গত পরশু (১৮/৮/২০১০) বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটু খবরের
শিরোনামে
এসেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলবৎ করার ব্যাপারে মূল আলোচনা বা বিতর্কের
জায়গায় ছিলো সুপ্রীম কোর্ট। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটাকে
পুনর্বহাল করেছিলো তারা। আর এখন নির্বাচন কমিশন ভোটার আইডি'তে যোগ করেছেন
বেশ কিছু পেশা। তাদের বক্তব্য, নতুন যোগ করা পেশাগুলোকে আগে চিহ্নিত করা
হতো না। সেই পেশাজীবী মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতেই এই উদ্যোগ।
লিস্টিটা দেখলাম- যৌনকর্মী, ইমাম/পুরোহিত/যাজক(clerics), সেবিকা,
হেয়ার-ড্রেসার, ধোপী, কাজের লোক (মেইড), মালী, ক্লিনার, বাবুর্চি, দর্জি,
ড্রাইভার। তবে এই পেশাগুলোকে নিয়ে তেমন আলোচনা তৈরি হয় নি। বাঙালি
মধ্যবিত্তের মননে 'তোলপাড়' তুলে ফেলেছে কেবল যৌনকর্মী পেশাটি। এই নিয়ে এরই
মাঝে কিছু ব্লগে কয়েকটা লেখা দেখলাম, মূলত খবরটার প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আশা
করেছিলাম যেমন, ঠিক তেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সকলেই আমার ধারণাটিকে বদ্ধমূল
করেছেন যে বাংলাদেশের সামাজিক চালচিত্র মোটেই এই পদক্ষেপের জন্যে অনুকূল
নয়।
যৌনকর্মী সংক্রান্ত প্রাথমিক 'বুকিশ' আলোচনার দিকে যাবো না, সেদিকে আমি
আপনার চাইতে বেশি কিছু জানি না। তাই চলুন একটু অন্যদিকে চোখ ফেরাই। ঐ যে
বলছিলাম, নির্বাচন কমিশন এবং সুপ্রীম কোর্ট নিয়মিতই কিছু পদক্ষেপ নিয়ে
আমাদের মাঝে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে। এই উঠে আসার কারণ হয়তো তাদের গৃহীত
সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের সাথে আমাদের মনন, সামাজিক প্রথাবদ্ধতার অমিল মূলাংশে
দায়ী। ধর্মপ্রবণ এবং মোটামুটি অশিক্ষিত এই জনপদে গিজ গিজ করছে মাথা, সেই
মাথায় চুল গজায় আবার ঝরে পড়ে টাক বিস্তৃত হয় কিন্তু খুলির ভেতরে
ধূসর-বস্তুতে খুব বেশি আলোড়ন ওঠে না। যে খুলিগুলোতে কিছুটা রসদ থাকে,
সেগুলো ড্রেন দিয়ে বা প্লেনে চড়ে পাচার হয়ে যায় ফর্সা-চামড়ার দেশে। তার
এখানকার কালো, কুৎসিত, কুশিক্ষিত মানুষের মনন একটা আধা-ধর্মান্ধ-আধা-সুশীল
অবস্থানে আটকে থাকে (আছে)। এই অবস্থায় আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা
পরপর দুটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। "যুগের অন্ত" আক্ষরিকার্থেই!
