বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১০

অব্যাখ্যাত কলাম...

লুই আর্মস্ট্রঙের একটা গান আছে। হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড। মানুষ হিসেবে আমরা তো নগণ্য, ক্ষণিক জীবন আর তার যাতনাতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে থাকি। তাই চোখ মেলে অনেক সময় চারপাশের সৌন্দর্য দেখা হয় না। এ পার্থিব জগত কতো সুন্দর! কতো নৈর্ব্যক্তিকভাবে সুন্দর! অর্থহীন এ প্রবল আবেগ, এ নদীর স্রোতের মতো দৃশ্য। কুলকুল করে বয়ে চলছে চোখের সামনে। চোখ মেলে দেখতে দেখতে একটা সময় দৃশ্যগুলো সব কিছু নিস্পৃহ করে দেয়। মুগ্ধতার পারদ সীমা ছাড়িয়ে গেলে বোধহীন জড়ের মতো চোখ মেলে রাখি। সেখানে কোনো রূপ-রস আর তাড়না জন্মাতে পারে না। তখন একটু চোখ ঝাপটানো লাগে। মানুষের চোখের পলক ফেলার গতি শুনছি খুব বেশি। দ্রুততায় চোখের পলক ঝাপটানো - তারপর আবার দৃশ্যরাজি।

আমি মনে করি দৃশ্যের কোন ভালো খারাপ নাই। সৌন্দর্য ও রূপের কোনো সংজ্ঞা নাই। অপার্থিব বলেও কোনো কিছু ব্যাখ্যাত নাই। আমরা যা দেখি, যা বুঝি, যা অনুভব করি, সবই পার্থিব। অপার্থিব, ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কোনো জায়গা নাই। তবে অব্যাখ্যাত অনুভব আছে আমাদের। কারণ আমাদের ভাষা শক্তিশালি না। এই ভাষার দৌর্বল্যে আমরা দুর্বল অনুভবের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি। একটা কিছু 'ফীল' করলে, সেইটারে সংজ্ঞায়নের মধ্যে ফেলি, দেখি খাপে খাপে মিলে কি না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এটা ফিট করে না। কোনো সংজ্ঞাতেই মিলে না। তখন নিজেরে বুঝ দেই যে এইটা 'অপার্থিব'। যে জগত আমরা দেখি নাই, জানি নাই, সেইটার নাম দিয়ে দিলাম অনায়াসে। ভাবলামও না, এ যেন ওই চোখের পলক ফেলার মতো একটা রিফ্লেক্স। কিন্তু এইটা ঠিক না। পার্থিব অনুভবকে নাম দিতে না পেরে, আমরা সেটা অপার্থিব কোয়াড্রেন্টে পাঠায় দিতেছি!

তাই আমি এখন অব্যাখ্যাত নামে একটা কলাম বানাইলাম। এই কলামে রাখবো ভাষিক সীমানার বাইরের সব কিছু।


একদিন রাস্তায় পা হড়কে পড়ে যাবার সময় যে পতনের অনুভব হলো - সেটাকে এখানে রাখলাম। এলোমেলো হেঁটে যাবার সময় আজকাল মাঝে মাঝে অমন করে পড়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু যদি প্ল্যান-প্রোগ্রাম ঠিক করে পড়ে যাই, তাইলে তো আর সেটার মতো হইলো না। তাই অপেক্ষা করি, কোনো একদিন তো আবার বেখেয়ালে পড়ে যাবো। ফুটপাতে ব্যস্ত পায়ের খটাখট চলে যাবার মধ্যিখানে আমি স্থানুর মতো পড়ে থাকবো। দ্রুত পায়ে দৃশ্যগুলা সরে সরে যাবে। আমার অস্থির লাগবে, মনে হবে তাড়াহুড়া, কোথাও যাওয়ার ছিলো, ভুলে গ্যাছি। মগজের রুমে রুমে আঁতিপাতি করে খুঁজবো, "কোথাও যাওনের কথা ভুইলা গেলাম!"

তারপর একদিন ক্লাসে অমনোযোগি। দেখা গেলো সেইদিন স্যারের চোখ আমার উপরেই পড়লো। দাঁড়া করায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "এতোক্ষণ কী বলসিলাম?" মুখ ফসকে বেরুচ্ছিলো, "তা আমি কী জানি?", সামলে নিয়ে বলে দিলাম কিছু একটা। তারপরে অপমান হয়ে গেলাম অনায়াসে, স্লোমোশনে স্যার শিকে বিঁধায়ে রোস্ট করলেন। ক্লাস জুড়ে হাসির কল্লোল। উল্টোদিকের করিডোর থেকে দুয়েকটা মাথা ঘুরে তাকালো, ভেতরে ঠাট্টারসে ভিজে ভিজে আমি দাঁড়ায়ে থাকলাম। সেদিন সারাদিন ধরে সেই ঠাট্টারস গায়ে চ্যাটচ্যাটে লেগে রইলো। মোছার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই গ্যালো না। ক্ষণে ক্ষণে আমাকে দেখে চত্বরের গাছগুলাও পরিহাসের হাসি হেসে উঠছিলো!

অথবা যেদিন শীতের মধ্যেও হেঁটে হেঁটে শহর পাড়ি দিলাম। অনেকগুলো সিএনজি, রিকশা আর বাস আমাকে ডাকাডাকি করছিলো। মাফলার জড়ানো, কোট চাপানো মানুষগুলো হেলে দুলে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়ছিলো সেগুলায়। আমি পিছায়ে রইলাম। আমার হুড়োহুড়ি করতে ভালো লাগছিলো না। আমার কোথাও পৌঁছানোর তাড়া ছিলো না। অস্থির এই দৃশ্যটা আমার ভালো লাগছিলো, তাই আমি দেখছিলাম। দেখতে দেখতে অনেকগুলা বাসহাতিঘোড়া চলে গেলো। তারপর আমি হুড তুলে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার আগেপিছে কিছু মানুষও হাঁটছিলো হনহন করে। আমি অতোটা জোরে আগাই নাই। ধীরে বহে যমুনা। রাস্তা পেরুলাম বিনা সিগন্যালে, শরীর বাঁচায়ে। গাড়িগুলোর কৃপা আমারে ধাক্কা দ্যায় নাই। চারপাশে শা শা করে অনেকগুলা গাড়ির ভীড়। শীতের রাত এই সন্ধ্যা নামতেই! মৃদু কনকনে, তাই জবুথবু বাঁকা হয়ে আমি এগোতে থাকি। ফুটপাতগুলো এখানে ফাঁকা, হকারদের তাড়ায় দিছে কেউ। হাঁটতে গিয়ে এলোমেলো লাগে। নানা কিছু ভাবি। একদম একা বলে কেউ ভাবনায় ভাগ বসায় না। চারপাশে বড়ো বড়ো দোকানের আলো জ্বলে উঠছে। জ্বলজ্বলে শহর ক্যামন কাতর চোখে তাকায়। আমারে ডাকে, আমি আজ তার ভোক্তা হইলে, রাতের কামাইটা পুরা হয়। আমি এই সম্ভাষণে ভুলি না, বুঝতে পারি এইটা মেকি। আমারে সে চেনেও না। গত পঁচিশ বছরেও চেনে নাই, আর চিনবেও না। এই শহর কাউরেই চিনতে পারে না।


এই সব অব্যাখ্যাত অনুভবগুলারে সাজাইতে সাজাইতে কলাম ভরে ওঠে। উপচায়া পড়ে। তার অনেক পরে একটা সময় আমি বাড়ি পৌঁছায় যাই। নিজের ঘরে ঢুকতেই অনেকগুলো কোলাহল জাপটায় ধরে। আমার একটুও ভালো লাগে না!

মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০

এখানে একটা শিরোনাম বসিয়ে নেন

এখানে 'নতুন ব্লগ লিখুন' লিংকটা একদম মুখের 'পরে, প্রথম পাতায় যাবার পাশেই। তাই মাঝে মাঝে মাউসের ভুলে এদিক ওদিক হয়ে যায়। প্রথম পাতার বদলে আমি খেরো কাগজে চলে আসি। মাউসের মন খুশি হয় একটু। সে এখন রেহাই পাবে কিছুক্ষণের জন্য। খটখট খটখট আঙুল পড়বে কিবোর্ডের ওপর। এই অবসরে মাউসটির মন আরো একটু খুশি হয়। খুশিতে তার লেজ নড়ে। এদিক ওদিক নড়তে থাকে সে। তলায় মাউসপ্যাডটা পুরনো হয়েছে। ঠিকমতো মাউসের পা বসতে চায় না, পিছলে পিছলে যায়। তাই লেজ নড়ে। আমি লেজ নড়া থেকে চোখ সরাই। মাউসটার মুচকি হাসি দেখে কিছু বলি না। কিবোর্ড একটু হতাশ হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

মাঝখানের ইংরেজি হরফগুলো দেখলেও আমার বাংলা হরফ মনে পড়ে। হরফগুলোর সাথে অনেকদিনের সখ্যতা। আমি ব্লাইন্ড টাইপিং পারি না, মানে মনিটরে তাকিয়ে খটাখট লিখতে পারি না। তবে এখন বাংলায় মনে হয় কিছুটা পারি। আমার মগজের কোন এক লোব বা কোন এক গুহায় পুরো হরফের ছবিগুলো ছাপা হয়ে গেছে। আঙুলগুলো একটু উঁচু করে রেখে কোন স্পর্শ ছাড়াই এগুলো নড়াতে পারি। ক খ গ ঙ (ঘ কাজ করে নাই, বেয়াদ্দপ!)

এর পরে অনেকটা লেখা হয়। লেখাগুলো কেন হয় জানি। আমি লিখতে চাই বলে। আমার ক্ষুধা লেগে যায় লিখতে লিখতে। লিখে পেট ভরানো গেলে আমার ক্ষুধা লাগতো না কখনোই। আমি অনেক লিখি। লিখতে লিখতে যখন হাঁপিয়ে যাই তখন একটু অবসর নেই, সেই অবসরেও লিখি। এক লাইন লিখে শেষ করতে করতে মাথার ভেতরের কোনো এক গুহায় তিন চারটা লাইন হারিয়ে গেলো। ধুৎ। এভাবে হয় না। যদি বলে বলে টেইপ রেকর্ডারে সব পুরে ফেলা যেতো, তবে মনে হয় আরো একটু লেখা বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু সেটাও তো সমস্যাজনক। দেখা যায় যে বলতে বলতেই মাথায় আরো কয়েকটা লাইন পুড়ে যায়। সেই পোড়া লাইনগুলো উদ্ধার করতে পারি না। মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ছিঁড়বো না। বেশি নাই। টাক পড়ে যাবে শেষে বিয়েশাদি নিয়ে টানাটানি। টানাটানিতে আরো চুলহ্রাস, শেয়ার বাজারের মতো দাম পড়ে গেলে মুশকিল!

লেখাগুলো জমিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে জমানো লেখা একা একাই মরে যায়। চুপচাপ। তাদের ফিউন্যারেল দেয়া হয় না। একা একা কেমন করে ফিউন্যারেল দেই? কেউ তো দরকার, শোকবার্তা নিয়ে আসবে। একটু কালো পোশাকে কাঁদবে। চোখের কোণ মুছবে শার্টের খুঁট দিয়ে। আমি সেই দৃশ্য দেখে শান্তি পাবো - আমার মৃত লেখার জন্য কারো কান্না পাচ্ছে ভেবে। আমার গর্ব হবে। আমার খুশি লাগবে। গর্ব খুশি মিলে ঝালমুড়ি হয়ে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিবে। আপাতভাবে দেখলে লেখাটার কিছু যায় আসে না। সে মরে গেছে বলে সে জানেও না আমি কেমন কেমন করছি তার জন্য। সব যায় আসে খালি আমার। লেখা মৃত্যুতে কষ্টও আমার, অন্যের কান্না দেখে প্রশান্তিও আমার।

এরপর সময় গড়ায়। ধীরে ধীরে নতুন লেখার জমে ওঠে। সেগুলো এডিটর বক্স ভরিয়ে দিতে থাকে। ভরাতে ভরাতে আর জায়গা কুলায় না। পাশে একটা স্ক্রলার জন্ম নেন। তিনি নীলচে রঙের, নতুন এলেন এডিটর বক্সের পাশে, বক্স তাকে জায়গা করে দিয়েছে। একটু একটু করে এই স্ক্রলারটির আকার ছোট হবে। আর তিনি নিচে নামবেন। অধঃপতন! হা হতোস্মি। নামতে নামতে আর ছোট হতে হতে তিনি অভিশাপ দেবেন - আঃ মরা! এতো ল্যাখে ক্যান শালা!!
কিবোর্ড অভিশাপ শুনে ভয় পাচ্ছে, একটু একটু ধীর হয়ে আসছে। ব্রাউজারটাও ভীতু, বেটা এমনিতে খাইতে খাইতে ভারী হইছে, অথচ সাহস জন্মায় নি একরত্তি। ধরে চটকানা লাগাতে ইচ্ছা করতেছে।

ব্রাউজার এগুলো শুনতে পেয়ে আরো ভড়কে গেলো। ধীরে ধীরে চলছে সে। দেখে শুনে, কখন ঠাশ করে একটা চটকানা মেরে দিবো, এই ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গেলো। আমারও রাগ টঙ হয়ে উঠে বসে থাকে, সহজে নামবে না। রাগের মাথায় কতোগুলো গালিগালাজ করি। সেগুলো টাইপ করে বেচারা কিবোর্ডও গলাখাকারি দেয়, য়্যাহেম। ওর অভ্যাস নাই তেমন। গালি নিয়ে ট্যাবু আছে কিছুটা। নিজে যখন শাপশাপান্ত করে, তখন কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি জোর করে টাইপ করলেই তার টনটনে টনক টিকটিক করতে থাকে। ব্যাটা টিকটিকি!

থাক, মুছে দিলাম। ব্যাকস্পেইস চেপে ধরে রাখলাম যতোদূর পর্যন্ত শাদা না হলে স্বস্তি হয় না ততোদূর। মুছে গেলে সব ফাঁকা হয়ে গেলো। ধবধব করছে ঘরটুকু। ঘরে আসবাব নেই। কার্পেট নেই। ঝাড়বাতি দূরে থাক, টিমটিমে ফিলিপসের বাত্তিও নেই। একটা কালো "ক" ঝুলছিলো বক্সের নিচে, এক কোণে, একা। হাতের চেটোয় ঘাম মুছে ফেলার মতো ওটাকেও মুছে ফেললাম। যাঃ



