বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০০৮

সেলাই

এখন চোখের ওপরে খড় দিয়ে তৈরি সুতো আর শাবল দিয়ে তৈরি সুঁই দিয়ে কেউ একজন আমার চোখ সেলাই করে দিচ্ছে। চোখের দু'পাতারা চিরে গিয়েছিলো জন্ম-মুহূর্তে। তারপরে চেরাফুটোয় গলগলিয়ে রঙ ঢুকেছে, আলো বাতাস পিতা মাতা সহোদরা ঢুকে গেছে এবং মেডুলায় তাদের কাদালেপা ঠাণ্ডাঘর বানিয়েছে। সে চোখচেরা গুহামুখেই প্রবল প্রতাপী তরুণীর শাদা শাদা স্তন আর যোনি ঢুকে গেছে সাথে করে কুষ্ঠভিখারিনীর গলিত হাত আর নখ, জটামাখা চুল।
সে চোখচেরাকে আজ শাবলসুঁইয়ে কেউ কড়কড় করে সেলাই করে দিচ্ছে, কোনার এক টুকরো ফাঁক এখনও বাকি। সে উপবৃত্তাকার ফাঁক দিয়ে সূর্যগ্রহণের আলো প্রবেশ করে- শেষ আলো। তারপরে শেষ একপোচে সাঁ করে আলো বন্ধের কান্নার তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে। আমি থরথরানো দু'হাত তুলে সেলাইকর্তার লোমশ ধাতব হাত চেপে ধরিঃ ওরে মাগো! এবারে ক্ষান্ত দে! আমার দু'চোখ বুজে গেছে চিরতরে! আমি আর কোন রঙ-রূপ-রস-গন্ধ-শোভা দেখবো না!

বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০০৮

ইন্দ্রিয়াবেগ ট্র্যাফিকিং




১.


... ... এ-খা-নে কো-ন-ও র-ঙ নে-ই কে-ন-না স-ব আ-লো মু-ছে গে-ছে অ-থ-বা স-ব আ-লো জ্ব-লে আ-ছে যে-হে-তু আ-লো-তে স-ব র-ঙ মে-শা-নো সে-হে-তু ধ-রে নি-তে পা-রি স-ব- র-ঙ মি-শে গে-ছে অ-থ-বা মু-ছে গে-ছে ... ...


প্রায়ালোকিত বিছানা জুড়ে তুমি
স্টীলশরীরে পড়ে আছো
একটু মুচড়ে হাত কিংবা পা,
অথবা টানটান করেই!


আমি ঢেউ দেখি,
নৌকা দেখি,
পাল দেখি,
স্রোত দেখি,
ছই দেখি,
নৌকোজমা কুয়াশা দেখি,
ছইঘেরা মেঘ দেখি,
আঁধারের অভাবে আমি সংশয়ে পড়ে যাই।


হাত বাড়ালেই তীব্র ধারালো ধাতবে
কেটে ছড়ে যেতে থাকে রোমকূপ
কাটাক্ষতে বইতে থাকে ভায়োলেট-মেঘ


নিবিড় হলে ইন্দ্রিয় খুব বিপন্ন হয়, ইন্দ্রিয়োর্ধ্ব স্পর্শ জমে ওঠে হীনমাছির নীলচোখ ঘিরে
বস্তুত আমি নীলমাছির পুঞ্জাক্ষি প্রেফার করতে শিখি
বস্তুত আমি ঝাঁঝাঁলো লাল বুদবুদ ভালোবাসতে শিখি
সেখানে তোমার চিহ্নমাত্র নেই!


অনায়াসে ঠেলে দিতে থাকো পর্যাবৃত্তে যেভাবে তোমাকে দেখেছিলো
আদিগন্ত চেনামাঠ দু'খানা বেতার-টাওয়ার-শিশ্ন মাথায় নিয়ে।
আমি দূরে যেতে যেতে ক্রমশই ক্ষীণ এবং ভারি হতে থাকি
অভিস্রবণ বড়ো ক্লান্তপ্রকৃয়া মনে হয়!


