শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৮

অবসন্ন জন্মোৎসব


প্রস্তরিত
রোদাক্রান্ত
রোদসিক্ত মাটিতে ধান জেগে উঠলে
তুমি খুব চিহ্নপ্রেমী হয়ে
খানিক বিলাসজাত, খানিক সমরজাত
হিংসা পুষে রাখো।


জাতিস্মরের স্মৃতিতে নেই
খরাশোক-
মুছে গেছে পিতামহের খুন;
তুষের গন্ধে জীবন পুষে রেখে।


তিরিশ আমনবর্ষ কেটে গেলে
বিলাবল সুর থেকে উৎসে ফিরে যায়
অপর পাশে বিবিক্ত তোমার
ত্বকে জমে কিছু জরাশোক।


কাদাঘোলা জল ছেনে রূপোর মাছ
বড় বিনম্র কুর্নিশে ছেড়ে গেছে
ভিটা-মাটি; সন্তাপ!
রহস্য ভালোবাসে গমরঙা যৌবন,
চান্নিপসরে ধান-শয্যায় মৃত্যু দিয়েছে ডাক!

বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০০৮

শহুরে জীবনের গান


বড় দেরি করে জন্মেছি
বড় অস্থির সময়ে,
মুহূর্তে হুট করে
বদলে যাচ্ছে মানচিত্র,
রাজাধিপতিরা অনায়াসে
পাল্টে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ।


প্রেমের জলে জমেছে
শ্যাওলা-পানা, টুপ করে
ঢিল ফেললেই
নিস্তরিত জলে ওঠে
ক্ষণিক তোলপাড়,
ক্ষণিক মন্থনজাত সুখ।


রোদ-বৃষ্টি ঋতুরা ফেরে
রেলগাড়ির মত মসৃণ,
পিছলে যায় দিন,
ব্যস্ত বিকেলে কাজের চাপ,
সন্ধ্যার ক্লান্তি - ঘরের টান।


শুকিয়ে যাওয়া ঘামের দাগে
তেলচিটে পোকার শৈশব কাটে
ধুয়ে মুছে সাফ হবার আগে।
আনন্দদায়ী গানের সুর তবু
গুনগুনিয়ে ভাঁজে
ও-পাড়ার বাউন্ডুলে হতচ্ছাড়া-


ভ্রূ-ভঙ্গিতে উপেক্ষা জড়িয়ে
চলে যায় তপ্ত-যৌবন,
হায়! এসবই নিয়মিত পুনরাবৃত্তি,
হৃদয়ে যার জায়গা নেই
পৃথিবীর বাইরেও থাকবে
তার চিহ্ন পরিষ্কার!




-ছন্নছাড়ার পেন্সিল

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৮

বিনীতা তোমাকে

প্রথাগত স্বরে বলিনি কিছু?
ফিরে আসার আগে তুমি যেখানে যেখানে
ফেলেছো পা, হেসেছো তুমুল
গাঢ় স্বরে ডেকেছো যাদের আমন্ত্রণে
আমি তাদের মাঝে ছিলাম না।
-শেষবেঞ্চে হেলান দিয়ে।


পৃথিবীতে দুপুরেরা দৌড়ে বিকেলের ঘরে ঢুকলে
নীল কাঁচের বাইরে শীতাতপ গায়ে নিয়ে
আমি ঝুম বর্ষায় হুড ফেলে হেঁটে গেছি
নীল-ক্ষত নীলক্ষেত, পরীনীড় পরীবাগ, সবুজ-জটলা গ্রীনরোড।
সিক্ত দালাল রিকশা গুলো ডেকেছে,
আয়.... আয়.... আয়....
ফুটপাতে জল জমে গেলে ছপছপে-
বস্তিবালক হেসে দিলো খিলখিল!


ঘাড় ফেরাতেই কলাপাতা সবুজ ঘ্রাণ
ডেকেছে ভেজাচুল- তোমার
আমি তথৈবচতায় মেতেছি একাই!


