে তা কতটা দরকারি? বা কবিতা নিজে আমাকে কতটা তার পাঠক হিসেবে গ্রহণ করবে সেটাও আনুষঙ্গিক প্রশ্ন। আমি মনে করি একজন গল্প বা প্রবন্ধপাঠকের চেয়ে কবিতা পাঠককে অনেক বেশি মাত্রাসম্পন্ন হতে হয়। সেখানে তার জন্যে কিছু সংবেদনশীলতা স্বভাবতই কবিতা দাবি করে। সেকারণেই কোনও দ্রুত প্রকরণেও যেতে চাইনা। ঘুরে ফিরে সেই প্রথম কথাটুকুর কার্যকারণ বের করে ফেলতে পারি। শরীরে মননে আসলেই কবিতা বিস্তারী ভালোবাসার মতোন ছড়িয়ে পড়ছে।


***
[ছাড়া ছাড়াভাবে কিছু কথা বেশ অনেকদিন বা কিছুদিন ধরে জমেছে। সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত না করলে অস্বস্তিবোধ... এবং ক্রমান্বয়ে অস্থিরতা। সে অস্থিরতার গলা টিপতেই এই লেখা!]

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০০৮

রেট্রোস্পেকটিভ

শায়িত বিলবোর্ডে শুয়ে আছে সে
ক্লান্ত শরীরেও কী তীব্র জ্বলে দু'চোখ
আর একভেদী ঝলক জেগে থাকে।


ব্যানার ঝুলানো বারান্দায় কেউ নেই নেই
ভেতরে নীলাভ কৌণিকালো চোঙা ফুঁড়ে বিপ্লব-
কিংবা শয়তান মেখে উৎকট।
দস্‌তয়ভোস্‌কি তলোস্‌তয় প্রমুখ
হেঁটমাথা, হাতের কড়েতে গুনে নেন
লোহা চেয়ারে ফেলে রাখা টিকেটসংখ্যা।


ঘন্টাকতক পরে শীতাতপ থামিয়ে
চোঙা নিভে সাধারন আলো জ্বেলে দিলে
পেছনসারি থেকে দু'জোড়া পায়রা
ডানাঝাপ্টে উড়ে যায়।


ফিরে তাকানোয় খানিক ক্লান্তি, খানিক মরাশ্বাস মিশে যেতে পারে।

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০০৮

একটা সন্ধ্যা আমাদেরও ছিল

বিকেল পড়ে আসার আগেই সুবাসিত রিংটোন
আহ্বানে আনন্দ ছিলো, স্বর শুনে আগ্রহ আমার
কাজেরাও ছুটি নিতে চায়-


সন্ধ্যার কোনও রাগ নেই আমার ওপরে,
জেগে উঠেও সে বেশ অমায়িক- হেসে দেয়
আমি শহরটাকে মুড়ে নিই বাদামি প্যাকেটে
সাথে নীলফিতে রিবন আর হলদেরাঙাফুল।


ওপাশে দোকান পসরা পেরিয়ে একটু এগিয়ে আমি
বহুচেনা কারও কারও দেখা পাই
গতি-মন্থরতা, স্থবিরতা প্রায়শই আরাম দেয়


হাসি আর কণ্ঠসুরে ক্রমশ
পরকীয়া, সুশীলতা, ক্লান্তি আর তীব্রতা
নিরূপিত হতে থাকে,
সময় হিসেবে রাত ঘন হয়
আমরাও কিছুটা গাঢ় হই ধীরে।


ফিরে এসেও জেনেছি ওখানে কাঠের বেঞ্চ, প্রভূত বিস্ময় নিয়ে জেগে আছে।

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০০৮

ইশকুল, ফ্লুরোসেন্ট ও রোদসঙ্গম;

ফ্লুরোসেন্ট


স্টেডিয়াম পেট চিরে দুজন বেরিয়ে এলাম
তুমিয়ামি বেশ গাঢ় হয়ে হাঁটি
পা মেলেনা, মাঝের দুরত্বটাও বাড়ে, কমে
তবে রচিত-পথ
ফ্লুরোসেন্ট সৌরভ মেখে তীর্যক দাঁড়িয়ে
সেখানে রিকশাও রূপবতী হয়ে যায়।






