রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১১

ক্ষয়ে যাবার সূত্র

এই শহরে একলা হয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার। নিজের অজান্তেই, একদম হুট করে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মাঝে দুয়েক মুহূর্তের ফাঁক দিয়ে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাই, নিঃসঙ্গ ও নির্বন্ধু হয়ে যাই। ধীর পরিবর্তন যেমন সহসা নজরে পড়ে না, খুব খেয়াল না করলে টের পাওয়া যায় না, সেরকম পরিবর্তন এটা নয়। একলা হয়ে যাবার কোন গাণিতিক সমীকরণ নেই। আর এই বিষয়ে কোন গবেষণা চলছে বলেও খবর পাই না। তবে এই প্রক্রিয়াটি যে একেবারেই আকস্মিক এবং দ্রুত, সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। ভূমিকম্প বা বজ্রপাতের মতোই, আমরা একা হয়ে পড়ি। বরং বলা চলে, একাকীত্ব আমাদের ওপর সনখ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধারালো আঁচড়ে চারপাশের নিরাপদ বলয় ভেদ করে নখ-দাঁত বসিয়ে দেয় নিঃশব্দে। সেই নিঃশব্দ আঁচড় বুকের গভীরে নিয়ে হতবাক হই – একে অপরের সামনে মুখোশের মতো হাসি লটকে রাখি।

চায়ের বাজার জমে ওঠে বনানীর অলিগলিতে। এই অলিগলিগুলো রাশেদের ভালো লাগে। নম্বর দিয়ে রেখেছে মিউনিসিপ্যালিটি, কিন্তু সেগুলো সে মনে রাখতে পারে না। সে বনানীর অলিগলি দোকানপাট দিয়ে চিনে নেয়, মনে রাখে মোড়ের মার্কেটের পসরা দেখে। কোন রাস্তার খোয়া-ওঠা ছাল দেখে তাকে চিনতে পারে, রাস্তাটি তার দিকে ঘেয়ো কুকুরের করুণ চোখে তাকায়। রিকশায় ঝাঁকি খেতে খেতে তার সম্ভাষণে রাশেদ মাথা এমনিতেই ঝাঁকি খেতে থাকে। রিকশায় দেখা গেলো রাশেদকে, যার সঙ্গে এইমাত্র পরিচিত হলাম আমরা, সে তখন একা বসে আছে। রাশেদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। ধীরে ধীরে তাকে জানার চেষ্টা করবো আমরা। পেঁয়াজের পরতের মতো মানুষের ভেতর অজস্র পরত। সেই ভাঁজে ভাঁজে রাশেদ কেমন হয়ে উঠছে – খুব পাষণ্ড চণ্ডাল হয়ে উঠছে, নাকি খুব অমায়িক ভদ্র হয়ে উঠছে, সেটা জানতে চাইবো। একজন মানুষকে তো পুরোপুরি জানা যায় না, তারপরেও চারপাশ দেখে তাকে বুঝে ওঠা যায়। সে কেন কীভাবে কোথায় চলে যাচ্ছে, কী করে বেঁচে থাকছে, সেগুলোর দিকে বারবার আমরা অনুসন্ধানী ও লোভীর মতো দৃষ্টি ফেলবো। আর এর ফাঁকে ফাঁকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নেয়ার এক অপ্রকাশিত অন্তর্লীন চেষ্টা চালাতে থাকবো। মিলে গেলে গল্প পড়ার সময়টাই উসুল!

