রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০০৯

একটা হওয়া না হওয়া নিয়ে খানিক বাচালতা কিংবা আজীবন ভেবে আমি যা ভেবে পেয়েছি


অ.তুমি শুরু করলেই হয়?
এভাবে হবে না কিছুই - যেমন টের পাই
আমার ভেতরে শব্দগুলো হতাশ হয়ে তাকায়
মাথা নেড়ে তারা খুব ম্রিয়মাণ হয়
ধুস্‌শালা! নষ্টমানুষ একটা!
স্ফটিক-বিম্বে বন্দী করছে আমাদের।


আ.কী নিরালম্ব আমাদের ঘুম!
ওভাবেও হবে না- তারা বলে, যখনই আমি সুঁই সুতো দিয়ে বাঁধতে গ্যাছি
"শুয়োরের ছাও, ফটকামি বোঝাও?"
এইভাবে গালি খেয়ে আমি চমকায় গ্যাছি
হাত থেকে সুঁই সুতা পিনপতনের দ্রুততায় হারাইলো
শুয়োরের ছাও হয়্যা আমি পুইড়া গ্যালাম


ই.এই অপার, জীবন হায়?
কোনভাবে হবে- তাও জানি না
যেভাবে শব্দ খেলি
যেভাবে তাদের সাথে শুই
গরম হই, "ওহ! শব্দসুন্দরী আসছে তারা ক্রমাগত একে একে"
ঠাণ্ডা হই, "যাহ্‌, কোথায় গমন গজহীন ভোর, কালকের পরে আর আসেনি তারা"
হাইস্যা ফেলি হা হা হা!
দমকে দমকে আমার শরীর নেতায় পড়ে।


ঈ.যাত্রার শেষ কোথায় হে পালিত পিতা!
সেভাবে হবে- বলে নিমগ্ন কবি
পাশে কাগজ কলম হাতে বসে দুর্দান্ত গতিতে
স্তবক স্তবক নেমে আসে থরথরে
পংক্তি পংক্তি জারি হয় গোলগাল সরব
এক একটা সর্গ রচিত হয় সানন্দেই


...আমি বুঝি আমার হাত নয়, লিখছে অপর মানব কোন ছায়াহীন কায়াহীন
আদ্যোপান্ত গাঢ় রোদ মেখে
শালা... আমার আর হইলোই না!


***

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০০৯

ফেইড-লেদার জুতো

আজ ছুটির দিন সকালে বেরোতে হলো কাজে। এমনিতে আমার ঘুম ভেঙে উঠতে উঠতে বেলা চড়ে যায়। কিন্তু আজকে চাকরির টান, পেটের গান। তাই সকালেই মশারি ভাঙলাম। ধুম ধাশ ঠাশ ধড়ক্কাট ঠুশ। এমন করেই চারকান ছেড়ে মশারিটা ভেঙে পড়ল, যেভাবে ফিনিক্স বিল্ডিংটা ধ্বসে গিয়েছিল, যেভাবে মার্কিন ইকনোমি চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ছে! আমি খুশি হই! কিন্তু আজ দপ্তরে খুটখাট করে কাজ করতে হবে সারাদিন। বাতিগুলোও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে! এরা সারা সপ্তাহশেষেও এসে গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে- এমন কথা বলে বিড়বিড় করবে!


জুতো বাছতে গিয়ে ধুলোমলিন ফেইড-লেদারের কাতর চাহনি চোখে পড়লো। "আহা! বহুদিন ঘুরি না দুরন্ত বেগে এই শহরে, সেই কবে বসন্তের শুরুতে বালিমাখা স্মৃতিই এখন সম্বল। নদী, ব্রীজ, কালভার্ট, হাইওয়ে পেরিয়ে সাগরের পারে বালুতে ডুবেছিল শরীর। রৌদ্রের বিপরীতে শাদা ফেনার ছায়ায় ভিজেছে ফেইড-লেদার শরীর আমার!" এমন সবিনয় নিবেদন কী করে এড়িয়ে যাই! পা গলিয়ে বেরিয়ে এলাম। মনে পড়লো জুতোর কথনে, বসন্তের সেই ভ্রমণের কথা। পুরনো স্মৃতির গায়ে একটু সাগরনুন ছিটে গেল কি?