কারণ, জন্মাবধি কাগজে কলমেও বাংলাদেশ সাড়ে চার বছরের বেশি সময়
ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পারে নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সময়ে যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছিলো যে এই
ইসলামিক রাষ্ট্রটি ১০০ বছর বাঁচবে, যুগে যুগে এইখান থেকে তৈরি হবে
নব্য-মুসলিম স্কলার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে ও সভ্যতার উৎকর্ষে তারা অবদান
রাখবেন; সেই সুখ কল্পনা ছেঁড়া কাথার ফুট দিয়ে পালিয়েছে। পেছনে ছিলো সামরিক
লাঠির বাড়ি। আধামূর্খ-আধামুসলিম বাঙালিত্বের লুঙ্গি খুলে খুলে যখন
পাক-পবিত্র পাকিস্তানিরা চেক করেছে, তখনই বোঝা গেছে পলিমাটিতে মরু-রুক্ষ
ইসলাম জমবে না। এখানে পীর-আউলিয়াদের হাত ধরে আগত ইসলাম কেবল আচারে, প্রথায়
রাখা যেতে পারে, তার বেশি মানুষ তা মানবে না।
বাঙালি তখন লুঙ্গি ছেড়ে সবে রাস্তাঘাট বানাচ্ছে আর শার্ট-প্যান্টের সাথে
জুলপি রাখতে শিখেছে। তাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার গ্রহণযোগ্যতা একটা
সামাজিক-রাজনৈতিক উল্লম্ফন ছিলো। কিন্তু পুরো শরীর এক সাথে না লাফালে যেমন
গোত্তা খেয়ে পড়তে হয়, তেমনি সাড়ে চার বছরেই ধর্মনিরপেক্ষতার ঝুমঝুমি হাত
ফস্কে গেছে, একেবারে নিচতলায়, বেইসমেন্টে ধুলো মেখে। আমরা শনৈ শনৈ সামরিক
উন্নয়নে ডুবে গেছি, বন্যায় ডুবেও রাস্তাঘাট আর খাল কেটে স্বস্তি পেয়েছি।
ব্রিটিশ জুতো, পাকিস্তানি জুতোর পরে বাংলাদেশী জুতোর পাড়া খেতে আমাদের কালো
দেহে মন্দ লাগে নি। পরিবারতন্ত্রের রাশান রুলেৎ খেলা "রহমান ডাইনেস্টি"
দুটোর ভগিজগিও গত বিশ বছরে সামরিক শাসনের 'সমসাময়িক' হয়ে উঠছে। তো, এবারে
নতুন শতকের এক দশক পেরিয়ে গেলে কোন দৈববলে আবার সেই মানিকরতন ফিরে এলো,
তাকে নিয়ে আমরা কী করবো; কোলে রাখবো নাকি ছুঁড়ে ফেলবো, এটাই এখনো ঠিকঠাক
ঠাহর হচ্ছে না।
তার ওপরে নির্বাচন কমিশন চাপিয়ে দিলেন পেশা-স্বীকৃতির এই 'অভাবনীয়'
বিজ্ঞপ্তি! এবারে আমাদের পুরুষালী রোম খাড়া হয়ে গেছে। এই উত্তেজনায় বাকি
সবগুলো পেশাজীবীকে বাদ দিয়ে আমরা যৌনকর্মীদের নিয়ে পড়েছি। এমনিতেই তাদের
ব্যাপারে ট্যাবু, চাপা-আগ্রহের কোনই কমতি নাই, তার ওপর নিঃকঃ এসে পেশা
হিসেবে উন্মুক্ত করে দিলো যেন। এখন হিসেব উঠে আসছে, ঢাকায় ঠিক কতোজন
যৌনকর্মী আছেন, ঠিক কোন কোন জায়গায় তাদের ডেরা, বাংলাদেশেই বা কতোগুলো
'নিষিদ্ধপল্লী' আছে ইত্যাদি।
খেয়াল করলাম, যে পেশাগুলোকে নতুনভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর
মধ্যে বেশিরভাগই নারীর পেশা। ইমাম/পুরোহিত/যাজক, মালী এবং ড্রাইভারের
পেশাতে এখনও পুরুষের একচ্ছত্রতা। সেবিকা, যৌনকর্মী, কাজের লোক এগুলো পেশায়
নারীর একচ্ছত্রতাও উল্লেখ করি। বাদ বাকি পেশাগুলোতে ধীরে ধীরে নারীকে জড়িয়ে
