শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

রেলের বিশমুহূর্তে জমাট প্রজাপতি

পাতালরেলের ভেতর হঠাৎ দিনের চমৎকার আলো বা রোদ মেখে


(সম্ভবত) দুটো প্রজাপতি ঢুকে পড়ে


ঝকঝকে রেলের কামরায় তারা ছটফটে দুর্দান্ত হেমন্ত নিয়ে আসে


এভাবে কবিতা এবং জীবন জন্ম নেয়


জানালাগুলো নিশ্ছিদ্র বলে


বেরুবার পথ নেই, নেই চলে যাবার অবারিত উপায়


তাতে দুটো বা অনেক প্রজাপতির কোনো ক্লায়কেশ নাই


জানি


দরোজাগুলোয় কড়িবর্গা নেই, নেই চমৎকার কড়ার কণ্ঠ


সেগুলো নিঃশব্দেই খোলে, বিশ কি তিরিশ মুহূর্তের পরে বুঁজে আসে


আবেশে আপ্লুত চোখে


খুব মসৃণ আমি দেখি বা


দেখি না


দরোজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে তারা বেশ নিমরাজি--


ঘুরছে তখনও চাকাবিহীন দুমুখো শকট


স্টেশন স্টেশন পেরিয়ে যায়


পায়ের নিচে বেরিয়ে যায়


এভাবে কতো অনির্ণেয় জাংশনে প্রজাপতি


(দুটোই ছিলো বোধহয়, নাকি অজস্র?)


সংখ্যা ও পরিসংখ্যানের কি বেমালুম প্রয়োজন, নয়!


তাদের কিছু যায় আসে না, মানবিক স্টেশনে


তারা থামতেই চায় না


গতিশীল অনড় চেয়ার


চেয়ারে আমরা বসে থাকি, গন্তব্যের প্রয়োজনে- উদ্দেশে


মনে হয় কিছু নেই? প্রজাপতিগুলোই কেবল


আছে


দিনশেষে রাতের কালোতেও রঙহীন পাখার ঝাপটানি দেখি


এ কেমন বিম্বাধর আকর্ষণে মেতেছে তারা!




দরোজার পাশে দুটো প্রজাপতি জড়াজড়ি উড়ছে না উড়বে না নিথর চুপচাপ শুয়ে থাকে পাখা নড়ে অল্প বেশি জড়াজড়ি পড়ে থাকে জমে থাকে রেলের কামরায়

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

পাথরের ঘ্রাণ!

কেন চলে গেলে দূরে, ভাসায়ে মোরে সুরে
কেন ফিরে এলে আবার, বাড়াতে দুখের ভার।
কোন কোন গান কেমন অন্তরের ভেতরে শিকড় গেড়ে ফেলে, ভাবলে অবাক হতে হয়!
*
ছোটবেলায় বাসার সামনে একটা পাকা রাস্তা ছিলো। সেই রাস্তার পাশে পিচ আর আলকাতরা মেশানো দুয়েকটা পাথর দেখা যেতো। ঠিকমতো জোড়া লাগেনি তারা। বিকেলের দিকে আমি সাইকেল চালাতে শিখে সেই রাস্তাগুলো দিয়ে অনবরত ঘুরে বেড়াতাম। নিরাপদ, শান্ত কলোনি। কবে যেন মায়ের নিশ্চিত ঘুমের ফাঁকে বিকেল পড়ার আগেই দাউদাউ রোদে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। পিঠের ওপর রোদকে পুড়ানোর কাজে চাকরি দিয়ে আমি বেশ আরামেই সাইকেল চালাচ্ছি। পনেরো কি বিশ মিনিটের মাথায় দমের অভাব আর ঘামের প্রাচুর্যে থামতেই হলো। রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর সাইকেল কাত করে রেখে দিয়ে বসে পড়লাম। হাঁপাচ্ছিলাম, কিছু একটা করতে হয় বলে ঘাস টেনে টেনে ছিঁড়ছি, সেসময় চোখ গেলো খুলে আসা কিছু পাথরের দিকে। ফ্যাকাসে ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে চুপচাপ। হাতে উঠিয়ে ঠুকোঠুকি, গোল গোল খেলা শুরু হলো। দম ফিয়ে এলে আর ঘাম শুকিয়ে গেলে, হাফ প্যান্টের পকেটে পুরলাম। সাইকেল ঠেলে বড়ো মাঠে গিয়ে ক্রিকেট কি ফুটবল দেখেছি মনে পড়ে। ছোট পকেটের ভেতর তখন পাথরে পাথরে মিলমিশ।