গতস্য শোচনা নাস্তি। গতস্য শোচনা নাস্তি। যা চলে গেছে, তার জন্য সন্তাপ করো না। কে বলে? কোন উন্মাদের মাথায় এই শ্লোক এসেছিলো? সে কি য়্যাল্‌ঝেইমারের রোগী? সে কি বুঝেই না গতস্যদের জ্বালা। সবচাইতে কড়া মদের চাইতেও বেশি পোড়াচ্ছে সেইসব গতস্য। শোচনা। শোচনা। অনুশোচনা। গ্লানি। "একবার শেষ দেখা যদি পাইতাম"। নাস্তি। নাস্তি। তুই নাচতি? শোচনার পিঠে চড়ে তুই নাচবি নাকি? নাচ, গড়াগড়া দিয়ে নাচাবে তোকে এই ভুরভুরে ভ্রূকূটিল শোচনা। তোর মুক্তি নেই, পায়ে মলমল।

মাঝে মাঝে আমরা ইচ্ছা করে শোচনা তৈরি করি। নিজ হাতে গলা টিপে গ্লানি বাড়াই। হাতের আঙুলের চাপে কতোগুলো নিরীহ অক্ষর মারা পড়ে। অক্ষরের সাথে আমার কিছু স্মৃতি ধুয়ে মুছে যায়। ওগুলো আর ফিরে পাবো না। তাই এক্সপোনেনশিয়ালি আমি শোচনায় ডুবতে থাকবো। কেউ কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না। চুল এলোমেলো করে দিবে না। বলবে না, 'ব্যাপার না'। আসলে তো ব্যাপার। খুব জরুরি ব্যাপার না হলে হয়তো এভাবে মুছতাম না, এভাবে ভুলে থাকতাম না। ভুলে থাকার গুণ রপ্ত করতে কয়টা জন্ম লাগবে? কয়যুগ ঘুমালে মাথার ভেতরের এই শোচনাকুল দিনরাত্রির শ্লোক মুছে যাবে?
- ভোরে ঘুমিয়েছি - দুপুর তাই সকাল - বিকেল তাই আমেজ - - রাত মজে হলো সন্ধ্যা - নিশুতি হয়েছে জেগে থাকা প্যাঁচা -
- ভোর থেকে নিশ্চুপ নীরবতা - এভাবে মুহূর্তের গুণ সময় -
- আর সময়ের গুণ ঘন্টা - মিনিট - অহ্ন -
- এভাবে তার ছিঁড়ে রেখেছে কেউ -
- টাওয়ার বানায় নি তাই দুঃখিত হয় মেয়েটি -
-এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে নাহ -
- যাআহ ফোট্‌ !!! -



******
দ্র - শিরোনাম কৃতজ্ঞতা - কবি আন্দালীব

অচেনা ইলিয়াস...

কেউ যে চরিত্রে বা আচরণে স্বচ্ছন্দ নয়, সেখানে তাকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। নতুন নতুন মনে হয় তাকে। এবং অস্বাচ্ছন্দ্য বলে, খুব সজাগ হয়ে আছে সে। বুঝতে পারি সে অপরিচিতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে চারপাশের সাথে যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছে। এভাবে তাকে বিপাকে পড়তে দেখে আমার ভালো লাগে। তাকেও ভুলভ্রান্ত মানুষ মনে হয়। যে কাজগুলো সে অনায়াসে করতে পারে, সেগুলো দেখে দেখে মনে ঈর্ষা জন্মেছিলো, সমীহ করার, মাথা ও মন অচিরেই নুয়ে পড়ার অনুভব তৈরি হয়েছিলো। সেটা ধীরে ধীরে কেটে যায়। তাকে আর ওভাবে শ্রদ্ধা ও সমীহ করতে হবে না জেনে আমি হাঁফ ছাড়ি। এখন থেকে তাকে আমার আরো একটু আপন মনে হবে। ফর্মালিটি কারই বা ভালো লাগে, তাই না?

তো, যার কথা বলছিলাম, 'তুমি' সম্বোধন করলেও সে অনেক বড়ো লেখক। গুণী তো বটেই, তারচে'ও বেশি প্রচণ্ড তার প্রকাশ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বাংলা উপন্যাস আর গল্পকে অনেকাংশে ট্যাবুহীন করেছেন তিনি। পুতুপুতু যে ভালোমানুষি গদ্য, সেখানে বাবুমশাই ব্রিটিশ আমলে ধুতি পড়তেন আর পাকিস্তান আমলে পড়তেন পাজামা-পাঞ্জাবি। সেইখানে প্যান্ট-হাফশার্ট অথবা লুঙ্গি পরা লোকগুলোকে চিৎকার করার জায়গা করে দিয়েছেন ইলিয়াস। এবং সে ভাবেই তিনি পরিচিত হন, সবাই তাকে সেভাবেই চেনে।

আজকে বই নাড়তে নাড়তে তাঁর কবিতা খুঁজে পেলাম। অবাক অবাক কৌতূহল জেগে উঠলো। খুব বেশি কবিতা লেখেন নি তিনি। হাতে গোনা কয়েক পাতা। বেশিরভাগই সম্ভবত তার সন্তানের জন্য, শিশুতোষ ছড়ার মতো কবিতা। শুধু দু'তিনটে কবিতা নজর কাড়লো, ইলিয়াসীয় ঢঙ, ঝাঁজ আর ভাষার ব্যবহারের কারণে। সেই উপন্যাসে পাওয়া কথাগুলোই অন্যচেহারায় ফিরে এলো।


স্বপ্নে আমার জন্ম
ঘুম
শুধু ঘুম
আমরা ছিলুম
সাত বিলিয়ন সাতাশশো ভাই;
শান্ত প্রবল তীক্ষ্ণ হাওয়া এলোমেলো
শিশির শরম, পূর্ব থেকে নরম আলো,
আমার বাবার মোমবাতিকে সবুজ কাঁপাই।
লবণ-লালে বলকানো পাপ আব্বা দিলো শান্ত সাঁতার
কাঁপা কাঁপা, অল্প তবু কি উদ্‌ভ্রান্তি গভীর ব্যথার
হাজারটা ভাই আকাশ উপুড় ওম্বে গাইছে তারার ফোঁটা,
জ্যোৎস্না রাতে ভাসছি সবাই এশার আজান হাওয়ায় লোটা।
গোলাপ থেকে, আপেল আমের আদর থেকে আগুন থেকে মায়ের ফেনা
নিষিদ্ধ সব গলি বেয়ে দিন রাত্রি বয়ে আনে, জীবন নামক জানাজাটা
'তারচে চলো শেষ হয়ে যাই।' ক্রেজি কণ্ঠ কাতর হলুম, 'ভাল্লাগেনা ভাল্লাগেনা'
বলতে বলতে ওয়েনিঙ স্বর তারার মতোন আত্মহত্যা করলো ওরা,
সাধও হলো, বিলীন হলো, দ্যাখো দ্যাখো নেই মানুষের নীরব ঝরা।
'আমিই একা, কী-যে করবো, হায় হায় এই চোপসানো ও লুপ্ত বুকে
ক্লান্ত ক্লাউন, আঁকাবাকা আঁধার ওম্বে একাই মরি ধুঁকে।
আম্মা তখোন বিবমিষায় উপুড় হলো দন্তবিহীন মুখে।
সাগর-শোষা, আগুন আওয়াজ, কোরান-কালো আলোর গ্রহে
ল্যাজ গুটানো, নেই নেই লোম, ছিন্ন শিশ্ন, কুঁজো হয়ে
এদিক ওদিক করুণ তাকাই, গলিয়ে পড়ি,
সে উনিশশো তেতাল্লিশের ফেব্রুয়ারি।
বমির টুকরো মোহিত মগ্ন
ঘুমের মধ্যে ঘামি
লোনলি লগ্ন
আমি।