পরত পরত অপ্রকাশ্য অসংখ্য মানুষের মাঝ থেকে আমরা রাশেদকে তুলে আনি। হয়তো সে তেমন জরুরি কেউ নয়, সে খুবই সাধারণ, কিন্তু এইখানে এই গল্পে সে প্রধান হয়ে ওঠে। আর সেজন্যেই তাকে আমরা বনানীতে দেখি। বনানীর কোন এক নম্বরহীন গলিতে রিকশার ওপরে রাশেদকে দেখি। রিকশার চালকটি বুড়ো, নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতো শিরা-জেগে-ওঠা জরাগ্রস্ত হাতে রিকশা চালায় সে। বুড়োরা আস্তে ধীরে রিকশা টানে বলে খানা-খন্দগুলো বড়ো বেশি কোমরে লাগে, হাড়গুলো বাজতে থাকে ঝনঝন করে। রাশেদ রিকশার ওপরে বেশ সামলে বসে, কায়দা করে তাল সামলাতে হয় তাকে। রাস্তাটা রাশেদের বেহাল দশায় মজা পায় মনে হয়; যদিও রাস্তার এই অনাবশ্যক রূঢ়তার দিকে নজর দেয়ার সময় নেই ওর। রাশেদের হাতে শক্ত করে ধরা চিঠিগুলো আজকের মধ্যে ডিএইচএল-এ পাঠিয়ে দিতে হবে। সে হলদে-কমলা দোকানের সাইনবোর্ড খোঁজে, মনে মনে ভাবে, ‘এই রাস্তার পরেই বুঝি চোখে পড়বে’। দোকানটা প্রথমদিকে রাশেদ চিনতো না, নিয়ন তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। নিয়নের সাথেই প্রথম এসেছিলো ওখানে, “শোন, এইটা সস্তা কিছুটা। ফেডএক্স অনেক টাকা নিবে। তোর তো বেশ কয়েকটা প্যাকেট পাঠাতে হবে, তাই ডিএইচএল-ই ভালো,” বলতে বলতে নিয়ন ওই কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলো। রাশেদ সেই দোকানটাই এখন খুঁজছে। রিকশার পাশ দিয়ে শিসের মতো মোটর বাইক বেরিয়ে গেলো। চিন্তা-ভঙ্গ। নিয়নের চিন্তাটুকু রাশেদের মাথায় ক্রমশ জড়াতে থাকা সুতো হয়ে উঠছিলো, সেটা ছিঁড়ে গেলো। তখনই রিকশা ডানে মোড় নিয়ে একটু এগোতেই দোকানটা চোখে পড়লো তার।


কাজ সেরে বেরুনোর পরে রাশেদের বেশ খালি খালি লাগতে থাকে। চিঠি পাঠানোর পুরনো উত্তেজনা ফিরে আসে। যদিও এই চিঠিগুলো তেমন ব্যক্তিগত নয়, এগুলো কাগুজে সনদ – তার যাবতীয় পড়াশোনা আর অর্জনের ফিরিস্তি। এগুলো কীভাবে জমেছে, কীভাবে সে পেয়েছে, মাঝে মাঝে নিজেই ঠাহর করতে পারে না। সাদা কাগজে গোটা গোটা করে রাশেদুল হাসানের কৃতিত্ব বা ব্যর্থতার যে ফিরিস্তি সনদগুলো সোচ্চারে ঘোষণা করতে থাকে, সেটা চোখের সামনে রেখেও সে মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে পারে না। তার মনে হয় রাশেদুল হাসান নামের অন্য কোন মানুষের কথা বলছে। আদ্যোপান্ত গাঁজাখুরি বৃত্তান্ত মনে হতে থাকে। কখনো কখনো সে রীতিমত লুকিয়ে রাখে কাগজগুলো। নিজস্ব অর্জন বা ব্যর্থতা অনেক সময় মানুষের কাছে প্রকাণ্ড পাথরের মতো। বুকের ওপর ছোট ছোট মেডেলের ভার কীর্তির পাশাপাশি হয়তো অকৃতকার্যতার অনুভব দেয় হঠাৎ করেই। এই অনুভব খুব বিদঘুটে, মাঝে মাঝে মনে হয় বিচ্ছিন্ন ব্যাপার, নিতান্তই তুচ্ছ, কিংবা ভাবালুতাও বলা চলে। কারো কাছে রাশেদ এগুলোর কথা বলবে, সেই সুযোগ পায় না। এমন বিপন্নতায় তাই একলা লাগার অনুভব তার কাছে ফিরে ফিরে আসে। ডিএইচএল-এর দোকানের বাইরে ধুলোর মধ্যে জুতা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ ডানে বামে তাকিয়ে সে তাই রোদ দেখে, বৃক্ষহীন খোলা মাঠের আশেপাশে গুটিকয় কসরত করতে থাকা বড়োলোক দেখে।

