আমি যে শহরে বাস করি, সেখানে ফুটপাতে প্রায়ই পাগল পাওয়া যায়। আপনি যদি
ভাবেন এটা উল্লেখযোগ্য কোন বিষয়ই নয়, তবে আপনি ভুল করবেন। পৃথিবীর আর
কোথাও এমন বৈচিত্র্যময়, উদ্ভিন্ন পাগল আপনি ফুটপাতে ফুটপাতে বিজ্ঞাপিত হতে
দেখবেন না। পৃথিবীর পথেঘাটে এভাবে তাদেরকে ছেড়ে রাখা হয় না। তারা মানব
প্রজাতির অমূল্য সম্পদ, তাই তাদেরকে কড়া রক্ষণাবেক্ষণে রাখা হয়।
প্রজাতিটির বর্তমান চালু নমুনাগুলো চায় না তাদের এই উন্নত জেনেটিক্স থেকে
আরেকটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হোক। তাই তারা জননরোধী হয়ে উঠেছে, পাগলের
মস্তিষ্কের জিন যেত প্রবাহিত হতে না পারে সকল পাগল-জরায়ু এবং
অপাগল-জরায়ুতে, এজন্য তারা পাগলদের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
সে যাক গে, যা বলছিলাম, আমার শহরে এমন কোন সতর্কতা নেয়া হয় নি। ভবিষ্যতেও
হবেও না, মেয়রসাহেব সেদিন বললেন। তাই এখানে দেদারসে পাগল ঘুরে বেড়ায়
রাস্তাঘাটে। বিভিন্ন আইল্যান্ডগুলোতে তারা ছাপড়া ঘর তুলবে কয়েক বছরের
মধ্যেই - এমন চালু গুজব তাই ফুটপাত থেকে ঘোর তপ্ত বাতাসে মিশে পাক খাচ্ছে
আজকাল। আমি বেশ পরিপাটি হয়ে রাস্তায় বেরুলে টের পাই বাতাসভর্তি গুজবগুলো
আমার গালে ঠাশ ঠাশ করে চড় মারছে। মাঝে মাঝে আমাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেয়ার
চেষ্টাও করে, আমি সতর্ক থাকি। কিন্তু আমার শহরের মানুষগুলো তেমন একটা সতর্ক
না, তারা প্রায়ই ল্যাঙ খেয়ে আছাড় খায় ফুটপাতের ওপর। অনেকে হন হন করে
হাঁটার সময়ে ভুল করে, উড়ে গিয়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে। তখন কোনো এক পাগল
চালক বিনা দ্বিধায় গাড়ির চাকাটা ওই মানুষটার পেটের ওপর দিয়ে চালিয়ে
দেয়। ভগ্ন পেট নিয়ে মানুষটা ল্যালব্যাল করে উঠে দাঁড়ালেও বেশিদিন টিকতে
পারে না। আমরা অনেকে এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আরেকটা জননাঙ্গ কমে
গেলো!
