বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১০

এই লেখাটা তার জন্য...

সে আসবে জেনে আমি তেমন কোন আবেগ বোধ করি নি প্রথমে। জেনেছি সে আসছে, খুশি হয়েছি যে খুব তাড়াতাড়ি এই অক্টোবরেই তার সাথে দেখা হবে। সে আসলে তার সাথে বেশ খাতির জমাবো ঠিক করে রেখেছিলাম। এমনিতেই আমি বেশ হাসিখুশি মিশুক মানুষ। প্রাথমিক জড়তা থাকে অপরিচিতের সাথে, সেটা কেটে যেতে একটু সময় লাগে। কিন্তু তারপরে আমি ভীষণ মিশে যেতে পারি কারো কারো সাথে। যাদের ভালো লাগে, তাদের দেখলেই ভালো লাগে। তাই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যে যদি তাকে আমার ভালো লাগে, তাহলে আমি তার সাথে বেশ খানিকটা সময় কাটাবো।

অক্টোবরে বাংলাদেশ খুব সুন্দর হয়ে ওঠে সাধারণত। আমি জানি এই কথার তেমন কোন প্রামাণ্য ভিত্তি নাই। তবে আমার ভালো লাগে। বাংলাদেশ ছোট হতে হতে আমার কাছে এখন খালি ঢাকা শহর হয়ে উঠেছে। আর ঢাকা শহরটাও পুরোটা আমার কাছে নেই, বাসস্থান আর দপ্তরের রাস্তাকতক এদিক সেদিক, দু'তিনটে গাছপালা, কয়েকটা ঘুপচি গলি-উপগলির মোড়, আর অবিরাম যানজট মিলিয়ে এই নগর সংকুচিত এখন। তো যখন অক্টোবর আসে, বৃষ্টি থেমেই গেলো প্রায়। শুকিয়ে এলো ড্রেন নামের নালাগুলো। গাছগুলো একটু হাঁফ ছাড়বার সুযোগ হারালো। ছাতা গুটিয়ে জবুথবু কেরানিগুলো আবার তেলচিটে শার্ট পরে ঘামা শুরু করলো। আমি অবশ্য এগুলোকে তেমন পাত্তা দেই নি। এদের এড়াতে আমি উপরে আকাশের দিকে তাকিয়েছি। তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। থরে থরে শরতের আকাশের হুবহু নকল যেন! অথচ এখন হেমন্ত যায় যায়। ধানক্ষেত তো নেই আশেপাশে, তাই টের পাই না কার্তিকের ঘ্রাণ। খালি সিএনজি গ্যাসে ভরা গাড়ি নাকে ঢুকে যায়। তেল পোড়ে হেঁশেলে, গ্যাস স্টেশনে। মাঝে মাঝে অক্টোবরের বিকেলে বাতাস নামে শহরে, আমি সে সময়ে ঘরের বাইরে থাকি বলে টের পাই... শহরটা গিজগিজ করছে দীর্ঘশ্বাসের তৈরি মানুষে। এই মানুষের ভীড় একেবারে খারাপ না - বৈচিত্র্যময় দারুণ।

তারপরে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে সে আসছে। একদিন হঠাৎ জানতে পেলাম গভীর শেষ রাতে আসবে সে। যখন খবর পেলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারো পার। আমি ঠিক করলাম যে খুব ভোরে উঠে তার সাথে দেখা করতে যাবো। ততোক্ষণে সে নিশ্চয়ই বেশ ধাতস্থ হয়ে যাবে ঢাকা শহরের চারপাশে। 'ভালোই হবে', ভেবে আমি 'ঘুমুতে গেলাম, যাচ্ছি' করছিলাম। ঠিক তখনই ফোন এলো যে জরুরি খবর - সে আসছে সময়ের একটু আগেই। আমি তড়িঘড়ি তৈরি হলাম, দেরি করা যাবে না। রাতের ঘুমের নিকুচি - তার সাথে দেখা করেই ঘুমাবো 'খন। সাথে করে ক্যামেরাখানা নিয়ে বের হলাম, যদি তার সাথে প্রথম দেখার সময়টা ধরে রাখতে পারি তো বেশ হয়।


মধ্যরাত পেরিয়ে পৌঁছালাম হাসপাতালে, জরুরি বিভাগ - কাচের দরজা - খুলে ঢুকতেই দেখি কান্নার শোরগোল। একটু আগেই একজন প্রৌঢ় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। হাসপাতালে আনতে আনতেই ভবলীলা...। তার পুরো পরিবার শোকে থরথর। মনে একটু কু-ডাক দিলো। মৃতের পরিবারের একজন আবার আমার ভাইয়ের পরিচিত। টুকটাক কথা বিনিময় হলো। আমরা শোকার্ত পরিবার পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। কু-ডাক লাপাত্তা হলো তার মায়ের মুখ দেখে। তিনি বেশ চুপচাপ। অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তাটুকু প্রকাশ করছেন না। আমি সেই মা হতে চলা আপুকে ডাকি পলিটিশিয়ান, আমার বেশ বড়ো তো, তাই আপুর বুদ্ধিতে বরাবরই ধরা খাই। বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। উৎকন্ঠা কমে না। প্রক্রিয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ সবসময়। কয়েকবার করে ডাক্তার দুইজনের সাথে কথা বলে বলে একটু শান্ত হওয়া গেলো।

