সোমবার, ২৯ জুন, ২০০৯

দ্বিচরণ


তোমাকে আমার ভাল লাগে
এই নির্দোষ বাক্যে কারো রাগ বা ক্ষোভ
হওয়ার কথা নয়, যদিও আমার সামনে বসে
তুমি ক্ষেপে ওঠো, ভীষণ সুন্দরভাবে
আমি দ্বিধায় পরিমাপ করি
রাগের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা, মাত্রাসমূহ
এবং পিথাগোরাস বা ইউক্লিড তুমুল বোকা বনে যায়।
হতাশ হয়ে আমি ফিরলাম কার্যকারণে
গ্যালিলিও বা অন্যান্য জ্ঞানীগণ
বেশ হিসেব নিকেশ নিকেশ করেই
বলে বসেন, “হুম। ক্যালকুলাস লাগবে
নিউটনকে ডাকা হউক।”
বিরক্ত আমি নিজেই খাতা বই টেনে
নিখুঁত ধারালো পেন্সিলে লিখি
আমার ভালোলাগা ও তোমার রেগে ওঠার মাঝের দূরত্ব।
কয়েক কিলোমিটার? সহস্র যোজন? দুই-চারটা আলোকবর্ষ!
মুদ্রার ওপর পিঠে অবলীলায়, তোমার ঠোঁটের কোণে
মুচকি হাসি ফুটে ওঠে
এই ভ্রান্ত-কলাবিদ্যা, এই দুরাচারী বিভ্রম
মুহূর্তেই ধরা দেয়, আহা, বিষমকোণ!

রবিবার, ২৮ জুন, ২০০৯

অপিয়াম


অপিয়াম বনে মিশে
ধীরে গহীনে ভীষণ গভীরে
আলোর মত আঁধারে
ক্রমশ ঘুরে ঘুরে অপিয়ামে
আমাদের চোখে রাত নামে
বাইরে রোদ্দুর
আদিম উন্মাতাল ভেষজ দুপুর
অজানা সুর রঙ মেশানো ভোর
সেইসব প্রথাগত ফুল
ফুলের সারিতে ঘুম
মুখস্থ দৃষ্টি, চোখ বা নূপুর।
অপিয়াম বনের ধারে আমরা পাঁচজন
মাথা গুনি
এদিক থেকে এক দুই তিন চার পাঁচ
ওদিক থেকেও এক হতে পাঁচ
হয়নি হিসেবে ভুল, হায়!
অপিয়াম বন ছেড়ে ঘুরে ওঠে
আকাশে বাতাসে মিশে মিশে
ঘাড়ের ওপারে বিদেশ
মর্ত্যের অপর স্বদেশ
গুঁড়ো গুঁড়ো চামড়া হাড়
বালকের বিস্ময় অপার
লাল ফুলের দাগ, নিদাঘ
বর্ষণ অবিরাম অপার অপার!
আহা, বিষাদ, গ্লানি-ক্ষমা
ক্ষমার পরেও কান্না জমা
চোখের ভাঁজে, পাঁপড়ি জুড়ে
রোদের ঝাঁজে যাচ্ছে পুড়ে
আঃ বিষণ্ণ রোদ, ঘোলা কাচ থেকে
ঠিকরে পড়ছে তার উদাম বুকে
আমাদের খোলা গায়ে, ঝরে
কোমল ঠোঁট, সুরের শাবল পড়ে
ধপাধপ গাঁইতির কোপে
নামিয়ে ফেলে যৌন চর্ম রোগ
আর বিলোল সম্ভোগ,
রেগে ওঠে চারজন আমার ওপর
ভাগ নেই পৃথিবীর তিনভাগ সাতভাগ
জল; অথবা স্থল।
লোহিতের পাশে চলে শ্বেত
শ্বেতের মাঝে খেলে রোদের ছায়া
ছায়ার ভেতরে কীট
শুককীট মূককীট ভ্রূণ
অনুচক্রিকা চক্রে পড়ে
ক্রমশ ও পুনঃ পুনঃ,
আমি হেসে ফেলি অপিয়াম!
তরল ঘুম উথাল-পাথাল
নালীজুড়ে পড়ে আছে
নগ্নতার ঝকঝকে আড়াল
আড়ালে শোক, শোকের বাগান
বাগানে বৃষ্টি খুব,
লোহার স্রোতে খয়েরি ঘুম
সীসার ভেতরে ঝাঁঝাঁ ক্ষোভ
এবং শোক ও পীতাভ,
বাগান ও হলুদ
অজস্র সবুজ রাত জেগে
চাষের মাঠের মৃত্যু গান।

বুধবার, ২৪ জুন, ২০০৯

স্নানক্লান্তি


পানির ফোয়ারা মুখ থেকে অনর্গল সাপের মতো ফোটায় ফোটায় পানি ছুটে আসছে। প্রথমে তারা উচ্ছ্বাসে ঝাপটা দিল আমার কপালে, ঈষৎ নিচু করে রাখা মুখে দ্রুত গড়িয়ে নামল তারা, সদলবলে, সোল্লাসে। চোখের পাতা কেঁপে উঠলো কিছুটা, পানিবিন্দুর ভারে আবেশে বুঁজে এলো। পানির রথের সেদিকে খেয়াল নেই, দুর্দান্ত দাপটে সে গাল, চিবুক, ঠোঁট, থুতনি পেরিয়ে গেল অনায়াসেই। তারপরে কেউ কেউ ঝরে গেল সুদূর টাইল্‌সে। মহাপতন! কেউ কেউ সেই ঊর্ধ্বমুখী চলনে গড়িয়ে গেল গলায়, গোপনে-


