শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১১

গেরিলা দেখতে গিয়ে

নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ছবি ‘গেরিলা’ মুক্তি পেলো ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের দিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বানানো ছবি। গল্প নেয়া হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ থেকে। চিত্রনাট্যে উপন্যাসের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা পরিচালকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেও গল্প নেয়া হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পরে আমার ছবিটা দেখতে যেতে একটু দেরি হলো। প্রথম সপ্তাহে পারলাম না, দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝামাঝিতে একদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে গিয়ে টিকেট কাটলাম। এক সপ্তাহ আগেই ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ দেখেছি। পরপর অল্প ব্যবধানে দু’টা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি দেখা আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি ভালো মানের ছবি বানানো হয় নি। কারিগরি ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা একটা বড়ো কারণ। বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি আরেকটি বড়ো কারণ। এছাড়াও ছোটখাটো কিছু কারণ আছে। অন্যতম প্রধান কারণ আমার মতে মুক্তিযুদ্ধকে পরিবেশন করার ভঙ্গি। ছোটবেলা থেকে আমাদেরকে যে মুক্তিযুদ্ধ শেখানো হয়, যা আমরা বইপুস্তক থেকে শিখি, মিডিয়া দেখে জানি, এটা চরম বিরক্তিকর পরিবেশনা। ভাঙা রেকর্ডের মতো কিছু বুলি আওড়ে মুক্তিযুদ্ধকে বর্ণনা করা হয়। দিন-তারিখ, মৃতের সংখ্যা, পক্ষ-বিপক্ষ এগুলো নিরসভাবে বলে দেয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্থিরচিত্রগুলো সে তুলনায় অনেক বাঙ্ময়। ছবিগুলো কেবল কথা বলে না, যেন চিৎকার করে। স্থিরচিত্রের একটা বড়ো অংশ নির্যাতিত বাঙালির ছবি। ২৫ মার্চের কালরাতের গণহত্যা থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার ছবিগুলো বহুল প্রচারিত। বন্দুক কাঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি গুটিকতক দেখতে পাই, মিছিল-আন্দোলনের কিছু স্ন্যাপশট দেখতে পাই। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধের ছবি তোলার উপায় ছিলো না, কিংবা পাকিস্তানিদের ছবি, তাদের সরাসরি অত্যাচার করার ছবি বাস্তব কারণেই নেই। সরাসরি না দেখে, কেবল আফটার-ম্যাথ দেখে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছি। এবং শূন্যস্থানগুলোতে নিজ নিজ কল্পনার আশ্রয়ে বসিয়ে দিয়েছি পাকিস্তানি খুনী বা রাজাকার ধর্ষণকারীদের চেহারা। কর্মকাণ্ডগুলো হয়তো ভিনদেশি মুভি দেখে বসিয়েও নিতে পারি আমরা কেউ কেউ। কিন্তু মূল চিত্রের ধারে-কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা তাতে কম।

মনে রাখতে হবে, এটা পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা ঘটা যুদ্ধ, গিনেজ বুকের হিসাবে , উনবিংশ শতকের প্রথম পাঁচটি গণহত্যার মধ্যে বাংলাদেশের গণহত্যা একটি। সময়ের হিসাবে মাত্র নয় মাসে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। অংশ নিয়েছে পাকিস্তানের আর্মি, বাঙালি ও বিহারি সিভিলিয়ান রাজাকার। এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের বিচ্ছিন্ন এবং তাৎপর্যহীন চিত্র সিনেমায় দেখেছি। আমাদের মধ্যবিত্তীয় ও গড়পড়তা মননে প্রশ্ন জাগে নি কেন এই হত্যাকাণ্ড। এতো বড়ো গণহত্যা এতো কম সময়ে করার পিছনে নিশ্চয়ই বড়ো কোন উদ্দীপনা ছিল! খুব স্বাভাবিক এই প্রশ্নের কারণ অনুসন্ধান ঘটে না মুক্তিযুদ্ধের গল্প-কবিতা-সিনেমা-তে। সেই কারণ অনুসন্ধান দেখতে পেলাম গেরিলায়। গোলাগুলি, মৃত্যু, রক্ত, সিনেমাটিক দৃশ্যাবলী ও সংলাপ, গান, সব কিছু ছাপিয়ে সিনেমা-শেষের পরে আমার প্রাপ্তি হলো এই প্রশ্নের উত্তর! একটু পরে বলছি এ নিয়ে বিস্তারিত।

মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে রাজনৈতিক পটভূমি জরুরি। একাত্তরের রাজনীতিতে, সমসাময়িক পাকিস্তানি দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সক্রিয় ছিলো জামায়াতে ইসলামী। এই দলের অবস্থান স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে। পাকিস্তান-রক্ষাকল্পে তারা দৃঢ় বলীয়ান। শেখ মুজিব একজন দুষ্কৃতিকারী, দেশে গণ্ডগোল লাগাতে চায়। মুজিবের চ্যালা-চামুণ্ডারা হলো নাশকতাবাদী। পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রকারী। তাই এদের রুখতে দলে দলে জামাতে ইসলামীতে যোগ দিন, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিন। পাকিস্তান আর্মির হাত সবল করুন। এই সত্য-শ্লোগানগুলো এতোদিন সিনেমায় ঠারেঠুরে দেখানো হতো। যেন ভাশুরের নাম, সরাসরি মুখে নিতে নেই! নাসির উদ্দিন সেই পথে যান নি। ছবির প্রায় পুরোটা জুড়েই এরকম শ্লোগান লেখা ব্যানার চোখে পড়েছে। গলিতে গলিতে, স্টেশনে স্টেশনে,পাকিস্তানি ক্যাম্পে, স্কুল-কলেজের সামনেও এমন ব্যানার ঝুলতো। ঘরে ঘরে গিয়ে দাওয়াত দিতো শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানরা, এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে। এরা শান্তি কমিটিতে যোগ দিলে তাদের প্রভূত লাভ, গুপ্তচরবৃত্তিতে সুবিধা, লুঠতরাজেও সুবিধা। রাজাকার চরিত্রগুলো সর্বোচ্চ-সৎ অভিনয় দেখিয়েছেন। পরিচালকসহ এই সকল অভিনেতাকে ধন্যবাদ জানাই! অভিনয়ের দিক থেকে জয়া আহসানের অভিনয় সম্ভবত নিখুঁতের কাছাকাছি। এতোটা প্রাণবন্ত, এতোটা ‘ভিভিড’ অভিনয় আমি অনেকদিন দেখি না। বাংলাদেশের নায়িকাদের মধ্যে তো না-ই। যেখানে মেলোড্রামার অভিনয় আর ছলোছলো নির্যাতিত অবলা নারীর বাইরে বাংলা সিনেমার নায়িকাদের কিছু করার থাকে না এবং এটুকু মোটামুটি পারলেই আমরা বাহবা দিয়ে ভাসিয়ে দেই, সেখানে, সেই চর্চার জায়গায় জয়া আহসান একটা উল্লম্ফিত পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। সিনেমার আড়াই ঘন্টায় তার চরিত্রের যে প্রগ্রেশন, যেভাবে তার অনুভূতিগুলো বদলে বদলে যাচ্ছিলো, সেটা অভিনব। বিশেষ করে, ছবির শেষ আধাঘন্টার অভিনয় দেখার মতো, চমকে যাওয়ার মতো, পুরষ্কার দেয়ার মতো।

সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কিছুদিন সময় লাগে আমার ধাতস্থ হতে। সিনেমার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমি সততই খুব আশাবাদী, কারণ এই অডিও-ভিজুয়্যাল মিডিয়া আমাদেরকে এক অদ্ভুত বাস্তবতার জগতে নিয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় তা কেবলই নিছক কল্পনা, কিংবা নৈর্ব্যক্তিক শিল্প। মাঝে মাঝে এই সিনেমার জগত কেবল কল্পনার বাস্তবতা বা শিল্পের পট ছেড়ে আমাদের বাস্তব জগতে ছড়িয়ে পড়ে। ফিরে আসি ওই প্রশ্নের কথায়। নাসির উদ্দীনের সিনেমা গেরিলা এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। উত্তরটি সত্য ও সৎ উত্তর, একইসাথে প্রচণ্ড বাস্তব ঘনিষ্ঠও বটে। এতোটাই যে হতভম্ব ও বিস্মিত হয়ে গিয়েছি, ধাতস্থ হতে কিছুদিন সময় লেগেছে। আবছা আবছা ‘চেতনা’র ধারণা থেকে এক টানে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে অনেকগুলো ধোঁয়াশা। সিনেমা কতো শক্তিশালি হতে পারে, কতো গাঢ়ভাবে দার্শনিক হতে পারে, সেটার প্রমাণ পেলাম। প্রশ্নটি ছিলো, এই এতো অল্প সময়ে এতো ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটার কারণ কী? সাথে সম্পূরক প্রশ্ন হলো মুক্তিযুদ্ধের দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দেশ্য কী ছিলো? এই দুটো প্রশ্নের উত্তরে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও একটু থতমত খান। যুদ্ধ করার প্রকট উদ্দেশ্য (অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইত্যাদি) এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকট কারণ (বাঙালি-পাকিস্তান জাতিগত বিরোধ, লোভ ইত্যাদি) ছাপিয়ে প্রচ্ছন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ কারণটি কারো চোখে পড়ে না। মুখেও সরে না। মুক্তিযুদ্ধে এতো বড়ো হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় বারবার বলা হয়েছে এই “দুষ্কৃতিকারী”রা পাকিস্তানের শত্রু, ইসলামের শত্রু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ইসলামিক রাষ্ট্র ভাঙার পাঁয়তারা করছে। সাহায্য নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে, হিন্দুদের থেকে। বাঙালি হিন্দুদেরকেও মারা হয়েছে, তা তিনি যতোবড়ো গুণী ব্যক্তিই হন না কেন, মেরে রায়েরবাজারে ফেলে রাখা হয়েছে। ধর্মের পরিচয়ে এতো বড়ো হত্যাযজ্ঞ আর ঘটে নি।