রাত ধীরে ধীরে চুইংগামের মতো লম্বা হচ্ছে। সেই রাতটুকুকে চিবুতে চিবুতে হঠাৎ খেয়াল করলাম প্রায় দুইটা বাজে। একটু খিদে লেগে গেলো। লাজশরমের মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আর কারো পেট ডাকছে নাকি। পেটুকের দলের কোন লজ্জা থাকে না, এই বাক্য প্রমাণ করে ভাই, দুলাভাই ঈষৎ মাথা দুলালো। সে আসুক, নির্ভার হয়ে খাদ্যের ভার নেয়া যাবে। এই অপেক্ষার মধ্যে হাসপাতাল নিশ্চুপ। লোকজন নেই, আমরা কয়েকজন বসে রইলাম। আমি, আপুর ছোটভাই, দুলাভাই, আপুর মা-বাবা-শাশুড়ি। আপুর মা বাবা দুইজনই এই প্রথম নানা নানি হতে চলেছেন। তাই তাদের উদ্বেগ কয়েক হাত দূরে বসেও দিব্যি টের পাচ্ছি। আমি একটু হাল্কা করতে আপুর মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে তার কীভাবে দেখা হলো। শুনে একটু হাসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, 'তোকে দেখে প্রথমে বুঝতেই পারি নি। হাসপাতালের কেবিনে এসে দেখি কাঁথার ওপরে একটা বাবু হাত-পা ছুঁড়ছে। ভেতরে গিয়ে তোর মায়ের দেখা পেলাম, তারপরে সে জানালো বাইরের ঘরে রাখা কাঁথার ওপরের মানুষটাই তুই।' একটু হাসলেন তিনি। অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে গেলো তার। ভালোই হলো, একে একে বাকিদের খবর বেরিয়ে এলো। কে কীভাবে এসেছে, আপুর মায়ের সব মনে আছে। আমি এক মনে শুনছিলাম।

একটু পরে দুলাভাইকে ডেকে নিয়ে গেলো ভেতরে। সময় হয়ে গেছে তার আসার। আমরা দ্বিগুণ উৎকণ্ঠায় বাইরে পায়চারি করছি। আপুর ভাইটা একটু বেশিই অস্থির। ঢোক ঢোক পানি খাচ্ছে, কারণ যদি রক্ত দেয়া লাগে। পানি খাওয়া শুরু হয়েছে সন্ধ্যা রাত থেকেই। এই কারণে একটু পরে পরে নিম্নচাপ - 'এক্সকিউজ মি, বাথরুমটা কোন্দিকে?' আমি বললাম, 'একটু সুস্থির হয়ে বোস। সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।' ঝামটা এলো উত্তরে, 'আরে তুমি জানো কচু। সাবধানের মাইর নাই। রেডি থাকা ভালো।'

অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা একটু খুলে ছিলো। আমি বুদ্ধি করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যদি আওয়াজ পাওয়া যায়, সে এলেই টের পাবো। মাঝে মাঝে আপুর বাবাকে দেখছি খালি করিডোরে পায়চারি করছেন। হাতে তসবি, নিবিষ্ট চোখে প্রার্থনা।

হঠাৎ একটা চিল চিৎকার। রাতের সময় বলে চারিপাশে আর কোন সাড়াশব্দই নাই। 'সে কি এলো?' আমরা একটু শশব্যস্ত হয়ে উঠি। ভেতর থেকে একজন দ্রুত বেরিয়ে পাশে NICU -তে ঢুকে পড়লো। 'নাটক করছে কেন এরা, বলে দিলেই পারে!' ভেতর থেকে সাড়া নেই। অস্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকারটা একটু পরে আবার শোনা গেলো, স্পষ্টতর, সুতীক্ষ্ণ। 'সে কি এলো?'

আপুর মায়ের চোখে একটা হাসি ঝিলিক দিয়েই উদ্বেগের ভারে চাপা পড়লো। আপুর বাবার হাতের আঙুলে তসবি শ্লথ। আরো তিনচার মিনিট পেরিয়ে গেলে দুলাভাই বেরিয়ে এলেন। মুখে হাল্কা নীল মুখোশ। চোখে হাসি। মাথাটা হাল্কা উপরে নিচে দুলিয়ে বললেন, 'ছেলে'।

আপুর বাবা তখন একদম তৈরি, আজান এই দিলেন বলে। নার্স জানালো আরেকটু অপেক্ষা করেন। নিয়ে আসি তাকে। 'বাচ্চার মা কেমন আছে?' 'এখনো সেন্সলেস, তবে স্টেবল'। পাথর চাপা দুশ্চিন্তা ফুরফুরিয়ে উড়ে গেলো!...