আমি ফিরে এসে ওভাবেই নোনাসমুদ্রী ঘ্রাণমাখা জুতোজোড়া রেখে দিয়েছিলাম। তার ওপরে পরতে পরতে আর জমেছে বিজাতীয় ধুলো, খোলের ভেতরে বাসা বেঁধেছিল নিরীহ মাকড়সা, আজ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিলাম। ঝুল-জামা পরে ছিল গায়ে, সেটাও ছিন্ন করে বের করে আনলাম, চকচকে নগ্ন ফেইড-লেদার জুতো! বুরুশের ঘনঘন ছোবলে, পর্যাবৃত্তিক ঝড়ে উড়ে খসে গেল সমুদয় ভ্রমণান্ত সুখ।


রিকশা, হাঁটা, রিকশা, আবার হাঁটা, সিঁড়ি বাওয়া, টাইল্‌স, দরজা, টেবিল, রিভলভিং চেয়ার। ব্যস্ত হলাম কাজে। কয়েকটা ই-মেইল এসেছে। আমারও করতে হল আরো কতগুলো। এ.সি. চলছে বিজ্‌বিজ্‌। শান্ত সুনসান সব। একটু পরে কানে এলো ঘুনঘুনে সুরে কান্নার শব্দ। সচকিত হয়ে টের পেলাম, ফেইড-লেদারের ভাঁজ থেকে, হারিয়ে ফেলা ধুলোর আঁচলের শোকে জুতোজোড়া থেকে আসছে ক্রমশ গলনের গান, মিশ্রসুরের ক্রন্দন, অপার্থিব সিম্ফনি!...

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০০৯

অশিরোনাম গ্রন্থনা

...তাকিয়ে থাকার মাঝে এক নিপুণ শিল্প অনেকটাই বিমূর্ত হয়ে লুকিয়ে থাকে। শুধুমাত্র দু'চোখ মেলে তোমার দিকে চেয়ে থাকা যায়। সেই নিস্তরঙ্গ চোখে জল-কাদা-রোদ লেগে ঝাঁঝরা রাতের ঝাঁঝ জমে, আর সেভাবেই তাকিয়ে থাকায় ক্লান্ত না হয়ে খুশি হই আমি।...


...সকালে চোখ মেলতেই বুকের ওপর থেকে জোড়া পায়রা উড়ে গেল! ধবল জোড়া কবুতরে থাকে অদ্ভুত শিহরণ, পায়রার বুকে এমন শুভ্রতা বিকিরিত হয়; এবং আমি বুঝে উঠি এই সকল প্রেম, ভালোবাসা, হাসি, কান্না, ঝগড়ার রীদম। পায়রার ডানায় শিশির জমে নতুন ভোরের, বিগত স্মৃতির।...


...হেসে ফেলা রাগী চোখে আমি সরাসরি তাকিয়ে ডানা ধুকপুক পায়রা ধরে আনি। এভাবে একে একে কয়েক অমূল্য মুহূর্ত কাটে, সেখানেও আমি এক দুই তিন চার করে গুনতে থাকি সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা। ত্রিমাত্রিক পরিমাপ শেষ হলে বিশুদ্ধ জ্যামিতিক খাঁচা আবিষ্কার করি।...


...অতঃপর আটকা পড়ে কতিপয় বিচ্ছিন্ন ভাবালুতামাখা মুহূর্ত। শেকলে বাঁধা সেকেন্ডের সারিবদ্ধ বন্দীরা একে একে মাথা নিচু করে খাঁচায় ঢুকে পড়ে। নিষ্পলকে খুব ক্রূর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, যেহেতু আমি জানি সেখানে কতো বিচিত্র অপরাধী সেকেন্ড আটকা পড়েছে।...


...তোমার চোখেও কেন ভালোবাসার মাঝে এমন বিষাদ, এমন গ্লানি আর এতসব অনুশোচনা জন্ম নিচ্ছে আজ? একটু আগেই শেষরাতের বিচারক রায় জানিয়েছেন। ফাঁসির আদেশে বিমর্ষ হয়েছে আসামীপক্ষ।...