ইশকুল


সারবাঁধা দেশলাই-সব,
স্কুলগামী ভ্যানে চড়ে ঝাঁকি খেতে খেতে
ভাঙাচোরা মিউনিসিপ্যাল্‌টি পেরিয়ে,
কাশবন ঘিরে বসে পড়ে।
ঘাসেরাও সেখানে মাথা-উঁচু করে
শতবর্ষী বটের গায়ে চকবোর্ড থেকে
কষ্ট করে লেখাগুলো তোলে,
গুটি গুটি পিঁপড়া-অক্ষরে।






রোদসঙ্গম;


রোদ হেসে দৌড়ে কপাটি দিয়ে
মেঘের সাথে
শুয়ে পড়লে
অভিমানে নদ খুব জোরালো আওয়াজে জেগে ওঠে
উদ্দাম সঙ্গমে
মেঘের শরীরে
টান টান সুখ
জমা পড়ে
গ্রীকাক্ষর সন্তর্পণে এলোমেলো হয়ে যায়।

শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০০৮

আজ কোন কবিতা লেখা হবে না আমার

আজ কোন কবিতা লেখা হবে না আমার।


প্রকাণ্ড বাসর ভেঙে নববধূ বেরিয়ে আসা অলক্ষুণে!


তারাজ্বলা রাত নেমেছিল
সাথে ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ অথবা মঠের পণ্ডিতও বসে ছিল হয়তো
সবার অলক্ষ্যে বিশ পেরুনো শরীর নিয়ে সে
চলে গেলো নদীধারে


সেখানে জানালা-গলা রোদ ঘুমিয়ে ছিল
সাথে মর্ষকামী বিড়াল আর হাতুড়ে হৃদয়
নিয়ে জেলে বসেছিল
প্রত্যেকের কোলে রাখা নিজস্ব চাঁদ
নিজস্ব রঙমেশা শায়িত প্রভাত


কিন্তু এমন চলে যাওয়াতে
আমার কেন ঘুম হবে না?
কেন ফিরে যেতে যেতেও স্মৃতি জ্বলবে অহর্নিশ।
প্রস্থান তো কখনও স্মরণরহিত নয়-
কাঁধ ছুয়ে রাত বিদায় নিলেও
চারপাশের বাস্তব তাকে ঘিরে রবেই


আমি অনেক দূরে থেকেও বুঝে নিতে পারি
জমাটালো ভাঙনমূলক অযথাই।


***
[লেখাটি জীবনানন্দ-স্মরণে ক্ষণিক চিন্তার ঢেউয়ে রচিত]

বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০০৮

ক্রমশ নির্মীয়মান দৃশ্য কিংবা চরিত্রের গল্প

আচ্ছা, আচ্ছা।


আসো এইবার একটা গলপো বানাই আর পড়ি, পড়ি আর বানাই। আমি কদ্দুর ধরে রাখতে পারবো তার থেকেও বড়ো দায় তুমি, তোমরা কদ্দুর টেনে যেতে পারবা, বা কদ্দুর এক জায়গায় আটকে দাঁড়িয়ে পেনিট্রেইট করতে পারবা। তার মানে আমি এখানে চতুর শকুনির মতো প্যাসিভ-অ্যাগ্রেসিভ ভেক নিলাম। শুরু থেকেই সব খেলা তোমার। র‌্যাকেট-ব্যাট, জুতো-মোজা পরিয়ে তোমাকে নামিয়ে দিলাম। আমি খালি মাঠের কিউরেটর।


