শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০০৯

দাবাখেলার সাথী


আমার ঘুম ভাঙে না- রোজ, ঘুমের ভেতর আমি প্রতিদিন
উল্টে ফেলি দাবার দান। রাজা-মন্ত্রি-সেনা-গজ
সকলে গজগজ
করতে করতে প্রজাপালনে যায়।
হায়
বেমালুম ভুলে থাকা প্রজারা পৈতে পায়,
কিছুটা সময়। এরাজ্যে এখন রাজা একজন,
বাকিরা সকল সভাসদ সেজে,
দাঁত মেজে
খুব পরিপাটি হয়েই নিমন্ত্রণে...
পাওয়া, না-পাওয়া এ আহ্বানে সাড়া দেয় তারা সকলে,
সদলবলে।


দেখো
দাবা থেকে আমি সামিয়ানা তলে
এসেছি চলে কী অবলীলে!
এটা ঠিক নয় পাঠক মহাশয়,
তোর জারুজুরি ফাঁস হবার ভয়
(কেবলই খেলছে মনে, জানি অবচেতনে)।
সে শঙ্কা ভয় আমারও হয়,
তবু ঝেড়ে ফেলে মন দেই এ লেখায়,
পড়তে তো বেশ লাগছে মন্দ নয়!


ভিনদেশ থেকে দু'ট্রুপ এসেছে, সামরিক সেনা
কানা খোঁড়া পা-হাত নিয়ে, বইতে বইতে।
বিভীষন হতে শিক্ষা নিয়েছে
এযুদ্ধভার সইতে সইতে
শিখেছে তারা ন্যায় অন্যায় হিসেব নিকেশ
বড়ো অপচয়, ঝরে গেল কেশ,
ক্যালকুলেটর, কম্পু বলেন তবেরে!
পামর।


হিসেব-মূর্খ গুনে দ্যাখ ফের
ক'জন গেছিলো যুদ্ধে
এবং
ফিরে এলো সব নিয়ে
প্রাণটা নিয়ে
যে এই হলো ঢের!

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০০৯

নাগরিক সনদপত্র এবং-

সকাল
ভোর নিয়ে আমার ভেতরে প্রবল কাঙ্ক্ষা সচল!
সকাল নিয়ে ততটা নয়। সকালে ঘুম কেটে যায়, চোখের কোণে জমে ওঠা পিঁচুটির মত ক্লান্তি ঝরে যায়। মুখের ওপরে বালিশের দাগ আর ঘুম ঘুম ওম মুছে যায়। সকালে আমরা ব্যস্ত, সকালে আমরা দ্রুত হয়ে উঠি। তাই সকাল অনেক সময়েই আমার প্রিয় সময় না। তবে মাঝে মাঝে সকাল খুব কামনার হয়। চুলের গন্ধ মাখা বালিশে মুখ ডুবিয়ে সকাল আসে। এলোমেলো পায়ে এসে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে। সকালের আগমনে জানালা চৌকাঠ ভেসে যায়।
ভোর তখন অভিমানী শরৎ, মেঘের মত চলনশীল। স্মৃতিহীন স্রোতের মত ভেসে চলে গেছে সে'সময় একটু আগেই। সকালের দাপটে।
সকালে বেণীগুলো থরে থরে সেজে ওঠে। ফ্রকের কুঁচিগুলো ফুলে ওঠে। শাদা জুতোর আঁকিবুকি ফিতে গোল গোল পাঁকে ফুলের মত হাসতে থাকে, দুলতে থাকে। গাঢ় নীল হাফ-প্যান্টেও ঝলমলে রোদ্দুর জমা হতে থাকে। কালরাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। কারা যানো দরজার বাইরে পানির ছোট একটা হ্রদ জমিয়েছে রাতের ঘুমে। সবাই অচেতন ছিলো যখন, তখন তারা এসে রেখে গেছে হ্রদ আর রোদ। পানির আয়না ভেঙে যায় দাপুটে জুতোর লাফানোয়। ছিটে ছিটে ওঠে হাসিমুখো বিন্দু রোদের শরীরে ঝিকিয়ে ওঠা ছুরির ফলার মতো। আমাদের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যায়।


দুপুর
দুপুর খুব সাধারণ। আটপৌরে হয়েছে তখন সকালের রোদ। থরে থরে জমে ওঠা বেণী আর হাফ-প্যান্ট ফিরে গেছে বাসায়। দুপুরের বুড়োটে ঝিমে তারা বাইরে ঘোরে না। বাউণ্ডুলে রোদ হা হা করে দৌড়ে বেড়ায় খালি ফুটপাতে, ময়লাটে বারান্দায়। শুকাতে দেয়া কাপড় থেকে চুমুর চুমুকে বাষ্প শুষে নেয় চকিতেই। গ্রীলের লোহায় মাঝে মাঝে কিছু রেখেও যায়- দুপুরের রোদ বড়ো খেয়ালি!
এই রোদে চকচকে ত্বকও পুড়ে তামাটে হতে থাকে, তামাটে থেকে কালো হতে থাকে। আমাদের সবার চামড়ায় রোদের পরশ খুব ছাপ রেখে গেছে গ্রীষ্মে। এখন শরতের রোদ, পুরোনো স্বভাব পুরোপুরি ছাড়েনি বলে আমরা পুড়ি, ধীরে ধীরে বার-বি-কিউ হয়ে উঠি নধর কুক্কুটের মাংসের মতো। আমাদের মেরিনেশন ঘটেছে নোনা-ঘামে। লবণে ঝলসে গেছে শার্টের ভাঁজ, নিভৃত আস্তিন। সেখানে শাদা শাদা নোনাদাগ পড়ে গেছে অনেকের, যারা বেশি ঘামে। শরীর শীতলের কত রকমারি উপায়...