এই উত্তর শুনে অনেকেই মাথা নাড়ছেন। বিরোধিতা করতে চাইছেন। দোষ আপনার নয়। আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে সামাজিক সকল প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে গেলে এই উত্তরটি এড়িয়ে যান। মুসলিম মুসলিম ভাই বলে একটা কথা খুব ফোটে আমাদের মুখে, সেটা একাত্তরের বর্ণনায় গিয়ে উচ্চারিত হয় না। খালি পাকিস্তানের খেলা থাকলে শুনতে পাই শ্লোগানের মতো। বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ধর্ম-রাজনীতির আফিম খেয়ে খেয়ে এখন আমরা এটাই মানি, এটাই জানি। নাসির উদ্দীন ইউসুফ সেই জানা ও মানার তোয়াক্কা করেন নি, সরাসরি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ কোরবানি দেয়া হয়েছে। গরু কোরবানির সময় যেমন আমরা গর্ত করি, মাঠে নিয়ে সেভাবে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের কোরবানি করা হয়েছে ইসলামের নামে। এই ইসলাম ‘প্রকৃত’ কী ‘স্খলিত’, ‘ঠিক’ কী ‘অন্যায়’ সেটা তখনও জরুরি ছিলো না, এখনও না। জরুরি হলো এই খুনিরা, তাদের খুনের বিচার। আমরা যদি এখনও এপোলোজেটিক হয়ে থাকি, ধর্ম-রাজনীতির ফাঁপা বুলিতে বিশ্বাস করে “ভাইয়ে ভাইয়ে ভুল করে মারামারি হয়ে গেছে” ভেবে “মরেই তো যাবে কয়েকদিন পরে” বলে এদেরকে ছেড়ে দেই, তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাংলাদেশ একদিন আবার পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠবে। ধর্মরাষ্ট্রের কুটিল ভোজালি এসে মানুষের গলা কাটবে। এগুলো কোন ‘ফিয়ার-পলিটিক্স’ না, এগুলো ‘এক তরফা দৃষ্টিভঙ্গি’ না। এই ভবিষ্যদ্বাণী অঙ্কের হিসাবের মতো সরল, অবশ্যম্ভাবী। যদি মানতে না চায় মন, গত মাসে আমিনীর হরতালের সময় বলা কথাগুলো স্মরণ করুন। “পানিবৎতরলং” হয়ে যাবে। নাসির উদ্দীন ইউসুফকে ধন্যবাদ। সৈয়দ শামসুল হককে ধন্যবাদ। কলাকুশলীদের ধন্যবাদ। গেরিলাকে ধন্যবাদ।

সিনেমা হল-এ আলো ফুটে উঠলে দেখলাম, আমার পাশে দুই বয়স্কা নারী শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছেন। চোখ মুছছেন। আমি তাদের দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমারও চোখ ভেজা। নিঃশব্দে দুয়েকফোঁটা অশ্রু না হয় পড়ুক তাঁদের জন্যে।

শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১১

ভুল

অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
এখন হুট করে ঘুম ভেঙে গেল
মনে হলো খুব অন্যায় কিছু করেছি
এমন কিছু করেছি, যা ঠিক হয় নি

যাদের মনে আঘাত দিয়েছিঃ দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী

যাদের কাছে মনে হয়েছে ভুল করেছিঃ শোধরাবার চেষ্টা করবো

না বুঝার চাইতে বড়ো স্খলন ভুল বুঝা


না-বুঝ নই বলে সেটা বুঝতে পেলাম

মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১১

জবাই

শান দেয়া ছুরিটা দুই হাতে শক্ত করে ধরতেই সুলতান মিয়ার শরীর একটু কেঁপে ওঠে। হালকা কাঁপুনি, দুই সেকেন্ডেই হারিয়ে যায়। আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করে সুলতান আরো শক্ত করে ধরে লম্বা বাঁকানো ছুরিটার বাট। বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। নামাজের ওয়াক্ত চলে গেছে। আজকে সারাদিন আকাশ মেঘলা বলে সূর্যের তেজ বুঝতে পারছে না সুলতান। ঘোলা ঘোলা মেঘের সাথে আজকে বেশ বাতাস ছুটেছে। গ্রামের মাঠে বাতাসের তোড়ে লুঙ্গি সামলানো কঠিন। সকালে দশটার দিকে মাঠে গিয়ে লুঙ্গি উড়ে যাচ্ছিলো তার। হঠাৎ দমকা বাতাসে পাছার কাপড় সরে গেলে এক পিচ্চি ফ্যাক করে হেসে দিছিলো। হাসি শুনে কটমট করে তার দিকে তাকায়ে সুলতান একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়ে। হুঙ্কারে কাজ হয়, পিচ্চি ভয়ে উল্টা দিকে দৌড় দেয়। সিকনি-পড়া নাক টেনে দৌড়ানোর সময় সুলতান দেখে, পিচ্চিটারও উদোম পাছা।