এর পরে আছে আরো নানারকমের বিপদ, আর বলবেন না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়
খালি ফুটপাতেই পাগল পাওয়া যায়, কিন্তু আসলে এই সব পাগলের পাগলামি অনেক
দূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এরা আমাদের দূর্বলতা বুঝে গেছে। বুঝে গেছে যে আমরা
বেশ আত্মবিশ্বাসী। স্যুট টাই পরে আমাদের বুক গর্ব ও টাকার গরমে ফুলে ফুলে
উঠছে। প্রতিদিন রাতে আমাদের বেশ ভালো জননকার্য এবং ঘুম মিলছে, তাই আমরা
পরদিন সকাল সকাল জগিং করতে পারি। শরীরটাকে ফিট রাখতে আমরা কোনো ছাড় দেই
না। তারপরে ঘরে ফিরে ফ্রেশ কমলার জ্যুস খাই আমরা। তারপরে সানস্ক্রিন
মেখেটেখে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়ি। পাগলের এতোকিছু কপালে জুটে না, তাই
তারা তক্কে তক্কে জ্বলতে থাকে। হিংসাও করে আমাদের, ঈর্ষাও করে আমাদের। এই
হিংসা, ঈর্ষা, জিঘাংসা মিলেমিশে একটা খিচুড়ি-ক্ষোভ তৈরি হয় তাদের। তারা
মাঝে মাঝে আমাদেরকে ওভারব্রিজের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। গাড়ি
চালানোর সময়ে আমরা একটু বেখেয়াল হলেই এক্সেলেটর চেপে ধরে জোর করে আমাদের
গাড়ি-দূর্ঘটনা ঘটায়। এরকম ঘটনা সারাদিন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তাই তো,
শহরের বিখ্যাত দৈনিকটির পাতার পর পাতা ভরে থাকে এইসব খবরে। আমরা যারা
ধাক্কা খাইনি, বা গাড়ি চালানোর সময়ে দূর্ঘটনায় পড়িনি, তারা আজকাল
জগিং করে এসেই খবরের কাগজ ওল্টাই। ভয়ে আমাদের পেটের নাড়িভূঁড়ি সেঁধিয়ে
যায়। ওই লোকটা বা সেই লোকটার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম, এটা ভেবে আমরা
ভয় পাই।
আমাদের মাঝে আমি সহ অনেকেই এই খবর কাগজ পড়ার কাজটা টয়লেটে সারি। এই
শুনুন, নাক সিঁটকাবেন না। প্রাতঃকালীন কর্মটিকে অবহেলা করবেন না। নিষ্কাশ
না হলে খাওয়া দাওয়া ভালো হয় না, জানেন? নিয়মিত সেই কর্মটির সুবিধা করতে
খবরের কাগজ বেশ উপাদেয় প্রভাবক। এটা আমাদের বৃহদান্ত্রকে ভয় পাইয়ে
দেয়, ওই যে বলছিলাম - নাড়িভূঁড়ি সেঁধিয়ে যাওয়া, সেজন্যেই তো আমরা
সুস্থ থাকতে পারি। ধাক্কা খেয়ে তিন তলা উঁচু ওভারব্রিজ থেকে পড়ে যাওয়া
মানুষ বা রাস্তার ফুটপাতের পাশে দুমড়ে মুচড়ে থাকা টয়োটা গাড়ির চালকের
জীবন আমাদের কাছে ইউসুফগুলের ভূষি হয়ে উঠেছে ইদানিং। আমরা খুশি হই, কিন্তু
এটা ভুলে যাই যে পাগলেরা ধীরে ধীরে জিতে যাচ্ছে। কে বলেছে, "সহিংসতা
নিরুপায়ের শেষ অস্ত্র"? আমি তো দেখছি, পাগলেরা সহিংসতার পিঠে লাগাম দিয়ে
দিব্যি আমাদের কোণঠাসা করে ফেলছে।
আর গত কিছুদিন ধরে নতুন পদ্ধতি শুরু করেছে চালাক পাগল-গোষ্ঠী। রক্তারক্তির
ঝামেলায় না গিয়ে তারা এখন ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে ছিনতাই শুরু করেছে।
যাবার সময়ে ওয়ালেটের পাশাপাশি তারা আমাদের সকল জরুরি কাগজ, আর গোপন খবর
নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা এমন দুয়েকটা বিছিন্ন ঘটনায় খুব একটা বিচলিত হই
নি। উটকো সন্ত্রাস ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু একদিন হুট করে দেখা গেলো,
ছিনতাই হওয়া লোকটা পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে
ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম (এখানে তার পরিচয় প্রকাশ করছি না)। জানতে পারলাম
তিনি গত সপ্তাহের রবিবার রাতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন। শহরের খুব দামি
এলাকায দিয়ে ফেরার সময় তার ছিনতাই ঘটেছে। কয়েকজন দুরাত্মা তার
মানিব্যাগ, ব্রিফকেইস এবং মুখের চামড়া তুলে নিয়ে চলে গেছেন। নাঃ, ভয়
পাবেন না, শিউরে উঠবেন না। মানিব্যাগ আর ব্রিফকেইসটাই দুশ্চিন্তার কারণ,
চামড়া তো দুয়েকদিন গেলেই আবার গজিয়ে ওঠে। (আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এটাই
এখানে প্রথা)।
তো, যা বলছিলাম, রবিবার রাতে ছিনতাই হলেন তিনি। বাড়ি ফিরলেন ক্লান্ত
বিধ্বস্ত অবস্থায়, তার স্ত্রীটিকে দেখা গেলো বেশ ব্যস্ত হয়ে তার পরিচর্যা
শুরু করতে। মানিব্যাগ ও ব্রিফকেইসের শোকে তিনি তখন মৃতপ্রায়। ধীরে ধীরে
স্ত্রীর উৎকণ্ঠার সামনে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। মানসিক যন্ত্রণার প্রকোপে
কেঁদেই ফেললেন প্রায়, স্ত্রীটিও ব্যাকুল হয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে
ধরলেন, "কেঁদো না লক্ষ্মীটি, সব ঠিক হয়ে যাবে"। চামড়াহীন মুখে জর্জেটের
শাড়ি ঘষা লাগছিলো, লোকটির আর সহ্য হলো না, "ছাই ঠিক হবে, মুখপুড়ি। চুপ
কর্! তুই ক্যামনে জানিস আমার কতো ক্ষতি হলো?" স্ত্রীটি বেশ থতোমতো খেয়ে
গেলেন, চুপ করে উঠে গেলেন। যাবার আগে লোকটির ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে
গেলেন। সে রাতটি তারা দুজনেই সঙ্গমহীন কাটালেন। আমিসহ বাকিরা দীর্ঘশ্বাস
ফেললাম, আরেকটি বন্ধ্যা রাত কেটে গেলো।
সোমবার পেরিয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত লোকটির চামড়া ঠিক হয়ে এলো, সেই সাথে
মনের গভীরের ভয়টুকু কমে আসতে লাগলো। ইনস্যুরেন্স থেকে তার ব্রিফকেইসের
কাগজপাতি উদ্ধার করতে পারলেন, ভাগ্যি সবকিছু ব্যাকআপ রাখা ছিলো!
মানিব্যাগের শোক সহজে সারার না, তাই সেই শোক মনে চেপেই তিনি শহরের বিখ্যাত
বারে রাত একটা পর্যন্ত মদে চুর হয়ে রইলেন। স্ত্রীটির কাজ এই সময়ে বেড়ে
গেলো, রাত দুটোর দিকে দেখা গেলো তিনি বার থেকে মদে ঢুলু ঢুলু স্বামীটিকে
টেনে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি নিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন। উবু
হয়ে জুতো ও মোজা খুলে দিচ্ছেন, টাই খুলছেন ও হাত ঘড়িটিও খুলছেন। এসব
খুলতে খুলতে তার থরো থরো হাত ও বুক আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। আমাদের ভালো
লাগে, "আহা, কতোই না পতিব্রতা স্ত্রী! ব্যাটার আসলেই রাজভাগ্যি।"
হঠাৎই শুক্রবার নাগাদ ছিনতাইকারী পাগলদের পুরো চক্রান্ত লোকটি বুঝতে
পারলেন। টের পেলেন যে কেবল ছিনতাই করেই তারা ক্ষান্ত হয় নি, আরো বড়ো
ক্ষতি ঘটে গেছে তার। সেদিন আর সব শুক্রবারের মতোই তিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে
উঠেছিলেন। জগিং সেরে এসে কমলার জ্যুস খেয়েছেন। তারপরে খবরের কাগজখানা
বাগিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেছেন। পাগলদের হাতে মানুষের হত্যার খবর পড়তে পড়তে
চুক চুক শব্দও করে থাকবেন হয়তো! তারপর "আমি একটু বাইরে থেকে আসছি" বলে
বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। সারাদিন তিনি বেশ কিছু জায়গায় গেছেন, যেগুলোর
বিবরণ আমরা জোগাড় করতে পারি নি।
সন্ধ্যার পরে তাকে আমরা দেখতে পেলাম সেই বারে বসে আয়েশ করে মদ গিলছেন।
আমরা ভাবলাম, এখন প্রায় ঘন্টা কয়েকের জন্যে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি
আর কোথাও যাবেন না, এখানেই রাত একটা পর্যন্ত মদ খাবেন। আমাদের অনুমান ভুল
হয় নি, রাত একটার দিকেই দেখা গেলো তার স্ত্রীটি আবার তাকে বয়ে নিয়ে
যাচ্ছেন। আমরা দেখি ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাটা ফটাস করে দুই খণ্ড হয়ে গেলো, যেন
নীলনদ। আমরা দেখি মাথার ওপরে জ্বলতে থাকে স্ট্রীট লাইটগুলো আরো উজ্জ্বল
হয়ে উঠলো, সেই আলোতে স্ত্রীটিকে আমরা চিনতে পারি না। আমাদের ভুল হয়, আমরা
মনে করি কাঠের স্বামীকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
রাত বিড়ির মতো দ্রুত শেষ হয়ে আসে। আর গিসগিস করতে থাকা শহরে একটু পরে
বিড়ির মোথার মতো রাতের শেষ পরশটুকু পড়ে থাকে। শনিবার আরো একটা ছুটির দিন
হয়ে খুব কষ্ট করে জেগে উঠতে থাকে, আমি হঠাৎ টের পাই যে পাগলেরা রাতে
ঘুমায় নি। আমরা খুব নিশ্চিন্তে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম, আর পাগলরা
সারা রাত জেগে ছিলো ফুটপাতে ফুটপাতে। তাদের জন্য আমার কেন জানি সেই সকালে
একটু মায়া হয়। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের প্রতি মায়া দেখানো একেবারেই নিষিদ্ধ,
তবু আমি চুরি করে একটু মায়া দেখাই। এক পলকের জন্য ভুলে যাই যে এরা আমাদের
শত্রু। হঠাৎ চোখে পড়ে, সেই বিখ্যাত বারের পেছনের দরজার কাছে একটা শরীর
দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। শরীরটি যে বেশ ব্যায়াম করে নিয়মিতই, তা বুঝতে
পারি। আরো বুঝতে পারি, সেটি কোন পাগল নয়। পরিপাটি শার্ট, ঢিলে না হওয়া
টাইয়ের কোনা দেখা যায়, প্যান্টখানাও নিপাট। দোকানের লোকগুলো ঘুমুচ্ছে
হয়তো এখনো। তাই আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। চেহারাটা দেখতে পারছি না, শরীর
উল্টে পড়ে আছে অ-পাগল।
আরো প্রায় ঘন্টাখানেক পরে লোকটির ঘুম ভাঙলো। যেন অচৈতন্য থেকে সে একটু
একটু করে জেগে উঠছে। হাত পেঁচিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম আমাদের
ছিনতাই হয়ে যাওয়া লোকের মুখ। হুবহু একই চোখ, একই চোয়াল, একই এলোমেলো
হয়ে থাকা চুল। চমক ভাঙতে না ভাঙতেই বুঝতে পারলাম গত রাতে এই লোকটি বাসায়
ফেরে নি। গত রাতে সে এই বারের পেছনের দরজার বাইরে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলো।
আমিসহ আমাদের ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। এটা আমাদের সতর্কতার পূর্বাবস্থা।
খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টা বুঝে গেলাম বলে আমি বাকিদের সাথে বেশ উত্তেজিত
স্বরে কথা বলতে শুরু করি। তাদের বুঝাতে চেষ্টা করি যে এক গভীর ষড়যন্ত্র
ঘটে গেছে রাতের আধারে। আমাদের শহরের পাগলেরা একটা বিরাট চাল চেলেছে, একই
চালে তারা আমাদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। এখনই সময় আমাদের সতর্ক হওয়ার!