বাইরে রোদের তোড় কমে এসেছে, শীত শীত বাতাস। হামা দেয়া বাচ্চার মতো টালমাটাল ভঙ্গিতে পড়ন্ত সেপ্টেম্বরে শীত এগিয়ে আসছে। এবারেও হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাবে শেষতক, এটা ভাবতে ভাবতে রাশেদ রাস্তার পাশ দিয়ে বাসার দিকে অথবা অন্য কোন দিকে হাঁটতে থাকে। দুঃখিত, আমি ঠিক বুঝতে পারি না, রাশেদের গতিবিধি আমার কাছে কিছুটা অপরিচিত এখনো। আপনার পাশাপাশি আমিও তাকে চিনে ও পড়ে নেয়ার চেষ্টা করছি, আর আপনার চেয়ে একটু এগিয়ে আছি কেবলমাত্র। কিন্তু রাশেদের সেগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই। অন্তত আমাকে বিভ্রান্ত না করেও সে গন্তব্য স্থির করতে পারতো। রাশেদের মাথায় হয়তো তখনও নিয়নের চেহারা জমাট বেঁধে ছিলো। ছিঁড়ে যাওয়া সুতোটা ল্যাতপ্যাত করছিলো মগজের কোন কুঠুরিতে। নিয়ন দেশ ছেড়ে যাবে যাবে করছিলো গত বছর। যাওয়া নিশ্চিত হবার পরে সময় পেয়েছিলো এক মাস, দৌড়াতে দৌড়াতেই সেটা পার হয়ে গেলো। শেষদিকে খুব বেশি দেখা হতো না তাদের। বিদেশে যাওয়ার এই চক্করের মাস ছয়েক আগে ওরা রুম ছেড়ে দিয়েছিলো। অহোরাত্রির সঙ্গী থেকে ব্যস্ত শহরে চাকরি ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে ওরা আলাদা হয়ে পড়ছিলো। এই বিমুক্তি এতোটাই স্বাভাবিক ও সন্তর্পণ, রাশেদ বা নিয়ন কেউই হয়তো অনুভব করে নি। তাই রুম ছেড়ে দেয়ার মাস-ছয়েক পরে নিয়নের বিদেশযাত্রার খবর এলে রাশেদ টের পেয়েছিলো দূরত্ব বেড়েছে অনেক। ঠিক তখন সময়টা এমন যে, ওর চলে যাওয়ার খবরে রাশেদও কেমন কাছিমের মতো গুটিয়ে গেলো, হাত-পা-মুখ সরিয়ে গর্তে ঢুকে পড়লো, ডুব দিলো সেলফোন বন্ধ করে। রাশেদ এটা প্রায়ই করে। কিন্তু ঠিক নিয়নের যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় ওদের দেখা হয়ে গেলো। এমনি হঠাৎ করে হয় নি। রাশেদই গিয়েছিলো দেখা করতে, তখন ব্যাগ বাঁধাছাঁদা করছিলো নিয়ন। খুব স্বাভাবিকভাবেই টুকটাক কথা হলো-

-“সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে ফেলেছিস?”
- “হ্যাঁ, চিঠি এসে গেছে। যাবার পরে আরো ডিটেইলে জানবো।”
- “কোন সমস্যা হয় নাই তো?”
- “নাহ্‌, সমস্যা আর কী হবে? দুনিয়া জুড়েই তো সমস্যা। ওখানে গিয়ে একটা রুমমেট জোগাড় করতে হবে। একা একা ভাড়া দিয়ে কুলাতে পারবো না।”
- “দেখিস, ফিরিঙ্গি দেশে দেখা জায়েজ, তবে ছুঁইলে পুলিশের চাইতে বেশি ঘা খাইতে হবে”, চোখ মটকে বলে রাশেদ।
সাথে সাথে নিয়নও হাজির-জবাব, “ছুঁইলে ঘা’ও হইয়া যাইতে পারে, হে হে হে!”