'যাকগে, গেছে গেছে, আর কেউ খেয়াল করে নাই, মানীর মান আল্লায় রাখে', ভেবে নজর ফেরায় মাঠের এক পাশে গাছগুলোর গোড়ায়। এখানে দুইটা শয়তানের পুত বেজন্মাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ বাঁধা আছে বেজন্মাগুলার, দুইটার মুখে রাইফেলের বাট দিয়ে শক্ত বাড়ি দেয়াতে দাত ভেঙে গেছে, ঠোঁট কেটে গেছে। রক্ত জমে কালসিটে পড়ে ফুলে আছে চেহারা, বোঝার উপায় নাই বেজন্মাগুলা আসলে দেখতে কেমন ছিলো। সুলতান দাঁতে দাঁত ঘষে। নালায়েকের দল। হিন্দু মালাউনদের সাথে হাত মিলানো কুত্তা এইগুলা। আজকে এইগুলারে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। কুরবানি দেয়া হবে সবার সামনে।

বাসায় ফিরে লুঙ্গি বদলে পায়জামা পাঞ্জাবি পড়ে নেয় সুলতান মিয়া। বাতাসের বেগ বিকালে আরো বাড়বে, রিস্ক নেয়া ঠিক না। উঠানে বসে ছুরিতে শান দিচ্ছিলো এক খাদেম। তাকে ডেকে এনে ছুরির শান পরীক্ষা করে সুলতান। বুড়া আঙুল ছোঁয়াতেই বুঝতে পারে, ধার মাশাল্লাহ দারুণ হয়েছে। এইসব কাজে ছুরি ভোঁতা হইলে খুব অসুবিধা। মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও সেটা মুখে প্রকাশ করে না সে। খাদেমকে গম্ভীর গলায় আরো ধার দিতে বলে। 'বালু মিশায় নে, ধার তাড়াতাড়ি হইবো'।

শান্তি কমিটির অফিস থেকে বাকিদের নিয়ে দুপুরের পরে মাঠে গিয়ে হাজির হয় সুলতান মিয়া। এতোক্ষণে অনেক মানুষ জমায়েত হয়ে গেছে। এদের সবার উদ্দেশ্য একটাই, সুলতান মিয়াকে দেখা। 'ভেড়ার দলের জন্যে ভালো লিডার লাগে, ভেড়ার দল হাতের মুঠির মধ্যে রাখতে হবে', ভাবে সে। গাছগুলোর সামনে দুইটা ছোট ছোট গর্ত খোঁড়া হয়েছে। এক হাত গভীর এবং এক বর্গহাত আকারের। এই বিষয়ে স্পষ্ট মাপ থাকা জরুরি। রক্ত যেন গড়ায় না পড়ে, রক্ত গড়ানো ভালো লক্ষণ না। খাদেমদের চোখের ইশারা করে সুলতান। প্রথম বেজন্মাটাকে ধরে আনতে বলে সে। পা ছেঁচড়ে নিয়ে আসে চারজন খাদেম। হাত পিছনে মুঠ করে বাঁধা, চোখ বাঁধা, গলা দিয়ে গ্যাঁগ্যাঁ শব্দ করছে শুয়োরের বাচ্চাটা। সুলতান একদলা থুতু ফেলে ওইটার মুখের ওপর। জমায়েতের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সুলতান জানে এখন এদেরকে ভয় দেখাতে হবে। কুরবানি কোন মশকরা না। এই বেজন্মাগুলার মতো আর কোন বেজন্মা যেন মাথা তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গলা উচু করে জমায়েতের দিকে স্থির চোখে তাকায় সে; বলে ওঠে, 'ইসলামের শত্রু, পাকিস্তানের শত্রু এই দালালরা। ইন্ডিয়ার ট্যাকা খায়া এখানে ব্রিজে বোমা ফেলছে এরা। পাকিস্তান ভাইঙ্গা দিতে চায় এরা। এগোরে কুরবানি দেয়া হবে এখন। সবাই হুঁশিয়ার!' চার জন খাদেম শক্ত করে চেপে ধরে শুয়োরটাকে। পায়জামাটা টেনে কাছে ঝুঁকে আসে সুলতান, ওইটার গলার চামড়াটা ফর্শা লাগছে। ছুরি শক্ত করে ধরে গলার চামড়ায় ছোঁয়ায়। 'ছুরির গোড়া থেকে আগার দিকে যাইতে হবে', 'এক টানে কাইটা ফেলতে হবে'। "আল্লাহু আকবর" বলে জোরে পোচ বসায় সুলতান মিয়া। গলার চামড়া ফ্যাট করে কেটে ছুরিটা ভিতরে ঢুকে যায়। মুহূর্তেই গরম রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসে। সুলতান দুই হাতে উষ্ণবোধ করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছুরিটা গেঁথে দিতে থাকে গলার ভিতরে। ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়...

