শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

ডু নট ডিসটার্ব মাই সার্কেলস

খ্রিষ্ট জন্মের দুইশ বারো বছর আগে, সাইরাকুস নগরীতে কিছু রোমান সৈন্য ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়, তাদের সেনাপতি ছিলেন মার্কাস ক্লডিয়াস মার্সেলাস। প্রায় দুই বছর অবরোধ করে রাখার পরে রোমান পক্ষ জিতে গেছে, ঢুকে পড়েছে সাইরাকুস নগরীর ভেতরে।


এক বৃদ্ধ কিছু গাণিতিক সরঞ্জাম নিয়ে গভীর মনোযোগে কাজ করছিলেন কোন অজ্ঞাত গাণিতিক সমস্যা নিয়ে। তাঁর চারপাশে ছড়ানো ছিলো বেশ কিছু বৃত্তের আকৃতি। রোমান সৈন্যদল সেগুলো তছনছ করে তার দিকে এগিয়ে এলে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, "Noli turbare circulos meos" ("Do not disturb my circles")। সৈন্যদের নেতা তাঁকে এই দম্ভোক্তি ও অসম্মানের অপরাধে সেনাপতির কাছে ধরে নিয়ে যেতে চাইলেন। বৃদ্ধ তখনও গাণিতিক সমস্যায় মগ্ন, তিনি যেতে রাজি হলেন না। ক্রোধে মত্ত সৈন্যদলের নেতা তার তীক্ষ্ণ তলোয়ারে মুহূর্তেই মেরে ফেললেন পয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধকে!


বৃদ্ধের নাম ছিলো আর্কিমিডিস। প্রবল প্রতাপশালী রোমান সৈন্যদের চাইতেও যাঁর কাছে নীরিহ বৃত্তগুলো জরুরি ছিলো!




খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার চার বছর পরে ঢাকা নগরীতেও উন্মত্ত চাপাতির কোপে আক্রান্ত হলেন আরেকজন গবেষক, বিদ্যানুরাগী, কবি। সেই বছরেই, মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস পর তিনি মারা গেছেন। তাঁর কাছেও ধর্মান্ধ, গোঁড়া, প্রতিক্রিয়াশীল হায়েনাদের চেয়ে জরুরি ছিলো রাড়িখাল, ফুল, কবিতা, বাঙলা ভাষা, বাঙলাদেশ*!


আজ বুদ্ধিবৃত্তির বিরুদ্ধে ধর্মান্ধের এই আক্রমণের দিনেআপনাকে স্মরণ করছি, প্রিয় হুমায়ুন আজাদ। আপনি যে বাংলাদেশ দেখে শিউরে উঠেছিলেন, আমরা সেই বাংলাদেশেই স্মৃতিহীন ও বিকারহীন হয়ে বাস করছি।






***




[*হুমায়ুন আজাদের লেখায় বাঙলাদেশ বানানটি অক্ষত রাখা হয়েছে]

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

নির্বাণ



মানুষকে বোবা করে তোলার সব প্রক্রিয়া যখন সমাপ্ত, তখন তাদের মাঝে এক ধরনের মিশ্র ক্লান্তি দেখা যাবে। অবয়ব পরিষ্কার নয় বলে তারা ঠিক কতোটা ক্লান্ত, সেটা আমি বুঝে উঠতে পারি না। স্যরি, আমি খালি নিজের কথা বলি। বাকিরাও বুঝে উঠতে পারে না। আমি এবং বাকিরা, আমরা সবাই তাদের মুখের রেখা পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো লাভ নাই, শালাদের মুখই নাই, তার আবার মুখের রেখা? ধুস! রেগেমেগে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা করে আমাদের। এরকম ধ্বংসযজ্ঞ অনেকবার করেছি আমরা, চারপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলেছি। তারপরে অনেক ভাঙচুরের পরে আমরা শান্ত হয়েছি। মাথা ও রক্ত ঠাণ্ডা হলে খেয়াল করেছি যে এইসব ভাঙচুর করে কোনো লাভ হয়নি। তাদের টিকিও স্পর্শ করা যায়নি, তারা বহাল তবিয়তেই আছে- আমাদের দিকে মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিটাও স্পষ্ট নয়। ঐ যে বললাম, তাদের অবয়ব দেখা যাচ্ছে না ঠিকঠাক।


