শনিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১১

ঘোলাপানি...

ফ্যাঁৎ!
  শীত চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো। দরজা খোলা, আরেকটু অপেক্ষা করলেই বেরিয়ে চলে যেতো, টা-টা দিচ্ছিলো। কিন্তু কী মনে করে আবার ফিরে এলো। এবং একটু অপ্রস্তুত ছিলাম, তাই আবারও ঠাণ্ডা আঁকড়ে ধরলো আমায়। এই ঋতুতে তিন তিন বার সর্দি-কাশিতে জেরবার হলাম। বুঝতেছি না আমার রোগ-প্রতিরোধ কমেছে নাকি নিত্যনতুন ভাইরাসের প্রাচুর্য বেড়েছে। তবে হাঁচতেকাশতেফ্যাঁৎফ্যাঁতাতে আমার কাহিল দশা।

***

ভবিষ্যত!

এরই মাঝে বছর শেষ হয়ে গেলো। এই গত দশক খুব সজাগ কাটিয়েছি। মানে এই দশ বছরে দিন দুনিয়া চিনলাম। দশকের শুরুতে কৈশোর শেষ হচ্ছিলো, আর এখন সামনে তিরিশ হাতছানি দিয়ে হা করে আছে। তিরিশ ছুঁয়ে ফেললে মনে হয় আরো একটু বুড়ো হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। ধীরে ধীরে নখদন্তশ্বাপদ থেকে ভোঁতা হতে শুরু করবো। পুঁচকেদের হিংসা করতে শুরু করবো। খিটখিটে হয়ে যাবো জীবন-যাপনের থাবড়া খেয়ে খেয়ে। আজ যা কিছু আমার নতুন, আমার পরাণ, সেগুলো অতিব্যবহৃত ছোবড়ায় পরিণত হবে। তিরিশ তাই মনে ত্রাসের সৃষ্টি করছে। ভাবছি তিরিশের পর বয়েস গোনা উল্টে দিবো। পরের বছর উনত্রিশ হবো, তার পরের বছর আটাশ, ফের ঘুরপাক মধ্যগগণে! সবাই মানবে না, তাতে কী, আমি কি কাউরে ব'লে ক'য়ে পৃথিবীতে আসছি, না কারো কথায় গুডবাই জানাবো?

***
 
সেলসমাচার!

খালি বিদায়ের কথা বলতেছি। এখন একটু আগমনীবাতচিত করি। গত পরশু নতুন সেলফোন কিনতে গেলাম। বাজারে সবসময় থরে থরে সেট সাজানো দেখি, ঠাটবাট দেখে ভেতো বাঙালি, তাহাদিগকে সম্মান করি। শীতল ধাতব শরীরে চকমকে সেটগুলো আমার কুর্নিশে হালকা মাথা নাড়াতো। সেদিন কিনতে যাবার আগে ভাবলাম খালি বাইরের রূপে ভুলিবো না, ভিতরে কি আছে জেনে যাই। মানুষের ভরসা নাই, তাই ইন্টারনেটে বসে ঘাঁটলাম। আমার ছোটবোন বয়সে ছোট আর মননে বড়ো হওয়ার কারণে এই ব্যাপারে মোটামুটি ডিগ্রিধারী। সেলফোন নিয়ে কয়েকটা সাইট ঘুরে-টুরে বুঝলাম কোনো সেট হাতে নিয়ে "এই ফোনে কী কী আছে?" জিজ্ঞাসা করার চাইতে "এই ফোনে কোন ফিচারটা নাই?" প্রশ্নটা সহজ। দোকানির বলতে কম সময় লাগবে। আমার ভোঁতা-হতে-চলা মগজে যা বুঝ আসলো, এখন সেলফোন সেট একটা ছোটখাটো কম্পিউটার। ওএস আছে - সিম্বিয়ান, উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়েড। এগুলোর মাঝে শেষেরটা সবচে ভালু মনে হয়। তারপরে আছে লুক-এর ব্যাপার, এখন টাচস্ক্রিনের যুগ। ওএস কতো র‍্যামে চলছে এটাও জরুরি। এটা দিয়ে টাচস্ক্রিনের দ্রুততাও হিসাব-যাচাই করে নিতে হবে। তারপরে আসে ওয়াই-ফাই এর হিসাব। ওয়াইফ হইলো না এখনু তাই ওয়াই-ফাই-ই সই। এটা না হলে চলছে না। এখন এই ওএস আর ওয়াই-ফাই আসলেই সেটের দাম আমার বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে!
এতোসব ঘোরাঘুরির মধ্যে মনে হচ্ছিলো নতুন যারা এখন বিশের কোঠা পেরুচ্ছে, তারা এই নতুন প্রযুক্তিগুলোতে বেশ মানিয়ে নিচ্ছে। এগুলো ব্যবহার করতে করতেই তারা হয়তো নতুন কিছু তৈরি করবে। কেউ কেউ মাথাপাগল জিনিয়াস নতুন ওএস বানিয়ে ফেলবে। আশাবাদী হইলে দিন ভালো কাটে আমার।

***

বইমেলা যাও!