**
আমার গন্ধ বিষয়ে খুব আগ্রহ। কোনকিছুর গন্ধ শুঁকলে একটা অবয়ব টের পাই মাথায়, স্মৃতির খাতায় কোন একটা অব্যাখ্যাত প্রক্রিয়ায় কোন কোন সূত্র লেখা আছে সবকিছুরই!
মায়ের ঘরে গেলেই একটা আবছা কিন্তু প্রবল গন্ধ পাই! মায়ের কাঁথা জড়িয়ে নাকের কাছে ধরলে অজান্তেই চোখ বুঁজে আসে। খুব শান্তির ঘুম পায় আমার...। তেমনি জানি আমার বালিশেও একটা নিজস্ব গন্ধ ছড়িয়ে আছে। তারপরে ধরা যাক, কাঠের টেবিল বা বাসার দরজার সামনে রাখা টবের গাছগুলোর একটা মাদকভরা গন্ধ আছে, আমাকে টেনে ধরে মাঝে মাঝেই। কুড়িয়ে তোলা সেই পাথর দুটোকেও আমি প্রায়ই হাতে নিয়ে শুঁকতাম। প্রথম দিকে ধুলোমেশা পাথুরে একটা গন্ধ পেতাম। ধীরে ধীরে বাইরের ধুলো কমতে শুরু করলো, আর জমতে থাকলো আমার ঘরের গার্হস্থ্য-ধুলোর আস্তরণ। পাথুরে সেই গন্ধটা কিন্তু পুরোপুরি গেলো না। টেবিলের ড্রয়ারের কোণে রেখে দেয়া পাথরের গায়ে এমন কী গন্ধ পেতাম আমি, কে জানে!