গোপন সুখের মত আমি চোখ বুঁজেই থাকি। পানির অবিশ্রাম ধারা ঝরছে, অঝোরে, নিভৃতে। গলারভাঁজ থেকে গ্রীবার সমতলে তারা ছুটে চলে। নীরব, কিন্তু নিরলস। আমি খেয়াল করি পিঠের ওপরেও আছড়ে পড়ছে ক্ষুদেকণা, বিম্বিসার পথের মত, সেখানে পথ তৈরি হয় অচিরে। গহনপথের ঠিকানায় ঘোলা ঘামের দাগ বিস্মৃত হয়, যেভাবে আমি আমার শৈশব ভুলে গ্যাছি, যেভাবে গতকালের জীবন হারিয়ে ফেলেছি। সেভাবে জরুরি প্রত্যাদেশের মত নোটিশ ঝুলে উঠল পিঠে, জলের দাগ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু প্লাবনেরও অধিক শোক মুছে দিতে পারে।


পানির ঢেউ আরো নিচে নেমে যেতেই থাকে আমাকে শিউরে দিয়ে। চোখ খুলে আমি পানির রঙ দেখি, উন্মনা দেহের সৌরভের মত রঙ পাঁপড়ির সামনে খেলা করে। চারপাশে পানির দোলায়মান দেয়াল, দুলছে, নাচছে, সরে যাচ্ছে, কাছে আসছে। আমিও অজান্তেই মাথা দুলাই। ঘুরতে থাকে পৃথিবী আমার চারপাশে, মানুষেরা বিম্বের মত বশংবদ হয়ে সঙ্গী হতে থাকে, কাতার কাতার মানুষ, অজস্র অসংখ্য অচেনা অবয়ব ঘিরে ধরে আমাকে। আমি টের পাই জলের পর্দার বাইরে সকলে হা হা করে আমার দিকে হাত বাড়িয়েছে। ডাকছে, আয়! আয়!


কিন্তু আমি নড়তেও পারি না। অচল পাথরের মত নিস্তব্ধ হয়ে আমি আমার শরীরে ক্রমাগত ঝাঁপিয়ে পড়া পানি, আর ঝরে পড়া বিন্দু গুনি। তার বাইরের পৃথিবী ঝাপসা, ক্রমশ দূরাগত, অভিমানী! সামনে ও পেছনে পানিপথে প্রবল স্রোত, আমি ভেসে যাই খড়কুটোর মত। নিঃশ্বাসেও জলজ অক্সিজেন আমার ফুসফুসে নৃত্য শুরু করে দেয়। আমি আরাম পাই, ধীরে ধীরে আমার পেশি শিথিল হয়ে আসে, চোখ বুঁজে ফেলি আবার, এবং এবারে আমি আর সেটা খুলতে চাই না। শুধুই অবিরাম বর্ষণ। শুধুই ঝরোসুর। শুধুই নীরবতায় পানির গান। আঁধারের পর্দা নেমে এলে আমার কোষ জেগে ওঠে পলিদ্বীপের মত, বাইশখালি চরের মত। চরের ধবল বালুর মত আমার শরীরে ভিন্‌রূপী ত্বক হেসে ওঠে। আমি চোখ না খুলেই অবাক হয়ে তার খিল খিল হাসি শুনি।


একটা সময়ে নেমে আসা পানির স্রোত থেমে যায়, স্রোতের ভেতরে বিন্দুর রথ স্থবির হয়ে আসে, উড়তে থাকা বাষ্প কণাও ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আমার খুলির ভেতরে সেঁধিয়ে যেতে থাকে। আমি চোখ খুলি না তখনও, শিথিল শরীরে পড়ে থাকে শাদাটে হাড়ের মত সিক্ত মেঝেতে। শরীরে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো সহোদর-মায়ায় মাটিতে নেমে আসতে থাকে, আমার আতিথেয়তা বুঝি তাদের আর ভালই লাগে না! দূরের পর্দার ওপাশে মূর্তির মত স্থির মানুষের মুখ, শতসহস্র মানুষের নির্বাক চোখ আমার বন্ধ চোখের ভিতর দিয়েও আমাকে বিঁধতে থাকে।

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০০৯

ফ্যাশন আই

বিষুব থেকে একটু দূরে, ক্রান্তিরেখার ওপর, এই জনপদে
ক্রমাগত রোদ, আর্দ্র-গরমে আমাদের মনুষ্যহৃদয়
ধীরে ধীরে পাললিক হয়ে ওঠে, সে পলিতে আঁচড় কাটে খয়েরি বিড়াল।


দোকানের নাম, ফ্যাশন আই। 
আইফ্যাশন বা ফ্যাশনআই, চোখের জন্যে দুনিয়া গোল লাগে আমাদের,
(আসলে তার চিড়ে চ্যাপ্টা রূপ এড়াতেই চোখের দোকানে চশমা
পাওয়া যায়) সেখানে কাচের দেয়ালে লেখা থাকে রঙিন কালিতে
আমরা রঙান্ধ হোমোস্যপিয়েন, দু'পেয়ে, শিরদাঁড়া সোজা এবং মস্তকে
কালো চুল রেখে হেঁটে যাই সামনে দিয়ে। কাচের দেয়ালে
সাঁটানো থাকে রঙিন পোস্টারঃ একটি গোলাপি নারী
নীল ট্যাঙ্কটপ গায়ে চোখে কালো চশমা এঁটে আমাদের দিকে
হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে। বিষুবীয় জলবায়ু, পোস্টারের
দ্বিমাত্রিক নারীর শরীর থেকে শুষে নিতে থাকে মোমজ আদরঘ্রাণ
ফটোশ্যুটের আগে তার চেটে দেয়া গাল থেকে খুলে নেয়া হয়
শাদাটে হাড়, সৌন্দর্য-
এই ক্রান্তীয় অঞ্চলে। নীল ফিতের জামা ও গোলাপি ত্বক ফ্যাকাসে চাদর হলুদ
জণ্ডিস হয়ে ওঠার পরেও আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটির বুক একবার চেটে যাই।

