শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০১০

ব্যাঙগল্প

নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এটা আমাদের কবিতাযাপনের কাল।

মানে যে সময়ে আমরা কবিতা লিখতে চাই, অথবা কবিতা পড়তে চাই। কবিতা না হোক - নিদেনপক্ষে কিছু লিখতে পড়তে চাই, সেই সময়টাই কেমন যেন ঘোরালো ঘোলাটে। যেন পানিবন্দী ব্যাঙ লাফাচ্ছে সদ্য বৃষ্টিতে জমে ওঠা ক্ষুদে-ডোবায়।

ঘোলাটে থেকে ভোলাটে হচ্ছে কাদামাখা ব্যাঙের পারিপার্শ্ব।

আমরা তেমনই ব্যাঙ, আমরা তেমনই কীটস্য কীট।

ধরে নিতে পারি এই রকম ব্যাঙের জন্যে কোন রাজকন্যার চুম্বন নেই, নেই অলীক-বিবর্তনে রাজপুত্র হয়ে ওঠা। আমরা সেই প্রতারিত যুগের মানুষ। আমাদের মেটামরফোসিসও হবে না! আমাদের অনেক কিছুই কথা দিয়েছিলেন অনেকে, তাই আশার ফুলকো ফুলিয়ে ব্যাঙের মতো বসে আছি আমি সেই সব মণ্ডুকের দলে। আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন যখন আমি বলবো যে কিছুই এখন নিত্য নেই।


ঐ যে বলছি কবিতাযাপনের কাল, সেখানে অকালের মতো জমাট বাঁধছে শ্রুতিহীনতা (আমরা কিছু শুনেও না শোনাকে এটা বলি)। এবং ইন্দ্রিয়ের আবেশে দৃষ্টিহীন দেখছি দালানের হেলে পড়া ডোবার ভেতরে। ছাইসুলভ দালান ডোবার কাদার সাথে মিশে গড়ে তুলছে কলয়েড নগর।

বাকস্বাধীনতার দরকার মানুষের নেই, সেটা অনুপার্জিতই থাকবে। বরং তার আছে চিন্তাস্বাধীনতা, এবং তার মুক্তি কেবল সেই পথে। - এই গূঢ় সত্যটা ধীরে ধীরে আমার কাছে স্বতঃসিদ্ধ মনে হচ্ছে, তাই এর প্রমাণ দিতে পারবো না। বলে হেসে ফেললাম নিরুপায় অমায়িক আমি, দার্শনিকদের খড়বিচালি চাবাই মাঝে মাঝে, জাবর কাটার মতো।

স্যরি, আমি ব্যাঙ হতে পারবো না। কারণ দেখুন, ধীরে ধীরে আমি গরু হয়ে উঠছি। জাবর কাটছি চর্বিত কবিতা, গলিত দর্শন, নাগরিকের লক্ষ্য ও সাফল্যের সূত্রটি ধীরে ধীরে আমর খড়ের সাথে চিটাগুড়ের মতো মিশিয়ে দিচ্ছে প্রভু-সামন্ত। আমার চোখ আরামে বুঁজে আসছে, ছায়াশীতল ঘুম এসে চারপেয়ে হাঁটুগুলো নরোম করে দিচ্ছে। আঃ! সুপ্ত-মনন।

রবিবার, ২০ জুন, ২০১০

বাবাদের ছবি - ছেলেমেয়েদের জন্যে! (অথবা বাবাদিবসের বাখানি)

আজকে বাবা দিবস। আমাদের সংস্কৃতিতে এই দিবসটা একেবারেই নতুন, আর নতুনের প্রতি সবারই একটা সন্দেহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সেই কারণে ভাবতে গেলে মাঝে মাঝেই নেতিবাচক মনোভাবেরও দেখা পাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা মাত্র দিনে ঘটা করে বাবাকে স্মরণ করার পক্ষে নই। আমার মতে মা-বাবা যে কোন মানুষের একান্ত আপনজন, সবচেয়ে নিঃস্বার্থ তো বটেই। তাঁদের জন্যে একটা মাত্র দিনে আলাদা করে উদযাপনের কোন মানে হয় না। তাঁরা চিরন্তন, আমার পার্থিব জীবনের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁদের। আমার সুখ, নিরাপত্তা আর মানবিক গুণাবলীর পেছনেও তাঁদের হাত সবচেয়ে বেশি।