চার জনে চার হাত-পা ধরে রাখায় ছুটাতে পারে না বেজন্মাটা। একটু দাপাদাপি করে। শান্ত হয়ে গেলে সুলতান খাদেমদের বলে 'শরীর উল্টায় দে। রক্ত ছিটা না পড়ে।'

'পরেরটারে ধইরা আন', হুকুম তামিল হতে সময় লাগে না। এটার স্বাস্থ্য একটু ভালো। পা ছুঁড়ে ছিটকে ফেলার চেষ্টা করে এইটা। সুলতান ধমক মারে, 'শক্ত কইরা ধর, ভাত খাস নাই নালায়েক!' গালিতে কাজ হয়, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক উৎসাহী খাদেমও এসে হাত লাগায়। পাঁচজনে মিলে ধরে বসে মোটা বেজন্মাটাকে। সুলতান ছুরিটা সরিয়ে বড়ো দা'টা হাতে নেয়। 'এইটারে দাও দিয়া কোরবানি দিতে হইবো', ভেবে একই নিয়মে বলে ওঠে, "আল্লাহু আকবর"। ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়...

দাপাদাপির চোটে একটা পা ছুটে যায়। শুকনো মাটিতে ক্রমাগত বাড়ি দিতে থাকে গোড়ালি দিয়ে। গর্তের চারপাশের ঘাসগুলো দ্রুত কালচে হয়ে ভিজে যেতে থাকে রক্তে। গরম উচ্ছ্বল রক্তে ভেসে যায় সুলতান মিয়া। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে দোয়া আওড়াতে থাকে সে। মিষ্টি বাতাস তার গায়ে প্রশান্তির আবেশ বইয়ে দেয়। কুরবানি সম্পন্ন। পেয়ারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ!



*****
- অনীক আন্দালিব
২৬/৪/১১
(দ্রঃ আজ ২৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর এক মাস। এখনও মনে পুষে রাখি। এখনও মনে রাখি। কারও বিচার হয় নি। এক জনেরও না! লেখাটির পিছনে সম্পূর্ণ কৃতজ্ঞতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ শামসুল হক ও 'গেরিলা' ছবির সাথে জড়িত সকল মানুষের।)

আপডেটঃ ৯ আগস্ট, ২০১৫
শান দেয়া চাপাতিটা দুই হাতে শক্ত করে ধরতেই সুলতান মিয়ার শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। হালকা কাঁপুনি, দুই সেকেন্ড। আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করে সুলতান আরও শক্ত করে ধরে চাপাতির  খাটো বাট। বেলা প্রায় তিনটা। জোহরের নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। সারাদিন আকাশ মেঘলা বলে সূর্যের তেজ বুঝতে পারছে না সুলতান। ঘোলা ঘোলা ছাইরঙা মেঘের সাথে আজকে বেশ বাতাসও ছুটেছে। গ্রামের মাঠে বাতাসের তোড়ে লুঙ্গি সামলানো কঠিন। সকালে দশটার দিকে মাঠে গিয়ে লুঙ্গি উড়ে যাচ্ছিলো তার। হঠাৎ দমকা বাতাসে পাছার কাপড় সরে গেলে এক পিচ্চি ফ্যাক করে হেসে দিয়েছিলো। হাসি শুনে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে সুলতান একটা চাপা হুঙ্কার ছেড়েছিল। হুঙ্কারে কাজ হলো, পিচ্চি ভয়ে উল্টা দিকে দৌড়ে পালালো। সিকনি-পড়া নাক টেনে দৌড়ানোর সময় সুলতান দেখে, পিচ্চিটারও উদোম পাছা।

যাকগে গেছে গেছে, আর কেউ খেয়াল করে নাই... মানীর মান আল্লায় রাখে, এই ভেবে সে নজর ফেরায় মাঠের এক পাশে গাছগুলোর গোড়ায়। এখানে দুইটা শয়তানের পুত বেজন্মাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ বাঁধা আছে বেজন্মাগুলার। সুলতান দেখলো দুইটার মুখে রাইফেলের বাট দিয়ে শক্ত বাড়ি দেয়াতে দাঁত ভেঙে গেছে, ঠোঁটও কেটে গেছে। রক্ত জমে জায়গায় জায়গায় কালশিটে পড়ে ফুলে আছে চেহারা, বোঝার উপায় নাই বেজন্মাগুলা আসলে দেখতে কেমন ছিলো। সুলতান দাঁতে দাঁত ঘষে। নালায়েকের দল। হিন্দু মালাউনদের সাথে হাত মিলানো কুত্তা এইগুলা। আজকে এইগুলারে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। জবাই করা হবে সবার সামনে।

বাসায় ফিরে লুঙ্গি বদলে পায়জামা পাঞ্জাবি পড়ে নেয় সুলতান মিয়া। বাতাসের বেগ বিকালে আরও বাড়তে পারে, ঝুঁকি নেয়া ঠিক না। উঠানে বসে চাপাতিটায় শান দিচ্ছিল খাদেম শহীদুল। সুলতান তাকে ডাক দেয়, সময় নিয়ে সাবধানে শান পরীক্ষা করে। বুড়ো আঙুল ছোঁয়াতেই বুঝতে পারে, ধার মাশাল্লা দারুণ হয়েছে। এইসব কাজে চাপাতি ভোঁতা হইলে খুব অসুবিধা। মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও সেটা মুখে প্রকাশ করে না সে। শহীদুলকে গম্ভীর গলায় আরও ধার দিতে বলে। 'বালু মিশায় নে, ধার তাড়াতাড়ি হইবো'।

