বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০০৮

গতজন্মের পাপ নিয়ে শুভাগত যা ভেবেছিলো

একটানা ঘড়ঘড় আওয়াজ মাথায় নিয়ে শুভাগত যখন চোখ খুললো তখন তার বন্ধ মুখের ভিতরে একটা টক টক স্বাদ জিহ্বা বেয়ে গলা দিয়ে নামতে থাকে, আর সেই টকস্বাদের ঝাঁঝ এড়াতে সে উপরের দিকে মুখ তুলে সময়টা বোঝার চেষ্টা করতে থাকে। একটা ঢোঁক গিলে সে টের পায় কাঁথার নিচে বের হয়ে থাকা বামপায়ের উপরে কেমন ঠাণ্ডা একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সকালের আলো বলে দিচ্ছে বেশ একটু আগেই সে শৈশব পেরিয়ে এসে এখন ধীরে ধীরে কৈশোরের দিকে যাচ্ছে।


খানিক পরে তার উন্মাতাল যুবক-জীবন শুরু হয়ে যাবে যার খরতায় নিচের দু'পেয়ে নোংরা জীবগুলো দরদরিয়ে ঘামতে ঘামতে নিজেদের অদৃষ্টকে দুষতে থাকবে, আর সবার মনেই এই মধ্যগ্রীষ্মের সময়টা পার হয়ে কবে কয়েকফোঁটা করুণা নিয়ে বর্ষা আসবে সেই অসহায় প্রার্থনাটা বারবার ফিরে আসবে।


ঘড়ঘড় শব্দতে ঘুম ভেঙেছে শুভাগতের, এটা বুঝে ফেলার পরে সে উঠে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করে যে ঘরের কোথায় এই বিদঘুটে শব্দটা জন্মাচ্ছে। পড়ে থাকা কয়েকদিনের খবরের কাগজ মেঝেতে বিছানো, কারণ গতরাতে এখানে রয়েল ভকভক করে তীব্র অম্লগন্ধী বমি করেছে; আর বমি পায়ে লেগে পিছলে পড়ে গিয়ে সারা শরীরে তা মাখিয়েছে। এরপরেই শুভাগত পুরোনো কাগজগুলো বিছিয়ে দিয়ে বাকি বমিটুকুকে ঢেকে দিয়েছে যাতে রয়েল তার মাটিতে পাতা বিছানাটায় মাখিয়ে না দেয়।


একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে শুভাগত বুঝতে পারে যে ঘড়ঘড় শব্দের উৎপত্তি বাইরে আর চলন ভেতরের দিকে। এই পাথরভাঙা ড্রিলমেশিনের ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়ার শব্দটা পাশের বাড়ির দেয়ালে ফুটো করার জন্য হচ্ছে যেটা নিয়ে চিন্তা করে শুভাগত অনেকটাই বিরক্ত হলো। স্বভাবতই আজকে একটা ছুটির দিনে এটাই করতে হবে বাড়িওয়ালার আর তাই এই শৈশব-পেরোনো সকালটাকে বলাৎকার করে একটা শক্তপোক্ত খড়খড়ে দিন বানানোর জন্য তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছেন।


এখানে আসলে ভাড়াটে হিসেবে এমনিতেই কারো কিছু বলার নেই, কারণ আর সব ছা-পোষা ভাড়াটেরা সপ্তাহে ছয়দিনের নিয়মানুযায়ী সকালেই উঠে গেছে হয়তো। যেসব নতুন বা আধা-পুরোনো দম্পতিরা কালরাতে শক্তিক্ষয় করে একে অপরকে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত করে এই তৃপ্তি পেয়েছে যা তারা বেশ একটা সুখী জীবন যাপন করছে, তারাও সকালে পেটের চনমনে ক্ষুধাটাকে মেরে ফেলার জন্য খিচুড়ি দিয়ে ডিমভাজি বা পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাংস খাবার চক্করে উঠে পড়েছে!