লোকে বলে গলপের শুরুতে খুব আকর্ষণীয় করতে হয়। বিজ্ঞাপিত করে দিতে হয়, মোড়কে মুড়িয়ে দিতে হয় শরীরকে। আর চিন্তা শেষটুক নিয়ে। মোড়ক খুলেই শিশুসুলভ আমরা জানতে চাই উপহারের ভিতর-সংবাদ! তো ঠিকাছে, শুরুটা আকর্ষণীয় করে দি। জনপদ অনেক বড়ো বিস্তৃত। তারচে' ছোট্ট বাসা অনেক ঘনোগহীন। ঢাকা শহরের গলি ঘুপচিতে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে তোমাকে একেবারে ফেলোপিয়ানের সফর করালাম, সেখানে একটা ডিম্বাশয়-সম বাসা। বাইরেটা রুক্ষ- ভিতরে টাইলস, ঝকঝকে তকতকে আরামের নীড়।


তো, এখন ক্যারেক্টার বানাতে হবে। হুঁ হুঁ বাবা, এবারে আমি আর কিউরেটর হয়ে থাকতে পারবো না। বাসা না হয় সিভিল কিম্বা আর্কি-পাশ কেউ বানালো, পেটমোটা ভুঁড়িওলা বাড়িওলাও বানায়ে দিলাম- কিন্তু চরিত্র, জলজ্যান্ত মানুষগুলো ক্যাম্বায় বানায়? পাঠকেরা একমতে পৌঁছুতে পারবে না জানি (কারণ বৈচিত্র্যময়তায় বন্দী আমরা!)। সেখানে কিউরেটর ঠিক করে দিক পিচের প্রকৃতি, তাই না?


গলাখাঁকারি দিয়ে নিই- প্রথমে একটা পুরুষ বানাই। হ্যাঁ পুরুষ, কারণ নারী বানানো এতো সোজা নয়। তাছাড়া পুরুষ পাঠকরা পূর্বানুমান করে নিবে যে আমি নারীকেন্দ্রিক গলপো বানাচ্ছি, সেখানে শিশ্ন নেতিয়ে পড়ার মতো বিপন্নতা বা সজাগ হবার মতো উচ্ছ্বাস তৈরি হতে পারে। তাতে গলপো পুরোপুরি লিঙ্গানুগ-বিধেয়তে আটকে যাবে বলে আমি পুরুষই বানালাম। এখন নাম দিতে হইবেক। এই তো মামু (এটা খুবই নিরীহ সম্বোধন! কোনও পাঠক নিজেকে অফেন্ডেড ভাবতে পারে, ইচ্ছা করেই। তাতে পরের গলপো তাহার ভাগিনা-রচিত ধরে নিতে সমস্যা হইলেও আমার কিছুই করার নাই।), আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলে! নামকরণে আমি খুবই কাঁচা। গলপো বানানো না হয় কোন না কোনওভাবে তোমাগো ঘাড়ে চাপাইছি, নাম তো আর তোমরা দিবা না। ঠিকাছে ঠিকাছে, আমি তাহলে আগ-বাড়ায়া ঠিক করে ফেলি যে মূল চরিত্রের একটা "আমি"। তাতে বিবিধ লাভঃ কোন নাম দেয়ার ঝামেলা হলো না, নিজের স্ব-রতিমূলক স্বভাবটাও বেশ খেলাইতে পারলাম, আর তোমরাও নিজেদেরকে "আমি"-স্থলে বসিয়ে বসিয়ে স্বাদ নিতে পারবা!