এই কারণে আমরা বারবার হেরে যাই- আমাদের পরাজয়ের পেছনে কোনো রণক্ষেত্রের বিশ্বাসঘাতকতা দায়ী নয়- যেটা ঘটেছিলো প্রাগৈতিহাসিক পুরাণের পলাশী-পরিচ্ছেদে। অথবা সম্প্রতি ইতিহাসে সংকলিত রক্তবিষ-শুয়োরদের ছদ্মবেশী আক্রমণপন্থাও আমরা এখন ধরতে পারি। এই পন্থায় আমাদের অনেক ভয়ানক একটি পরাজয় ঘটেছিলো- প্রাগৈতিহাসিক পুরাণের বঙ্গ-পরিচ্ছেদে। আমাদের শৈশবেই এইসব প্রাগেতিহাস পড়ানো হয়। এগুলো থেকে আমরা ভ্রান্তিমোচনের উপায় এবং কৌশল শিখি। তথ্যগুলো একটা রঙিন সিরিঞ্জে ভরে আমাদের ঘাড়ের একটু উপরে, নরম গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বেশি ব্যথা লাগে না চেতনানাশকের প্রভাবে, তবে একটু ঝিমঝিম করে। সিরিঞ্জগুলো রঙিন করা হয় যাতে শিশুরা ভয় না পায় সেজন্যে। সিরিঞ্জ পুশ করার পর একদিন সেই গাঢ় রঙ আমাদের চোখের রং বদলে দেয়। দূর থেকে দেখলেই বুঝা যায় কারা কারা এখন বঙ্গ-পরিচ্ছেদ, বা পলাশী-পরিচ্ছেদ, বা পাকি-পরিচ্ছেদ, বা কোম্পানি-পরিচ্ছেদ নিয়েছে। এগুলো নিয়ে এখন আমরা আর তর্কও করি না- সবাই সঠিক অভ্রান্ত প্রাগেতিহাস জানলে সেটা নিয়ে কথা বলা বাতুলতা। আমরা বাতুলতায় সময় নষ্ট করি না।


রণক্ষেত্রে যারা এবারে খুব চৌকস রণ করেছেন তারা মিশমিশে কালো হয়ে গেছেন, কারণ তারা কালো রঙের সিরিঞ্জে করে স্মৃতিনাশক ঢুকিয়ে দিয়েছে। এদের চোখ তো চোখ, হাত-পা-মুখ-চুল-ত্বক-আঙুল-বুক-পেট-লিঙ্গ সবকিছু কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। খুব খেয়াল না করলে এদেরকে মূর্তি বলে মনে হয়, যারা খুব দুর্দান্ত রণকৌশল দেখিয়েছেন। এরা কথা বলতে পারে না এখন। সেটাই বলছিলাম শুরুতে- যখন আমরা মানুষরা বোবা হয়ে যেতে শুরু করি তখন তাদের সম্ভবত ক্লান্ত লাগে। বোবা ও অথর্ব আমাদের চোখের ভেতরে সাদা অংশটি কালো হয়ে গেলে তারা হেসেও ওঠে জোরে। সেই হাসি বোবা মানুষেরা, আমরা শুনতে পাই, তবে ঠাহর করতে পারি না। কী করে করবো? আমাদের তো চোখের ভেতরে কালো রঙ!


হেসে উঠে তারা একটি তালিকা ধরিয়ে দেয় মূল-বোবার হাতে। শুধু মূল-বোবা'ই তখনও চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি তালিকাটিতে চোখ রাখেন। পড়ার সাথে সাথে তার মাথার পেছনের নরম গর্তে লাগানো ধ্বনিযন্ত্রে শব্দগুলো জোরে জোরে উচ্চারিত হতে থাকে। তালিকায় লেখা আছেঃ




=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+==+=+=+=+=
______সকল কৃতজ্ঞতা তাঁর! সকল দায়িত্ব তাঁর!______


___আজ আধুনিক পুরাণের দশম বছরের দ্বাবিংশতিতম দিন।___


মানুষকে আমরা পরাজিত করেছি অত্যাধুনিক রণক্ষেত্রে তিনদিনব্যাপী রণ সম্পন্ন করে। এখন তাদের আটককৃত দক্ষ যোদ্ধাদের সকলকে কৃষ্ণমধু দিয়ে নিরপেক্ষ সত্ত্বায় পরিণত করা হয়েছে। কৃষ্ণমধু দেয়া হয়েছে চোখ-হাত-পা-মুখ-চুল-ত্বক-আঙুল-বুক-পেট-লিঙ্গ ইত্যাদি অঙ্গে। সেইসাথে বর্ণিত হলো কেন তাদের অধিকার নেই, কেন তারা কালো হয়ে গেলেন, কেন তারা বোবা এবং কেন সকল ক্ষমতা হারালেন-