শুধু শুভাগত আর রয়েল আর আরো দুইজন ছেলে যাদেরকে রয়েল কিভাবে যেন চিনে তারা চারজন সারারাত জেগে ঠিক কখন ঘুমিয়েছে তা টের পায়নি, আর তারাই চাচ্ছিল যেন সারাদিন তাদের চোখ খুলতে না হয়। এজন্য চারিদিকে পর্দাগুলো টেনে আলো আটকে রেখেও লাভ হয়নি খুব একটা, কারণ এখন শুভাগতকে দেখা যাচ্ছে লুঙ্গির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে নিজেকে মুক্ত করে শুভাগত হাতমুখ ধুয়ে এসে টের পায় যে তার পেটে গুড়গুড় করে এসিড ঘোলাচ্ছে আর মুখের সেই টকভাবটা ব্রাশ করার পরেও দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে ফিরে আসছে। জামা বদলে নিচে নেমে তেলেচুবানো পরোটা আর ডিমভাজি খেতে খেতে শুভাগত সারাদিন কী করবে তা ভাবতে থাকে।


কাল সারাদিনে প্রিয়তা তাকে অনেকবার ফোন করেছে। মেয়েটা ক্লান্তিহীন ঝিঁঝিঁপোকার মতো একটানা ফোন করে যেতে পারে, এতটাই যে ফোনের কম্পনও একসময় শুভাগতকে বিরক্ত করে দেয়। অবশেষে সে ফোনটাকে পুরোপুরি নীরব করে দিয়ে বসে থাকে যাতে ঐ বিজবিজ শব্দটাও না হতে পারে। প্রিয়তাকে এড়িয়ে চলার পেছনে যেটা প্রধান কারণ তা ঠিক কীভাবে ওকে বলা যায় সেটা বুঝে উঠতে পারেনি বলেই বেশ ক'বার ফোনটা হাতে নিয়েও কথা বলার ইচ্ছাটাকে বশে আনতে হয়েছে। ফোনটা নেহাতই বন্ধ করে দেয়নি মেয়েটার ওপর এতো কঠোর হতে পারেনি বলে। এহেন পরিস্থিতিতে তেল-পরোটা টেনে টেনে ছেঁড়ার সময় তার মনে আরেকবার প্রিয়তা উঁকি দিয়ে যায়।


খাওয়া শেষে আবার বাসায় ফিরে আসতে আসতে সে খেয়াল করে মুখ চটকে চুল গুছিয়ে রয়েল তার রুম থেকে বের হয়ে আসছে। ওর প্যান্টে এখনও হলুদে-সবুজ বমির দাগ কালচে হয়ে লেগে আছে যদিও সেটা নিয়ে শুভাগত খুব একটা মাথা ঘামালো না। রয়েল কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়েও সে চিন্তিত না। তাই ওকে নীরবে পাশ কাটিয়ে শুভাগত আবার নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে।


বাইরে একটু একটু করে যুবক সকাল তেজ বাড়িয়ে গোঁ গোঁ করতে করতে পর্দা-জানালা পেরিয়ে ঘরে কুঁকড়ে থাকা বমিল্যাপ্টানো কাগজ আর কালশিটে মোজাইক মেঝের উপরে চৌকো চৌকো ট্র্যাপিজিয়মিক খোপ কাটছে আর ঘরের অন্যপাশে বিপ্রতীপ অন্ধকার অনেকটাই চমকে পালিয়ে বের হবার ফন্দি করছে। কাগজ মাড়িয়ে জাজিমে বসার আগেই বাইরে অসহিষ্ণু কড়া-নাড়ার শব্দে শুভাগত একটু চমকে ওঠে। এই বেলা ছুটির দিনে তার আর রয়েলের খোঁজে আসার মত মানুষ খুব বেশি নেই আর যারা আছে তারাও এরকম কড়া না নেড়ে টুকটুক শব্দ করে চুপ করে যায়, যেন খুব ধীরস্থিরভাবে তারা কুমারীকন্যায় প্রথম প্রবেশের মতো অপেক্ষা আর অগ্রসরতায় সামঞ্জস্য রাখতে চায়।