বুধবার, ১৭ জুন, ২০০৯

সঁর্দি কাঁশি জিঁদাবাঁদ

সৈয়দ মুজতবা আলীকে আমার ভাল লাগে। লোকটা মহারসিক ছিলেন। এত কনফিডেন্স নিয়ে বললাম, এখন কেউ যদি চেপে ধরে, “কেমনে জানলেন, আপনি তো মুজতবা আলীকে দেখেনই নাই?” তাহলে আমিও বিগলিত হেসে বলবো, তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, জনাব। তিনি অত্যন্ত রসিক ছিলেন। আমাদের পাঠ্যেও তাঁর লেখা ছিল। তবে আমি পাঠ্যের পাশে তার বই রেখে বেমালুম পড়তাম। সেই সময়ে নেশা চাপলো যখন বাবার পোস্টিঙয়ের কারণে মা তার সন্তানদ্বয় নিয়ে পিতৃগৃহে। সেখানে আমার মামার বইয়ের বিরাট সম্ভার। আমাকেও কে জানি বললো, বেশি বেশি গল্পের বই পড়লে চোখ নষ্ট হয়, চোখ নষ্ট হলে চশমা পাওয়া যায়। আমি চশমার লোভে বই পড়া শুরু করলাম। এক পর্যায়ে পেলাম আলী সাহেবকে। তিনি মোটামুটি বাক্যঝঙ্কার আর পৌরাণিক উপমা মিশিয়ে আমার চর্মচক্ষু রঙিন করে দিলেন..


তো, এতদিন গেল, এত বকবক করলাম, পাতার পর পাতা লিখেও ফেললাম। কিন্তু একবারও মুজতবা আলীর কথা এলো না কেন? এমন প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন! আসলে হয়েছে কি, নিঃশ্বাস না আটকালে যেমন বাতাসের মূল্য টের পাওয়া যায় না, এসির বাইরে না বেরুলে যেমন গরমের তাপ টের পাওয়া যায় না, তেমনি সর্দি কাশি না হওয়া পর্যন্ত সৈয়দ মুজতবা আলীকে স্মরণ করা হয় না। তাঁর “বেঁচে থাকো সর্দি কাশি” পড়ে যতটা হেসেছি, মজা পেয়েছি, সাথে মন ভার-ভারও হয়ে উঠেছে, তেমনটা আর কোন রম্য লেখাতেই হলো না। আজকে হ্যাচ্চো হ্যাচ্চোর ঠেলায় যখন নাক বেচারা ফাটে, খকখক কাশিতে গলার ফর্দাফাই (নাকি পর্দা-ফাই?), তখনই মনে পড়ল আলী সাহেব বলেছিলেন, “দুই নাকে রাইন আর ওডার বইছে!” তা উনি জর্মনদেশের বাসিন্দা, এমনধারা নদীর নাম নিতেই পারেন যার নাম আমার বাপ-দাদা কেউ শুনেন নাই, শুনলেও চোখে দেখেন নাই, চোখে দেখলেও নাতি বা পুত্রকে এসে বলে যান নাই। মোদ্দাকথা, আমি জানতে পারি নাই।


ভূগোলে আমি বরাবরই গোল্লা। এই গোলগাল পৃথিবীর উত্তল পিঠে কোথায় যে কী তা ঠিক ঠাহর হয় না মাঝে মাঝেই। পরে শুনলাম পুরো ভূখণ্ড নাকি এককালে একসাথেই ছিল! তাকে “প্যানজিয়া” বলতো। পরে কেমনে কেমনে দূরে সরে গেছে। { শিক্ষাঃ কেবল মর্ত্যের পাপী-তাপী পুরুষ-নারী, মতান্তরে বিএফ-জিএফ-রাই দূরে সরে না। মায় পুরো স্থলভাগই যোজন যোজন দূরে ছিটকে যায়} এমনধারা না হলে সবাই কত কাছাকাছি থাকতাম। হেঁটে হেঁটেই এপার ওপার করা যেত। বুশের মত বেয়াক্কেল বা সাদ্দামের মত ঘাউরা বেশি লাফালাফি করলে বাড়ির কাছে গিয়ে হাউকাউ করা যেত সবাই মিলেই! কিন্তু দুই নাকের শিকনির নহরের মতোই, সব খাবলা খাবলা মাটি আলাদা হয়ে গেল, কেউ টেরটিও পেল না। এখন কত পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন, মাইগ্রেশন, রেসিডেন্ট, ওয়ার্ক পারমিট, স্টুডেন্ট ভিসা ইত্যাদি ইত্যাদি।


