শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১০

মুখবন্ধ

হ্যাং হয়ে থমকে আছি। মনিটরে মাঝেমাঝে ফেইটাল এরর হয়। গাঢ় চকচকে নীল পর্দা এসে সব ঢেকে দেয়। শাদা গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থেকে নির্মম পরিহাস। সকল চেষ্টা ফাঁকি দিয়ে মরে গেছে যন্ত্র। যন্ত্রেরও শরীর বিগড়ায়, মাথা নষ্ট হয়। মাথা মানে প্রসেসর, নয়তো মাদারবোর্ড। মা! মা! তোমার কী হয়েছে মা? মন খারাপ? মন খারাপ হলে আমাকে একটু জড়িয়ে থাকো। আরো একটু সময়… তোমার গায়ের গন্ধে একটা শৈশব ফেলে এসেছি আমি। মা!


নীল পর্দাটা তিরতির করে কাঁপছে। হাত চলে যাচ্ছে রিসেট বোতামের দিকে। চাপ দিলেই নিকষ কালো হয়ে উঠবে সব। সওব। তারপরে দমবন্ধ অনুভূতির অক্টোপাস, চেপে ধরে চারপাশ। নাগপাশ। হাঁসফাঁস। ফাঁসে ঝুলে গেছি আমি হ্যাং।


তারপরে বিপ বিপ করে আমার ধুকপুকানি ফিরে আসবে আমার, এবং আমার কম্পিউটারের। কম্পুসোনা চোখ খোলো। দেখো গাঢ় কোমল রাত জানালার বাইরে জমা হয়ে আছে। আলোগুলো অনেকেই একা একা তোমাকে দেখার জন্যে দূর থেকে এসেছে। তাদেরকে বিষণ্ণ করে দিও না। ওদের আলোটুকু উজ্জ্বল আর ভালো। তুমি ভালোমানুষের মতো জেগে ওঠো।


মা! আমার অনেক অনেক পাপ এই জীবনে। তুমি ছাড়া সেই কথা আমি আর কাকে বলবো। এই নষ্টতা ভ্রষ্টতার পৃথিবীতে জন্মের পর থেকে আমি পাপ করছি। সবাই বলে আমি অন্যায়ও করেছি অনেক। প্রথম প্রথম আমি ‘ভুল’ করতাম, তারপরে ‘কাজটা ঠিক করো নি’ বলতো সবাই। আরো কিছুদিন পরে বললো, ‘তুমি খুব খারাপ! এটা কী করে করলে? এ বড়ো অন্যায়’। একদিন সবাই খুব রেগে গেলো, ‘পাপী! নষ্ট! খারাপ! কুৎসিত!’ বলে তারা চেঁচিয়ে উঠলো, আমার চারপাশের বাতাসও থমকে গেলো। মনে হলো, সেদিন ফুসফুস ভরে উঠলো প্রাকৃতিক পাপে। আমি তো এরকম চাইনি। এভাবে সব ঘটে গেলো কীভাবে? আমাকে একটু জায়গা দিবে না মা? তোমার জঠরে ঢুকে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।


মনের ওজন কতো? এতো কিছু বিজ্ঞান জেনে গেলো, অণুপরমাণুর ভেতরের বিদ্যা! আমাকে কেউ বললো না কতোদিন বাঁচলে মনের ওজন অসহনীয় হয়ে ওঠে? বললে আমি হয়তো সাবধান হতাম, সতর্ক হতাম যে আমি বিপজ্জনক হয়ে উঠছি। পাপবোধের ছুরি রক্তনালীর ভেতরে গুঁড়ো গুঁড়ো আফিমের মতো মিশে যাচ্ছে। তুমিও তো কিছু বলো নাই মা। আরেকটু হেসে আমাকে নিষেধ করতে! ‘বাবু, ওদিকে যেও না। আমার কথা শোনো। তাকাও এদিকে। ওখানে যেতে নেই।’ এভাবে বললেই আমি শুনতাম তোমার কথা। আমি তো তোমার লক্ষ্মীসোনা…


***


আমি এখনও নিথর মনিটরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছি। ঘরে কেউ নাই। ঘরের বাইরের লাইটগুলো নেভানো। চুপচাপ। এদিকে বাইরে জানালার বাইরে রাস্তায়ও কেউ নেই, কয়েকটা স্ট্রিট লাইট। ওগুলোকে এখন একলা একলা আর বিষণ্ণ লাগছে আমার। আর দেখো আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে হাসছি। স্ক্রিন-সেভারে জলজ মাতৃকায় একটা শিশু চোখ মুদে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি সেই শিশুটির মুঠো জড়িয়ে ধরলাম!




----

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১০

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ১:৫১

নিয়ন্তি,

মেইল করতে বলেছিলেন। মাঝে কী মেইল করবো বুঝে উঠি নাই বলে, করা হয় নাই।

খবর কি আপনার? রাতে ঝিমাচ্ছিলাম পিসি’র সামনে বসে।

হঠাৎ ডিং করে একটা মেইল আসলোঃ পিচ্চিদের নোট!

অথচ দেখি অফলাইন, তাই বুঝলাম না কি হইলো (?)

যাক ভালো থেকেন।

রাইন


-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-

সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ১:৫৯

রাইন,

আপনি কেমন আছেন? ঝিমান কেনো?

আমি জিমেইলে নাই। এটা আমার অফিসের ইমেইল অ্যাড্রেস। ঐ জন্যেই অফলাইন।

ভালোই আছি, কালকে অবশ্য অনেক জ্বর ছিল, অফিসেই আসি নাই। জ্বর হলে মন টন খারাপ হয়ে যায়। তাই অনেক গজল শুনলাম। :-)

বিলাই ভালো আছে। আসার সময় দেখে আসলাম আরামসে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার বিলাই হতে ইচ্ছা করে… কী ভালো হতো! সবচেয়ে ভালো হতো- ইফ আই ওয়্যার এ ক্যাট ইউথ এ হিউম্যান মাইন্ড….

কী করেন আপনি?

নিয়ন্তি


-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-

সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ২:১০

নিয়ন্তি,

ঝিমাই কারণ রাত দুইটা। ঢাকার মানুষ নিশাচর, এতো রাতেও নেটের স্পিড খারাপ। আজকালকার যুগে যদি “বেসিক এইচটিএমএল ভিউ” খুলে মেইল করতে হয় তাইলে মেজাজ খিঁচড়ে যায়। অবশ্য নেগেটিভ ঘটনার লাভ থাকে। আজকের লাভ, এখন ঘুম একটু কম!

পরে খেয়াল করলাম (আগে ঝিমুনির কারণে খেয়াল করি নাই) যে আপনি অফিসে। এখন নয়টা বাজে এবং শুক্রবারে বিদেশে লোকজন কাজ করে!

সবারই জ্বর হচ্ছে। আমাদের এখানেও। আমার প্রিয় মানুষটারও জ্বর! আজকে সারাদিন আমিও ব্যস্ত ছিলাম, সে আমাকে অনেক মিস করে, কিন্তু কথা বলারও সময় করতে পারি নাই। রাতে বাসায় ফিরে কথা হলো, খারাপ লাগলো তখন। সে ঘুমিয়ে পড়েছে এখন। আর আমি মন খারাপের ঠেলায় ঘুমাতে পারছি না!

সীজনটা খুব বাজে। বাতাসে মনে হয় ফ্লু-এর রেণু/জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে!! আমি মন খারাপ হলে, জ্বরে পড়লে পিঙ্ক ফ্লয়েড শুনি! ওরা আমার মন আরো বিষণ্ণ করে দেয়!! হা হা :-))

আমার মাঝে মাঝে চেয়ার টেবিল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। জড়বস্তু হতে ইচ্ছা করাটা মনে হয় মাথা খারাপের লক্ষণ!

বকবকাচ্ছিলাম। অফিসে কাজ ফাঁকি দিয়ে পড়বেন! টাইপ করতে কষ্ট হইসে! ;-)

রাইন


-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-

সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ২:২০

রাইন,

বাহ! আপনার চিঠি কতো সুন্দর!

আমি কখনো এইরকম ফ্লুইড কথা লিখতে পারি না। আমার সব কিছু কেমন ছাড়া ছাড়া থাকে। আজকে জানেন, একদম মেঘলা বাইরে। আর আমার অফিসে চারপাশে কাচ। আর কাচের বাইরে টানা বারান্দা। চার তলার উপরে। আমার কেমন সুররিয়্যেল মতো লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আছি কিন্তু নাই। এটা একটা ওপেন প্ল্যান অফিস, চারপাশে সবাইকে দেখা যায়, কথা শোনা যায়… সবার কথা মিলে মিশে আসলে কোনো কথা হয় না, শুধু একটা ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজের মতোন… একটা গুঞ্জন… অনেক সময় ঢাকার দুপুরের কথা মনে পড়ে।

আসলে আমার যে সময়কার কথা মনে পড়ে, ঐ সময়টা তো নাই এখন। এখনকার দুপুর নিশ্চয়ই অনেক আলাদা। তো, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আম্মা আর বাড়ির সবাই দুপুরে ঘুমাতো। আমি কোনোদিন ঘুমাতাম না। আমাদের বাসা ছিলো ফুলার রোডের সামনে, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সে। বারান্দা থেকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল দেখা যেতো আর ঠিক দেয়ালের পাশে একটা বিশাল গাছ ছিলো। তো, ঐ দুপুরগুলা অনেক স্লো আর ঝিম ধরা থাকতো, আর একটা কেমন… ধূলার গন্ধ… সাথে ঐ রকম ঝাঁ ঝাঁ ধরনের একটা শব্দ… এখন প্রায় ঐ রকম এখানে। যদিও এখন দুপুর না, যদিও এখন রোদ নাই… আর যদিও সময়টাও অন্য।

আপনার প্রিয়মানুষের নাম জানা হয় নাই। কেনো মন খারাপ আপনার? তার সাথে কথা হয় নাই, তাই? তার জ্বর আর আপনি ছিলেন না, এই জন্য?

