বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০১০

নতুন যুদ্ধ! স্মৃতিরক্ষার যুদ্ধ!

কাচের বড়ো বড়ো শোকেসগুলোতে থরে থরে সাজানো কতোগুলো কঙ্কাল-- মাথার খুলি, পাঁজরের হাড়, ফিমার, হিউমেরাস, রেডিও-আলনা, টিবিও-ফিবুলাঃ এগুলো সব হাত আর পায়ের হাড়। খুলির কারো কারো দাঁত নেই, কারো কারো দাঁত আছে। কঙ্কালগুলো নতুন না। হাড়ের গায়ে খয়েরি দাগ, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সেটা রক্তের। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরা এই হাড় ও খুলির পরীক্ষা করেছেন, সংরক্ষণের জন্যে ধুয়ে মুছে এখানে পাঠিয়েছেন আর স্মৃতির জাদুঘরে সেগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। জাদুঘরটি আমাদের। স্মৃতিগুলো আমাদের। হাড়গুলো আমার পূর্বপুরুষের।
আজকে দৈববলে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পা পড়লো আমার। মক্কার লোক যেমন হজ্জ পায় না, আমিও তেমনি এতোদিন ঢাকার জল-কাদায় বসবাস করেও এই জাদুঘরে যেতে পারি নি। ব্যর্থতা পুরোপুরি আমার, আর অল্প একটু জাদুঘর বানানো লোকজনের, এমন চিপার মধ্যে, গলির ভেতরে আড়াল করে কেন এটা বানিয়ে রেখেছে আমি তা জানি না। বিস্ময় লাগলো এই অভাবনীয় স্মৃতিগুলোর সংরক্ষণের ব্যবস্থা দেখে! গার্ডগুলো মরা-শুকনো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এই যে মহামূল্যবান সব নিদর্শন, যা দেশের কোনা কোনা থেকে মানুষেরা যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে আগলে রেখেছিলেন, আর এখানে পাঠিয়েছেন, সেগুলোর কিছু হলে কী হবে ভাবতেই খারাপ লাগছিলো।
তবে এই খারাপ লাগাটা শুরু হয়েছে শেষের দিকে। তার আগে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম জাদুঘরে রাখা প্রাচীন সব রত্নগুলোকে। একটা ব্যাপার খুব চমৎকার লেগেছে, তা হলো দ্রব্যগুলো সাজানোর পন্থা। খুবই যত্ন নিয়ে, সময়কালের বিভেদগুলো পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে সাজানো ছিলো। এক একটা ঘর এক একটা যুগ, এক ঘর থেকে হেঁটে আরেক ঘরে গেলেই প্রজন্ম বদলে যাচ্ছে! অভাবিত রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম।
প্রথম ঘরটিতে প্রাগৈতিহাসিক বঙ্গ, বা বাঙ্গালা, বা ভারতবর্ষের কিছু নিদর্শন। গ্রীকরা যখন দাপটে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে, সেসময়কালীন দক্ষিণ এশীয় এই জনপদেও আর্য-অনার্য-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী দাপটের সাথেই বসবাস করতো। পলল মাটিতে তাদের সেই চিহ্ন খুব বেশি নেই, তবুও অল্প একটু আলো দেখেই সেইসময়ের কিছু কিছু ধারণা পেলাম। এদের পরে এলো মৌর্যের শাসন, বৌদ্ধসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, অতীশ দীপঙ্কর-- অহিংসতা। এই জিনগত বৈশিষ্ট্য এখনো হয়তো কিছুটা বাকি রয়ে গেছে আমাদের মাঝে! তারপরে পালবংশ ও সেনবংশের হাত বদলে মুসলিম রাজ- সেখান থেকে ব্রিটিশরাজ। এই সময়কালগুলো ঘর থেকে ঘরে যেতে যেতে পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। থমকে গেলাম একটা বদ্ধকুঠুরির সামনে এসে।
একটা কালো দেয়ালের ঘরের মেঝেটা লাল রঙ করা। ভেতরে দুটা ইট, মোমবাতিতে আগুন জ্বলছে। দরজার জায়গায় কাচ দেয়া, সেই কাচের ফাঁক দিয়ে দেখলাম কালো দেয়ালে একটা স্বর্ণতালিকা!
ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীদের নাম, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনসহ সকলের নাম মোমবাতির মৃদু আলোতেও জ্বলজ্বল করছে।
মনে হলো আস্তে আস্তে এই পলল মাটির জনপদ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। টের পাচ্ছিলাম আশেপাশে সাপের মতো হিসহিসে কণ্ঠস্বর। সামনেই পড়লো দ্বিজাতিতত্ত্বের পুরোধাদের ছবিঃ এ কে ফজলুল হক, মোঃ আলী জিন্নাহ সহ একটা বড়ো গ্রুপ ফটো। দেখে কিছুটা শরীর রি রি করে উঠলো। এই জনপদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে গভীর বিষ খুঁড়ে বের করে আনার রূপকারদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ধর্ম দিয়েও বিভাজন করা যায়, সেটা এনারাই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসময়ের পর থেকে কোন হিন্দু আর মুসলমান একে অপরকে নির্মল মনে বিশ্বাস করে নাই!
পরের ঘরটিতে পাকিস্তান শাসনকালের সব (কু)কীর্তি। বামে প্রথম দেয়ালে একটা সাদাকালো ছবি দেখতে পেলামঃ একটা মানুষের মৃতদেহ- তাঁর মাথার খুলি ফেটে ঘিলু ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। মৃতদেহটি শহীদ রফিকের। এই ছবিটি লুকিয়ে তুলেছিলেন ফটোগ্রাফার (মার্জনাঃ আমি নাম ভুলে গেছি দেখার পরেও)। মগজের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটলো একটা। শুয়ো*!!
তারপরেও আমরা তো ঘুরে দাঁড়িয়েছি। চুয়ান্নের পরিষদের ছবি দেখলাম। পাশেই দৈনিক পাকিস্তানের কিছু পেপার কাটিং। আরেকটু এগিয়েই সেই কুলাঙ্গার আইয়ুব খান! সামরিক শাসনের মতো অভিশাপ যিনি আমাদের প্রথম চাখিয়েছিলেন।