হয় কি, সারাদিন পাশাপাশি থাকলে অতি আপনজনদেরও অনেক সময়ে বলা হয় না তাঁরা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরকে আমরা কতোটা ভালোবাসি। সেই কথাগুলো হুট করে বলতেও একটু লজ্জা লজ্জা লাগে। মায়ের আর বাবার জন্মদিনে বাসায় ঘটা করে কেক কাটি, বাচ্চাদের মতো আনন্দ করে তাঁদেরকে একটু হলেও খুশি রাখার চেষ্টা করি। এর পাশাপাশি বাবা দিবস, মা দিবসে আরেকটা সুযোগ/উপলক্ষ্যও পাওয়া গেলো বলারঃ "বাবা, তোমার জন্যেই সব ভালোবাসা। তোমার কাছেই শিখেছি জীবনের কতো পাঠ, প্রথম নামতা, প্রথম সাইকেল চালানো।" প্রথম যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হলো, তুমিই বলেছিলে, "এখন তুমি বড়ো হয়ে গেছো, জীবনের সব সিদ্ধান্ত এখন থেকে তোমাকেই নিতে হবে। খালি মনে রাখবে তোমার কাজেকর্মে যেন অপরের ক্ষতি না হয়, তাহলেই তুমি 'মানুষ' হতে পারবে!"


ইদানিংখুব মুভি দেখছি। পুরনো দেখা মুভিগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছিলাম বাবা-ছেলে অথবা বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে ভালো ছবিগুলো কি কি। আমার দেখা সেইসব মুভির একটা সংগ্রহ নিয়েই লিখবো ভাবলাম!



এই মুভিটা নির্বাক যুগের, এবং চার্লি চ্যাপলিনের পরিচালক হিসেবে অন্যতম মাস্টারপিস। অভিনেতাও মূলত দুজনে- চার্লি হলো সেই পুরনো ভবঘুরে, যার কোন চালচুলা নাই, ঘরবাড়ি নাই, টুটাফাটা পোশাক, বোওলার হ্যাট পরে আর ছড়ি হাতে সে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই তার দেখা হয়ে যায় এক অনাথ শিশুর সাথে। শিশুটি পরিত্যক্ত, বিনাবাপের ছেলেকে মা জন্মানোর পরেই ফেলে রেখে গেছে। চার্লি সেই ছেলেটিকে তুলে নেয়, তারপরে তাকে পালতে থাকে। নিজের খাওয়ার কোন খবর নাই, কিন্তু সেই নাম-পরিচয়হীন শিশুটির জন্যে সে কত কীই না করলো!
উদ্ভট ভবঘুরের মনুষ্যত্ব দেখে চোখের পানি আটকে রাখাও মুশকিল, আবার দেখা যায় তার কমিক চেহারার নানারকম মুখভঙ্গি আমাদের মুখেও এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলছে! এই ছবিটা সম্ভবত চার্লি চ্যাপলিনের আইকনিক প্যাথো-কমেডির (যে ছবির মূল সূর বিষাদাত্মক, অথচ সমাপ্তি মিলনাত্মক) একটা উজ্জ্বল নিদর্শন। দেখার পরে একই সাথে মন খারাপ হয়, আবার মন ভালোও হয়।


এই ছবিটাও অসামান্য খালি বাবা এবং ছেলের অভিনয়ের গুণে! উইল স্মিথকে আমার সবসময়েই বাণিজ্যিক ছবির হালকা চালের অভিনেতা মনে হতো, কিন্তু এই ছবি এবং সেভেন পাউন্ডস দেখার পরে আমি সেই ধারণা বদলে ফেলেছি। গুণী পরিচালক (গ্যাব্রিয়েল মুচ্চিনো) আর দুর্দান্ত চিত্রনাট্য পেলে ছবি ভালো হবেই। সেই সাথে জুড়ে গেছে বাস্তবের পিতাপুত্রের অভিনয় (উইল স্মিথ আর তার ছেলে জ্যাডেন স্মিথ)। আর এই ছবিটা একটা সত্য ঘটনার উপরে ভিত্তি করে বানানো বলে দেখার সময়েই মনে হতে থাকে কারো জীবনের কাহিনী দেখছি!
যাদের কাছে মনে হয় বিদেশের জীবন খুব সুখের আর আনন্দের, তাদেরকেও যে আমাদের মতো জীবনযুদ্ধ করতে হয়, একটা একটা করে পয়সা জোগাড় করতে হয় সেটা এই ছবিটা দেখলে বুঝা যায়!