সে যাক, কথা হচ্ছিল নাকের নহর নিয়ে। গত হপ্তায় বিষম ঘটনা ঘটে গেল। গরমের এই সময়টায় আমি বরাবরই সাবধান থাকি যেন ঠাণ্ডা না লাগে। সেদিন খুব ঘেমে নেয়ে বাসায় ফিরে, কোথায় ঠাণ্ডা হবো, আমি ঢুকে পড়লাম বাথরুমে। কী ভূত চেপেছিল কে জানে। কলেজ বাথরুমের মত লা লা লে লে আন্দাজে গান গেয়ে বেরিয়ে চুল মাথা মুছে বসে রইলাম। রাত ঘনালে দেখি নাকের মাঝে শুলশুল করছে! একটু পরে গলার ভেতরে খুশখুশ। আমি নিজেই উশখুশ শুরু করলাম। শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার-স্যাপার বুঝি কম। খালি উদ্দীপনা-পরবর্তী-প্রতিক্রিয়া (!!) টের পাই। রাতের পরে সকালে উঠেই দেখি মাঁআঁআঁআঁআঁ! নাঁক বঁন্ধ, খ্যাঁশখ্যাঁশে কাঁশি। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই হালকা গা গরম। আমি তো মহাখুশ। এই পেয়েছি সুযোগ, অফিস ফাঁকি দেবার।


মানুষ ভাবে এক, আর উল্টাপাল্টা কিছু একটা ঘটে যায়, কিন্তু যেটা ভেবেছে সেটা কিছুতেই ঘটে না। পরীক্ষা নিতে হবে সেই সময়েই। নিজের পরীক্ষা দেয়ার হলে ডজ্‌ মারা যায়, না বলে কয়ে পরে একটা ভুয়া ডাক্তারের চুয়া সার্টিফিকেটও দেখানো যায়, কিন্তু যেখানে আমি নিজেই পরীক্ষক, সেখানে ফাঁকিবাজির জো নাই। তাই আমাকেও এই গরমে, ভাজি হতে হতে বিদ্যালয়ে যেতে হয়, নাক টানতে টানতে কথা বলতেই হয়, খকখক কাশি ঠেকাতে ঠেকাতে খাতা বিলি করে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বড়ো হওয়ার বড়ো জ্বালা। কোনমতে গার্ড শেষ হলেই, হেড স্যার আমার ঘাড়ে আজাইরা কোন কাজ চাপানোর আগেই, আমি বাসায় ফুটলাম। এসে দেখি আমার ঘরও ফুটন্ত কড়াই। জানালা খোলা ছিল বলে হু হু করে গরম বাতাস ঢুকে গেছে। সেখানেই পিঠ পেতে শুয়ে রইলাম। পনেরো মিনিট পর পর গিয়ে নাক ঝাড়ি, ফিরে আসতে আসতেই ভারি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ ফোঁৎ ফোঁৎ তারপরে আবার বেসিন…


এমন যন্ত্রণায় তো স্বয়ং ইয়েসউদ্দীনও পড়েন নাই। তাই আমি শুরু করলাম ডুয়াল অ্যাটাক। একদিকে অ্যান্টিহিস্টামিনে নাক জমাট বাঁধাই, তারপরে অ্যান্টাজল দিয়ে সেটা তরল করি। জমাট তরলের ফাঁকে পড়ে একটা সময়ে নাক ফুরফুরে হয়ে ওঠে। তাতে আগের মতোই ঘণ্টায় ষাট কিমি বেগে বাতাস বইতে শুরু করে। কিন্তু অন্যদিকে গলার অবস্থা বেগতিক। ওখানে ঝড়োবাতাস সহ দমকা দমকা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। থামানোর উপায় (বাংলাদেশের দূর্যোগকালীন ব্যবস্থার মতোই) আমার জানা নেই। জলোচ্ছ্বাস এলে যেমন, গরু-ছাগল নিয়ে মানুষ পাকা দালানে ওঠে, তেমনি কাশি বিপর্যয়েও আমি আশ্রয় নিলাম জিথ্রক্সের কাছে। ৫০০ মিলিগ্রামের শুকনো ট্যাবলেট কী বেমালুম গলার ক্ষতে পরশ বুলিয়ে দিল। আহা! এমন আরাম, প্রশান্তি আর কোথায় পাবো? পেলাম, আমি ইহাকে পেলাম। রোজ কোঁৎ করে গিললাম, সাথে জ্বরের বাণঃ প্যারাসিটামল। এই ফার্মাসিউটিক্যাল ট্যাকটিক্সে তিন ভাইরাসীয় সেনা একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে গেল। কপালের ঘাম শুকালো, সাথে নাকের ভেতরে ‘রাইন-ওডার’! গলার ব্যথা গেল ও কথা ফিরে এল। সব মিলিয়ে আবার আগের মতোই আমি “ফিট! একদম ফিট!”


পরিশিষ্টঃ পুরো লেখার মাঝে কোথাও কিন্তু সর্দিকাশির ভালো দিকটা বলিনি। খালি বকেই গেলাম হতচ্ছাড়া নচ্ছার ভাইরাসগুলোকে। তবে লেখাটাতো আসলে তাদের গুণগানের জন্যেই, তাই শেষ করার আগে একটু ভাল দিক বলি। সুস্থ থাকলে কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। আসি যাই, চোখের সামনেই ঝুলছি বলে সবার কাছেই সাধারণ, স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলাম। এই কয়দিনের অসুখে নানাপ্রান্তে হাঁকডাক বড়ো মধুময় লাগলো।
কেউ ফেসবুকে নক দেয়ঃ কিরে, তোর খবর কি? আওয়াজ নাই!
কেউ এসেমেস করেঃ দোস্ত, কেমন আছিস? একটা জিটুজি কর। অফিস করতে করতে কাহিল হয়ে গেলাম তো! তোরে অনেকদিন দেখি না।
আর কেউ বারবার ফোন করে খোঁজ নেয়ঃ ঠাণ্ডা লাগাবা না। গলায় কাপড় জড়িয়ে রাখো। সময়মত অষুধ খাও। আজকে গোসল করতে পারো তবে বেশি ভিজবা না। গরম পানিতে গার্গল করো, ভালো লাগবে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো, রাত অনেক হয়েছে।


ক্যাডেটে পড়া অব্দি মা ছাড়া এভাবে কেউ যত্ন করে নাই। এই ভয়ানক সর্দিকাশির সুবাদে সেটার পরশে মন কেমন করে উঠলো। আমি তো সাধারণ মানুষ, এমন অসাধারণ ভালোবাসা পেলে কীভাবে তা সামলাই!