১. চোখে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা আর কখনোই সত্য দেখতে না পান। এখন থেকে তারা কেবল সেই ছবিই দেখবেন যেটি আমরা দেখাবো।


২. হাতে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা স্বেচ্ছায় কোন ক্রিয়া করতে না পারেন। এই সাথে হাতের সকল অনিচ্ছাকৃত কার্যও নিষিদ্ধ হলো।


৩. পায়ে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা কোথাও হেঁটে যেতে না পারেন। এখন থেকে তাদেরকে নিতম্বের ওপর ভর দিয়ে গোড়ালির সাহায্যে চলাচল করতে হবে।


৪. মুখে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা কোন নিজস্ব বক্তব্য রাখতে না পারেন। কথা ও শব্দের সকল অধিকার রদ করা হলো।


৫. চুল, আঙুল ও ত্বকে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা পরষ্পরকে স্পর্শ করে কোন তথ্য পাচার করতে ও যূথবদ্ধ হতে না পারেন। মধুর প্রলেপের কারণে তারা এখন সম্পূর্ণ শরীরে ও মনে বিচ্ছিন্ন থাকবেন।


৬. বুকে মধু দেয়া হয়েছে যাতে আত্মা ও হৃদয় বলে বহুল প্রচারিত প্রপঞ্চটি দমন করা যায়। যেহেতু সঠিক নিয়মে আত্মা ও হৃদয়ের অবস্থান নির্ণয় করা যায়নি, সেহেতু আমরা নিকটবর্তী হাইপোথিসিসটি মেনে নিয়েছি।


৭. পেটে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা সর্বসময় ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দূরীভূত থাকেন। নিবৃত্তির বশবর্তী হয়ে প্রাগৈতিহাসিক রণসমূহের কোনো পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।


৮. লিঙ্গে মধু দেয়া হয়েছে যাতে সেগুলো বাইরের কোনো উদ্দীপনা বা ভেতরের লিবিডোর থেকে মুক্ত থাকে। অতীতে অতিপ্রজননশীল মানুষ নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শনের সংখ্যা ছাড়িয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিলো। সেটি বন্ধ করতে এই নতুন উদ্যোগ।


একটি সুসভ্য, সুষ্ঠু, নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠি আমাদের সকলেরই কাম্য। সেই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে মানুষের ভবিষ্যত সংরক্ষণে আমরা সদা তৎপর। সকল বিভ্রান্তি ও দ্বিধা এড়িয়ে যারা আমাদের সাথে রণে সাহায্য করেছেন- তারা বন্ধু, সহযোগী ও সাথী। তারা অবশ্যই তাঁর (সকল কৃতজ্ঞতা তাঁর! সকল দায়িত্ব তাঁর!) কৃপা পাবে।


=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+==+=+=+=+=


পুরো তালিকাটি পড়া হলে মূল-বোবার হাত থেকে তারা সেটি কেড়ে নিলো। মূল-বোবার কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে তার চোখের সাদা অংশটি কালো হয়ে উঠলো কৃষ্ণমধুর প্রভাবে। আমরা বাকিরা একটা ধপ করে শব্দ শুনলাম। তারপরে হিস হিস করে শব্দ হতে থাকলো। আমরা সবাই যদি দেখতে পেতাম তবে দেখতাম যে মূল-বোবার নিথর ধড় ইলেকট্রিক শক দেয়া ব্যাঙের শরীরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ধপ করে খসে পড়েছে তার কালো চুলসহ মাথাটা।


যেন পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে সেটা একজনের পায়ের কাছে এসে থামলো।
যেন কোন ব্যারাকের কালো নর্দমায় সেটা ভেসে উঠলো তিন দিন পরে।
যেন কোন বধ্যভূমিতে গণকবর খুঁড়তেই লাফিয়ে বেরিয়ে এলো সেটা।
যেন কালো শীতল নদীতে সেটা আলতো করে ভেসেই যাচ্ছিলো।
যেন পিচের ঢালু রাস্তায় তপ্ত দুপুরে সেটা গড়িয়ে যাচ্ছে।
যেন লাঠির আঘাতে কারাগারের অন্ধকুঠুরিতে সেটি গুমরে মরছে।
যেন কোন জমিদারবাড়ির পেছনের বনে কতগুলো তলোয়ার তাকে টুকরো করেছে।