থিয়েটারের ভারি কাচের দরজা ঠেলে সে বেরিয়ে এলো, এসে ড্যাবড্যাবে চোখে টিউব লাইট দেখছে। এতো রাত হয়েছে, কিন্তু ঘুম নেই দেখি! সারা শরীর আঁটোসাঁটো কাঁথায় মুড়ানো। মাথায় তুলোট টুপি। গোলগোল রক্তাভ গাল, ছোট এক্টুস পাতলা ঠোঁট। আর বড়ো বড়ো চোখ। পুরো চোখ খুলতে পারছে না সে। আর একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে শীতে। আমি বেশ কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে বেশ অদ্ভুত দৃষ্টি দিলো এক পলক। তারপরে অন্য দিকে চাইলো একটু। এদিক সেদিক। জঠরের উত্তাপ খুঁজছিলো বোধহয়। তাই তাকে আবার ভেতরে নিয়ে গেলো নার্সটা।

তাকে এক পলক দেখেই আমার মনে হলো তার সাথে আমার আরো অনেক অনেক বার দেখা হবে। কিন্তু তার বিশ মিনিট বয়সের সেই পরিচয়ের মুহূর্তটা আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। সাক্ষাতে দুইপক্ষের সমান আগ্রহ বা মনোযোগ থাকে না জানি। এই সাক্ষাতটাও তেমনি। সংক্ষিপ্ত - সরল - সরাসরি। এই লেখাটা তার জন্যে। অক্টোবরের আধা রাত আধা ভোরে যে এই শহরে এলো, এবং এখন থেকে সে এখানে জল-কাদা-বাতাসে বড়ো হয়ে উঠবে। তার জন্যে।

একটু পরে ফুরফুরে মনে আমরা তিন জন, খেতে বেরুলাম। পেটে ইদুর ডনবৈঠক দিয়ে অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে। তারে দাফন করে আমরা বেশ খানাদানা করলাম। খাবারের দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তার মাথায় পুব দিকে দেখলাম সূর্যলাল হয়ে উঠছে। মেঘগুলো রঙচঙে হয়ে গেছে বেশ। এতো সাজ! পাখির কিচিরমিচির। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভাঙা ভাঙা আলো। পৃথিবীতে আজ সুন্দর ভোর...

এই সুন্দর পৃথিবীতে তোকে সুস্বাগতম জানাই...!!!

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১০

সান্ধ্যচিন্তা... অপ্রাথমিকতা ও অবিকলতা

=====
ফিলোস-ফিক্যাল
=====
শোনেন, বেশি বুইঝেন না। আর যা বুঝেন না,
সেইটা নিয়া ফটর ফটরও বেশি কইরেন না।
একদিন না একদিন ধরা খাইবেন,
জারিজুরি ফাঁস হইবো
পাবলিক আইসা গদাম মাইর দিবো
যারা শান্তিকামী গান্ধীবাদী,
তারা আপনের বেকুবিতে হাহাহিহি হাসবেন
ফিলোসোফিকে উল্টায় দিলেও ফিলোসফিই থাকে, বুঝছেন?
=====
=====
বেচাল-বিড়াল
=====
জাদুবিদ্যায় পারদর্শী এক অখ্যাত বিড়াল বসে আছে
কমলা কমলা কুমড়োর ওপরে, ক্যামেরার দিকে
আছে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে, মাথায় কালো টুপিটা
ধার নিয়েছে তার চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে,
আর পাশের বাড়ির সুন্দর মুন্দর মেয়েটা
ওড়না দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে অবিশ্বাস্য এক সুপার হিরো!
ক্যামেরাটা ছিলো ভুলোর হাতে, সে রেডি হতেই
ভুলো বলল, "ঘেউ", আর শাটার দিলো চোখটিপ -
ছবিবন্দী হলো পৃথিবীর সেরা জাদুবিদ-অতিনায়ক!
=====
=====
উৎচারণ
=====

তোমার্‌ আমার্‌ এই ভালোবাশাবাশি খুব্‌ এক্‌টা ওভিনবো কিছু না। সবাই যেমোন্‌, তেমোন্‌ ভালোবাশে নানাভাবে অ-ভালোবাশিক্‌ কথাবার্ত্তা বোলে বোলে আবাশিক্‌ জিবোন্‌ কাটাচ্ছে। অ্যাতো কিছু বুঝ্‌তে গ্যালে সারাদিনও জেগে থাক্‌তে হবে। বরোঞ্চ আম্‌রা চোখ্‌ মুদে চলো ভালোবাশাবাশি কোরি!
=====

একটি চুমুতে দ্বিধা জমে ছিলো বাতাসে শুয়ে,
সেখানে সেদিন গটমটে বাঘ ঢুকে দাঁড়ালো ঘাড় ফুলিয়ে।
ঠোঁট বাঁকাতেই বকের গলা, ভ্রূকূটিতে সন্ধ্যা,
বাইকের পেছনে তুমি আর ঘন ঘন ব্রেক।
ঢাকার রাস্তা আস্তাবলে ঘোড়ারা ঘুমায়,
আঁকাবাঁকা গাড়িগুলো অমল ধবল চিত্রলেখ!
=====