***

মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০০৯

১০১০

নভেম্বরের এক শুকনো বিকেল। বিকেলের রোদ জমাট বেঁধে আছে তখনও, রাস্তায়। আমি গাড়িতে তল্পিতল্পা নিয়ে রওনা দিয়েছি। উদ্দেশ্য ১০১০।


১.
দরজা ঠেলে ঢুকতেই দুটো বিছানা, ডানদিকে লম্বালম্বি, বামদিকে আড়াআড়ি, দরজার পেছনে। চারকোনা ঘর। ঐপ্রান্তে আরও দুখানা বিছানা। ঘরের মাঝখানে দুটো বড়োবড়ো আলমারি দিয়ে মোটামুটি একটা বিভাজন তৈরি করা। আমি যখন ঢুকলাম, তখন কাউকে চোখে পড়লো না, অথচ ঘরে তালা দেয়া নেই। একটু ভিতরে গিয়ে দেখলাম আলমারির আড়ালের বিছানাতে একজন ঘুমাচ্ছেন, তার মাথার কাছে চেয়ারের উপরে রাখা টেবিল ফ্যান মৃদু শব্দে ঘুরছে। আমার হাতে গোল করে বাঁধা তোষক, ওটা মাটিতে রেখে আমি ঘুমন্ত মানুষটাকেই ডাক দিলাম।


সন্ধ্যা নামতে নামতেই সাকিব ভাইয়ের ফেলে যাওয়া আলনা, বাক্স, হ্যাঙার, তোষক, চাদর ইত্যাদি বাইরে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলা হলো। ঝুল এবং ময়লা পরিষ্কার করে আমি গোল করে বাঁধা তোষকটা মেলে দিলাম। টেবিল, বিছানা, চাদর, বালিশ। পায়ের কাছের জানালা দিয়ে বাইরে বাগানে জ্বালিয়ে রাখা টিউবলাইটের আলো এসে পড়ছে। আমি হেলান দিয়ে বসে থাকলাম আপাত অবস্থানে, কিছুটা ক্লান্ত এবং মলিন। ঘরের বাকি দুই বাসিন্দাও ফিরলেন। একজন ফিরেই ঘুম। আরেকজন মশারির ভিতরে উবু হয়ে বসে কী যেন করছেন। সাকিব ভাইয়ের মতো, এরাও কিছুদিন পরে ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। বাকি থাকবে আড়ালে থাকা বিছানাধারী। রাত বাড়ে, কোলাহল, হাসি, খুচরো কথা ছিটকে ছিটকে যায় আমার চারপাশে। বুঝতে পারি এখানে মূলত বিযুক্ত এবং আলাদা আমি।


ক্লাসের পরে দুপুরে আড্ডার একটা প্রিয় জায়গা ছিল ক্যাফের সামনের চত্বর। অন্য ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরাও জমায়েত হতো। মাঝে মাঝে ফিল্ম সোসাইটির সন্ধ্যার মুভি শো দেখা হবে কী না সেটা নিয়ে কথাবার্তা। কারো কারো আড়াইটায় সেশনাল, তারা বেশিক্ষণ থাকতো না। সোয়া একটা দেড়টার দিকে ক্যাফের ভেতরে ভিড়, শোরগোল, খাওয়া দাওয়া, তেহারি বিশটাকা, ঝালফ্রাই বিশটাকা, খিচুরি তুলনামূলক সস্তা ও বিস্বাদ। তারপরে আড়াইটার পরে নিঝুম হতো সিরামিকের উঠান। চলাচল হলাহল কমে আসতো, আমরা কেউ কেউ বসেই থাকতাম এবং মাপার চেষ্টা করতাম কীভাবে রোদ নেমে যায়, বেলা পড়ে যায়। মাঝে মাঝে দুয়েকজন ছিটকে যেত হেঁটে চলে যাওয়া ওড়নার সাথে। আবার কিছু পরে ফিরেও আসতো, দুপুরের সময় অনেক দীর্ঘ ও ধীর বলে। ১০১০-এর সাথে যেসময়ে আমার সম্পর্ক হলো, সেই নভেম্বরের সময়, সেই আশু শীতের টান বা রোদের দাপটের সময়েই আমি ধীরে ধীরে ক্যাফের সাথে আলাদা হয়ে যাই। টের পাইনি কখন, ক্লাস শেষে বের হয়ে ডানের বদলে বামে যাওয়া শুরু হলো। গেইট পেরিয়ে রাস্তার ওপারের ছোট গেইট দিয়ে ঢুকলেই তিতুমীর। তারপরে পেছনের উইঙয়ে, ডানদিকের শেষের আগের ঘর ১০১০। ঘরে ঢোকার আগে প্রায়ই ১০১১এ উঁকি দিতাম। আদিরসাত্মকদাদা হাঁক ছাড়তেন, কিরে ***! কারো মুখে এমন আদরণীয় অশ্লীল সম্বোধনও সয়ে যেতে পারে, এটা আমার ধারণাই ছিল না। এখানে দুপুরের পরে ডাইনিঙের সমালোচনা জমে, মহিষের মাংস বা ছাইপাশ খেতে হচ্ছে বলে আমরা বড়োই বিরক্ত হই। ম্যানেজার কত টাকা মেরে নোকিয়া কি স্যামসাং কিনে ফেলছে ভেবে যারপরনাই হতাশ হই। বিছানাধারী ছাড়া আমাদের ঘরের বাকি দুই চাকরি পেয়ে চলে গেছেন বলে আমাদের ঘর মোটামুটি ফাঁকাই। আমরা দু'জনে রেক্সিনের ম্যাট বিছাই ঘরে, ঝেড়েপুঁছে ঝুল-টুল পরিষ্কার করি। ঘরে যারা আসেন, তারা বেশ চমৎকৃত হল আমাদের পারিপাট্যে। দু'টা কম্পিউটার, মাঝে মাঝে মুভি শো, সারাউন্ড সাউন্ডে আশেপাশের মুভিখোরেরা জমায়েত হয়, রেক্সিনের মেঝেতে মফস্বলীয় কায়দায় আমরা হাসি, শোরগোল করি। সেখানে আমি আর নিজের উচ্ছ্বাসটুকুকে আলাদা করতে পারি না। কেবলই মনে হতে থাকে, এটাই স্বাভাবিক, সবচেয়ে বাস্তব জীবন।