জড়বস্তু আমারো হতে ইচ্ছা করে। অবশ্য আমার তো মাথা খারাপই! আমার আসলে অনেক কিছুই হতে ইচ্ছা করে… মাঝে মাঝে… আমার আমি হতে ইচ্ছা করে…

আরো অনেক লিখেন, আমার কাজ করতে ভালো লাগে না…

নিয়ন্তি


-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-

সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ২:৩৬

নিয়ন্তি,

ভালো লিখেন না, ছাড়া ছাড়া, এসব বলে যা লিখলেন তাতে আমি আবার তিন বছর আগের সময়টায় চলে গেলাম!

আমি তো হলে থাকতাম, ফুলার রোডের কাছেই, দুইটা রাস্তা পেরোলেই। আমিও ঐ গাছটা চিনেছি। এখন অবশ্য আরো গাছ হইসে ওখানে। হয়তো কোলাহলও আরো অনেক বেড়ে গেছে, যাওয়া হয় না আমারও অনেকদিন।

কী তাজ্জব! আপনি যেভাবে বললেন, আমি একটা টাইমে যশোরে থাকতে ওরকম অনুভব করতাম। স্তব্ধ দুপুর, মা ঘুমে। আমি ঘুমাইতাম না। বই পড়তাম। সুকুমার, শিবরাম, নয়তো বাংলা হাসির গল্প! পড়তাম, আর কল্পনা করতাম। চারপাশের পরিবেশটা আমাকে আরো মগ্ন করে দিতো। কখন আঁধার হয়ে যেতো! আম্মা এসে ঝাড়ি লাগাইতো, আন্ধারের মধ্যে বইসা পড়তেছিস, চোখের মাথা খাবি!! আমি পরের দিনও ওভাবেই পড়তাম। চোখের মাথা খেয়ে চশমা নেয়ার শখ ছিলো।

শখ অবশ্য মিটে নাই, কারণ চোখ খারাপ করতেই পারলাম না!

প্রিয় মানুষটা আজকে একটু আক্ষেপ করে বলেছে যে তার আমাকে অনেক মনে পড়তেছিলো। কিন্তু ভাবসে যে আমি ব্যস্ত, অফিসে,তাই ফোন করে নাই। আমি ভাবসি সে অসুস্থ, রেস্ট নিচ্ছে, তাই ফোন দেই নাই। সব মিলায়ে প্রায়ই ডিসকানেক্টেড!

পরে ‘আফসুস’ করলাম একটু। হা হা! সন্ধ্যায় তার জ্বর ঠিক হইসিলো, ভালো লাগতেসিলো শুনে। পরে রাতে আবার জ্বর আসলো! আমারও মন খারাপ হলো! ও কিছুদিন ধরে ভুগতেসে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ খুবই খারাপ। পারলে বকাঝকা করে যত্ন নিতাম, কিন্তু সেই অধিকারটা এখনও জন্মায় নাই। কিন্তু অধিকারবোধটা জন্মায় গেসে। আমার সঙ্গী এখন খালি দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠা!

আপনার অফিসরুম নিয়ে একটা কল্পনা মাথায় চলে আসছে। আপনি একটা বাব্‌লে বসে আছেন, কাচের বাব্‌ল- এজন্য গোলাকার না হয়ে চৌকোনা, এটা করা হইসে শুধুই আপনাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। বাব্‌লে আটকে সবাইকে বসিয়ে রাখছে, আমার অফিসটাও চারিদিকে কাচ। পিছনে দেয়াল, তার মাঝেও একটা বড় জানালা! বাইরে আমি দিন শেষ হওয়া দেখি রোজ। বিকাল ভাঙা দেখি। আগে কতো বাইরে বাইরে ঘুরতাম ঐ সময়টা, বাসায় ফিরে আসতে ইচ্ছা করতো, বিপন্ন লাগতো, সবাই দুদ্দাড় করে বাড়ি ফিরছে আর আমি পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি এমন বোধ হতো! আর এখন, একটা কিউবিক্‌লে বসে মাথা গুঁজে কাটায়ে দেই বিপন্নতা। আসলেই চেয়ার টেবিল হয়ে গেছি… বাসায় ফিরতে ফিরতে যখন রাত হয়, তখন টের পাই, আমি বহুদিন বিকাল দেখি না!!

রাইন

-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৩:০৩

রাইন!

ইশ! কতো কিছু মনে করায় দিচ্ছেন!

আরেকটা গাছ ছিলো। ফুলার রোডের ঐ পাড়া। ভিসির বাড়ি আর ইউনিভার্সিটির মাঝখানে একটা আইল্যান্ড ছিলো, তিনকোনা। সেই আইল্যান্ডের মাঝখান... মাঝখানেই তো।
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমি ল্যাবরেটরি স্কুলের যেতাম আর উইক-এন্ডে ঐ খানেই ছায়ানট, নাচ শিখতাম। কখন ফোটে কৃষ্ণচূড়া? গ্রীষ্মকালে?
পুরা রাস্তায় পাঁপড়ি ছড়িয়ে থাকতো আর আমি মাঝে মাঝে তুলতাম। ডায়েরিতে রাখতাম।

আমার একটা বান্ধবী ছিলো। নাম হলো দিয়া। ও পুরনো উদয়ন স্কুল যেখানে ছিলো, তার পাশের পাড়ায় থাকতো। একদিন এমন বৃষ্টি আসলো, ওর কোনো ছাতা নাই আর আমার কাছে একটা ছাতা। আমরা দুই জন এক ছাতার তলায় আসলাম দৌড়াতে দৌড়াতে। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজলাম ঠিকই। পরে, আমার পাড়ার গেইট পর্যন্ত এসে ওকে দিয়ে দিলাম ছাতাটা। আর আমি আরো ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরলাম। বৃষ্টিটা অনেক ভালো ছিলো। অনেক!

চশমা নেয়ার আমারও শখ ছিলো জানেন? আমাদের বাসায় একটা ফ্যামিলি আসলো বেড়াতে। উনাদের তিন ছেলেমেয়ে। সবগুলার চশমা পড়তো! আমার শখ অবশ্য মিটেছে। এখন ড্রাইভ করতে হলে চশমা পড়তে হয়। কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। স্পেশালি বৃষ্টির মধ্যে মহা যন্ত্রণা। তখন মনে হয় চশমায় যদি ওয়াইপার থাকতো, গাড়ির মতোন!

কী দারুণ বলেন? যেই গাছটা আমি দেখতাম ঐ গাছটা আপনিও দেখেছেন। এটা একটা যোগাযোগ। আপনার সাথে আমার, না? এই রকম আমার ভালো লাগে। মনে হয় যে আপনাকে আরো কত্তো আগে থেকেই চিনি... যখন চিনতাম না...

সুন্দর করে বলসেন, অধিকারের কথা। অধিকারবোধ আর অধিকার এক জিনিস না, তাই না? বোধহয় একটা অনুরণনের মতোন... মাঝে মাঝে অধিকার জন্মাবার আগে থেকেই অনুভূতিটা থাকে... আবার শেষ হওয়ার পরও বাজতে থাকে।

নিয়ন্তি

-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৩:৪৬

নিয়ন্তি,

আমি এমনিতে এখন মরবিড হয়ে আছি। মৃত্যুচিন্তা করি না, এটা আসলে আমার অস্তিত্ব নিয়ে আজীবন ধরে চলমান ভয়, শঙ্কা। আমি নিজের অস্তিত্ব হারাতে খুব ভয় পাই। এজন্য কখনই মৃত্যু নিয়ে ভাবি না।

বৃষ্টি নিয়ে আমার কলেজের একটা স্মৃতি মনে পড়লো। আমি তখন একটা কোচিংয়ে পড়তাম। এক স্যারের কাছে অঙ্ক, আরেকজনের কাছে কেমিস্ট্রি। একই গলিতে দু’জন স্যার, পড়ার টাইমটাও ছিলো পরপর। পড়া শেষ হলে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসতাম।
ওটা পুরো ছেলেদের ব্যাচ ছিলো। তারপরে মেয়েদের ব্যাচে জায়গা হয়নি বলে দু’টা মেয়ে পড়তে এলো! আর সব ছেলেগুলা অতিরিক্ত এটেনশন দেয়া শুরু করলো, বুঝেনই সতের বছর বয়েস।

আমার কেনো জানি সতের বছরের তরুণীদের তখন থেকেই দূর্বোধ্য লাগতো। কথা, চাহনি, সবকিছু। তাই এড়িয়ে চলতাম। একজনের তাতে কৃপা হলো, আমার প্রতি নজর পড়লো। অন্য সব শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সে আমার সাথে যেচে কথা বলতো। আমি তাতে বিরাট বিব্রত হতাম, বিব্রত হলে আমার কান লাল হয়ে যায়। যারা জানতো ব্যাপারটা সেই বন্ধুরা বিরাট ক্ষেপানো শুরু করলো! আর ক্রমেই আমার মেয়েটার উপরে রাগ বাড়তো।

অগাস্ট সেপ্টেম্বরের দিকে, বৃষ্টি মৌসুমে একদিন এরকম ঝুম নামলো। আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি ফুটপাত দিয়ে, খেয়াল করলাম মেয়েটা বড়ো কষ্ট করে ছাতা সামলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাস! ছাতা শেষমেশ ভেঙেই গেলো উল্টা হয়ে। আই দৌড়ে ওটা কুড়িয়ে দিলাম আর কী বেকুবের মতো বললাম, ‘স্যরি’, যেনো আমি ওটা ভেঙে ফেলেছি!
মেয়েটা ঐ বৃষ্টির তোপের মধ্যেও হেসে ফেলেছিলো। তারপরে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে দ্রুত-হাঁটা। আমি আমার প্রায় খালি ব্যাগ (ওটার ভেতরে দুয়েকটা খাতা ছিলো) ওর মাথায় ধরলাম। মেয়েটা এমনভাবে তাকালো!!... ...

