বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার



ছাইদানির মানচিত্রে খয়েরিদাগেরা বলে তুমি সেখানে শুয়েছিলে পরতে পরতে
তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার


বিছানায় ফিরে যাবার সময়ে তোমার চোখেও কয়েকটি মৃত্যু জমে থাকে
তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার


সেখানে বিষন্ন বালিশ কেঁদেছিল তিনযুগ জেগে থাকা বিনিদ্রতায়
শীত রাতের কুয়াশা শাল গায়ে খুব মোলায়েম ব'সা ছিল রোদে


সূর্যে আগুন ধরে গেলে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো
বই-মলাটের ভাঁজে ভাঁজে তখনও জেগে থাকে অলস জন্ম-কোষ


তুমি যা হতে চেয়েছিলে একবার, সেরকম হয়ে ওঠা হয়নি তোমার




***


[উইলকো'র একটি গান শুনে...]

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

ইন্টারভিউয়ের টেবিলের ওপাশে আমি

"'আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন - কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;-"
এরকমই লিখেছিলেন জীবনবাবু
কলম-নিবের প্যাঁচানো কালো কালো সাপ
সর্পিল ধমনীপথেই সর্‌সর্‌ নেমে গেছিলো।


আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকিনি ব'লে
জানতে পারিনি কতটা ছোবল কতটা অভিশাপ
মেখেছিল জীবনবাবু'র আস্তিন।


এখন এখানেও শীতঘুম-ভাঙা
প্রকাণ্ড বুভুক্ষু সাপ! তিনটা! চারটা! শতশত!
রোমরন্ধ্র ছিড়ে খুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে মাংসে...


আমি নীলবিষের পুলকানন্দ কুড়িয়ে নিতে থাকি
(এবং এহেন গ্রহণে কোনও লজ্জা লাগে না আমার!)
তাই বলে প্রথাগত প্রাচীন সর্পদল মাথা হেলে
আমার বেশর্‌ম নগ্নত্বকে মানচিত্র উল্কি এঁকে দিতে কুণ্ঠাও করে না।


| | তাঁদের চোখে জীবনবাবু অনেক ভালো লোক ছিলেন | |
আহারে! লোকটা অযথা অসময়ে অকালে
তাঁদের বেকার শীতঘুমে পাঠিয়েই মারা গেলেন?


বিশেষণ-ক্লান্ত সাপ, শেষে, মাথা নেড়ে
পরবর্তী রিফ্লেক্সে সটান ছোবল হানে
করোটির ঠিক জ্যা-বরাবর মাঝখানে
ফুঁসে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে বলে,
তুমি একটা চূড়ান্তরকম ফাউল্‌!

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

পুরোনো জন্ম এবং নতুন মৃত্যু


প্রথম খণ্ড


গাড়ীটা চলছিল অনেক জোরে। জানালা খোলা। আমি অনেকদিন চুল কাটাইনি। তুমুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল বারবার। আমি ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম না। আমার চোখ ঢেকে যাচ্ছিল ঝাপ্টায়, বার বার!


আমরা দুই ভাই এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে যাচ্ছি। ড্রাইভিং সীটে আমার খালাতো ভাই। বিস্রস্ত মুখে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বিপজ্জনকভাবে কয়েকটা গাড়িকে এদিক ওদিক করে পাশ কাটালো।


"আস্তে!" "সামলায়ে চালা!"- আমি একটু সচকিত হই!


"আর শালার বাইঞ্চোৎ দুনিয়া!" "আস্তে চালায়া কী লাভ?" - আরো কয়েকটা কুৎসিত জন্মসংক্রান্ত গালি বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে।


দ্রুত মোড় ঘুরে আমরা আরেকটা রাস্তায় ঢুকে পড়ি। ফাঁকা রাস্তা- ঘড়িতে কোয়ার্টজ বলছে দশটা বেয়াল্লিশ।


"বাড়ি চল! আর কত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি?"- আমার স্বরে হতাশা আর ক্লান্তি ঝরে পড়ে। শেষ কিছু সময় ধরে আমরা এখানে ঘুরছি। প্রায় ফাঁকা রাস্তাগুলোয় গাড়ির গ্যাস পুড়িয়ে চর্কির মতো, আর ওর মাথার ভেতর যেভাবে হিরোশিমা ভেঙে পড়ছে সেটা বুঝতে পেরে আমি থমকে থাকি! এখানে আমার কিছু বলার নাই।


দ্রুত ছায়াবাজি সামলে একটা বিকট ট্রাকের হর্ণ এবং ফ্ল্যাশলাইট আমাদের ঝলসে দেয়ার সাথে সাথেই ঘটাং করে ব্রেকহুইলটা ভেঙে গেল। ওর মুখ একচিলতে হাসি ঝিকিয়ে উঠল আর আমি দেখলাম বুলেট-মোশনে আমরা গাড়িসমেত আইল্যাণ্ডে আছড়ে পড়লাম। জ্ঞান হারানোর আগে তূর্য কাতর কণ্ঠে হেসে দিল না কঁকিয়ে উঠল সেটা আমি টের পাইনি।


---- ---- ---- ---- 


দ্বিতীয় খণ্ড


স্বচ্ছ গ্লাসে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ভেতরে জমানো আইসক্রিম একটু একটু গলনের সূত্র মাপছে। টুং করে গ্লাসের গায়ে একটা টোকা দিল সুমাইয়া। দুয়েকফোঁটা পানি তার নখাগ্র ছুঁয়ে নেমে আসছিল। আলতো ঝাঁকিতে তারা নিচে রাখা টিস্যুতে আশ্রয় নিল। টিস্যুমাতার কোল ছাপিয়ে বিন্দুদ্বয় ব্যাপিত- অভিস্রবিত! সুমাইয়া নখ ঘষে মুছে নিতে নিতে দু'ঠোঁটে টেনে নিলো স্ট্র! ঘোলাটে স্ট্রয়ের ভেতর দিয়ে চকোলেট উঠছে ক্রমশ!