ফুটনোটে যাবার আগে কটা চোখ
অস্থির ভেসে থেকে, ডুবসাঁতারে
ত্বক-ভাঁজে উষ্ণতার সাথে মিশে
ধ্রুবমেঘের বিছানায় তুমি-আমি মিশে গেলে
বাইরে বৃষ্টিব্যাপী চাকুরের শাপশাপান্ত
আমাদের পুনঃপুনঃ আশীর্বাদ দিবে।

সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০০৮

ক্ষুদ্রাকৃতি প্রেম কিংবা...

রোজ নির্মাণ, রোজ চুরমার, রোজ প্রসব, রোজ বিয়োগ
স্বত্ব ছেড়ে বিক্ষত হবার পরেই জমছে গ্লানি-উপচানো-ঢেউ
পিঠের পিছনে ঢেউয়েরা ভেঙে পূর্বটান ফিরে যেতে থাকে বলে
নীলনীল বুদ্বুদ সাঁজোয়া-মিছিলে দাগবে অগ্ন্যুৎপাত, ফেটে যাবার আগেই
দরশোনতত্‌তো ফুঁলে ফেঁপে ছড়াবে মালীর হাত দিয়ে ফুলের
বাগান আর গোরস্থান মিলে-মিশে-যায়! ধূপের আলো থেকে সর্পিল-
সর্পিল রূপসী উঠে এলে, জেনে গেছি ভেবে আমি পিঠ ফিরেই থাকবো।


দ্বিরুক্তি খুব সহজেই বাঁকা হাসি মুছে দিবে বলে তুমি চেয়েই থাকো
বিষ উগরে বাদামি বিক্ষোভে জেনে যাও কতরঙ জমে আছে বুকের আঁধারে
চেয়ে থেকে কতো কথা বলা হয়ে যেতে পারে বা পারে না!
দোলাচল- শুধুই দোলাচল-
ফিরে যাওয়া ঝিনুক তো জানতো না সবুজ ঝাউবন কেন ভালোবেসেছিলো?

শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৮

জীবনানন্দ দ্যাকলে বড় খুশি হইতো রে!


আজ আমি ধাক্কা খেয়ে কিছু সময় পড়ে রইলাম,
......নুড়ি
............পাথর
....................গদ্য
...........................চপ্পল
সরে যেতে যেতে থেমে থাকলোইবা-
এক গড়ানে সটান হলেই দেখি রূপায়িত ঘুঙুর
"জীবনানন্দ দ্যাকলে বড় খুশি হইতো রে!"
গাঁকগাঁক করে বিরক্ত যুবক-হামার চলে গেলে
মনে পড়ে ট্রাম-বিকট-আওয়াজ-বিকেল পোড়ানো অবসাদ।


উবু বসে চরাচর ক্ষেতখামার ভেসে এলে
আমি এলোপাথাড়ি হাত বাড়াই,
অন্ধ-উদ্বেগ! ঘাসেরা নেই নেই,
শক্ত পিচ-গোলানো রাজপথ বড় মোলায়েম বিছানা-
হয়ে আমাকে ডাকতে থাকে।
জীবনানন্দ ভেসে যাবার আগে বিব্রত ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখেন,
আমি মুখ তুলে দালানের ছাদের পাশে
দিকভ্রান্ত মেঘের সুতো হাতে বেঁধে নিতে ব্যস্ত।


ধুলো ঝেড়ে পা বাড়ালে ফের মনে পড়ে
ট্রামের আলোয় কোন সরণী গড়ে উঠবে?
বস্তুত দ্বন্দ্বপ্রেমী চিন্তারা ছিটকে দেউড়ি পেরিয়ে যেতে থাকে।


মৃত্যু তখনও দ' ভেঙে আমার পাশে বসেই ছিল বসেই ছিল বসেই ছিল!

বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০০৮

ছিন্নস্বর


সিলুয়েটে করতল জমে উঠলে একটা বিছানা ধীরে খুব ধীরে রওয়ানা দিল আস্তাকুঁড়ে
যেখানে প্রতিদিনরাত বার্ধক্য-উপনীতা শুকুতে দেয় কুমড়োর বড়া; ঐ বড়াভাজা মাদুরের
পাশে পিঁপড়ের সারি লাইনে জমাট বিক্ষোভ ফেলে একটা চিকন জলধারা ক্রমশ শৃঙ্খলিত
হতে থাকলে মোলায়েম শকট এসে তার চেহারায় অদ্ভুত রঙ এঁকে দ্যায়।


কাছেই সিঙ্ক্রোনাইজ্‌ড ঘুমের বাসর থেকে জেগে উঠতে পারে কালো কুকুরটি- এহেন
ভাবনা ঠাস্‌ করে বেলুন ফুটে মিলিয়ে যাবার আগে নিঃসরিত বায়ুত্যাগী জোছনা আমাকে
ঠ্যালা দিয়ে রমণে ঠেলে দিতে থাকে আর ভিখেরিপনায় পটু আমার ছোটভাই চেয়ারের
নিচে রাখা গলিত-ঘামসিক্ত তোয়ালে জড়িয়ে দিনকে দিন শুষ্ক হতে থাকে।


তুমি যখন উল্টো ঘুরে কাঁথায় মুখ গুঁজে আলোর বিপরীতে যাচ্ছিলে সেদিকে তাকিয়ে ঐ
পিঁপড়েগুলো অবাক হয়ে হা করে চেয়েছিলো, আর জীবন্ত গান সুর বিছিয়ে মেঝেতে
সরীসৃপ হয়ে জেনে গিয়েছিল কতটা ঢেউ ভাঙলে বালি ভিজিয়ে রক্ত মাটি তৈরি করতে
পারে, এরকম চিন্তায় বার্ধক্য-উপনীতা আমার রমণে বাধা দিতে জোছনার গলা টিপে ধরে।

মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০০৮

প্রতিপ্রভ আলোয় সুখ ও সঙ্গম ২

রঙিন আলো- রঙিন আঁধার খেলা করে ধাতব কাউন্টারে
উপরে বসানো নিশ্চুপ গেলাশেরা গায়ে বাষ্পফোঁটা নিয়ে
গোলাপি-মসৃণ টিস্যুতে ফেলে জলছাপ, বিন্দু মহাদেশ!


যদিও আলোকিত হলজুড়ে থাকে অন্ধকার-গোলানো জ্যাজ
বাষ্পায়িত যৌবন খুব আলগোছে গায়ে ঢলে পড়লে
তিতিক্ষা-সকল সরে পড়ে নিষিদ্ধ-অঞ্চলে
স্তন-মেদ-বাহুসৌরভ বিস্তৃত হয় প্রতিপ্রভ আলোয়,
কালিমা-
কালিমা
জমে ওঠে গেলাশে দেবতা-স্তব!


পাশে নিশ্চল বসে থাকা টুলে ভার
ছেড়ে নতবৃদ্ধ-বালক বিভাজিত হয়,
ফ্লাশলাইটে ঝলসে দেয় লোম-চর্ম-সাটিন
ওষ্ঠে বিদ্রূপ মিলছে শুধু ছায়াশরীরে-
গলিত হতে হতে জ্যাজ হঠাৎ জমে ওঠে||


প্রতি রাতেই আসর ভেঙে দুয়েকটা পাঁড় হৈহুল্লোড়
দমকা ঝড় ক্ষিন্ন প্রলাপ অপচয়িত হোক-


তবু সেদিন নাভিমূলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেগে ছিল সংকুচিত মেঘ।

শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৮

আমার ঘরের মানচিত্র

আমার ঘরটা আজ বড় অগোছালো হয়ে গেছে,
চারিদিকে শবাধারের মত টেবিল, চেয়ার, বিছানা, বালিশ
রক্তধারার মত বিস্রস্ত জামা-গামছা-তোয়ালে।
হঠাৎ পায়ে বেধে যায় ছিন্ন হাত-পায়ের মত বইয়েরা
গতশতকের চিন্তকের প্রলাপ যেগুলো ঘোরের মতন!
চারদেয়ালে রক্তছিটে, কালসিটে দাগেদের কোলাজ
আমার কিংবা পূর্বের ভাড়াটিয়ার দুরন্ত ছেলেমেয়ে
কী অপূর্ব বিষাদ এঁকেছে দেয়ালজুড়ে, মাটিতে,
বিছানা-বালিশ বেয়ে উল্টে পড়া দোয়াতের মত আল্পনা-
ছুটোছুটি করে ঘরময়।


আজ ঘরে ফিরতে বড়ই ভয় হয়, কোন অন্ধকারে ঘাপটি মেরে
উন্মাদ-ছোরা হাতে আমারই সহোদর হয়ত বসে আছে। তালা
খুলে ডোকা মাত্রই আমার পাঁজর হাড়-ভেদী নির্ভুল ছোবল-
যে ঘর এতটা আপন, মায়ের মত আঁচল মেলে রেখেছিল
এত এত সূর্যাস্ত, সেখানে আজ ফিরতে বড় ভয় হয়।
আমি বাহিরে ফিরি, পথের পাশে পড়ে রই বেমক্কা খেয়ালে
ভবঘুরে মাতাল বাতাস আমাকে নিয়ে উথালপাথাল খেলে।






রাত শেষে তবু সেখানেই ফিরব,
যে ঘরের আঁধারে
আমার সহোদর হয়ত
সমূলে সমতল জমিন খুঁড়ে
একটা
একটা
একটা
একটা
করে সবটুকু হৃদয় বের করে সেই অনাবাদী সিঁড়িতে ফেলে দেবে...

মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০০৮

ইউক্যালিপ্টাসের মুখ

আমি যখন কুয়াশা-শৈশব-মেশানো-ভোরে দৌড়াতাম পিচে-ঢালা-পথে ঘুরে ঘুরে অনবরত;
বারবার তোমাকে টপকে যেতাম আলতো-আঙুল-গীটারে-বোলানোর মত পদবিক্ষেপে
সেখানে দাঁড়ানো ঊর্ধ্বমেঘ-ছোঁয়ায়-সঙ্গমেচ্ছু ইউক্যালিপ্টাসের শরীর, ঋজুত্ব দেখে
লয়-ভাঙা-পা পড়তো পিচ আর আলকাতরা-মেশানো-শতবর্ষী বুড়ো রাস্তায়।
দিনের আলো কতবার বদলে দিত ওর শরীরের চাল-ধোয়া-ঘোলাটে-সাদা রঙ;
আমি সারাদিন ওরপাশে ঘুরে ঘুরে পা মেপে মেপে চকিতে আঁক কষতাম, উপরে
তার শরীর-ছাড়ানো-মুখ দেখার তীব্র, তুমুল, নাড়িছেঁড়া-বাঁধনের মত ইচ্ছারা
বিতর্কিত-বেশ্যা-ছেনাল মেঘেদের সাথে কূট-কুরুক্ষেত্রে মেতেছে শকুনির মতোই!
আমাকে রেখে ইউক্যালিপ্টাস- কত দূরে চলে গেছে আদিগন্ত-পাড়ি-পার, আমি
শৈশবে-কৈশোরে খুঁজতে গিয়ে বাদামী-যুবতী-মাদক-শরীর খুঁড়েও তাকে পাই নাই!

রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০০৮

জলের ঘর্ষণদাগ

অনতিদূর সময়ের তীর্যক রূপায়িত বিকেল
মেঘের সাথে গুন টেনে বহুক্ষণ
মিলানোর আগে সেদিন পশ্চিমে
ছোট এক দৃশ্য রেখে গ্যাছিলো।


পটভূমি ভাঙনে জড়ো হওয়া শিকলখণ্ড আর পেরেকগুলো
জীবন্ত বীক্ষণে মাতে তোলপাড়, হা হুতাশে সময় নেই!
সেদিন ঠিক জেনেছিল ফটকজুড়ে দেয়াল পাথর তুলে
জীবন! আহা ঐপারে বিস্ময়ে ডাকছিল কই?


গুচ্ছেরা জমা পড়ে করতলে, পাথর-কাদা-বালু
একে একে সরে আসে নিবিড়ে বিনয়ে জড়সুখ
কণাসদৃশ অহংকার, গ্লানিরাও সরে আসে
স্বকীয় বিম্বে দ্যাখো কতটা হাহাকার!


দ্বীপ থেকে সেতু ভেঙে দিলে কতদূরে অন্যতীর?
উন্মাদ বিধাতাও জানে তোষামোদ আর প্রায়শ্চিত্তের দাম,
অবোধ হৃদয় সেখানে তীরে পাথুরে ভিত-টুকরো
এভাবেই বুঝি জড়ো করে ক্রমাগত!


প্রস্তরে ঘর্ষণদাগ রেখে গ্যাছিলো জলকঙ্কাল
পুনরাগমন হবে না জেনে!

শুক্রবার, ৮ আগস্ট, ২০০৮

যুগল দ্বন্দ্ব


এপাশ-ওপাশ


দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে
দেখি না কিছুই
দরজার ওপাশে যা-
জীবন প্রাত্যহিক
হয়ত জমে আছে
এপাশে হাতল ধরে আছি-
ওপাশ থেকে কেউ খুলে দিলে
ভার নেমে যায়।


---


ভাঙন-মূলক


অবিশ্রাম ঢেউয়ে ভাঙে
ধানের ক্ষেত,
হালট,
নারিকেল গাছ,
কুয়া,
বাঁশঝাড়,
বনেদী টিনের ঘর।
পৌরাণিক জমিন জুড়ে
থইথই কাদা-পানি
যেন ঘটোৎকচ উদ্বাহু প্রলয় ডেকেছে কুরুক্ষেত্রে!

বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০০৮

আর্দ্রতাবোধক

চারপাশে ছায়া তৈরি ঘষাকাচে আলো ঢেকে
বিলম্বিত লয়ে ভেসে আসে টুকটাক ছিন্ন হাসি-চুড়ির রিনঝিন
ঘোলাটে গলায় কথা বলে দুজন, মুখ দেখি না আড়ালের ওপাশে
খটখট শব্দে বাজে মৃত আলাপ যন্ত্রের-
শীতাতপ শুষে নেয় আর্দ্রতা, সিরিঞ্জে রক্ত টেনে নেবার মতই,
অপেক্ষায় বসে থাকি, পা নাচাই, ঘড়ি দেখি
হাত চালিয়ে ঠিক করি অবিন্যস্ত চুল।
চাকুরিদাতা ডাকবে বলে চলে গেছে বাদামী দেয়ালের ওপারে
ধীরে বহে টিক টিক টিক, অপেক্ষায় শুয়ে পড়ি আস্তিনে লুকিয়ে
দীর্ঘশরীর সাপের বিষ; প্রণয়জাত।
হেঁটে বেরিয়ে পড়ি ঝাঁঝাঁলো রোদ্দুর, চূর্ণ আলোর ঝলমলে লাশ
ঝাপটা শীতাতপ ঠেলে দিলে সামনে, চাকুরিদাতার মুখ দেখি কোলাজ হয়ে ঝরে
ছায়ার প্রাসাদ বানিয়ে মাথায় রেখে দিই একটা দুপুরকে ভালবেসে
আর্দ্রতা জাপটে চুমু দেয় প্রেমিকার চেয়েও থরোথরো বাষ্পে
আস্তিনের বিষ, সাপের আদরে পেঁচিয়ে ছোটে বুকের দিকে!

মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০০৮

হিমায়ন ঘর থেকে সুপ্ত অক্ষরেরা

বরফায়িত অক্ষরেরা জেগে ওঠে হিমায়ন ঘরে
কুয়াশা বাতাসে তাদের শরীর প্রাকৃত-শীতল।
বহুদিন আঙুলে ছুঁইনি তাদের, কোষে কোষে মাখিনি আদর।
অক্ষরের ধারে কেটে যায়নি বাদামী-ত্বক
শিউরে ওঠেনি রোমকূপেরা।


অব্যবহৃত জড়তায় তাদের শরীরে বড় ক্লান্তি
শিশুসুলভ আমুদে স্থবিরতা,
খিলখিলে হেসে দেয় ই-কার!
শব্দেরা ফিরে আসে চিলেকোঠায়, হাতে হাত
ধরে তারা বসে পড়ে জাজিমে।


খানিক দূরে আমি বিস্ময়ে- প্রকাশিত চোখ
অক্ষরের সংলাপ দেখি ক্রমশ-
শব্দেরা জড়ো হয়, ঘন হয়, বিন্যস্ত বিপ্লব
আমি দস্তানা গলিয়ে তৈরি তীক্ষ্ণ টানটান,
শুরু হবে দ্বৈত মল্লার!

রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০০৮

কাল রাস্তায় পায়ের ছাপেরা


কালো আঁচড়ে আঁকা পথে, যে পথে বৃষ্টি হয়েছিল আজ সকাল
হেঁটে চলি আমরা ক'জন, সামনে ধূসর ক্ষয়িষ্ণু মেঘেরা
ঝঙ্কারে নেমে আসছে নীচের দিগন্তে, আলোমিশ্রিত আঁধার!
পেছনে তাকিয়ে কিছু চোখে পড়ে কি? রোদেরা নিয়েছে বিদায়
বহুদিন তাও আজ, অভিমান করে চলে গেছে তরুণী বিকেল।


আমরা তাকাই ডানে-বামে পরস্পর, দেখে সাহসী প্রান্তজন
পদক্ষেপে দৃঢ় সে, পানি ছিটকে আসে তার পদতল থেকে,
আমরা এগোই, ধীরে মন্থর, গতি সচলতা।
মূর্খেরাই অন্তরীণ শুধু এমন ঘোলাটে বিরূপ রাস্তায়,
টানেনি কেন তাদের স্বতস্ফূর্ত, প্রান্তজনের মগজে ঝিলিক প্রশ্ন
পেছনে পায়ের ছাপেরা ভরে ওঠে শেষ বর্ষার ঘোলাজলে।