সবকিছুই একটা সময়ে পুরনো হয়। আমার এই অকারণ গন্ধশীলনও কেমন কেমন করে অনভ্যস্ত আচরণ হয়ে গেলো। ভুলে গেছি আমি সেই পাথরদুটোকে। জীবন ব্যস্ত হয়েছে, আমি তার চেয়েও ব্যস্ত হয়েছি। ঝিনাইদহে পড়তাম, ছুটিছাটায় বাসায় আসা হতো। একেবারে চলে আসার সময়ে ও'দুটো পাথর ব্যাগে করে আমিই এনেছিলাম মনে হয়। বাসার বদলেও আমার অজান্তেই সেগুলো তল্পিতল্পার সাথে গুটি গুটি পায়ে চলাচল করেছে। আর সবশেষে আমার ঘরেই তাদের ঠিকানা হয়েছে। আমার আর পুরনো এই পাথরদুটোর কোন দরকার পড়ে না। চারপাশে কতো অসংখ্য গন্ধের উপাদান!
কলেজের পরে এলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সিঁড়ির গন্ধ আর করিডোর পেরিয়ে ক্লাসে ঢোকার পরে যে মৃদু সুবাস পেয়েছিলাম- তা খুব সহজেই মাথায় গেঁথে যায়! সেদিনই প্রথম জানলাম, "মৃদুতার তীব্রতাই বেশি!" তবে পড়ার চাপে, আর কিছুটা পরীক্ষার ভীতিতে মৃদুসুবাস উড়ে গেলো। কলমের কালি হাতের আঙুলে লেপ্টে যেতে লাগলো, সেই হাত ধোয়ার পরেও সেই গন্ধটা যায় না। একটা সময়ে পাট চুকে গেলো ওখানে। চার বছরের শিক্ষা আর এক বছরের অযথা-অলস "পরীক্ষা-পেছানো-ছুটি" কাটিয়ে পাশ করলাম। চাকরি করতে গিয়েও নতুন ধরনের ব্যস্ততা। রোজ যেতে হয়, চাইলেই অলস অনাগ্রহে এড়ানো যায় না- এ এমনই এক গ্যাঁড়াকল। ছুটির দিনগুলোতে ঘুম চেপে ধরে বিছানার সাথে। "ঘুমা ঘুমা, কালকেই আবার অফিসে যেতে হবে।"
রোজ সকালে পরিপাটি হয়ে যেতে হয় কাজে। জিন্‌স আর টি-শার্টের জায়গায় ঘন ঘন পড়তে হয় শার্ট-প্যান্ট-জুতো। দাড়ি কাটতে হয় দু'তিনদিন যেতে না যেতেই। বন্ধুদের উপহারের সুবাদে কয়েকটা বিদেশি পারফিউমও আমার ঘরে আশ্রয় পেলেন। মাঝে মাঝে তাদের মাথা খুলে শরীরে ছিটাই, ঝাঁকিয়ে নেই। ভুরভুরে সুবাসটুকু ভালোই লাগে। তারপরে ফেরার সময়ে রিকশা-সওয়ার হলে সারাদিনের পরে মুছে যাওয়া সৌরভের জায়গায় জেঁকে বসে ঘাম-ধুলো-ক্লান্তি। রিকশাওয়ালা প্যাডেল টানে, আমি মুছে যাওয়া আলোতে, গাঢ় আধারে নানারকম হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। বেশিরভাগই মিলে না। আর মিলে না বলেই অসমাপ্ত হিসাবটুকু পরের দিন চলতে থাকে। রিকশাওয়ালা কিছু টের পান না, জানা কথা। তার হিসাব আরো অনেক সরল এবং কঠিন, জবাবশূন্য এবং জ্ঞাত।
***
জীবনের নিয়মই বোধহয় এমন যে আমরা যা হারিয়ে ফেলি তার শোক ঠিকভাবে বুঝে ওঠার সুযোগ সে আমাদের দেয় না। বেশি কিছু না, নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি এটুকুই আমরা ঠিকমত মনে রাখতে পারি না। প্রাপ্তিও প্রচুর থাকে হয়তো, অন্তত আপাত-প্রাপ্তির মতো ব্যাপারগুলো উপশমের কাজ করে খুব। তাই হারিয়ে যাওয়া মানুষ, স্মৃতি বা হৃদয়-সম্পদের জন্যে শোকটাও স্তিমিত হয়ে আসে। আর সেটা আসে বলেই নতুনভাবেই আমরা আঘাত সহ্য করতে পারি!