ঘড়িতে সময় দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। সুমাইয়ার গায়ে শীতল শীতাতপ একটা পরশ বুলিয়ে দিলে সে একটু কেঁপে ওঠে কি? পাশে রাইয়ান বসে ছিল। আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে সে সুমাইয়াকে। তপ্ততার সূত্র তখন খেলতে শুরু করে। ইতস্তত বিক্ষেপ অভিক্ষেপ এপাশ ওপাশে দোলনাক্রান্ত-শৈশব বিস্মৃত হয়। সুমাইয়াও উষ্ণ হতে চায়!


তিনমিনিট পরে আবছা জ্ঞান ফিরলে তূর্যও উষ্ণ রক্তপাত টের পায়। আস্তিন ছাপিয়ে রক্ত ছুটছে ট্রাউজার ছাপিয়ে গরম স্রোত নামছে। সম্বিত ফিরে পেতেই পাশ ফিরে আমাকে দেখল ও। আমার পা দুটো দুমড়ে বেঁকিয়ে উপরের দিকে উঠে এসেছে পেটের কাছাকাছি। মুখ ঈষৎ হা। হাত দুটো সরানো। বুক জুড়ে চাপ চাপ রক্ত। গাড়ির উইন্ডশীল্ডের ফাটলে বিকিরিত হয় দূরান্তগামী হেডলাইট।


রক্তে যেন প্লাবন বইছে সুমাইয়ারাইয়ানের। তারা মিশে যেতে থাকলে সে টের পায় প্লাবন নামছে দুই পা জুড়ে। তূর্যের শরীরেও রক্ত বইছে। আমি দর্শক হয়ে যেতে যেতে টের পাচ্ছি তূর্য ঠা ঠা করে হেসে দিচ্ছে। সুমাইয়ার চাপা শীৎকারের সাথে ওর গোঙানি মিশে যাচ্ছে হাইওয়েতে।


---- ---- ---- ---- 


তৃতীয় খণ্ড


সাদা আলোর বেশ কিছু প্রকার আছে। হলুদাভ, নীলাভ অনেকগুলো শেডে সাদারঙ মেলে রাখা যায়। এখন যেমন নীলচে সাদা আলো জ্বলে আছে এখানে। দেয়ালের টাইলসগুলোকেও সেই আলোতে নীল মনে হচ্ছে। ফ্রস্টেড গ্লাস বন্ধ। শীতাতপের ঘন বিজবিজে শব্দের সাথে সহচর শব্দ হচ্ছে আরেকটাঃ পর্যায়বৃত্তিক বিপ্‌-বিপ্‌-বিপ্‌... । সেসময়ে দস্তানাবৃত অপরিচিত দু'হাত তূর্যের বাদামী জীবাণুনাশক মাখানো লোমহীন-ত্বকহীন পা থেকে পায়ের টিস্যুগুলো কেটে ফেলছিল। তীব্র সাদা আলোটাও সেখানে হা করে রাখা হাড়মাংসের পাশে ছটফট করছিল। 


কালো হয়ে যাওয়া মরা টিস্যুগুলোকে ডাক্তারের কেটে ফেলা খচাখচ- সে দেখতে পারছিল না, কারণ চোখে সাদা গজ্‌ খুব শক্ত করে আঁটা। নাকেমুখে কয়েকগণ্ডা নল, অ্যানেস্থেটিকে ফুসফুস আর মস্তিষ্ক ভরা। ঘি'রঙা-দস্তানাতে রক্ত মিশতে থাকে, যেভাবে সুমাইয়ার ফর্শা উরুতে রক্ত মিশছিল। তূর্যের শরীরে ছোপ ছোপ শ্লেষা মিশেছিল তখনও! চিল-চিৎকার দিয়ে সে পৃথিবীকে জানাচ্ছিল তার ইশতেহার। ক্ষুদ্র হাত-পা অব্যবহৃত চলনে তৎপর! সুমাইয়া ক্লান্ত হেসে দিচ্ছিল। রাইয়ানের ঢেকে রাখা মুখে শুধু চোখের ঝিলিক দেখে সে বুঝে নিচ্ছিল যে তার সন্তান ঠিকঠাক জন্মেছে। 


এখানে দস্তানা-সমূহ তূর্যের পা ড্রেসিং করে দিতে ব্যস্ত। আরও দু'দিন পরে তার শরীর জুড়ে লেন্সবাচক-চোখ স্থির হলে শিশু-তূর্য আর তরুণ-তূর্য ফ্রেমজুড়ে মাখামাখি হয়ে যায়। 


কেন্দ্রে শুধু সুমাইয়ার হাসিটুকু অমলিন চেয়ে থাকে। 


---- ---- ---- ----
(সমাপ্ত)

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০০৮

সেলাই#২

ফোরসেপ হাতে তুমি আমাকে কাটছিলে চারবার এদিক ওদিক কৌণিক পোচে ভূখণ্ড কেটে ফেলে জোড়াতালি কাঁটাতার মেখে সেখানে চড়ুইয়ের ঘর বসানো বাড়ি থেকে সূর্যরশ্মি তীর্যক উড়ে এসেছিল। তোমার নখের ভেতর চুলের ভেতর মরাত্বকের ভেতর জন্মজ ডাক ছেড়ে কাঁদা ত্রিরাত্রবয়সী বালিকা আমার কানে চিৎকার পৌঁছে দিল বলে ধাতব টিনের বিছানায় উপুড়মুখী শুয়ে থাকা তোমাকে দেখে আমিও পাশে নগ্ন-উন্মুল ঊর্ধ্বাকাশ মাপি আর ফাটল ফাটল বেছে ফেলি উকুনের গুষ্টি বাছার মতোন। অ্যামোনিয়াগন্ধ সেসময়ে মাঝখানে অভিলম্ব ধরে ঝুলে থাকা শিরদাঁড়ায় জমে যাচ্ছিল।