১৯.১০.১০

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১০

পাখি মন্ত্রণা

আর কতোকিছুই তো ভালো লাগে কাঁপনে মিশে থাকে এইসব দিনরাত্রির গান অজস্র কোলাহল আন্তরিক টানটান হলাহল ডুবে থাকে চুলের ভেতর, মৃদু সৌরভ…

আমাকে প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কেমন আছি। আমি খুব সরলমুখে বলে দেই, আমি ভালো আছি; অথবা বলি, এই তো চলতেছে; কিংবা বলে ফেলি, ভালোই আছি। এরকম বেশ কিছু টেমপ্লেট জবাব তৈরি থাকে – বলে ফেলতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। তারপর ভুলে যাই, অন্য বিষয়ে চলে যাই। তাকেও হয়তো পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেও ভালো থাকার কথা জানিয়ে দেয়। আমরা দুইজনেই তখন ভালো থাকতে থাকতে অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের তুচ্ছ ভালো লাগার চাইতে এইসব মানুষিক ব্যাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো কোথাও বাজ পড়ে। হয়তো কোন একটা গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ে, ডালের খাঁজে বাসা বেঁধেছিলো কোন খয়েরি পাখি, বাসার ভেতরে ছিলো তিন চারটে নতুন শিশু পাখি। ডাল ভেঙে যখন মাটিতে নেমে আসে, পাখিগুলো উড়ে চলে যায়… দূরে, অনেক অনেক দূরে…! এই পাখিরাও ভালো থাকে হয়তো, আমার সাথে যদি দেখা হতো, তাহলে আমি তাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছেন? তারা স্মিতমুখে বলতো, ভালো আছি। আপনার কী খবর? আমি হাতে একটু ভঙ্গি করে বলতাম, ‘এই তো চলতেছে’।

পাখিগুলো মারা গেছেন সবাই। মৃতের সরকারি সংখ্যা ৪, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি ডালে বসবাসকারী পাখি জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা ৫। সরকার একটি পাখির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে নাই। তারা মনে হয় ভুলে গেছে গুনতে। আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্যে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে ফোন দিলাম। অনেকক্ষণ রিং হচ্ছিলো, কিন্তু কেউ ধরছিলো না। ঘাম-শুকানো দুপুরে আমি চাতালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কানে রিসিভার চেপে ধরে রাখলাম। একঘেঁয়ে স্বরে রিং বাজছে, ট্রিং ট্রিং…

এভাবে অনেকক্ষণ, জানি না ঠিক কতোক্ষণ, রিং বাজার পরে একজন ফোন ওঠালেন। আমি চমকে গেলাম, কানের ভেতরে বাজতে থাকা ট্রিং ট্রিং ততোক্ষণে মাথার ভেতর বাজতে শুরু করেছে। সেই বাজনায় চকিত ছন্দপতন। ‘হ্যালো’, খ্যানখ্যানে স্বর শুনে একটু দমে গেলাম। আমি ফোন করেছি সরকারি হিসাবের ভুল ধরতে। যে লোকটি ফোন ধরেছে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমি পরিষ্কার দেখছিলাম লোকটা পেটমোটা কুমড়োপটাশের মতো। একটু আগে দুপুরে ভাত খেয়ে এসেছে, সাথে ঝোল ঝোল তরকারি আর সবজি ছিলো। ভাত খেয়ে মোড়ের দোকান থেকে একটা পান কিনেছে। পান চিবাতে চিবাতে এসে আয়েশ করে চেয়ারে বসে ফোন ধরেই গলা খাকারি দিয়েছে, ‘হ্যালো’। মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে তেমন কাজ নেই বোধহয়! তাই তারা এতো ঢিলাঢালা।

আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ভুল রিপোর্ট নিয়ে ফোন করেছি’, একটু থেমে আবার বলি, ‘গতকাল খবরে মৃত পাখির সংখ্যা ভুল বলেছেন আপনারা, আসলে মোট ৫টা পাখি মারা গেছেন – আপনারা লিখেছেন ৪টা। একটা পাখির হিসাব দেন নি’। লোকটা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেছে, পান চিবানোর শব্দ পেলাম না, বরং দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল, ‘হতে পারে একটা পাখির হিসাব মিলে নাই। তাতে কি হইছে? গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’


তার তীব্র স্বরে আমি মারা গেলাম। প্রশ্নটা অশ্লীল লাগছে। প্রশ্ন করার ফাঁকে তার দাঁত চিবানো বা পান চিবানো অশ্লীল লাগছে। রিসিভার বেয়ে কানে পৌঁছে যাওয়া তার কণ্ঠস্বর অশ্লীলতায় থকথক করছে। আমি যে হাতে রিসিভার ধরে ছিলাম, সেই হাতটাকে কোনো ঘিনঘিনে কমোডের ভেতরে ডুবিয়ে রেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এই প্রবল অনুভূতিগুলো আমাকে মূক করে রাখলো। টেলিফোন সেটটায় কি কোন সমস্যা আছে? লোকটা ফোন ধরার আগে কানে ট্রিং ট্রিং প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো। আর এখন তার শেষ প্রশ্নটা গনগন করছে কানের ভেতর।

‘গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

‘বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

‘আপনের কি?’