বইমেলা আসতেছে সামনেই, আর দিন আটেক বাকি। প্রতি বইমেলার মাসটা আমার কাছে খুব আনন্দের। কতো কতো নতুন-পুরাতন বই, সেই বাংলা একাডেমীর মাঠ, বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দা, স্টলের সামনে মানুষের ভীড়! আর পরিচিত আধাপরিচিত মানুষদের সাথে আড্ডা আর সাথে চা। আহ! সারা বছরের সব ঝুটঝামেলা আর কলুষ এক মাসে ধুয়ে যায়। আর বছর দুই ধরে ব্লগারদের সাথে আড্ডা বাড়ছে বইমেলাতে। এক কোণ ফাঁকা পেলেই তিন চার জন মিলে দিকবিদিক ভুলে সন্ধ্যা-রাত অবধি খোশগল্প চলে। রাত জমাট হইলে শেষ চা খেয়ে বাসায় ফিরি। আর শেষ দশ দিনে বেশি বই কিনি, লিস্ট করা শুরু করছি মনে মনে। গতবারের কেনা কিছু কিছু বই এখনো পড়া শেষ হয় নি, সেগুলোও তাক থেকে নামালাম পরশু। এই ধুমে পড়ে ফেলতে হবে!

***

তারপর!

মাঝে মাঝে কারো কারো কথায় হার্ট হই। ভার্চুয়াল জগতে কতো মানুষকে দেখলাম, কতো নটীর নাটক। এইসব দেখে এবং ঠেকে শিখেছি যে টেক্সটকে বেশি ভ্যালু দিতে নাই। ছোটবেলায় শিখেছিলাম ছাপার অক্ষরে ভুল থাকে না। পাঠ্যবইয়ে অঙ্কের ভুল উত্তর লেখা থাকলে সেটা মিলাতে গিয়ে মাথার চুলও ছিঁড়েছি কম না। সেই বেদবাক্যতুল্য অক্ষরকে ভালোবাসতেবাসতে আর সম্মান করতে করতে মজ্জাগত হয়ে গেছিলো। এখন ব্লগে যোগাযোগের অক্ষরগুলোকে তাই আলাদা মূল্যায়ন করা শিখলাম। বুঝে নিয়েছি যে মানুষ সামনাসামনি যেমন সামাজিক ভড়ং, ভণ্ডামি ও দ্বিমুখিতা দেখায়, ঠিক সেরকমই এই ভার্চুয়াল-পীঠ। ভালো খারাপ তকমা দেই না, এগুলো ঠিক যেমন, সেভাবে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করি। তারপরেও ভুলভাল হয়। মনের কাজ প্রজেকশন, নিজে নিজে ধইরা নেয় অনেক কিছু। স্টেরিওটাইপিং করে, গোষ্ঠিবাদ করে, ভুল বুইঝা চুপ যায়, ঠিক বুঝলে তেড়ে যায়। এইসব ভ্রান্ত-আচরণের চিপায় পড়ে (পড়ুন, পড়তে) ভালো লাগে না। তারপর মানায় নিতে হয়।
আজকে হঠাৎ মনে হলো, আকাশ ভাইয়ের সিনেস্থেশিয়া নিয়ে দুর্দান্ত পোস্টটা পড়তে পড়তে, যদি আমাদের মুখের অভিব্যক্তিগুলো টেক্সটের মধ্যে দিয়ে বুঝা যাইতো, তাইলে যেমন অনেকের গোমর ফাঁস হয়ে যেতো, তেমনি অনেকের কথার অবমূল্যায়নও বন্ধ হইতো। আমি বুড়োটে হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু হয়তো সদ্য-বিশে পা রাখা কেউ এরকম একটা কিছু আবিষ্কার করেই ফেলবে। তখন এই ব্লগ যারা পড়বে তারা কেমন মজা পাবে ভেবে একটু মুচকি মুচকি হাসলাম!

***

রবিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১১

হঠাৎই দুইটা লেখা...

(একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায় বলেই আমার চারপাশে গল্প জমে থাকে। চারপাশে গল্পের চরিত্রেরা ঘুরে বেড়ায়, খেলে বেড়ায়। তাদের অনুনয় বিনয়ের ভার আমার বড়ো ভারি লাগে!)


***
দৃশ্যের আগে পরে
 
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে নেমে আসে না, অন্ধকার দ্রুত জমাট বাঁধে। সেই জটাজাল কাটাতে গাড়ির হেডলাইট জ্বলে ওঠে নিঃশব্দে। আলো চিরে দেয় ভরাট আঁধারের পেট আর ফুটপাতের পাশে দোকানগুলোতেও জোরে জোরে জ্বলে ওঠে তারাবাতি। অধুনা তারাবাতিতেও তীব্র ঝলক। ঝল্‌কে ঝল্‌কে ওঠে আলো, লাল। নীল। হলুদ। ভেসে যেতে থাকে ছিন্নমূল হকারের বসাতি। হকার এড়িয়ে হনহনিয়ে চলা টবের মতো মানুষ। টবগুলো থপথপিয়ে চলে ফুটপাতে - ফুটপাত থকথক করে। সেখানে সন্ধ্যার পর অনেকটা রাত নেমে এলে একটা মেয়ে এলোমেলো হাঁটে। চুল কাঁধ ছাপিয়ে একটু দূর নেমে এলোমেলো, হাঁটার কারণে আরো এলোমেলো হতে থাকে। পরনের পোশাকে খেয়াল নেই তার, দৃষ্টি উদভ্রান্ত, উন্মুখ। ফুটপাতের খোপ খোপ ট্রাপিজিয়াম পাথরে সে একটু হড়কে হড়কে হাঁটে। 
 