৩.
শীতের কম্বল থেকে ওম চলে গেলে, গরম বাড়ে। ঘরে একটাই ফ্যান, আমরা দু'জনেই সালমান খানের ফ্যান, এজন্য উদোম গায়েই বসবাস। বিছানাধারীর শেষ টার্ম। পাশ করলেই তিনি যে বিদেশে উড়বেন, সেখানে তার সুপারভাইজার যে একজন মহিলা প্রফেসর এবং তাঁর নাম লিসা। লিসার সাথে তার পত্রালাপের আমি নীরব সাক্ষী, মাঝে মাঝে ভাষাবিড়ম্বনা ঘুচোতেও সমান সহায়তাকারী। শেষপরীক্ষার আগে ১০১০এ আরো দুটো ছানাপোনা আমার মতোই উঠে আসে। দরজার দিকের দুইবিছানায়। তারা অতিশয় চঞ্চল, প্রগলভ। আমাদের ঘরে প্রচুর হৈচৈ জমা হতে থাকে। এভাবে একটা সময়ে দুপুরের ঘুম উবে যায়, শান্ত ঘরেই ডাইনিঙ-ম্যানেজার-মস্তকমুণ্ডন-গর্দভবৈঠন-গ্রামছাড়ন চলতে থাকে। বিছানাধারীর যাবার সময় ঘনিয়ে আসে। আমি বুঝতে পারি, এভাবে চলে যাওয়াটাই আসল সত্য, এবং তারপরে নিজের ব্যাপারেও সচেতন হই। চেষ্টা করি জড়িয়ে পড়া সুতোগুলো আলাদা করতে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। সব যোগাযোগ মানতেই হবে এমন তো কথা নেই- এমনটা ভেবেই আমি আলাদা ও বিচ্ছিন্ন হতে চাই। আমার খেয়ালে একবারও আসে না যে নিজের অজান্তেই আমি ধীরে ধীরে ক্যাফের ভীড় ভুলে গেছি, আর মনে নাই দুপুরের দৌড়, ঘাম, ওড়নাদের সৌন্দর্য।


আমাদের ঘরে বিছানাধারীর জায়গায় উঠে আসে মোটামানুষ। মোটামানুষের বাসা খুব কাছেই, কিন্তু বেচারা সদাব্যস্ত, সদাদৌড়বিদ, মহাকেজো। কেঁচোর মত পড়ে থাকতেও দেখিনি কখনও তাকে। রোল বিচারে আমার থেকে দুই পরে, কিন্তু মানুষ বিচারে সম্ভবত আমি তার ধারে কাছে নেই। মোটামানুষের হৃদয় বড়ো হয় এটা শুনেছিলাম, আফসোস ছিল কাছ থেকে এমন কাউকে দেখিনি বলে। এই মোটামানুষের ঘরে ওঠার পর থেকে আমিও বুঝলাম আপ্তবাক্য এমনি এমনি উক্ত হয় না। (একারণেই হয়তো আমিও মোটা হচ্ছি, হৃদয়ের আয়তন বাড়ানো যায় না, শুধু স্থূলত্ব দিয়ে যদি ধোঁকা দেয়া যায়!) মোটামানুষ একা এলো না, সাথে আরও একজন মোটামানুষ এলো। বোঝার সুবিধার্থে আসুন আমরা পরেরজনকে গীটারিক বলি। তার সাথে আমার পরিচয় ঐ গীটার দিয়েই। মানুষটা পাঁচতলা হল-এর ছাদে বসে নিশুতি রাতে গীটার বাজাতো। আমি শুনতাম, মাঝে মাঝে মোটামানুষের সাথে গলা মিলিয়ে গাইতাম। শিশির পড়লে, আমার ঠাণ্ডা লাগতো এবং মোটামানুষ ও গীটারিক মাথা দুলাতো, "তোরে নিয়ে... যে কী করি!" আমি হেসে ফেলতাম নিরুপায়, কারণ আমি নিজেই জানি না নিজেরে নিয়ে কী করা উচিত!