‘কি?’

আমি একদম নিথর হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাইরে স্তব্ধ দুপুর আর ঘোলাটে হলদে আলোটা অনেকটা সময় আমার সাথে স্থির হয়ে থাকলো। তারপরে প্রশ্নটা আমার ফুসফুসে পৌঁছে গেলে আমি রিসিভার আলতো করে নামিয়ে রাখলাম। তারপরে চুপ করে বসে রইলাম। পাখিটি মারা গেছেন। পাখিটি বাজ পড়ে গতকাল মারা গেছেন। আজকে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয় তাকে ভুল হিসাব করে গোনায় ধরে নি। পাখিটি ডালের ফাঁকে পাতার গভীরে শুয়ে আছে। তার পেলব বুকে একটা স্পন্দনও আর বাকি নেই। কয়েকটা সবুজ পাতা পুড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আরো কিছু পাতা এখনও সবুজ হয়ে আছে।

হঠাৎ কেমন বাতাস হলো, মৃদুমন্দ শিহরণ। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবুজ পাতা কয়টি পাখির স্পন্দনহীন দেহটিকে ঢেকে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

*****

১৪.১০.১০

শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১০

জগাখিচুড়ি দুই নম্বর!

 ক্রেজ অর্থাৎ উন্মাদনা টের পেলাম ফেইসবুক থেকে। আমার খোমাখাতা-বন্ধুমহলে অনেকেই তার ভক্ত বলে দেখলাম নতুন গানের খবরাখবর জানতে সবাই ইচ্ছুক। প্রায় দুই বছর হয়ে গেলো তাই সবাই জানতে চাইছে কবে নতুন গান - নতুন অ্যালবাম আসবে। আমিও ইতস্তত ঘুরঘুর করলাম অর্ণবের ফেইসবুক পাতায়। কিছুদিন পরে জানলাম, 'রোদ বলেছে হবে' অ্যালবামের নাম। রিলিজ পেলো এই গত সপ্তাহে। আমি কিনলাম গতকাল।

অর্ণবের গান নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়ে গেছে। গত চার-ছয় বছরে একটা নির্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে তার। 'বাংলা' ব্যান্ডের গীটারিস্ট আর ভোকাল অর্ণব যখন 'সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছে ঘর' অথবা 'তুই গান গা' গেয়েছেন, তখন থেকেই তিনি পরিচিত। এরপরে 'সে যে বসে আছে' থেকে যে তুঙ্গ খ্যাতি সেটুকু সরিয়ে তার সাথে নিবিড় পরিচয় হলো "চাই না ভাবিস" অ্যালবামে। অ্যালবামটিকে আমি একশব্দে বলি, 'ভিন্ন', আরেক শব্দে বললে 'অগতানুগতিক'। সেটা অর্ণবের গলা, বা গায়কী ঢঙকে বাদ দিলেও গানের কথা আর সুরের কারণেও অনেকটা, বেশিরভাগটা। সম্ভবত ভার্চুয়াল জগতে আমার দেখা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গানের কলি "হারিয়ে গিয়েছি" গানটি থেকে নেয়া।

সে যাকগে। অসংখ্য তারিখ-না-জানা রাতের নিঃস্তব্ধতায় যেসব গান সঙ্গ দিয়েছে, সেগুলো না হয় নিজের জন্যেই তোলা থাক। তবে অর্ণব খুব ধুমধাড়াক্কা নন। রক-মেটাল রক জঁরার বাংলা গানগুলো যেমন ব্যান্ডভিত্তিক চর্চিত হয়, সেভাবে দেখলে নতুন বা ভিন্ন ঘরানায় আধুনিক গান ছাড়া কিছু ছিলো না। সেই ক্লিশে গানের কথা, তুমিয়ামির জলো বাতচিত ফেলে দেয়ার সময় অনেক আগেই হয়ে গেছে। ফিউশন থেকে ভাটিয়ালি বা পল্লীগানকে তুলে এনে রিমিক্স করা হচ্ছে নানাভাবে, সেখানেও মৌলিকত্ব হারায় অতিরিক্ত যন্ত্রের মন্ত্রণায়। তাই চুপচাপ অনেকেরই অর্ণব প্রিয়।