আমরা কেবল দৃশ্য দেখি, আর দৃশ্যের আগে পরে জুড়ে দেই অন্যান্য দৃশ্য। ভেবে নেই আপাত অনুমান। অনুবাদ করি পরিচলনের ইতিহাস। মেয়েটির হেঁটে চলে যাওয়ার দৃশ্যে আমরা তার সঙ্গী খুঁজি, একা এতো রাতে মানুষের ভীড়ে কেন নেমেছে মেয়েটি? কোথায় যাচ্ছে সে? উত্তর কার কার জানা আছে? আমার তো লিখে দেওয়ার কথা, মেয়েটির যাত্রা ও গন্তব্যের ইতিহাস। আমি জানি সে কোনো এক বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আবার কোনো এক বাড়িতে পৌঁছাতে চাইছে। এই তথ্যে আমাদের কোনো লাভ হলো না। জানা গেলো না মেয়েটি ঠিক কেমন, কী ঘটছে তার জীবনে।

ঠিক তবে, তার চোখের মাঝে দোকানের ওই আলোগুলো পিছলে যাচ্ছে। পিছলে যাচ্ছে শরীরেও। চারপাশে ভীড় করা টবের মতো মানুষ। টবের সাথে ধাক্কা, হেলে যাওয়া টব, পড়ো পড়ো টব, সচকিত টব, বেখেয়াল টব, বেলেল্লা টব। টবগুলোকে হঠাৎই মেয়েটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে চায়। একটা টব এসে তাকে চেপে ধরে।

তখন পাশে তীব্র পেটচেরা আলো মুখে গাড়িটা এসে থাকে। টায়ার চমকে ওঠে, সেই সাথে টবগুলোও। সরে ছিটকে যায় এদিক-সেদিক। গাড়ির সামনের দরজা খটাশ খুলে দিয়ে ভেতর থেকে মেয়েটাকে ডাকে একজন। ছেলেটার খোঁচা খোঁচা চুল - হাত কাঁপছে তিরতির, স্টিয়ারিঙে। খসখসে গলায় সে মেয়েটাকে ডাকে, "উঠে আসো", মেয়েটা আরো দু'পা এগিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকে।

এই দৃশ্যের পরে দুই যুগ কেটে গেলে, চারপাশের আলো একটু একটু কমে আসবে। তারপর মেয়েটি গাড়িতে উঠে বসবে। এবং দরজা বন্ধ করে দেবে। তারপর তারা সাঁ করে চলে যাবে। সেই বাতাসে মেয়েটার অবিন্যস্ত কাঁধ ছাপানো চুল আর এলোমেলো হবে না। ছেলেটারও তিরতির হাতে স্টিয়ারিং কাঁপবে না। স্থির ভ্রমণের পর তারা নিশ্চয়ই সুখীই হবে। নাকি?

***


যা ঘটে গেছে
 
মাঝে মাঝে এই শহরে আমি বন্ধুহীন হয়ে পড়ি
দু'কোটি মানুষ আর সাথে তেরো হাজার সিএনজি
এর মাঝে আমার কোন বন্ধু নাই, নাই। নাই এফেনেফ
কম রেটে কথা বলার সাগ্রহ আবেদনময়ী অপারেটর
আমার বন্ধুহীনতায় ক্রমেই দেউলিয়া হয়, আর দেখা
যায় সে'সব মানুষ ও সিএনজির সাথে বেশ ঢলাঢলি করে।
***

শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১১

অ্যালেন গিনসবার্গের Howl...