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

স্মৃতিভ্রষ্টতার উল্টোযাত্রা

এটাই প্রারম্ভের অন্ত অথবা অন্তিমের আরম্ভঃ এরকম ঘোষণায় সচকিত হয় রোমকূপ। সামনে জীবন নাই, আশা নাই, সুর নাই, নারী নাই। নেশা নাই, কবিতা নাই, তোমার দুচোখ নাই। তার থেকেও তীব্রশরীর, স্তন আর নাভিমূল নাই, তোমার মধুকূপী বাহু নাই, রীডসুলভ আঙুল নাই। প্রথাগত শূন্যতার চাইতেও বেশি কিছু, অনেক কিছু জীবন ছাড়িয়ে যার ছায়া পড়তে পারে, আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। সংখ্যারেখার প্রমাণবিন্দু হারিয়ে গেলে খুব বিপন্ন লাগে। যেমন বিপন্ন লাগে সময়-ঘড়ি হারালে। যেমন বিপন্ন লাগে মাংস স্বাদের গন্ধ হারালে।


আরম্ভ হলেই শেষ হবে, জানা কথা। তাহলে কোন কিছু শুরু করতে আমি এতো উদযাপন করি কেন? উদ্বোধনের প্রগলভ উচ্ছ্বাসে আমি সময় অপচয় করি, অর্থ আর শ্রম ব্যয় করি, যদিও জানি সামনে এরকম কিছু নাই- কিছু থাকবে না। এই ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার মতো অমোঘ নিয়তিতে সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে আর আমার খেলার মাঠ জুড়ে বিষন্ন কাক বসে র'বে।


চিকন কণ্ঠে তুমি গাইছো। একটু কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে গলা। ওটা পেরিয়ে যাই আমি, ও কিছু না। গানটা সুন্দর লাগছে, কান দিয়ে ঢুকে বুকে পৌঁছে যাচ্ছে। আপাত নির্বাক আমি একটু আগে বলছিলাম, একটা গান শোনাও না। তুমি লাজুক হাসছিলে, ধুর! আমি গান পারি নাকি? আমি বললাম, খুব পারো। গাও, আমি শুনবো। তুমি শুরু করতেই আমি জড় হই, স্থির হই। কাঁপনগুলো থেমে আসে। বোধসমূহ তাবৎ জামাকাপড় সাজসজ্জা খুলে ঘুমুতে যায় আলো নিভিয়ে।


অনেকক্ষণ পরে, কখন আমার খেয়াল নেই, তোমার গান হয়তো অনেক আগেই থেমে গেছে। গান থামিয়ে তুমি আমাকেই দেখছিলে হয়তো। আমি সম্বিত ফিরে পাওয়ায়, সেটা হারানোর লজ্জায় বিব্রত হই। ভালোবাসা প্রকাশিত হলে লাজুক লাগে মনে হয়! আমি শশব্যস্ত হয়ে ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে চেষ্টা করি। কী আশ্চর্য! এই নিশুতিতে ঘুঘু কোত্থেকে আসবে? "ঘুঊঊঊ ...ঘুঊঊঊ ..." আমি চমকে তাল সামলে বুঝতে পারি কোথাও আসলেই ঘুঘু ডাকছে। গভীর বিষন্ন সুরে ডাকছে। সেই ডাকের পশ্চাতে একটা বিমর্ষ হাহাকার জেগে উঠতে থাকে। দূরত্ব বাড়লে আমাদের প্রিয় মুখের উত্তাপ কি ধীরে ধীরে কমতে থাকে? আমরা কি স্মৃতি প্রখর নই? কেনইবা আমাদের প্রতিদিন দেখা লাগে, ছোঁয়া লাগে, খুঁজে নেয়া লাগে প্রাণান্ত-আত্মাদের!


গায়ের গন্ধ খুব মাতাল করে দিতে পারে। নাসা ফুলিয়ে ফুলিয়ে আমি যে সুবাস পাই তা নিউরণে ঢুকে কী প্রলাপ শুরু করে দিতেছে, আমার স্রোতবহা রক্তে নাচন ধরিয়ে দিচ্ছে! সেখানে কণিকার ভাঁজে ভাঁজে রূপায়িত ঘুঙুর বেঁধে ঝুন ঝুন, রুন ঝুন করে তোমার ত্বক-সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি গাঢ় হয়ে আসি, ঘন আর নিবিড় করে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। তাপ পরিবাহে আটানব্বুই ডিগ্রীর তীব্রতার আঁচে আমরা জড়লাল হয়ে উঠি! দূরত্ব কমে গেলে তোমার বুকের ভাঁজে একটা নরম তিল জন্মে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি দূরে যেতে চাই না। আমি চোখের আড়ালে যেতে চাই না। ইন্দ্রিয়-বিপন্ন হয়ে আমি খুঁড়ে খুঁড়ে গোপন বিষন্নতাগুলো লুকিয়ে রাখতে চাই।


তুমি সেকথা জানো। খুব ভালো করেই জানো বলেই হেসে দাও খিল খিল করে। চুলের শীর্ষমুখী কাঁপন থেকে থরে থরে মুক্তার মতো হাসি ঝরে পড়তে থাকে। আমি তোমার সাথে নিবিড় হয়েও বিস্তারী-অস্থিরতা লুকাতে পারি না।


-"মাত্র তো একটা সপ্তাহ!"
-"মাত্র?"
-"আহা! তুমি অবুঝ হলে আমি কোথায় যাই?"
-"কোথাও যাওয়া লাগবে না। থাকো।"
-"আমার দায় তুমি বুঝো না? দিনগুলোকে কঠিন করে দিও না।"
-"কেন নয়? আমি কীভাবে থাকবো অনুভব করো তুমি!"
-"করছি বলেই, করবো বলেই তো ফিরে আসবো!"
-"কবে?"
-"এই তো, সাত দিন। কষ্টে কাটবে দিনগুলো!"