"চাই না ভাবিস" -এর পরে "হোক কলরব" আর "ডুব" একদিকে যেমন অনেক রকম খেয়াল খুশিতে গানবাজনা তুলে আনছে, সেখানে অর্ণবের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে দিনে দিনে। 'ডুব'-এর বেশ কিছু গান শুনে মনে হয়েছে কিছুটা কি জনপ্রিয়তার ভূতে ধরলো? কিছুটা কি তরুণ চাপল্যে পেলো তাকে? যে সুরগুলো জমে জমে শ্রোতার ভেতরে জায়গা করে নেয়, তারা এবারে হয়তো একটু লঘু হয়ে উঠেছে। "ডুবে"র পরে তাই আশা করছিলাম পরের অ্যালবামে অর্ণব আরেকটু সচেতন হবেন। সঙ্গীতের এতো এতো দিক, বিচিত্র গলিঘুপচি যেখানে খুঁজলে দারুণ দারুণ সব মণিমুক্তা পাওয়া যায়। তিনি না হয় সেই পথেই হাটুক। প্রথাগত চটুল জনপ্রিয়তা গানবাজনার বারোটা না বাজাক।


তাই "রোদ বলেছে হবে" নিয়ে বেশ আগ্রহ জন্মালো। খাপের ভেতরটা একটু আলাদা। একটা ছোট লিফলেটের মতো বই, লিরিক ভেবেছি। কিন্তু শেষ চারপাতায় পেলাম গানের লিরিক, তার আগের পাতাগুলো অদ্ভুত সুন্দর একটা গল্পে সেজে আছে। অর্ণবের লেখা, ছবিগুলোও তার আঁকা। অর্ণবের আঁকাআঁকি আগে দেখার সুযোগ হয় নি, তাই রীতিমত মুগ্ধই হলাম। ডিজিটাল পেইন্ট নিয়ে দেখাশোনা কম, গ্রাফিক্সের কাজ দেখে তাই আসলেই ভাবছিলাম মানুষের কল্পনা কতো বিচিত্রই না হয়! অনেকটা অর্ণবের মাথার ভেতরে ঢুকে পড়েছি মনে হচ্ছিলো। (Being John Malcovich!) আর যে গল্পটা অর্ণব বললেন, একটা সোনার হরিণ, সেই স্বপ্নপোকা, মায়াঘাত মাখা তীর, দুটো তীব্র আঁধার চোখের আক্রমণের, সেই গল্পটা আমি বলতে চাই না এখানে। কোন অ্যালবামের মাঝে এমন কিছু পাওয়ার জন্যে শ্রোতামন প্রস্তুত ছিলো না!

শেষ কথাগুলো বারবার ভাবছি...


সব সবুজ...
লাল হয়ে উঠছে ...
রোজ
আমার চারপাশে
বাক্স বাক্স ...
আহাম্মক বাক্সের দল!

CD তে মোট বারোটা গান। প্রতিধ্বনি, চিঠি পাঠাও, রোদ বলেছে হবে, মাথা নীচু, ইনিয়ে বিনিয়ে, বিড়ি, কে আমি, আমি যদি, মন খারাপ, একটা মেয়ে, মেঘ ফেটে গেছে, তোমরা যা বলো।

তুলনামূলকতা চলে আসে, প্রিয় গান শুনতে গেলে। তাই প্রতিধ্বনি শুনতে শুনতে হোক কলরব অ্যালবামের ঢঙ মনে পড়লো। গীটারের টোনের দিক থেকে খুব সজীব একটা আমেজ তৈরি হতে থাকে। অবশ্যই তো। তুমি একটা গানের যাত্রা শুরু করছো, সেটা কেন বিষণ্ণভাবে শুরু করবে? আসো, পথে নামি, রওনা দেই।

ঘাসফড়িং ও পাখির বুকে স্বপ্ন যতো
প্রাচীন কিছু সংগ্রহের গান হয় নিহত
সঙ্গীবিহীন সব হারানোর দুঃখ জেনে
রূপকথা তার সময় মতো নিয়ম মেনে।
(কথাঃ রাজীব আশরাফ)

অ্যালবামের সেরা গান সম্ভবত "চিঠি পাঠাও"। বিক্রম সিংয়ের লেখা গানটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগে গেছে। গানের মেজাজ সেই পুরনো 'চাইনা ভাবিস'-এর মতো মনকাড়া। প্রতিধ্বনি গানের রেশ কাটতে না কাটতেই অর্ণব হুট করে টেনে নিয়ে গেলেন রাতের বিস্রস্ত একাকীত্বের মধ্যে। সেখানে আমার সাথে কেবল আমি। চারপাশে নিশ্চুপ হয়ে আসা স্ট্রীটলাইটের ক্ষীণ আলো। এই সময়ে আর কিছু দরকার নেই, কিছুই না!