ডেনিস ডুগানের এই ছবিটাও অনেকটা দ্য কিডের ঘরানার। পার্থক্য হলো এই মুভিটায় অভিনয় করেছেন এডাম স্যান্ডলার। আর তার মধ্যে ট্রাজেডির লেশমাত্র নাই। পুরো ছবিতে তার ছোট ছোট জোক আর পান শুনতে শুনতে হাসি আটকানো মুশকিল। তার চরিত্র (সানি) থাকে কেয়ারফ্রি ধরনের এক যুবক। ঘটনাক্রমে বন্ধুর বিনাবিয়ের ছেলে এসে তার ঘাড়ে পড়ে। সেই বন্ধু আবার তখন আরেক মেয়ের সাথে বাগদান করে ফেলেছে। সামনে বিয়ে। এরকম নাজুক অবস্থায় ছেলের পরিচয় জানলে সমূহ(!) বিপদ, তাই সানির ঘাড়েই পড়ে কিছুদিন সেই বাচ্চা ছেলেকে দেখাভালের ভার। যে মানুষ নিজেরই ঠিকমতো টেক কেয়ার করতে পারে না, সে কী ধরনের মুশকিলে পড়ে, সেটা এই ছবি দেখলে ভালো মতো বুঝা যায়। আর যারা বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর বলে মনে করেন, তাদের জন্যেও শিক্ষামূলক ( ;) ) ছবি এইটা! হা হা হা!
Father of the bride (1950) , (1991)
বাবা হিসেবে সবচেয়ে কঠিন কাজের মধ্যে একটা মনে হয় নিজের মেয়ের বিয়ে। এমনিতেই দেখা যায় মেয়েরা বাবার বেশি কাছের হয়। সব মেয়েরই কমবেশি কিশোরী বয়সের আইডল হলো তার বাবা। সেই বাবার সাথেই তার বেশি খাতির থাকে। তারপরে একদিন সেই বাবা টের পান যে তার মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে! সে এখন একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে। তার সাথে বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করতে চায়। সেই সময়ের অনুভূতি সব বাবার জন্যেই মনে হয় একরকম। হঠাৎ করে টের পান মেয়ের চোখে তিনি এখন সেকেন্ড হিরো, নতুন হিরো (নাকি ভিলেইন?) হয়ে দেখা দিয়েছে অজানা এক উড়ে এসে মেয়ের হৃদয়ে জুড়ে বসা কেউ! এই অবস্থায় বাবা'রা কী করেন?
ছবিটা দেখার সময়ে অনেক হাসিঠাট্টার মাঝেও মনে হয়েছে বাবার অনুভূতিগুলো একেবারেই আলাদা! সে না পারে সইতে, না পারে প্রকাশ করতে। ছবিটার দুইটা ভার্সন আছে। একটা '৫০ সালের (স্পেন্সার ট্রেসি-এলিজাবেথ টেইলর পিতা-কন্যার অভিনয়ে), আরেকটা '৯১ সালের (স্টিভ মার্টিন-কিম্বারলি উইলিয়ামস পিতা-কন্যার অভিনয়ে)। দুইটাই সমানভাবে উপভোগ্য, তবে আমার নিজের কাছে পুরনোটা বেশি ভালো লেগেছে। হয়তো দুইজনই দুর্দান্ত অভিনেতা বলে!


                                                                Mrs. Doubtfire (1993) 

ক্রিস কলম্বাসের অসাধারণ সব ছবির মাঝে এই ছবিটা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য, অনেকগুলো কারণে। রবিন উইলিয়ামস কতোটা শক্তিশালী অভিনেতা সেটা কারণ নম্বর এক। দুই নং কারণ হলো রবিন উইলিয়ামস কতোটা বড়োমাপের অভিনেত্রী সেটা। তিন নং কারণ হলো রবিন উইলিয়ামস একইসাথে পুরুষ ও নারীচরিত্রে কতোটা পারদর্শী সেটার অনবদ্য উদাহরণ এই ছবিটা! সব মিলিয়ে দমফাটা হাসির, একই সাথে ছেলেমেয়ের জন্যে তার অনাবিল ভালোবাসার। বিদেশী সমাজের মতো এখন আমাদের সমাজেও বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এই ছাড়াছাড়িতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা। সেই সন্তানদের জন্যে বাবা'র থেকে দূরত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, কারণ দেখা যায় বেশিরভাগ সময়েই কাস্টডি মায়ের তরফে যায়। বাবার সাথে দেখা হয় কেবল উইক-এন্ডের দুই দিন। এই ধরনের ব্যবস্থা মানতে নারাজ ড্যানিয়েল, তাই সে কেয়ার টেকারের বেশ ধরে হাজির হয় নিজেরই বাড়িতে, ছেলেমেয়ের কাছে। দুই ধরনের জীবন হ্যান্ডেল করার ঝক্কি আর ঝঞ্ঝাট নিয়েই এই ছবিটা। এটার একটা মজার রিমেক হয়েছিলো হিন্দিতে (চাচী ৪২০)। সেটাও কমল হাসান আর টাবুর অভিনয় মিলিয়ে দেখতে খারাপ লাগে নি!