তার পাশের ফ্রেমে একটা পেপার কাটিংয়ে লেখা পাকিস্তান বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যান হবার খবরটা। বাংলার প্রতি এমন বিদ্বেষ কেন ছিলো পাকিদের মনে? আমি তখন হুট করেই এই প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে বসলামঃ আসলেই তো, আমরা নিরীহ লুঙ্গি পরা চাষা ভুষা লোকজন। দুইবেলা খাইতে পারলেই খুশি থাকতাম। পুরা পাক-আমলের শুরু থেকে এই জনপদের মানুষদের সাথে এরকম নিষ্ঠুর আচরণ কেন করেছিলো তারা? আমি বুঝে পাই না। সব শাসকই শোষক- এটা ধরে নিলেও, "কেন বাপু, খাও যতো হাউশ ততো, তয় আমাগো চাইরডা ভাত দিয়া খাইলে কি অয়?" কী হতো যদি সামরিক শাসন করতে করতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা দুটা উপকার করতো। আমরা তো প্রদেশ ছিলাম, আমাদের সেটুকু অধিকার দিলে কার কী এসে যেতো? কেন্দ্র তো সব লাভের গুড় এমনিতেই পাচ্ছিলো! তবে কি ভবিতব্য?
এর পরে ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিলো আসাদ আর কিশোর মতিউরের লাশের ছবি দুইটা। উনসত্তরের শহীদ। পাকিস্তান আমলে ঠিক কতো জন বাঙালিকে বিনা কারণে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিলো? একটা "শান্তিপূর্ণ" দেশে হুটহাট এরকম মানুষ মারা পড়লে সেটা দেশের কর্তাব্যক্তিদের সম্বন্ধে কোন ধরনের ধারণা দেয়? পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র সম্ভবত এখন এটা কেয়ারও করে না। "চল্লিশ বছর ধরে মারছি, মাথা ঠাণ্ডা রেখে আজও মেরে চলছি!"
এর পরের ঘরটি প্রতারণা-হত্যা-রক্তপাত-জল্লাদের ছবিতে ভরপুর। চার দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ছবিগুলো দেখে মাথা ঘুরাবে, আপনি একসাথে দেখার চেষ্টা করেই দেখুন! প্রায় গোলাকার গণ্ডি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, এই ছবিগুলোর কাছাকাছি গিয়ে দেখার শক্তি অনেকেরই নেই। ঢাকা শহরে পঁচিশে মার্চের রাতে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, সেটার বর্ণনা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। এই হত্যাকাণ্ডের খবর যারা জানতো, যারা এই হত্যাকাণ্ডের কিছু কিছু নিজেরাই দেখেছে চোখের সামনেই, তাদের মধ্যে থেকেই কোন কোন বেজন্মা রাজাকার দলে নাম লিখিয়েছিলো! হায়রে! এতোকিছুর পরেও এদেরকে এখন কেউ কেউ 'বেনিফিট অফ ডাউট' দিতে চায়, 'অতীত ভুলে' মিলেমিশে চলতে চায়! ধিক্‌
ঘরটার এক কোণে একটা ছোট ফ্রেমে ভারতে চলে যাওয়া মোট শরনার্থীর সংখ্যা লেখা। শেষের তিনটা ডিজিট ভুলে গেছি। তবে তা ছিলো ৯৮,৯৯,০০০ এর বেশি। শূন্যগুলো ভুলে গেছি। সেখানে যে কোন সংখ্যা বসিয়ে নেয়া যায়। আটানব্বই লাখের কাছে কয়েকশত আর এমন কী! তাজ্জব! আমি এইটা কী বলছি? আমার কাছেই এগুলো কেবল সংখ্যা, আমি জানিও না ৯৯৯ আর ১০০০ এর পার্থক্য ১ আর সেই ১-টা মানুষ আমি নিজেও হতে পারতাম! একটা মানুষের দাম ইতিহাসের পাতায় কিছুই না, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে নির্বিশেষে মেরে ফেলাদের আর্তনাদ বলছে, সেগুলো ভুলে যাবার মতো নয়!
এর পরের ঘরগুলো আমি কেবল ছুঁয়ে গেছি। কোন ঘরেই বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর মতো মানসিক জোর ছিলো না। একটা ঘরে একটু বেশি সময় ছিলাম। সেখানে থরে থরে স্টেন গান, এল এমজি, গ্রেনেড, মর্টারশেলগুলো সাজানো। মেশিনগানের খালি খোসা দিয়ে লিখে রাখা হয়েছে বাংলা। দেখলাম ইপিআরের হাতে বানানো বর্শা, এইগুলা দিয়ে যে নরপশুদের মারা হয়েছে, তাদের চেহারাটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। আর কুর্ণিশ করতে ইচ্ছা করছিলো বন্দুক আর বর্শা আর গ্রেনেড হাতে সেই সাধারণ মানুষগুলোকে! অসামান্য ঋণ শোধের চিন্তা করাও পাপ!
শেষের ঘরগুলোর মাঝে দুটো ঘরে দমবন্ধ অনুভূতি হলো। একটা হলো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঘর। সারি সারি খুলিগুলো সেখানেই দেখেছি। ঢাকার বধ্যভূমিগুলো থেকে তুলে আনা হীরকখণ্ডসম মানুষগুলোর দেহাবশেষ। তাঁরা চলে গেছেন এবং আমাদের নিঃস্ব করে গেছেন- মননে, চিন্তায়, আবেগ-অনুভূতিতে আমরা একটা নিঃস্ব জাতি হয়ে গেছি। আলো হাতে যাঁরা ছিলেন, তাদেরকে ঐ আল-বদর, আল-শামসের রাজাকারগুলো মেরে ফেলেছে। এই দলগুলোর পুরোভাগে ছিলো গোআ-মইত্যা-মুজাহিদের মতো পাপিষ্ঠ। (গালিও কম হয় এদের জন্যে)!!
আরেকটা ঘর আমার মায়ের, আমার বোনের। সেই ঘরটা আমি দ্রুত হেঁটে বের হয়ে গেছি, আশেপাশের ছবিগুলো বা নিদর্শনগুলো আমি দেখতে চাই না।
****
ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম জাদুঘর থেকে। একটা মৃদু নিঃশ্বাস ফেললাম। সামনে একটা উঠান, চারপাশে সবুজ গাছপালার মাঝে একটা শান্ত সমাধিস্থ প্রকৃতি। যেন আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে,