...তাদের জন্যে আমার সমবেদনা তৈরি হতে থাকে। আমি ধীরে ধীরে অবিশেষ কাতরতা, সাধারণ উদ্বিগ্নতা বোধ করি। আমাদের স্মৃতিতে অনেক ভাল সময় জমে ছিল।...


...এইসকল একরকম মোহন প্যারাডক্স! কীভাবে এক মুহূর্তের মাঝে আদ্যন্ত সেঁধিয়ে যায় হা হা করে তাবৎ অতীতকাল? পাশাপাশি কাটিয়ে দেয়া সময়ে আমরা ভাবিনি যে ভালোবাসা জমেছিল ঘাড়ের ওপর, চুলের জড়োমেঘের ভেতর, বাহুযুগল-যুগলের বেষ্টনীর ভেতর, কোমর বুক নাভি জঙ্ঘা কনিষ্ঠায়। জমাট রিক্ততাতেও আমরা অপেক্ষা করিনি। সেই পলেক স্মৃতি কোষান্তর চলাচলে ক্ষয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে। জীবন পেরিয়ে যাওয়ার আগে হিসেব মেলেনা, আর যখন তা মেলে, আমাদের জীবনের বাকি থাকে না কিছুই।...

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০০৯

এই পথ আমাদেরওঃ এই শহরের পথে আমি ও কয়েকজন

ইঁটের পাশেই ঘাস, মাটি, ধুলো। সিরামিকের ইটের গাঁথুনি, বিন্যস্ত ঘাট। এই হ্রদের পাশে নগর। বা এই নগরের পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে প্রাগোতীত হ্রদ। নীল ছিল এর পানি বোধহয় এক কালে। এখন শ্যাওলাটে ময়লা; পলিথিন, এবং প্লাস্টিকের বোতল। সজ্জা স্বভাবতই নাগরিকের উচ্ছিষ্ট দিয়ে। এবং এই নগরযাপিত সকল ময়লা ধারণ করছে হ্রদ, নিজের বুকে। খানিকটা নীরবেই এর বুকের ওপরে শহুরে সেতুমালার সেলাই, আমরা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছি কবেই! এখন তার শরীর পাঁশুটে, ম্লান, ক্ষীয়মান। সন্ধ্যে নেমে আসার আগেই আঁধার জমা হতে থাকে হ্রদের বুকে।


আমি যখন একটা সেলাইফোঁড়ের উপর দিয়ে হেঁটে ঘাটের দিকে এগুলাম, দেখলাম চৌকো চৌকো কংক্রীট পাথর ফেলা হচ্ছে হ্রদের পাড়ে। ধ্বস ধ্বস করে আমার বুকেই পড়ছে যেন ওগুলো! মাঝে দেয়া হচ্ছে অমোচনীয় সিমেন্ট। যেন পৌরাণিক কোন বন্য পশুকে বেঁধে ফেলার সকল উদ্যোগ আগেই সেরেছি আমরা, কিন্তু তারপরেও তার সূক্ষ্ণ হুটোপুটি চলছে। স্থানে স্থানে বেরিয়ে আছে কালো মাটি, কাদা, ঘাসের মখমলী একটু একটু। সেটাকেও ঢেকে ফ্যালো, মুড়ে দাও, শেকলে বাঁধো! হত্যার জান্তব দৃশ্য আমার স্নায়ু ভেঙে দেয় বলে আমি স্ল্যাবজমানো শ্রমিক আর সিমেন্টের থালা মাথায় মহিলাটিকে এগিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই দ্রুত!!