====================
howl [হাউ্‌ল্‌] n. বিশেষত নেকড়ের একটানা হুঙ্কার; (মানুষের) আর্তনাদ; (অবজ্ঞা, কৌতুক ইত্যাদির) চিৎকার।
====================
কিছু কিছু ছবি গুগলের কাছে নিয়ে যায়। ছবি দেখা শেষ হলে, ইচ্ছা করে একটু পিছনের গল্পটা জেনে নেই। কতোটুকু সত্যিই ছিল, কতোটুকু পরিচালকের সিনেম্যাটিক বাস্তবতা, কতোটুকু দর্শক হিসেবে আমার অনুমান। গুগল করে অনেককিছু জানা যায়। অনেকে অজানা খবর ঠিক ঠাক বুঝা যায়। তারপর আবার কিছু কিছু ছবি থাকে, দেখার পরে গুগল করার ইচ্ছা হলেও করি না, তাতে সিনেমার মজাটা হারিয়ে যেতে পারে। অতিবিশ্লেষণ মাঝে মাঝে রসভঙ্গ দেয়। ভাং খাওয়ার পরে কেউ ভাঙের রাসায়নিক কম্পোজিশন কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করলে যেমন লাগে, তেমন। Howl দেখার পরে আমি এই দুইদিকের টানাটানিতে পড়ে গেলাম। সিনেমা খুব ভালো লেগে গেছে। ভীতিকর স্বপ্নের মতো ভালো লেগেছে। যেমন স্বপ্ন ঠিক ঠিক দুঃস্বপ্ন না, কারণ দেখার সময় পানিতে পড়ি নাই, স্বপ্নে কোন দুর্ঘটনাও ঘটে নাই। কিন্তু ঘুম ভেঙে সেই স্বপ্নের কথা ভাবলে একটু একটু ভয় হচ্ছে। সেই ভয়ের সাথে আবার অজানা আনন্দও মিশে আছে। আবার সেই ভয়ের অনুভবের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। 
ছবিটা বিস্ময়কর। একটি কবিতাকে সিনেমায় তুলে আনা দুরূহ কাজ। বেশিরভাগ উপন্যাসকে সিনেমায় আনতে গিয়েই অনেকে হিমশিম খায়, সেখানে গল্প বা উপন্যাস নয়, একেবারে কবিতা! পরিচালকের কি মাথা খারাপ হয়েছিলো? তাও এমন কবিতা যা পঞ্চাশের দশকে পুরো একটা জাতির একটা প্রজন্মকে মোটামুটি তুলে আনতে পারে? কবিতা ছাড়েন, কবির নামটাও আমাদের অজপাড়াদেশের বেশিরভাগ মানুষ জানেন। সেই সুবিখ্যাত কবি, সেই (কু)খ্যাত আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সিনেমার দৃশ্য বয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিনতম কাজের একটা। তাই পরিচালক অতিবাস্তব কল্পনার কাছে আশ্রয় নিলেন। সিনেমার অর্ধেক অংশ হলো কবি অ্যালেন গিনসবার্গের সাক্ষাতকার এবং কবিতার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মামলার শুনানি। বাকি অর্ধেক অংশ কবির কবিতা পাঠ এবং কবিতার পাশাপাশি কবিতাদৃশ্য। এই দৃশ্যগুলো অ্যানিমেটেড। এছাড়া উপায়ও নেই, বরং এটাই সর্বোত্তম উপায়। কবিতার দৃশ্যকে সেলুলয়েডে বাস্তব চিত্র দিয়ে তুলে আনা যায় না। সেখানে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ভরসায় না থেকে পরিচালকেরা সরাসরি অ্যানিমেশনে চলে গেছেন। মাঝে মাঝে বাস্তব জগতের ভেতর থেকে ফুঁড়ে বেরুচ্ছে অ্যানিমেশন, মাঝে মাঝে অ্যানিমেশন মিশে যাচ্ছে সাদাকালো আলোর অ্যালেনের পাঠরত অবয়বের সাথে। চশমাটা একটু ঠিক করে নিয়ে আবার পাঠ শুরু করছেন অ্যালেন, একটু দম নিয়ে নিচ্ছেন দুই স্তবকের মাঝে। উদ্দাম কণ্ঠ ছাড়া ছোট হোটেলের পাটাতনে সবাই নিশ্চুপ। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে, নীরবতার মাঝে শোনা যাচ্ছে টুং টাং গেলাসের আওয়াজ। সব কিছু ছাপিয়ে এক টানা নেকড়ের আর্তনাদ, Howl!! 
পরিচালক দু'জনের নাম রবার্ট এপস্টিন এবং জেফ্রি ফ্রিডম্যান। দু'জনেই এর আগে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন। এই ছবিটা ঠিক ডকুমেন্টারি নয়, একটু পুরোদস্তুর মোশন পিকচার। তবে বৈশিষ্ট্য হলো, এই ছবির সকল সংলাপ, বাস্তব। কেউ না কেউ, কখনো না কখনো, কোথাও না কোথাও বলেছেন। যেমন সাক্ষাতকার নেয়ার দৃশ্যে অ্যালেনের বলা সকল কথাই বাস্তবে বলেছেন তিনি। যেমন কোর্টরুমে শুনানির সময় বলা সব কথাই সত্যি। সেইদিক থেকে সিনেমার ভেতরে সংলাপগুলো কল্পনার নয়। তবে তার বাইরে মূল অংশ যে কবিতা, যে কবিতার আলাপ, সেগুলো কল্পনার রঙ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে বার বার। এবং দর্শকের চোখে, মনে, মগজে ছাপ ফেলে দেয়ার মতো দৃশ্য। এই দৃশ্য তৈরির জন্য এরিক ড্রুকারকে ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে!
কবিতার শরীরের ভেতর দিয়ে অ্যালেনের জীবন-ছবি ফুটে উঠতে থাকে। ছোটোবেলা, কিশোরবেলা, আবেগ। কিশোরবেলা-যুবকবেলা, প্রেম। অ্যালেন সমকামী ছিলেন, যাদের ভালোবাসতেন, তাদের জন্য তাঁর আকুতির মাঝে আমি কোনো ভেদাভেদ পাই না। অনুভবের কোন লিঙ্গ নাই, তাই একজন বিষমকামী যেভাবে প্রেয়সীকে কামনা করে, যেভাবে কাতর হয়, যেভাবে তার বিনিদ্র রাত জুড়ে থাকে একজনের চুলের সুবাস, ঠোঁটের বাঁকানো হাসি, তেমনভাবেই অ্যালেন তাড়িত হন। সেই উন্মাতাল সময়, মাদক-ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া বাস্তবতা, আর পরাবাস্তব কবিতার সময়ের মধ্যে অ্যালেন জন্মেছিলেন আরেক জন্ম। সেই সময় আমেরিকায় একটা পুরো প্রজন্ম বেড়ে উঠছিলো, অবয়ব পাচ্ছিলো, যাদের নাম বিট জেনারেশন। অ্যালেন সেই জেনারেশনের পুরোধা কবি। 
Howl And Other Poems বইটা অ্যালেনের প্রথম বই। এই কবিতার দায়ে বইটা অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়। মার্কিন আদালতে মামলা চলে প্রকাশক এবং সরকারি পক্ষের মধ্যে। সেন্সরশীপ, অশ্লীলতা নিয়ে সীমারেখার আলাপ উঠে আসে সেই মামলায়। বিভিন্ন অধ্যাপককে জবানি দিতে হয় এই বইয়ের সাহিত্যমূল্য বা সাহিত্যিক গুরুত্ব নিয়ে। এই অংশটুকু মজাদার। বেশ কিছু বুড়োটে প্রতিক্রিয়াশীল হামবড়া বুড়ো-জোয়ান প্রফেসর দেখতে পাই। তারা প্রথাগত কোটরে বন্দি, চোখের সামনে প্রথাগত ঠুলি। ঠুলি চোখে Howl তাদের কাছে অশ্লীল, নোংরা, অশ্রাব্য, হোমোসেক্সুয়াল, ট্যাবু। তাই এই কবিতার নানা অংশ নিয়েই তাদের প্রশ্ন উঠে গেছে। শব্দের শুদ্ধবাদিতা নিয়ে এঁড়োতর্কও জুড়ে দিয়েছেন তারা। এই অংশটা দেখে মজা লাগলো কারণ এখনও চারপাশে এই এঁড়ো ষাঁড় প্রচুর পয়দা হয়ে আছে। এই যুগে এসেও যারা ভাষার গায়ে পোশাক ও অলঙ্কার নিয়ে চিন্তিত। একটা শব্দেই তাদের শুচিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