বাসায় ফিরে জ্বর, ঠাণ্ডা। কোচিং বন্ধ। তারপরে পরীক্ষা চলে এলো আর কোচিংটা বন্ধ করে দিলাম। পরীক্ষার পরে, মাঝে তিনমাস চলে গেছে, স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম একদিন দেখা করতে। মেয়েটা হতো অন্য কোনো কোচিংয়ে চলে গেছে। দেখা হয়নি আর কোনোদিন!

তখন বুঝিনাই, এখন বুঝি। এ ধরনের স্মৃতিগুলো মনে হয় মানুষকে অনেক বড়ো করে দেয়, পরিপক্ক করে দেয়। তখন যে ভাবালুতা কাজ করতো, মেয়েটার জন্য একটা করুণ কান্না পেতো মাঝে মাঝে। মনে হতো, ওকে একবার দেখতে পেলে বেশ হয়। জীবন নীরবেই শিখিয়ে দিচ্ছে, দেখা পেলে বেশ হতো না! তাতে আমার শেখা হতো না, যে মানুষের জীবনটাই এমন। ফ্রেম ফ্রেম সারি সারি মুখ, কিন্তু কেউই কারো আপন নয়!!

অনেক বাজে এখন। আপনার অফিস টাইমের বারোটা বাজাচ্ছি। স্মৃতিকাতরতা মার্জনা হউক!


রাইন

-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৪:১০

ওয়াও রাইন!

আপনার বর্ণনা এত্তো ভিভিড। আমি মনে হলো দেখলাম আমার সামনে, আপনাকে, মেয়েটাকে… বৃষ্টি!
কী সুন্দর সব।

অনেক আগে আমি একটা গল্প লেখা শুরু করেছিলাম। ঐখানে বৃষ্টিতে একজনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার বর্ণনা ছিলো। আপনার কথা শুনে মনে পড়ে গেলো। ঐটাও ছাতা বিষয়ক... দেখি মনে হয় পুরানো ডায়েরিতে আছে এখনও, আজকে বাসায় যাওয়ার পরে পাঠাবো আপনাকে।

আরেকটা স্মৃতি এখন আমার মনে পড়লো। আমার একটা বন্ধু ছিলো, প্রদীপ। মানে বন্ধু আছে এখনও, কিন্তু যোগাযোগ নাই। সে মেলবোর্ন থেকে বেশ ভালো একটা ডিগ্রি নিয়ে এখন বাংলাদেশে কোন গ্রামে একটা স্কুলের হেডমাস্টার যেন। ওর বোন থাকে মেলবোর্নে, আমাকে বললো যে প্রদীপ নাকি গ্রামের রাস্তায় লুঙ্গি পড়ে মোটর-সাইকেল চালায়! এবং হাজার হলেও বিদেশে আসবে না...

প্রদীপ খুব সুন্দর গান করতো। একদিন, আমাদের বাসায় বসে গান করছে আর এই রকম সব কথা বলছে আমাকে... প্রথম প্রেমের স্মৃতি। তারপরে একটা মেয়ের সাথে অনেক ফোনে কথা বলতো, এই সব... কিছুক্ষণ পর ভাবলাম বীচ থেকে ঘুরে আসা যায়। তো, গেলাম। মেলবোর্নের ওয়েদার খুব বিখ্যাত হঠাৎ করে বদলে যাওয়ার জন্য। আমরা যখন বাড়ি থেকে বের হলাম, তখন বেশ সুন্দর রোদ। বীচে কিছুক্ষণ পরেই দুই এক ফোটা বৃষ্টি শুরু হলো। প্রদীপ বললো, “চলো ফিরি...”

তার মধ্যেই এমন ঝড় শুরু হয়ে গেলো। আর চারপাশ থেকে ধুলা উড়ে এসে একদম লাফ ঝাপ দিয়ে আমাদের গায়ে... এত্তো বাতাস, আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম! ও আমাকে হাত ধরে একটা দৌড় লাগালো, প্রায় ১০ মিনিটের মতো, একবারও হাত ছাড়ে নাই!

কী রকম অন্যরকম লাগলো তখন... কিন্তু জানেন, এর পরে আমরা কোনদিন ঐ দিনটা নিয়ে কথা বলি নাই... যেন কখনো ঘটেই নাই এটা... বা যেন আমরা ছিলাম না আসলে... অদ্ভুত না? আপনাকে হঠাৎ বলে দিলাম... এর আগে কাউকে বলিও নাই!

আমি আসলে কখনই খুব নিয়মিত কিছু করতে পারি না। বললাম না আমার সব ছাড়া ছাড়া? আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা করে আমি আগে কেমন ছিলাম... আসলে ভুলে গেছি। বা আমি কি আমিই নাকি, সেই সন্দেহও হয় মাঝে মাঝে।

আপনি মরবিড হয়ে আছেন? জানেন মৃত্যুচিন্তা আমার সাথে থাকে সবসময়... ... আর মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠলে আরো বেশি... কেমন খালি খালি একটা ব্যাপার হয় তখন। সন্ধ্যার সময় আগে বাসায় ফেরার সময় এরকম লাগতো... অথবা যদি কখনও দিনের বেলায় ঘুমিয়ে ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে উঠি, তখনকার মতোন...

আপনি মোটেও খারাপ না... অনেএএএএক ভালো... অনেক লিখেন আরো, আজ কাজ-টাজ মাথায় থাক।


নিয়ন্তি

-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-





সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৪:২৮

নিয়ন্তি,

আগের মেইলে বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু নিজের কথা বলতে গিয়ে ভুলে গেছি। আপনি বলেছিলেন দেশে চলে আসবেন। সেই কথাটা কি এখনও মাথায় আছে? থাকলে মাথা থেকে নামায়ে কাজে রূপান্তর করেন তো ! এটা আমার জন্যে না, আপনার জন্যেই সাধাসাধি করতেছি।

আমার প্ল্যান ছিলো, পাশ করার পরপরই বাইরে চলে যাবো। ইউএস, নয়তো কানাডা, পড়াশোনা করতে নয়তো নেহাৎ চাকরি করতেই! তারপরে আমার যাওয়া হলো না। পাশ করার পরে চাকরিতে ঢুকে গেলাম। যে কয়দিন বেকার ছিলাম, খুব বাজে লাগতো। ভাবলাম, সময় আছে, এখনই বাইরে চলে যাই। যে সময়টায় সব প্রস্তুতি নিবো সেই সময়েই হুট করে চাকরি হয়ে গেলো। বেতনের জন্যে না শুধু, কীভাবে কীভাবে জানি চাকরির লোকগুলোকেও ভালো লেগে গেলো। আমি যা চার-পাঁচ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায় শিখি নাই, সেই ব্যাপারগুলো ছয় মাসেই শিখে ফেললাম। আমাদের চারপাশের অতিসাধারণ মানুষগুলোর কোন একটা ডাকিনীবিদ্যার মন্ত্র শেখা আছে। দেশ তো কোনো সত্ত্বা না, মানুষগুলোই দেশ গড়ে। আর একটা কথা চুপিচুপি বলি, এই সব দূর্নীতি আর গরীবিয়ানা আমাদের দেশের ভুল পোশাক। ভেতরের কাহিনী অনেক হৃদয়-নিঙড়ানো, অনেক গভীর জীবনবোধের। মানুষের জীবনটা আসলে এতোই ছোট যে সবকিছু ঠিকমতো বুঝতে না বুঝতেই পেরিয়ে যায়। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে সেটা যেদিন বুঝে যাবেন, হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকবে না!

এখন আর আমার বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। সব বাদ।

আমার মা’কে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কোলঘেঁষা আমি। মা অনেক কষ্ট করেছে, আর্থিক কষ্টের চেয়েও বেশি, মানসিক কষ্ট। আমাকে অনেক সংগ্রাম করেই বড়ো করেছে। এগুলো সংগ্রাম দেখাও যায় না, শুধু যুদ্ধ করতে করতে তাঁর শরীর ভেঙেছে, মন দূর্বল হয়ে গেছে। হঠাৎ করে কেউ দেখলে চমকে উঠবে, এই মানুষটা এমন ভেঙে পড়েছে কেনো! কিন্তু উনি কাউকে বলবেন না এগুলো, মহীয়সী সেজে বসে থাকবেন!