বিকেল আরেকটু গড়িয়ে পড়লে শান্তি কমিটির অফিস থেকে বাকিদের নিয়ে মাঠে গিয়ে হাজির হয় সুলতান মিয়া। এতক্ষণে অনেক মানুষ জমায়েত হয়ে গেছে। সুলতানের মনে হয়, এদের সবার উদ্দেশ্য একটাই - এরা আমাকে দেখতে এখানে এসে হাজির হয়েছে। এরা বিভ্রান্ত। ভীতু। এরা বোকার হদ্দ। সঠিক পথ চেনে না। বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করে নাই। এরা জানে না চারপাশে কী হচ্ছে। কী করা উচিত একজন সাচ্চা মুসলমানের। তাই তারা আমার ভরসায় এখানে এসেছে। ভেড়ার দলের জন্যে ভালো লিডার লাগে, ভেড়ার দল হাতের মুঠির মধ্যে রাখতে হবে - ভাবে সে। গাছগুলোর সামনে দুইটা ছোট ছোট গর্ত খোঁড়া হয়েছে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে এক হাত করে এক হাত গভীর। এই বিষয়ে স্পষ্ট মাপ থাকা জরুরি। রক্ত যেন গড়ায় না পড়ে, রক্ত গড়ানো ভালো লক্ষণ না। শহীদুলকে চোখের ইশারা করে সুলতান। প্রথম বেজন্মাটাকে ধরে আনতে বলে সে। শহীদুলের সাথে হাত লাগায় সোবহান আর মুরশিদ। দুই হাত আর চুল ধরে বেজন্মাটার পা ছেঁচড়ে নিয়ে আসে তিনজন খাদেম। হাত পিছনে মুঠো করে বাঁধা, চোখ বাঁধা, গলা দিয়ে গাঁগাঁ শব্দ করছে শুয়োরের বাচ্চাটা। সুলতান এক দলা থুতু ফেলে ওইটার মুখের ওপর। জমায়েতের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সুলতান জানে এখন এদেরকে ভয় দেখাতে হবে। জবাই করা কোন মশকারি না। এই বেজন্মাগুলার মতো আর কোন বেজন্মা যেন মাথা তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মাথা উঁচু করে জমায়েতের দিকে স্থির চোখে তাকায় সে; গলা তুলে বলে ওঠে, 'ইসলামের শত্রু এই মালাউনের বাচ্চারা। ইন্ডিয়ার ট্যাকা খায়া এখানে ব্রিজে বোমা ফেলছে এরা। পাকিস্তান ভাইঙ্গা দিতে চায় এরা। এগোরে জবাই দেয়া হবে এখন। সবাই হুঁশিয়ার!' শহীদুল, সোবহান, আর মুরশিদ শক্ত করে চেপে ধরে শুয়োরটাকে। পায়জামাটা টেনে কাছে ঝুঁকে আসে সুলতান, সামনে গলার চামড়াটা ফর্শা লাগছে। চাপাতিটা শক্ত করে ধরে গলার চামড়ায় ছোঁয়ায়। 'চাপাতির গোড়া থেকে আগার দিকে যাইতে হবে'। 'এক পোঁচে কাইটা ফেলতে হবে'। "আল্লাহু আকবর" বলে জোরে পোঁচ বসায় সুলতান মিয়া। গলার চামড়া ফ্যাট্‌ করে কেটে চাপাতিটা ভিতরে ঢুকে যায়। মুহূর্তেই গরম রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসে। সুলতান দুই হাতে উষ্ণবোধ করে, বুড়ো আঙুল দুটো বাটে চেপে ধরে সে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেঁথে দিতে থাকে গলার ভিতরে। ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়...

তিন জনে হাত-পা ধরে রাখায় ছুটাতে পারে না বেজন্মাটা। পা ছোঁড়ার চেষ্টা করে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুক পেট উঁচু করে উঠে আসতে চায়। শহীদুল আর সোবহান চেপে ধরে রাখে। এক টানে গলা পুরো কাটে না। কিন্তু দ্বিতীয় টানের সময় ফড়াৎ করে গলার নালীটা ফেটে যায়। দাপাদাপি শান্ত হয়ে গেলে সুলতান খাদেমদের বলে 'শরীর উল্টায় দে। রক্ত ছিটা না পড়ে।'

'পরেরটারে ধইরা আন', হুকুম তামিল হতে সময় লাগে না। এটার স্বাস্থ্য একটু ভালো। পা ছুঁড়ে ছিটকে ফেলার চেষ্টা করে এইটাও। সুলতান ধমক মারে, 'শক্ত কইরা ধর, ভাত খাস নাই নালায়েক!' গালিতে কাজ হয়, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক উৎসাহী দর্শকও এসে হাত লাগায়। চার জনে মিলে ধরে বসে মোটা বেজন্মাটাকে। সুলতান তার রক্তে পিচ্ছিল হাত দুটো খবরের কাগজে মুছে বাটটা আবারও শক্ত করে ধরে। বলে ওঠে, "আল্লাহু আকবর"। ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়...