এখন দুপুরগুলো দীর্ঘ। অচল পাথরের মত চেপে বসে, শ্লথগতিতে গড়িয়ে চলে, স্বল্পঢাল রাস্তায় যেভাবে ভারি-চাকা গড়ায়...


বিকেল
বিকেল এলেও উষ্ণতা কমে না। রোদের ঝাঁজ কমে আসে, রাগের তীব্রতা। আমাদের মনে তবু স্বস্তি নেই। আর কত বাকি দিনের, রাত এলো না কেন এখনও? এমন প্রশ্নে আমরা পেঁচিয়ে যেতে থাকি। সাপের মত কুণ্ডলি-পাকানো গরম বাতাস আমাদের জামায়, হাতে, মুখে জড়িয়ে থাকে। বিকেল অস্থির। সবার তাড়াহুড়োয় আমরা সবাই কোনো না কোনো জরুরি কথা ভুলে যাই। আজকে হয়তো কারো সাথে দেখা করার কথা, কাউকে কোনো জরুরি কিছু ফেরত দেবার কথা। কারো কাছে আমরা আজই টাকা পেতাম অনেকগুলো। এরকম টুকিটাকি চিন্তাগুলো গলে পড়ে যায় ফুটো পকেট দিয়ে। মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে পড়ে যাবার দুরন্ত-ভুলে আমরা মনেও করে ফেলতে পারি, আজকে বাসার গ্যাসের বিলটা দেয়া হয়নি! এরকম অস্থির বিকেল দৌড়ে চলে যায়। যাবার সময়টাতে আমরা অস্থিরতায় তাকে বিদায় জানাতেও ভুলে যাই। খেয়ালও করি না, বিকেলের রোদ মরে যাবার সময় কী করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল। সেই চাহনির কোলে, চোখের পাঁপড়ির ভেতর আমাদের ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরা কৈশোরের গল্পটা ছিল।


যেদিন খেলতে গিয়ে আমরা মারামারি করেছিলাম।


যেদিন জুতো ছিঁড়ে গেলো বলে বাসায় ফিরে বকা খাওয়ার ভয় ছিলো।


যেদিন গোলাপি ফ্রকের মেয়েটার সামনে সাইকেল নিয়ে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষেছিলাম আমরা।


যেদিন মহল্লার বড়োভাই ধাম ধাম করে আমাদের পিঠে কিল ঘুষি দিয়েছিলো হাতাহাতির সময়ে।


সেই সময়টা গোল, নিষ্পলক চোখ মেলে বিকেলের কোলে শুয়েই থাকে। আমাদের অস্থিরতায় খুব দ্রুতই হারিয়ে যায়।


সন্ধ্যা
সন্ধ্যা বড়ো রূপসী। নীলের ভেতর হলুদ আর কমলা, লাল আর গোলাপি গুলে সন্ধ্যা আসে। আর চলে যায়। সন্ধ্যায় বাতাসে যে পোকাগুলো ওড়ে, তাদের নাম আমাদের জানা নেই। ঠিক কখন ট্র্যাফিকের লাইটগুলো জ্বলে ওঠে তাও আমাদের খেয়াল করা হয় না। আমাদের ঘামে ভেজা শরীরগুলো শুকিয়ে উঠতে থাকলে আমরা স্থবির হই। বিকেলের সেই বিজাতীয় অস্থিরতা কমে আসতে থাকে। রক্তের ভেতর ঘাম শুকিয়ে আসে। টান জাগে চাঁদের। টান পড়ে বাড়ির। কেউ কেউ এসময়ে গোপনেই বেরিয়ে পড়ে। কেউবা এ'সময়ে খুব অসময়ের অনিয়ম-ঘুম থেকে উঠে বিপন্ন হয়ে যেতে থাকে অযথাই! কালো হয়ে আসতে থাকা আকাশে আরও বেশি কালো পাখিরা জোরে জোরে উড়তে থাকে। সশব্দে। আমরা নাগরিক মাথা হেলিয়ে এক পলকের জন্যে তাদের দিকে তাকিয়ে বিরক্তই হই হয়তো। 'এত চেঁচামেচির কী আছে?'- এই ভাবনা বাসের হর্নের মতো আমাদের মনের মাঝে ছুটে বেড়ায়। সন্ধ্যা নেমে চুল এলিয়ে ঢলে পড়ে রাতে। আমাদের নিশাচর চোখ জ্বলে, নিভে- গাড়ির অবিশ্রাম হেডলাইটের মতো