আমি যতদিনে বুঝেছি ততদিকে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি মায়ের সাথে। এখন মনে হচ্ছে মা ক্ষমা করেই দিয়েছে, কিন্তু আমার নিজের কাছে তো ক্ষমা হয় না। এজন্যেই বাকিটা সময়, তাদের কাছেই থাকবো।

আপনি চলে আসেন। দেশের বাইরে যাই নাই কখনো, চিন্তাও করতে পারি না কতোটা একাকিত্ব! আমি বন্ধুস্বজন হারায়ে কতো একা একা ফীল করি, তারা কিন্তু আশেপাশেই আছে। যোগাযোগ নাই খালি, তাতেই আমি শেষ। ছাইয়ের মতো রুক্ষ হালকা হয়ে গেছি!! আর আপনার মতো যারা বিদেশে আছেন, তাদের অবস্থা কেমন তা আমার “বিখ্যাত” কল্পনাতেও আসবে না। না হয় দেশে এসে লুঙ্গি না পড়লেন, মোটর-বাইক না চালাইলেন! ;-)

রাইন
(পুনশ্চঃ অফিসের কাজের মৃত্যু ঘটায়ে দিলাম বোধহয়?)



-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৪:৪৫

রাইন,

হা হা! আপনার শেষ কথাগুলো পড়ে এমন জোরে হেসে উঠসি, আমার দিকে আমার কলিগ তাকাচ্ছে। বলে যে... “শেয়ার দ্যা জোক”। এখন এইটা কেমনে শেয়ার করি?
এই জিনিশগুলা খারাপ লাগে বিদেশে, সব তো বুঝানো যায় না। অবশ্য সেটা আর বিদেশ কেন... সব তো কোথাওই বোঝানো যায় না!

তবে হ্যাঁ। দেশে ফেরার চিন্তা মাথায় আছে আসলেই। কী করবো ওটাই হলো ব্যাপার। আমি আসলে বাংলাদেশের জন্য একদমই আনাড়ি। এখন গেলেও কেমন একটা হারিয়ে যাওয়া রকম লাগে। কিছুই চিনি না, নিয়ম বুঝি না... শুধু ভাষা বুঝি... আর চারপাশের মানুষগুলা দেখতে আমার মতোন... ... এই সব চিন্তা করে ভয় লাগে একটু। আবার নতুন সব কিছু!

তারপরেও ফিরবো। এই রকম ফ্র্যাগমেন্টেস থাকতে আমার ভালো লাগে না আর। ঐ যে বললেন... “সারি সারি ফ্রেম... মুখ...” ঐ রকম!

আমার মনে হয় দেশে ফিরলে এই... ছাড়া ছাড়া ভাবটা কমবে একটু। কারণ ছোটবেলার স্মৃতি তো আছেই ঢাকাতেই... তাই কিছুটা হলেও আমার মতোন লাগবে...

মাঝখান থেকে একটু একটু হাওয়া যদিও... তা সেই রকম তো হয়ই... পাজলের সব পিস এক সাথে বেশিদিন থাকে নাকি? আমার এরকম অনেক হারায়... তারপরে হঠাৎ কখনো ঘর পরিষ্কার করতে করতে সোফার পেছন থেকে, বা কার্পেটের তল থেকে, বা ম্যাট্রেসের নিচে আবিষ্কার করি! তখন মনে হয়, আরে, এ যে ছিলো আমি তো ভুলেই গেসিলাম, কী আজব! ঐ রকম হয়তো লাগবে আমার ঢাকায় গেলে, কে জানে...

আপনার আম্মার গল্প বলেন। কীভাবে কষ্ট দিলেন? বলেনননন...

আর হ্যাঁ, কাজের মৃত্যু ঘটসে আপাতত। বলেন ইন্নালিল্লাহ! :-)

নিয়ন্তি



-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৫:১৪

নিয়ন্তি,

আপনার “ইন্নালিল্লাহ” পড়ে তো আমারো হাসি পাইলো! তবে ঘর ফাটায়ে হাসলেও কেউ শুনবে না!

ছোটবেলায় আমি সবসময় ১ম-২য়-৩য় হতাম সবকিছুতে। পড়াশোনা, খেলা, আবৃত্তি, গান, নাটক...
তারপরে বড় হতে হতে টের পেলাম এগুলো করে, পজিশন পেয়ে কোনো লাভ নাই। উল্টা পজিশন হারানোর ভয় মনে ঢুকে গেলো। পরের কম্পিটিশনে পজিশন করার প্রেশার তৈরি হলো। তাই ঠিক করলাম যে এখন থেকে স্বীকৃতি দেয়া স্থানগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
লাস্ট বেঞ্চ। লাস্ট রুম।
লিস্টের মাঝামাঝি কোনো একটা ইররেলেভেন্ট পজিশন।

পাজল নিয়ে যা বললেন, সেটা খুবই মনে ধরলো! আপনার এক্সাম্পল গুলা এতো গুছানো, বুঝে নেয়া তো সাধারণ কথাতেই হয়, কিন্তু আপনি একেবারে বুঝে ওঠার আনন্দটাও দিয়ে দেন! আমার কি মনে হয় জানেন? এই যে কিছু মিসিং পিসেস, বা মাঝে মাঝে কিছু খুঁজে পাওয়া পিসেস যাদেরকে বাকিদের সাথে মিলানো যায় না, এগুলোও কিন্তু আপনার লাইফের পিকচারের অংশ! কে বললো যে সব এক রকম প্রগ্রেশনে কালার্‌ড হবে? ফুলার রোডের ঝিম ধরা দুপুর যেমন থাকবে, তেমনি নিউমার্কেটের ভীড়-ভাট্টা, হট্টগোল থাকবে, মেলবোর্নের যে কোনো একটা সী-বীচও থাকবে! তারপরে বুড়ি হবেন, ফোকলা দাঁতে নিজের অথবা প্রতিবেশির নাতনিদের এই সব পাজল পিসের গল্প বলবেন। আপনার পাজল ততোদিনে প্রায় মিলানো শেষ হবে, তাই না?? সেই তৃপ্তিটাও চোখে মুখে থাকবে।

এখন দেশে না ফিরলে আপনার পরে মনে হতে পারে যে সেই ম্যাট্রেসটা উঠায়ে দেখা হলো না তলায় কোনো পাজল আছে কি না! বা বিদেশে না গেলে যেমন জানতেন না জীবনের অনেক অনেক রূপ! (আমি কিন্তু বিনা খরচে উপদেশ বিলাচ্ছি। আমি জীবনের কোনো রূপই দেখি নাই, তায় আবার বিদেশ! ;-) )

তবে আমি জানি যে আপনি দেশে ফিরবেন। আপনার মা বেঁচে আছেন?? তার কথা জানাবেন আমাকে সামনে। আমার মা’কে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। আদরের সন্তান, এজন্যে মা আমার ব্যাপারে অনেক দূর্বল। তার উপরে ঝামেলা করতাম না, দুষ্টামি করলেও তা খুবই শিশুতোষ, ভাবুক টাইপ ছিলাম, ভাবুক সন্তানকে বাবা-মায়েরা কোনো এক অজানা কারণে অনেক জিনিয়াস ভাবে! হয়তো ঠিকমতো “ফিগার-আউট” করতে পারে না। চাপা স্বভাবের ছিলাম বলে আলগা খাতিরও পেতাম! আমি বড় হয়ে সেই সুযোগটাই নিয়েছিলাম...

জীবনের এই অংশটা আমি এক্সপ্লোর করতে চাই না। আমার নীরবতাটুকু মার্জনা করবেন!

আমি ভাবতেছি এখন আর ঘুমাবো না। একেবারে বাবা-মায়ের সাথে নাশতা করেই... হা হা হা!

রাইন


-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৫:৩৪

রাইন,

হ্যাঁ, এখন তো আপনার ভোর হয়ে গেছে। আযান দিচ্ছে এখনও? আপনার বাড়ি থেকে আযান শোনা যায়?
আমাদের বাসা থেকে যেতো... একদম অন্যরকম লাগে শুনতে... বিশেষ করে ফজর আর মাগরিব...
আপনি কি সুন্দর করে পাজল নিয়ে বললেন... ইউ রিয়েলি হ্যাভ এ ওয়ে উইথ ওয়ার্ডস! শুনতে কখনই লেকচার লাগে না...