"শীতলপাটি চিনেছে রাত চিরকাঙাল
চির কাঙাল স্নেহের মতো একটু দিন
ভেঙেছে কতো নষ্ট ঢেউ উন্মাদের
কতো না মেঘ মেঘের কাছে বেড়েছে ঋণ।
মেঘের নীচে চাদোয়া নীল মফঃস্বল
মেঘের নীচে হেসেল ঠেলে বিষণ্ণতা।।"
এমন নিবিড় কথা, কবিতাই তো। একই সাথে গোপন আর সৎ, একই সাথে অভিমানি আর নিস্পৃহ। আমি এই গানটিই বারবার ঘুরে ফিরে শুনছি।

এর পরে শিরোনামের গান ''রোদ বলেছে হবে", এবং এই গান হতাশ করেছে 'ডুবের' গানগুলোর মতো। হয়তো ভিন্ন মুডের সাথে এই গানের অন্য চরিত্র ধরা পড়তে পারে, তবে আমার কাছে তেমন একটা আহামরি মনে হয় নি। এটার কথা রাজীব আশরাফের লেখা। তবে 'প্রতিধ্বনি'র কারণে তাকে আর দোষ দিলাম না।

এর পরের গান (মাথা নীচু)-এর কথা সাহানা বাজপেয়ীর। 'স্বপ্ন দেবে ডুব' যেমন ভাবিয়েছিলো, উস্কে দিয়েছিলো অনেক অনেক চিন্তার উনুন, তেমনি এই গানটিও ভাবাচ্ছে। সুরের দিক থেকে একটা থমথমে আবহের সাথে গানের কথাগুলো মিলেমিশে একটা অস্বস্তিকর অনুভব দেয়, যে অনুভব আমাদের বাস্তবতার একটা নিয়মিত অনুষঙ্গ। যেমন প্রতিক্রিয়াহীনভাবে আমরা খানিকটা বিযুক্ত হয়ে আছি আমাদের বাস্তবতায়, সেটারই ছবি এই গানে।
কথার বেড়া গেঁথে দিয়ে গেছে, কবেকার কোন কবি
বলবার কিছু বাকি নেই আর, নিথর নীরব এ ছবি

"ইনিয়ে বিনিয়ে" চমৎকার গান। তাল লয় মিলিয়ে সেই খাপছাড়া অর্ণব। মজা লাগে, এমন বেখাপ্পা তালের গানে মিশ খেতে খেতেও যেমন বেলাইন হয়ে যাওয়া, পাগলামি ঘরানার এই সুরটুকু জমতে জমতে আইসক্রিমের মতো গলে যেতে থাকা। পাহাড় থেকে বরফখণ্ডের গড়িয়ে পড়া বা উঠে উঠে আসা ধোঁয়ার মতো গান। জোহাদের সাহায্যভোকালটাই খালি বাজে লেগেছে। অর্ণবের গলার সাথে মিশেও নাই, পরিপূরকও হতে পারে নাই।

এই সুযোগে অর্ণবের গলা নিয়ে কিছু কথা বলে রাখি। এই অ্যালবাম শুনে মনে হচ্ছে হয়তো তিনি গলার যত্ন কম নিচ্ছেন। ফলস নোটে এতো বেশিবার চলে যাওয়া, লিরিক বেশিরভাগ জায়গাতেই অস্পষ্ট হয়ে ওঠা পীড়া দিয়েছে। হুট করে লিরিক হাতে না নিয়ে গান শুনতে বসে শব্দ বুঝতে না পারা শ্রোতার কাছে বিরক্তিকর, গায়কের জন্যে বিব্রতকর। তার এই দিকে আরো সচেতন হওয়া দরকার। আর ভুল উচ্চারণও পীড়াদায়ক ভীষণ। বানান ভুল যেমন একটা সুন্দর লেখার বারোটা বাজায়, তেমনি ভুল উচ্চারণের গানের আমেজের ক্ষতি করে। বিদেশে দেখি বুড়ো বুড়ো গায়কেরাও কী চমৎকার গলা ধরে রেখেছেন, আমাদের দেশের গায়কেরা কেন গলার বারোটা বাজান? সেটাকে ঠিকঠাক না রাখলে যতোই ভালো সুর আর কথা হোক না কেন, গান শুনতে ভালো লাগে না।

"বিড়ি" গানটার শিরোনাম যতোটা চমক দেয়, গানটি ততোটা মুগ্ধ করেনি। বিড়ি খেলে হয়তো আরো একটু রিলেট করতে পারতাম, তবে সে ব্যাপারেও সন্দিহান। প্রথম লাইন (হাত থেকে বিড়ি পড়ে যায়) ছাড়া বিড়ির গুরুত্ব বুঝলাম না। তাই এটাকে দ্রুত পেরিয়ে যাই।

অ্যালবামের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর গান সম্ভবত "কে আমি"। এমনকি লিরিকের হিসেবেও প্রাণবন্ত (রাজীব আশরাফ আবারও)। এই গানে বিশেষ করে যেটা কানে বেজেছে সেটা হলো গীটারের নির্দিষ্ট একটা প্রগ্রেশন। অর্ণবের অ্যালবামে এমন দুয়েকটা গান থাকেই, সেগুলো বাজনার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে। 'কে আমি' সেই কানের ক্ষিধেটা খুব ভালোভাবেই মিটিয়ে দিয়েছে। আর এই গানটা শুনে মনে হয়েছে লংড্রাইভে দারুণ মানাবে!