কোন ভয় নেই, তুমি স্বাধীন। এতোক্ষণ যাঁদের দেখলে, তাদের ধমনীতেও তোমার মতো জীবন দৌড়ে বেড়াচ্ছিলোঃ ঐ রুমী, ঐ বাদল, ঐ আসাদ, ঐ মতিউর, ঐ নামহীন খুলির মানুষটাও এই পলিমাটির জমিনে একদা হাঁটতো। তাঁরা আজ নেই, কারণ তাঁরা কেউ কেউ তোমার কথা ভেবেছিলো- আর সবকিছু ছেড়ে মরে গিয়েছিলো। অখ্যাত এক গ্রামের একটা দা জাদুঘরে দেখেছো না? সেটা দিয়ে কুপিয়ে একজন মহিলা পাঁচটা রাজাকারকে মেরেছিলেন। কুপিয়ে একটা ডাব কাটতে যাও, তাহলে বুঝতে পারবে ঐ মহিলাটি কতো অপূর্ব যোদ্ধা ছিলেন!! তাঁর জন্যে শ্রদ্ধা, সম্মান এগুলো ফাঁপা শব্দের কোন দরকার নেই। খালি ঐ ঘৃণ্য রাজাকারগুলাকে ছেড়ো না। ঐ মহিলাটির শতাংশেরও শতাংশ পরিমাণ জোর যদি তোমার মনে আর হাতে থাকে, তাহলে এই স্বাধীন দেশে বসে ঐ রাজাকার আর অপরাধীগুলোকে সাজা দাও!