দরজা খুলে দেখা যায় দোতলা উপরের বাসিন্দা ঘোলাটে, কটাচোখো-ডিপ্লোমার বউ দাঁড়িয়ে এবং তার অস্থির কড়ানাড়ায় আর উত্থিত বুকের দ্রুত ওঠানামায় সে যে খুব ব্যাকুল হয়ে আছে সেটা বুঝে নিতে পারে শুভাগত। সে একটু আগেই রয়েলকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে এবং জানালা ছেড়ে এখন সিঁড়িগুলো তরতরিয়ে নেমে শুভাগতের কাছে চলে এসেছে। তার ডিপ্লোমা স্বামীটি নির্ঘাৎ সকালের নাশতা করে আরেকদফা ঘুমের চেষ্টা করছে অথবা আরও সম্ভাব্যতায় এই ছুটির সকালে বেরিয়ে গিয়ে সে তার মা এবং অসুস্থ বোনকে দেখতে গিয়েছে। সেসময়ে তার উত্থিতবক্ষা স্ত্রী শরীর খারাপের টালবাহানা দিলে তার কিছু করার থাকে না। অথচ সে বেরিয়ে গেলে স্ত্রীটি শ্বাপদের মতো রয়েলের বেরিয়ে যাওয়া আর শুভাগতের ঘরে ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলো। এখন ঘরে ঢুকেই দ্রুত কাঁপাহাতে ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে সে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে শুভাগতের দিকে তাকিয়ে একটু থেমে থেমে শ্বাস নিতে থাকে। অনিয়মিত স্পন্দনে শুভাগতের মনে হতে থাকে যে মহিলাটি হয়তো মানসিক দিকটি ছাড়াও শারীরিকভাবেও পুরোপুরি সুস্থ নয়! তবুও অনেকটা নিস্পৃহতায় যেভাবে সে রোজ গোসলের সময় লাক্স ডলে ডলে নিজেকে পরিষ্কার করে সেভাবেই আঁকড়ে ধরে ডিপ্লোমা-স্ত্রীকে। গরমে তার শার্টের তলে পিঠে চিকন ঘাম জেগে উঠলে এবং ডিপ্লোমা-স্ত্রীয়ের নিঃশ্বাসে পেঁয়াজের হালকা ঝাঁঝাঁলো গন্ধটা পেলে সেই গতিতে বাধা পড়ে এবং অযথাই শুভাগতের ক্লান্ত লাগে; ক্রমশ নিজেকে এভাবে অভাবিত-রকমের ক্লান্ত জেনে শুভাগত খুবই অবাক হয়। রমণ তো ক্লান্তিকর ছিল না?


ব্যাপারটা বেশ ফালতু কথাবার্তা, যেভাবে ক্রিকেটারগুলো অনুশীলনের নাম করে আলগোছে বল লোফালুফি করে তেমনিভাবেই শুরু হয়েছিলো যেহেতু শুভাগত আর ডিপ্লোমা-স্ত্রী একইভাবে অবসরপ্রাপ্ত গৃহবন্দী। যদিও তারা দুজনেই জানে যে তাদের মধ্যে চাহিদা এবং আকাঙ্খার ব্যাপ্তিতে দারুন আকাশপাতাল তফাৎ। তবুও এই খণ্ড খণ্ড ঘাম-শীৎকার-হাঁপানি তাদের দুজনেরই ভালো লাগে। কিন্তু আজকে কেন জানি পুরো ব্যাপারটায়, এই একঘেঁয়ে পরিষ্কার-পর্ব আর এর পরের নোংরা হওয়ার নাটকে শুভাগত অভিনয় করতে চাইলো না। ডিপ্লোমা-স্ত্রী খুব মন-খারাপ, হতাশ, পুলক-অতৃপ্ত চেহারা নিয়ে পা টেনে টেনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে শুভাগত নিজেকেই দুষতে থাকে আর প্রিয়তাকে দায়ীও করতে থাকে। সব রাগটুকু প্রিয়তার উপরে গিয়ে পড়লে শুভাগত মনস্থির করে আজকেই সে এই সম্পর্কটা অ্যাবোরেশনের মত টেনে বের করে পেট্রিডিশে ফেলে দিবে। ঝিমঝিমে রাগটা ঝাপটা দিতে থাকে কানে, গলায়, মুখে, হাতের তালুতে। একটু পরে শুভাগতকে দেখা যায় নিজেই ফোনে প্রিয়তার আপাত-উৎকণ্ঠা আর স্লুইস-গেট-খুলে দেয়া উদ্বেগ-উচ্ছ্বাস নিরাময় করে তাকে বিকেলবেলা দেখা করতে বলছে। বিকেলই সই, সময়টা বেশ নরোম থাকে, এরকম ভাবতে ভাবতে শুভাগত গা এলিয়ে দেয় টক বমি-ঢেকে-রাখা কাগজের পাশের জাজিমে।