"রোদ বলেছে হবে"তে অর্ণব নিজে দুটো গান লিখেছেন। তার প্রথমটা "ইনিয়ে বিনিয়ে", আর পরেরটা "আমি যদি"। কিছুটা ফোক ঘরানার লিরিক, তেমন নজর কাড়ে নি, তবে এই গানটা অর্ণবের গাওয়ার গুণে একেবারে খারাপ লাগছে না!

বৃষ্টিমুখর দিনে শুনছিলাম, সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো বলে করার কিছু ছিলো না। তাই রাজীব আশরাফের তৃতীয় গানটা খুব ভালো লেগে গেলো। "মনখারাপের একটা সকাল, শূন্য আকাশ সফেদ নীলে, ক্লান্ত কোন চিলের প্রতি, তুমি কি আজ দিয়েছিলে? একটা অচীন ছায়াও তখন তোমার পাশে গোপনে, দাঁড়িয়ে ছিলো একান্তে ঠিক খুঁজতে তোমায় অনুরণে।" মন খারাপ সময়গুলোতে যেসব গান বালিশে ওয়াড়ে মিশে থাকে, আদর করে, সেগুলোকে তো ফেলে দিতে পারি না। সেগুলো মনের ভেতরে, ত্বকের গভীরে সেঁধিয়ে যায় খুউব!

ভালো লাগার দিক থেকে তিন চার নম্বরে যে গানটা, সেটা এর পরেই, শিরোনাম "একটা মেয়ে"। এই গানটার লিরিক এক কথায় অসামান্য লেভেলে ভালো লেগেছে। মেয়েটা হয়তো জানে না, তাকে নিয়ে কি অদ্ভুত গান গাইছে আরেকটা ছেলে। এই অনুভূতিপ্রবণতা, এই অন্যকে বুঝে ওঠার নিরন্তর চেষ্টা মানুষ এখন অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে মনে হয়। ভার্চুয়ালি কতো কতো দূরত্ব পাড়ি দিয়েছি আমরা, তাই তো পৌঁছুতে চাই মনের গহীনে। কী আছে তোমার মনে, মেয়ে? এক এক শব্দে উঠে আসছে টুকরো টুকরো মেয়েটা।
একটা মেয়ে/ কাক ভেজা রোদ/ রোদ পোড়া ঘাস/ কাশফুল/ দীর্ঘশ্বাস/ পথের পাশ/ মনের ভুলে/ রঙিন ফুল

তবে কাব্যিকতায় সবগুলো গানকে ছাড়িয়ে গেছে - মেঘ ফেটে গেছে। এবং আমি খুশি হয়েছি যে এই গানের কথা সাহানা বাজপেয়ীর লেখা দেখে। হুট হুট করে এমন কিছু লেখেন, মুগ্ধ হয়ে যাই!
"কোপাই'র মেটে জল থেকে, বুনো গন্ধে ভিজে
বকের ওই দলটা উড়ে এলো আমার দিকে
গত বিকেলের বার্তাসহ, ডানায় নিয়ে কাশফুলের রোঁয়া।
এই বেশ ভালো
মেঘ ফেটে গিয়ে চুঁইয়ে পড়া একটুখানি আলো"
একু্য়স্টিক গীটারে একেবারে খালি গলায় গান! আহা! চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম, কোন বৃষ্টিশেষের বিকেলে বন্ধুরা মিলে গোল হয়ে এলোমেলো বসে আছে। আর পুরো দলের মাঝে একজনের হাতে গীটার, সে মেঘধোয়া আকাশের দিকে চেয়ে আনমনেই এই গানখানি গাইছে। বাকিরাও হয়তো তার সাথে মিলে মেঘফাটা সেই একটুখানি আলোর দিকে তাকিয়ে আছে!

আর শেষ গানখানা রবিবাবুর। আর অর্ণবের সেই পাগলা অ্যারেঞ্জমেন্ট। সেই বেখেয়াল উদাম গলা, যে গলায় সাধারণত অন্য গানগুলো সে গায় না। ভালোও লাগছে, আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আসল অ্যারেঞ্জমেন্টটাই ভালো ছিলো। যতোগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন পর্যন্ত অর্ণব গেয়েছেন, সেগুলোর সবগুলোতেই আমার এই রকম মনে হয়েছে। তবু, এই প্রচেষ্টাটুকু 'রক ইউদ রবীন্দ্রনাথ' টাইপের আবালামির চাইতে অনেক ভালো!


(*পুরো অ্যালবামের কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশটা বাংলায় দেয়ার জন্যে অর্ণবকে ধন্যবাদ। সবাই কেন যে এটা ইংরেজি দেয় আমি বুঝি না। বাংলার মানুষ, বাংলায় গান গেয়ে যদি ইংরেজিতে ধন্যবাদ জানায়, তবে কেমন উটকো আচরণ বলে মনে হতে থাকে। সেটা এখানে ঘটে নি।)