====================


এলেমজির জন্য শোক
আমার এলএমজি, এলএমজি, এলেমজি আজ
কোথায় গিয়েছ তুমি? কতোদূর, বলো কোন লোকে
নিরুদ্দেশ যাত্রা করো? শীতল শরীরে রক্ত শিখা
জ্বেলে দাও অন্ধকারে, ব্রাশ করো কোন সেক্টরে?
তোমার ট্রিগারে কার কিশোর তর্জনী টানে গান,
পূর্বজন্ম, মৃত্যু, সাধ? সুপ্তশিশ্ন ব্যারেলের কাম
এ্যামবুশ করে কার রক্তে? তুমি কার অধিকারে?
এলেমজি, তুমি ছিলে হাত জোড়া, বুক জুড়ে, বুক ভরে ছিলে।
তুমি ছিলে, ক্রোধ ছিলো; প্রতিহিংসা ছিলো; হৃৎপিণ্ডে
ঘৃণা; বাঁচবার নির্লজ্জ স্পৃহা। যাবার বেলায়
মহারাজ, ঠাণ্ডা ঠোঁটে শুষে নিলে সব, তুমিই তো
একদিন দিয়েছিলে। তুমি নাই, প্রতিহিংসা নাই;
ঘৃণা নাইল তুমি নাই, ক্রোধশূন্য বুক আজ ফাঁকা।
হৃৎপিণ্ড নিদারুণ খালি, বুক নাই, চাঁদে চাঁদ
নাই। স্পৃহাশূন্য হাতে কেউ এসে গুঁজে দেবে - নাই।


====================
মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষেরা অস্ত্রগুলো হাতে না পেলে হয়তো একাত্তরে এতোটা আত্মত্যাগী হইতে পারতো না। অস্ত্র হাতে আসার আগে আমরা ভীরু, পলায়নপর, ম্রিয়মাণ জাতি হিসেবে বেড়ে উঠেছি, অস্ত্র সরে যাবার পরে আবারও সেই রকম হয়ে গিয়েছি ধীরে ধীরে। (দীর্ঘশ্বাসের ইমো) ...

বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১০

ভালো কাজ

বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে গিয়ে "মনের মানুষ" ছবিটা দেখে আসছি। গৌতম ঘোষ পরিচালক, দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনার ছবি। অনেক আগে গৌতম ঘোষ পদ্মা নদীর মাঝি বানিয়েছিলেন। দেখে হতাশ হয়েছিলাম। কোন উপন্যাসের লাইন বাই লাইন দৃশ্য রচনা করে জুড়ে দিলেই সেটা চলচ্চিত্র হয়ে যায় না। এইটা গৌতম ঘোষ জানলেও, মানেন না। এদিকে "মনের মানুষ" বইটা পড়া হয় নাই (সুনীল গাঙ্গুলির লেখা), তাই ভাবলাম ছবিটাই দেখে ফেলি। কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁইয়ের জীবন নিয়ে বানানো ছবি।

লালনের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ, লালনের গুরুর ভূমিকায় রাইসুল ইসলাম আসাদ। এখানে গিয়েই বিপত্তি বাঁধলো। এরই মধ্যে লালন হিসেবে আসাদের চেহারা ও অভিনয় মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো। সেখানে প্রসেনজিৎকে বসানো খুব কঠিন। আর যেহেতু ওপারের পরিচালক (এবং লেখক) সেহেতু গল্প শুরু হলো লালনের পোর্ট্রেট করছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর - এই দৃশ্য থেকে। সেখান থেকে ফ্ল্যাশব্যাক। লালনের তরুণ জীবন। বিবাহিত ও সুখী লালন, সরলসোজা, গান গায়, বৈষয়িক তাড়না নাই, গাঁয়ের মোড়ল বা কর্তার ঘোড়ার দেখভালের দায়িত্ব পেলো। দৃশ্যধারণের এই খাপছাড়াভাব দেখে সুনীলের বইটা পড়ার শখ হলো। এখানে কেন এরকম? 'সেইসময়' উপন্যাসে যেমন সুনীল জাম্প-কাট করতেন, সেরকম ভাবে এই বইটাও কি লিখেছেন নাকি? গৌতম ঘোষ কেন এভাবে শুরু করলেন।

ভাবতে ভাবতেই লালনের অসুখ। জলবসন্ত, চিকিৎসাহীন ও নিরাময়হীন। তাই সবাই মিলে গঙ্গায় (পদ্মায়) ভাসিয়ে দিলো। বাঁশের ভেলার ওপর মশারি, শাদা চাদর গায়ে মুমূর্ষু লালনের দেহখানা ভেসে চলছে। ঢেউ ছাড়া চরাচরে কোন শব্দ নাই। এইখানে দৃশ্যের সাথে শব্দের যে মিল, সেটা চমকে দিলো। এখানেই বলে রাখি কারিগরি দিক থেকে ছবিটি দারুণ লেগেছে। লালনের ছবিতে যদি শব্দধারণ ভালো না হতো, তাহলে ভালো লাগতো না। চিত্রগ্রহণের ব্যাপারেও একই কথা, ভোরের কুয়াশামাখা নদীর পাড়, অথবা রাতের চন্দ্রালোকিত কুটির - সবই অদ্ভুত আলো-ছায়া-রহস্যমাখা মনে হয়েছে! লালনের নাম ও জীবনের সাথে যে রহস্যময়তা, সেটা এখানেই ফুটে উঠেছে!

ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত জমজমাট ছবি। গান, সুর, অভিনয়। আসাদ-চঞ্চল-পাওলী দাম, তিনজনের চরিত্র খুব চমৎকার লেগেছে। লালনের স্ত্রীর চরিত্রের অভিনেত্রী এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রও টেনে নিয়ে গেছেন। ডুবিয়ে দিয়েছেন লালনের মায়ের চরিত্রে চম্পা (তার একটা খুব ক্রুশিয়াল দৃশ্যের অতি-অভিনয়ে হলের ভেতরেই লোকজন হাসতে শুরু করলো, অথচ দৃশ্যটা খুবই সিরিয়াস ছিলো), এবং পরে লালনের সেবাদাসী হিসেবে এক অভিনেত্রী। বিশেষ করে পরের জনকে কেন কাস্ট করা হয়েছে তা বুঝলাম না। একেবারেই অভিব্যক্তি নাই!

গৌতম ঘোষের মূল দূর্বলতার জায়গা দেখলাম ক্লাইম্যাক্স এবং ফিনিশিংয়ে। ছবির আমেজ অনেকটাই কেটে গেলো শেষে এসে। তবু কিছু ছবি দেখে এসে যেমন সেই ছবির ভেতরের জীবনধারা নিয়ে আগ্রহ লাগে, একটু গুগল করতে ইচ্ছা করে, একটু জানতে আর পড়তে ইচ্ছা করে, এই ছবিটাও সে'রকমই। গানের মাঝে সবগুলোই ভালো লেগেছে। দুয়েকটা গান শেষে গিয়ে একই থিমের কারণে একটু ধরে আসলেও অসুবিধা নাই। উপরি পাওনা, চঞ্চলের কমেডি। ধীরে ধীরে বাংলা সিনেমার এই ধরনের রোলগুলো তিনি কব্জা করে নিচ্ছেন!

এখন লালনের গানগুলো শুনছি। কিছু কিছু জিনিস অনেকদিন পর শুনলে মন ধুয়ে মুছে যায়। মাঝে হয়তো মনে অনেক শ্রান্তি আর ক্লেশ জমে গেছিলো। সব কেটে যাচ্ছে!

বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১০

এ বিট অফ...