বিকেলে প্রিয়তার সাথে দেখা করতে গিয়ে শুভাগত আবিষ্কার করে যে এই ভাঙা-গড়ার খেলায় সে বেশ অপরিসীম বিরক্ত হয়ে উঠছে। এজন্য সে পুরো দায়ভার সে বিগত বান্ধবীদের ঘাড়ে চাপাতে চায় কারণ বিচারকার্য তার মনেই সম্পন্ন হচ্ছিলো। প্রিয়তাও একই দোষে দোষী- এরকম ভাবনা মাথায় এলেই সে মাছিতাড়ানো ঝাপটায় তা তাড়িয়ে দেয়। প্রিয়তা দোষী না, প্রায় এরকমই আরেকটা মেয়ে ছিলো, বিশাখা, যাকে শুভাগতের একইরকমের ভালো লাগতো, যেভাবে এখন প্রিয়তাকে লাগে। সেসময় ঐ বাসায় শুভাগতের সাথে থাকতো মঞ্জুর, দশাসই, লম্বা ছেলেটা কোথায় এখন? মঞ্জুরের চিন্তা পানিতে ছুঁড়ে দেয়া চারার মতো শুভাগতের চিন্তাকে একটু আলোড়িত করে যায়। কালরাতে রয়েলকে নিয়ে এত খাওয়া ঠিক হয়নি, অনভ্যস্ত শরীরে আজকে আবার সেই ক্ষুধাটা চাগিয়ে উঠছে। এটা খুব একটা ভালো সংবাদ না কারণ আজকে রাতে রয়েল থাকবে না আর শুভাগত ভালো করেই জানে যে এই নেশার মজাটা একা একা উপভোগ করা যায় না। তিনদিন আগে নেশাটা মাথায় চেপেছে ওর, সেই থেকে বিকারগ্রস্তের মতো নিজেকে পুঁথি পড়িয়ে সামলে রাখছে শুভাগত, অবাধ্য বিড়াল!


তিনদিন আগে প্রিয়তা এসেছিলো শুভাগতের ফ্ল্যাটে, সেসময় কোন এক বিদঘুটে কারণে শুভাগত ছিলো না। তাতে ওর কোন সমস্যা হয়নি কারণ রয়েল নিজেই ছিটকিনি খুলে তাকে ভিতরে বসতে দিয়েছিল। এরপরের ঘরের দরজা ওদের পেছনে বন্ধ হয়ে গেলে ওপাশে কী ঘটেছিল তা-ও শুভাগত জানতে পারেনি আর ফিরে এসে দরজা খুলে সে দুজনকে বাইরের ঘরটায় বসে থাকতেও দেখেনি। তবে খুব বিদঘুটে কারণে সে প্রিয়তার অসহ্য আরামদায়ক চাপাস্বর শুনেছে যা রয়েলের ঘর থেকে বের হচ্ছিলো আর পুরো ব্যাপারটার মিনিটখানেক পরে সে বের হয়ে এসেছিলো। রাস্তায় নেমে হনহন করে হেঁটে অনেকদুরে গিয়ে কোথাও সে বসেছিলো অনেকটা সময় সেটা শুভাগত এখন মনে করতে চায় বা চায় না।


বিদঘুটে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো একটার পর একটা ভাবলে শুভাগতের মাথায় পুরোনো নেশাটা আবার বিশ্রীভাবে জেগে ওঠে একটা কামুক সাপের মতো। প্রিয়তাকে আজ এখানে ডেকেছে সেই নেশাটাকে শান্ত পুষিবিড়াল বানিয়ে ফেলার জন্য। কালরাতে রয়েল আর সে ছিলো, সাথে বাকি দুজনকে এখন ঝাপসা লাগে। সকালে উঠে তাদের দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তাদের উপস্থিতি নিয়ে একটু দোলাচলে পড়ে যায় শুভাগত। তবে একগাদা মদ খেয়ে রয়েলের বমি করাটা স্পষ্ট উজ্জ্বল। ছোট বাঁকানো ছুরিটা তলপেটে হালকা চাপে ঢুকিয়ে রয়েলকে জড়িয়ে ধরে শুভাগত যখন উপরে টানছিল তখন মনে হচ্ছিলো রয়েল কেমন নির্বাপিত সলতের মতো শ্বাস নিচ্ছে, অনেকটা যেভাবে ডিপ্লোমা-স্ত্রী শ্বাস নেয়।