রাত
রাতের কোনো গল্প নেই। বাইরের রাত আর ভেতরের রাত আলাদা। ভেতরে প্রথাগত জীবন, মানবিক সম্পর্ক। সকালে ছেড়ে যাওয়া আধবোনা উলের সোয়েটার আমরা হাতে তুলে নেই। সুতোর এক মাথায় মা ছিলেন, আরেকপাশে বাবা, নিচের দিকে এক কোণে বোনেরা, ভাইয়েরা। তাদের সুতোগুলো গুটিয়ে আবার বুনতে শুরু করি। ফেলে রাখা সুতোতে কথা জমে আছে। আমরা কথা বলি।


ওদের কথা আমরা সারাদিন ভাবি নাই। আরো ভাবি নাই চারপাশে অচল, নিথর গাছগুলোর কথা। তারাও সারাদিন আমাদের মতোই আলো মেখেছে, আঁধার মেখেছে। থোক থোক রঙ তাদের শরীরেও জমেছিলো, আমরা দেখিনি বোধহয়। ওরা রাতে কী করে? ঘুমায়? নাকি জেগে জেগে কথা বলে আমাদের মতোই! এখানেই ভেতর বাহির ফেড়ে ফেলা তরমুজের ফালি ফালি হয়ে যায়। আমরা ভেতরে বসে সুতো বোনার ফাঁকে টের পাই না, গাছেরা ফিসফিস করে। তাদের পাতা আর ডালের মাঝে নিঃশব্দ আগুন ধরে যায়। আগুনে অদৃশ্যে পুড়তে থাকে ছাল, বাকল, কাঠ। কাঠের গভীরে কান্না জমানো ছিলো যে! সেই কান্না আগুনের ভেতরে হু হু করে কাঁদতে থাকে। গাছেদের পুরোনো স্বপ্ন আর চিন্তাগুলোও চলাচল করতে করতে পুড়ে যেতে থাকে। আমরা বাইরে তাকালে এগুলো দেখি না। দেখার চোখ আমাদের বুজে গেছে, যেদিন আমরা ভেতরে চলে গেছি সেদিনই।


সেইদিনের স্মৃতিও আমরা ভুলে গেছি। বৃক্ষের সাথে মানবের বিদায়ের ক্ষণে কী কথা হয়েছিলো কে জানে! কে বলতে পারে! সে'সময়ে তারা কেঁদেছিলো, নাকি হাসিমুখে একে অপরকে বিদায় জানিয়েছিলো, তা আমাদের পুরোপুরি অজ্ঞাত। আমরা কেবল এখন ভেতরে বসে নিথর, দোদুল্যমান ছায়াটে গাছ দেখতে পাই। আগুনের ঘ্রাণ এলেও, তা আমাদের কাছে অচেনা লাগে।


তবে কেউ কেউ সে গন্ধ পায়। উন্মাতাল মানুষের জাত, বেজাতের পশুদের মতো শুঁকে শুঁকে তারা এই প্রবল দহনের খোঁজ পেয়ে যায়। ভালোবাসার মতো আগুনে তারাও পুরে যেতে চায়, এই আকাঙ্ক্ষার কোনো দাম নেই মানবের কাছে আর! তাই তারা, গুটিকয় মানুষ, জনপদ ছেড়ে চলে যায়। চুক্তি-মোতাবেক, আমরা তাদেরকে ভুলে গেছি, এই জগতের প্রয়োজন বা উপযোগ নেই। বেখাপ্পাদের জায়গা পেছনে, গুদামঘরে।


রাত ফুরিয়ে গেলে আমাদের জনপদে, ভোর এসে সব দৃশ্য ও আগুন নিভিয়ে দেয়। একারণেই ঘুম পায় আমার। আগুনের ভালোবাসা হারিয়ে কোমল ঘুম কামড়ে ধরে আমাদের। আমাদের কাছে তাই ভোর প্রিয়!

মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০০৯

ভোরঃ আমাদের, আমার, তোমাদের একান্ত-

পূর্ব প্রকাশের পরে...




বিষাদের চেহারায় কতগুলো দাগ পড়ে গেছে।


আঁকাবাঁকা, খরখরে দাগগুলো বিষাদের চেহারায় মরা সাপের মত লেগে থাকে। আমার আর বিষণ্ণ লাগে না। আমি অনেক দিন বিষণ্ণ হই না। কতদিন! আরেক জন্মে আমি শেষ বিষণ্ণ হয়েছিলাম কি? নাকি গতকালই, অথচ আমার স্মৃতি সেটাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখে। আমাকে বাঁচাতে নিজের কাছ থেকেই...