শেষেঃ
গহ্বর থেকে চোখ খুলে ফেলি;
আঙুলগুলোও একে একে, টেনে টেনে;
ত্বক ফেলে দিলে হলুদাভ মেদ আর লালরঙ মাংস চেয়ে থাকে পলকহীন;
বাকি দুই - সীসা ঢেলে বন্ধ করে দেয়ার পর
আমি ধীরে ধীরে হিমায়িত ভাগাড়গামী রথে কর্ণকে সারথি করি


মৃত্যুর চেয়ে গাঢ় কোন গান, চুমুর চেয়ে ঘন কোন গলনে জ্বলতে থাকে তোমারারামার চারিপাশ।


২.


বাঁশিবাদক সুর থামিয়ে থমকে দিলে ঘোর কেটে যাওয়া
থতমত আমি দৃষ্টি অনুসরণ করি,
দৃষ্টির শেষরেখায় জ্বলন্ত টিউবের নিচে
সারবাঁধা মানুষের সামনে দিয়ে
এক রূপসী আগুন ছুটে আসে।


আগুনের গায়ে শাদা-শামুক মালা লেগে থাকে,
আগুনের পায়ে সূক্ষ্ণহিল বর্শা গেঁথে থাকে,
আগুনের শরীরে কোমল ধোঁয়ামেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার ভয়ে আটকে থাকে,
আগুনের লম্বা পায়ের ঝুল-বরাবর আমি আমার গলনাঙ্ক লেখা রাখা দেখি।
মুহূর্তেই আমার কাছে আগুন,
দুমড়ে মুচড়ে নীলখাম-প্রেমপত্র হয়ে যায়।
মুহূর্তেই সে সর্‌সর্‌ করে ময়াল সাপের মতো,
ইনহেলারে পাফ্‌ নেয়ার মতো,
চুমুকে ব্ল্যাক কফি জিহ্বায় টানার মতো,
এমনকি আরো অনেক আশ্লেষ-গ্রহণের মতো
আমার চুল-ত্বক-ময়লা শরীর ভেদ করে ঢুকে পড়তে থাকে।


আমি আগুন খুলে খুলে দেখি-
বাদামী শরীরে পোশাক খুলে খুলে নিবিড় হই।
আগুনের আভরণ খসে গেলে বাদাম-ত্বক চর হয়ে জেগে ওঠে।
চরের বালিতে আমি ব্রাস্ট্র্যাপের আইল পাই,
সেখানে দুতিন-বিঘা জমিন কেনা নিয়ে
আমি পান-খাওয়া দালালের সাথে বচসা বাঁধিয়ে দিই!
আগুন আমাকে টেনে টেনে তার ভিতরে নিতে থাকে,
আরো গভীরে
আরো গভীরে
আমি গলে গলে যেতে থাকি।
সেখানে নিমগ্ন চৈতন্যের জল এসে পাড় ভিজানো তাল ঠুকে ঠুকে
চরের জমিন ভিজিয়ে দেয়।


এখানে বাদামে চিরহরিৎ তিল জেগে থাকে
এখানে নৌকায় কালোকাঠে খাঁজ, খাঁজ পলি জমা হয়
এখানে প্লাবিত-উপকূল জুড়ে আমি জমিহারা আর্তনাদ গুনি।


সবশেষে ঘনোচাঁদঘোনোকাশফুলঘনোবাঁশবন প্যান্টিলাইনের চেয়ে গাঢ় হয়ে জেগে থাকে।

শনিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০০৮

অতিক্রান্ত বিকেলস্মৃতি


ক্লাশ শেষ হবার ঠিক তিন মিনিটের মাথায় দু'চারটে বেঞ্চ আর
মাঝে জমিয়ে রাখা খাতাপত্তর ব্যাগ
দু'চারজন সহপাঠীর কলরোল সরিয়ে
মোটাসোঁটা ফটোকপি-বইয়েরা
স্যারের নোটাকার পথ্যসকল
ছড়ানো কলম- পোড়ানো হৃদয় ছাপিয়েও
অমিতলাবণ্য কাছাকাছি চলে আসে
তাদের জন্যে বিকেল ফুরোতে ফুরোতে
কোমল গান্ধারের সলতে জ্বেলে দেয়
অমিশুক দারোয়ান খটখটে হেঁটে যাবার কয়েক মিনিট পরঃ
অমিতলাবণ্য পুনর্জন্ম নেয়।


সেখানে আদতে লাবণ্যের ওড়না থেকে
নরোম-রোদ্দুর-গোলানো-মাঘ ঝরে পড়েছিলো জানি
বলে আমি চুপচাপ চোখ মেলে থাকতে ভালোবাসি।
বেঞ্চ আর অমিতের ঝুল ফতুয়া, আমার সাথে নিনির্মেখ ঘিয়েরঙা ওড়নার প্রতীক্ষা করে!