পড়তে হচ্ছে। এই সবগুলো পেশার মধ্যে মিল হলো সচরাচর এগুলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র
'চিনতে' চায় না। কাজের লোককে নামমাত্র বেতনে রাখা হয়। ইংরেজি খবরে
"ক্লিনার" বলে সম্ভবত মেথর ও জমাদার বুঝিয়েছে, তাদেরকেই বা কতোটা দ্রষ্টব্য
ভাবা হয়? সেবিকাদের নামের আশে পাশে 'মহামতি ফ্লোরেন্সে'র নাম নিয়ে
তাদেরকেও শ্রমের ন্যায্যমূল্য দেয়া হয় না। হয়তো শুভ্র পোশাকের সেবিকাদেরকে
ততোটা 'খেটে খাওয়া' বলে মনে করতে আমাদের 'সুশীল' চোখ অভ্যস্ত নয়। আর সেই
সুশীল চোখের কাছে যৌনকর্মীর নাম দূরে থাক, উল্লেখমাত্রই একেবারে অচ্ছুৎ।
তবু নিষিদ্ধের কৌতূহল আর বিকৃত আগ্রহ আমরা নিশ্চিত লালন করি। তাদের জীবন
ও জীবিকার খবর জানতে, পরিসংখ্যানের ভেতরে আরো খতিয়ে জানতে অনেকেই উৎসুক।
এই ঔৎসুক্য জন্মেছে পারিবারিকভাবে শেখানো ঠুঁটো নিষিদ্ধতার কারণে। যৌনতা এ
অঞ্চলে ট্যাবু হলেও অন্তরীণ নয়। সকলেই চর্চা করেন, এখন তথ্যপ্রবাহের ঢেউয়ে
তার অনেকটাই জানা যায়। নারী বা পুরুষ কেউই এই চর্চার বাইরে নেই। হয়তো
অংশগ্রহণের স্বাভাবিকতায় নারী যুগযুগ জিইয়ে রাখা জড়তা এখনও কাটাতে পারে
নাই, তবু প্রায় সমানে সমানেই (আড়ালে বা প্রকাশ্যে) যৌনতার লালন ঘটছে।
সুতরাং এখানে কোন উন্নাসিকতার উপায় নেই, সুযোগ নেই উপেক্ষার। স্বীকার
করেই নিতে হয় যে এই আদিমতম পেশাটি বঙ্গ-জনপদে প্রাচীনকাল থেকেই আছে, আছে এর
"ভোক্তা" (পুরুষ) ও "কর্মী" (নারী)। সমাজে পুরুষ নিজের সামাজিক প্রতিপত্তি
আর পরিচয়ের জন্যে রেখেছে স্ত্রী, আর ভোগ ও লালসার জন্যে রেখেছে যৌনকর্মী।
এবং নিজেদের 'সম্মান' ধরে রাখতে এই কর্মীদের নাম দিয়েছে 'পতিতা', 'বেশ্যা'
ইত্যাদি। নামগুলো দেখুন, নিছক শব্দ হিসেবেই প্রথম শুনেছিলেনঃ কিশোর বয়সের
কথা মনে করুন। তারপরে শিখে গেছেন, এগুলো কতোটা নিকৃষ্ট শব্দ, অশ্লীল,
অসভ্য, কুৎসিত। তারপরে পরিচিত হয়েছেন এই শব্দগুলো যাদের সাথে ব্যবহার করা
হয়, তাদের সাথে - সেই নারীদের সাথে যারা পতিত, অস্পৃশ্য, নিষিদ্ধ ইত্যাদি।
অথচ তারা কোথায় থাকে, কি করে, কারা তাদের কাছে যায় এটা জিজ্ঞেস করলে
নিশ্চিত বড়ো একটা ধমক খেতেন। 'চুপ' বলে চেঁচিয়ে উঠতো আপনাকে আদর্শলিপির পাঠ
দেয়া 'পুরুষ' চরিত্রটি।
এই চর্চা, আবহমান সংস্কৃতির মতো চলে আসছে। পুরুষ কখনই যৌনকর্মীর কাছে
যাওয়া থামায় নি, এবং নিয়মিত খদ্দেরকেই দেখা গেছে তাদের বিপরীতে উচ্চকণ্ঠে।
এই দ্বিমুখী আচরণ আসে কুশিক্ষা থেকে, প্রথাবদ্ধতা থেকে, অন্ধের মতো ক্ষমতা
দখলের লিপ্সা থেকে। এখানে কেন ক্ষমতার কথা আনলাম? একটু ভেবে দেখলে আপনি
নিজেও বুঝতে পারবেন।
সমাজের ক্ষমতার পিরামিডে এই নারীদের অবস্থান কতোটা নিচে! হয়তো সবার
নিচে। এমনিতেই অনগ্রসর ও দরিদ্র জনপদে গড়পড়তা নারীরা ২য় শ্রেণীর নাগরিক,
তার ওপরে তাদের মধ্যে যারা দেহব্যবসার সাথে জড়িত, তারা না পান পরিচয়, না