***
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অনেক অনেক প্রচার ও উন্নয়ন দরকার। জাদুঘরের ঢোকার পর থেকেই এইটা মাথায় ঘুরছিলো যে কেন এর ব্যবস্থা নেয়া হয় নি এখনও?? বের হওয়ার আগেই মন ভালো হলো এটা দেখে যে আসলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টি গঠন করা হয়েছে। নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে আগারগাঁওয়ে। ভবনের নকশা দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠলো! একেবারে স্থাপত্য সৌন্দর্য্য! ঠিক ওভাবে বানানো হলে আমি প্রতি সপ্তাহে বিকালবেলা হাঁটতে যাবো ওখানে। শপিংমলের চাইতে ঢের ভালো!
তবে কাজ শেষ হয়ে যায় নি। নতুন জাদুঘরের নির্মাণব্যয় ৬০ কোটি টাকা। নেট ঘেঁটে ইত্তেফাকের খবর পেলাম যে গতমাসেই সম্মেলনে জানানো হয়েছে যে অতিসত্ত্বর এই ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হবে! 
আমি যুদ্ধে যেতে পারি নাই। তবে যুদ্ধের স্মৃতি টিকিয়ে রাখার যুদ্ধতে শামিল হতে চাই!


সোমবার, ২৪ মে, ২০১০

ভোকাবুলারিহীন দিনপঞ্জি

যেসব দিনে আমি হারানো বিজ্ঞপ্তির ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে দেখি কোন পুরনো বিলুপ্তিকে পাওয়া গেলো নাকি, সেসব দিনে আমার বুক ভেঙে যায়। সেরকম দিন মাদকতাময় এবং প্রান্তিক, আমি সেইসব দিনে ভারসাম্য হারাই
দেখি মহেঞ্জোদারোর মতো বিক্ষিপ্ত পোড়ামাটির হৃৎপেশী। কোন কোন দিনে ভুলে যাই যেসব ঐতিহাসিক পরাজয়, সেগুলো দিনক্লান্তির খোপে লুকানো শ্বাস। তারপরে শীতল একটা ঘরে ঢুকে পড়ি, সেখানে নির্বোধ মুখেরা আমাকে চেনে না। দেয়ালে ইলেক্ট্রন ঘুরে বেড়ায়, আমি দেখতে পাই
বৈজ্ঞানিক কতো অসামান্য শিহরণে মাতাল হয়েছিলেন, শিভাস রিগাল তরঙ্গের চূড়ায় নাচছে একটা ফোটন- পাশে তুমি। তিনি দেখছেন ধীরে খুলছে পোশাক, পোশাকের নিচে খরা ও জরা। তুমি কোথাও নাই
দিনগ্রস্ত বৃষ্টি ও অন্যান্য উপষঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে আমাদের ক্যালেন্ডারে। আমরা জানি এই খরাতে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ওপরে দাওয়াই নেই, নেই চূড়ান্ত কোন সত্য, সকলই পরিবর্তনোন্মুখ অশ্লীলতা- অযথাই
এই বর্ষণে ভেজামাটি ডাকে, পাশে সেই পুরনো বিজ্ঞপ্তি ভিজতে থাকে, ঝর্ণাকলমে গোটা গোটা হরফে লেখা কতোকিছু, হারিয়ে গিয়েছে যা, যারা, যেসব, যেগুলো। ধুয়ে যাচ্ছে সওব... নিরন্তর হারানোর খাতাটাও হারাই
তারপর রোদ উঠছে স্লো-মোশনে... ‍ঃ এগুলো সবই নির্জলা কন্ডিশনিং, আমার ও তোমার প্রাথমিক নিয়ম-মাফিক রাশান রুলেৎ। আমি সেই মুহূর্তে জেনে যাই

রবিবার, ৯ মে, ২০১০

আমরা যেভাবে যতিচিহ্ন টানি


("অনায়াস সন্তর্পণে, নীরব পারদের উত্থানের মতো বেড়ে যাবে মৃত্যুহার")
নগরীর প্রান্তে দেখা দেবে উজ্জ্বল চাঁদযান যে'রাতে, সেই ক্ষণে উড়ে যাবে গোটাকয় মরাটে দুঃখ, আদিনিবাস- তোমার বুকের গহীন পাঁজর চিরে, তুমি আমার আত্মপ্রজ খুব প্রকাশ্য রোদ, আমার জনাকীর্ণ ঘর, বিকেল-পোড়া আকাশের মেঘ ও মৃদুসমীর, তুমি এই ফাঁপা চোখের ভেতরে ঘুমানো তীর, তোমার ভেতরে সকল ক্রোধ ও শূন্যতার রঙ আমার শাদা নখে লেগে আছে, তুমি যেদিন দড়িপ্রেমী, তুমি যেদিন সিলিংস্পর্শী, আকাশভেদী সুতীব্র চিৎকার, আমি সেদিন বিলীন- লীন- নীল নীল ডুমো মাছির চোখ হয়ে গেছি
যা অনুভব করছি তা মিথ্যা, অহেতুক বানানো শোক, বানোয়াট, জরুরি নয়, ভাবনাকে সত্যি হতেই হবে, এমনকি নিখাঁদ মিথ্যের মাঝেও আমি অজস্র সরলশুভ্র স্বপ্নের প্রশ্বাস শুনেছি, যেমন এই শোকের দেহ-সৌষ্ঠবে তোমাকে না জানার আক্ষেপ মিশে আছে প্রসাধনের মতো, আমাদের দূরত্ব এই গলিত শহরের মতো নিরাকার, উলম্বতলে যা মাপা হবে, কেননা তুমি বুদবুদ হয়ে গেছো অনায়াসে, সিলিং থেকে কয়েক থোকা ঝুলে থাকা ফুল হয়ে গেছো


নিঃসীম বাতাসে ফুলগুলো অল্প অল্প দুলছে

বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০১০

রবীন্দ্রনাথ!