এবারে একটু সিরিয়াস ছবি। পিতৃত্বের সাথে কেবল হাসিঠাট্টা বা আত্মত্যাগই জড়িত নয়, একই সাথে দায়িত্ববোধ আর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের সংবেদনশীলতারও গুরুত্ব অনেক। পিতা হিসেবে, আইকন হয়ে ওঠা, বা আইডল হয়ে ওঠার জন্যে যে পরিমাণ দৃঢ়তা দরকার, যে ধরনের একাগ্রতা দরকার, সেটা সবার মাঝে থাকে না। সেটা ধীরে ধীরে চর্চা করে গড়ে তুলতে হয়।

'টু কিল এ মকিংবার্ড' সেই ধরনের গল্প নিয়েই তৈরি। একই নামের উপন্যাস থেকে ছবিটা বানানো হয়েছে, হারপার লি'এর উপন্যাসটি পুলিৎজার পুরষ্কারপ্রাপ্ত। সেটা থেকে ছবি বানানো হয়েছে '৬২ সালে। মূল চরিত্রটি বাবার, অভিনয় করেছেন গ্রেগরি পেক। ছবিটায় তিনি দুই সন্তানের পিতা, মা মারা যাওয়ার পরে যাদেরকে একাই কোলেপিঠে করে মানুষ করছেন। পেশায় আইনজীবি। শান্ত গ্রামের মতো শহরে হঠাৎ একদিন এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা নিহত হলেন, সেই খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলো এক কালো। সময়টা '৩০-এর দশক, আমেরিকায় তখনও কালোদের নিগ্রো বলা হতো। ছবিটার পরতে পরতে বর্ণবাদ, সামাজিক অনৈতিকতাগুলো উঠে এসেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো এর সবকিছুই দেখা হয়েছে একটা কিশোরের চোখ দিয়ে। তার চোখে কী করে তার বাবা নায়ক হয়ে উঠলেন। সাধারণ মানুষ (এবং সাদা) হয়েও একজন কালোর হয়ে আইনি লড়াইয়ে নামলেন সেটার গল্প এই ছবিটা। নিঃসন্দেহে টিন-এজার ছেলেপুলে নিয়ে একসাথে বসে দেখা যায়!


এই অ্যানিমেশন মুভিটা দেখে প্রথম যা মনে হয়েছে, সেটা হলো মাছেরাও মানুষ! তাদেরও আছে বেঁচে থাকার, থুড়ি, বাবা হওয়ার অধিকার। ফাইন্ডিং নিমো সম্ভবত সবাই দেখে ফেলেছেন। তারপরেও যারা দেখেন নি, তারা বিরাট অপরাধী, দ্রুত দেখে ফেলেন সুযোগ পাওয়া মাত্রই। যাদের ৫ থেকে ১০ বছর বয়েসি বাবু আছে, তারা আরো দ্রুত দেখেন। বাচ্চার সাথে সাথে নিজেরও পিতৃত্বের পাঠ হয়ে যাবে!

ক্লাউন ফিশটার নাম মারলিন। তার ছেলের নাম নিমো। ছেলের ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন থাকেন তিনি, বাস করেন অস্ট্রেলিয়ার রীফের ভেতর। ছেলেকে ভর্তি করেছেন স্কুলে, প্রথম দিন তাকে স্কুলে পাঠানোর সময় সদাচিন্তিত মারলিনকে সবারই ভালো লাগবে। কেউ কেউ নিজের ছায়াও(!) খুঁজে পেতে পারেন। তারপরে এক দুঃসহ দূর্ঘটনায় নিমো হারিয়ে গেলো। সেই খোঁজে বের হলো ছোট্ট মারলিন, আর সেই নিয়েই ছবির গল্প!


সবশেষে ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার। এই ছবিটা একসাথে পাঁচটা অস্কার পেয়েছে। ছবির মূল চরিত্র বাবা এবং মায়ের রোলে আছেন ডাস্টিন হফম্যান এবং মেরিল স্ট্রিপ। এখানেই সম্ভবত ছবিটা কেন দেখতে হবে সেটা বলা হয়ে গেলো। তারপরেও যদি কারো দোনমনা থাকে, তাহলে ছোট বাচ্চাটার অভিনয় দেখার জন্যে দেখতে পারেন। আমার ধারণা, বাবা মায়ের চাইতে সে অনেক বেশি ভালো অভিনয় করেছে।

এই ছবির গল্পটাও বিবাহ বিচ্ছেদের সাথে জড়িত। বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ির পরে ছেলেটা থাকা শুরু করে বাবার সাথে। গেরস্থালির কাজে অনভিজ্ঞ বাবার চাকরি জীবনেও ভয়ানক কাজের চাপে থাকেন। ঘর আর বাহির দুইদিক সামলাতে গিয়ে তার হিমশিম খেতে হয়। সেখানে ছেলের দিকেও মনোযোগ দেয়া লাগে।
এরই মাঝে একসময় মা ফিরে আসেন। কিন্তু তাদের মাঝে মিল ঘটাতে নয়, বরং ছেলেকে নিয়ে যেতে। স্বভাবতই বাবার দাবি, এতোদিন ছেলেকে মানুষ করেছেন তিনি, সুতরাং তিনিই ছেলেকে এখন লালন করবেন। আবার মায়ের দাবিও ঠিক, ছেলে এখনও নাবালক, এবং মায়ের কাছেই সে ভালো থাকবে। এই টানাপোড়েন গড়াতে গড়াতে কোর্টতক গেলো।
অদ্ভুত রকমের মানবীয় ছবিটা। বাবা-ছেলের সম্পর্ক, মায়ের প্রতি ছেলের টান, বাবার আবেগ, মায়ের ভালোবাসা সব মিলিয়ে ঝালমুড়ি।