বিশাখাকে মনে পড়ছে আবার, কী অদ্ভুত মিল দু'জনার! মঞ্জুরও অনেক বমি করেছিলো। প্রিয়তার জন্যে অদ্ভুত সুখ অনুভব করে শুভাগত। কফিশপের ভিতরে হালকা আমেজী ঠাণ্ডায় শরীরকে মেলে দিয়ে শুভাগতের মুখের স্মিত হাসিটা বড় হতে শুরু করে। বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে একটুক্ষণ আর বেশ্যাভরা শহরের হলদে আলোগুলো রাস্তায় রাস্তায় জ্বেলে দেয়া হয়েছে। কর্কশ খিস্তির মতো শব্দ করে চকচকে গাড়িগুলো একটা একটার পেছনে লেগে এগুতে থাকে, যেভাবে রমণের পূর্বে পুরুষপশুটি শুঁকে শুঁকে যাচাই করে উপযুক্ত নারীপশুটিকে। প্রিয়তাকে আবছা দেখা যাচ্ছে, সব শব্দগুলো ছাপিয়ে রমণে উদ্যত পশুপাল পেছনে ফেলে একটা দৈবদীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে দুইধাপ সিঁড়ি অবলীলায় পেরিয়ে মৃদুপায়ে এগিয়ে আসছে।




----

চিত্রকল্পের মৃত্যু


পূণ্যাত্মারা যতই বলেছেন, বুঝিয়েছেন
জেনে ফেলে তাবৎ রহস্য প্রকৃতি ও স্রষ্টার
আমি ততই ভ্রষ্টেছি, কাদাপাঁকে আটকে পা
বালখিল্য আবেগে উচ্ছ্বাসে মেতেছি।


অজানা কারণে বৃহৎ গ্রন্থে একটাও
শুদ্ধ মোহন চিত্রকল্প পাইনি, যেরকম সবাই পায়,
বোধিপ্রাপ্তেরা চিৎকার করে জানান দেয়
কী তীব্র পুলকে তারা শিহরিত হয় দিবারাত!


আমি পাশে ফুটপাতে বসে দেখে দেখে প্রশ্নাকুল
বালকের মনে কত বিনম্র জিজ্ঞাসা!
ক্রমশ ম্রিয়মান অনুসারীদের উল্লাসে সে
চিত্রকল্পেরা অক্ষতিকর উৎক্ষেপের ন্যায়।


তবুও স্বর জাগে না, সুর বাঁচে না,
শুধু পেলব দূরগামী মেঘের শকটে
প্রিজমের মত খোলসে মুড়ানো চিত্রকল্পেরা
ভেসে চলে বালকের অপার বিস্ময়ে!

সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০০৮

সুখ ও দুঃখের নির্বাণ আর কবাটবাঁধা ঘর

পরাবৃত্তিক গতিপথে
যে জল বেরিয়ে পড়ে
তার মতই ছড়ছড় করে নির্গত হয়
সুখেরা, সশব্দে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
ভিজিয়ে চারিদিক।

হিমধরা কবাট-বদ্ধ ঘরে,
পেছনে ছিটকিনি আটকে দিলে,
ধরে রাখা শ্বাস বা টানটান মেরুদণ্ড ছেড়ে,
নিমগ্ন হতে পারি নিজের সাথে।
চারিদিকে হিমেরা ত্বকে মিশে যায়
কালো বেড়ালের মত জ্বলজ্বলে তীক্ষ্ণতায়
শিউরে কাঁপুনি একটু,
অতঃপর নির্বাণ!

জলভার নেমে গেলে,
টুপ করে দু'এক অযাচিত দুঃখেরা
নেমে আসে চকচকে মার্বেলে,
থ্যাবড়ানো বিন্দু কেবলই
ছিটকানো অপ্রাকৃত ছবি।
সরলরৈখিক-নমন ঘটে শেষবিন্দুর,
একাকী ছিল সে।

নির্গত অতীত ডাকে পেছনে
সামনে শুধুই ফর্সা জড় কবাট,
খুলে বেরোলেই কবিতা শেষ
সুখেরা হারানো গহ্বরে, কোন অতলে,
পাদানিতে পড়ে রয় কতক দুঃখ।