দাপাদাপির চোটে একটা পা ছুটে যায়। শুকনো মাটিতে ক্রমাগত বাড়ি দিতে থাকে গোড়ালি দিয়ে। গর্তের চারপাশের ঘাসগুলো দ্রুত কালচে হয়ে ভিজে যেতে থাকে। গরম স্রোতের মতো উচ্ছল রক্তে ভেসে যায় সুলতান মিয়া। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে দোয়া আওড়াতে থাকে সে। দমকা বাতাস তার গায়ে প্রশান্তির আবেশ বইয়ে দেয়। জবাই সম্পন্ন।

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১১

আমার বন্ধু রাশেদ

আমার বন্ধু রাশেদ একটি ভালো ছায়াছবি, মানে ফিল্ম। সিনেমাও বলা যায়। মোরশেদুল ইসলাম একজন ভালো পরিচালক। আমার বন্ধু রাশেদ বইটির লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন ভালো লেখক।

এই তিন লাইনেই আসলে শুক্রবারের সিনেমা-দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ফেলা যায়। কিন্তু তারপর আরো একটু বলতে গেলে আমি কিছুটা মুশকিলে পড়ি। বাক্য-বিন্যাস বা চিন্তা-প্রকাশের মুশকিল। অসুবিধা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় কৈশোর ও প্রথম যৌবনের আবেগ। বাস্তবতার ভিতর থেকে অতি সহজেই সিনেমার ভেতরে প্রবেশ করেছি, এখন সেই বাস্তবতার মাঝে ফেরত আসতে ইচ্ছা করে না। সিনেপ্লেক্সের প্রায়ান্ধকার হলরুমটিকেই বাস্তব বলে মনে হতে থাকে। আর সামনে ওয়াইড-স্ক্রিন সিনেমার পর্দাটিকে আয়না বলে ভ্রম হয়। যে রাজশাহী শহরটিকে সেখানে দেখি, শহরতলীর মতো শান্ত, নিবিড়, রিকশার টুংটাং; সেই শহরটিকে সত্য বলে মনে হয়। সত্য বলে মনে হয় শফিক ভাই, অরু আপা কিংবা আজরফ রাজাকারকেও।

সম্ভবত এখানেই সিনেমার মুনশিয়ানা। পরিচালকের একক-দর্শন ছাপিয়ে তা হাজারো দর্শকের মন ছুঁয়ে দিতে পারে, কখনো তাদের হাসায়, কখনো তাদের কাঁদায়, কখনো তারা উল্লাস করে সিনেম্যাটিক বাস্তবতার দৃশ্য দেখে। এই সবকিছুর এক ঝলক পেয়ে গেলাম শুক্রবার বিকেলে।

যখন শহর ছেড়ে চলে গেলো প্রদীপরা, ইবু যখন দেখা করতে গেলো ভোর ভোর বেলায়, প্রদীপ যখন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, "আজকে থেকে আমরা বাস্তুহারা। আমাদের আর কোনো ভিটামাটি থাকলো না। আর কোনোদিন তোর সাথে দেখা হবে কি না জানি না!", তখন অজান্তেই চোখে পানি এলো। যুদ্ধের দমফাটা আর্তনাদের পিছনেও কতো লক্ষ মানুষের ঘরহারানোর কষ্ট একা একা গুমরে মরেছে! কেউ শোনে নি, কেউ জানতেও পারে নি। ভোর ফোটার আগেই তারা কষ্টগুলো পোটলা বেঁধে রিকশায় করে চলে গেছে সীমান্তের ওপারে। যেতে যেতে পাকিস্তানির গুলিতে মরেছে, বেয়োনেটে মরেছে, ধর্ষণ হয়েও আত্মহত্যা করেছে কতো শতো হিন্দু নারী, কিশোরী। এগুলো দলিলে আসে না। খালি শর্মিলা বসুরা থিসিস করে আর মেহেরজানরা প্রেম করে!

তারপর যখন দেখি, রাশেদ শার্ট খুলে মুখ ঢেকে আজরফ রাজাকারকে ভয় দেখায়। দুই চ্যালা রাজাকার আজরফকে খবর দিতে আসছিলো। রাশেদ আগেই গিয়ে বললো, "মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে, তোমারে খুঁজতেছে", বলেই দ্রুত পালিয়ে গেলো। তখন আজরফের ভয় খাওয়া, পাতি রাজাকার দেখে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে পড়িমড়ি করে দৌড় দেয়া আর রাজাকাররা তাকে ধরে ফেললে হড়বড় করে বলতে থাকা, "আমি বঙ্গবন্ধুর লোক, আমি জয়বাংলার লোক, আমারে মাইরেন না", শুনে হল ভরে তালি বেজে উঠলো। মনে হলো আত্মীয়ের মাঝে আছি, নিরাপদ আছি। এই হলরুমের বাইরেই একটা গোষ্ঠী আছে, যারা বাংলাদেশ চায় নি। তারা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রী। দেশের অনেকখানি ক্ষমতা তাদের হাতে। সেই গোষ্ঠী একাত্তরের পরে "বঙ্গবন্ধুর লোক" হয়ে গিয়েছিলো চার বছরের জন্যে। আবার সময় এলে ঘাপটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সুবেশি এইসব রাজাকার ও রাজাকারমনা কেউ কি সেদিন হল-এ ছিলো? মনে হয় না।