আজকে সারাদিন ভ্যানভ্যানে বৃষ্টি হইছে। আমি সকাল সকাল উঠছি। তারপর থেকে মুড ঠিক করার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে ঠিক হৈছে, তারপরে আবার বিগড়ায় গেছে। কী করবো, ফুয়েল নাই।
শেষে আমার শেষ সম্বল ইউটিউবে ঢুকলাম। এখানে ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায়। চার্লি বিট মাই ফিঙ্গার, আর ফ্রিকের মতো হাসে এমন দুইটা পিচ্চিকে তো আগেই সবাই দেখছেন। সেগুলোর মতো চিজদের পাইলেই আমি দেখে শুনে রাখি। এরা বেশি স্পেশাল।
এরা ছাড়াও আরো কিছু লোকজন আমার খুব ভালো লাগে। একজন জর্জ কারলিন, স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান। এরকম আরেকজন আছে, রাসেল পিটার্স । জর্জ কারলিন অনেক পলিটিক্যাল, সোশ্যাল ট্যাবু আর ইস্যু নিয়ে পঁচায়। রাসেল তার বহুসাংস্কৃতিক ও বহুজাতিক বাস্তবতা নিয়ে পঁচায়। এই সুযোগে আরো কিছু কমেডিয়ানের স্ট্যান্ডআপ দেখা হয়ে গেলো।
তবে এদের সব কিছুর চেয়েও ক্লাসিক হলো ব্রিটিশ কমেডি। হলিউড যতোই স্পেশাল ইফেক্ট দিক আর চেষ্টা করুক না কেন, ব্রিটিশ কমেডির মতো দম ফাটানো এবং পেটে খিল ধরিয়ে দেয়ার মতো কমেডি বানাতে পারবে না। ব্রিটিশ কমেডিগুলোর তেমন চাকচিক্য নাই, প্রিন্টও খারাপ। কিন্তু সংলাপ বা ম্যাটেরিয়ালের দিক থেকে এতো দুর্দান্ত কিছু নাই!

 অনেকে House, M.D. সিরিজের অভিনেতা Hugh Laurie - কে চিনতে পারেন। বেরসিক, কাঠখোট্টা, ড্রাগঅ্যাডিক্ট এরকম ডাক্তার রিয়েল লাইফে থাকলে তাকে সবাই ধরে মাইর দিতো। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানে না যে হিউ লরির অভিনয় জীবনের সেরা কাজ এই হাউসে না। হিউ লরি তার নিজের সেরা অভিনয় দেখিয়েছে ব্রিটিশ কমেডিগুলোতে। ব্ল্যাক অ্যাডার-এর তৃতীয় সীজন থেকে শুরু। আর পুরোদমে হিউ লরির ক্যারিশমা দেখলাম A Bit of Fry & Laurie সিরিজে।


মাত্র দুইজন অভিনেতা - Stephen Fry আর Hugh Laurie। "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানে যেমন ছোট ছোট স্কিট দেখায়, ছোট ছোট ঘটনা বা জোকস, এই পুরো অনুষ্ঠানটাই সেরকম নানা অংশে ভরা। একেকবার তারা দুইজন একেক সাজে আসে। সাজের সাথে সাথে মুখের ভাষা আর অ্যাকসেন্ট বদলে যায়। আর বেশিরভাগ অনুষ্ঠান শেষ হয় হিউ লরির একটা করে গান দিয়ে। খুব পপুলার একটা পাঞ্চ লাইন ছিলো - ফ্রাই বলতেন, "Please Mr. Music, will you play?" তখন দেখা যেত এক এক রকম সাজে পিয়ানোর সামনে হিউ, বাজাচ্ছেন তার নিজেরই লেখা কোন গান, অথবা কোন বিখ্যাত গানের রিমেক করে বারোটা বাজাচ্ছেন! আজকে অসংখ্য ছোট ছোট স্কিট না দিয়ে খালি গানগুলো দিলাম। পুরাই বিনোদন!!
America: 
=====================================
Mystery:

 =====================================
Little Girl:

 

মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১০

নতুন বাজার

মোড়ের কোমরের কাছে বেঁকে গেছে। গাড়ির হর্ন আর রিকশাওলাদের ক্যাচাল। শীত শীত আরাম বাতাস। একটু আগেই রোদ ছিলো, এখন মেঘ ঢেকে আছে। আমি বেশ ভেঙে ভেঙে এখানে পৌঁছেছি। পকেটে ভাংতি ছিলো না বেশি। রিকশাভাড়া হিসেব করে করে এলাম। মাঝের রাস্তায় মোড়ের এক পার থেকে রিকশা নিলে এক রেট, আরেক পারে গেলে পাঁচ টাকা কম। তাই হেঁটে পার হইলাম ওই মোড়টা।

তো, মোড়ের পরে মোড়, কোমরের বাঁকগুলোকে অবহেলায় এড়িয়ে এসে, আমি নতুন বাজারে বসে রইলাম। সকাল দশটা বাজে। অনেকটা ঘুরে ঘুরে এসেছি। পথে শীতের বাতাস শার্টের বোতামে আটকে গেছে। তারপর সেগুলোর জট ছাড়াতে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম মোড়টায়। এখানে রিকশা, সিএনজি আর মিশুকের খ্যাপ-স্টেশন। জন প্রতি দশ টাকা গুলশান দুইয়ের মোড়। সব পক্ষ খুশি থাকে এরকম বন্দোবস্তে। একসাথে গিজগিজ করে সিএনজি-মিশুকে উঠে যাচ্ছে মোটা-শুকনা লোকগুলো। ভাড়া করা সিএনজি দেখে দেখে অভ্যস্ত চোখে একটু খটকা লাগে। এখানেও এক সিএনজি নানাজনকে টেনে নিচ্ছে পেটের ভেতর। কোনো একজন যদি একা একা যেতে চায় বনানী, কিংবা মহাখালি, এরা যাবে না। পলিগ্যামি!! টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না!

আমি একটু হেঁটে শীত আমেজটা কাটিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। এখনও একটু পরপর বাতাস দিচ্ছে। মোড়ের ওপর চায়ের দোকানে ব্যানার দিয়ে আড়াল করা। বাতাস ঠেকাচ্ছে। দেখে পদ্মার নৌকার কথা মনে পড়লো, আরিচা ঘাট থেকে নগরবাড়ি ঘাট। পালতোলা নৌকার মতো ফুলে উঠছে এই ব্যানারটা। ব্যানারে ছাত্রলীগের দেয়া কুরবানির হাটের খবর লেখা। আমি কুরবানির হাটকে পিঠে রেখে বসলাম, "মামা, একটা চা করেন", চায়ের দোকানদারের হাতের চামচ নড়তে থাকে। দোকানদারের নাম কেরামত। গালে থুতনিতে অল্প দু'গাছা দাড়ি। গলায় মাফলার, পরনের কাপড় পুরনো এবং শীত মানবে না আর কয়দিন পরেই। "নতুন লিকার বসাইসি, একটু ধাগ কম হইবো", বললেন তিনি, "এখনই খাবেন নাকি আরেকটু পরে দিমু?" আমি বললাম, "ঠিকাছে মামা, পরেই দেন। দশ মিনিট।"

দশ মিনিট পরে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সামনের ওভারব্রিজটাকে দেখি। দুপাশ দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, রাস্তার ওপারেও একই রকমের সিঁড়ি। দেখে হঠাৎ মনে হয় এই নতুন বাজারে একটা শীর্ণ লোক বুকডন দিচ্ছে। দুই পাশের ফুটপাতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে, আর পিঠ উঁচু করে রেখেছে, যাতে তলা দিয়ে সারসার বাস-ট্রাক-গাড়ি-রিকশা চলে যেতে পারে! নিজের চিন্তায় নিজেই হেসে উঠলাম। পাশে একজন বিড়ি ফুঁকতেছিলাম। হাসতে হাসতে তার বিড়ির দমবন্ধ গন্ধটাও ভালো লাগলো!