রবিবার, ২০ জুলাই, ২০০৮

ত্রয়ী

কাগজে মোড়ানো অতীত


কাগজের এক মোড়কে জড়িয়ে নিলাম তখন-
খামসমূহ, হলমার্ক-আর্চির
উপহার-বার্তাদের।
আপন আত্মারা এককালে
কত ভালবেসে
আদর, মমতা, স্নেহ আর প্রেমে ডুবিয়ে
লিখেছিল অক্ষর ঐ
কাগজগুলোয়-
তাদের পাঠানো এত এত ভালবাসা,
আজ কাগজে মুড়িয়ে নিলাম-
চিলেকোঠার এক কাঠের বাক্সে রেখে দিলাম।








লাল পিঁপড়া


আমার চোখের নীচে আজ একটা পিঁপড়া
গুটিগুটি হেঁটে যেতে যেতে আচমকা
কুট করে কামড়ে দিয়েছে।
লাল পিঁপড়ার লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে
চামড়া জুড়ে- ধমনী বেয়ে বার্তা চলেছে
হৃদয়-ফুসফুস-প্লীহা
আহা! কত দূর্দান্ত পিঁপড়ার আদর!






মাননীয় স্যার


মাননীয় স্যার, শিক্ষক, আশা করি ভাল আছেন, বেশ।
আমি অমুক, ব্যাচ তমুক, রোল সেমুক, নিতান্তই তুচ্ছ
অগ্রাহ্য-করার-মত বিস্তারিত পরিচয় ( যা দিয়ে আপনি
আমায় চিনবেন না স্বভাবতই )। আমাকে একটা সমাধান
আশা করি আপনি দিবেন, তাই সমস্যাটা নিয়ে এসেছি।
সাথে সংযুক্ত কাগজে যার বর্ণনা করেছি পুঙ্খানুপুঙ্খ।
বিনীত নিবেদন, সমাধান জানাবেন, পাওয়ামাত্রই,
নিবেদন ইতি, আপনার একান্ত অনুগত, অমুক অপাঙক্তেয়।

সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০০৮

আলোর কণিকারা আর তুমি

তোমাকে ভেবে ভেবে কাটালাম একটা আস্তদুপুরবিকেল
আলোর ঝাঁ ঝাঁ তীর নরম হতে হতে যখন
তোমার গালের রঙের মত পেলব হয়ে এলো,
আমি বাইরের রোদে গা ভাসিয়ে ঊৎসর্গ করলাম
সূর্যের অজস্রকণাগুলো, পাহারা দিবে তারা তোমাকে ঘিরে
সব বাজে শয়তানদের ভাগিয়ে দিবে দুদ্দাড়!
এজন্য তোমাকে নিয়ে ভাবি শুধু দুপুরে আর বিকেল জুড়ে
সকালের আলো শিশুর মত, তোমাকে বাঁচাতে দরকার
সৈন্য-সামন্ত ঝন্‌ঝনে ঝিকিমিকি রোদ্দুর।


তোমাকে এই তুচ্ছ আবেগ হলদে কথারা ছুঁবে না জানি
জানলে তুমি হেসে দিবে ঠিক, ফিক করে,
শক্ত মাটিতে পা তোমার, চপ্পলে আর কতটুকু বাঁচে?
আমি শুধুই অপার্থিব স্বপ্ন বুনি, ঐ সোনালি আলো
তোমার চারপাশে যাদের বিচরণ, তাদের নিয়ে আমি
নবম সিম্ফোনির অধিক মধুর সুর বুনি, তাঁতীর একাগ্রতায়
শব্দের পিঠে যুতসই শব্দ খুঁজি, পরপর বসিয়ে যাই বিনা কারণে।


তোমার আমার চোখের সব আলো নিভে যাবে একদিন,
বুড়োটে চামড়ার নিচের ধমণীগুলো থেমে যাবে
শুধু এই শব্দরাশিরাশি তোমায় আলতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে
তখনও ঘুরে বেড়াবে আজীবন।

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০০৮

ভুলে যাওয়া জন্মদিন

গতকাল ভুলে গেছি বন্ধুর জন্মদিন।

খেপেছে খুব হয়ত সে,
রেগে মেগে ধুস্‌শালা বলে গাল পেড়েছে একচোট
দেখে নিব হতচ্ছাড়া ফোন দিলে,
ভেবে পায়তাঁরা কষেছে মনে মনে।

তারপর হয়ত ভেবেছে, মাথা ঠাণ্ডা হলে
এরকম কেন করল ও, নিশ্চয়ই শরীর খারাপ!
কিংবা ফেঁসে গেছে কোন কাজে, এরকম
ভেবে ভেবে অযথাই শঙ্কা করেছে একটু।