মাঝে মাঝে তুমি খুব নিবিড়ে ছুরি গাঁথো
মাঝে মাঝে আমি চোখ দিয়ে তোমাকে চিরে ফেলতে পারি
মাঝে মাঝে আমাদের দিনগুলো ঘোলাটে কাচ হয়ে ওঠে

কোন কোন মানুষকে 'কোয়ান্টিফাই' করা যায় না (কোয়ান্টিফাইয়ের ভালো বাংলা পাচ্ছি না, তুল্যমূল্য ধরনের কিছু নাকি?)। আর কাউকে বুঝে ওঠার জন্যে অনেকরকমের বিষয়-আশয় মাথায় রাখা লাগে। এটাও ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। যেমন ধরুন, ছোটবেলায় কোন একটা গান শুনেছিলেন। ছোট মানে ততোটা ছোট, যখন গান শুনে কথাগুলো বুঝতে বা মনে রাখতে পারবেন। তারপরে মাঝের বিশ বছরে সেটা শোনাই হয় নি। এরপর হুট করে একদিন কোন এক কুঠুরি থেকে ক্যাসেট বের হলো, ধুলো ঝেড়ে চালানোর পরে ঘাই মেরে সব স্মৃতি জেগে উঠবেই। গানের সুর, কথা মাতাল করে দিবেই। গানটার কারিগরি উপাদানের ভালো লাগার চেয়ে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি বেশি জরুরি হয়ে যাবে। তখন কেউ আগ বাড়িয়ে চশমা নাড়িয়ে সুরজ্ঞান দিতে আসলে আপনার রাগ হওয়া বিচিত্র নয়।
ভাবতে বসেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। চতুর্মাত্রিকে ঢুকেই লালচে-আগুন আর শ্যামল-সবুজ দু'টো ব্যানার পেলাম। আমাদের যাপিত জীবনে রবীন্দ্রনাথ মোটেই জয়ন্তীতে পালন করার মতো বিষয় নন। আমি নিজে অনেক বেশিই নির্ভর করি তাঁর উপরে। তবুও উদ্দেশ্য পেলে বিধেয় খুশি হয়, তাই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাঁকে একটু বিশেষভাবে মনে করতে চাইলাম। আমি তেমন হোমরাচোমরা কেউ নই, রবীন্দ্রনাথের ওপরে অভিসন্দর্ভও লিখি নাই, সেমিনার-আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও দেই নাই। তাঁর উপস্থিতি বা গুরুত্ব আমার কাছে একান্তই আমার বিচারে, আমার চিন্তনে। তাই এই বেলা অন্যসব গুরুবিদ্যা দূরে থাক!
বাংলা পাঠ্যবইয়ের একটা ভালো দিক হলো রবীন্দ্রনাথের সাথে আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়া, খারাপ দিক হলো সেই পরিচয়টা বেশিরভাগ সময়েই অনেকটাই ভ্রান্ত হওয়া। পাঠ্যবইয়ে কবিতা, ছড়া আর ছোটগল্পগুলোকে কেটে ছিঁড়ে মোটামুটি ফালি ফালি করা হয়। শব্দার্থ, সারমর্ম, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শব্দ আর বাক্য ধরে আলোচনা করে করে রবীন্দ্রনাথের পিণ্ডিও চটকে দেয়া হয় ভালোমতোন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে পড়ে ফররুখ আহমদের সমমানের রচয়িতা, দু'জনের প্রশ্নের উত্তরেই নম্বর সমান। সবার ক্ষেত্রেই প্রথাগত শিক্ষার গণ্ডির বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে আসল পরিচয় ঘটে! সেই পরিচয় বড়ো রহস্যময়, প্রেম-ভক্তি-জাদু মিশ্রিত রঁদেভু'র মতোন।
প্রতি শুক্রবারের ছুটির দিন সকালে দেবব্রত আর কণিকা গান গাইতেন আমার বাসায়। ঘুম ঘুম চোখ মেলতেই 'শীতের হাওয়ায় লাগতো নাচন', হোক না তখন প্রখর গ্রীষ্ম। মাঝে মাঝে সকালের খাবারের টেবিলে 'বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বাণী' হয়ে আসতো গরম খিচুড়ির ঘ্রাণ, এই সবেই মিশে থাকতো তাঁর উপস্থিতি। যদিও তাঁকে ঠিকমতো চিনি নি তখনও, তাই মনে হতো 'আমার বেলা যে যায়' গানটা কেউ একজন সারাদিন নিরুপায় বসে থেকে লিখেছেন। এই শিশুতোষ কল্পনা লাগাম ছাড়া হলো যখন 'বীরপুরুষ' আর অন্যান্য কিশোর লেখার সংকলন পেলাম উপহারে। বইটার নাম ছিলো "কৈশোরক"। রবীন্দ্র-রচনাবলির কিশোর উপযোগি লেখাগুলো নিয়ে সংকলন এটা। ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, কী নাই? সেইখানেই আমার প্রথম কল্পনার জাল ছড়ানো চিন্তার শুরু। ছোটবেলাতেই মুগ্ধ হলাম, বিস্মিতও কিছুটা।
ফটিক বলাইদের সাথে পরিচয় ঘটলো, দেখা হলো অমলের সাথে, কাবুলিওয়ালার মিনি'কেও পছন্দ হলো খুব!
সেখানে আরো পেলাম কেষ্টা বেটাকে, তাকে কেন সবাই চোর ঠাউরাচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগলো। মন খারাপ হলো উপেনের জন্যেও, বাবু তার দুইবিঘা নিবেই নিবে যে!
কালো কৃষ্ণকলির প্রেমে পড়লাম আরো একটু বড়ো হয়ে, লোকে কি বলে সেটার কেয়ার তো আমি নিজেও করি না!
এইট পাশের পরে কে যেন খোঁজ দিলো গল্পগুচ্ছের। আমাকে বললো, এই ছোটখাটো লেখা পড়ে কী করবি? রবীন্দ্রনাথের আসল ঐশ্বর্য গল্পে, সেগুলো পড়। আমি ঝাঁপ দিলাম, অতলে। ভেসে উঠলাম কয়েকদিন পরে, যখন গোগ্রাসে পড়ে ফেলেছি 'ইচ্ছাপূরণ', পেটের ব্যথার ভান করে আমিও তো অনেকসময় ইশকুলে যেতে চাইতাম না। সেটা মনে হয় রবীন্দ্রনাথ টের পেয়ে গিয়েছিলেন। 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' পড়ে মনে হলো রাইচরণের মতো আমারও যদি কেউ থাকতো! 'গুপ্তধন' গল্পে পেলাম ধাঁধা:
রা নাহি দেয় রাধা
পায়ে ধরে সাধা
শেষে দিলো রা
পাগোল ছাড়ো পা
হৈমন্তী, অতিথি আর সমাপ্তি গল্প তিনটির ব্যাপারে কিছু বলাটাই বলে হয় বাতুলতা হবে।

রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে অনুভূতিগুলো ছাড়াছাড়া হয়ে যায়, তাঁর রচনার মতোই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ি। বাংলা কবিতায় রোমান্টিসিজমের পুরোধা তিনিই। সাধারণত রচনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক লেখকই কোন নতুন ধারার সূচনা করলে সেটাতে দক্ষতা দেখাতে পারেন না, পরের কেউ এসে সেখানে অসম্ভব সব কাজ করেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় সেই সূত্র খাটে না। তিনি একাই যে রোমান্টিসিজমের চর্চা শুরু করেছিলেন, বাঙালির অন্তরের 'আমিত্ব'কে যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন তেমন সৌরভ আর কারো পক্ষেই ছড়ানো সম্ভব হয় নি। মনের রুক্ষতম রাগ, হিংসা থেকে শুরু করে গাঢ়তম আবেগ পর্যন্ত, কোমলশ্যামল রূপ থেকে রুদ্রতার বয়ান সবখানেই রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া। এবং বহুমুখিতার রূপায়ন এতোটাই বৈচিত্রময় যে, সবার মনেই লেখাগুলো নিয়ে অনুভবের একটা সাধারণ মন্তব্য হলো, "আরে! আমি নিজেই তো এভাবে চিন্তা করি। আমার মনের এই কথাটা রবিবাবু জানলেন কেমন করে?!"
সম্ভবত এখানেই রবীন্দ্রনাথের মুন্সিয়ানা। দেড়শ' বছর আগে জন্মেও যে কোন যুগে, যে কোন মানুষের মনের গহীনে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন তিনি। তাঁর এই ঈর্ষণীয় ব্যাপনক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তার দেড়শতম জন্মদিনে!
শুভ জন্মদিন রবিবাবু, শুভ জন্মদিন বুড়োবাবু!!
***

সোমবার, ৩ মে, ২০১০

ঠিকানা

তোমাদের শহর ছেড়ে প্রতিদিন যারা উড়াল পথে চলে যায়, তাদের জামায় অনেক শোক ও অশ্রুর পরতে এই শহরের অনেক ধুলা ও রাস্তার ম্যাপ লেগে আছে। তোমরা সেগুলো চিনতে পারছো বলে তাদেরকে ভুলে থাকো। এ কারণে এই শহরে বৃষ্টি হয় না, কেবল বিদ্যুতের খামে করে শোক ও অশ্রুর খবর পাওয়া যায়। নাগরিকের জন্যে সেটুকু অপরিমেয়...

নিউজ অ্যাট সিক্স


এরপর শহর কালো হয়ে ওঠে
চুলের চেয়েও
কয়লার চেয়েও
মন্ত্রণা এবং মন্ত্রীদের চেয়েও
গাঢ় হয়ে ওঠে তোমার ঘর
আসবাব যাবতীয়।
আমরা জানতে পেরেছি
এগুলো বিভ্রম
কল্পিত সত্য,
এগুলো জাতিগত ক্ষোভ
এবং একাত্মবোধ
নগরে ছিনতাই ও জবাই
দ্রব্যমূল্যের মতো বেড়েছে রোজ
এরকম রোজ সন্ধ্যার খবরে
পাঠ করেন স্তনগর্বী মেয়েটি; মুখে হাসি

নাব্যতার গান


নগরীর তীরবর্তী একটি নদী ছিল এককালে,
তাকে ঘিরে গাড়ি-ঘোড়ার নৃত্য ঘন হয়ে আসে
নদী কষ্টে সরে যায় দূরে, দূরে অভিমানী অথবা
অরূপ বিষাদাচ্ছন্নতায়।
একাকি নগর তারপর হুট করেই মানসিক বৈকল্যে পড়েঃ মেনোপজাল ক্রনিক ডিপ্রেসন
কলকারখানা ও রাজনৈতিক আবাসনে দেখা দেয় সংকটের ঘনঘটা, শেয়ার বাজারের ধ্বস ছাপিয়েও শোনা যায় শ্রবণযোগ্য আর্তনাদ, কবি ও কথাশিল্পীদের ভালো লাগে এই নতুন প্লটের বাঁধন, সীমানা চিহ্নিত হবার ফাঁকে, রাজউক যখন তাদের পারমিট দিচ্ছিলো, তখন তাদের মগজের কোষে সেই আর্তনাদ একটি সুরম্য প্লট হয়ে ওঠে।
প্লটের গায়ে দুটো মেহগনি লাগানো হয়,
মেহগনি অর্থ আনে,
অর্থবোধক হয়ে ওঠে মগজের প্লট
এবং নগরের প্রান্তে ম্যাজিক টাউন।
লিপ্সার রঙে ডুব দিয়েছে ফার্মগেট ওভারব্রিজের দুটো উন্মূল ভিখারি

ট্র্যাপিজ-লাফ


এমন অসম্ভবেও ঢেউপ্রবণ নগরে জটাজট মানুষ জমে ওঠে
জাদুবিদের কারসাজি দেখা যায় সুউচ্চতল আকাশে, যে প্রান্ত অবধি দালানটি পৌঁছে গেছে অনেকদিন আগে- হয়তো গত শতাব্দীতে, হয়তো গতকালই, সেই দালান-চূড়ার কাছাকাছি চলিষ্ণু মেঘের ট্র্যাফিক সিগন্যাল, নানান রুটের বাস ও ট্রাকদের হুইসেল, ভেঁপু বাজান-থামুন-১০০ হাত দূরে থাকুন
ছুটে আসা কৃষ্ণবরণা মেঘ।
আর আমরা দেখতে পাই সেই দালানের কার্নিশে প্রকাণ্ড মেঘগুলো জমে আছে
সেখানে জাদুবিদ টলোমলো পায়ে হাঁটছেন ঝুঁকে পড়ে মাপছেন জলের তাপমাত্রা, অনেক নিচে আমাদের সারি সারি মাথাগুলো ধীরে স্লোমোশনে হেঁট হয়ে যায় চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্যে, অনুগামী শটের এডিটে কাটা পড়ে একটি জাদুকরি দেহ...