চা শেষ হইলো। পাঁচ টাকা হইছে, মামা। এই নেন রাখেন। আমার পকেটে শেষ পাঁচ টাকার কয়েনটাও দিয়ে দিলাম। এখন হালকা লাগছে। কড়কড়ে দুইটা এক হাজার টাকার নোট আছে। এটা এখন আর কেউ ভাঙিয়ে দিবে না। এক হাজার টাকার নোটের মেরুদণ্ড বাংলাদেশের সব চাইতে শক্ত শিশ্নের চাইতেও শক্ত। [অ্যাঅ্যাই! কেউ আমাকে খারাপ ভাববেন না, প্লিজ। আমি বাংলাদেশির মেরুদণ্ডের সাথে তুলনা করছি না বলে দোষ ধইরেন না। ওটা স্পঞ্জের মতো নরম, মুরগির কচি হাড়ের চাইতেও তুলতুলে। ওর সাথে কি 'অভাঙনযোগ্য' হাজার টাকার নোটের তুলনা করা যায়?]

পৌনে বারোটা বাজে। সূর্য বেশ চড়া। এখন আর শীত লাগছে না। ওম ওম উষ্ণতা। কেরামত ভালো থাকুক। ওভারব্রিজটাও ভালো থাকুক। আমি ফিরে চললাম!

সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১০

দুঃস্বপ্ন

খুব বাজে দুঃস্বপ্ন দেখাটা একটা অভিশাপের মতো। দুঃস্বপ্ন সন্তর্পণে এসেছে। ঘুমিয়ে ছিলাম, আর ঘুমটাও এমন যে টের পাচ্ছিলাম অনেকক্ষণ ধরে অনেক আরামের ঘুম হচ্ছে। ঘরে এই পড়ো পড়ো শীতে হালকা করে ফ্যান ঘুরছে। গায়ে পাতলা কম্বল গায়ে দিয়েছি। বাতাস টের পাচ্ছি, কিন্তু শীত লাগছে না। এই ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ দুঃস্বপ্নটা আক্রমণ করে বসলো। মনে হলো, কেউ বুকের বাঁ পাশে গনগনে লোহার বর্শা গেঁথে দিয়েছে। ফুসফুসের কুঠুরিতে সেই গরম বর্শার ফলা বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষে জরজর হয়ে আমি দুঃস্বপ্নটা দেখতে থাকি। সেলুলয়েডের মতো একটানা চোখের যামনে বয়ে চলছে। এ খুব অবাক ব্যাপার, সুখস্বপ্নগুলো এতো ভিভিড হয় না। ছেঁড়া ছেঁড়া, খণ্ডদৃশ্যের মতো হয়। ঘুম ভেঙে সেগুলো ঠিক ঠাক জোড়া দেয়া যায় না। মাঝে মিসিং লিংক থাকে অনেক। কিন্তু দুঃস্বপ্নগুলো একদম ডিটেইল। আমার বুকে জমে থাকা বাতাস ফুরিয়ে যেতে থাকে। আমি ঘুমের মধ্যেই ছটফট করি। নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করি। আর আমার শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জন্য আঁকুপাকু করে। জগদ্দল শরীর। অযথা বেহুদা ক্লেশ। শেষ হয়ে গেলে আমি হালকা হয়ে যেতাম, শালিকের মতো। এই অচকিত ভাবনাটাও গরম তাপে মোমের মতো গলে যায়। দুঃস্বপ্নকে এখন আর স্বপ্ন মনে হচ্ছে না। মনে হতে থাকে এটা বাস্তব। আমার যাপিত জীবন!

আমার চোখ ফেটে জল আসে। আমি বুকের শেষ শ্বাসটুকু ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠি। আমার হাত মুঠো হয়ে ওঠে। আমার গলা ভেঙে যেতে থাকে। আমি চিৎকার করতেই থাকি। কে যেন থাইয়ের কাছে করাত দিয়ে পা কেটে ফেলছে। চিৎকারের শব্দ হারিয়ে যায়। আমার শরীর বেঁকে চুরে যাচ্ছে। চিৎকার দিতে দিতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।

ঘর অন্ধকার।

ফ্যান সরসর সাপের মতো ঘুরছে।

আমার গায়ে পাতলা কম্বল।

আমি খুব জোরে চিৎকার করছিলাম, গলা ভেঙে গেছে।


আমি বেঁচে আছি, কিন্তু আমি মরে গেলেই বেঁচে যেতাম।



এখন এই অবশ্যম্ভাবী দুঃস্বপ্নটা সত্যি হওয়া পর্যন্ত আমি সেটা যাপন করবো।

রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১০

পুরোনো ত্রয়ী

সংকট

হাতের উল্টোপিঠে তারাদের ছাপ তৈরির বিষয়টা অস্বস্তিকর; বড়ো বিস্ময়েরও বটে। আমি যদ্দুর জানতাম, ওরা আজকাল এখানে বাসা বাঁধে না। জমি বিক্রি বন্ধ সেই আদ্যিকাল থেকে, যুদ্ধেরও কয়েক বছর আগে হইতে! তখন খোলা প্রান্তরেও তামাবর্ণ মানুষের হাতে উল্কির মতো, কুষ্ঠের মতো, শ্বেতীর মতো তারাবাজি খেলা করতো। তারপর বহুদিন আগে কোন্‌ দুর্ঘটনায় আদিম তারার নির্দেশে মানুষের করতল থেকে মুছে গেলো উল্কিময় কারুকার্য। তারাদের কাছে আমরা হলাম অপাংক্তেয়।

অথচ আমার হাতের পিঠে সেদিন পুড়ে গেলো চামড়ার তল, অপতলে ফুটে উঠলো বিম্বিত নক্ষত্র! যখন কাঠ, খড়, তুষের সম্বল নিয়ে তারকা-নেতা এলেন, পেছনে সারি বেঁধে এলো তারাসকল, আমি খুবই অবাক বিব্রত ঘাম মুছে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উদোম হাতের পিঠে ছাই হয়ে গেলো সুন্দরবনের মতো মানচিত্র...


***

ভালোবাসা

শীৎকারগুলো দেয়ালে গেঁথে আছে চিত্রশিল্পের মতো
আর তাদের দুজনের মাথা দুটো, দুভাগ করা লেবুর মতো
দুদিকে এলিয়ে পড়ে আছে। তবুও তাদের রমণ বেগ
অমন্দন গতিশীল নিরাবেগ। যান্ত্রিকও কিছুটা, তাদের
ঘুমের ভেতর বিনিময় হয়ে যায় হাত ও পায়ের আঙুল
নিদ্রাতটের জলদস্যুতায়, তারা চুরি করে
একে অপরের মস্তিষ্ক চিরতরে