মানুষের দলের আমাদের মাঝে অনেকেই আমার কথা মানতে পারলো না। আমি যে
অবিশ্বাস্য কথা বলছি, আমি যে উদ্ভট কথা বলছি সে বিষয়ে অনেকেই তখন
নিঃসন্দেহ। তাদের চোখে আমার আচরণ কিছুটা অপ্রকৃতস্থ বলে মনে হচ্ছে -- এই
কথাও ব্যক্ত করলো কেউ কেউ। আমি অসহায় বোধ করলাম। পাগলদের সাথে যুদ্ধে আমরা
হেরে যাবো, এই ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আমার বিপন্নতা বেড়ে গেলো। আমি জোরে
জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলাম কী বিপর্যয় ঘটে গেছে। দিনের আলোর মতো
পরিষ্কার ব্যাপারটা, তাও কেউ কেন বুঝতে চাইছে না? আশ্চর্য!
তারা খুব দ্রুত একটা সভা করে নিলো আমার অভিযোগ নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতি
যাচাই করে আমাদের নেতারা বললেন প্রমাণবিহীন এই অভিযোগ সত্যি হবার সম্ভাবনা
খুবই কম। বলতে গেলে নগণ্য। তাই আমার এই অতি-আশঙ্কা, এই অতিকল্পনার কোন
ভিত্তি নেই। আমি যে এমন পাগলের মতো আচরণ করছি, এটাই এক ধরণের অসুখ। পাগল
হয়ে যাবার আগে এরকম উপসর্গ দেখা দেয়। এই শহরে এরকম সময়ে কোন চিকিৎসা হয়
না বললেই চলে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কতোজনেই তো পাগল হয়ে গেলো এভাবে!
তাই সভাসদরা ঠিক করলেন আমাকে অতিসত্ত্বর বিদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। এই শহরে
পঁচে পঁচে পাগল হয়ে যাবার আগেই আমার বিদেশে চলে যাওয়া উচিত। সেখানে
চিকিৎসালয় আছে। বিশাল সুরম্য অট্টালিকাগুলোকে চিকিৎসালয় বানিয়ে
অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পাগলদের চিকিৎসা করা হয়। তাদের ঘুমের বড়ি খাইয়ে ঘুম
পাড়িয়ে রাখা হয়। এখানে থাকলে আমাকে সারা রাত জেগে থাকতে হবে, আমি আর
সুস্থদের মতো রাতে ঘুমুতেই পারবো না। তারপরে একদিন পাগল হয়ে ফুটপাত ঘেঁষে
রাত কাটাবো।
আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমার ভালো চান। তাই আমি মুখ বুঁজে তাদের মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকি। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো হঠাৎ আমার কাছে সিনেমার পর্দার মতো
মনে হয়, ত্রিমাত্রিক মানুষগুলোকে চ্যাপ্টা লাগে, সামনের টেবিল
চেয়ারগুলোকে মনে হয় দেয়ালে এঁকে রেখেছে কেউ। সিনেমার মতোই তারা মাথা
নাড়ে, ঘন ঘন হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখে। তারপরে নিজেরা নিজেরা ফিসফিস করে কী
কী যেন বলে, আমাদের দিকে তাকিয়ে পেশাদার হাসি দেয়। কাগজের খসখসাখস শুনতে
পাই।
আমার চোখে কোন একটা সমস্যা হয়েছে মনে হয়। ঠিক এই দৃশ্যগুলোর ভেতর দিয়েও
আমি লোকটিকে দেখতে পাই। বারের পেছনের দরজার কাছে এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখা
লোকটিকে না, গতরাতে যে লোকটি স্ত্রীয়ের কাঁধে চেপে চলে গেছে সেই লোকটিকে
দেখি। দেখতে পাই গত রাতেও তার স্ত্রীটি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে,
তারপরে জুতো ও মোজা খুলে দিয়েছে। সারা রাত লোকটি ঘুমায় নি যদিও, চোখ বুঝে
পড়ে ছিলো (আমি নিশ্চিত)। তারপরে সকালে উঠে ঠিকঠাক অভিনয় শুরু করে
দিয়েছে।
আমার সামনের সিনেমার দৃশ্যে আটকে থাকা মানুষেরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে আমি
চেয়ার বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু একটু মাথা দোলাচ্ছি, আর পাগলের
মতো হা হা হা করে হাসছি!