ভাগ্যিস সেই অত্যাচার বেশিক্ষণ সইতে হয় নি। কালো ফ্রেমের চশমা পরা অ্যালেন এসে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। জেমস ফ্র্যাঙ্কোকে চিনেছি সেই স্পাইডারম্যান (২০০২) থেকে। তবে এই বছরে তার ছবিগুলো প্রশংসার দাবিদার। "127 Days", "Howl", "Eat Pray Love" সবগুলোতেই ফ্র্যাঙ্কো ধীরে ধীরে নিজের জাত চিনিয়ে দিচ্ছেন। যেমন ২০০৮-এ Milk ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হোমোসেক্সুয়াল চরিত্রের জন্যে ফ্র্যাঙ্কো বাঁধা পছন্দ হয়ে যাবেন মনে হয় পরিচালকদের। 
সবকিছু ছাপিয়েও, শেষমেশ ছবি জুড়ে একটা কবিতাই জ্বলজ্বল করছে। অ্যালেন গিনসবার্গকে আমরা সবাই 'যশোর রোড' দিয়ে চিনতাম, এবার আমি 'হাওল' দিয়ে চিনলাম। এবং এই পরিচয় আরো গভীর, প্রোথিত আবেগের, মানবিক, প্রেমাকুল। এক নেকড়ের দীর্ঘ আর্তনাদের মতোই এক টানা জান্তব, অথচ তীব্র কামনাময়!

====================

সম্পূর্ণ কবিতাঃ এখানে
সম্পূর্ণ সিনেমাঃ এখানে

====================






বুধবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১১

এপিক্যুরাস ভনে...

আজকাল খুব স্পিরিচুয়াল মানুষজন দেখি চারপাশে। মহাত্মা মহাত্মা লাগে তাদেরকে। খুশি হই যে আমি খুব ভাগ্যবান, আমার চারদিকে প্রতুল বিশ্বাসী মানুষ। বিশ্বাসের চাকাটায় নানা অপবিশ্বাস ও অপবিজ্ঞান এসে জুড়ে যাচ্ছে। এগুলো ভালো-খারাপ আপেক্ষিক। (মানে আমার কাছে খারাপ, আর অনেকের কাছে ভালো) তবে জরুরি হলো এগুলোকে কেউ যাচাই বাছাইও করছে না। ব্যধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয় - তাই ভাবছি একটু স্বাস্থ্যবটিকা ছড়াই। যুক্তিবিদ্যা আর দর্শন আমাদের সিলেবাসেই নাই। কেউ পড়ি নাই। আর পড়ি নাই বলে জানি না আমরা কুয়োর তলদেশের শ্যাওলামাখা ব্যাঙ! 
 
এপিক্যুরাসকে মনে পড়ছে। দুই হাজার দুইশ' সাত বছর আগে হেজে মজে গেছে। গ্রিক। এরিস্ততল, প্লেতো, দেমোক্রিতাসের পরে জন্মাইছেন। কাউরে সেভাবে পাত্তা দেন নাই। আর পাত্তা দেন নাই বলেই নতুন কিছু দিয়ে গেছেন জগতে মানবের জন্য। যুগে যুগে যতো মণীষী, আগের মানুষজনরে পাত্তা দেয় নাই বেশিরভাগই। ভাগ্যিস!