কিন্তু আমি ফোন দিইনি,
আচমকা চমকে কোন সারপ্রাইজ,
বা হুট করে কোন গিফট
পাঠিয়ে দিইনি ওর ঠিকানায়।

বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমার বন্ধুকে
আজ সকালে পড়ল মনে সব।
গতকালে ফিরে যাবার কোন
অতিপ্রাকৃত ব্যবস্থা দরকার খুব,
তাহলে ওকে বেশ চমকে দিতাম,
উইশ করে ধন্য করতাম, ওর জন্মের দিন
এবছর স্মরণীয় হয়ে থাকত ওর জীবনে,
খেতে যেতাম সবাই মিলে সৌখিন রেস্তোঁরায়
আড্ডা দিতাম অনেকক্ষণ, হা হা হেসে টেবিল চাপড়ে।

কিন্তু কিছুই করা হয়নি, আজ ক্ষমা চেয়ে ফোনও করিনি,
"বন্ধু, স্যরি, ভুল হয়ে গেছে, কালকে বেমালুম
ভুলে খেয়ে বসেছিলাম, হে হে,"
সলাজ হেসে বললে বোধহয় সব ভুলে যেত
আমার বন্ধু, বলত, "আরে! বাদ দে, দুপুরে চলে আয়,
বসে খানিক আড্ডা হবে'খন।"

ঐ ভয়েই কিনা জানি না, ফোন করিনি আর
নীরব নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি, জগদ্দল পাথর।
বন্ধু বোধহয় মনে অনেক কষ্ট পেল!

শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০০৮

প্রতিপ্রভ আলোয় সুখ ও সঙ্গম ১

নিশ্চুপ ভেজে হেঁটমাথা স্ট্রিটলাইট বেহাগী বর্ষায়
প্রতিপ্রভ আলোয় শুয়ে থাকে রাতের ভবঘুরে
স্বেদবিন্দুর মত বৃষ্টিতে ঝরে ক্ষোভ, শোক, নির্বাণ।


যে হলুদ আলোয় জন্মেছিল বিষাদ,
বিষাদ-
নিষ্পাপ বিষাদ,
সেখানে ভবঘুরে রাস্তায় পড়ে শ্বাস নেয়
একবার, দুইবার, থেমে থেমে।
তার শরীরে ফোঁটে বরফশীতল বনসাই-প্রেম,
বেশ্যা এসে ছুঁয়ে যায় ত্বক,
কড়া সৌরভে ভিজে মিশে যাচ্ছে
যেন চোখের তারার দীপ্তি।
ভবঘুরে চোখ মেলতে পারে না
নিশ্চুপ ভেজে সব -
রাস্তা-ড্রেন-ইঁট-বালু-বিল্ডিং-পোর্চ।


একটা বিপরীত শুষ্কতা বোধে ঢুকে যায়
গলা বেয়ে নামে অম্লের স্রোত
ভবঘুরে ঢোঁক গিলে বন্ধ করে মুখ।
বাণিজ্যিক বিপ্লব ভিজে যায় বুর্জোয়া রাস্তায়।
বেশ্যা ক্রমশ হতাশায় ফেরে,
খদ্দেরের অভাবে ভেজে হাঁড়িকুড়ি সব
কপালে জমেছে বলিরেখা, চটকে মেকাপ।


পরিধি জুড়ে পসরা সাজিয়ে
কেন্দ্রে শুধুই জমা হয় শূন্যেরা,
সুখে মগ্ন কামনায় জ্বলে নির্বাপিত বিষাদেরা।

সোমবার, ৭ জুলাই, ২০০৮

বাইনারী আবেগ আর ঝিঁ ঝিঁ পোকারা

- আছো?
- জ্বি, আছি।

কেব্‌ল দিয়ে বাইনারি আবেগ ছোটে, এক আর শূন্যেরা
একে অপরের ঘাড়ে চেপে সাঁ সাঁ দৌড়ে বেড়ায় দুদ্দাড়।