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০০৮

জ্বরতপ্ত স্পন্টেনিউয়্যিটিতে সেলফোন বা আমার চোখ

ভোর হইতে যাইতেছে। আমি জানালার পাশে একটা জংধরা জালি টপকে বাইরে তাকায়ে অদ্ভুত লালাভা দেখতেছি। মাথায় সবকিছু ছিঁড়াছিঁড়া থট্‌ শুক্রাণুর মতোন খসমান লেজ নাড়ায়ে চলতেছে। এগুলারে টোপে ধরা যায় না। সূঁচালো জালে ধরার চেষ্টা করি।


১.
একটা হালকা জিনিশ শুরুতেই! স্পন্টেনিয়াস লেখালেখির একটা প্রচেষ্টা চালাইতেছি। দেখি ঠুক ঠুক করে কামার সাহেব কিরাম বেতের সোফা বানাইতে গিয়া চেয়ার বানায়ে ফেলেন! সেখানে নিচের চার লাইন বান্ধছি। কেমন হইলো!! 




"তোমার জন্যে নীলচে তারার একটুখানি আলো
দিতে পারলে বড়ো বেশি লাগতো আমার ভালো
কিন্তু তুমি ফুঁক মাইরা কেন নিভায়ে দিলা?
নিভে যাওয়া বাতি হাতে মনটা আমার বিলা!"






২.
খুবই নিম্নমানে বা উচ্চমানে অবস্থানের শখ হয় কখনও কখনও। সেখানে থাকতে হলে কী কী ক্রিয়াপালন বা শর্তপূরণ করতে হয় জানি না। সেজন্যে আমারও ওসব স্থানে যাওয়া হয় না। তবে কেউ যখন নিম্নে থেকে আমার দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টি ফেলে আমি তার কৃতিত্বটুক চেটে-পুটে-গিলে খাই। আবার কেউ যখন উচ্চ থেকে আমারে করুণা করে থুতু ফেলে দেয়, তার প্রতি ভক্তি উথলায়ে দুধের বলগ আসার মতোন চুলা ভিজায়ে দিয়ে বের হতে থাকে। মাঝখানে থেকে আহা!! আমি কতো সুখ সুখ কুসুম লাভ করি!




৩.
জ্বরতপ্ত অবস্থাটা খুব মোহনীয়। আমি পাতলা কাঁথা মুড়ে শুয়ে নিজের ওমে গরম হতে থাকি। গত দু'দিন এরকম কেটেছে। তারপরে আমি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে চামড়া থেকে তাপ পামোলিভ সাবানে ঘষে তুলে ফেলেছি। তারপরে টাইলস বেয়ে সাবানের ফেনায় সওয়ার হয়ে জ্বরকণার চাদর যখন চুঁয়ে চুঁয়ে স্যুয়ারেজে চলে গেলো, আমি হাহাকার করে উঠেছি। দৌড়ে হালকা ভেজা শরীরেই আমি কাঁথাটা আঁকড়ে ধরি, আঁতিপাতি করে খুঁজি।


নাহ্‌! আমাকে ছেড়ে সে মাদক ঘোর চলে গেছে।




৪.
এখানে জেগে থাকার আগেই নোনতা বিস্কুট মিশিয়ে র'চায়ের মগ ব'সে থাকে/
এখানে র'চায়ের মগের পাশে আমার চল্টাওঠা সেলফোন ব্লিঙ্ক করে/
এখানে ব্লিঙ্কের সাথে ঘরের লাইট জ্বলে জ্বলে জেগে থাকে/
লাইটের আলো বাইরে আঁধারে দু-একটা তক্ষককে হিংস্র করে দেয়/


নোনতা বিস্কুট-র'চা-সেলফোন-লাইট-তক্ষক-
এসবকিছু ফেলে আমি কীভাবে তোমার জন্যে চোখ খুলে হাতে নিয়ে রক্ত গোলাপ-
জেগে থাকি?






ফুটনোটঃ কিসুই হয় নাই, কিসুই হবে না, কিসুই হস্যে না!