বিটকেলে হাসি আর তামাশার খড়ের মধ্যে রাশেদ কিছু একটা খুঁজছিলো। সুইয়ের মতো কিছু একটা বিঁধছিলো। এই কথাগুলো, কোন পুরনো নাটকের টুকরো টুকরো সংলাপ যেন, টান টান ছিলায় করে ছুঁড়ে দিচ্ছিলো তারা। কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে – সেটা জরুরি না। আবার লুফেও নিচ্ছিলো একজন আরেকজনের কথা। ঠিক যেন আগের মতো। যেন কিছুই হয় নি। যেন তাদের মাঝে কোন ঝগড়া হয় নি, কোন দূরত্ব নেই। ছিলার টানের মতো টান টান করেই যেন সুতোটা কেউ পাকাচ্ছিলো। রাশেদ টের পাচ্ছিলো, আরেকটু টানে সাঁ করে ছিঁড়ে যাবে। তারপরে দুই দিকে ছুটে যাবে সুতোর মুখ, গোল অন্তর্মুখী প্যাঁচে ভুলে যাবে বাকি অংশের কথা।

রাত একটায় ফ্লাইট। তাই রাতের খাবার খেয়ে নিয়ন আর নিয়নের বাবার সাথে রাশেদ একটা ট্যাক্সিতে চড়ে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে থাকে। সামনের সিটে রাশেদ, পেছনে ওরা দু’জন। মৃদুস্বরে একটু একটু করে উপদেশ দিচ্ছিলেন নিয়নের বাবা। বুড়ো ছাড়া নিয়নের পরিবারে আর তেমন কেউ নেই। রাশেদের সাথে যতদিন পরিচয় হয়েছে, নিয়নের মা ততদিনে ওপারে চলে গেছেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরাও দূরে দূরে, অন্য শহরে। এই একা একা নিয়নের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে রাশেদের খাতিরও হয়ে গেছে এক রুমে পড়ে যাবার পর। নিয়নের বাসায় যতবার গিয়েছে, মৃদুভাষী বাবার সাথে নিয়নের সম্পর্কটা উপভোগ করেছে। পিতাপুত্রের মাঝে যেন এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব; আংশিক লুকানো, আংশিক ব্যক্ত, অনেকটাই ভাসাভাসা যা এক বিকেলের দাওয়াতে ধরা পড়ে না। নিয়নের বাসায় আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গেলে যখন রাশেদ থেকে যেত, রাতের খাবারের পরে বাইরের কোলাহল থেমে যেত, তখন মন্থর সময়ে বুঝতে পারতো নিয়ন আর তার বাবার মধ্যে বন্ধনের গভীরতাটুকু এরকম শান্ত থির না হলে বোঝা যায় না। এই যেমন এখন, ট্যাক্সির ভেতরে নিয়নের বাবা মৃদুস্বরে নানা উপদেশ দিচ্ছেন। উপদেশের ফাঁকে হঠাৎ নীরব হয়ে যাচ্ছেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার কী একটা মনে পড়ে গেছে ভঙ্গিতে হয়তো বলছেন, ‘আচ্ছা শোন, গিয়ে রাতে ঘুমানোর আগে ওষুধগুলো খেতে ভুলবি না’, কিংবা ‘রাস্তা ঘাটে সাবধান থাকিস, অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু খাবি না’। এমন বাক্যগুলো মায়েদের বলার কথা, নিয়নের বাবা কী অবলীলায় বলে বসছেন। সামনের সিটে বসে রাশেদের মজা লাগে। পিছনে না তাকিয়েও সে নিয়নের নিশ্চুপ মাথা নাড়া দেখতে পাচ্ছে। নিয়ন চলে গেলে সবাই একই সাথে একা হয়ে যাবে।