এবারে একঘেঁয়ে সুর ছেড়ে একটু তালবদল করি। একটা নারী চরিত্র নিয়ে আসি। তবে তাকে আর নামহীন রাখা যাবে না। সেখানে বরং নাম দেয়াটাই গলপের জন্য লাভবাচক। কী নাম দেয়া যায়? একটা নামে তো অনেক কিছুই বুঝে নেয়া যায়- সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সঙ্গতি বা সামর্থ্য, অনেক সময় কোন সময়ের চরিত্র সেটা দশক ধরে বলে দেয়া যায়। তবে পাঠকেরা বিরক্ত হবার আগেই একটা টেনে-রাখা নাম দিতে হবে, লৌহবাচক কোন কিছুকে চৌম্বকবল যেভাবে টানে- সেরকম। আচ্ছা নাম দিলাম "ঐন্দ্রিলা"। বাহ বাহ বেশ নাম। নামের মধ্যেই মেয়েটির কামনা, বাসনা, চাহনি, চুল সব ভেসে উঠছে, না? বেশ দারুন মেয়েটি। চোখ মুখ বাদ দিলাম, শরীরে আসি, বায়বীয় অনুভূতি উড়ে গেলে শুন্যস্থানই গুরুত্বপূর্ণ! শরীরের কথায় ৩৪২৬৩৬ চলে আসে। শরীরে ঝুলানো উঠে উঠে আসা সালোয়ার চলে আসে। শরীরে শিফন ওড়না আর রূপালি স্কার্ফ চলে আসে। শরীরে এমন কি খয়েরি কাঠের বালা, গোলাপি লিপস্টিক, অন্তর্বাস চলে আসে। শুধু আদিঅকৃত্রিম শরীরটাই আসে না। পরত পরত লেবাস-রূপবর্ধক-শ্যাম্পু-জেল-মেকাপে শরীরত্বক ঢেকে যায়। আমি ত্বকও খুলে ফেলতে চাই ঐন্দ্রিলার। ত্বকের নিচে মাংস, হাড়ের নিচের মজ্জাও ফেলে দিতে চাই। তারপরে কিছু কি বাকি থাকবে? মন? মনন? হৃদয়?


এবারে গলপো জমতে গিয়ে ঝুলে গেল। ওফ্‌, আবারও সেই পুরোনো হৃদয়ভিত্তিক আলোচনা। তবে আমরা গলপে ঢোকার সময়েই ঠিক করেছি এতে বায়বীয়তার বর্জন ঘটাতে হবে। সেজন্য আমরা আমি-কে বেশ নপুংসক করে দিই। সারাজীবনে সে কিছুই পায় নাই, কিছুই ঘটায় নাই। অর্জন আর কীর্তি বাদ দিলে কিছুই থাকে না আমাদের। তাহলে নপুংসক কাউকে চেনা যাবে অবয়ব দিয়ে। মুশকিল হলো "আমি"-র তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য অবয়ব নাই। কিন্তু তাহার রিপু আছে। প্রবল প্রতাপী পরিষ্কার রিপু। রিপুসকল তাকে দোলায়, গলায়, এমনকি জমাট বাঁধতেও সাহায্য করে!


আমার সাথে ঐন্দ্রিলার দেখা করানোর জন্যে কোনও বিদঘুটে কাকতালীয় ঘটনার আমরা অবতারণা না ঘটাই! ধরে নেই আমরা একে অপরকে চিনি। কোন না কোন বন্ধু-সমাবেশ-আড্ডা বা চেনা-পরিচিত আত্মীয়ের বাসায় তাদের দেখা হয়েছে, টুকটাক কথা হয়েছে। এমন মাপবিশিষ্ট চুল-চর্ম নারীর সাথে অর্জনহীন আমার এভাবে 'দেখা হইলো', আবার 'কথাও হইলো' এটা অবাস্তব লাগতে পারে। তাই কথা হওয়ার ঘটনাটা বলিঃ আমার আসলে একটা আড্ডা বা আত্মীয়ের বাসায় বসে থাকতে থাকতে বোরিং লাগতেছিলো, বারান্দায় গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বাইরে দেখছিলাম ১৭তলা নিচে মানুষেরা কেমন পিলপিলিয়ে হাঁটছে, চারপাশে তাদেরকে রিকশা আর গাড়িগুলো ছেঁকে ধরছে। ফেলোপিয়ানে চলাচলকারী শুক্রাণুসব! দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম বারান্দায় আমি ছাড়াও আরেকজন এসেছে। মুখ-চেনার কারণে মুখে একটা স্মিতহাসি ঝুলিয়ে দিলো সে। আমিও ক্যাচ ধরে রিটার্নে আরেকটা লোফা বল ঠেলে দিলাম।