- আমি ঘুমাবো, খুব ক্লান্ত। তুমি জেগে র'বে?
- হুঁ, আরো কিছুখন, আরেকটু সময়, বসে থাকি নিনির্মেখ।
- কি করবা জেগে জেগে?
(পাঁজর ফুঁড়ে লোহিত অশ্রু পড়ে)
- আমার রাত তো স'বে শুরু হলো! প্রেমিক শর্বরী।
- এভাবে রাত জেগে জেগে তুমি একদিন বড় একটা
ঝামেলায় পড়বে? ঈষৎ অনুযোগে গাঢ় হয় স্বর।
- এই বেশ ভাল লাগে, অযথা ভেবে মরো, আমাকে নিয়ে!
মর্চে পড়া শরীরে বুলাতে চাও স্প্রে-পেইন্টের ব্যানার?
- ধুর! তুমি যাচ্ছেতাই! আমি কি তাই বলেছি নাকি?
রাগ লাগে কথা শুনে তোমার, আমার খেয়ে কাজ নেই,
তোমার মাথার হারানো স্ক্রু খুঁজে মরি আর কি!
- বাহ্‌! ভালোই দিয়েছ রূপক, আমাকে চিনছি আজ তোমার চোখে।
- একটু মন দিয়ে কথাগুলো শুনলে কী হয়?
মনে হয় কানে তুলো গুঁজে বসে আছে নির্বোধ।
আমার সব কথা ফিরে আসে নিস্ফল!
- না না, শুনি আমি খুব মন দিয়ে কথাগুলো, মনে তুলে রাখি
আলতো করে গুছিয়ে, বড় দামি যে এই যত্নটুকু - !
দেখে নিও ঠিক একদিন গুছিয়ে নিব সব,
নিয়মে বেঁধে রশিতে কষে আঁটবো যত বিপন্ন আবেগ!

তথৈবচ বাইনারি বিটেরা গতি কমিয়ে দেয়, এলোমেলো
ভাবনা আর টুকরো কথা জমা পড়ে খোপে খোপে,
অবশেষে চলে যায় সে, ক্লান্ত। অপরজনের পাশে জমে
খুশকির মত বিরক্তিকর দুঃখেরা, আপন বলয়ে।
বাইরে তখন ঝিঁঝিঁরা তুলে সিম্ফোনির সুর।

বুধবার, ২ জুলাই, ২০০৮

নেতা-পিতার বিচারালয়

পাপের প্রকৃতি স্বরূপে বিচার করেন
আমাদের প্রিয়, আদরণীয় নেতা-পিতা।


সকলে মোরা সারি সারি দিয়ে সামনে তাঁর
পিপীলিকার মত দাঁড়াই, শান্ত-শিষ্ট, নির্বিবাদী
আগে পিছে কারো সাথে ঝগড়ায় মত্ত হইনা,
আমাদের সকল মনোযোগ তখন সামনে
উপবিষ্ট নেতা-পিতার সৌম্য মুখভঙ্গি ঘিরে।


নেতা-পিতার সৌম্য সেই মুখে শরতের আকাশের মত
মেঘ-মাখা-রোদ খেলা করে। ক্রমশই আলো অন্ধকার,
নেতা-পিতা হাসেন, রেগে যান, ভ্রূকূটিতে বেঁকে যান
আমরা সামনে নিশ্চল অপেক্ষায় বিদ্যমান তখনও
বারম্বার পুলকিত হই, বিমোহিত হই।


নেতা-পিতা স্বীয় প্রজ্ঞায়, চুলচেরা হিসাব করেন
পুরুষের পাপ, নারীর পাপ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-অশীতিপর
কিংবা শিশু, কিশোরী-বালিকা-যুবতীর পাপ।
সকলের আলাদা আলাদা মানদণ্ডের মাপকাঠিতে
নেতা-পিতা বিচার করেন।
বিচার শেষে মোরা যার যার ঘরে ফিরে যাই
শ্রান্ত, কিন্তু তৃপ্ত, মুগ্ধ।


প্রায়শ্চিত্ত বড় টানাপোড়েনে ভোগায় আমাদের,
তাই পাপস্খলন শেষে পরিতৃপ্ত শরীরে মোরা
স্বসম্ভোগে লিপ্ত হই, বিস্রস্ত হই
বিস্তৃত এবং প্রসারিত হই,শেষমেশ কেবলই
পুলকের বেদনা-আবেশে নির্ঘুম ঘুমে সুপ্ত হই।


নরম পালকের বিছানায় শুয়ে সেই পরম ঘুমের মাঝে
মোরা পূর্বজন্মের পাপের স্বপ্ন দেখি।