সাথে এক্টু যোগ করিঃ গাই ফওক্‌স-কে মনে পড়তেছে। লোকটাকে কেউ চিনে না সেভাবে। কিন্তু তাকে নিয়ে একটা নার্সারি রাইম আছে। শিশুদের আমরা দেশদ্রোহিতার শাস্তি শিখাইতে এইটা আউড়াইঃ


রিমেমবার রিমেমবার, দ্যা ফিফথ অব নভেম্বার
গানপাউডার, ট্রীজ্‌ন অ্যাণ্ড প্লট।
আই সি নো রিজ্‌ন, হোয়াই গানপাউডার ট্রীজ্‌ন
শ্যুড এভার বি ফরগট!

রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০০৮

অপ্রস্তুত ব্যস্ততা ভেদ করে আসা শব্দেরা

গুলশান


দুপুরে গুলশান গনগনে খুব
সাদা-কালো-শ্যামলা কোমল আগুন
চলাচল করে আইল্যান্ড আর ফুটপাতে।
বৃন্ত ছেড়ে পরিধিজুড়ে
ঘনোঘাম কণা জমে, সারি সারি রাশি
তারপরে তারা খুব চুপচাপ চেয়ে থাকে।
শীতাতপ-কাঁথা গায়ে কাচের ওপাশে আমি
রোদফাটা গুলশান দেখি।
---


অনুসন্ধান


আয়নাগলনের সাথে স্ফটিকের সম্পর্ক নেই,
যেভাবে শুদ্ধতম শ্লোকের সাথে মেলে না কামার্ঘ্য মেশানো শীৎকার;
সেখানে মেঝে ফুঁড়ে প্রকাণ্ড ফলা ঢুকে গেলে
তার মাথার খাঁজে আমি গোলাপখণ্ড খুঁজি।


বীতরাগ মানেই তো নিবিড় হওয়া নয়?


খুলে রাখা ঘুঙুর দেখে,
আরব্য-রজনী-শেষের কিছু ক্লান্তি পাই।
ত্বকাত্বক সীমানাতে জমে থাকা ঘামকণা
একটু একটু শীতল হয়ে যায়।
সেখানে বেহুলা কিংবা শাহারজাদী কেউ উপস্থিত ছিলো না।

মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০০৮

এই শহরে আমার পথে মগ্ন হয়ে যায় বাসের শিস

এই যে ঢাকা শহরে হেঁটে চলে বেড়াই, দিন যায়, মাস যায়, গরমের দিনগুলো পেরিয়ে শীতের বাতাস আসে। তারও আগে বৃষ্টি ঝুম করে দারুন ভিজিয়ে যায়। সিক্ত নগরীও একসময় শুকিয়ে ওঠে। তারপরে আবার কুয়াশা কেটে চরাচরে উৎসব জমে ওঠে। এরকম দিনাতিপাতে খেয়াল থাকে না কখন বেড়ে উঠছি। বয়েসের কোঠা একটা একটা ধাপ পেরুচ্ছে। সেখানে ধাপে ধাপে কতমুখঃ চেনা-অচেনা-সাদা-তামাটে-কালো-কালিমাখা। এইসব মুখের ভীড়েও কাউকে চিনে ফেলি স্বজন মনে করে। কাউকে দু'চোখে ঘৃণা করি শত্রু ভেবে। এভাবেই দিন কাটাই। ঘুড়িওড়া দিন শেষে টের পাই, বয়েস বাড়ছে। যেসব সময় পিছনে ফেলে এসেছি সেসব কেমন বিবর্ণ হয়েও জ্বলজ্বল করছে। ফিরে তাকালে হাসিমাখা কিংবা কান্নাভেজা দু' চোখ দেখি। পুরোনো আমি'র সেই দু'চোখ আমাকে মাঝে মাঝে সাহস দেয়ঃ "এই দেখো, পুরোনো আমাকে ফেলে তুমি কতো কতো পথ এগিয়ে গেছো! সেখানে তোমার ত্বকে ভাঁজের সাথে জমেছে স্মৃতিরা।" আবার মাঝে মাঝে সেইমুখটাই আমার দিকে তাকিয়ে ঠা ঠা হেসে দেয়ঃ "কী অদ্ভুতভাবে তুমি ব্যর্থ হচ্ছো! এতকিছু শিখেও বুঝে উঠলে না জীবনের মানে!"