আমি ম্রিয়মাণ ক্ষোভে সরে যেতে থাকি দূরবর্তী বাতিঘরের মতো। ছলাৎ শব্দে পাড়ভাঙা বিষাদ এলোমেলো বয়ে যেতে থাকে তথৈবচ উদ্দেশ্যহীন। শরীর শীতার্ত আগ্রহে স্বেদকণা শুকিয়ে নোনাদাগ ধরে রাখে। আজ মনে হয় তিন দিন-তিন রাত হলো, আমি দেখি নাই তোমাকে। অবসর মুহূর্তের ক্লান্তি জ্যাকেটের বোতামে লেগে থাকে। যেমন অনেক সময় বাতি নেভানোর পরেও আলোর রেশ চোখে লেগে থাকে। বাইরে কুয়াশা ছিটকে দেউড়ি পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। আবছায়া আলোতে দেখি ছেঁড়া পৃষ্ঠার মতো হালকা দোলনে শিশিরকণারা দুধসাদা বিছানায় শুয়ে পড়ছে। আমি ধীরপায়ে তাদের সরিয়ে গুটিসুঁটি মেরে শুয়ে থাকি জামাকাপড় না ছেড়েই। গ্রাফাইট কণার গন্ধ জড়িয়ে থাকে লিনেনের প্রান্তে। ঘুম এসে ভেঙে ভেঙে যায় এই বিভ্রমে যে আমি চলন্ত ট্রেনে আছি, যেটাতে করে রোজ ফিরি। আমার উল্টোদিকে ব'সে থাকা ভাবলেশহীন মুখব্যক্তি চোখ মেলে দেখেই আমি চমকে উঠি। লোহার হাতলের স্পর্শও আমাকে শিহরিত করে। ট্রেনেই আছি তাহলে! শাটলের মতো দ্রুততায় তুমি সরে সরে যাও। আমি দুঃস্বপ্নের ছোবল ভেঙে জেগে উঠি। গলা শুকিয়ে কাঠ! অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে সিঙ্ক পর্যন্ত গিয়ে পানি খাই ঢকঢক করে। রেখে দেয়ার সময়ে গ্লাস বড়ো শব্দ করে টাইল্‌সে!


আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আর কখনোই দেখা হবে না আমার। যেদিন শেষ দেখেছি সেটাই তোমার আমার শেষ দেখা ছিল। ফ্ল্যাশের আলোতে চোখ ঝলসে গেলে তারাবাজি হচ্ছিল চোখে, ফুটি ফুটি তারা জ্বলে নিভে উঠছিল। সয়ে নিতে নিতে তুমি হেসে নির্বাক ফটোফ্রেম হয়ে গেলে। দ্বিমাত্রিক তলের নিষ্ঠুরতায় তাকিয়ে আছো! ঈষৎ হেলানো তোমার মাথা। চুলগুলোও ঢেউ খেলিয়ে সরে আছে। ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ধরে আছো। আর চোখের তারায় দুষ্টুমি। আমি ক্যামেরার ফ্ল্যাশের সাথে বিন্দু বিন্দু তোমাকে বেঁধে নিয়েছিলাম।


পীতাভ ঝলকে তুমি আটকে আছো তেইশে। তেইশ পেরিয়ে আমি অনেকদূর চলে গেছি। দূরত্ব বাড়লেও টান কমে না কেন? নাকি কমে যায়? জ্যামিতি ভালো বুঝি না বলে ক্লাশের স্যারেরা খুব বকতো। মারও খেয়েছি কম না। তারপরেও আমি কিছুতেই দুই বিন্দুর দূরত্ব বের করতে পারতাম না। বারবার ভুল হয়ে যেত। আরও কতো কতো ভুল হয় আমার! হিসেবে ভুল, সময়ে ভুল, স্মৃতিতে ভুল। এখানে জলজ চোখ ছেড়ে তুমি শুষ্ক হয়ে গেছো- জানার পরেও আমি প্রক্রিয়াজাত করতে পারি না। ক্রমশই আমার মনে হতে থাকে,"এই তো, সাত দিন। কষ্টে কাটবে দিনগুলো।" বলে তুমি উঠে গেছো। তোমার শরীরগন্ধী উষ্ণতা এখনও পড়ে আছে এখানে কয়েকবিন্দু। আমি দু'হাতে সেগুলো কুড়িয়ে মুঠোবন্ধ করতে থাকি। করতলে তখনও ঘুঘুর ধুকপুকানি শোনা যায়!

সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

শীতঃ জন্মশোক পর্ব

অরূপাক্ষ ছেড়ে শহরকামী আমি
বহুদিন;
হলুদ ধূলোর মতো কুয়াশা আমার জন্যে
অনেকটা পথ পদছাপ খুঁজে এসেছিলো,
জড়ানো বিষাদ ফেলে।


ফর্সা আলো ছিঁড়ে এসে আমি
মিহি আঁধার খুঁজে পেতে থাকি।


নিচে কালো-পাথর রাজপথ রেখে
চতুর্ধা চিহ্নশাখায় অকস্মাৎ
গাড়িহীন নৈঃশব্দ্যে
বিপন্ন ঝুলন্ত লাল ট্র্যাফিক সিগন্যালে
পুরোনো ধূলো-কুয়াশা কিছু-
দেখতে পাই।


বিভ্রম ভেবে মুখ ফেরালেই
কাঁধের ওপরে এক বাক্স সূর্য
হেসে দেয়।

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৮

দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং!!