বিষাদ গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মত অপরাধী। দুঃখবোধের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার আজকেই শেষ দিন। তারা খুব হরিহর আত্মা ছিলো। আত্ম-যোগাযোগ। মিলে যাওয়া সুরে সুর। তানে তান। টুং বাজলেই টাং বেজে ওঠা। এ'সকল পার্থিব যোগাযোগ আর সেগুলোর পরিমাপক বাদেই বিষাদ ও দুঃখবোধের নিবিড়তা আলাদাভাবে গড়ে উঠেছিলো। আজকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমি দুঃখবোধের সুতো পাকানো মুখটা খুলে রাখছি বিছানার পাশে, মেঝেতে টবের ধারে। ওপাশের জানালা বেয়ে বয়ে চলছে বিষাদের কান্নার স্রোত। কাঁদছে সে, আকুল, নির্ঝর, নিঃশব্দ। তার কান্নার দৃশ্য আমাকে হালকা করছে। দুঃখবোধের শরীর নুয়ে পড়ছে ক্রমশ... মিশে যাচ্ছে আমার ঝুলিয়ে রাখা হাতের নখে। আর সেখানে রোদ্দুর চাষ। সহসাই ঝলক আলো, হঠাৎ নিথর জানালা।




আজকে বিষাদের ছুটি। আজকে থেকে বিষাদের ছুটি। আজ আমি খুশি।




***
- ১১.৮.৯

শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০০৯

ভাঁজবিহীন সময়ের গল্প

আমরা কিছু সময়কে পুরনো কাঁপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখি। সেসব সময়ের রং চাররঙা খবরের কাগজের মত জ্বলজ্বলে ছিলো হয়তো একসময়। অনেকদিন কাপড়ের ভাঁজে থাকতে থাকতে সেসব সময়ের গায়ে সেলাইয়ের দাগগুলো স্পষ্ট হয়। সুতোর গন্ধ তীব্র হয়। রংসমূহ ধীরে ধীরে খয়েরি ও বাদামি হয়ে উঠতে থাকে। মনের ভুলে কেউ এসে ড্রয়ার থেকে কাপড়টা বের করে নেয়, আর তখনই তার ভেতর থেকে ভাঁজবিহীন সময়ের পাতাটা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে যায়। মেঝেতে, কিছুটা শীতল পরিবেশ ঝরে যাওয়া সময় আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মুখের রেখার সাথে সন্ধিচুক্তি করে।


কোন্‌ অতীতকালে, নব্বুইয়ের স্বৈরাচার পতনের ডামাডোলের ফাঁকে তখন নিরন্তর হরতাল মিছিলের উত্তাপ ছড়াচ্ছে। সে উত্তাপ গালে মেখে দুরন্ত ফেব্রুয়ারিতে এক কিশোরের পথচলা দেখতে পাই। আমরা উৎসুক চোখে দেখি ফুটপাত জুড়ে বেলী কেড্‌সের জুতো মশমশিয়ে চলে যাচ্ছে লঘু পায়ে। ফুটপাত আর রাস্তার উল্টোদিকেই একটু নিচুমাটির মাঠ। মাঠের কিনারে ছয়ফুট দেয়াল। দেয়ালের গায়ে মোচওয়ালা এরশাদের ছেঁড়া পোস্টার। কালকে রাতে কারা ছিঁড়ে রেখে গেছে আর কালো কয়লার চকে লিখেছে, "স্বৈরাচারী নিপাত যাক!" কিশোরের চোখ কালো এবড়ো খেবড়ো অক্ষরগুলোর ওপর দিয়ে পিছলে যায়, আবার পুরোপুরি পিছলে যেতে যেতে "স্বৈরাচারী"তে আটকে থাকে। 'স্বৈরাচারী মানে কী? অত্যাচারীর মত নাকি?' এই অতিসরল চিন্তা নিয়ে দুই কি এক মিনিট সে দড়িলাফ খেলে। হাঁপ ধরে যাবার আগেই পরাবৃত্তের মত বাঁকান দড়িটা মাটিতে ফেলে সে হাঁটতে থাকে। 'হোক্‌গে কেউ স্বৈরাচারী'! ফুটপাতের মুখটা যেখানে নিচু হয়ে রাস্তার বাঁকে মিলে গেছে, সেখানে সে নেমে পড়ে। নিচুমাঠের ধারে দেয়ালটাও বেঁকে ভেতরে ঢুকে গেছে রাস্তার সাথে। কিশোরের লঘু পায়ের ছাপ এই পিচের রাস্তায় পড়ে না, উল্টোদিকের দোকানে ঝুলিয়ে রাখা হলুদ চিপ্‌সের দিকেই তার চোখ চলে যায়। খানিক জুলজুলে দৃষ্টি ঝানু দোকানি চিনতে পেরে বেশ অমায়িক হাসি দেয়, কিন্তু কিশোরের হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। লোহার কালো গরাদের মত গেইটটা ঠেলে খুব কষ্ট করে কিশোর ছেলেটি একটা বিল্ডিঙের পেটে সেঁধিয়ে যায়।