একটা সোজা কথা দিয়ে শুরু করিঃ
প্রজ্ঞাবান, নীতিবান আর ভালো হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া কেউ সুখের জীবন কাটাতে পারবে না, এবং সুখের জীবন না কাটিয়ে কেউ প্রজ্ঞাবান, নীতিবান আর ভালো হয়ে বাঁচতে পারবে না। যখনই কোনো একটার অভাব ঘটবে, যেমন কেউ যদি প্রজ্ঞাবান না হয়, তাহলে যতোই সম্মান আর নীতির সাথেই চলুক না কেন, সে কখনই সুখী হবে না।
চেনা চেনা লাগে? এইটাই গোল্ডেন রুল অফ এথিকস। অন্যরে এমনভাবে ট্রিট করো যেমনে তুমি নিজে ট্রিটেড হইবার চাও।
এপিক্যুরাস এইটা বললেন। বলেই থামেন নাই। টুকটাক যুক্তি দিয়ে বুঝায় দিছেন যে এইটা সত্য। (সত্য মানে ব্যক্তিগত সত্য না, সার্বিক সত্য, সকল যুগে, সকল কালে, জাত-পাত নির্বিশেষে)

আরেকদিকে যাই চলেন। এপিক্যুরাস লোকটি দেমোক্রিতাসের মতো বিশ্বাস করতেন পরমাণুর চাইতে ছোট কণা নাই। atomos, অবিভাজ্য। তবে তিনি দেমোক্রিতাস থেকে একটু ভিন্ন মতের ছিলেন। তিনি বলেছেন যে পরমাণু সবসময় সরল পথে চলে, তবে মাঝে মাঝে তারা পথ বিচ্যুত হয়, মাঝে মাঝে তারা swerve করে। এই খানে কেন তিনি এভাবে মত পাল্টালেন? কারণ নিয়ে একটু ভাবি, আসুন। "পরমাণু অবিভাজ্য আর সর্বদা সরলপথেই চলে" - এই বক্তব্যটা কেমন আদেশ আদেশ লাগে না? এই লাইনেই চলবি, এর বাইরে যাবি না। ব্যস। এইটা মানুষের ক্ষেত্রে - সমাজের ক্ষেত্রে খাটাই চলুন। গোষ্ঠি থেকে বড়ো হতে হতে রাষ্ট্র বানালো গ্রিকরা। সেই খানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো determinism, কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে বাঁচতে হবে - বলে দিলো দার্শনিক - নেতা - রাজনীতিবিদ - সিনেটর - প্রিফেক্ট এরা। বেশ। তবে মানুষের freewill কোথায় যাবে? গ্রিকরা মোটামুটি নিয়তি-বিশ্বাসী ছিলেন। মনে আছে, ইলিয়াড আর অডিসির নায়কদের কথা? বিশ্ববীর - অদম্য তারা, তারপরেও শেষ নিয়তি করুণ, দুঃসহ। সিসিফাসের কথাও মনে পড়ে। এই সবের মাঝে মানুষের কোন ক্ষমতা নাই নিজের নিয়তি বেছে নেয়ার। নাকি আছে? এপিক্যুরাস লোকটা সেই প্রশ্ন উস্কে দিলেন। অবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কোনকিছু 'আছে' আর 'সবাই মানে' বলে আমাকেও মানতে হবে? না। যাচাই করে দেখি। দেখা গেলো, মানুষেরও ফ্রি-উইল আছে। যেমন আছে পরমাণুর মাঝে মাঝে বেঁকে যাবার অধিকার!

বলে কী পাগল (কেউ কেউ ছাগলও বলেছিলো তাঁকে!)! জানেন, দুই হাজার মোটে বছর গেলো। আর ম্যাক্স প্লাঙ্ক নামক এক 'জর্মন' বিজ্ঞানী বের করে ফেললেন, পরমাণু আসলেই বেঁকে যায়।

এই রে, এখন ভাবছেন, এই ব্যাটা এপিক্যুরাস তো অবিশ্বাসী বুঝলাম, হু হু, তার মানেই ব্যাটা পাঁড় নাস্তিক। (হারেরেরে! ধর ব্যাটারে। করবো কতল!)

শুনুন শুনুন। একটু শান্ত হোন। ভয় নাই, এপিক্যুরাস 'নাস্তিক' ছিলেন না। নঞ+আস্তিক = স্রষ্টার অস্তিত্বে না তিনি বলেননি। তাহলে কেমন গুব্লেট খেয়ে গেলো। দেখি চতুর-এপিক্যুরাস কী বললেন -
The gods are immortal and blessed and men who ascribe any additional qualities that are alien to immortality and blessedness are, according to Epicurus, impious.
আমরা সবাই ভাবি, ভালো কাজে পুরষ্কার আর খারাপ কাজে শাস্তি দিবেন স্রষ্টা(রা)। সব হিসেব রাখা হচ্ছে ডান কাঁধে, বাম কাঁধে। মরলেই বিচার অনিবার্য। এপিক্যুরাসের মতে, "স্রষ্টারা মর্ত্যের মানুষের কাজকর্ম খেয়াল রাখেন না। যে মানুষ সকলের জনমতে মেনে চলা স্রষ্টাকে অমান্য করে, সে অধার্মিক নয়। বরং সবাই মিলে স্রষ্টার যে গুণাগুণ চাপিয়ে দেয় সেগুলো যে মানুষ মানে, সে-ই অধার্মিক।"