===

বুধবার, ৯ জুন, ২০১০

দ্য ডিভাইন পনিটেইল



...dedicated to him that, despite the enemies and the bad luck, was, is and will be always the talent person that the italian football has ever expressed.
-Antonio Cavallaro
ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডিনায় রোজ বো’ওল স্টেডিয়ামের কথা। সময়টা চুরানব্বুইয়ের সতেরই জুলাই, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের রোদ তেরছা হয়ে পড়ছে মাঠের ভেতর। সাড়ে বারোটায় খেলা শুরু হয়েছে, নব্বুই মিনিটের পরে অতিরিক্ত তিরিশ মিনিটের খেলাও শেষ। বন্ধ্যা ম্যাচ, এখনতক কোন গোলের দেখা নেই, পুরো টুর্নামেন্টেই অবশ্য গোলখরা। ফাইনাল ম্যাচ হচ্ছে বিশ্বকাপের, এতোক্ষণ ধরে এই গোলহীন লড়াইয়ের শেষে দুইদলের সব খেলোয়াড়ই ক্লান্ত, বিমর্ষ কোচদের দু’জনের চেহারায় ফুটে উঠছে অনিশ্চয়তার রেখা। টাইব্রেকারের জন্যে অপেক্ষা করছে ৯৪ হাজার দর্শক, তাদের সামনে দিয়ে একে একে দুই দলের চারজন করে খেলোয়াড় প্যানাল্টি কিক করলো। স্কোর ৩-২। পাঁচ নম্বরে পিছিয়ে থাকা দলের যিনি কিক নিতে গেলেন, তার জন্যে হিসাব ছিলো গোল না করতে পারলে হার, আর গোল দিতে পারলেও অপর দল মিস না করলে বিশ্বকাপের আশা শেষ। দর্শকদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখা মুহূর্ত পেরিয়ে গেলো, দেখা গেলো সেই পঞ্চম খেলোয়াড়ের সাবলীল মাপা দৌড়, কিক নেয়ার সাথে সাথে বলটা উড়ে গেলো গোলবারের ওপর দিয়ে গ্যালারির দিকে। বিপক্ষদলের সমর্থকদের উল্লাসে রোজ বো’ওল স্টেডিয়াম ফেটে পড়লো। আর সেই আকাশ ফাটা চিৎকারের নিচে দেখা গেলো নির্বাক হয়ে উড়ে যাওয়া বলটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি- রবার্তো ব্যাজ্জিও।
আদর করে তাকে ডাকা হতো Il divin codino (দ্যা ডিভাইন পনিটেইল)। কোঁকড়ানো ছোট ছোট চুলের পেছনে একটা ঝলমলে পনিটেইল। বাইশ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রায় বেশিরভাগ সময়েই এটা ছিলো তার আইকন।
প্যানাল্টি কিকের সাথে এ’রকম অম্ল-মধুর স্মৃতি ব্যাজ্জিওর পুরো ফুটবল ক্যারিয়ারে অনেকগুলো। যেমন ফাইনালের ঘটনার চার বছর আগে, ফ্লোরেন্সের মাঠে টাইব্রেকারের সময় জুভেন্টাসের জার্সি পরা ব্যাজ্জিও কিক নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বিপক্ষ দলটা ছিলো ফিওরেন্তিনা, যে দলের হয়ে ’৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত খেলেছেন। মাত্রই সেই মৌসুমের শুরুতে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি দিয়ে জুভেন্টাস তাকে কিনে নিয়েছে, কিন্তু এখনও তিনি ফিওরেন্তিনাকে ভুলতে পারেন না। এই ক্লাবই তাকে এতোটা পরিচিতি দিয়েছে, এতোদিনের সেই সম্পর্ক ভুলে তিনি প্যানাল্টি কিক নিতে যান নি। বরং সাইড লাইনের পাশে পড়ে থাকা ফিওরেন্তিনার একটা বেগুনি স্কার্ফ তুলে নিয়ে চুমু খেলেন। পরে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “Deep in my heart I am always purple.” ফ্লোরেন্সের রঙ বেগুনি।