এই ঘাটে আজ মানুষের মেলা। কালো মানুষ আমরা, শরীরে ক্ষীণকায়, ময়লা ত্বক আমাদের, চুলে প্রসাধন নেই, পায়ের চপ্পলেরও টুটাফাটা দশা। জামার ভাঁজহীনতা বলে ওটি বেশ কয়েকদিন হলো ধোপার কাছে যায়নি। তারপরেও আমাদের চোখে মুখে উজ্জ্বলতা! নীরবেই আমরা অর্ধবৃত্তাকার ঘাটের পাশে জমা হয়েছি! ঘাটের সীমানায় চারটা থাম, সামনে ইটবাঁধানো চত্বরেই কয়েকজন যন্ত্রপাতি সাজাচ্ছেন। বড়ো, কালো স্পীকারে টুংটাং টিউনিং চলছে। এখানে থামের গায়ে বড়ো একটা ব্যানার। ব্যানারে নিচে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, তাদের সামনে ইটের সিঁড়ি জুড়ে প্রচুর মানুষ! আমি নিজেই এসে একটু ভড়কে গেলাম। ভেবেছিলাম অল্প কিছু ভলান্টিয়ার আর হ্রদে বৈকালিক ভ্রমণে আসা বহুমূত্রাক্রান্ত প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের দেখবো। হাঁটার ক্লান্তিতে হয়তো তারা সেখানে জিরোচ্ছেন, এমন। কিন্তু দেখলাম টগবগে উচ্ছল একদল নানারঙের মানুষ শান্ত হয়ে বসে আছেন। বন্ধু, বান্ধব, ভাই, বোন, প্রেমিক, প্রেমিকা, পিতা, সন্তান, মাতা। এরা সকলেই নিবিড় ঘনো হয়ে বসেছেন। মাটিতেই, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে জামাকাপড়ে শান্ত ধুলো লাগলেই বা কি? কয়েকটা ফ্রকপরা শিশুও দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আহা! ওরা তো আমাদের মতো উদাম খেলার মাঠ পায়নি। বাসার ব্যালকনি, ছাত, বড়োজোর পার্কিং লট। তার বাইরে হিংস্র রাস্তা আর ভয়ানক গতির যান-দৈত্য! ওদের গিলে খাবে বেরুলে। এখানে এই সিরামিকের বৃত্তাকার ঘাটে ওরা পিতামাতা, বড়ো ভাইবোনদের চক্রের মাঝে নিশ্চিন্তে হাসে, দৌড়ায়, আর খিলখিলিয়ে ওঠে আমার বিকেলটা।


তারপরে আমি কিছু পরিচিতমুখ দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, ছোটভাইয়েরা অনেকেই ভলান্টিয়ার, তারা বেশ ব্যস্ত। কুশলালাপের পরেই চলে যায়। আমি আর দত্ত’দা-ই খালি শ্রোতা। বসে পড়লাম একটু জায়গা বানিয়ে। পাশেই অপরিচিত মানুষ। অতিসাধারণ, আমার দেশের নিরীহ নাগরিক। এখানে তাদের সাথে আমিও এসে গেছি। আমরা কত সাধারণ সেই সত্যটা টের পাই। কিছুই ‘করি’ না আমরা কখনো!
বসুন্ধরায় আগুন, আমরা দেখি (টিভিতে বা পান্থপথে ঘাড় উঁচিয়ে)।
র‌্যাঙ’স ভবন ভাঙা হয়, আমরা দেখি। ওখানে লোহার শিকে মানুষ গেঁথে যায়, তারপরেও আমরা কেবল দেখি।
রাস্তায় জ্যাম, ধোঁয়া- তবুও আমরা নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়েই থাকি!
আরও অনেক কিছু আমাদের সামনেই ঘটেঃ রাজাকারেরা বিবৃতি দেয়, যুদ্ধাপরাধী নাই দেশে। শুয়োরবৎসাকাচৌ অশলীল হাসে টিভিপর্দায়, আমরা তাকিয়েই থাকি।


এসব প্রলয়ঙ্কারি ঘটনাও আমাদের চোখের সামনে সহজাত হয়ে গেছে। আর সাধারণ নারীর লাঞ্ছনা, রাস্তাঘাটে বা কর্মক্ষেত্রে তার উপরে ঘটে যাওয়া টিটকারি, ঈভটিজিঙয়ের বিরুদ্ধে একটা পদযাত্রা হয়েছে শহরে আজকে, তাতে কী যায় আসে। শুনেছি ঢাকা শহরে বাতাসে সীসা, সেই সীসায় আমাদের কান, চোখ, মুখ, ইন্দ্রিয়গুলো ঢেকে বুঁজে গেছে!