আমার আব্বাও এই রকম জানেন? ঢাকা ইউনিতে ইকোনোমিক্স পড়াতো আগে... এখন তো একটা করে সেমিস্টার পড়ায় এআইইউবি’তে। ঐ স্টুডেন্টদের কথা একদিন বলছিলো। বললো যে ওদেরকে পড়ায় নাকি ততো আরাম পেতো না প্রথম প্রথম, কারণ কেউ মনোযোগী ছিলো না। তারপরে একদিন ঝাড়ি লাগাইসে, একদম পুরানো স্টাইলের টিচারদের মতোন... আব্বা আব্বা ভাবে! তারপর থেকে নাকি অনেক ভক্ত হয়ে গেসিলো। তো একবার আব্বা আমাকে এক্সাম্পল দিচ্ছিলো ক্লাসে একটা থিওরি কীভাবে এক্সপ্লেইন করসে, ঐটা শুনে আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেসি! থিওরিটা ইকোনোমিক্সের... একটা টার্ম আছে “প্রিজনার’স ডিলেমা”।

এটাকে... গেইম থিওরি বলে। ব্যাপারটা হলো এরকম। ধরেন দুই জন প্রিজনার, তাদের কাছে আলাদা আলাদা করে বললেন রাজসাক্ষী হতে। এখন একজন যদি রাজসাক্ষী হয়, তাহলে অন্যজনের লাইফ ইমপ্রিজনমেন্ট হবে আর সে হেল্প করার জন্যে মুক্তি পাবে। দুইজনই যদি বলে দেয়, দুইজনই শাস্তি পাবে... কেউই যদি না বলে... তাহলে চান্স আছে যে অপরাধ প্রমাণ হবে না... এবং কেউই শাস্তি পাবে না... ... এই থিওরি দিয়ে অনেক বিজনেসের মতিগতি বোঝানো হয়।

তো, আব্বা এইটা বুঝাতে গিয়ে ইন্ডিয়ানা জোনসের কথা বলসে ক্লাসে। মানে দুইটা জিনিশ বুঝাইসে একসাথে। একটা হলো যদিও ইকোনোমিক্সে ধরে নেয়া হয় যে হিউম্যান বিয়িংস আর র্যাসশনাল থিংকারস, সব সময়ই এরকম না। আমরা মাঝে মাঝে ইরর্যা শনাল কাজ করি... আরেকটা হলো প্রিজনার’স ডিলেমা... একটা সীন আছে যেখানে বাবা আর ছেলে থাকে... এবং তাদের সামনে দুইটা ড্রিঙ্ক... একটায় বিষ আরেকটা অমৃত। কোনটা যে কি কেউ জানে না। একজন একটা খেয়ে যদি মারা যায়, তাইলে অন্যটা অমৃত... আর বেঁচে থাকলে অন্যটা বিষ... যদিও র‌্যাশনালি স্পিকিং, বাবাকে দিয়ে টেস্ট করানো উচিত ছিল, যেহেতু তার বয়স বেশি এবং শক্তি কম... কিন্তু মুভিতে ইন্ডিয়ানা জোনসই প্রথম ট্রাই করলো ড্রিঙ্কটা (দেখেন, আব্বা আম্মার কথা বলতে গিয়ে আপনাকে ইকোনোমিক্স শিখাইতেসি!! আর আপনি বলেন আপনি লেকচার ঝাড়সেন?)

হ্যাঁ, আম্মা বেঁচে আছে ভালোমতোই... সে এখন পঞ্চান্নের মতোন। আম্মা আমার আব্বার চেয়ে অনেক ছোট, দশ বছরের ডিফারেন্স। এবং আমাদের সাথে বাচ্চাদের মতো ভাব তার। আসলে বিয়ের সময়... শী অয়াজ অনলি ফিফটীন। আর মনে হয় ঐ বয়সটাতেই আছে। যেমন সেইদিন কথা বলছি তার সাথে... কথার মাঝখানে হঠাৎ আব্বাকে বলে যে... “এই, তোমার পায়ে পোকা কামড়ায়!”

আমি বললাম... “পোকা আছে নাকি?”

বলে যে... “বাংলাদেশে অনেক পোকা... বড়ো, মেঝো, খাটো!” তারপরে ছড়া বলে... “তোর আব্বার তাড়া খাইয়া, আমার দিকে আসছে ধাইয়া, দিসি পড়া, গেসে মইরা!” এইটা নিয়ে হাসলাম অনেক... আমার একবার ইচ্ছা ছিলো তিন গোয়েন্দার মতোন একটা সিরিজ লিখবো। সেইখানে তিন বোন থাকবে তিন গোয়েন্দা আর তাদের মা থাকবে প্রবলেম সলভার। পরে আর লেখা হয় নাই...

কতো কিছু যে ইচ্ছা করে!

ওহ! আপনি কানাডা যাবেন কেনো? নিউজিল্যাণ্ডে চলে আসেন বরং... আমি এখানে থাকি... তাই সার্টিফিকেট দিচ্ছি... অনেক সুন্দর দেশ... মানুষজন ভালো অনেক... আর এই দেশের maori name হলো aotearoa মানে...দ্যা ল্যান্ড অফ লং হোয়াইট ক্লাউডস........



নিয়ন্তি




-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-



সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৬:১৬

নিয়ন্তি,

বাহ! কতো মিল পাই। আমি তো নিউজিল্যান্ডে আসবোই না তাহলে। লর্ড অফ দ্যা রিংস দেখে নিউজিল্যান্ডের প্রেমে পড়েছি। ওখানে নিউজিল্যান্ড কতো সুন্দর দেশ সেটা বুঝা যায়!

আমি সুন্দর কোনো দেশে যাবো না। গেলে শেষে দেশের প্রেমে পরে যেতে হবে। তারপরে যখন বাংলাদেশে ফিরবো, আমার কাছে মনে হবে এখানে জ্যাম, ধুলা, ধোঁয়া, গ্যাঞ্জাম, ট্র্যাফিক, মানুষ খারাপ। বাসাগুলা তখন শ্যাবি লাগবে, টয়লেট ময়লা লাগবে, বিদেশের সিস্টেমে ফরম্যাট হয়ে গেলে সেই ভার্সন দেশে অচল!! বাইরে থাকা আত্মীয়দের দেখেই বুঝি এই ফারাকটা। তাদের দোষ নাই, আমাদেরও উপায় নাই। যার যার সিস্টেম তার তার কাছে। এজন্যে আমি বেঁচে থাকা কঠিন এমন দেশে যাবো, যেখানে সৌন্দর্য উপভোগের সময় পাবো, কিন্তু আরাম পাবো না। দেশের বৃষ্টি, মাটি, কাদা, ধুলার জন্য মন কাঁদবে। তারপরে কাজ (পড়া) শেষ হলেই ফিরে আসবো! :-)

আপনার বাবার পড়ানো আমার পছন্দ হইসে। যে টিচার ক্লাসে মুভির উদাহরণ থেকে গল্প করতে পারেন, তিনি বস!! ওনার মতো কয়েকজন টিচার ক্লাসে পাইলে আমাদের অনেক উপকার হইতো। শুধু শুধু ক্লাসগুলা বাংক করে রেজাল্টের বারোটা বাজানো লাগতো না!

আমার মা কেমন শুনবেন? অনেক নরম সরম আর ভালোমানুষ ধরনের। আমার এলোমেলো জীবন-যাপনের পেছনে সে নিজে দায়ী কি না এটা অনেকদিন ধরে চিন্তা করেছে। তার ধারণা, আমি যা করেছিলাম, এমন জীবন কাটাচ্ছি, এটা তার কোনো একটা ভুলে হয়েছে। তার এই ধারণা ভাঙাতে আমার অনেকদিন লেগেছে।

গত উইকএন্ডে গিয়েছিলো বসুন্ধরা হাউজিংয়ে। আমার আব্বা অনেক আগে একটা জমি কিনেছিলো ওখানে, সেটা তদারকি করতে। পাঁচিল দিবে, হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি। আমি বললাম, “কেনো?”
বলে, “টাকা জমাইসি, এই জমিটা তো আমার নামে, এখানে একটা দুইতলা বাড়ি করবো, তারপরে আমরা থাকবো। তুই উপরের তলা নিবি না নিচের তলা?”
আমার কী হইলো, ঐ দুপুরে গরম রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েই গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে গেলো তাল তাল কান্না! বললাম, “আমার কিছু লাগবে না, আমি যা কামাই, তা দিয়ে অনায়াসে চলে যাবে।”
তখন বলে যে, “তা তো যাবেই। কিন্তু তুই কাছে থাকলি, আমার টেনশন করতে হবে না। বুড়া বয়সে দূরে দূরে থাকবি আমার দিন কাটবে টেনশন করে করে।”

বলেন! এইসব ব্ল্যাকমেইলিং কেমন লাগে!

মায়ের গল্প বলতে থাকলে এই মেইল আর শেষ হবে না। আপনিও পুরোটা না পড়েই ডিলিট করে দিবেন! আমি বরং থামি।


ইতি

রাইন

(আমি একটু শুবো। মাথা ঘুরতেছে। অনেকদিন পরে এমন সারা রাত জাগলাম। এই মেইলের রিপ্লাই দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন। পরে আবার কথা হবে...
শুভ দুপুর-ভোর!)



-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-



সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ৭:২২

রাইন,

হ্যাঁ, ঘুমান। (বাবা-মায়ের সাথে নাশতা খাওয়ার প্ল্যান বাতিল?)

আপনাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখলাম আজকে। অবশ্য এজন্য আমার একটুও দুঃখ লাগছে না... অপরাধবোধও না! কারণ আমি জানি আমার কাছে লিখতে আপনার ভালোই লাগলো, আমারও যেমন। না? :-)

লর্ড অফ দ্যা রিংস আমারও খুব প্রিয় একটা মুভি। আমরা প্রত্যেকটা হলে গিয়ে দেখসি। কয়েকটা দৃশ্য আছে এতো সুন্দর। ঐ দৃশ্যটা মনে আছে আপনার? একটা বনের মধ্যে দিয়ে এল্‌ভ্‌সদের একটা দল হেঁটে যাচ্ছে। সবাই খুব সুন্দর... পারিপার্শ্বিক সুন্দর... সবাই নীরব... ঐটা দেখলেই আমার স্বপ্নদৃশ্য মনে হয়।

আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র হলো... স্যাম। আর খুব সুন্দর একটা দৃশ্য একদম শেষ অংশতে... যখন ফ্রোডো ফিরেছে জয়ী হয়ে আর সবাই ওকে ঘিরে আছে, পরদিন সকালে আস্তে চোখ খুললো চারপাশে অনেক মুখ... সবাই খুশি, সবাই গর্বিত... সবার এক্সপ্রেশনে মায়া... ভালোবাসা... ফ্রোডো সারাঘর খুঁজতে থাকে... আর হঠাৎ করে স্যামের মুখ উঁকি দেয় দরজার আড়াল থেকে। আর খুব স্মিত হাসে। আর কেউ দেখে না ওকে, শুধু ফ্রোডো ছাড়া... কী সুন্দর না?

আমি যতোবার ঐ অংশটা দেখি আমার কান্না চলে আসে... আমি অবশ্য সবসময় মুভি দেখলে অনেক কান্নাকাটি করি!

আমার কী মনে হয় জানেন? যতোই সুন্দর হোক দেশ... যে কোনো কিছু... বেহেস্তের মতোন হোক, তবু মানুষের মধ্যে তার বড়ো হওয়ার জায়গাটার প্রতি আলাদা একটা টান থাকে... আর কোনোকিছুই “হোম” না... তাই... আপনার বিদেশী আত্মীয়রা যেমনই হোক, আপনি কখনোই ঐ রকম ফীল করবেন না আমি জানি। যে দেশেই যান... শেষমেশ ঐ ধূলা, কাদা, ভীড়, ট্রাফিক এই গুলাই মিস করবেন। আমি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুদের ফোন করি, ওরা যখন রাস্তায় থাকে। চারপাশের এতো শব্দ! গাড়ির হর্ন... মানুষের কথা! আমার অনেক অনেক ভালো লাগে... মনে হয় আমিও ঢাকার রাস্তায়। কিছু ভালো লাগা থাকে, যা ভিতরের... বাইরের আপাতত সৌন্দর্য বা আগলিনেসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই। কি যেন একটা কবিতার লাইন আছে না? “নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা!” ... অথবা নজরুল গীতি মনে পড়ছে এখন... “যত ফুল ততো ভুল কণ্টক জাগে, মাটির পৃথিবীটাই এতো ভালো লাগে... স্বর্গের প্রেমে নাই বিরহ অনল, সুন্দরও আঁখি আছে, নাই আঁখি জল...”

চোখের পানি বলেন, অনুভূতি অথবা স্মৃতি... এই গুলা মিসিং লিঙ্ক। যখন আমি ঢাকার কথা ভাবি, তখন একটা মায়ার প্রলেপ থাকে ভাবনার ওপরে... তাই কোনকিছু খারাপ লাগে না... সব ভাল...

আপনার আম্মার কথা শুনে আমার অনেক ভালো লাগছিলো... সব বইলেন... একদম মহাকাব্য লিখলেও আমি খুশি!

আপনার জীবন-যাপন এখন কেমন? আমার তো এম্নিতেই আপনার সাথে কথা বলে যে ধারণা হয়, তাতে মনে হয় অনেক অগোছালো... বাবা-মা আসলেই আজব জিনিশ। মাঝে মাঝে ওরা কতো কিছু কল্পনা করে কষ্ট পায়, অপরাধবোধে ভোগে, অথচ আমাদের হয়তো ঐসবকিছু মনেই থাকে না। আমরা তিন বোন, আমি সবচেয়ে বড়ো এবং আমার বাবা মায়ের মতে, সবচেয়ে বোকা... ওদের বেশিরভাগ চিন্তা আমাকে নিয়ে থাকে, কারণ আমি নাকি অনেক ভালনারেবল্‌ , একা একা কিছুই পারি না! অথচ ওদের ধারণার চেয়ে আমি অনেকই অন্যরকম। শেষ বার যখন ওরা আমার এখানে বেড়াতে আসছিলো, তখন একবার আব্বা নোটিস করেছে যে আমি রাবিশ বিন নিয়ে রেখে আসছি ড্রাইভ ওয়েতে, যেখান থেকে উইকলি কালেক্ট করে... ঐটা দেখেই আব্বা একদম ইমপ্রেস্‌ড! ‘আমার মেয়েটা কী রেসপন্সিব্‌ল হইসে, কত্তো কাজ করে!’...

আমার এই রকম ভালো লাগে... আর আপনার মতোনই হঠাৎ করে কান্না চলে আসে, একটা পৃথিবী থাকবে, যেখানে একদিন আমার বাবা মা থাকবে না, অথচ আমি থাকবো, আমি এখনও এমন ভাবতে পারি না... বা বিশ্বাস করতে... আস্তে আস্তে মানুষের যাওয়ার জায়গা কমতে থাকে, না?

আপনি এতোক্ষণে নিশ্চয়ই খুব ঘুমাচ্ছেন! আমি তো মাঝখানে লাঞ্চ-ব্রেক নিয়ে আবার আসলাম। এই চিঠির উত্তর যদি দেন, তাহলে আমার অন্য একাউন্টেও cc করে দিয়েন, নয়তো সোমবারের আগে দেখা হবে না।

অনেক ভালো থাকেন আর সুখে নিদ্রা যান!


ইতি

নিয়ন্তি




-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-


ডিসেম্বর ৮, ২০০৯ রাত ১:৩৪


নিয়ন্তি,

আজকে সারাদিন খুব ব্যস্ত গেলো। খুবই ব্যস্ত। আমার ভিসা হয়ে গেছে। বিদেশ চলে যাচ্ছি। আমার যাওয়ার পুরোপুরি ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু অবস্থা এমন হয়েছে! আমার চারপাশের সবকিছু ভেঙে পড়ছে। আমি ঠিক জানিও না আমি এখন এখানে কী করছি, কেনো করছি। নিঃশ্বাস নেয়াটাই যদি জীবন হয় তাহলে সেটাই এখন কাটছে।

আপনার সেদিনের ভোরে পাওয়া মেইলটা সারা সকাল ঘুমিয়ে দেখতে দেখতে দুপুর। পরের কিছুদিন ভর্তির দৌড়ে কাটলো। তারপরে আমার ভর্তিটা হয়ে গেলো। এর পরে ভিসাটাও। মনে হলো আজকে আপনাকে একটা মেইল করা যায়।

আপনার অফিসের মেইলে এর মাঝে দুয়েকটা মেইল করেছি। আপনি কি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন? মেইলার-ডিমোন আমাকে অশুভ শয়তানের মতোই বড়ো বড়ো নোটিশ পাঠিয়েছে যে আপনার ঠিকানা ইনভ্যালিড। ভেবে দেখলাম চাকরি না ছাড়লে মেইল একাউন্ট ডিলিট করার কথা না।

আমাকে জানাতে পারতেন। তিন মাস কেটে গেলো, জানাননি। যাক, জানাননি যখন…

এই মেইলটা একই নামের জিমেইলে পাঠাচ্ছি। শিওর না যে আপনি পাবেন। শিওর না যে আপনি পড়বেন আর জবাব দিবেন। সেই রাতের সবগুলো মেইল আমি মাঝে মাঝে পড়ি। পুর্নেন্দু পত্রী কেন কথোপকথন লিখলেন?

আমি গতকাল ফুলার রোডে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে এখন শীত, রোদ পড়ে আসলে হাড়ে কাঁপন লাগে। আমি সেই বড়ো গাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সেই মেয়েটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, যে অনেকদিন আগে এখান দিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে হেঁটে গিয়েছিলো। মেয়েটা এখানে নাই। তার স্মৃতিটা আমার কাছে দিয়ে গেছে।

এই মেইলটা যদি না পান, তাহলে বেশ অদ্ভুত ব্যাপার হবে, মেইলার-ডিমোন বেটা আমাকে দুইবার করে ওয়ার্নিং দিবে যে আমি বোকার মতো মাথা খুঁড়ে মরছি। ভার্চুয়ালি আমি আরো একবার সেকেলে প্রমাণিত হবো।

পুরোপুরি হইনি যদিও, কারণ আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থিতু হবো এগুলো বলবো না এখন। যোগাযোগের সেতু তৈরি হলে... হয়তো... হয়তো না।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের মেইল করার আয়ু আমরা এক রাতের সব মেইলেই শেষ করে ফেলেছি। সেজন্যেই আর কথা হলো না, সেজন্যেই আর যোগাযোগ হলো না। মাঝে মাঝে আমার কাছে সবকিছু অবাস্তব মনে হয়, স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়...

মেইল পেলে শুভেচ্ছা নিবেন। আর না পেলে বাতাসে সেই আন্তরিক শুভেচ্ছাটা পাঠিয়ে দিলাম। মেসেজ ইন আ বটল!






রাইন


-০-০-০- -০-০-০- -০-০-০-
.
.
.
.
.
ডিসেম্বর ১০, ২০০৯ রাত ১:৩৪


Mail Delivery Subsystem

To: rayeen.****@gmail.com

This is an automatically generated Delivery Status Notification

Delivery to the following recipient failed permanently:

niyontee.****@gmail.com

Technical details of permanent failure:
DNS Error: Domain name not found

- Show quoted text –







***

(সমাপ্ত)


২২/১/১০~২৮/১/১০

শনিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১০

ঘুণ ও দুপুর

ঘুণের জীবন নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। তাদের সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ইতিহাসও তেমন সমৃদ্ধ নয়। এমনকি পরজীবী হিসেবেও, তারা আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। তাদের প্রকৃতি-প্রত্যয়, ক্রিয়া ও অব্যয়, সমূহ সমূহ বিদ্যা!