শহরের কথা বলছিলাম। কিছু কিছু রাস্তা এখানে আমার হাতের তালুর মতো আপন মনে হয়। এমনও হয়েছে, দিনে দু'তিনবার করে একই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছি। আজকে যেমন ফিরে আসছিলাম, সোজা শাহবাগ থেকে ক্যান্টনমেন্ট। রাত ঘড়িতে নয় ছুঁই ছুঁই। রেডিয়াম জানিয়ে দেয় খুব বেশি বাকি নেই, নিশুতি রাত নেমে আসবে এই জরাক্লান্ত শহরটাতে। রাস্তার আলোগুলো আরও ম্লান হবে আর ঢাউস পেতনি-র মতো সিটিবাসগুলো ভাঙাচোরা বাম্পার আর চটে-থেবড়ে যাওয়া বডি নিয়ে নিঃশব্দ হবে। আমি মোড় থেকে একটা মিশুক নেই। সিএনজি পেলাম না। ওরা আসার পরে এই মিশুক কেমন জানি দত্তক-নেয়া সন্তানের মতো হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকলেও কাছে ডাকি না। সিএনজি-কে খুঁজি। এখন যেমন, না পেয়ে অগত্যা! উঠে পড়ে টের পেলাম কী অবহেলায় মিশুকটা দিনে দিনে পাশের বারডেমের বহুমূত্র রোগীর মতো শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। গিয়ার বদলাতে গেলে অদ্ভুত ঝাঁকুনি দেয়। পিঠের পেছনে ফোমটাও চিমশে গেছে বলে আমাকে শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে হয়। বাস্তবতার কঠোর চাপে ওটা প্রায় বেঁকে গেছে বলে এখন সোজা করতে অস্বস্তি হয়, টের পাই।


চারপাশে ডাইনিগুলো খেদিয়ে আমাদের ড্রেনের কাছে নিয়ে যায়। দীর্ঘ বন্ধ্যাকালীন জ্যামে বসে বসে আমি ফুটপাতের দ্রুতগামী মানুষ দেখি। কাজ শেষে সবাই ফিরছে। কতো কতো দূর এরা এভাবেই হেঁটে যাবে। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম, যেতে হতো- যখন কিছুই পেতাম না রাত বেড়ে গেলে, তখন পায়ের জোর বেড়ে যেতো কোন কারণে। একটু পরে, বেশ একটু পরে আমরা দাড়িয়ে থাকাদের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে দাহ্য-গ্যাসোলিনের ইঞ্জিনের পাশে এসে যাই। সিগন্যাল ছাড়ে অনেকক্ষণ পরে। ওপাশে অসহায় বন্ধ্যাদের ফেলে আমার মিশুক আবার গুঙিয়ে এগুতে থাকে।


বাতাসটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সামনে শীতে অনেকগুলো মানুষ মারা যাবে। পেপারে লিড হবে সেটা। তারপরে পেছনের পাতায় যাবে, সেখান থেকে ভিতরে ময়লাটে পাতায় স্থান পাবে কারণ আর কোন খবর নেই এই দেশে। শীতে কুঁকড়ে মানুষস্বরূপ প্রাণীদলের মরে যাওয়াতে পেপারকাটতি, মানবাধিকার-সংগ্রামীদের উদ্যোগ এসবই সার। এরপরে আর কিছুনাই- এটাই বড়ো সত্য! তারপরে বসন্ত এসে গেলে আমরা অপরাধবোধের জোয়াল নামিয়ে রেখে হাঁপ ছাড়বো।


এখন আমার মিশুক বেগবান! এঁকেবেঁকে ছুটছে, যদিও বৈমাত্রেয় সিএনজি টপকে যায়, কুৎসিত প্রতিবেশী কালো কিংবা হলুদ ট্যাক্সি টপকে যায়। রাস্তার মাঝখানে কয়েকটা ম্যানহোল, ওগুলোর চারপাশে একটা সিমেন্টের বর্ডার দেয়া। আমার মিশুক ওগুলো টপকে যাবার সময়ে জোরে ঝাঁকুনি খায়। মসৃণ ত্বকের ওপরে জড়ুল!! আমি সামনের জংধরা রডটা শক্ত করে ধরে থাকি। পথে সার্ক ফোয়ারার বিষন্ন গোলক দেখি। গোলকের গায়ে হেডলাইট-টেললাইট-স্ট্রিটলাইট পড়ে পড়ে কী মোহময় ছবি আঁকছে। এই শহরেও সুন্দর জন্ম নেয় তাহলে! চুপচাপ দু'সেকেন্ড বেঁচে থাকে। তারপরে কর্কশ হর্ন-ধোঁয়া-ধুলোয় ওদের মৃত্যু হয়। আমি ঐ জীবন্ত সৌন্দর্যের জীবনকাল দেখি, কিন্তু শেষকৃত্যে সঙ্গী হতে পারি না।