এই পদযাত্রার কথা শুনে আমার পঁচাগলা শহরের অনেকেই ভুরু উঁচিয়ে ফেলেছেন! পুরুষাঙ্গে ঈষৎ নাচন ঘটেছে, আহা! গ্রোপিং, আর শ্লীলতাহানি! এগুলা কী, একটু বিশদে বলো- শুনি। কীভাবে নারীর লাঞ্ছনা ঘটে? তাই নাকি?? ছি ছি মানুষ এতো খারাপ!- এগুলো বলে আমরা পা নাচাই তৎসম নাচনেই। সেই ভ্রু-লিঙ্গ-পদনাচন উপেক্ষা করেও অনেকে এসেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়েই এসেছেন। আমার বোন পথে হাঁটে, প্রেমিকা বাসে চড়ে, মা-ও চাকরি করে। আমার অনেকগুলো সহপাঠী বান্ধবীও পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরিতে ঢুকেছে, ওরাও রোজ রাস্তায় যানবাহনে চড়ে। এদের জন্যে হলেও আমি আজকে বিকেলে হ্রদের পাশে গিয়েছি। এবং হতবাক হয়েছি কিছুটা, খুশি তারচেয়েও বেশি। কীভাবে আমরা নীরবেও কত কিছু ‘করি’। না হোক তা একটা বিকেল, একটা পদযাত্রা, একটা সন্ধ্যা। এই নেমে আসা আঁধারের রেশ থাকতেই আমার মনে হয় আস্তে আস্তে একটা আলো জ্বলছে কোথাও কোথাও!


ওখানে গান পরিবেশন করলেন কয়েকজন শিল্পী। গানের আগে পরেও তাঁরা বললেন- নিজেদের নারী হওয়ার কারণে প্রাপ্ত ঠ্যালা, গুঁতা, চিমটি, টিটকারির কথা। তারা অন্তত একটা মাইক্রোফোন পাচ্ছেন। আর অন্যেরা তো তা-ও পাচ্ছে না। এ দেশের অর্ধেক মানুষই মেয়ে, তারা কেউ পাচ্ছে না। আমরা বাকি অর্ধেকের, পুরুষের, সেটা চোখেও পড়ে না। রাস্তায় কেউ পড়ে গেলে কয়েকজন “আহা, আহা!” করে ওঠেন। কেউ কেউ এগিয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। যে ঠ্যালা দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে তাকে উত্তম-মধ্যম দেয়ার লোকেরও অভাব হয় না। কিন্তু একটা মেয়েকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আমরা বীরত্বের হাসি দেই! কী চমৎকার অনুভূতি আমার। তাকে কেউ তুলতে যায় না, গেলেও লোভ জাগে নরোম বাহু চেপে ধরার। টেনে তুলে ‘সাহায্য’ করে আমরা পুঙ্গব হই। শিশ্নে দৃঢ়তা পাই! এই কথাগুলো চিন্তা করতে করতে আমার বুকেও ঐ স্ল্যাবগুলো সিমেন্টের গাঁথুনিতে বসতে থাকে।


এভাবে একদিনের প্রোগ্রামে কিছু হয় না। কয়েকজনের মনে যে শিখা আদৌ জ্বলে ওঠে, সেটাও পরেরদিন জোরালো জীবনের ঝাপটায় নিভু নিভু হয়ে যায়। কিন্তু আজকে আমার মনে হলো, যদি তাই হবে, তাহলে এতোগুলো মানুষ কেন এভাবে একত্রিত হলো? এখানে তো কোন জনপ্রিয় কেউ আসে নাই, পয়সা পাতি বিলানো হয় নাই। যারা কথা বললেন, এমন কেউকেটা কেউ নন। যে গান গাওয়া হলো, সেগুলোও নেহায়েৎ সাদামাটা, মোটেই ধুমধাড়াক্কা কনসার্ট নয়। তাহলে নিশ্চয়ই সেই নির্বাপিত শিখার একটা রেশ কারো কারো মনে ছিল। কেউ কেউ সেই আলোটাকেই আবার উস্কে দিতেই এসেছেন। সাথে হয়তো পরিচিত মানুষদেরও নিয়ে এসেছেন! সীমিত হাতের দৈর্ঘ্য আমাদের তাই আমরা বেশিদূর হাত বাড়াতে পারি না। কিন্তু হাতে হাতে ধরে একটা বাঁধন তৈরি করতেও পারি, করতেই পারি! এই কথাটা মাথায় আসতেই স্ল্যাবের চাপ একটু হালকা হলো।