যেভাবে খুব সন্তর্পণে এক ঘুণচলন মগজের কোষে শুরু হয়। ডাক্তারবিদ যা বললেন, সেটা ছোটখাটো রসায়ন। দুইপাতা পড়লেই জানা যায় আমার মগজের কোন কোন কোণে বেঁধে গেছে রণকৌশলে মত্ত দুই বাহিনীর- নেতা ও নেত্রীর। ঘুণের কাজ তবু কেটে কেটে ছবিগুলোর ছাই জমানো, তুষ জমানো। নিরীহ!


মগজে সেগুলো জমা হলে পরে, ডাক্তারবিদের জবাব থাকে না। সেখানে যাবতীয় সম্পত্তি, স্থাবর এবং অস্থাবর, নিখোঁজ হতে থাকে। ফাঁকা হতে থাকে তামাদি দলিল- মন হারানোর সকাল, স্মৃতিভ্রষ্টের আকাল, প্রিয় গীত ও ক্রন্দন! ঘুণের কাজ বড়ো সুচারু। ডাক্তারের সূঁচের ভেতরে আমার মগজের এক টুকরো সরসর সাপের বিষের মতো উঠে আসে। গোল সিরিঞ্জে জমা পড়ে বিবিধ পীতঃ!


পীতাভ দুপুরগুলো এই জনপদ থেকে ক্লিনিকে কুমারীর জরায়ুতে আটকে গেছে। সেখানে ভ্রূণের মগজে ঘুণের মতোই, দুপুর বাড়ে। আহঃ মাইটোসিস!






------------------------------
উৎসর্গঃ আকাশচুরি অথবা তারিক স্বপন

মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১০

অপমেঘরূপকথা

আপনার শরীরের ভাঁজের মতোই পরতে পরতে দ্বিমাত্রিকতা এখানে। ধীরে আসুন, সন্দেহে আসুন, অবশ্যই সতর্কিত অবস্থানে




কতোকিছুই তো হারিয়ে ফেলি,
অনায়াস দক্ষতায়।
কতোদিন হয়ে গেছে,
আমি হারিয়ে যাওয়া দ্রব্য আর
দ্রব্যমূল্যের লিস্টিখানাও হারিয়েছি।
তারপর আবার নতুন লিস্টির উদ্যমে
শুরুতেই লেখেছি গত-লিস্টের নামটি।
তার নিচে জ্বলজ্বল করছে
অধুনালুপ্ত দুখের বালিশ আর প্রচণ্ড বিষাদ!




তোমার মুখের রেখায় আজ তিনটে চুল এসে পড়লো,
চকিত হুটোপুটি খেললো
নোনা-মেঘ-ঘোলা-রোদ।
রূপকের আজন্ম শোধ।
তারপর মেঘের পালকে
উড়ে গেলো বিবর্ণ শৈত্য-
এক ঝাঁক অতিথি পাখির ল্যাজে ঝুলে বেখেয়াল যুগ্মঘুম।




আজকের ডায়েরিতে
(কী চমৎকার! দেখো আমি আবারও ডায়েরি-মজ্জায় মজে গেছি!)
অবলীলায় তোমার চোখের পাঁপড়ি দুটো সেঁধিয়ে গেলো।
এতো গভীরে যে আমি আর সেগুলো খুঁজেই পেলাম না।
দৈনন্দিন ভাঁজে হারিয়ে গেলো মদির কালো পাঁপড়ি।
ফেব্রুয়ারি কি মার্চের দশ-বারো তারিখে হয়তো টুপ করে
ফিরে আসবে তারা!


কতোকিছুই তো হারিয়ে ফেলি...




রূপকথার বই খুললেই দেখি
ভেতর থেকে
রাজা ও রাণীদের হাড় ঝুলছে,
এই জনপদে
কোনো রাজা নেই, মন্ত্রি-পেয়াদাগণ
ধীরে ধীরে
বেতনভাতা হারিয়ে ঠকঠক কাঁপছে
বৈশ্বিক উষ্ণতায়;
নাকি ভয়ে? নাকি অযথা শঙ্কায়?
রাজকন্যাদের রূপ ও কমনীয়তা খুলে নিয়ে
গেছে কোটালপুত্রের ক্রুর-পেশল-মুঠি। তাদের
দাঁতের ভেতরে রাজকন্যার চুল ও ত্বক,
মুখ ও চোখের টুকরো টুকরো গেঁথে আছে,
লেগে আছে। বড়ো নগ্ন সুন্দর সেইসব
অপরূপকথা ছায়াচিত্র!




এই শহর যতোই সুউচ্চে চুম্বন কাতর শীৎকারে উঠে যাচ্ছে
বিশ-তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ তলা, খোপ খোপ বহুতল প্রাসাদোপম
উচ্চতায়। ততোই মেঘদল নেমে আসছে, নুয়ে আসছে
আমার ভ্রান্তিবোধে ধরা পড়ে চিল ও শকুনেরা এখন
ঠোঁট বাঁকালেই টপাটপ আমাদের পুতুলের মতো ঠুকরে ফেলবে!
তাই আমরা মাথা নুয়ে চলি, ঝুঁকে ঝুঁকে চলি, পারলে মাটিতে
মিশে ও রাস্তায় শুয়ে চলতে পারলেই স্বস্তি পাই। উপরের দালান
আমাদের পেটের ভেতরে উদ্ভিদের শেকড় ঢুকিয়ে দিচ্ছে খুব!
রোজ এক প্রস্থ শেকড় আমাদের জন্ম-নাভিমূলে ঢুকে যায়, হায়
আমরা নির্ঘাৎ শিশ্নপ্রবেশিউন্মূল আনন্দ পাই!


ভবনের দর্শনকাম জমে জমে মেঘে উঠে যায়- মেঘদল
বয়ে চলে থরথর পশুবোধ ও কোমল ধবল অমল রেতঃ




এই শীতে মৃতরোদের নিঃশ্বাসের জন্যে আমাদের শোকবার্তার পাতাগুলো ভরে উঠবে।


মেঘেরা নিশ্চল।


আমরা জমে যাওয়া বাসস্টপে অনন্ত অপেক্ষায় হঠাৎ মুখ তুলে দেখি-
উপরে, অনেক উপরে (অথবা চোখের পাতার কাছেই)
একগুচ্ছ শাদা হাড় ও কিছু কিছু শরীর ঝুলে আছে।
কালো শরীরগুলো প্রবল শীতার্ত গ্লোবালায়নে
শাদা হয়ে গেছে। নির্দোষ প্রশ্নঃ


ওরা কী মাখে?
ওরা কী খায়?
মানে, ওরা কী খেয়েছিলো?
ঝুলে ঝুলে কেনো তারা নির্বাক এমন?


আমাদের বাস আসে না।


ভীড় ভীড় রাস্তায় একটা স্টপেজ লাইট জ্বলতেই থাকে। জ্বলতেই থাকে।

শনিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১০

তুমি জানবেও না যে এই লেখাটা তোমায় নিয়ে...

আ,


ছোটবেলায় আমি একবার দৌড়ের রেসে নেমেছিলাম। অনেক প্রাণপণ দৌড়ে নিঃশ্বাসের শেষবিন্দুতে পৌঁছে দেখি আমি হেরে গেছি আরেকটা ঢ্যাঙা ছেলের কাছে। সেদিন ফিনিশিং লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আমার অনেক কান্না পাচ্ছিলো, ছোট ছিলাম। আবেগী ছিলাম। এখনও হতচ্ছাড়া আবেগ আমায় ছাড়ে না। সেদিন থেকে হারতে বড়ো কষ্ট হয় সবসময়।


 ২
বছরের বিশেষ দিনগুলোতে আমাদের কখনোই দেখা হয় না! এটা খুব অদ্ভুতভাবে তুমি একদিন বললে, কী নিয়ে যেনো আমাদের মধ্যে খুটখাট লেগে গেলো আর তুমি বললে, খুব ক্লান্ত স্বরে, যেন এই কথাগুলো বলতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে! বললে, “তুমি কি খেয়াল করেছো যে আমরা কোন উৎসবের দিনে, আয়োজনের দিনে, দিবসগুলোতে দেখা করতেই পারি না!” আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম হয়তো, তাই ভেবে দেখলাম যে আসলেই পারি না। কিন্তু এটা নিয়ে বলার কিছুই ছিলো না। দেখা না করার কারণ আমরা হইনি কখনো। পরিপার্শ্ব আমাদের কতোভাবে বেঁকেচুরে দেয়। সহস্র আকাঙ্ক্ষার গলা পরিস্থিতির চাপে বুজে আসে অনায়াসে, যেনো কোনো বাগানের মালি গাছে পানি দেয়ার নলটা অনায়াসে বুজে দিলো!


এক একটা বছর যায় আর আমি অবাক হই, কীভাবে বিস্তর বিস্তর স্মৃতি জমা হয়। আমি জন্মের পর থেকে এক একটা স্মৃতির ঘর বুনছি। কত হর্ষ, বেদনা আর বিরহ জমা হয়ে আছে, অমলিন আর্কাইভের মতো। কিন্তু তুমি এলে আর এসব ঘরের চাবি হারিয়েই ফেললাম আমি। টেরও পাই না যে সেই দুঃস্মৃতির ঘর আমার বুকের ভেতরে এখনও আছে!