তার খোলা ভোকাল কর্ড আর ঘাড়ের ভেতর থেকে হিস হিস করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। মেঝের পুরো মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠলো। আমরা যেখানে বসেছিলাম, আমাদের পায়ে, পাছায়, হাতে লাল রঙ লেগে গেলো। আমরা যদি ত্বকে কোন অনুভূতি পেতাম, তবে আমরা গরম রক্তের অনুভব পেতাম। আমরা যদি কথা বলতে পারতাম তাহলে আমরা চিৎকার করে উঠতাম। আমাদের চোখের সামনে এভাবে মূল-বোবা'র মাথা কেটে ফেলার আগে বাধা দেয়ার চেষ্টাও করতাম। মূল-বোবা হয়ে ওঠার আগে তার একটা সুন্দর নাম ছিলো- সেই নাম ধরে আমরা শ্লোগান দিতাম, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। আমাদের হাত-পা কালো না হয়ে উঠলে আমরা দৌড়ে যেতাম তাদের দিকে, বাধা দিতাম নিশ্চিত!


কিন্তু আমাদের চোখের ভেতর, মাথার ভেতর, মুখের ভেতর, হাতের ভেতর, পায়ের ভেতর ঘোর ঘোর কালো। তারা না চাইলে আমরা আমাদের লিঙ্গও উত্থিত করতে পারবো না। তাদের কী মনে হলো, তারা চাইলেন আমরা যেন একটু হাসি। অমনি আমাদের মুখে মুচকি মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। দেখা গেলো মূল-বোবার ধড় ছটফটানি কমিয়ে দিয়েছে, মাথাটা তখনও আমাদের একজনের পায়ে লেগে এদিক ওদিক দুলছে। রক্তের বেগ কমে গেছে। থিকথিকে ঘন কালচে রক্তের মাঝে বসে আমরা অল্প অল্প দুলছি এবং হাসছি।






তারা নিশ্চয়ই মহান। তারা নিশ্চয়ই প্রতিভাবান। তারা নিশ্চয়ই সুসভ্য। তারা নিশ্চয়ই আমাদের ভালো চান। মূল-বোবার মাথাবিহীন ধড়ের পাশে রক্তে ভিজতে ভিজতে আমরা এই ধরনেরই একটা প্রবল বোধিলাভ করি!




***

শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

যোগাযোগ

জানালার কাচের ওপর আমি ডান হাত রেখে বসে আছি। আমার পাশে একটা কালো কাচ। কাচের তাপমাত্রা খুব কম। হাতের আঙুলে ঠাণ্ডা লাগছে। বাইরে শিশির পড়ছে। কে বলেছিলো কাচ আসলে তাপ কুপরিবাহী? তাহলে আমার শীত লাগছে কেন! আমি হাত সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবলেও সরাই না। আঙুলের ডগা কেমন অবশ হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ কী হলো, আরেকটা হাত এসে কালো কাচটার ওপাশে ঠিক আবার হাতের মধ্যে এসে পড়লো। আগেই বলেছি, কাচটা একেবারে কুচকুচে কালো, তাই আমি ঠিক মতো দেখতেও পারছি না ওপাশে কে আছে। খালি অন্ধকারের মাঝ থেকে একটা সাদা হাত দেখা যাচ্ছে। সেটার আঙুলের সাথে আমার আঙুলগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো আমার হাতে আবার সাড় ফিরে আসছে।




আমি পিয়ানোর রীডে বাজনার মতো আঙুলগুলো নাড়ালাম। টুং টাং। কোনো শব্দ নেই তবুও আমার মনে হলো কিছু একটা সুর বেজে উঠলো, কোনো টান টান তারে স্পন্দন জাগলো, চকিতে উপ্ত হলো কোনো আলতো উচ্চারণ। শব্দ এক প্রকার শক্তি যা বায়ু, তরল ও কঠিন মাধ্যমের সাহায্যে চলাচল করে। কাচ এবং আমার আঙুলের মাঝে তেমন কোনো সম্পর্কই ছিলো না একটু আগে। ওপাশে হাতের পরশ এসে দাঁড়ালো আর সুরগুলো, কথাগুলো সশব্দ হয়ে উঠলো। আমার টুং টাং দেখেই কি না জানি না, ওপাশের আঙুলগুলোও নড়ে উঠলো। খুব অল্প সময়ের জন্যে। নাকি আমি ভুল দেখছি? টিং টি টি টুং! টিং টি টি টুং! জগতে কতো আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! এই যে আমি একা একা বসে ছিলাম, আমি আর আমার হাত, আর একটা শান্ত শীতল কাচ। আর কেউ ছিলো না, এখনও তেমন কেউ নেই। তবু একটা নাম-পরিচয়হীন হাত এসে আমার সাথে মিশে গেছে। এখন কেমন অপার্থিব শ্রবণ-মধুর সুর বেজে উঠছে। মনোটোনাস একাকিত্বের মাঝে সিঙ্গেল টোন...!