পান মূল্য - সামাজিক অবস্থান তো দূরাস্ত। এ অবস্থায় তাদেরকে আলাদাভাবে কেন
'পতিত' বলে চিহ্নিত করা হলো? কারণটা কি খুব স্পষ্ট না? কারণ সমাজের পুরুষের
দুশ্চরিত্রের অনেকটা চেহারাই তাদের কাছে উন্মুক্ত। ভ্রষ্ট প্রথা মেনে
সমাজে প্রতিপত্তি গড়ে তোলা উপরতলার বেশির ভাগ পুরুষ এই সকল নারীর ভোক্তা।
কাঁচা বাজারে গেলে তারা যেমন প্যান্ট উঁচু করে চলেন, কাদা মাড়ালে যেমন
তাদের নাক কুঁচকে যায়, সেই সকল উন্নাসিকের গতায়াত এই অঞ্চলে অহরহ। আর
সেজন্যেই, যৌনকর্মীদেরকে সমাজের নিচু থেকে নিচুতলায় ঠেলে দিলে এই সব
পুরুষদের স্বস্তি হবে। এতোটা নিচুতলা থেকে তারা আর কিইবা বলবে, আর সেটা
কে-ইবা শুনবে?
বিষয়টা প্রবলভাবে রাজনৈতিক - ক্ষমতার বন্টনের মতো। কিন্তু সে দিকে না
তাকাই। আমরা বরং 'আম' জনতা সেজে থাকি। অন্ধকারে আমাদের মাঝে কে কে এই
পল্লীতে এগুবেন সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। আমরা সেখানে কোন
জাজমেন্টাল অবস্থান নিতে চাই না।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। যুগের পর যুগ ধরে
তাদের প্রতি জমে ওঠা অবহেলা, নাক সিঁটকানোর স্বভাবটাকে বদলাতে তারা সমাজের
আরো পাঁচজন পেশাজীবীর কাতারে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন। এই পদক্ষেপটি যাদের
গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তারা স্বভাবতই উপরে উল্লিখিত মানুষদের মতো
মন-মানসিকতা ধারণ করেন। যতোক্ষণ তাদের সেই কূপমণ্ডুক, পুরুষতান্ত্রিক
মনোভাব তারা নিজেদের ভেতর রাখছেন, ততোক্ষণ সেটা নিয়ে মনে হয় না কারো
মাথাব্যথা আছে। কিন্তু যখনই তারা গলাবাজি করে সমাজের নৈতিকতা, এবং
অনুশাসনের বুলি আওড়াতে যাবেন, তখন মনে করিয়ে দেয়া জরুরি যে এই নারীদের
পেশাবৃত্তির ভোক্তাশ্রেণীটি কারা।
যৌনকর্মীদের পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াটা মূলত পুরুষ ভোক্তাদেরকে
ভোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সমতূল্য। এই বিষয়টিই হয়তো কাঁটার মতো গলায়
বিঁধছে অনেকেরই। তাদের জন্যে প্রেসক্রিপশন, দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ
করুন। আপনার পুরুষতান্ত্রিকতার গলায়, মানবতার ফোরসেপ দিয়ে কাঁটাটি না তুললে
অচিরেই সেপটিক হয়ে যাবে। তখন না গোটা গলাটাকেই কেটে ফেলতে হয়!
***
[
*নির্বাচন কমিশনে এবং সরকারি কর্তাব্যক্তিদের মাঝে কোটি কোটি
দোষত্রুটি আছে। এই সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন খাতে ব্যর্থতার পরিচয় 'সগৌরবে'
রেখেছে। তারপরেও এরকম কিছু দুরন্ত উদ্যোগের জন্যে তারা সাধুবাদ দাবি করেন।
বাংলাদেশে সামরিক ও ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়াশীলতার পিঠে এরকম প্রগতিশীল
পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই!]