রাত নামলে নিশাচর সকল প্রাণিদের মাঝে একটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। যেমন করে দিবাচর প্রাণিরা সকালে সূর্যকে মানে, উনি উঠে গেলেই তারা বিছানা-বালিশ ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপরে বিমূঢ় ত্বকে পানি ঝাপটা দিয়ে জেগে ওঠে। জেগে ওঠার ক্ষণ থেকেই তাদের বোধসমূহ সজাগ হতে থাকে। শৌচ শেষ করে নাশতার পরে ধূমায়িত চা খেতে খেতে সকল পাপ ঘাড়ে নিয়ে জাগতিক বোধেরা ফিরে আসে।


সেরকম ভাবে নিশ্চয়ই নিশাচর প্রাণিরা জেগে ওঠে। সূর্য ডোবার সাথে চাঁদের সময়কাল মিলে না অনেক সময়। রাত আসে যখন, সন্ধ্যা ফুরানোর পরে, প্যালেট থেকে আরো একপোঁচ গাঢ় অবাস্তব বিমর্ষ আঁধার চারপাশে বুলিয়ে দিলে, রাত নেমেছে নিশ্চিত হওয়ার পরে তারা জেগে ওঠেন। তাদের জেগে ওঠা দিবাচরদের মতো এতো সশব্দ হয় না। অনেকটা সরীসৃপের মতো নিস্তব্ধতায় একটা সাড়া পড়ে যায়। একটু পরে, টের পাওয়া যায়, নগরের জনপদ ছাপিয়ে, রাস্তার জ্বলজ্বলে চৌকস গাড়ি-হেডলাইট মাড়িয়েও নিশাচরেরা জেগে উঠতে থাকেন।


রাত বাড়তে শুরু করলে নিশাচরদের প্রাত্যহিক আলাপ শুরু হয়। তাদের আলাপে দিবাচরদের মতো সরলীকরণ থাকে না। সকালের মানুষেরা যেমন সরাসরি কথা বলে, সরাসরি হাসে, কাঁদে, ঝগড়া করে, নিশাচরেরা তেমন করতে পারেন না। রাতে আলোকিত করার মাধ্যমগুলো হয় ঝাপসা নাহয় অতি উজ্জ্বল। নিশাচরদের চোখ তাতে পুরোপুরি কখনোই মানিয়ে নিতে পারে না। ক্রমশ অভিযোজনের চেষ্টায় রত চোখে সবকিছু ঠিকঠাক ঠাহর করা যায় না। বৈদ্যুতিক আলো সেকেণ্ডে পঞ্চাশবার জ্বলে ওঠে আর নিভে যায়। এতো দ্রুততার সাথে কাজ করলেও নিশাচরদের চোখে এই আলোর অনবরত ওঠানামায় একটা ঢেউমূলক সরণ ঘটে। চোখের বাইরে সবকিছুকে তারা কর্ণিয়ায় গেঁথে নিতে পারে না। আর যেখানে বৈদ্যুতিক আলোরহিত, সেখানে তারা আধোঅন্ধকারে ঠাহর করতে শুরু করে। দেখার ক্রিয়াটার সাথে ঠাহর মিশলে একটা তেলজল মিশ্রণ তৈরি হয়। প্রতারক স্মৃতি তাদেরকে ভ্রষ্ট করে।


এহেন পরিস্থিতিতে নিশাচরদের কথা জড়ানোকুটিল বহুবিধ মাথাওয়ালা হয়ে ওঠে। কথার লেজের মুখও খোলা থাকে অনেকগুলো। র‌্যাটলস্নেকের জান্তব সর্‌সর্‌ শব্দ করে লেজের ছিন্নমাথাগুলো নড়ে চড়ে শূন্যে। অন্য নিশাচরেরা সেকথার লেজে পাড়া দিয়ে কখনো কখনো নতুন কথা বাঁধে শক্ত গিঁট দিয়ে।


তারপরে দিবাচরদের ঘুমানোর সময় আসে। তারা খেয়ে দেয়ে মশারি টাঙায়, দাঁত ব্রাশ করে, একটু টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়। তারপরে হাই তুলতে থাকে। একটা সময়ে কাঁথাচাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। তখন নিশাচরেরা হেসে হেসে দিবাচরদের ঘুমিয়ে পড়া দেখে। শিশুদের ঘুম দেখে যেমন করে নব্যপিতামাতারা স্নেহের হাসি হাসেন, সেরকম একটুকরো হাসি ক্ষয়াজ্যোৎস্নার মতোন তাদের চোয়ালে লটকে থাকে। এইরকম জীবন তারা কবে কতো আগে কয়েকমৃত্যু আগে ছেড়ে এসেছে! কয়েকজীবন পরের একজোড়া নিশাচর-চোখে তারা চেয়ে থাকে।


তারও কিছু পরে ওদের ভুলে তারা আবার কথার গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগে বাঁধা কথার সুতোরা অনেকসময়ে হারিয়ে যায়। নিশাচরেরা তাতে খুব একটা উদ্বিগ্ন হয় না। রাতে চলাচল কম হয় প্রাণিদের, এরকম বহুমাথা আর সর্পলেজী কথার সুতোয় অন্যকেউ ভুলেও পা মাড়াবে না। পথের পাশে পড়ে রইলেও বাকিরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যাবে। তাই হারানো কথামালা নিয়ে ব্যস্ত হয় না এরা। বরং দেখা যায় নতুন কথার প্রতি তাদের অনেক মনোযোগ, অখণ্ড মনোযোগ।


আরো কিছু পরে নিশাচরদের মাঝে কেউ একজন জোরে শব্দ করে হেসে ওঠেন। শব্দের তীব্র সাইরেন ঠাশ ঠাশ করে দেয়াল ভেঙে দেয়, রেলিঙে হেলান দিয়ে রাখা চৌকি বা কাঠের স্তুপগুলো প্রতিধ্বনির মতো গুড়িয়ে পড়তে থাকে। রেজোনেন্সের মতো শব্দের ঢেউ অনুনাদ-চূড়া-খাদ মাড়িয়ে আসতেই থাকে, আসতেই থাকে। কোনও কোনও দিবাচরের ঘুম সেই শব্দে ভেঙে যায়। তারা চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠে পানি খায়, বুকে মাথায় ঝাপটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে মশারির পেটে।