স্মৃতির স্বভাবও গন্ধের মতো হয়ে গেছে, দ্রুত ভুলে যাই সবকিছু। আজকে আমার সব অলসতার গায়ে আগুন ধরাতে সকাল সকাল মা চিৎকার শুরু করলো। "ভাদাইম্যা পুলা। কাজকাম নাই। পড়ে পড়ে ঘুমায়। ওঠ্‌! ঘর গুছা। দুইদিন পরে ঈদ, ঘরের কী অবস্থা! টেবিল চেয়ারে ধুলা। এই ঘরে কি মানুষ বাস করে?" গলাবাজির তোড়ে ধুপধাপ উঠে বসি। তারপরে চোখ কচলে মুখ-হাত ধুয়ে চারদিকে তাকিয়ে মনে হয় আসলেই অনেক ধুলো জমে গেছে! একটা ন্যাকড়া নিয়ে ধুলো ঝাড়া শুরু করি। বইগুলো এলোমেলো, গুছালাম। রাজ্যের সিডি, ডিভিডি পড়ে আছে খোলা, একটা একটা করে প্যাকেটে পুরে আলমারিতে ভরলাম। বিছানা-বালিশের চাদর, ওয়াড় গেলো ধোবার জায়গায়, তারপর ঘর ঝাঁট আর মোছা। একেবারে শেষে, টেবিলের ওপরে খাতা, কাগজ, হেডফোন, চার্জার -ইত্যাদি নানাপদের জিনিস গুছাতে শুরু করলাম। খুব পরিপাটি করে এনেছি, এমন সময়ে ড্রয়ার গুছাতে গিয়ে হাতে পাথরদুটো ঠেকলো।
এক মুহূর্তের থমকে যাওয়া। নিঃশ্বাস নেই। হাত টেনে বের করে আনি জোড়াভাইকে। হাতের মুঠোয় বিবর্ণ ধুলোমাখা, ধূসর পাথর! নাকের কাছে নিয়ে খুব ধীরে শ্বাস টেনে নিই। অপরিচিত গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। বহুদিন পরে কারো সাথে দেখা হলে যেমন মনে হয়, "কোথায় যেন দেখেছি", সামনাসামনি দাঁড়িয়ে যেভাবে আমরা অপ্রস্তুত হই কিছুটা, সেরকম একটা অনুভূতি হতে থাকে আমার। পাথর নিশ্চুপ, আমিও। নির্বাক যোগাযোগেও কোন আলোড়ন ওঠে না মনে। এরপর আমার ঠিক কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারি না। দ্বিধায় দোল খেতে খেতে পাথর দুটোকে আবার ড্রয়ার-গহীনেই রেখে দেই।
ড্রয়ার বন্ধ করে দেয়ার পরে বুঝতে পারি আমি নিজের কাছেই অপরিচিত হয়ে গেছি। হাতের তালুতে করে নাড়াচাড়া করা সেই দুটো অমূল্য পাথর আসলে আমি হারিয়েই ফেলেছি! এখানে যা আছে, তা কেবল স্মৃতিভার, কেবল ক্ষয়াটে আলোর মত ভ্রম।

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

ভূমিকম্পের পেছনের গল্প

আজকাল পৃথিবী দুলছে।
প্রবল, স্থিতধী যে পৃথিবীকে খুব বন্‌বন্‌ করে ঘোরার পরেও
স্থির লাগে আমাদের, সেই অচল শরীর দুলে উঠছে।
আমরা ছোটবেলায় নানা ছেলেভুলানো বিজ্ঞান পড়ে জেনেছি
এই শরীরে কত বিলিওন বছরের তাপ-জরা-শোক
নিক্তিতে মেপে পৃথিবী চুপচাপ নির্বিকার, আছে বেশ!
এমনকি ঘুরছে প্রবল, মুহূর্তে পেরিয়ে যাচ্ছে অসামান্য দূরত্ব।
আমাদের মাঝেও হয়তো একারণেই দূরত্ব বাড়ে, নাকি!

হয়তো, হবে-ই বা কোনো অজ্ঞাত কারণে জুঁই ফুলের গন্ধের সাথে মিশে আমাদের দূরত্ব অমর হয়ে যায়। হায় অমরতা, কী আকুল করছো আমাকে, কী প্রগলভ করছে দেখো তোমাকে! তবু এমন সাদামাটা পথেও আমাদের পায়ের নিচে সব চলিত মন্থর গতি থেমেই আছে-- বহুদিন। কতদিন!
সে কারণে আমাদের মনেই পড়ে না যাপনের ক্লেশ। ঘূর্ণনের কথা বলতে গিয়ে পুরাকালীন বৈজ্ঞানিক কী আশ্চর্য তত্ত্ব দিয়েছিলেন–– 'আমরা ঘুরে ঘুরে কেন্দ্রেই ফিরে আসি, যাবতীয় শক্তিক্ষয়ের শেষে'। অন্যেরা বানচাল করে দিলো ওটা, কী জানি কী যুক্তিতে। আমি যুক্তিবোধে হোঁচট খাই বিধায় মাঝে মাঝে বেভুলে বিশ্বাস করিঃ তিনি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন।
আশায় আমাদের চোখের তারায় ফুলফুল সৌরভ জমা হয়, আমরা তবে কাছাকাছি আসছি!
তখনই পৃথিবী দুলে ওঠে, পায়ের তলে।
ঘূর্ণনের ফাঁকে সে ক্লাশের পড়া ভুলে যায়।নিয়ম মুছে যায় পুরাণের চেয়েও পুরাতন স্মৃতি থেকে।
পৃথিবীর মনেও থাকে না এমন বেখাপ্পা নৃত্যে পুড়ে ছাই হতে পারে কয়েকটি মহাদেশ।
আমাদের, অর্থাৎ তোমার আর আমার
দুটো নেহায়েত অযাচক প্রাণের হিসেব করছি না।
কেবল জরুরি হিসেবে, নতুন শিশুগুলোর অমল হাসিও ফুরিয়ে যাবে এসব বেহিসেবি কাঁপনে,
কোলের ভেতরে ভয়ে শুকিয়ে যেতে পারে ঘাসের তৈরি সবুজ শিশুটিও!