পরস্পর কয়েক মুহুর্ত চুপ থাকলে সে হয়তো বুঝতে পারে আমি নীরব থাকবো ভেবে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু সে সম্ভবত শোরগোল এড়িয়ে এখানে এসেও নৈঃশব্দ্য পছন্দ করছে না। কথা শুরু হলেও ঠিক গতি পাচ্ছিলো না, দায়সারা সামাজিকতার টুংটাং সেরে আমরা আবার নীরব হয়ে পড়তে পড়তেই ঐন্দ্রিলার ফোন বেজে উঠলো। ঈষৎ গাঢ়স্বরে তার কথাগুলো শুনে আর কথা বলার সময়ে তার সন্তর্পণে চুল কানের-পেছনে-ঠেলে-দেয়া দেখে আমি একটু সিদ্ধান্ত নেই যে ফোনের ওপাশে তার হৃদয়পুরের মানুষ।


এমন হঠকারী চকিত সিদ্ধান্ত আমি প্রায়ই নিয়ে থাকি। এবং দ্রুত নিয়ে ফেলা সিদ্ধান্তে অনড় থাকার প্রবল চেষ্টা করতে করতে আমি অন্যান্য সম্ভাব্য সিদ্ধান্তগুলোর ফলপ্রসূতা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। ঐন্দ্রিলার বেলাতেও তাই ঘটলো। আমি টের পাচ্ছিলাম যে যেহেতু আমি এই মঞ্চে নপুংসক এবং নিতান্তই ধীরজ, সেহেতু সুন্দরী এবং কমনীয় বাক-উৎসাহী নারীটিকে একজন সাথী দিতে হবে। তাকে একই সাথে পৌরুষোদ্দীপ্ত এবং চৌকস এবং সন্দেহপরায়ণ হতে হবে। ফোনালাপ হুট করেই শেষ হওয়াতে আমার চিন্তায় বাধা পড়ে। একটু বিব্রতমুখে ঐন্দ্রিলা তাকালে আমি জিজ্ঞেস করি, "কোন ঝামেলা?" সাথে একটু অতি অমায়িক মুখোশ বজায় রাখতে, "অবশ্য সমস্যা হলে বলার দরকার নাই।"


এটা যে একটা ফেইক লাইন সেটা অন্তত ঐন্দ্রিলা জানে। যত সমস্যাই হোক সেটা আমার সাথে সে এখন ভাগ করবে কারণ বারান্দায় অনুজীবেরা ছাড়া আর একটা মানিপ্ল্যান্ট ছাড়া জীবিত বস্তু নাই।
"আসলে একটু সমস্যা হয়েছে। আমার বয়ফ্রেণ্ড আজকে আসতে পারছে না তো, তাই বলেছিল যেন আমি না যাই। কিন্তু আমার বন্ধুটি রাগ করবে ভেবে এসেছি। এখন ..."


ঠোঁটের ঈষৎ বেঁকে যাওয়া-টা টের পেলাম কথা বলা টাউন-বাসের মতোন থেমে যাওয়াতে। স্বরে অস্বস্তি।
বললাম, "ঠিকাছে, তো এখন চলে যান। বয়ফ্রেণ্ডের রাগ ভাঙান।"
"ও আসলে এরকম কখনো করে না, আজকে কী যে হলো!"
প্রগলভ মেয়েটা কি আমাকে ফ্রয়েড ঠাউরেছে? নাকি তার কাউন্সেলর? একটু ঠেশ দিয়ে বললাম, "কী-ই আর হবে! জেলাসি, অভিমান। বড়োজোর সন্দেহ বা রাগ! গিয়ে কথা বলেন, ঠিক হয়ে যাবে।"
ঐন্দ্রিলার ইতস্তত ভাব তবুও যায় না! "আপনি যদি একটু পৌঁছে দিতেন!"
"আমি?"
"আপনার সমস্যা হলে দরকার নেই।"
বাহ! আমার কথার এতো ত্বরিত ফেরত! মেয়েটা শার্প আছে।
আড্ডা ভালো দিচ্ছিলাম না। এমন আত্মীয়ও নয় যে অনেক রাত পর্যন্ত হা হা হে হে করে থাকতে হবে। আমি এই ঐন্দ্রিলার কথায় ঘুরে দাঁড়িয়ে সাথে যেতে উদ্যত হলাম। পথে বেরিয়ে রিকশা না সিএনজি কী নিবো জিজ্ঞেস করলে ঐন্দ্রিলার চকিত জবাব, "সিএনজি নেন"। আরো একটু ভাঙলো আগল, নাকি?