দুই বোন


অনেক অনেক দিন আগে, এক দেশে দুই বোন বাস করতো। তারা দুজনে ছিলো যে একই ফুলের দুইটি কুঁড়ি; কিন্তু একজন ছিলো ভালো, আরেকজন খুব রগচটা। তাদের বাবার কোন চাকরি ছিলো না, তাই তারা দুই বোনে ঠিক করলো তারা কাজ করে টাকা উপার্জন করতে যাবে।
“আমি আগে যাই, দেখি কী করতে পারি,” ছোট মেয়েটা খুশি মনে বললো, “তারপরে যদি আমি কিছু পয়সা পাই, তাহলে তুমিও চলে এসো আপু।”
তারপর সে তার জামাকাপড় একটা বোঁচকায় বাঁধলো, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাজ খুঁজতে বের হলো। কিন্তু শহরের কেউই তাকে নিতে চাইলো না। কাজের খোঁজে মেয়েটি শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে আসলো। পথে যেতে যেতে যেতে, একদিন তার পথে একটা বিরাট চুলা দেখতে পেলো। চুলাটার উপরে অনেকগুলো রুটি গনগন করে ভাজা হচ্ছিলো। মেয়েটি যখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন চুলার ওপর থেকে রুটিগুলো একসাথে চেঁচিয়ে উঠলোঃ
“ছোট্ট খুকি! ছোট্ট খুকি! আমাদের বাঁচাও! প্লিজ আমাদের বাঁচাও! সা-ত বছর ধরে আমাদের ভাজি করছে, কেউই আমাদের চুলা থেকে বের করছে না। আমরা তো পুড়েই গেলাম! তাড়াতাড়ি আমাদের বের করে নাও!”
মেয়েটা খুব দয়ালু ছিলো, তাই রুটিদের চিৎকারে তার খুব মায়া হলো। সে তার বোঁচকা নামিয়ে রেখে রুটিদের বের করে আনলো। তারপরে আবার রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বললোঃ
“এবারে তোমরা একটু আরাম পাবে।”
আরো কিছুদূর যাবার পরে মেয়েটি দেখলো একটা গরু পাশে খালি বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গরুটা কাতরস্বরে মেয়েটিকে বললোঃ
“ছোট্ট খুকি! ছোট্ট খুকি! আমার দুধ দুইয়ে দাও! প্লিজ আমার দুধ দুইয়ে দাও! সা’ত বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি, কিন্তু কেউই আমার দুধ দুইয়ে দিচ্ছে না।”
তো, লক্ষ্মী মেয়েটি সেখানে থামলো, কাঁধ থেকে বোঁচকা নামিয়ে রেখে গরুটার দুধ দুইয়ে পাশের বালতিতে রাখলো, তারপরে যেতে যেতে বললোঃ
“এবারে তুমি একটু আরাম পাবে।”
আরো একটু পথ এগিয়ে মেয়েটার সাথে একটা আপেল গাছের দেখা হলো। গাছের ডালে ডালে থোকা থোকা আপেল ঝুলছে, ফলের ভারে তার ডালগুলো প্রায় ভাঙার উপক্রম! আপেল গাছটি মেয়েটিকে ডেকে বললোঃ
“ছোট্ট খুকি! ছোট্ট খুকি! আমার ডালগুলো ঝাঁকি দাও। ফলের ভারে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছি না!”
লক্ষ্মী মেয়েটি সেখানে থামলো, কাঁধ থেকে বোঁচকা নামিয়ে আপেল গাছের ডাল ধরে অনেক জোরে ঝাঁকুনি দিলো। সাথে সাথে সব আপেলগুলো ঝরে গেলো আর গাছটাও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো। মেয়েটি চলে যেতে যেতে বললোঃ
“এবারে তুমি একটু আরাম পাবে।”
তো, মেয়েটা গ্রামের পথ ধরে যাচ্ছে যাচ্ছে, একসময়ে সে এসে হাজির হলো এক বুড়ি ডাইনির বাড়ির সামনে। এই বুড়ি ডাইনির একটা কাজের মেয়ের দরকার ছিলো, বিনিময়ে তাকে বেতন দিবে। তাই মেয়েটি ঐ বাড়িতে থেমে বললো যে সে কাজ করতে চায়। বুড়ি বললো, তাকে ঘর ঝাড়ু দিতে হবে, বাসা পরিষ্কার করতে হবে, শীতের দিনে আগুন জ্বালাতে হবে। তবে ডাইনিটা বার বার নিষেধ করে দিলো যে আগুন জ্বালানোর সময়ে কোনমতেই চিমনির ভেতরে তাকানো যাবে না!
“যদি একবার তাকিয়েছো”, বুড়ি খ্যানখ্যানে গলায় বললো, “তবে তোমার মাথায় একটা জিনিস এসে পড়বে। এর পরিণতি একেবারেই ভালো হবে না!”
বেশ! মেয়েটা ঝাড়ু দেয়, ঘর মোছে, ধুলা ঝাড়ে, আগুন জ্বালায়, কিন্তু বুড়ি তাকে কোনই বেতন দেয় না। অনেকদিন এভাবে কেটে গেলো। এখন, মেয়েটা বাসায় ফিরতে চায়। বুড়ি ডাইনির বাড়িতে কাজ করতে তার একটুও ভালো লাগছিলো না। কারণ এই ডাইনি রাতের খাবারে বাবুদের ধরে ধরে সিদ্ধ করে খেতো, তারপরে তাদের হাড়গুলো বাগানে পাথরের নিচে পুঁতে রাখতো! কিন্তু মেয়েটা খালি হাতে বাসায় ফিরতে চাচ্ছিলো না, তাই সে আরো কিছুদিন ঘরের কাজকর্ম করলো। এরকমই একদিন হঠাৎ হলো কি, আগুনের চুলা পরিষ্কার করার মেয়েটি ময়লার সাথে পা বেঁধে পড়ে গেলো, আর বেখেয়ালে চিমনির ভেতর দিয়ে উপরে তাকালো। আর যায় কোথায়! এক বিরাট বস্তাভর্তি স্বর্ণমুদ্রা ধপ করে তার কোলে এসে পড়লো!
সেইসময়ে ডাইনিটা ছিলো বাড়ির বাইরে কাজে। তাই মেয়েটি ভাবলো, নিজের বাসায় পালিয়ে যাওয়ার এখনই সুযোগ। সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বেঁধে নিয়ে বস্তা কাঁধে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। কিন্তু একটু এগুতে না এগুতেই সে টের পেলো যে ডাইনিবুড়ি ঝাড়ু নিয়ে তার দিকে তেড়ে আসছে। পড়িমড়ি করে মেয়েটি ছুট লাগালো। এক ছুটে সামনে এগিয়ে দেখে সেই আপেল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়ে ওটার কাছে গিয়ে বললোঃ
“আপেল গাছ! আপেল গাছ! লুকিয়ে আমায় রাখো
ডাইনি বুড়ি আমায় যেন ধরতে পারে নাকো
আমায় পেলে হাড়গুলো সে আস্ত ভেজে খাবে
বাগানের ঐ পাথর তলে আমায় চাপা দিবে!”
তখন আপেলগাছ বললো, “অবশ্যই! তুমি আমার কতোবড়ো উপকার করেছিলে, আর উপকারীর উপকার করাটাই উচিত কাজ!”
তাই আপেল গাছ তাকে নিজের ডালপালার ফাঁকে লুকিয়ে রাখলো। ডাইনি সেখান দিয়ে যাবার সময়ে বললোঃ
“ওরে আমার আপেল গাছ! ওরে আমার গাছ!
বদমাশ এক পিচ্চি মেয়ে দেখেছিস নাকি আজ?
এদিক দিয়েই গেছে সে যে ঝোলা কাঁধে নিয়ে
ভর্তি ঝোলা আমার যতো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে!”
আপেল গাছ বললোঃ
“না গো বুড়ি, রয়েছি আমি পথের পানে চেয়ে
সাত বছরে এইদিকেতে যায়নি কোন মেয়ে”
তখন ডাইনি বুড়ি অন্যদিকে ঝাড়ু বাগিয়ে চলে গেলো। আর মেয়েটি গাছ থেকে নেমে আপেল গাছকে অনেকবার ধন্যবাদ দিলো। তারপরে আবার বাসার পথে রওনা হলো। কিন্তু যেই না সে গরুটার কাছে পৌঁছেছে, কোথা থেকে ডাইনির আসার আওয়াজ পাওয়া গেলো। মেয়েটা তাড়াতাড়ি গরুর কাছে গিয়ে বললোঃ
“শুনছো গরু! এই যে গরু! লুকিয়ে আমায় রাখো
ডাইনি বুড়ি আমায় যেন ধরতে পারে নাকো
আমায় পেলে হাড়গুলো সে আস্ত ভেজে খাবে
বাগানের ঐ পাথর তলে আমায় চাপা দিবে!”
তখন গরু বললো, “অবশ্যই! তুমিই না আমার দুধ দুইয়ে কতোবড়ো উপকার করেছিলে? আমার পিছনে লুকিয়ে থাকো, কেউ তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না!”