তখনই আমি বুঝে যাই এই দোলনে পৃথিবীর কী বিষম স্বার্থ। কম্পাঙ্কের হিসেবে আমাদের কোনই লাভ হবে না, তবু জানা যাবে মোটিভ। ফাঁস হবে তার দুরভিসন্ধি। চাই কি, আমি অথবা তুমি আমাদের অন্তর্গত ক্রূর রাজনীতির চেয়েও গভীর কোনো ষড়যন্ত্রও ফাঁস করে ফেলতেই পারি!...

মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

মডুলেশন ৮৮


মডুলেট মডুলেট! মডুলেট মানে কী? গুণন?
যোগ। বিয়োগ। নাকি উপরিপাতন, অথবা পতন!


এহেন টানাপোড়েন মোটেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। না! কেননা জন্মেই জানা গেছে
মানবজনম বড়ো বিসদৃশ প্রহার। নিরন্তর দুঃখবোধের সীমিত সাধ্যে
কেঁপে যাওয়া। সকল কম্পনেই কোনো না কোনো বৈষয়িক দিনাতিপাত মিশে থাকে।
আমি এবং তুমি ঝুম বৃষ্টিতে পুড়ে যাই
আমি এবং তুমি গতকাল মরেছি রোদের স্রোতে
এমন জীবন, এমন মরণ বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের
আর তোমাদেরও তো অনেক শোক, তাই না?


তোমরাও জেনেছো প্রতিদিন কেন সবাই হাসিমুখে নীরব হয়ে কথা বলে। পাশাপাশি বসে থাকে। গা ঘেঁষে তাপ নেয়। তাপ দেয় অবলীলায়। তাপমাত্রার পারদ একেবারে স্থির থাকে। সকল জলের বাষ্প জমে থাকার ঘটনাও তোমাদের জানা আছে। বিষুবের কাছে হলে, এ'দেশে অনেক রোদ জন্মাতো, রবিশস্যের প্রচুর ফলনে ভরে যেত হাসিমুখ হাসিচোখ।
কিন্তু আমরা কর্কটের পথের পাশেই থাকি, দূরে বিষুবতীরে কালো মানুষেরা কলস্বরে মেতে উঠলে আমরা বিস্মৃত হই ঘাম। ভুলে যাই ধুলো-আর্দ্রতা।


এখানে সকলে গা ঘেঁষে বসে বসেই সবাইকে ভুলে যায়। আর ভুলে যায় বলেই হাসে, উদ্দাম, বিস্রস্ত হাস্য-কলরেখা চকচকে ঝিলিকের মতো আমার চেহারায় প্রসাধন হয়ে থাকে।


'থাকে' বললে নিজস্ব নিরুপায় নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ হয়। বোঝা যায়, এই দুঃসহ কাজ আমার কৃতকর্ম নয়। নেহাত দৈবাৎ। ঘটে গেছে ঘটমান দূর্ঘটনার মতোন। অপরের ভুলে যাওয়া নিয়ে আমার নিদারুণ অবহেলা ও হাসি-উপহাস কেবলই সয়ংক্রিয় নিষ্ঠুরতা। তবে আমি জানি ভাষার মারপ্যাঁচ। কূটনৈতিক শব্দের ছল, কূটিল চরিত্রের শব্দ দিয়ে খুব সহজেই তোমাদের ধর্ষণ করে ফেলা যায়!


কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে আমাদের পারঙ্গমতা প্রকাশ্য। তাই কারিকুলামের বাইরে আমরা অ্যাকটিভ ভীষণ। দেখুন না, কী সুন্দর ভুলে যাই মনে রাখার সিলেবাসসমূহ! পদ্মপাতার কাঁপন লিখে রাখি খালি বইয়ে, সাদা খাতায়। তারপরে দলছুট বিজ্ঞাপনের মতোই বিবিক্ত উল্লাসে আমরা একে অপরের মাঝে সেঁধিয়ে শুয়ে পড়ি। সেঁধিয়ে গেলে খুব আরাম লাগে–– ওঃ!


কোথা থেকে কোথায় গড়িয়ে সরে যায় জলরেখা। নদীপথ। সেরকম আমার ভাষ্যও বিষম দূর্বোধ্য হয়ে পড়ে। ভাষায় অপ্রতুল, প্রকাশে অক্ষম। সেজন্যে শুরুর মডুলেশন খাই খাই করে ওঠে। ঘুণের জোরে কাটতেই থাকে ভেতরে ভেতরে, আমি টের পাই না। কারে কয় মডুলেশন? গুণ করি, যোগ করি। হাতের কড়ের মাঝে গুনতেই থাকে সাংখ্যিক বিয়োজন। হারিয়ে ফেললাম যেসব। খোয়া গেছে যেগুলো। নিশ্চিহ্নির খবর এসেছে যাদের। হারিয়ে যাবার আগে যারা চিৎকার করেছিলো। সেসব হিসেব আমার মডুলেট করতে হয় নিজের ভেতর, ঐ নিজেদের ভেতরে সেঁধিয়ে যাবার মতোই। ব্যথা লাগে–– কিন্তু কী আর করা!


কেউ কি জানে মডুলেট কেমন হয়? কি হয় এভাবে বদলে গেলে? কর্কটের পাশের ফুটপাতে কোন কোন বাষ্পকণায় আমার এবং তোমার কথা লেখা থাকে?

সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

খুচরাটে কতিপয়...

সাধ
সাধের গায়ে নষ্টামির দাগ লেগে গেছে
নষ্টামিকেও ভালো লাগে, বেশ!
আঃ জেগে জেগে ভালো লাগে পঞ্চান্ন রাত
ওঃ তোমাদের দেখলেও ভালো লাগে
কী মনোহর রূপ-কুন্তল সাজিয়েছো মধু! মধু!
==
১ সেপ্টেম্বর
***


মোজাইক বিন্যাস
মোজাইক মেঝেতে বিসদৃশ- দাগের ভেতর
খুব ভেতরে
একটা খয়েরি প্রজাপতি
ভীষণ স্তব্ধ বসে
ছিল
ঘর গেরস্তি ছেড়ে শশব্যস্ত,
জমাট মোজাইকে বিবিধ মার্বেল
অথবা কাচ।
কঠিনে পাখার ঝাপ
নিঃশব্দে ফড়িঙের মত জীবন্ত
দর্শক সারিতে হাততালি
ঘন
হয়ে ওঠে সশব্দে
এভাবেই


অজস্র দুর্দান্ত খয়েরি প্রজাপতি রঙহীনতার ফুটো ফুটো আকাশে পাখা মেলে উড়ে যায়...
বিস্মিত হাততালির লেজে শুয়ে থাকে আমাদের নিঃশ্বাস।
===
৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
***


নিভৃত-খোঁজ
কোনো নিভৃতে যাই চলো
চলাচলের অযথা বাহানা যেখানে
বিষম অনুপস্থিত


এই কোলাহল-হলাহল মেশানো বারুদ-ঘ্রাণ
জমা থাক বুকের ভেতর, চলো
আমরা নিভৃতে জমাই ঝিনুক কতক


নিভৃতে সময় থাকে সচল কাঁটার চেয়ে গতিশীল
সচকিত শৈবালেরও এমন কোমল শরীর ভালো লাগে
কাঁটা খুলে চলো বৈদেশিক নিভৃত খুঁজি!
===
৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
***