সারাজীবন ক্লাব থেকে ক্লাবে ব্যাজ্জিওকে খেলতে হয়েছে। ভিঞ্চেঞ্জা (’৮২ – ’৮৫), ফিওরেন্তিনা (’৮৫ – ’৯০), জুভেন্টাস (’৯০ –’৯৫), মিলান (’৯৫ – ’৯৭), বোলোনা (’৯৭ – ’৯৮), ইন্টার (’৯৮ – ’০০), ব্রেসিয়া (’০০ – ’০৪)। প্রায় বাইশ বছরে এতোগুলো ক্লাবের হয়ে খেলেছেন, মাঝে দুইবার তার দলবদলের ট্রান্সফার ফি সেই সময়ের সর্বোচ্চ ছিলো। এগুলো হঠাৎ শুনলেই মনে হবে হয়তো তিনি খুবই হিসেবি আর পেশাদার খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে ব্যাজ্জিও বরাবরই আবেগি, বলা চলে emotional fool, এজন্যেই হয়তো আটানব্বুইয়ের বিশ্বকাপে মাঠে নামলেন সেই বিখ্যাত পনি টেইল ছাড়া।
ছোট ছোট চুল, পুরো ম্যাচেও কোচ তাকে খেলাতেন না, দেল পিয়েরোর বদলি হিসেবে নামেন শেষ দিকে। ‘বুড়ো’ হয়ে আসছেন ভেবে সবাই হয়তো একটু করুণা কি সহানুভূতি দেখায়- এমন অবস্থা। চিলির সাথে ম্যাচে যখন ইটালি ১-২ গোলে পিছিয়ে তখন বদলি হিসেবে নামলেন। আক্রমণে উঠে ডি-বক্সের কাছাকাছি জায়গায় বল কাটাতে গিয়ে তা চিলির ডিফেন্ডারের হাতে লেগে গেলো। প্যানাল্টি! আবার! চুরানব্বুইয়ের পরে এই প্রথম ব্যাজ্জিও’র সামনে আরেকটা প্যানাল্টি কিক নেয়ার সুযোগ। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে ঠিক সেই মুহূর্তে কী ভেবেছিলেন তিনি! টিভিতে দেখালোঃ হ্যান্ডবল হওয়ামাত্রই রেফারির বাঁশি শুনে একটু ঝুঁকে গেলেন ব্যাজ্জিও। নিজেকে আড়াল করলেন সবার থেকে, তার স্মৃতিতে চার বছর আগের কথাই ভেসে আসছিলো নিশ্চয়ই। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে প্যানাল্টি কিক নিতে এগিয়ে গেলেন। এবারে ভুল হলো না, তার গোলেই তখন চিলির সাথে ম্যাচে সমতা পেলো ইটালি।
ফুটবলের মাঠে হাজার হাজার সমর্থকদের চিৎকার, কোচের কথা, সতীর্থদের কথা, গেম প্ল্যান, স্ট্র্যাটেজি এই সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে ব্যাজ্জিওর এই মানবিক রূপটা অদ্ভুত ভালো লাগে। মনে হয় এই লোকটা ফুটবলার হয়ে বিপদে পড়ে গেছেন নিজের বেহিসেবী আবেগ নিয়ে।
এমন না যে ব্যাজ্জিওর ক্যারিয়ারে খালি হা-হুতাশ। পাশাপাশি রাখলে এক বিশ্বকাপ ছাড়া তার পুরো ক্যারিয়ারে তেমন একটা হার নেই। নব্বুইয়ের দশকে জুভেন্টাসের স্কুদেতো জয়ের পেছনে তিনিই ছিলেন মূল শক্তি। লীগের অনেকগুলো ট্রফি জিতেছিলো সেই সময়ে জুভেন্টাস। পঁচানব্বুইয়ে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন তিনি, একইসাথে ইউরোপিয়ান বর্ষসেরাও! বিশ্বকাপে ব্যাজ্জিও ইটালির একমাত্র খেলোয়াড় যিনি পরপর তিনটা বিশ্বকাপেই গোল করেছেন। আর চুরানব্বুইয়ের বিশ্বকাপের পুরোটাই তার অনবদ্য খেলার দৃষ্টান্ত।
অনবদ্য এই অর্থে যে তেমন একটা স্কিল দেখিয়ে খেলতেন না। এমনকি পুরো মাঠ দাপিয়েও বেড়াতেন না। যেটা করতেন সেটা হলো সুযোগের সদ্ব্যবহার। তক্কে তক্কে থাকতেন, আর যাকে বলে, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকতেন, দুর্দান্ত ফিনিশিং ছিলো। খুব বেশি যে কৌশলটা খাটাতেন তা হলো ডজিং। এমন অনেকগুলো গোল দেখেছি, যা কেবল গোলকিপারকে পুরোপুরি নাস্তানাবুদ করেই দিয়েছেন।
পরিসংখ্যান যদিও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, ওটা দিয়ে তেমন কিছু বুঝাও যায় না, তবু একটা মজার ফ্যাক্ট পেলাম। যে তিনটা বিশ্বকাপে ব্যাজ্জিও ইটালির হয়ে ১৬ টা ম্যাচ খেলেছেন (’৯০, ’৯৪, ’৯৮), তার প্রতিটাতেই ইটালির বিদায় হয়েছে টাইব্রেকারে। ’৯০-এ আর্জেন্টিনা, ’৯৪-এ ব্রাজিল আর ’৯৮-এ ফ্রান্স। তার মানে কোনবারেই ইটালি সরাসরি কোন ম্যাচ হেরে বাদ পড়ে নি {গ্রুপ ম্যাচগুলোর মাঝে কেবল একটা ম্যাচেই তারা হেরেছিলো (’৯৪) আয়ারল্যান্ডের সাথে}।
আসলেই ফুটবল একটা নিষ্ঠুর খেলা!