এই লেখাটা তোর জন্যে

আমরা দু’জনে বসেছিলাম। রাত অনেক, প্রায় এগারটা বাজে। একটু দুরে স্ট্রীটল্যাম্পেরা ছাড়া আর কেউ নাই। আমরা দুজন বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে বসেছিলাম। চারপাশে বেশ দমকা বাতাস আজকে। আমি আর তুই কংক্রিটের মাঠে পা ছড়িয়ে বসছিলাম চুপচাপ। আমাদের মাঝে খালি অনিশ্চিত নীরবতা।
তোর সাথে আমার বিরাট ঝগড়া চলতেছে। আমি অনেক নাড়া খেয়েছি ভিতরে ভিতরে। তুই আমার সাথে এরকম করতে পারলি?
ঝামেলাটা কী নিয়ে লেগেছিলো ভুলে গেছি। আমার শুধু ঐ রাতের আধঘন্টার কথা মনে আছে। তুই আমার খারাপ দিকগুলোর কথা বলতেছিলি। বলছিলি আমি একগুঁয়ে, ঘাড়ত্যাড়া, বদমেজাজি, কোন কথা বুঝার চেষ্টা করি না। খামাখা গ্যাঞ্জাম লাগাই। আমার কারণেই এই ঝামেলাটা লেগেছে। এখন তোকে দু’দিক সামাল দিতে হবে। এই উটকো কাজটা তুই আমার জন্য করবি। রাগের মাথায় তুই এরকম কতকিছু বলছিলি!!
আমি শুধু মাথা নিচু করে বসে বসে ভাবছিলাম তুই এত বাজে ব্যবহার কেন করছিস আমার সাথে? মনে হচ্ছিল তুই খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিস, অযথা রিঅ্যাক্ট করছিস। এমন কিছু হয়নি যে তোকে সামাল দিতে হবে। হ্যাঁ ঝামেলা পাকাইছি, তো কি হইছে? আমার ঝামেলা আমি নিজেই ট্যাক্‌ল করতে পারি, তোর হেল্প কেন লাগবে? এসব টুকরা টুকরা কথা আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল।
তোর মনে পড়ে দোস্ত? আমরা কী দুর্দান্ত ছিলাম! কী ডায়নামিক ছিলাম। পুরা ক্লাসে এরকম আর কয়টা দোস্তি ছিল? একটাও কি ছিল? সেই ক্লাস এইটে একবার সিটপ্ল্যানে স্যার তোকে আর আমাকে পাশাপাশি বসিয়ে দিল। তার আগে তেমন কোন খাতিরও ছিল না। আর তারপর থেকে কীভাবে কীভাবে জানি তোর সাথে দারুন একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল! একসাথে পড়তাম আমরা মনে আছে। আমি তোরে ঠেলতাম, “ঐ বলদ! এইডা পড়, ফোর্টনাইটে আসবে। আজাইরা টাইম লস করিসনা!”
তুই কম পড়াশোনা করতি। কী কী নিয়ে ভাবতি। হাউসের নানা ফালতু ঝামেলায় জড়াইতি। কে কাকে কি বলছে, কেন বলছে এগুলা নিয়ে গুড ফর নাথিং পোলাগুলার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘোঁট পাকাইতি। একটা সময়ে আবার আমার ঝাড়িতে কাজ হত, ওসব বাদ দিয়ে পড়তে বসতি। এভাবে ক্লাস নাইন, টেন, এসএসসি!
মনে আছে তোর, একবার স্যার সিটপ্ল্যানে আমাদের পাশাপাশি সীট না দিয়ে সামনা-সামনি দিয়েছিল। আমরা দুইজন গিয়ে স্যারকে ধরেছিলাম ঠিক করে দেয়ার জন্য! স্যার একটা দাবড়ানি দিয়ে বললেন, “সারাদিন দেখি দুইটা বকর বকর করতেছিস! সামনা-সামনি বস্‌, তাইলে বদমায়েশি একটু কমবে তোদের! হা হা!” …কমেছিল কি দোস্ত?