আমার বন্ধু রাশেদ সিনেমা হিসেবে কেমন? এই বিচার কি আমি করতে পারি? মাঝে মাঝে কিছু সিনেমা নির্মিত হয়, যেগুলোকে সাদা চোখে বিচার করার ক্ষমতা দর্শকদের থাকে না। এর কারণ ছবিটির সাথে অনেক ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক আবেগ জড়িয়ে থাকে। এই আবেগ খারাপ কিছু নয়। আর বাংলাদেশিদের জন্যে এই আবেগ দুর্লভ হয়ে পড়ছে দিন দিন। আমরা এখন রিকনসিলিয়েশনের বাণী শুনি। মিরপুরে পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখি। এই মিরপুরেই রাশেদের মতো চোখ বেঁধে কতো মানুষকে মেরে ফেলেছিলো আজরফের মতো রাজাকাররা, সেটা ভুলে যাই। অতীতের ভুলচুক!

"You fooled us once, shame on you. You fooled us twice, shame on us." - এই আপ্তবাক্যটি ভুলে যেতে আমাদের বেশি সময় লাগে না। হয়তো রাশেদদের কথাও আমরা ভুলেই গেছি। এখন সেগুলো প্যানপ্যানানি হয়ে গেছে। আমি সিনেমা দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, পিছনে এক ছোট্ট বাবু মায়ের সাথে ছবি দেখতে এসেছে। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর-এ পড়ে। ছবির ফাঁকে ফাঁকে তার প্রশ্নগুলো শুনছিলাম।

কী নির্দোষ, কি সরলমনে সে জিজ্ঞাসা করছে, "ওরা কেন গুলি নিয়ে যাচ্ছে?"
- "যুদ্ধ করার জন্যে, মা।"

"ওদের অনেক সাহস?"
- "হ্যাঁ, মা।"

"রাশেদকে কেন বেঁধে রেখেছে?"
- "মেরে ফেলবে, মা"

"কেন?"
...
...এর পরে আর বাবুটির মা জবাব দেয় না। কেন রাশেদকে মেরে ফেললো, কেনই বা আমরা রাশেদদের কথা বারবার বলি না, সেটা ওই ছোট বাবুটা এখন বুঝবে না। কিন্তু একদিন বুঝবে, সেদিন হয়তো আমাদেরকেই দোষ দিবে। আমরা কেন রাশেদদের কথা মনে রাখি নি, শিখাই নি বলে।

মোরশেদুল ইসলামকে ধন্যবাদ, যে ছবিগুলো নির্মিত হওয়া দরকার, সেগুলোর মাঝে একটি ছবি এত আন্তরিকতা দিয়ে তৈরি করার জন্যে। যে বিষয়গুলো জরুরি, যে কথাগুলো না বললেই না, সেগুলো বলার মানুষ খুব বেশি নেই। এই উপন্যাসটি কিশোর বয়সে কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। আর এতো বছর পরে এই ছবিটি আবারও কাঁদালো, ভাবালো। আর কী চাই!
রাশেদ আর ইবুর চরিত্রের অভিনেতা দু'জন চমৎকার অভিনয় করেছেন। হয়তো পেশাদার নয় তারা, কিন্তু যে আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করেছে, সেটা খুব ভালো লেগেছে। পাশাপাশি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় (ইবুর বাবার চরিত্র) -এর গুজব নিয়ে কমিক রিলিফগুলো, কিংবা রাইসুল ইসলাম আসাদের (বড়ো বয়সের ইবু) স্মৃতিচারণের দৃশ্যগুলো মনে দাগ কেটে গেছে।
ছবির নির্মাণ বা কারিগরি দিকের বোদ্ধা আমি নই। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে সিনেমা কতো দ্রুত ও সহজে দর্শকের সাথে জুড়ে যেতে পারে, সেই বিচারে "আমার বন্ধু রাশেদ" অনেক এগিয়ে থাকবে। কিশোরদের জন্যে কিশোরদের অভিনীত ছবি সব-বয়সী দর্শকের চোখে জল আনছে, এই দৃশ্যটি চমৎকার। হল থেকে বেরিয়ে তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
এখনও সময় যায় নি, এখনও সব ফুরিয়ে যায় নি। টিমটিম করে হলেও আশার প্রদীপ জ্বলছে। বাংলাদেশের সকল কিশোর-কিশোরীর এই ছবিটি দেখা দরকার। তাহলে হয়তো আমরা এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারবো, যারা অশ্লীল পাকি-পতাকা নিয়ে অর্ধনগ্ন হয়ে 'খেলার নামে' পাকিস্তান পাকিস্তান জপবে না। যারা রাজাকারদের চিহ্নিত করতে পারবে - দলমত নির্বিশেষে। যারা বাংলাদেশের সঠিক জন্মেতিহাস জানবে। যারা এই দেশের নায়ক ও খলনায়কদের সত্য-পরিচয় জানবে। সেই দিন আসবেই।
রাশেদদের জন্যে রইলো অন্তরতর ভালোবাসা!