বাইরের দুপুরের ছায়া একটু একটু করে প্রলম্বিত হচ্ছে, ঝিমে ধরা কালবৈশাখীর বুনো ঘাম বুকে নিয়ে। এপ্রিলের এই জ্বলে ওঠা গ্রীষ্মে শহরের নালী-উপনালীতে আগুন। দাউ দাউ করে গণতন্ত্র জ্বলছে। জাতীয়তাবাদে ঝলসে যাচ্ছে কিশোরের পিঠের ব্যাগ, হাতের ওয়াটার বট্‌ল। দুটোকে টেনে টেনে সে দুপুরের রোদের সকল রাগ নিয়ে ফুঁসতে থাকে। গত দুইমাসে পথের ধারে এই বিল্ডিঙে তার জিরোবার জায়গা হয়েছে। ইশকুলের সময় বেড়েছে ফাইভে ওঠার পর থেকে। ঘন্টাখানেক বেশি সময়ে সকালের নিখুঁত আঁচড়ে দেয়া চুল এলোমেলো হয়। বাতাসের হুটোপুটি শোনা যায় দোতলার ক্লাশরুমে। বুড়ো স্যারের মন নেই পড়ানোতে আজও, তাই তারা সকলে আজকে গল্প বলেছে। কিশোর চেষ্টা করছিল আবৃত্তি করার, "থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে..."। সেই ক্লান্তির শেষে আজকে রাস্তায় প্রচুর ধুলো। বিল্ডিঙয়ের তিনতলায় উঠে কলিঙবেল টিপতে যা দেরি, দরজা খুলে দিলে সে ধপাস করেই ব্যাগ-বট্‌ল ফেলে দেয়। এক দৌড়ে টেবিলের জগ থেকে পানি ঢকঢক করে গিলতে থাকে। যে মেয়েটা দরজা খুলে দিলো তার চোখে মুখে বিস্ময়। দরজা ফের লাগিয়ে দিয়ে সে টেবিলের কোনায় এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। আর দেখে যে কিশোরের কষ বেয়ে গ্লাসের পানি উপচে গড়িয়ে পড়ছে, আর পিস্টনের মত ওঠানামা করছে গলার উঁচু হাড়!


'তুই এত ঘামছিস কেন?'


'ধুর গরম বাইরে। ধুলা!'


কিশোরীর সাথে এমন অযথাই কথা হয় কিশোরের। ফেব্রুয়ারিতে এই বিল্ডিঙে এসে উঠেছে ওরা, আর গলির শেষমাথায় কিশোরের বাসা। এর আগে অনেকটা পথ হাঁটতে হতো ওকে রোজ (রিকশা নেয়া যায়, কিন্তু একবার পড়ে গিয়ে হাঁটু আর কনুই ছিলে গিয়েছিল বলে এখন মা টাকা দেয় না)। এই বাসায় ওরা উঠে আসার পরে কিশোরের মাঝপথে থামার একটা জায়গা হয়েছে। দুপুরের এই ঝিমধরা বাতাস মেখে ও তাই তিনতলায় উঠে আসে রোজ। তারপরে কিশোরীর সাথে অযথা গল্পের সময়, বারান্দার গ্রীলের মধ্যে দিয়ে সারি সারি টিনের বস্তি দেখতে দেখতে ওরা গল্প করে। তিনতলা থেকে এই গরমের আঁচে পুড়তে থাকা বস্তির মানুষগুলোকে দেখে ওরা কী ছেলেমানুষি খেলা খেলে! মাঝে মাঝে স্কুলের ঘটনাও চলে আসে, এই যেমন সেদিন মারামারি হচ্ছিলো বস্তিতে। সেটা দেখে কিশোর তার ক্লাশের দুই গুণ্ডার মারামারির গল্প বলেঃ পেন্সিল নিয়ে কাড়াকাড়ির সময়ে মুশতাক কেমন করে একটা পেন্সিল তীরের মত ছুঁড়ে দিয়েছিল আবীরের দিকে। আবীরের পায়ে লেগে সেটা মাটিতে পড়ে গেলেও সেখানে কেটে গিয়েছিল কিছুটা। মুশতাকের আব্বু পুলিশে চাকরি করে। এইসব হাবিজাবি। কিশোরী চোখ গোল গোল করে শুনে শেষপর্যন্ত তাচ্ছিল্যে মুখ বাঁকায়। 'যতসব ফালতু পোলাপাইন'! এভাবে বললে কয়েকটা গ্রীল জুড়ে জমে থাকা মরিচা শুকিয়ে যায়। 'তুই এদের সাথে মিশিস কেন?' নিরুত্তর কিশোরের মুখে কথা সরে না অনেকক্ষণ। তারপরে বস্তির মারামারি শেষ হলে, সবাই যার যার টিনের চালের নিচে ঢুকে পড়লে তারা বারান্দা ছেড়ে ঘরের ভেতরে আসে।