আর সকালের রোদে দেখা গেলো তাদের মুখের চামড়া খুলে
ঝুলছে অপরজনের চেহারায়।

টেড হিউজের একটি কবিতা অবলম্বনে

***

একটি নিছক আটপৌরে ঘটনা

যারা রাস্তায় থাকে তাদের কাছে আলোবিহীন সড়ক ভূতুড়ে নয়; তেমন একটা। কিন্তু আমরা যারা দালানকোঠায় বাস করি, আমাদের যাপিত জীবনে আঁধার ও বৈকল্য এক সাথে আসে। আজ কয়েকজনকে দাওয়াত করেছিলাম। নিছক অনেকদিন বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাত নেই, ফোনে কথা বলে মনের আশ বা প্রাণের সাধ কোনোটাই মিটছে না। নেহাত বাইরের কোন ফাস্টফুড বা হ-য-ব-র-ল রেস্তোরাঁ আমার পছন্দ না বলে সবাইকে বাসায় ডেকেছি। সবাই বলতে ওরা পাঁচজন, এখন যারা আমার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে খুব। তারা হাসি ঠাট্টায় জমে উঠতে উঠতেই হুট করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলো। ধুপ করে সব কালো। চোখ সয়ে এলে আবছা একটা আলো চোখে পড়ে। নীলচে-কালচে আলোতে দেখি বিছানা-চেয়ার মিলিয়ে ওরা চারজন অনাহূত অন্ধকারে কথা থামিয়ে দিয়েছে।

আড্ডা থিতিয়ে এলে জায়গা বা বিষয়বদল দরকার। আমি সফল হোস্ট হতে চাওয়ার লোভে ভুগছি। ভাবছি আজকের গেট-টুগেদারের গপ্পো যদি আগামি এক সপ্তা না চলে, তাহলে আমার এই উইক-এন্ডটাই মাটি! ফেসবুকে ছবি আর নোটিফিকেশনের ঝড় ওঠা চাই। কমেন্টের ফুলঝুরি আর ওয়াল পোস্ট চাই। কিন্তু ছবি তুলবো কীভাবে, কারেন্টই তো নেই! ভেবেই মেজাজ ফট্টিনাইন হয়ে যাচ্ছিলো। তারপর নিজেকে সামলে নিলাম, হোস্ট হয়ে অন্ধকারের মাঝে ঘোস্ট হওয়ার দরকার নেই। বরং জায়গা বদলে দেই। "অ্যাই, তোরা কি ছাদে যাবি?", বলামাত্রই ওরা শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালো। হুড়হুড়িয়ে সবাই ছাদে উঠে গেলো। তেরো তলার উপরে ছাদ। একদিকে এরকমই লম্বা একটা হাইরাইজ ছাড়া বাকি তিনদিকে খালি, মিষ্টি বাতাস বইছে, বসন্ত-সমীরণ।

আমার বন্ধুরা অবশ্য বাতাস উপভোগ করে না। তারা গুমোট বিকল লোডশেডিং থেকে মুক্ত হয়েই খুশি। সবাই মিলে ছাদের রেলিংয়ের দিকে ছুটে গেলো। নিচে তাকিয়ে একজন গাড়িঘোড়া দেখছে। মানুষগুলো পিঁপড়ের মতো। আমাদের বন্ধুদের মাঝে যে সবচেয়ে বিটলা, সে থুক করে একদলা থুতু ফেললো। আমরা 'ইয়াক', 'ঈঊ' করে উঠলাম, "এ কী ধরনের অসভ্যতা! ম্যানারলেস! ক্রাস!" থুতুর মতোই ওর দিকে কতোগুলো গালি ছুঁড়লাম আমরা। ও নির্বিকার হাসলো। যেন এই গালিগুলো আমাদের দিয়ে বলিয়ে নিতেই সে এমনটা করেছে। ওর কারণেই হোক, অথবা নিচের গাড়িমানুষের লিলিপুট ভার্সন একঘেঁয়ে ওঠার কারণেই হোক, আমরা রেলিং থেকে সরে এলাম। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ছাদের কুসুমগরম মেঝেতে বসে পড়লাম সবাই। একটু আগেই বিকেল মরে জেগে ওঠা সন্ধ্যাটা মরে গেছে। চারদিকে আজান তোলা শেষ। এখন খালি রাস্তার আবছা কোলাহল আর নিঃস্তব্ধতা। আমাদের পাঁচটে দেহবিহীন আত্মা তেরো তলার ওপর চৌদ্দ তলা ছাদ থেকে বার বার লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবার কসরত করছে।


***

শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১০

ওন্দস্কান

মাথা ভার ভার করছে সারাদিন ধরে। অনেক কাজ করছি সারাদিন ধরে। বেশিরভাগ সময় কম্পিউটারের সামনে যারা কাটান, হঠাৎ করে পুরো একটা দিন বা সারা সপ্তাহ ইন্টারনেট আর কম্পিউটার না ধরলে তাদের কেমন লাগবে? ভাবছিলাম। কিছু কিছু ব্যাপার যেমন কল্পনাতেও আসে না, ফ্যান্টাসির চাইতেও বেশি অসম্ভব বলে মনে হয়, এই ব্যাপারটাও মনে হয় সেরকম! আমি প্রায় দশ বছর ধরে নিজের কম্পিউটার ব্যবহার করছি, হঠাৎ করে এক দিন বা দুই দিন কম্পিউটার সচল না পেলে মাথার সার্কিটে কোন একটা 'গিয়াঞ্জাম' লেগে যায় (আগে গিট্টু লাগতো, গিট্টুর পরের দশা হলো গেরো, আর গিয়াঞ্জাম হলো শেষ অবস্থা!)। মনে হতে থাকে একটা হাত নাই; অথবা পেটের ভেতরে পাকস্থলী নাই - খাবার খাইলে সরাসরি তলপেটে চলে যাচ্ছে। এই ধরনের উদ্ভট শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে মনে হতে থাকে যে আমি বোধহয় আসক্ত। নেশাগ্রস্ত।

অনেক আগে একটা ছবি দেখেছিলাম মনিটরের ভেতরে মাথা ম্যাট্রিক্সের মতো গলে গলে ঢুকে যাচ্ছে আর বাকি শরীরটা টার্মিনেটর টু-এর মতো এলুমিনিয়ামের মতো গলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তেমন লাগে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এটা যে অস্বাভাবিক বা সমস্যা, তা বুঝতে পারি না। স্বাভাবিক মনে হয়। অভ্যস্ত হলে অপ্রাকৃতিক আচরণও ন্যায্য মনে হয়।



কিছু ছবি দেখার পরে অতীতের কথা মনে পড়ে। আমার স্বল্পায়ু অতীত। সুইডেনের ছবি ওন্দস্কান (Ondskan), মানে হলো Evil, শয়তান। ছবিটা যার কাছ থেকে নিয়েছি, সে বলেছিলো যে ক্যাডেট কলেজের কথা মনে পড়বে, দেখেন, মজা পাবেন (সে নিজেও এক্স-ক্যাডেট)। দেখা শুরু করার ২০ মিনিট পরে একটু থামলাম। একটা দৃশ্য দেখালো, বোর্ডিং হাউজে আসার পরে রুমমেটের সাথে কথোপকথন। রুমমেট বেশ পড়ুয়া, ভালো ছাত্র, তবে খেলাধুলায় ভালো না, একটু পৃথুল শরীরের। যে সিনিয়র প্রিফেক্ট নতুন ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে, সে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু হালকা ঝাড়ি দিয়ে গেলো। নতুন ছেলেটাই গল্পের মূল নায়ক, রাগী, বয়ঃসন্ধির রাগ, পেটা শরীর, সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। আমি থেমে গেলাম কারণ আমি নিজেও খুব একটা ভালো ছিলাম না খেলাধুলায়। খেলতাম, খুব এনজয় করেই খেলেছি দুই তিন বছর। কিন্তু যতো সিনিয়র হয়ে গেছি ততোই খেলাধুলার দিক থেকে মন সরে গিয়েছে। খুব প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমার কখনই ভালো লাগে না। ওপেন চ্যালেঞ্জ, জিগীষার যে খাপ-খোলা-রূপ খেলার মাঠে ফুটে ওঠে, সেটা আমাকে কিছুটা সন্ত্রস্ত করে।