নিশাচরদের দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি ঘুম-চটে-চেয়ে-থাকা দিবাচর-চোখদের থাকে না। এটা অনেক আগে থেকেই জানে নিশাচরেরা। এজন্যে তাদের হাসির শব্দের অনুরণন চলতেই থাকে। প্রস্তর-গড়া-জনপদ-বস্তির চল্‌টা-ওঠা রাস্তায় সেই হাসিগুলো কথাগুলো মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে। উপরে বিবিক্ত আকাশে এ-ক-ফোঁ-টা আলোও বাকি থাকে না। রাত কতটা গভীর হলো বুঝে উঠতে কোনও এক নিশাচর মুখ তোলে। অন্য-অনেক সর্পিলেরা তাকে নিশ্চিন্ত করেঃ "আরে! দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং!"



বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৮

উৎসব কোলাজ

করতল থেকে মুখ মুছে যায় রেখা মুছে যায়
জ্বলজ্বলে মার্বেল ভাস্কর্য হয়ে শরীর ছাপিয়ে উঁচুতে-
আরও উঁচুতে উঠে যায়, এহেন বিদারী-চিৎকার
আটশতেক বিল্ডিঙ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক!


রঙহীন ক্যানভাস থেকে নেমে দুয়েকফোঁটা বিষাদ-
রিয়ার-ভিউ মিররে চল-ছবি হয়ে যায় ইচ্ছে অবাধ-


প্যালেটে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া শীতঋতু জেগে
মালসায় মাখে ভাপ মাতামহীর বলিরেখা ছেড়ে
আছড়ে পড়া ঘাসজমিনে মেলে রাখা নিবিড় উৎসব
ঘূর্ণায়মান লাটিমে জড়ো হয় তুমুল বান্ধব!


এখানে জীবন মৃত্যু সকাল সন্ধ্যা নাই, নাই,
অবিচল নিশ্চুপ ছায়াহীন সময় স্থির
সূর্যনির্ভর সময় মাপতে আমার অনাগ্রহ যারপরনাই
এখানে ওখানে ছায়া সরে যায়; ধারণা পাই
সমান্তরালে বিশ্বে তখন সকলে করেছে ভীড়।


রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

সুপারভাইজার ও অনন্যার চোখ


সুপারভাইজার


সুপ্রিয় যাত্রীবৃন্দ, আপনাদের শুভেচ্ছা!
এখানে সোহাগ ভলভো সার্ভিসে আমাদের পথচলায়
আমি মোকাদ্দেস আলি, আপনাদের সাথেই আছি
এখানে আপনাদের দেয়া হবে একটি হেডফোন
সাথে কুকি-বিস্কুট এবং পানীয়
সেগুলো পেয়ে আপনারা বিগলিত হবেন
এবং ভাববেন, "এযাত্রায় খুব দাঁও মেরে দিলুম!"




অনন্যার চোখ


...ক্রমশ কীটচলনের ফলে আমার মাথার ভিতরে নাগাসাকি ঝরে পড়তে থাকে বলে আমি চোখ মেলে নির্লিপ্ত মনিটরে ফোটন খুঁজি, পিক্সেল ভেঙে ভেঙে দুইশছাপ্পান্ন রং ঢুকে পড়ে ইন্দ্রিয়পথে; সেখানে তাদের ইগলু-ঘরের পাশে রোম রোম পেতে ধূসর জর্নাল পৃষ্ঠা উন্মোচনের গাঢ়বিষাদের আয়নার ওপাশে অনন্যার চোখে ঝিলিক বুলায়। রুঝ মুছে গেলো কিনা বুঝে ওঠার জন্যে অনন্যা একবার তাকিয়েছিল পারদলেপা তলে, সেজন্যেই ফ্রেমের মাঝখানে তার গোলাপি ঠোঁট তিরতিরিয়ে গোপন কথাগুলো বলে ফেলে অকপটে। খানিকপরের বিকশিত চর্চিত লালাভ শরীর আমার মনিটর পেরিয়ে এলে আমি কপাট বন্ধ করে দিই...

শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

~যাত্রাপথে~মাত্রাছাড়া~কথার্মালা~


রাস্তারপাশে নীল নীল সাদা আলো কিছু কিছু
জ্বলে ছিল নিভে নিভে ছিল জ্বলে
পেরিয়ে গেলেই সাঁই সাঁই টানে
এদিক ওদিক দুলতে দুলতে
সামনে পড়লো হলুদ কমলা আলোর মিছিল
জোনাক পোকার চেয়েও শীতল অথবা
উষ্ণপ্রবাহ নিয়ে
আলোরা জ্বলছে
নিভছে জ্বলছে নিভছে ডুবছে ভাসছে হাসছে
আমি দেখে দেখে চোখের পলক ফেলতে পারি না
চেয়ে থাকি দূরে নজর কেড়েছে
তা'রা জেনে গেছে মুগ্ধ বালক জীবন ফে'লে
ছুটে আসবেই মোহের টানেতে কেটে কেটে পানি
কেটে যাবে দিন রাত নেমে যাবে ধু ধু মাঠব্যাপী
সেখানে শেফালি ঝরে ঝরে ঘাস সেজে নেবে রূপ
অপরূপ তার সেই ঘাসেদের পথ ধরে আলো চুপ!