বিকেলের পরে, কিশোরের বাবা ঘরে ফেরার পথে তাকে এখান থেকে উঠিয়ে নেন। বসার ঘরে কিছুক্ষণ বসেন, চা নাস্তা খান। কিশোরীর মায়ের সাথে কথা বলেন টুকটাক। এসময়টা তারা দু'জনে ভিতরের শোবার ঘরে গিয়ে বসে থাকে। তারপরে বাইরে থেকে ডাক দিলে, কিশোর ব্যাগ-বট্‌ল তুলে নিয়ে ফিরে যায়। পরের দিন দুপুরে আবারও তাদেরকে ঐ বারান্দায় দেখা যায়। শুধু আজকে একটু বদল ঘটলো। বাসায় ঢুকেই কিশোরের ঢক ঢক করে পানি খাওয়া দেখে কিশোরী চমকে গেল একটু। তারপরে তারা খুব বেশি কথা বলেনি, সাদা-কালো টিভি খুলে বসে ছিল। ঝিরঝিরে অ্যান্টেনা নাড়ালে দূরদর্শন আসে, কিশোর কায়দা করে সেটা ঠিক করে খুব বাহাদুরের হাসি ছুঁড়ে দেয়, কিশোরী আবারও চমকে যায়। আজ সব ঘুণে ধরার দিন। কুরকুর করে ঘুন কাটছে ভিতরে ভিতরে। তারপর আজকে আরো বদলে যায় দিনটা, কারণ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলেও কিশোরের বাবা ফেরেন না।


সন্ধ্যা নেমে আসলে বস্তির ভেতরে ভেতরে টিমটিমে আলোগুলো জ্বলে ওঠে। হলুদ আলোকে দূর থেকে কমলা রঙের লাগে, আর গ্রীলের গা ঘেঁষে বসে থাকতে থাকতে কিশোর শুনতে পায় বসার ঘরে তার মা কাঁদছে বোনের গলা জড়িয়ে। এপ্রিলের ঝাঁজালো আলো নিভে গেলেও তাপের অনুষদ ঘুরঘুর করছিলো টিনের চালের ওপর দিয়ে। তিনতলার বারান্দায় অল্প আঁচে পুড়তে থাকে কিশোর। মেয়েটি তখন বসার ঘরের পর্দা আঁকড়ে বিস্ফারিত চোখে দু'জন পূর্ণবয়স্কার কান্না দেখছিলো। আজকে সব হতবাকের দিন, এলোমেলো দিন। সে'রাতে কিশোর বাড়ি ফেরে না। মায়ের সাথে ঘুমানোর জন্যে বসার ঘরে তাদেরকে তোষক বিছিয়ে দেন গৃহকর্ত্রী। মশারির মাথাগুলো নতুন পেরেকের উচ্চতায় মিশ খায়নি বলে বাঁকা পালের মত অস্থির দুলছে। সেখানে অপরিচিত বালিশে শুয়ে কিশোরের নদীভ্রমণের ভ্রম হয়। তার মনে হয় মা আর সে একটা দিকহীন, পালের নৌকায় করে ভেসে যাচ্ছে। তোষকের বাইরেই পানির স্বাদ, মাছের ঘ্রাণে তার নিঃশ্বাস আটকে আসতে থাকে। মায়ের কান্নার দমক ততক্ষণে থেমেছে, এমনকি মা'কেও তার অপরিচিত লাগে খুব।


পরের দিন তাকে স্কুলে যেতে হয় না, এমনকি তার পরের দিনও। কিছুদিন পরে সে বুঝে যায় বাবা আর কখনও আসবে না। ধীরে ধীরে রাস্তার শেষের বাসাটা সে ভুলে যায়। জাতীয়তাবাদের পোস্টারের দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে সে এই বাসাতেই এখন ফিরে আসে, বসার ঘরে তার মা তার জন্য অপেক্ষা করে।


২.


তারপরে ঘনবর্ষণের আগস্টে, সেবার তাদের শহরে অনেক থই থই পানি জমে। পানির ঢেউ বিল্ডিঙয়ের ল্যান্ডিং জুড়ে অনেক শ্যাওলা ঠেলে নিয়ে আসে। দারোয়ানের রোজ সকালের খেউ খেউ শোনা যায়, বস্তির ওখানে টিনের চালগুলোর ফাঁকে ফাঁকে জলমগ্ন জীবন কিশোর এবং কিশোরীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকে কী করে তারা রান্না করে, এটা কিশোরীর গভীর রহস্যজনক লাগে। শুনে কিশোর বুঝতে পারে যে তারা আলাদা। অনেক আগে, একদিন কিশোরী যেভাবে গোপনে চমকে গিয়েছিল, সেভাবেই একদিন সে চমকে ওঠে।