এই সিএনজি-তে উঠে আমাদের মধ্যে বেশ সহজিয়া কথোপকথন হতে থাকে। কী ভালো লাগে, কী খারাপ লাগে এগুলো পেরিয়ে আমরা ব্যক্তিগত হই। দূরত্ব বজায়ে রেখে কাছে আসার চেষ্টা করি।
আমার দেশের বাইরে যাবার ইচ্ছা নাই,
ঐন্দ্রিলা খুব ইলিশ-সর্ষে ভালবাসে,
আমি ঘুমকাতুরে এবং অলস,
ঐন্দ্রিলা এমবিএ করবে সামনে বছর।
এরকম নানা অপ্রয়োজনীয় তথ্যাদি আমাদের মাঝে চলাচল করতে থাকে ঐ ঘেরাটোপের সিএনজিতে। বাইরের গুমোটেও ফাঁকা রাস্তার বাতাসে আমার ফতুয়ার প্রান্ত আর ঐন্দ্রিলার ওড়না সামলাতে কষ্ট হয়।


তো, সেই ওভামসদৃশ বাসা ছেড়ে আমরা ঢাকার জরায়ু পেরিয়ে অনেকটা বাইরে উত্তরার দিকে চলে এলাম। সেখানে বড়োরাস্তা ছেড়ে ছোটরাস্তা, তারপর গলি, এদিক ওদিক, ডানে, ডানে, সামনে বামে করে করে আমরা একটা মেটাল দরজা লাগানো বাসায় এসে পৌঁছালাম। রাত বেড়ে দশটার কাছাকাছি। ঐন্দ্রিলার বয়ফ্রেণ্ডপ্রবর এখানে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। ওর সাবলীল সরণে আমি টের পাই যে এখানে যাতায়াত নিয়মিত । ভালো ভালো, যাতায়াত থাকতেই পারে। সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলা উঠতে হবে কারণ বাড়িওলা লিফট বানায়নি। এহেন নিষ্ঠুরতা আমার উপরে আর দেখাতে চায় না ঐন্দ্রিলা। তাই আমাকে ট্রু-ফল্‌স অপশন দেয়। বলে, "আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন।"
আমি জানি আমি যাবো না। আমার নপুংসক রিপুকুল আমাকে এখান থেকে যেতে দিবে না। যদিও ওগুলো না থাকলে এই এতরাতে শহর ঠেলে আমি অ্যাদ্দুর আসতাম না। বলি, না ঠিকাছে, আপনাকে তো ফিরতে হবে।"
"ওমা! আমাকে তো ও-ই পৌঁছে দিবে। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম।"
আমি বিরক্তিটুকু ঢেকে বলি, "আর ধুর এটা কোনও ব্যাপার না! চলেন দেখি।"
এভাবে বলার পরেও ঐন্দ্রিলা বারবার সাধাসাধি করতে থাকে। শেষে ভদ্রতার মুখোশ পরে আছি বলেই আমি বলি ঠিকাছে, আমি ফিরে যাচ্ছি। পরে জানায়েন কী হলো।"