আমরা তিনজন রিকশায় চড়তাম। আপাতশীর্ণ আমাকে কীভাবে চিপা ও চাপা খেতে হতো সেটা সহজেই অনুমেয়। আমরা রাত জাগতাম। বারান্দায় বা ফুটপাতে হেঁটে বেড়াতাম। সোডিয়ামের আলো আমাদের ভালো লাগতো বলে আমরা চা খেতে বেরুতাম। পলাশীর মোড় ঘুরলেই আদা-চায়ের মামা, আমরা সেখানেই নিরন্তর ফাঁকা রাস্তার পাশে বসে ট্র্যাফিক সিগনালের ওঠানামা দেখতাম। বাহনবিহীন চওড়া রাস্তায় মাঝে মাঝে মহিষের দল চলে যেত, দেখে আমরা অবাকও হতাম কিছুটা। কখনও কখনও আমাদের ক্ষিদে লাগত। ডাইনিঙয়ের ঝোলঝোলকিউবিকমাছ বা আগাছাশাক রুচতো না বলেই আমরা রিকশা চেপে সোহাগে যেতাম। কালাভুনার ঝালে মোটামানুষ খুশি হতো, গীটারিক আরো দুয়েকটা মরিচ নিত আর আমি নাকের জল চোখের জল এক করতাম। খাওয়াশেষে জ্বলন্ত জিহ্বায় আরো তাড়না আনতেই আমরা চা খেতাম। গীটারিক ফস্‌ করে একটা সিগারেট ধরাতো। আমরা ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে খচ্চর স্যার আর ক্লাসের সবচেয়ে বড়ো আবাল ছেলেটাকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম।


৪.
১০১০এ আমার জীবনও ফুরিয়ে এলো, এবং আমাদের তিনজনেরই সময় ফুরলো। মোটামানুষের সবার আগে। সে বেরিয়েই চাকরি নিয়ে নিলো (পরে সেটা ছেড়েও দিল)। গীটারিক নিজের আলসেমি ও নবাবি আচরণে কয়েকমাস পরেই চাকরি পেল দিনবদলের ফাঁকিঝুকিতে। আমার তখনও ঘরের মায়া কাটেনি, আমি পড়েই রইলাম আরো কিছুদিন। ছানাপোনা দুইজনের পরে আরো একজন ঘরে জায়গা নিল। তারপরেও আরও কিছুদিন আমি চক্কর কাটলাম। সেসময়ে বুঝিনি, তবে এখহন মনে হয় এটারও দরকার ছিল হয়তো। আমি ১০১০এ সব বাস্তবতাকে বুঝে উঠিনি তখনও। শেষ শিক্ষাটা হয়ে গেল শেষ তিন মাসেই। তারপরে আমি গ্র্যাজুয়েট, আমি ১০১০এর প্রাক্তন। দরজা ঠেলে ভেতরে এলে অচেনা মুখ, দরজা ঠেলে বাইরে গেলেও অচেনামুখ। আমাকে মুখোশ পরতে হয়। সেটা আমার ভাল লাগে না। তাই আমি ১০১০থেকে দরজা ঠেলেই বেরিয়ে আসি। যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই চলে গেলাম। ভেবেছি যে সব শিখিয়ে দিয়েছে ১০১০ আমাকে, কিন্তু বেরিয়ে আসার সময়েই জানলাম সবচেয়ে বড়ো সত্যটা। এতদিন, প্রায় তিনবছরে যেটা আমি জানতেই পারিনি। টেরও পাইনি কীভাবে ১০১০ আমার কাছ থেকে এটা লুকিয়ে রাখলো, আড়াল করলো!


ফিরে আসার পরেই জানলাম, জুড়ে যাওয়া বা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত মানুষ নিলেও সেখানে কতটা মানসিক ক্ষয় ঘটবে তা আগে থেকে বোঝার কোনই সুযোগ নাই।

আঁধারের জোনাক

আঁধারে যেরকম দেখা যায়, যতটা পরিষ্কার বা যতটা ঘোলাটে দৃশ্য জন্ম নেয় এবং স্থির হয়ে ঝুলতে থাকে, দুলতে থাকে আমাদের মাঝখানে; ঠিক মধ্যবিন্দুতে চক্রাকারে পাক খায়, সেসব বিন্দু এবং দৃশ্যকণা সুন্দর। এখন আমরা ভ্যাপসা গরমে আরো সঙ্গী চাই, আঁধার ঘন হলে আমরা গোপন এবং প্রকাশিত হই, গাঢ় এবং নিবিড় হই। সেকারণেই আলো ঝরে, প্রবীণের কুঠুরিগুলোতে সময়ঘড়ির কাঁটায়, ধীরে। তেমন করেই আমাদের বেঞ্চে আর্দ্রতা স্থবির। কিছুটা বক্র। অনেকটাই সরল। বেশ খানিকটা নিঝুম। সেই বেঞ্চটাই চারকোণে ছিটিয়ে পড়ে, যেভাবে চারবিন্দু সরে যায় কিংবা ঝিঁঝিঁর সাথে বাজে। সেখানেই আমি যাবতীয় শৈত্যপ্রেম জমা দিয়ে এসেছি।