আরো চমকে যাওয়ার মত কিছুদিন পরে তারা উজানে নতুন বাসায় উঠে যায়। মাঝখানে পড়ে ইশকুল। এখন কিশোরের বাসায় ফেরার পথ উল্টে যায়, সাথে উল্টে যায় দিনের ছন্দ। তার তাল কেটে যায়, সুর কেটে যায়। প্রায়ই স্কুল থেকে বেরিয়ে সে পুরনো পথের দিকেই হেঁটে যাবার চেষ্টা করে। সেদিকে অনেক সুন্দর পিচ-ঢালাই হয়েছে এখন, ফুটপাতের পাশের নিচুমাঠে অনেকগুলো দোকান, দুটা সেলুন আর সাইকেল-অটোরিক্সা সারাইয়ের দোকানও হয়েছে। এসবকিছুই সে জানে। কারণ মাঝে মাঝে সেদিকে গিয়েও ফিরে এসেছে। চমকে ওঠার পরদিন থেকেই তার কাছে বিল্ডিঙের পুরনো গেইটটাকে অচেনা লাগে। ভিন্‌দেশী মনে হয় সিঁড়িগুলো, তিনতলার ঠিকানাও মনে হতে থাকে অজ্ঞাত। তাই দূরবর্তী নৌকার মতোন ক্ষুদ্র লাগতে থাকে ডোরবেল, চৌকাঠের কমলাটে রং! পথ ভুলে ওদিকে হেঁটে হেঁটে দুপুরটা পুড়ে গেলে সে বাসায় ফিরে আসে। তালা খুলে গুমোট বাতাস ভর্তি বাসায় তার একা লাগে। এই বাসাটা একতলা। মাটির কাছে ভ্যাপসা রোদ আর ছায়া মিলমিশ করছে। সেখানে ব্যাগের ওজন সহসাই অনেক বেশি মনে হয় তার।


কিশোরীর খবরও পাওয়া যায় না অনেকদিন। চোখের আড়াল হলেই কেউ কেউ মনের আড়ালে চলে যায়--এই আপ্তবাক্য তখন কিশোরকে শিখে নিতে হয়। ঐ পথে রাস্তা চওড়া হয়, নতুন চকচকে বিল্ডিং ওঠে পুরনো পরিচিতটির গা ঘেঁষে। আর সজোরে উত্থিত হয় সুপার মার্কেট। এ সবই বহু বহু পুরাতন পরিবর্তন, কিশোরের অজ্ঞাতেই এহেন ভাঙা-গড়া চলতেই থাকে।


শুধু ঐ বিল্ডিঙটা বদলায় না। সেখানে তিনতলার দরজা খুলে ভেতরে গেলে আমরা দেখি সবকিছুই বদলে গেছে! বসার ঘরের বিন্যাস, দেয়ালের চিত্রকর্ম, মেঝের কার্পেট, মায় খাবার টেবিলের গ্লাস আর জগ পর্যন্ত সবই নতুন, পরিপাটি। বারান্দার বাইরে টিনের চালাগুলো আরো পুরাতন কালচে হয়ে উঠেছে, ঘন ঝিলিকের মত রোদ এখন আর সেখানে পিছলে যায় না। বাসার ভেতরে নতুনের পসরা সেজেছে অনেকদিন হলো। কিশোরী বড়ো হয়ে গেছে, তার মায়ের শরীর ভেঙে পড়েছে। কিশোরী চাকরি পেয়েছে, সে প্রেমে পড়েছে। তারপরে একদিন প্রেমিকের সাথে সে বিয়েও করে ফেলেছে।


এইসকল হাইলাইটেড খবর কিশোরের জানা আছে। অনুষ্ঠানে তারা মুখোমুখি হয়, দেখা হয়ে যায় কখনো কখনো পথ চলতেও। শুধু অবসর মিলে না। অথবা বলা চলে তারা কেউই সেই অবসরটুকু খুঁজতে চায় না। তাদের দু'জনের অগোচরেই বারান্দার অপরিবর্তিত গ্রীল, তার গায়ে জমে থাকা মরিচা, হু হু করে কাঁদতে থাকে!