আরো কত কত চিন্তাও মাথায় আসছিল। ফেরার পথে দত্ত’দার সাথেই ফিরছিলাম। কথায় কথায় বললাম, আদৌ কীভাবে এই মানুষগুলো নিরাপদে রাস্তায় হাঁটতে পারবে? কোনদিন পারবে কী? আমার শহরের রাস্তায় আমি যতটুকু নির্ভার হয়ে হাঁটি, আমার বয়েসী একটা মেয়ে কবে সেইরকম নির্ভরতায় হাঁটতে পারবে?


আমিও কেমন, বে-আদবের মতো স্বপ্ন দেখি!

রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০০৯

দাপ্তরিকের প্রত্যাবর্তন

সাম্প্রতিক


আমি বৈপরীত্য বুঝি, যেভাবে আমাদের আচরণে এই বোধ পালিত হয়।
অসহ্য রোদ ত্বকভেদ করলে আমার কেবলই মনে পড়ে বিগত শীত, ঊলভেজা স্মৃতি এবং ডিসেম্বরের বিকেল। তিন মাসব্যাপী ক্রমশ নিদ্রাহরণ, যুদ্ধযাপন শেষ হয়, চল্লিশ বছরের পুরনো অভ্যাস, এপ্রিল এলেই ভালো থাকি!
আমাদের নিয়ত যুদ্ধসমূহ নথিভুক্ত হয় না।






নদীপ্লট


খুব ভোরেই শহরপত্তনঃ কতিপয় বর্গাকার প্লট
ঘেসোজমিতে বাউণ্ডুলে শিশুগাছ
সিমেন্টের বানানো-
ডি-মার্‌-কে-শন্‌।
আমাদের শহরে রাত হয় না।
ব্লুপ্রিন্টে ভুল নেই বলে
জমি খুঁজে পাওয়া গেছে
আমি খেয়ো-ইঁটপথ ঘুরে ঘুরে নদীর কিনারে এসে
বুঝে নেই ৬০০বাই ৪০০, মন খুঁতখুঁত করে।
এখানে বুঝি দরিদ্র সন্ধ্যা একবার নেমেছিল শত বছর আগে!
নগরে রাত হয় না আমাদের,
আদিগন্ত পৃথিবীতে সবাই নাগরিক স্বপ্ন বেচে খাই।






তত্ত্বসুন্দর


"প্রোফাউন্ড বিউটি বলে কিছু নাই"--
একথা বলে সিরাজুল সাহেব ঈষৎ মাথা ঝাঁকান।
আমার হাতে স্ফটিকের গ্লাস আরেকটু শীতল হয়
ঘনোচুমুকে ছলকে তরলতত্ত্ব আমার মুখে,
গলায়, অন্ত্রে চলাচল সহজেই করছে।
আমি পাশে শায়িত সুন্দরীর লেজ-নাড়া দেখি
মুক্তা-দাঁতে ঝিলমিল বিপনন- আহা বিষণ্ণ প্রোডাক্ট,
কনজ্যুমার বেসিসে তার শরীর আদল বদলায়
এটাও এক গবেষণার বিষয় হতে পারে বই কি?
সুন্দরীর গম-আঙুলে তাবৎ তত্ত্বের মূল রোপন করা, তাই সেই স্মিত হাসি বড়ো মনোহর লাগে!
সিরাজুল সাহেবের জুড়ি মেলা ভার।