এসএসসির পুরা তিনমাস ছুটি আমার কী যে বাজে কাটল! এলাকায় একটা ফ্রেন্ড নাই। গল্পের বই শেষ, টিভি দেখতে দেখতে মুখস্ত হলো “কহো না প্যায়ার হ্যায়”-এর গান! তোর সাথে কথা বলবো তার একটা মাধ্যম নাই। কলেজে ফিরলাম ২২শে জুন, মনে আছে? রেজাল্ট নিয়ে কী আনন্দ! আর তার চেয়ে বড় আনন্দ তোর সাথে এতদিন পরে দেখা, কত গল্প! ছুটির মধ্যে ঈদে তোর সেই ফোনালাপী মেয়েটা, সেই ঈদের শুভেচ্ছা দেয়া। কলেজে এসে সেই মেয়েটাকে কী লেখা যায় তাই নিয়ে আমার সাথে তোর কত পরামর্শ!!!
কী সব দিন গেছে! আর সেই তুই আমার সাথে এরকম করলি? আমার না হয় মাথা গরম, পাগলা থাকি। তুই তো শান্ত-শিষ্ট, মাথা ঠাণ্ডা, আমারে বুঝাইলেও পারতি। রাগের চে’ বেশি জন্মাইছিলো অভিমান। তুই আমারে ক্যামনে ভুল বুঝলি? আজকে আমারে ভূতে পাইল যে আমি এইসব ভাবতেছি। কত বছর আগের কথা সেই বাস্কেটের গ্রাউন্ড? মনে হয় আগের জন্মের স্মৃতি বিধাতা কৌতুক করে ভইরা দিছে মাথায়। সেগুলো আজকে বড় কাঁদায়!
কলেজ ছেড়ে আসার আগে দিয়ে তোর উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছিল। প্রিন্সিপ্যাল, অ্যাডজু’ সবাই তোরে বাঁশ দিতেছিল। পড়তে পারতি না, টাইম পাইতি না। সেই তুই মাঝেমাঝে আমাকে এসে বলতি, “একটু পড়ায়ে দে দোস্ত, এইটা বুঝতেসি না”। আজকে মনে হয়, “আর তো কেউ কোনদিন এভাবে বললো না!” কলেজ ছেড়ে বের হয়ে তুই গেলি আর্মিতে, আর আমি গেলাম বুয়েটে। তাও ভর্তির আগে তবু ঢাকায় ছিলি, ডিসেম্বরে চলে গেলি চিটাগাং। কত দুরে! তোর সাথে দেখা হইতো না, কথা হইতো না, কিন্তু তুই ছিলি। এমন কতদিন গেছে তোর কথা মনেও পড়ে নাই! কিন্তু আড্ডার মধ্যে কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড নিয়ে কথা তুললে আমার ঝাঁ করে তোকে মনে পড়ত। তারপর আর কিছুই ভাল লাগত না, ঐ আড্ডা, ঐ হৈচৈ। আমি তখন সেখানে অপাংক্তেয়!
তোর পোস্টিং হলো বগুড়ায়। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতি। দুই একদিনের জন্য। আমি কাজ ফেলে যাইতাম বিকালে বা সন্ধ্যায়, তোর সাথে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম! কী অদ্ভুত লাগত তখন বাস্তবতা! আমার মাঝে মাঝে মনে হত এ কেমন জীবনে ফেঁসে গেছি তুই আর আমি! একটা দিন দেখা হলেই মনে হত অনেক পেলাম!!
এখন তুই তো আরো দুরে। কোন সুদুরে আইভরি কোস্টে। কবে ফিরবি রে? তোরে দেখিনা বহুদিন, বহুদিন!!
একটা জীবনে মানুষ কয়টা বন্ধু পায়? কয়জন তাকে পুরোপুরি বুঝে? রেগে গেলে শান্ত করে, ক্ষমা চাওয়ার আগেই ক্ষমা করে দেয়? তোকে একদিন বলেছিলাম, (কবে মনে নাই) “আমি তোর উপরে আর কোনদিন রাগ করবো না। চ্যাত দেখাবো না।” তুই বলেছিলি, “ক্যান?” আমি মুখে বলেছিলাম, “কারণ লাভ নাই, তুই একটা টিউবলাইট। বুঝবিও না যে আমি চ্যাতছি। হুদাহুদি আমার রাগ নষ্ট করমু ক্যান। তুই হালায় একটা ফাউল!”
আসল কারণটা হইল আমি তোর উপ্রে ক্যামনে রাগ দ্যাখাই? তুই যে আমার না জন্মানো ভাই! ভাল থাকিস। আমার এলোমেলো জীবনের সবটুকু ভাল জিনিশ দিয়ে তোর জন্য দোয়া করি, তুই ভাল থাকিস, বন্ধু!