হুমম, ভাবনায় পড়ে গেলেন। ভজে গেছে মন ভজন গানে, তারে কেমনে বুঝাবেন খোদার রূপ? আসুন একটু অবসর করে ভাবি। ভাবলে তো কেউ দোষ দিবে না। মারতেও আসবে না। এপিক্যুরাস খালি এমনি এমনি বললে কেউ মানবে কেন। তাই তিনি একটা যুক্তি দিলেন। নির্জলা যুক্তি। তাঁকে যদি খুব বেশি খারাপ না লাগে, তাহলে আরেকটা কথা বলছিলেন সেইটা বলতে পারি।
একটি পবিত্রতম ও অক্ষয় সত্ত্বার কোন ঝুটঝামেলা নাই, সেই সত্ত্বা অন্য কারো জন্য ঝামেলা তৈরি করে না; সুতরাং সে সকল ক্রোধ ও পক্ষপাত থেকে মুক্ত, কারণ ক্রোধ ও পক্ষপাত, দুর্বলতা।
আরেকটা যুক্তিও দিলেন ধাঁধার আড়ালে। ধাঁধাটার সরল সমাধান এখনও কেউ দিতে পারে নাই। আফসোস!
Is God willing to prevent evil, but not able?
Then he is not omnipotent.
Is he able, but not willing?
Then he is malevolent.
Is he both able and willing?
Then whence cometh evil?
Is he neither able nor willing?
Then why call him God?


বড়ো মুশকিল! বড়ো মুশকিল! যুক্তিতে চুকে যাচ্ছে চুক্তি! মর্ত্যের মানবের তরে এ কী আজব শর্ত!


এপিক্যুরাসের দর্শনের সবচেয়ে সুন্দর অবদান কী জানেন? তাঁর দর্শনের প্রবল প্রভাব আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে রয়ে গেছে। এপিক্যুরাসের মতে, সকল হিত ও অহিতের উৎস হলো সুখ ও যাতনার উদ্দীপনা (sensation)। আমরা যা কিছুতে সুখ পাই, সেগুলো ভালো, আর যা কিছুতে কষ্ট পাই, যা কিছু যন্ত্রণাময়, তা খারাপ।* ভালো খারাপের এই নীতিগত পার্থক্যের ব্যাপারে এপিক্যুরাস প্রথম বললেন। যদি কখনও কেউ সেধে যাতনা বেছে নেয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই যাতনার ফলশ্রুতিতে রয়েছে প্রচণ্ড সুখের সম্ভাবনা। এখানে অনেকে ভুল বুঝতে পারেন, এপিক্যুরাস হয়তো সুখের তাড়নায় যাচ্ছেতাই করার কথা বলেছেন। আসলে ঘটনা ভিন্ন। তিনি মূলত মানুষের যাতনাহীনতার তত্ত্ব-তালাশের কথা বলেছেন। জন্মের পর থেকে আমরা মূলত যাতনার লাঘব চাই। এই জন্ম এক নিরন্তর তাড়না, আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যাতনাহীন সুখের দিকে। সুখ আসলে যাতনার অ্যাবসেন্স। কষ্ট যতো কমে আসবে, ততো সুখের পরিমাণ বাড়বে। সদ্যজাত সন্তানের মুখ দেখে মা হেসে ফেলেন কেন? নাড়ী ছেঁড়া ব্যথাও তার কিচ্ছুটি মনে হয় না, কেন? ভাবুন তো!

এপিক্যুরাসের এই যাতনালাঘবের দর্শন জেনেছিলেন বিথাইনিয়া শহরের ডাক্তার অ্যাসক্লেপ্যেদিস। তিনি রোমে গিয়ে চালু করলেন সৌহার্দ্যপূর্ণ, সহানুভূতিশীল চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি। এর আগে মানসিক রোগীদের আটকে রাখা হতো, সামাজিকভাবে 'পতিত' করে রাখা হতো। অ্যাসক্লেপ্যেদিস এর অবসান ঘটালেন। তাদেরকে অন্যান্য রোগীদের মতো সেবা দেয়া শুরু করলেন। মানবিক থেরাপির গুণে কেউ কেউ অনেকটাই প্রকৃতস্থ হয়ে উঠলো! এই যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, যার কারনে এখনও ডাক্তারের হাসি দেখে আমরা ভরসা পাই, মারাত্মক অসুখেও সাহস হারাই না, তার কারণ এই অ্যাসক্লেপ্যেদিসের পদ্ধতি। তাঁকে সাইকোথেরাপি আর ফিজিকাল থেরাপির ডাক্তাররা কী সম্মান করেন, কাউকে পেলে জিগাইয়েন!
সেদিন থার্টি ফার্স্টের পরে গালগল্পে শুনলাম, বন্ধুদের পার্টির কথা। তরলের তোড়ে কয়েকজন ভেসে গেছে। অনভ্যাস বলি, বা অতি-পান, তাতে পরের দিন আর কারো গা-নড়ানোর উপায় নাই। হ্যাংওভার। কেন হলো? অতিরিক্ত পান। এখন ভাবুন তো, এমন ধারা হ্যাংওভার আর কখন কখন ঘটে। যখন আমরা অতিরিক্ত ঝাল খাই, অতিরিক্ত মিষ্টি খাই, (আর বাদ দেই কেন, যখন অতিরিক্ত পেট ঠেসে খাই), যখন শরীরকে অতিরিক্ত খাটাই, যথেচ্ছাচারে মাতি, তখন কেমন লাগে! যখন কাউকে ভালোবাসতে বাসতে আমাদের অবসেশন তৈরি হয়, কান্নাকাটি, অবসাদ, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যা পর্যন্তও গড়ায়। সবই এক ধরনের হ্যাংওভার - মানসিক - শারীরিক।