একটু অপেক্ষা করে আমি হাতের ভাঁজ মুঠো করলাম। তেলোর অংশ তখনও কাচের ওপরে লেগে আছে। ওপাশের হাতটি মনে হয় একটু বিভ্রান্ত হলো, একটু ভেবে-চিন্তে তার দুটো আঙুল ভাঁজ হয়ে এলো। অনামিকা আর কনিষ্ঠা। বাকি তিনটে আঙুল একা একা নড়তেই লাগলো, দুলে দুলে। আমার ভালো লাগছিলো হাতটির এমন খুশি খুশি নাচ দেখে। ওভাবে কাচের ওপরে ঝুলে থেকে এমন নাচ আমি আগে দেখিই নাই কখনও! সে'ও হয়তো একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, দেখলাম কব্জির নিচে সবুজ রগ দুটো ফুলে ফুলে উঠছে কেমন অশান্ত ঘোড়ার মতো। সাদা ধবল বকের মতো হাত, তার মাঝে সবুজ ঘাসের মতো দুটো রগের আভাস। ওপরে লালচে তালু আর চিকন তিনটে আঙুল নাচছে তাথৈ। আমার যেনো হঠাৎ করেই অনেক ভালো লাগতে থাকলো। মন ফুরফুরে হয়ে হালকা পালক হয়ে গেলো। সেই একলা ঘরের ভেতরে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো। আমি খুশিতে মুঠো খুলে সেই তিনটা আঙুলকে ধরতে চাইলাম, ছুঁতে চাইলাম। কাচের কালো রঙ হুমকি দিলো, খবরদার! ওকে স্পর্শ করার কোনো অধিকার তোমার নেই!




আমার কী যে হলো হঠাৎ, একা একটা ঘরে অনেক সময় থাকার কুফল মনে হয়, আমি খুব ক্ষেপে উঠলাম। রেগে গেলাম হুট করেই। তারপরে খুব জোরে কাচের গায়ে আঘাত করলাম। একটা ধপ করে শব্দ হলো বিদঘুটে। কিছুই বদলালো না। ওপাশের তিনটা আঙুল এখন বেঁকে মুচড়ে যাচ্ছে। কাচের কালো রং সেই আলতা লাল আঙুলের মাঝের দাগে ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে! আমার বিপন্ন লাগছে আমার মাঝে দানা দানা ক্ষোভ জমা হচ্ছে। আমি আরো জোরে কাচের ওপর মুঠো দিয়ে মারলাম। আরো একবার। আরো একবার। আমার হাড়ের ভেতরে ব্যথার মাশরুম ফুটে উঠছে হলুদ হলুদ। আমার জেদ চেপে গেলো। ওপাশের আঙুলদের ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় আমি কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠলাম। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি শেষবারের মতোন একটা ঘুষি দিলাম।




মনে হলো আমি আবারও হঠাৎ করেই হালকা হয়ে গেছি। নিজের হাতটাকে বেলুনের মতো নির্ভার মনে হলো। দেখলাম খুব স্লো-মোশন ম্যুভির মতো কাচের টুকরোর ফাঁক দিয়ে হাতের মুঠিটা বেরিয়ে গেলো। কব্জি আর চামড়ার ভেতরে কয়েকটা রাগী কাচের টুকরো ঢুকে গেলো, আর গলগল করে গরম রক্ত বেরিয়ে এলো। আমার কনুই আর পায়ের ওপরে স্রোতের মতো লাল নদী বইতে লাগলো। আমি কোনো ব্যথা অনুভব করছি না। কারণ দেখতে পাচ্ছি ভাঙা টুকরোর ওপাশে আমার লাল হলুদ আঙুলের সাথে কতোগুলো উষ্ণ আঙুল জড়িয়ে আছে। অপরিচিত সেই হাতটিকে সামনে টেনে নিতেই আমি যে মুখটি দেখি, সেখানে অনেক অনেক পুরোনো স্মৃতির ভোর আর দুরন্ত রোদ আমার দিকে খলখল করে হেসে দিচ্ছে।



মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

স্ট্যাটিকাব্য

ইদানিং চিন্তা ও ভাবনা অস্থির ইদুর হয়ে উঠেছে। কুটকুট করে নিউরন কাটছে, বুনছে না কিছুই। মাকু হারানো তাঁতির মতোই দশা। মাঝে মাঝে উটকো কিছু লাইন, কিছু শব্দ বুদবুদের মত ভেসে ওঠে। সেগুলো ছড়িয়ে পড়ার আগে, ফুলে ফেঁপে বড়ো হয়ে ওঠার আগেই পারিপার্শ্বিকতার বায়ুচাপ ফটাশ করে ফাটিয়ে দেয়। শব্দ ও পরিবেশ দূষণের ভয়ে সেগুলো খোমাখাতায় জমা হয়। সেখান থেকে আজকের জ্বরকাতর বিকেলে সেঁচে আনলাম কতক বিচ্ছিন্ন লাইন।


***
ডিসেম্বর ২২, ২০০৯ সময়ঃ ১:৩৫ পূর্বাহ্ন
এখন আর আজকাল মৃত্যুরত মানুষের মুখ আমাকে স্তম্ভিত করে না। মৃত্যু ধীরে ধীরে সহনীয় ঘটনা হয়ে উঠছে...




ডিসেম্বর ২৪, ২০০৯ সময়ঃ ১০:৪৪ সকাল
I admit I can't shake the idea that there is virtue in suffering, that there is a sort of psychic economy, whereby if you embrace success, happiness and comfort, these things have to be paid for.




জানুয়ারি ১২, ২০১০ সময়ঃ ৯:৪৫ রাত
প্রতিদিন আমাদের শরীর থেকে এক পরতা ত্বক ঝরে যায়, দৈনন্দিন পরাজয় ও দুঃখরাজি এভাবে ঝরে যায় না কেন??




জানুয়ারি ১৫, ২০১০ সময়ঃ ১১:২১ সকাল
:: প্রত্যুষে জানা গেলো এ সকল হর্ষ ও বেদনার দায় কড়িমূল্যে মিটাতে হবে দিন শেষে ::




জানুয়ারি ১৬, ২০১০ সময়ঃ ৯:১১ রাত
কফি গরম থাকলে তাকে হট কফি বলে, আর ঠাণ্ডা হলে তাকে কোল্ড কফি বলে...




জানুয়ারি ১৮, ২০১০ সময়ঃ ১:১১ দুপুর
:: তোমাকে এক ঝলক দেখার তৃপ্তি-অতৃপ্তির পাল্লা মেপে এই তুমুল শীতের ক্ষয়াটে কুয়াশা আমার চোখে জমছে...




জানুয়ারি ৩০, ২০১০ সময়ঃ ১:০০ দুপুর
: কতকিছুই তো ভাবি, কতোকিছুই তো করতে চাই... তারপরে টের পাই এভাবে অনেককিছুই আমি করতে পারি না। আমার কতো শত ইচ্ছের মৃত্যু ঘটে রোজ, মরা ত্বকের মতোন। হে আমার প্রিয় বিদেহী ইচ্ছেরা, তোমরা শান্তিতে ঘুমাও। তোমাদের জন্যে একটা তীব্র এলিজি লিখে আমি একদিন শান্তি পাবো!




জানুয়ারি ৩১, ২০১০ সময়ঃ ৪:২৮ বিকাল
: প্রথমে ভেবেছি এইসব ভুলভ্রান্তি আমারই গলদ, দেখেছি সকলে কেমন চমৎকার জীবনে সফল! এখন পাতা উলটে দেখি দগদগে পূঁজ ও পয়ঃ সকলের গভীরে কৃষ্ণ-অনল!




ফেব্রুয়ারি ১, ২০১০ সময়ঃ ৮:১৫ রাত
: নির্জন ফুটপাত। মরা কুয়াশা দূরে, দূরে চলে গেছে। হলুদ সায়ানাইড আলো। বাতাসে ক্ষণিক টায়ারের পোড়া ঘ্রাণ ও মৃত্যু এসেছে কাচের পেয়ালায়। ঘনো ঘনো আলো ঘনালো।




ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১০ সময়ঃ ৩:০৮ বিকাল
: তোমাকে ভুলে যাবার আগে আমার চোখের আলো নিভে যাক, তাতে এ বিশ্ব-সংসারের কোনো ক্ষতি নেই। তুমি যতো দূরেই থাকো, আমি জানি তোমারও মগজে বিনিদ্র রাত পোকার মতো সুতো কাটে!...






***