একটু পরেই ডাইনি উড়ে এলো, আর গরুটাকে জিজ্ঞাসা করলোঃ
“ওরে গরু! শোন ফেলে সব কাজ
বদমাশ এক পিচ্চি মেয়ে দেখেছিস নাকি আজ?
এদিক দিয়েই গেছে সে যে ঝোলা কাঁধে নিয়ে
ভর্তি ঝোলা আমার যতো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে!”
গরুটা খুব নরম স্বরে বললোঃ
“না গো বুড়ি, রয়েছি আমি পথের পানে চেয়ে
সাত বছরে এইদিকেতে যায়নি কোন মেয়ে”
তখন বুড়িটা আবারও ভুল পথে চলে গেলো, আর মেয়েটা আবার নিশ্চিন্ত মনে নিজের বাসার দিকে রওনা হলো। কিন্তু যেই না সে চুলাটার কাছে পৌঁছেছে, আবারও কোথা থেকে বুড়ি এসে হাজির। মেয়েটা তাড়াতাড়ি চুলার কাছে গিয়ে কাতরকণ্ঠে বললোঃ
“শুনছো চুলো! এই যে চুলো! লুকিয়ে আমায় রাখো
ডাইনি বুড়ি আমায় যেন ধরতে পারে নাকো
আমায় পেলে হাড়গুলো সে আস্ত ভেজে খাবে
বাগানের ঐ পাথর তলে আমায় চাপা দিবে!”
তখন চুলাটা গমগমে স্বরে বলো, “হায়! এখন কি করি, আমার ভেতরে তো অনেকগুলো রুটি এখন ভাজা হচ্ছে, তোমাকে রাখার জায়গা নেই। তুমি এক কাজ করো, ঐ যে রুটিওয়ালা বসে আছে, তাকে গিয়ে বলো।”
মেয়েটা তাড়াতাড়ি রুটিওয়ালার কাছে গিয়ে বলতেই রুটিওয়ালা বললো, “অবশ্যই! তুমি না থাকলে আমার আগের সেই রুটিগুলো সবই পুড়ে যেতো। তুমি শিগগিরই আমার ঘরের ভেতর গিয়ে লুকাও। আমি বুড়িকে সামলাচ্ছি।”
মেয়েটা কোনমতে রুটিওয়ালার ঘরের ভেতরে লুকিয়েছে, আর তখনই ডাইনি এসে হাজির। খ্যানখ্যানে বুড়ি রেগেমেগে বললোঃ
“ঐ বেটা! ঐ রুটিওয়ালা ব্যাটা, শোন দেখি
বদমাশ এক পিচ্চি মেয়ে আজ দেখেছিস নাকি?
এদিক দিয়েই গেছে সে যে ঝোলা কাঁধে নিয়ে
ভর্তি ঝোলা আমার যতো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে!”
রুটিওয়ালা বললো, “বুড়ি, তুমি ঐ চুলার মধ্যে দেখো দিকি। মেয়েটা থাকলেও থাকতে পারে।” তখন বুড়ি ঝাড়ু থেকে নেমে চুলার ভেতর উঁকিঝুঁকি মারছে, দেখে কেউ নেই। রুটিওয়ালা বললো, “আরেকটু ভিতরে ঢুকে দেখো, বুড়ি”, আর যেই না ডাইনি চুলার ভেতরে গেছে, ---
ধড়াম!----
রুটিওয়ালা তার মুখের ওপরে চুলার দরজা দিলো লাগিয়ে। আর বুড়ি চুলার ভেতরে পুড়ে কয়লা হয়ে গেলো। যতোক্ষণে সে চুলা থেকে বের হয়েছে, পুরো মুচমুচে ভাজা খয়েরি হয়ে গেছে। তখন তার বাড়ি ফিরে সারা গায়ে ক্রিম মাখা ছাড়া আর কোন উপায়ই নাই!
আর মেয়েটা? দয়ালু লক্ষ্মী মেয়েটা বস্তাভর্তি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বাসায় ফিরে আসলো।
এখন তার বদমেজাজী বড়ো বোন সব দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই! সেও তখন ঠিক করলো যে এমন এক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা না আনলে কিছুতেই চলছে না। তাই সে জামাকাপড় বোঁচকা বেঁধে তার বোনের মতোই পথে বের হলো কাজের খোঁজে। সেই একই রাস্তা ধরে যেতে যেতে বড়ো বোনটিও একই রুটির চুলার কাছে এসে হাজির হলো। চুলার ওপর থাকা রুটিগুলো আগের মতোই বোনটাকে বললো, তাদেরকে নামিয়ে নিতে, তারা সাত বছর ধরে ভাজি হচ্ছে, আরেকটু সময় থাকলেই তারা পুড়ে যাবে। মেয়েটা নাক সিঁটকে বললোঃ
"খুব মজা তাই না? তোমাদের নামাতে গিয়ে আমি আমার আঙুল পুড়াই আর কি! খেয়ে কাজ নেই আমার। হুঁহ!”
এরপর সে আবারও একটু এগিয়ে গরুটার দেখা পেলো। কিন্তু যখন গরুটা বললোঃ
“ছোট্ট খুকি! ছোট্ট খুকি! আমার দুধ দুইয়ে দাও! প্লিজ আমার দুধ দুইয়ে দাও! সা’ত বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি, কিন্তু কেউই আমার দুধ দুইয়ে দিচ্ছে না।”
মেয়েটা অবজ্ঞার হাসি হেসে বললো, “তুমি আরো সাত বছর অপেক্ষা করলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি তোমার কাজ করে দিতে পারবো না।” এটা বলে সে এগিয়ে গেলো। আরো একটু দূর যাবার পরে তার সামনে পড়লো সেই আপেল গাছটা। আবারও তাতে আপেল ধরেছে, এবং সে নুয়ে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে। যখন সে মেয়েটাকে অনুরোধ করলো তার ডাল ধরে ঝাঁকি দিতে, তখন মেয়েটা কেবল খিল খিল করে হাসলো। আর একটা পাকা আপেল ছিঁড়ে নিয়ে খেতে খেতে চলে গেলো। যাওয়ার সময় বললোঃ
“ আমার একটা আপেলেই হবে। বাকিগুলো তুমিই রেখে দাও।” এভাবে আপেল খেতে খেতে সে অবশেষে ডাইনি বুড়ির বাসায় এসে হাজির হলো।
এতোদিনে বুড়ির গায়ের পোড়া দাগগুলো ঠিক হয়েছে। কিন্তু মনের ঝাল মেটেনি একটুও। কাজের মেয়েদের উপরে সে ভয়ংকর রেগে থাকে। আর এক মুহূর্তের জন্যেও ঘর ছেড়ে বের হয় না। এজন্যে বদমেজাজি মেয়েটাও আর সুযোগ পাচ্ছে না চিমনির ভেতরে তাকানোর। তাকে বুড়ি খুব খাটাচ্ছে, রোজ ঘর ঝাড়ু দিতে হয়, মুছতে হয়, আগুন জ্বালাতে হয়। কাজ করতে করতে সে একদম শেষ!
কিন্তু একদিন হুট করেই সুযোগ এলো। ডাইনিটা রাতে খাওয়া বাচ্চাদের হাড়গুলো যেই পুঁততে গেছে, সেই সুযোগে মেয়েটা চিমনির ভেতরে তাকালো। আর সাথে সাথেই, এক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা!
তো, মেয়েটা খুব তাড়াতাড়িই ডাইনির বাড়ি ছেড়ে পালালো। দৌড়াতে দৌড়াতে আপেল গাছের কাছে এসে শুনতে পেলো ডাইনি তাড়া করে আসছে। তার ছোট বোনের মতো এই মেয়েটাও আপেল গাছকে মিনতি করে বললোঃ
“আপেল গাছ! আপেল গাছ! লুকিয়ে আমায় রাখো
ডাইনি বুড়ি আমায় যেন ধরতে পারে নাকো
আমায় পেলে হাড়গুলো সে আস্ত ভেজে খাবে
বাগানের ঐ পাথর তলে আমায় চাপা দিবে!”
কিন্তু আপেল গাছ উত্তর দিলোঃ
“আমার এখানে কোন জায়গা নাই। আপেলে ঠেসে আছি। তুমি রাস্তা মাপো।”
মেয়েটা নিরুপায় হয়ে আবার দৌড় লাগালো। ডাইনি বুড়ি আপেল গাছের কাছে এসে আগের মতো জিজ্ঞাসা করলোঃ
“ওরে আমার আপেল গাছ! ওরে আমার গাছ!
বদমাশ এক পিচ্চি মেয়ে দেখেছিস নাকি আজ?
এদিক দিয়েই গেছে সে যে ঝোলা কাঁধে নিয়ে
ভর্তি ঝোলা আমার যতো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে!”
আপেল গাছ উত্তর দিলোঃ
“দেখছি বুড়ি দেখছি মেয়েটারে
এ পথে গেলে পাইবা তুমি তারে”
তারপর ডাইনি বুড়ি সেই পথে তাড়া করে গিয়ে একসময় মেয়েটাকে ধরেই ফেললো। স্বর্ণমুদ্রা কেড়ে নিয়ে খুব মার মারলো। আর দূর দূর করে তাকে তাড়িয়ে দিলো, কোন বেতন, টাকা পয়সা না দিয়েই!
===========
।।আমার গল্পটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।

মূল গল্প