***

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০০৯

দৃশ্যকল্প


ড্রয়ার
দৃশ্যকল্পের কয়েকটা গাছ বুনেছিলাম ঘরের কোণে রাখা পুরনো আলমারির ভেতরের
চাবি দেয়া ড্রয়ারে। ঘষাছাল চামড়া থেকে অনুমেয়ঃ আমার বয়সের দ্বিগুণ বয়সী কাঠের
আলমারি প্রায়শঃ বৃদ্ধ শরীরে বহু টানাপোড়েন, টানাহ্যাঁচড়া, বাসাবদলের স্মৃতি ধরে
রাখেন। মূলত গৃহস্থের ঘরে অন্য সবার সাথে জায়গা না হওয়ায় তার অবস্থান এ ঘরে
ঘটেছে, এমন তথ্য মনে সৌহার্দ্যের জন্ম দেয়। আর্দ্রতা ও শৈত্যপ্রভাবে কাঠের শরীরে
প্রসারণ-সংকোচন, ফলতঃ ড্রয়ারের খোল ও কাঠামো ঢিলে, নড়বড়ে করে হয়ে গেছে,
তাই চাবি দেয়া ড্রয়ার যথেষ্ট অগোপন- মৃদু আন্দোলনেই প্রতিরোধ তার, ভেঙে পড়ে।
তবু গোপনীয়তা ফাঁসের এই সমূহ সম্ভাবনা মাথায় রেখে যাবতীয় সম্পদ, সম্পত্তি,
অর্থবাচক স্থাবর আবেগ সেই কুঠুরিতেই নিরীহ ঘুম-মগ্ন। এবং সম্পদের ভাঁজে কিছু
দৃশ্যকল্পের গাছ ন্যাপথলিনের পোকারোধক-ভূমিকা পালন করে, স্মৃতিজাত গবেষণায়
প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ না ঘটিয়ে পুরনো আলমারির ড্রয়ারে চাবি
দেয়া থাকলে আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বেও মন্দা দেখা দিবে। দৃশ্যকল্পের গাছেরা তাই
আলোহীন কুঠুরিতে স্মিতমুখে আগাছার জনন দ্রুততায় বেড়ে ওঠে। দিনমান ব্যস্ততায়
তাদের ভুলে থাকা যায়, ড্রয়ারটি অমনোযোগে ভারি থেকে ভারি হতে থাকে, হায়
সকল বনসাই দৃশ্যকল্পের ফুল, নরম গালিচা স্মৃতির শবাধারে বিমুগ্ধ শ্রোতা- আর দেখো
আমাদের সকল বসবাস জুড়ে কী ভীষণ জমকালো শোক। অনাদিব্যাপী বনসাই চিত্রলেখ।




অজগর
প্রতিটি শকটে জ্বলন্ত লাল ও হলুদ চোখ, স্থবির অজগর বাঁকানো কালো শরীরে
পড়ে আছে। নদীতটে বা ঘাটে জমানো নৌকার মত দুলছে, নিভছে, ধীরে, ধীরে
এই আধুনিক বাহনে ছইয়ের মত উঁচু হয়ে থাকা পেটের ভেতর শীতল বাতাস
তোমাদের অন্তর্বাসে হিম বরফকণা চেটে শুয়ে থাকে। সূক্ষ পুলকসমূহ দীর্ঘশ্বাস
হয়ে চোরাগোপ্তা পথে তুলোর পোশাক চুঁয়ে চুঁয়ে শকটের পাঁজরে লেগে থাকে,
এবং ভিক্ষাপ্রার্থীর খোঁড়ল-জমা দৃষ্টিতে কয়েকটি চাঁদে-পাওয়া আহ্বানের ফাঁকে
সেগুলো চুপিসারে পাচার হয়ে যায়- শকটবন্দীর অন্তর্বাস হতে পুলকচুরি অহরহ
ঘটছেই। জনপদ বিধাতার সভাসদের শয্যা থেকে ক্রমশ বিলীন নিম্নবিত্ত বিরহ!




গলনাঙ্ক
একটি বিষণ্ণ কাচের গেলাস উষ্ণজুনের তাপদাহে ঘামের শীতলবিন্দু বুকে মেখে
গোলাপি টিস্যুর পোশাক পরে আকুল কাঁদছে। দেখো কী সহজে সে কান্না দেখে
আমি স্ট্র দিয়ে টেনে নিচ্ছি হরিৎ তরল পানীয়। মনে পড়ে কুহকী অ্যাবসিন্থ আহা
জিহ্বার কোষ খুঁড়ে স্বাদের নেশা তুঙ্গে ধাপে ধাপে উঠতে থাকে। গলিত লোহা-
গোলানো পানিতে আমাদের প্রেম ও পাপ, বিবিধ গলনাঙ্কে মিশে যেতে থাকে
গেলাসের শীতলবিন্দুর প্যাভিলিয়ন হতে উষ্ণতার জুন কেবল চোখ মেলে রাখে।




সিঁড়ি
সন্ধ্যের পরে যেমন আঁধার নামছে, সভ্য নগরে
ওভারব্রীজ বেয়ে তুলোবোনা ওড়নাগুলো গিঁট বেঁধে
উঠে আসে
............আশে পাশে
.........................নেমে আসে
......................................ধাপে ধাপে


লোহার সিঁড়িতে ধুলোবন্দী মূল্যমানে তাদের
......................কৌমার্য
...............................বেণির ধৈর্য
............................................সাহচর্য
........................মিশে যেতে থাকে-
.....................শ্চ....................র্য


পেছনের পথে নুয়ে পড়া স্ট্রীটলাইটের জিহ্বা ও শিশ্ন থরথরে কাঁপন ধরে রাখে
লোহার পেছনে
দাঁতের পেছনে
রেলিঙের গায়ে
সিঁড়িদের পায়ে


বিগত সন্ধ্যার লালাভ দীপ্তি জ্বলজ্বলে হাসি হয়ে ঝরে পড়তে থাকে।


***






উৎসর্গঃ প্রণব আচার্য, প্রচ্ছদ এবং "প্রতিধ্বনি, তুমিতো"