রবিবার, ৬ জুন, ২০১০

নটে গাছ না মুড়োলে...


খাতার পৃষ্ঠা খুলে আমি অনেককিছু লিখতে চাইতাম, কিন্তু পারতাম না। মাঝে মাঝে শব্দহীনতায় কামড় দিতো। আমি প্রায় ছয় বছর কিছুই লিখি নি, কারণ আমার ভেতরে কোন শব্দ জেগে উঠতো না। আমি শব্দহীন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কথা বলতাম, ভাবনাচিন্তাও করতাম, কিন্তু সেগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারতাম না। ওই ছয় বছরের সকল স্মৃতি মগজের ভেতরে আটকে আছে। হয়তো সেগুলো সেখানেই ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। আমি সেই ঘরগুলোতে আর ঢুকতে চাই না। এড়িয়ে যাই। কষে তালা দিয়ে আটকে রেখেছি। ওগুলো নিভৃত- অযতনে থাকুক!

আমার কখনো দলের ভেতরে থাকা হলো না। প্রথাগত হওয়া হলো না। আমি কখনো কারো সাথে আত্মীয়-যোগ করতে পারি নি। আমার চারপাশে হয়তো একটা অদৃশ্য দেয়াল ছিলো সবসময়েই। আমি হয়তো সেই দেয়ালের কারণেই সবার সাথে স্বচ্ছন্দ হতাম। "বি ইয়োরসেল্ফ" বলেছিলেন বড়ো বোন, তারপর থেকে আমি কেবল নিজের মতোই হতে চেয়েছি। এই চাওয়া পূরণ হয়েছে নানা পথে, নানা ভাবে, আমি বদলে বদলে গেছি সময়ের সাথে। এবং আমি কখনই কারো মতো হতে পারি নি। একটি দলের সকলের থেকে আলাদা হয়ে গেছি অচিরেই। দেখেছি তাদের সাথে আমার মিলের পরিমাণ কেবল পোশাকে, বা স্থানিকতায়। আমরা এক জায়গায় আছি, থাকছি বা বসবাস করছি বলেই কেবল যোগাযোগ হচ্ছে, যোজন বিয়োজন হচ্ছে, আদান-প্রদান হচ্ছে। কিন্তু সেটা না হলে আমি ক্রমশ আলাদা, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তাদের সকলের সাথে আমার যোগাযোগ রক্ষা করা হয় না। তারা বা আমি কেউই কারো অভাব অনুভব করি না।

যদিও মনে হতে পারে এহেন অ-যোগাযোগ আমাকে দুঃখী করে, আসলে তা সত্যি না। আমি দুঃখ পাই না। সম্পর্কের সুতোগুলো ধীরে গুটিয়ে নিতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এই স্বাচ্ছন্দ্যের কোন ভালো বা খারাপ তকমা নেই, নৈর্ব্যক্তিক পুরোটাই। তাই আমি এভাবেই জুড়ে যাই, এবং বিযুক্ত হয়ে যাই। এবং এই প্রক্রিয়া কোনমতেই আরোপিত নয়। খুব প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে থাকে। যেমন পৃথিবীর ঘূর্ণন বা পানির চক্রের কোন ব্যত্যয় নেই, ঠিক তেমনি- নিয়মানুগ!


প্রবলভাবে জাগতিক বলেই, আমি চারপাশের ঘটনাবলিতে উদ্দীপ্ত হই অনেকটা নিপীড়নের কাছাকাছি। প্রতিক্রিয়ায় বিচারে তাই আমার মননে সেগুলোর ছাপ পড়ে থাকে অনেক বছর। আমার চারপাশে পিরিচ-ঘূর্ণনের মতো মানুষরা জুড়ে যায় একে অপরের সাথে। আমি দেখে তৃপ্তি পাই- এই তৃপ্তিটুকুও, স্বাচ্ছন্দ্যের মতোই- অনেতিবাচক ও অনস্তিবাচক অনুভব। তা, যা বলছিলাম, পিরিচের ঘূর্ণিতে মানুষ জুড়ে যেতে থাকে। এ বড়ো অদ্ভুত সুন্দর প্রক্রিয়া! কেউ যদি দেখে থাকেন, কেউ যদি সেইসময়ে অনুভব করতে পারেন, কী অবলীলায় দু'জনে জুড়ে যাচ্ছে, তাহলে বুঝবেন আমি কিসের কথা বলছি। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতে থাকে। আমার দূর্ভাগ্যবানও মনে হয়, যখন দেখি পিরিচের ঘূর্ণিতেই, সেই মানুষরা আলাদা হয়ে যাচ্ছে দেখে। আমি কষ্ট পাই, আর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি।