দুর! আজকের দিনে কেনো আমি এসব বলছি। কিন্তু জানো তো, আমি কেমন মেলাঙ্কলিক-অ্যালকোহলিকের মতোন। মাঝে মাঝে রেট্রোস্পেক্টে নিজেকে দেখি, আর ভাবি আমি কীভাবে খাদের একটু পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে এলাম। তুমি সামনে ছিলে নিয়ত ঘূর্ণির বছরটা জুড়ে ছায়ার মতো একই গতিতে ঘুরেছি দু’জনেই। এতো দ্রুত দিনগুলো পেরিয়েছে যে মাঝে মাঝে টের পাই নিঃ আমি অনলাইনে একজনের সাথেই কথা বলছি, রোজ রোজ। প্রতিদিন। তুমিও খেয়াল করেছিলে? আমি কতটা অপেক্ষা করতাম, অপেক্ষার মুহূর্তে কী ভাবতাম এখনও সব জানি।


ঝকঝকে দোকানটার চেয়ারগুলো ঠাণ্ডা ছিলো, সেটা শীতের জানুয়ারি ছিলো। আমি কাঠ হয়ে বসে ছিলাম আর তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তুমি একটা নীলচে বেগুনি জামা পরে আসলে, জামায় শাদা শাদা ফুল। এসে সামনের চেয়ারটা টেনে বসলে আর আমি জমে গেলাম। আমার হাতে একটা প্যাকেট ছিলো, প্যাকেটের ভেতরে পোকা ছিল। পোকা না, একটা ঝিনুক ছিলো। ছোট প্যাট্রিফায়েড ঝিনুক। ঝিনুকটা একটা চাবির রিঙের ভেতরে সারাজীবনের জন্যে আটকা পড়ে গেছে! আমি সেই প্যাকেটটা তোমার দিকে ঠেলে দেয়ার সময়ে একটু একটু কাঁপছিলাম মনে হয়। সেদিন তো বুঝি নি, সেই প্যাকেটের ভেতরের চাবির রিঙে আমার সবটুকু বাঁধা পড়ে গেছে…


তোমার সাথে এর পরে আমার যতোদিনই দেখা হয়েছে, আমি সেই কম্পনটা টের পেয়েছি। এটা কোনো বলার মতো বিষয় না, বরং হয়তো দুশ্চিন্তার বিষয়। আমি নিশ্চয়ই উদভ্রান্ত অসুস্থ কেউ! নাহলে কেনো আমি এমন সম্মোহিত হবো, কেনো একজনের চোখের দিকে তাকালে আমার আর কোনোকিছুই ভালো লাগবে না– তাকে ছাড়া। কেনো কারো খিল খিল হাসি শুনলে আমি মোবাইল কোম্পানিকে ধন্যবাদ দিবো আর সারাজীবনের জন্যে চার্লি চ্যাপলিনের চেয়ে বড়ো কমেডিয়ান হয়ে যাবো! কেনো সে ব্যস্ত আর পাঁচ মিনিটের বেশি দেখা করতে পারবে না জেনেও আমি ঠা ঠা রোদ্দুর অনায়াসে মাথায় মেখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো! এতোসব কেনো বড়ো অস্থির করে আমাকে!


আমি জানি তুমিও আমার মতোই কাঁপো। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি এই খেলাঘরে তুমি আমার চেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসো। নিজের ওপর দাবি ছেড়ে দিয়েছি সেদিনই, চাবির রিঙের সাথে তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম স-ও-ব!
এই প্রথম আমি হেরে গিয়ে অনেক খুশি হয়ে গেছি। এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই। মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে…


শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১০

স্পর্শবিজ্ঞান

তোমাদের যেখানে মন চায় চলে যাও, আজ আমি কোথাও যাবো না। আজকের দিন হোক কেবলই আমার নিজেকে নিয়ে। আমি নিজের ভেতরে খুঁড়ে দেখবো কতোটুকু তোমরা ছুঁতেও পারো নি। আমি এতোদিন আগলে রাখতে পেরেছি! এতো এতো সংগ্রাম অর্থবোধক ভীষণ, আমি কাউকে ছুঁতেও দিবো না সেই কয়েকটুকরো হৃদয়ের জমিন।


কাউকে স্পর্শ করার কামনা কতোটা তীব্র হতে পারে? এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি কখনই ভাবি নি। আর ভাবি নি বলেই আমার জানা নেই স্পর্শ করার আকুতিতে মনের ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। বেশি না। শুধু হাতের আঙুলের আলতো ছোঁয়ার ইচ্ছার শক্তি এতোটাই! আমার বুকের ‘পরে পাথরের মতো চেপে বসতে পারে। মনে হতে থাকে চারপাশে কোথাও কোনো বাতাস নেই। আদিগন্ত ভ্যাকুয়াম। জ্যাজ!


তাই সেদিন থেকে আমি জানার চেষ্টা করি স্পর্শকামনা কেমন। ঠিক কতোটা বিচিত্রভাবে কাউকে স্পর্শ করা যায়! আমি কি শুধু হাসি দিয়ে কাউকে ছুঁয়ে দেয়ার দুরূহ কাজটা করতে পারবো? মুখের হাসি, চোখের হাসি, এগুলো শুনেছি প্রবল সংক্রামক। এক চিলতে হাসি অনেক সময় তলোয়ারের মতো ঝিকিয়ে উঠতে পারে। এই সত্য সম্ভাবনা, কারণ আমি এমন অসংখ্য হাসির কোপে কাটা পড়েছি অনেকবার। বহুবার! তারপর, অবাক হয়ে দেখেছি আমার ভেতরে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর কণার মতো ক্ল্যামেন্টাইনের হাসিমুখ। অথবা সুনয়নার, অথবা রাত্রির, হয়তো তোমার!


আমিও হয়তো ওর মতো, ওদের মতো হাসিতে স্পর্শ করতে পারবো যেমন আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে! তাই সেদিন থেকে আমার দিন রাত অবিরাম হাসিহুল্লোড়ে ভরে উঠলো। খলখল-ট্রেনে চেপে বসলো হাসির অমেয়কণিকা আমার… আমি বিস্ময়ে দেখি তারা কী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। তুমি দেখো না? তোমরা দেখো না? আমি আজ ঘরের ভেতরে গুটিশুঁটি খুব হাসছি অবিকল সেই শিশুটির মতো।
শিশুদের কথা আর না বলি? শিশুরা মোটেই ভালো নয়, তারা আমাকে ভুলে যাবে আর কিছু দিন পরেই। আমি জানি। সবাই তাদের বড়ো হয়ে ওঠার গল্প করবে আর এক ফাঁকে টুপ করে ঝরে পড়বে আমার একলা ঘরে বসে থাকার গল্পটা। ধুলোয় মিশে মিশে ওটার চেহারা আর চেনাই যাবে না। তারপরে একদিন জমাদারের ঠেলাগাড়িতে করে আমি হারিয়েই যাবো নির্ঘাত! উহ!


ওই ক্লিষ্ট খিন্ন মুখের দল। হা করে না থেকে আমার কথা শোনো। কান পেতে শোনো আমি হাসছি গ্রামারবিহীন। তোমরা বিরক্ত না হয়ে খেয়াল করলেই দেখবে আমার হাসির শব্দ আর গমক তোমাদের কোষে কোষে ঢুকে গেছে। অমল শিশুগুলো হাসছে, তাদের ওপরে আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ নেই কিন্তু!


কিন্তু আমি আদতে চাইছিলাম কাউকে স্পর্শ করতে, এমনভাবে ছুঁয়ে দিতে যেন সে একটুকরো রুমালের মতো আমার ছোঁয়াটুকু নিয়ে চলে যেতে পারে। সে আমাকে ভুলে গেলেও তার ভেতরে, বাইরে আমার দেয়া আঙুলের ছাপ থাকবে। ছাপ মুছে গেলে উত্তাপ থাকবে। উত্তাপও যেদিন চলে যাবে সেদিন হয়তো আমিই থাকবো না, তাই না?


কলমে আর পেন্সিলে লিখছিলাম। কাগজ আর শীষের শীর্ষের কত গভীর ছিনিমিনি প্রেম। আঠারো আর একুশের প্রেম যেমন! ষোলো আর বিশের প্রেম যেমন। চকিত আর ক্ষণিকেই বুকে গেঁথে ফেলে একশ’ গোলাপ। সুবাসটুক বুক পকেটে নিয়ে অযথাই একুশ আর বিশ ঘুরে বেড়ায়। আঠারো আর ষোলোর কামিজপ্রান্তে তাদের গুমখুনের খবর কেউ জানতে পারবে না। কোথাও কোনো মামলা দায়ের হবে না। খালি বাদী-বিবাদীরা নিরন্তর ক্ষয়াটে এই গ্লোবে আরেকটু সবুজ হয়ে উঠবে। আরেকটু নীল করে তুলবে আমাদের আকাশ। কলম-পেন্সিল আরও কতো কী করে কাগজের বুকে। আমার অক্ষমতা যে আমি তা পুরো বুঝে উঠতে পারি না কখনোই!…