বিজয় সরণি পেরিয়ে নাখালপাড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাই। এখানে রাস্তা ফাঁকা-প্রায়। ঠাণ্ডাটা গায়ে লাগছে এখন। আরো কয়েকটা জড়ুল পড়ে পথে। মিশুকওলা একটু আগে র‌্যাঙগস-ভবনের সামনে তার হাতের কড়াপরা তালু দেখাচ্ছিলো। সারাদিন খ্যাপ মেরে, গরমে রাবারের হাতল মসৃণ করে ফেলেছে, সেখানে তার হাতও কালশিটে পড়ে মসৃণতর হয়ে গেছে। দেখে আমার ত্বকেও চর পড়ে যায়!! তোবড়ানো গালের লোকটা অনেক বেশি ভাড়া চেয়েছে, নিরুপায় হয়েই উঠেছি। তবে সেসব কিছু ছাপিয়ে ওঠে অন্যকিছু। আমার খুব তাঁর কাঁধে হাত রাখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। রডের পাশেই তো! তার আগেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলো। আবার ঝাঁকুনিতে সামলে বা বেসামলে নিই আমি।


ঢোকার মুখে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবেন? উত্তর দেই স্বাভাবিকভাবে। এই পাহারা, কড়াকড়িতে সন্ত্রস্ত হয়ে যাই, অপরাধী লাগে আর হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো সংকুচিত হতে থাকি। বাসার কাছাকাছি এসে ডিরেকশন দেই। মিশুক থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় পৌঁছে গেলে টের পাই গত একঘন্টায় শরীরে কয়েক পরত ধুলো আর ময়লা জমেছে। আমার শহরের ধুলো। চকিতে শহবাগ থেকে বাসা অবধি পথ মনে ভেসে ওঠে! ডাইনি বাসকে বৃদ্ধ-পিতামহের মতো মনে হয়। অনাত্মীয় ট্যাক্সি কিংবা প্রিমিও গাড়ীগুলোকেও অতো বেশি পর মনে হয় না! শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে রাখতে এখন বেশ আরামও পাই। তখনই টের পাই এই শহরটা আমাকে কীভাবে মায়ায় বেঁধে ফেলছে। শিকড়ের সন্ধান জানি না, তবে আমি পিচমেশানো শহরের মাটিবিহীন জমিনে নিজের কিছু ত্বকছায়া পড়ে থাকতে দেখি।

রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০০৮

ত্রয়ী ২

শিশিরের ট্রেন
বিকেলবেলাঃ ঠিক পাঁচটা বাজার একটু আগে
শিশিরের ট্রেন থামে;
স্টেশন গার্ড সবুজ পতাকা মৃদু দুলিয়ে দিলে-
ঘাসেরাও শিশিরের ওয়েটিং রুম হয়ে যায়।




মুখবন্ধে সুরাইয়া
প্রচ্ছদের শক্ত মলাট থেকে দু'পাতা উল্টে
সাদা জমিনে কয়েকটা লাইন;
বেশি নয়- কতগুলো মুঠোভরা শব্দে লেখক
পরিচয় ঘটালেন সুরাইয়ার সাথে- আমাদের,
শব্দগুলো জমে জমে সুরাইয়াকে গড়ে তোলে
আর সেখানে কলমের নিব সুরাইয়ার শরীরে ঘষা খেয়ে যায়।




চিত্রকলপো
সবুজ কাঠের নিচে প'ড়ে আছো তুমি
পাশে কয়েকটা জোনাক কিংবা শামুক
স্থবির হয়ে তোমাকে দেখেঃ
এই চিত্রকল্প মাথায় এলে-
আমি পোশাক খুলে তোমার পাশে শুয়ে পড়ি।


তোমাকে আর আমাকে কেউ দেখতে পাবে না আর।