আমি দেখে দেখে অবাক বিভুঁই
হঠাৎ বুঝেছি এ হলো শুধুই
ভ্রান্তি মায়ায় জড়ানো শৈত্য
বুক থেকে নেমে হৃদকণা ছেড়ে
আমার শরীরে শীতের নৃত্য।

বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

সনদবিহীন আত্মজ


ঙ.
...শশাঙ্ক নামে একটা ছেলে জন্মেছে একটু আগে। ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ডের ঘোলাটে পর্দাঢাকা কেবিন থেকে তার চিল-চিৎকার ভেসে আসছে। ফিনাইলধোয়া ঘরে জীবাণুমুক্ত তোয়ালেতে সে জড়ানো। রোগ-জরা তাকে এখন ছুঁতে পারবে না। আরো অনেক অনেক দিন পরে সে পঙ্কিল হবে, তার আগে এখন অন্তত সে নিষ্পাপ, সরল, নির্মল আগমনের পরে কাঁদছে। শশাঙ্কের মা, একটু আগে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন চুপচাপ। মৃত্যুর একটু আগে তিনি একবার শশাঙ্ককে কোলে নিয়ে তার নরোম মাথায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলেছেন।...




ঘ.
...গত কিছুদিন ধরে শরীরটা কেমন খুলে খুলে যাচ্ছে। এমন ক্লান্ত লাগে! বসতে কষ্ট কষ্ট উঠে হাঁটতে কষ্ট। বেশি সময় একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। পা দুটোও ফুলে গেছে। আমি একটা সময়ে কী সুন্দর তন্বী ছিলাম। পাতলা ছিপছিপে ছিলো শরীরটা। এখন কেমন ভারি হয়ে গেছি। আমার ভেতরে বাবুটা নড়াচড়া করে। ও আসছে। আর ক'টাদিন পরেই। ও এলে আমি ওকে বুকে চেপে বড়ো করবো। ছেলে আসছে আমার। ওর সাথে এতদিনে কতো কতো কথা বলেছি! কীভাবে কীভাবে সময়টা চলে গেল! শশাঙ্ক! শশাঙ্ক নাম রাখবো ওর। কী সুন্দর তেজস্বী নামটা! শুনলেই রক্তের মধ্যে চিন্‌ চিন্‌ করে ওঠে। মনে হয় মৌর্যসম্রাট সাঁই সাঁই করে তরবারি ঘুরাচ্ছে আর বীরের মতো এগিয়ে আসছে!...




গ.
...আমার ভেতরে একটা বাবু জন্মাচ্ছে একটু একটু করে। আমি ওর জন্যে দিনরাত জেগে থাকি বা ঘুমিয়ে থাকি। ওর সাথে কথা বলি বা অভিমান করি। বাবুটার জন্যে আমার কেমন কেমন করে! গত পাঁচ-ছয়মাস ধরে এই বাবুটা আমার মধ্যে জন্মেছে, বড়ো হচ্ছে. আজকাল খুব দাপাদাপি করে। ফুলে ওঠা পেটের টানটান চামড়ার নিচেই শুয়ে আছে। ওর কি এখনও চোখ ফুটেছে? ও কি স্বপ্ন দেখা শিখেছে? কিসের স্বপ্ন দেখে ও? নিশ্চয়ই স্বর্গের স্বপ্ন দেখে ও। সেই স্বপ্ন দেখে মুখে হাসিও ফুটে ওঠে আমার বাবুটার।...




খ.
...এটা খুব বিরক্তিকর একটা রুটিন হয়েছে! রোজ সকালে উঠেই গা গুলানো বমি আসে। চেষ্টা করেও আটকানো যায় না। তারপরে নাশতা করার আগ পর্যন্ত মুখটা টকে থাকে। সেই স্বাদে আরো বমি হবে বলে মনে হতে থাকে। বিচ্ছিরি! সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ হয়ে থাকে। এ কেমন যন্ত্রণায় ফেঁসে গেলাম! সামনের দিনগুলোয় আরো কী কী ভোগান্তি হবে ভাবতেই শিউরে উঠছে গায়ের লোম। বাচ্চা জন্ম দেয়া কতো কষ্টের! যাদের কাছে শুনেছি সবাই বলেছে, সবাই সুযোগ পেয়ে খালি ভয় দেখায়।...




ক.
...আমি হাতে টেস্টের কাঠিটা ধরে বসে আছি। এটা কীভাবে সম্ভব! অবিশ্বাস্য লাগছে নিজের কাছেই। এভাবে তো আমি চাইনি। এভাবে করে কি হয় কোন কিছু? ভয় হচ্ছে খুব। আমি এখন কী করি! এখন কোনভাবেই বাচ্চা নেয়া যাবে না। আরো অন্তত দুইবছর। আমার ক্যারিয়ারের পুরা বারোটা বেজে যাবে। তারওপর বাচ্চা মানুষ করবে কে? কাজ দেখবে কে? আমার কেমন দিশেহারা উদভ্রান্ত লাগছে! ইস্‌! আরেকটু কেয়ারফুল হলেই হতো। কেন যে... ...




০.
কোন গল্প নয়। কোন সত্যকাহিনী নয়। একটা মানুষ আর তার অপত্য-মানবের কথা। টুকরো টুকরো কথা, যে কথাগুলোর কোন মূল্য নেই পৃথিবীর কাছে। সর্বসম ঘূর্ণনে পৃথিবী নশ্বর সত্য বুকে নিয়ে ঘুরছে। সবই বিনাশ হবে একদিন। পৃথিবীচারী মানুষও সেকথা জানে, জানে বলেই আরো আরো নতুন প্রাণ নিয়ে আসে এখানে। নারীদের গর্ভে বীরপ্রসব ঘটে। তারপরে সেই বীর, পুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠে। পেছনে নারীটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যান, বেঁচে থাকলে, কিংবা মরে গিয়েও তাঁরা হারিয়ে যান। পৃথিবীর কিছু যায় আসে না তাতে। তবে তাঁরাও বড়ো অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান, যেন আর কারো স্বীকৃত সনদের কোনও দরকার নাই।

সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০০৮

শীতের শুরুতে আর বছরের শেষে জমে থাকা কথারা কম্বলের ওম পোহাতে চায়

শুরুঃ
শুরু বলে আদৌ কিছু নেই। সেখানে পেছোতে পেছোতে আমরা একেবারে পিছনে গিয়েও একটা আদি সুতো পাই, যার মাথায় আরো অন্য সুতোর লেজ বাঁধা থাকে। এই আপ্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিলে আমরা অনায়াসে হাল ছেড়ে দিতে পারি। তখন বাকি থাকে যেকোনও একটা শুরু বেছে নেয়া। যেকোনভাবে ঠেলা দেয়ার মতো একটা কথা বলতে শুরু করে দিলে পরের কথা গুলো এমনি এমনি চলে আসবে। এদেশে মানুষের অভাব নাই, কথারও অভাব নাই। পথে ঘাটে, রুলারে টানা মার্জিনের মতো ফুটপাতে বসে থাকা কালো ঝর্ণাকলমের ফোঁটার মতো ভিক্ষুকও কথা বলে, ঘুরে ফিরে একই স্বরে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। আমরা সেসব কথা শুনেও না শোনার চেষ্টা করি। এরকম আরো অনেক প্রচেষ্টা চলে আমাদের। বাবা-মায়ের কথা না শোনার, শিক্ষকের কথা না বুঝার, বাড়িওয়ালার কথা তোয়াক্কা না করার, অফিসে বসের কথা গা থেকে ঝেড়ে ফেলার হাজারো নিয়ত প্রচেষ্টা আমাদের ক্লান্ত করার বদলে এহেন কাজে আরো চৌকস করে তোলে। বোকাবাক্স খুলে দেখি না অনেকদিন আমরা, কিংবা সবসময়েই খোলা থাকে ওটা। সেখানে নানারকম রঙিনকথার সাথে শাড়িশিফনমালাদুল মিশিয়ে মিশিয়ে সিদ্দিকা কবীর'স রেসিপির মতো গুলিয়ে ঘুলিয়ে খাওয়ানো হয়। আমরা সেটা খেয়ে ঠোঁটে জিব টেনে শব্দ করি। আহ!! কী চমৎকার স্বাদু রান্না খেলাম! রাঁধুনির হাতে জাদু আছে। এরকম উপ-প্রশংসা শুনে কোনো কোনো রাঁধুনি বড়ো খুশি হয়ে পড়েন, গরমে রেখে দেয়া মাখনের মতো গলতে গলতে তরল হয়ে যান। সেই তরলকেও আমরা মাখিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি, ক্রমশঃ। ধীরে ধীরে আমাদের নেতি-অস্তির পথ ঝাপসা হয়ে আসে। ধীর প্রক্রিয়া টের পাওয়া কঠিন হয়, যেরকম ধীরে ধীরে শুয়োরবৎ কিছু পিশাচ আমাদের ঘর-আঙিনা দখল করে নিচ্ছিলো যা আমরা টের পাইনি বা টের পেলেও তোয়াক্কা করি নাই। এখন তাদের অস্তিতে মাথা দুলাই, তাদের নেতিতে ঘাড় নাড়ি। ও হ্যাঁ, আমরা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলা শিখেছিলাম। শিশুর সরলতায় সত্য বলে বকুনি খেয়েছি। চড়, থাপ্পড় দিয়ে দিয়ে বড়োরা শিখিয়েছে সত্য বলতে হয় না। বইয়ে ভুল লেখা ছিল। সদা সত্য কথা 'বলিবে'র জায়গায় 'লুকাইবে' হবে, বুঝেছো সোনামণি? তাই অভ্যাস হয়ে গেছে সত্য মুখের ওপরে না বলার। যেমন এখানে আমরা জামাত-শিবিরকে অপছন্দ করি, বিএনপিকে অপছন্দ করি, আওয়ামীলীগকে অপছন্দ করি, জাপা-এর উঃ, দঃ, এরশাদ-রওশন সব উপদলগুলোকেও অপছন্দ করি। রাজনীতিবিদের প্রশংসা কারো মুখে শুনলে আমাদের জানতে ইচ্ছা করে লোকটি এই রাজনীতিবিদের কাছে কী উপকার উপঢৌকন পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা লোকগুলোকে দেখেও সন্দেহ হইতে থাকে। আটত্রিশ বছর আগে এই মাসে স্বাধীনতা এসেছে সেটা নিয়ে প্রতি শীতেই সকল মিডিয়াপেপার গরম হয়ে ওঠে। দিকে দিকে দিগগজেরা গজিয়ে ওঠেন। কেন? স্মরণ ভালো, শিক্ষা কি তার থেকে জরুরি নয়? সেই স্মরণের কীই বা দরকার যেটা আমাদের পূর্বপিতাদের হত্যার, খুনের প্রতিশোধ নিতে দেয় না। এহেন ক্লীব স্মরণের কোন দরকার নাই। ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চের কোন দরকার নাই। দেশগড়া বলতে সবাই কী বুঝে? দালান ইমারত গায়ে গায়ে লাগায়ে তৈরি করতেছি, অথচ আমরা খেয়াল করি না যে চলাচলকারী মানুষগুলো কত নির্জীব, হতাশ, নষ্ট, ভ্রষ্ট। ভ্রষ্টতার পথ ধরে টাকা এসেছে, নোংরামি এসেছে। বিদেশি যৌনতা এসে বেডরুম, ওয়েবক্যাম, মোবাইল, থ্রিজিপি ফরম্যাট হয়ে যাচ্ছে। তার থেকেও উগ্রতার লেবাসে ধর্মরাজনীতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। এইডস নিয়ে আমাদের প্রেজুডিস আর ভয় অনেক বেশি ছিলো। হয়তো সেটাই দরকার। রাজাকার নিয়ে ভয় কম থাকায় এখন আটত্রিশ বছর পরে কী অবস্থা হয়েছে দেখা যাচ্ছে। এরকম আরো আরো আলোচনা আর কথা বার্তা আমরা বলতে থাকি কিন্তু কথার সুতো শেষ হয় না, শেষ করা সম্ভব হয় না।