জ্বলজ্বলে এয়ারপোর্ট অসামান্য রাতের আলোয় ঝাঁঝাঁ করছে। নিয়ন ক্লিয়ারেন্সের জন্যে এগিয়ে গেলে রাশেদ আর ওর বাবা বাইরে জায়গা খুঁজে বসে পড়ে। প্লেন ছাড়তে এখনো ঘণ্টা দেড়েক বাকি। রাশেদের উল্টোদিকে জবুথবু নিয়নের বাবাকে বুড়োটে লাগে। এতো জ্বলজ্বলে আলোতে কি আমাদের চামড়ার ওপরের মুখোশটা খসে পড়ে? ভেতরের রূপ আর দুর্বলতা অবধি চোখ পিছলে চলে যায়? এয়ারপোর্টের চকচকে কাচের দেয়ালের ওপাশে ঝাপসা হতে থাকে নিয়ন। এতো সারি সারি কাচ দেয়া চারিদিকে। মানুষের নিঃশ্বাসে সেগুলো হয়তো প্রায়ই ঝাপসা হয়ে ওঠে। এখানে অনেক অশ্রু জমে আছে। নিয়ন যাবার আগে একটা মুচকি হাসি দিয়েছে। তারপর চলে গেছে হনহন করে ক্যারি-অন টানতে টানতে। এখানে তিনজনের মাঝে ওই সবচেয়ে বাস্তববাদী। কাঁদে না। আবেগে ভেসে যায় না। রাশেদ জানে- ও অনেকদূর অবধি যাবে, নিয়নের বাবাও জানেন সেটা। আমরাও হয়তো বুঝতে পারি। দেশ ছেড়ে যারা যায় তারা কেউই অবাস্তব চিন্তায় যায় না। নিয়নের প্লেন ছেড়ে দেয়ার নোটিশ ওপরের বোর্ডে অনেকক্ষণ ঝুলে থাকলো। তারপর আরো কিছুটা সময় নিয়নের বাবা জবুথবু বসে রইলেন। রাশেদ দেখলো ঘড়িতে রাত ক্রমশ ডানে-বামে হেলে পড়ছে নিদ্রায় ঢুলুঢুলু চোখে। ওর বাবাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাশেদ চলে এসেছিলো।

নিয়ন চলে যাবার পর ওর বাবার সাথে রাশেদের একদমই দেখা হয় নি। দেখা করার সামাজিকতা কখনো ছিলো না অথবা দেখা করার তাড়না অনুভব করে নি অথবা দেখা করার অস্বস্তি ও কথা বলার বিড়ম্বনা নিতে চায় নি রাশেদ। যেহেতু আমরা রাশেদকে পুরোপুরি চিনতে পারবো না, সেহেতু দেখা না করার কারণও আমরা নিশ্চিত করে জানতে পারবো না। নিয়নের সাথেও তার যোগাযোগের মাত্রা কমে গেছে ধীরে ধীরে। অনুপস্থিতি এরকম ঘটায়, অনলাইনে বসেও তাই রাশেদ ও নিয়ন কথা বলে না। সহসা নক্‌ করে না একে অপরকে। অনেকদিন পরপর হয়তো টুকটাক কথা হয়, সেগুলো খোলামকুচির মতো উড়ে যায় অল্পেই। নিয়ন অনেক ব্যস্ত থাকে বলে বেশিক্ষণ কথাও হয় না। রাশেদ একসময় বুঝতে পারে ওদের জীবন ধীরে ধীরে দূরবর্তী ল্যাম্পপোস্টের মত দূরে সরে গেছে। হয়তো সেজন্যই রাশেদ এখন উতলা হচ্ছে। হয়তো সেজন্যই সে বাইরে চলে যেতে চাইছে। পরিচিত জগতের জীবন পরিচিতদের ছাড়া দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই জীবনটাকেই পাল্টে ফেলতে চাইছে সে।