যাহোক ঐন্দ্রিলা ভিতরে চলে যাবার পরেও আমি সিএনজি নিয়ে একটু দূরে গলির লেজে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি মেয়েটা কখন বের হয়! ঔৎসুক্যের চাইতেও উদ্বিগ্নতা সচল ছিলো বেশি। অপেক্ষার সময়টাকে আরেকটু দ্রুত কাটানোর জন্যেই হাতে সিগারেট আসে, লাইটার ধোঁয়া মিশিয়ে ফেলে আমি ওটা শেষ করেছি কি করি নাই, দেখি লোহার গেট ঠেলে ঐন্দ্রিলা বেরিয়ে আসছে। দ্রুত কোনও সম্মিলন শেষ হলে একটা চোরা-শঙ্কা জেগে ওঠে। আমি এগিয়ে দেখি ঐন্দ্রিলা লাশ হয়ে গেছে। চেহারা সাদাটে। খুব জোর থমথমে ঝড় চোখে জমে আছে। ওর পদক্ষেপে জড়ানো-তাল। "কী হয়েছে?"- এটা জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর ফেরত পাইনা আমি। বাকরহিত ঐন্দ্রিলাকে আমার আর পছন্দ হয় না। তারপরও, যেহেতু এই অর্থোডক্স রাতটা তার কারণে বদলে যাচ্ছে তাই আমি তৎপর হই। সিএনজিতে টেনে বসিয়ে দিই। ওর বাসার ঠিকানাটা জানতাম। তাই বলি, "ধানমণ্ডি চলেন।" পাশে ঐন্দ্রিলা কাঠ হয়ে বসে থাকে। মৃদু ঝাঁকুনিতেও তার সাড় আসে না। আমি দুয়েকবার চেষ্টা করি পুনরায় "কী হয়েছে?" শব্দগুচ্ছ ঠেলে দিয়ে। কিন্তু অভিমানী বিড়ালের মতোই ঐন্দ্রিলা মুখ ঘুরিয়ে নেয় । পাশে এরকম নিরুত্তর বসে থাকা ঐন্দ্রিলা রেখে আমি ফেরার পথে বাইরে চোখ রাখি। রাত এগারো ছুঁই ছুঁই, এয়ারপোর্ট রোডের পাশে খিলক্ষেত দেখে মনে হয় রেচননালী নিয়ে বৃক্ক পড়ে আছে। হঠাৎ লোডশেডিঙের ঝাপ্টায় টের পাই আবছা তীব্র আলো জ্বেলে আকাশে চাঁদ জেগে আছে।


মুহুর্তেই সব মিথ্যা হয়ে যায়। এই গলপো বানানো, চরিত্র বানানো, পটভূমি বানানো সব। এই আমি, এই ঐন্দ্রিলা, এই ফোনের ওপাশে তার পৌরুষ-বন্ধু সব। এমনকি মায় এই সিএনজিসুদ্ধা রাস্তাঘাটও কর্পুরের মত উবে যেতে থাকে। এই সন্ধ্যাটা আর রাতটা খালি জেগে থাকে। সেখানে ঐন্দ্রিলা আর আমি পাশাপাশি বিযুক্ত আর নির্বাক হয়ে ছুটে যেতে থাকি।

মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০০৮

পতিত নক্ষত্রদলও আমাদের চেয়ে একাকী


জারিত রূপোরঙা জলবুকে নদী, স্থির,
বিষন্ন সার্চলাইট পরশ বুলিয়ে খোঁজে পতিত নক্ষত্রদল
সচকিত পানসি থেকে
ঢেউদোলা আলো নিয়ে
চিকন চিৎকারে মাঝিপুত্র চিরে দেয় বাতাসের দেহ
উজানে স্মৃতি জমিয়ে
আমি ইস্টিমারে সুখেদের জমা রাখি।


জাতশোক ভুলে যাবার আগেই
নিদ্রাহীন সারেঙ
অবলীলায় তোমার মুখ তুলে আনে
নীলোসাদা আলোর মতন গাঢ় হয়ে জ্বলছো তুমি
আমি গালে শিশির মেখেও জেনে যাই,
কুয়াশা কাটলে এজীবন পুরোনো স্বপ্নের মতো
তোমাকে ভুলে নিভে যাবে।


পেছনে ফেনার দাগ মুছে যায়
মীনশরীর-
ফেনা জমছে নখাগ্রে আমিষগন্ধী নেলপলিশের মতো,
একাকী প্লাস্টিকের চেয়ার আর তার পাশে আমি বসে থাকি -


রাত
ঘন
হলে
দূরে
গভীরে
নিবিড়
হলো
বন


পানসি, শুশুক আর ধ্রুবতারাটি
আমাদের মতোই একাকী
সেখানে স্তুপাকার আলো- রঙিন আঁধারে
আমরা একা একা নিজেদের ঘিরে থাকি।