শুক্রবার, ১২ জুন, ২০০৯

সুকন্যা সম্পর্কিত কর্মপন্থা

উপমান আর উপমিত সমাসের মাঝখানে পড়ে, কিঞ্চিৎ টানাহ্যাঁচড়ায় আমার সুকন্যাকে ভালো লেগে গেল। সুকন্যার চেহারাই সব, সেটাই দৃশ্যমান, ভালোলাগা তৈরির জন্যে সেটুকুই যথেষ্ট, এই উপসিদ্ধান্তে আসতে আমার সময় লাগে না; সুতরাং উপমান সমাসের নিকুচি করেই আমি সুকন্যার জন্যে আকুল-ব্যাকুল হয়ে উঠলাম, কুলকুল ঘামতে লাগলাম বিলকুল। এভাবেই সুকন্যার সাথে আমার প্রেমের শুরু হবে। আমরা দুর্দান্ত প্রেম শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে লা--ল হয়ে উঠবো, কিংবা সে গোলাপি, আমি নীল হতে চাইবো। এই রংবেরঙের খেলাটাও পূর্ব নির্ধারিত শিডিউলে চালাতে আমাদের ভালোই লাগবে।

সুকন্যার জন্যে আমার অনেক প্ল্যানপ্রোগ্রাম ছিল, তবে সেগুলোকে যাচাই বাছাই করার প্রয়াস ছিল না। যেমন আমি চাইছি তাকে উল্টে বা পাল্টে শোকেসে রেখে দিতে, বা কাঠের ড্রয়ারের কোণে একটা মেঘ বানিয়ে বন্দী করে রাখতে, বা বালিশের ওয়াড়ের ভেতর পুরে রাখতে। এরকম আকাঙ্ক্ষাগুলো যথেষ্ট আশাবাদী, আমি বাস্তবায়নের পাঁচমুখী কর্মপন্থা রচনা করি। বার বার নোট নেই, কাটাকুটি ড্রাফটে সেগুলো নিখুঁত, নিটোল হয়ে ওঠে; সুসজ্জিত প্রেমপন্থা আমার! বাঁধিয়ে নিলে, ল্যামিনেটিঙয়ে বেশি খরচ হবে না হয়তো। সুকন্যার ত্বকের দামেই খরচ পুষিয়ে যাবে!


-১২.৬.৯

বুধবার, ৩ জুন, ২০০৯

ল্যাবে-

দুপুরে দুইটা পাখি ঘুমিয়ে পড়লেঃ


"এই পরীক্ষাটির সঠিক এবং নির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যায়নি।", বলে
আমাদের শিক্ষক, যিনি একই সাথে আমাদের ল্যাব নিয়ে থাকেন
একটু স্মিত মুখে থেমে রইলেন।
তারপরে ল্যাবের টেবিলে সকলে তাঁকে ডাইসেক্ট করলাম
চিরে চিরে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা "সিদ্ধান্ত" অনুচ্ছেদে
গুছিয়ে লিখলাম প্রাপ্ত মান, উপাত্ত, তথ্যাবলি, নিয়মানুগ উপাচার।
"উপসংহার" লিখতে গিয়ে অনেকেই ইতস্তত করছিল
মুহূর্তেই শিক্ষক, যিনি একই সাথে আমাদের ল্যাব নিয়ে থাকেন
উঠে বসে সজোরে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলেন তাদের, যেভাবে
কাগজ কিংবা টিস্যুপেপার ছিঁড়ে আমরা ডাস্টবিনে ফেলে দেই।
তখনও তারমুখে দেখা যাচ্ছিল স্মিত রৌদ্রের মত পরীক্ষার উপকরণসমূহ | |

মঙ্গলবার, ২ জুন, ২০০৯

সেতু-চরিতঃ

একটি সেতু পেরোনোর জন্যে স্বতঃপ্রবৃত্ত ইচ্ছা বা অনুকূল জিঘাংসা ক্রমশই দানা বাঁধতে থাকে। সেতুটির নিচে সবুজ কর্কশ পানিতে নিস্তরঙ্গ সময়ঘড়ি আটকে থাকে এবং, গতবার পেরুতে পেরুতে সেটা থেমে গিয়েছিল, এই স্মৃতি আমাদেরকে একইসাথে উল্লসিত ও মথিত করে। সেতুটি কিছুটা বাঁকানো, উত্তল-


আমাদের মাঝে যাঁরা প্রথম এসেছেন, সেতু পেরুনোর শুভেচ্ছা আতরের মতো মেখে, চাপকান এবং পাঞ্জাবিসুলভ পোশাকে, তাঁরা ইতস্তত তাকাচ্ছেন। সহযাত্রী পরিচিত মুখ না দেখে তাঁরা অতিমাত্রায় নিরাশ কিংবা স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠেন। এমনকি আমার ভুলও হতে পারে, কিছুটা হতাশাও তাদের ভুরুর উত্তলতায় মিশে যায়-


সেতুর দেয়াল লাল লোহা, নরোম লোহা, ভিন্নত্বের লোহায় বাঁধানো। ঢোকার মুখে ফলকে পরিষ্কার লেখা আছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বুক চেতানো গৌরবাকাঙ্ক্ষা- "আমরাই নির্মাণে পারদর্শী, নিখুঁত এবং নিরলস।" এরকম দম্ভোক্তি আমাদের সাহস দেয়। নতুনেরাও হাসিমুখে পা বাড়ায়। পদতলে ধড়মড় করে ভেঙে যেতে থাকে নিগূঢ় বৈভব।




২.
সেতুর ওপারের বঙ্কিম শরীর পড়ে আছে,
শায়নের আলস্যে গভীর মদির চোখ
পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চিরচিরে
রৌদ্রের ছুরিসজ্জা মেখে। আমরা সেতুর ওপার
ভাঙনের গন্ধে আকৃষ্ট হই।




***