এই অমিত-সুখ ভালো নয়। এপিক্যুরাস খুব জোরেশোরেই এইটার প্রতিবাদ করেছিলেন।
No pleasure is a bad thing in itself, but the things which produce certain pleasures entail disturbances many times greater than the pleasures themselves.
তাহলে কোথায় সীমানা, কোথায় গিয়ে থামবো আমরা? কীভাবে বুঝবো এই সুখের খোঁজ এর পরে আমাদের যাতনার দিকেই নিয়ে যাবে? ইঙ্গিত আছে ওই এপিক্যুরাসেই।
Bodily pleasure does not increase when the pain of want has been removed; after that it only admits of variation. The limit of mental pleasure, however, is reached when we reflect on these bodily pleasures and their related emotions, which used to cause the mind the greatest alarms.
কামনার যাতনা চলে গেলেই শারীরিক সুখ বাড়ে না; বরং তা বিচিত্র দিকে যায়। তবে, যখন আমরা শারীরিক সুখ আর তার সাথে জড়ানো আবেগগুলোকে পুনরায় তুলে আনি, তখন আমরা মানসিক সুখের সীমানায় পৌঁছে যাই, এই আবেগগুলো আমাদের মনে এর আগে খুব সতর্কতা তৈরি করে দিতো।
শেষ করি মৃত্যু দিয়ে। হায় আমার প্রিয় টপিক। তোমাকে ছাড়া আমার সব কাজ অর্থহীন কারণ তুমি নিজেও অর্থহীন!

আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ মৃত্যুকে বালিশ কাঁথা বানিয়ে ফেলেছিলেন, মাঝে মাঝে উটের গ্রীবা। আমি সে'রকম ভাবতাম, মৃত্যুকে আটপৌরে বানাইলে আর ভয় লাগে না তেমন একটা। অভ্যস্ত ভয় খুব একটা চমকেও দেয় না! ধারণা বদলে গেলো কয়দিন পরে এপিক্যুরাসের দেখা পেয়ে।

মৃত্যু আমাদের কাছে কিচ্ছু না এমন একটা ধারণার সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠো, কারণ সব ভালো-খারাপ মূলত উদ্দীপনার মাঝে নিহিত। এবং মৃত্যু মানে সকল উদ্দীপনার নিরসন। সুতরাং সঠিকভাবে বুঝে নেয়া যে মৃত্যু আসলে আমাদের কাছে কিছুই না, এই বোধ আমাদের মরণশীল জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে, অসীম আয়ু যোগের মাধ্যমে না, বরঞ্চ অমরত্বের প্রতি কাঙ্ক্ষা দূর করার মাধ্যমে। সেই মানবের কাছে জীবনের কোনকিছুই দুঃসহ না, যে বুঝে গেছে যে বেঁচে না থাকার মাঝে কোন ভয়ঙ্কর কিছু নেই। একারণেই, যে মানব বলে যে, মৃত্যুর যাতনার জন্য নয় বরং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা যাতনাময় বলে সে মৃত্যুকে ভয় পায়, সে বোকা। যা এসে পৌঁছুলে আমাদের কোন সমস্যা হবে না, তার জন্য অপেক্ষা করা এক ধরনের অলস অপচিন্তা। তাই, মৃত্যু - ভয়ঙ্করতম ভয়ঙ্কর - আদতে আমাদের কাছে অর্থহীন, কারণ আমাদের অস্তিত্ব যতোক্ষণ, ততোক্ষণ মৃত্যু অনুপস্থিত, আর যখনই মৃত্যু আসবে, তখন আমরা থাকবো না। এই মৃত্যু জীবিত কিংবা মৃত সকলের কাছেই মূল্যহীন, কারণ জীবিতের জন্য এটা অবাস্তব, আর মৃতের নিজেরই কোন অস্তিত্ব নাই।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। এপিক্যুরাস " বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি"র উদ্ভাবক। তিনি না বললে, আমাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতির হয়তো আরো অনেক বছর লাগতো ঠিকঠাক কাঠামো দাঁড় করাতে! তাঁর জন্য অবিমিশ্র শ্রদ্ধা!


=0=


*এখানে এই তত্ত্বটি বিশদে বলা গেলো না। আগ্রহী যে কেউ এখানে কিছু আলোচনা পাবেন। আর নেট জুড়ে আরো অসংখ্য আলোচনা আছে, আমি যেগুলো ঠিকঠাক বর্ণনাও করতে পারবো না!