ছবিটা মূলত এই বোর্ডিংয়ের জীবন-যাপন নিয়ে নয়। বরং আরো অনেক গভীর মনস্তত্ত্বে গিয়ে নাড়া দিয়েছে। আর এখন যদি ব্যাখ্যা করতে যাই, পারবো না। এতোটাই সূক্ষ্ণ-উদ্দীপন, যে ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা নাই। ছবিটার নামে যে শয়তানের কথা বলেছে, সেটা আমাদের ভেতরের পাশবিকতা। হিংস্র জানোয়ারের মতো আমরা মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে, নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাই। সামনে পরা মানুষটাকে আর মানুষ বলে মনে করি না। ভায়োলেন্স আসলে খুবই "সাপেক্ষ" আচরণ। যা কিনা পরিবেশ, মুহূর্ত এবং আরো অনেক প্রভাবকের ওপর নির্ভর করে। গিয়ারের দাঁতের মতো, অনেকগুলো ছোটবড় চাকার দাঁত মিলে গেলে ঘোটঘোট করে ঘুরতে থাকে ভায়োলেন্সের চাকা। এর সাথে যুক্ত হয় মব-ফিয়ার, দলগত-হিংস্রতা। কোন র‍্যাশনাল বা ক্রিটিকাল সমালোচনা এখানে তুচ্ছ।

আরেকটা জিনিস খুব ঘটতে দেখেছি, যে কোন বদ্ধ-আবাসিক ব্যবস্থায়। সেটা হলো ব্যবস্থার নিজস্ব একটা চালু 'সিস্টেম' থাকে। এটা অনেকটাই সপ্রাণ। আর প্রাণের বৈশিষ্ট্যই হলো বিবর্তন। সিস্টেম ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়। অনেক বুঝে শুনে নিয়মকানুন বানালেও নিজে নিজে সিস্টেমটা মানুষগুলোকে দিয়ে আরেকটা আলাদা নিয়মকানুনের ইশতেহার বানিয়ে ফেলে। যেন সে বুঝতে পারছে কোনভাবে চললে, কোন নিয়মে চালালে সবচেয়ে স্থিতিশীল সিস্টেম তৈরি করা যাবে। যতোই 'রেড বুক' বা 'নীতিমালা' বানাই না কেন, শেষতক সেই সিস্টেমের-বানানো-নিয়মটাই টিকে থাকবে। এটা যেন নিজেই নিজের জন্য সীমানা তৈরি করে!

আর মানুষ খুবই ফালতু সৃষ্টি। কারণ অধিকাংশ মানুষ এই সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যারা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারে থাকেন, তারাও পারেন না। সিস্টেমের হাতে তারাও এক একটা ঘুঁটি। এখানেও লজিক্যাল কোন ডিডাকশন নাই। মেনে চলো। সুখী হবে। এই যে 'সুখ', এটাও সিস্টেম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঠিক ওই ম্যাট্রিক্সের মতোন!

যাস্‌সালা, ঘুরে ফিরে সেই তো গোড়ায় ফিরে এলুম! এই কী গেরো! ( আশার কথা, গিয়াঞ্জাম কেটে 'গেরো'তে এসেছি, গিট্টুতেও চলে আসতে পারবো নিশ্চিত!)

বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১০

স্মৃতি ও বিস্মৃতি

ডিসেম্বর এলে আস্তে আস্তে শীত বাড়ে। আমার এই শীতকাল খুব মেলাঙ্কলিক লাগে। যে স্মৃতিগুলোকে আগের জন্মের বলে মনে হয়, সেই কৈশোরের সময়টা মনে পড়তে থাকে। সেই সময়ের 'আমি'কে নিজের সত্ত্বা বলতে চিনতে পারি না। অচেনা মানুষের সাথে পরিচয়ে আমি বরাবরই অমিশুক, সন্তর্পণ। তাই সহজ হতে পারি না, চুপচাপ তার কাজকর্ম দেখি। কাজকর্ম দেখি মানে সেই সময়ে 'আমি' কি কি করতাম সেগুলো মনে করার চেষ্টা করি। জীবন যাপন করা তখনও অনেক কঠিন মনে হতো। অথচ তখন যদি জানতাম, এখনের জীবন এমন, এই রূপ, তাহলে হয়তো সেই কষ্টগুলো আর কষ্ট বলে গায়েই লাগতো না!

শীতের সময়ে সম্ভবত আমার প্রথম স্মৃতি তৈরি হয়েছিলো। দুইদিন আগে আমার এক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, জন্মের পরে প্রথম স্মৃতি কোনটা, কতোদূর পষ্টভাবে মনে করা যায়? বন্ধুটি বেশ শিল্পমনা, রুচিশীল। এমনিতে ফেসবুকে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কথাবার্তাকে তেমন আমল দেই না। তবে তখন ভাবনা যোগালো, মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রথম স্মৃতি। বোনের জন্ম মনে আছে, সেটার বয়স চার। তার আগে? ময়মনসিংহে একতলা বাসায় থাকতাম, বাসার সামনে ইট-বিছানো উঠান ছিলো, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই পাঁচিল ঘেঁষে আকাশছোঁয়া গাছ ছিলো। বাসার সামনের বারান্দা পার হলে বাম কোণে কলতলা ছিলো, টিউবওয়েল ছিলো কিন্তু আমি ওটা চাপতে পারতাম না। নানী ছিলো, ওটাকে চাপকল বলতেন। আমি তাঁর সাদা আঁচল আঁকড়ে ধরে হেঁটে বেড়াতাম।

এগুলো সবই তরতাজা স্মৃতি। ময়মনসিংহের বাসাটায়, আমি যে দেয়াল ভর্তি করে অ আ ক খ লিখতাম, সেটাও চার বছরের স্মৃতি। আরো পিছে যাই। ঝাপসা ঝাপসা লাগে। এর আগে সাভারে ছিলাম, স্মৃতিসৌধে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঝাপসা খোপ খোপ স্মৃতিসৌধ, ভয় পেয়েছিলাম। মোটেই ছবির মতো সুন্দর বাঁকানো সুউচ্চ মনে হয় নি। আতঙ্কের স্মৃতি খুব সহজে ছাপ ফেলে। আমি বোধহয় স্মৃতিসৌধের ভেতরে ঢুকে কেঁদে ফেলেছিলাম ভয়ে। তারপরে বেরোনোর পরে সামনের ঝিলে শাপলা দেখে একটু থেমেছি, শান্ত হয়েছি। দাদী ছিলেন সাথেই। তবে তার কথা মনে নেই, ছবি দেখে বুঝি এখন।

সাভারের আগে ঢাকায় থাকতাম, সেগুলো ধুয়ে মুছে গেছে। মানুষের এই স্মৃতিগুলো থাকে না কেন? আমার ভাগ্নে আরাভ বড়ো হচ্ছে। বাসায় আমরা মামা-খালা-চাচারা এলেই তাকে নিয়ে নানা আদর-সোহাগ। এগুলোর অমূল্যতা সে কোনোদিন মনে রাখতে পারবে না! আমি জানি আজ থেকে পনেরো বছর পরে তার সাথে আমার এই যোগাযোগ, এই নিবিড়তা থাকবে না। তখন হয়তো এই স্মৃতিগুলো পেলে তার খুব ভালো লাগতো!

জর্নাল জিনিসটা চমৎকার। রোজ রোজ ভাবনার ভার ক্লান্ত করে। আজকের ক্লান্তি একটু কমে গেলো। এখন থেকে লিখবো। অনেক অনেক শব্দ, যেগুলো আদতে একদমই মূল্যহীন!