যখন আমি মানুষদের দু'জনকেই চিনি, তখন এই যোগাযোগ ও অ-যোগাযোগের অশরীরী প্রক্রিয়াটা আরো মোহনীয় হয়ে ওঠে। আমি এর রসায়ন বুঝে যাই অনেকটাই। পুরোপুরি বোঝা অসম্ভব। তাদের দু'জনের জন্যেই নির্মল ভবিষ্যত কামনা করতে থাকি। এই সময়েরই আগে পরে, টের পাই কেউ কেউ নিঃশব্দে আর কারো কাছে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "কী হয়েছে তোর?" অচিরেই জবাব এলো, "আমি ধরা পড়ে গেছি নিজের কাছেই। গোপনীয়তার সূত্র ভেঙে অকপটেই দেয়ালটাকে ভাঙলাম। এখন আমার আবরণ নেই।"

ছেলেটার চোখে আমি কেবলই অদৃশ্য অশ্রু খুঁজি। নেই। সেখানে কেবল আবেগী-শূন্যতা। আমি সেই শূন্যতাকে অনেক যুক্তিতে হারাতে চাই, কিন্তু পারি না। আমার মনে হয় এখানে যুক্তি চলে না। আমার খুব ইচ্ছা করে এতোদিন ধরে পরিচিত ছেলেটির এই সময়ে পাশে দাঁড়াতে। তাকে এভাবে বদলে যেতে দেখে আমার আর ততোটা ভালো লাগে না। তাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখেও ভালো লাগে না। মেয়েটি হয়তো জানতেও পারছে না ও কীভাবে কষ্ট পাচ্ছে! আমাদের যোগাযোগের এতো এতো মাধ্যম, তারপরেও আমরা একে অপরের সাথে সামান্য এই কথাটুকুও বলতে পারি না যে আমাদের ঠিক কেমন লাগছে। হায়!

আমার মনে হয় পুরনো যুগে মানুষ অনেক আরামে ছিলো। অবশ্যই, তাদের অনেক রকমের অসুবিধা ছিলো। তাদের দৈনন্দিন সুবিধাগুলো ছিলো না, তাদের মোবাইল আর এসএমএস ছিলো না, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে প্রচুর শ্রম ও সময় দিতে হতো। কিন্তু কী অদ্ভুতভাবেই না আমরা এই সমস্যাগুলো দূরে করে ফেলেছি! এখন হুট করেই সব করা যায়, চট করেই কাজ সেরে ফেলা যায়, উড়ে চলে যাওয়া যায় দেশ-দেশান্তর। তারপরেও আমরা অনেক বেশি কষ্টে আছি। এখন আমি যখন সেই ছেলেটির চোখের দিকে তাকাই, সেখানের সবগুলো অব্যক্ত কথা পড়তে পারি না। হয়তো সে-ও পারে না। যেমন করে সে মেয়েটিকে বলতে পারছে না অকপটে। মেয়েটিও সেটা বুঝতে পারছে না!

ভাবছিলাম আমরা কী এখনও কৈশোরক? আটকে গেছি বয়ঃসন্ধির দোলাচলে? নাহলে কেন এই বয়সে এসেও এভাবে কারো হৃদয় টুকরো টুকরো হতে দেখবো! সেই অস্থির অন্তর্লীন সময় তো আমরা কবেই পেরিয়ে এসেছি, এখন সময় বুঝে চলার বুঝে নেয়ার। সব কিছু দেখে শুনে সিদ্ধান্ত নেয়ার। ছেলেমানুষীর, খামখেয়ালিপনার দিন ঢলে চলে গেছে কবেই! তারপরেও টের পেলাম যে আমরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আমাদের বিচারে ভুল হয়ে গেছে। ছেলেটি যেদিন টের পেলো, সেই ভুলের দিন, সেই খামখেয়ালির দিনে মনে হয় আকাশ গাঢ় কালো হয়ে এসেছিলো। ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরেছিলো মধ্যগ্রীষ্মে। তারপরে সে বুঝে গেছে হৃদয় হারালে কতোটা ক্ষরণ!

ভেবেছিলাম তার জন্যে এলিজি লিখবো। আশাবাদ লিখবো। সাথে তার জন্যে স্মৃতিগুলো লিখবো। কিছুই হলো না। কেবল (অ)যথা-বাক্যক্ষয়! পারা না-পারার দোলাচল।


দেখি ঘরে কে এলো, ওমা! তুমি? যাই এ'বেলা। কথা ফুরোবে না, নটে গাছও মুড়বে না!


******** ********** ***********