তারপর একদিন খবর এলো, নিয়ন পৃথিবীর উল্টো পিঠে এক দুর্দান্ত শহর থেকে সাঁ সাঁ করে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। রাতে কোথাও পার্টি ছিল হয়তো, ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসেই। পার্টি থেকে বেরিয়ে হয়তো প্ল্যান হয়েছিলো কোন রোড-ট্রিপে যাবার। হোস্টেলে ফেরার ইচ্ছা কারোই ছিল না। সেই গাড়িতে তার সাথে আরো দুইজন বন্ধুবান্ধব ছিলো। দুয়েকটা মদের বোতলও ছিলো হয়তো; আর গাড়ির বাইরে ছিলো আদিগন্ত বিস্তৃত রাত। রাতের অন্ধকার বুঝি গাড়ির ভিতরেও প্রবেশ করেছিলো কিছুটা। রাশেদ কল্পনা করতে পারে, এমনটাই ঘটে থাকবে, এমনটাই ঘটেছিলো। সেই অন্ধকারের কারণে নিয়নকে নিয়ে সুউচ্চ খাদ থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেছে গাড়িটা। এমন বিদঘুটে আর দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো নিয়নের লাশ, সনাক্ত করার জন্যে প্যান্টের পকেটে রাখা আইডি কার্ডটাই ভরসা হলো। রাতে তাকে যারা পার্টিতে দেখেছিলো, তারাও পোশাক দেখে সম্মতিই জানিয়েছে। এই সব কথা আর খবর রাশেদ নিজে পেয়েছে আরো তিন-চার দিন পর। নিয়নের বাবার সাথে তার দেখা করার কারণ যে নিয়নের মৃত্যু হয়ে উঠলো, সেই চিন্তায় রাশেদ মাঝেমাঝে ফ্যাক করে হেসে ওঠে।
দ্রষ্টব্যের মতো আমরা আরো জানতে পারি যে নিয়নের দ্রুতগতির গাড়ি যখন গ্লোব ছিটকে খাদে ঢুকে পড়ছিলো, তখন পৃথিবীর এই পিঠে আমাদের আধা-পরিচিত রাশেদ কর্মজ-চিঠিগুলো নিয়ে বনানীতে অলি-গলি খুঁজে মরছিল। এই শহরে ঘনবসতি, এই শহরে কোন খাদ নেই, অনিয়ন্ত্রণ গাড়ি চালানোর ধু ধু সড়কও নেই!

সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১১

এই লেখাটা কেবল আমার জন্যে

এড়িয়ে যাচ্ছি বৃষ্টিপ্রবণ আবহাওয়া, দৃষ্টির সীমানায় সহসা
দেখছি মানুষের মুখ - শ্বাপদস্বরূপ; দাঁত - আক্রোশের আঘাত।

তার নখমূলে অনির্ণেয় লেগে আছে ছিঁড়ে আনা ত্বক, রক্ত,
উপড়ে আনা নিউরনে দেখি থরথর করছে দুয়েকটা স্মৃতি...

শৈশবের বেণী,

শিউলিতলার শুঁয়োপোকাটি,

ঘুমঘুম হিম স্কুলবেলা

কলতলার শ্যাওলা সবুজ

দেখছি কতো অজস্র মানুষের লালাভ ঠোঁটে
অপরূপ
প্রসাধনীর মতো
চিত্রিত সুন্দর
দু'টি হাত
দলা দলা উরুর মাংশ,
গোড়ালির শিরা

দেখি অশ্রু টলোমল থেবড়ে গ্যাছে চোখের কোলে

তালিকা করছি হারানো বিজ্ঞপ্তি,

তার মুখে
মেয়েটির মুখ, কাঁদছে কেন


দ্রষ্টব্য এই যে কিশোর বয়সে দু-চারজন পাণ্ডা হুমকি দিয়েছিল অজানা কারণে

জরুরি এই না-বলা স্মৃতির সিন্দুকে
দ্যাখো নিরীহ কিশোর হুমকি ধমকে মানে নি

তাই দ্যাখো সে মাটিতে পেরেক দিয়ে গাঁথা
তাই তুমি চিৎকার করতে পারো না নিরীহ কিশোর
তাই তোমাকে ধরে বেঁধে চড় মারে কেউ একজন
তাই তোমার মুখে তারা ন্যাকড়া গুঁজে দেয় আর চেপে ধরে
তাই তোমাকে বেল্ট খুলে মারে কেউ একজন
তাই তুমি টের পাও হাজার মানুষ মিলে তোমাকে ছিঁড়ে ফেলছে পুরানো খবরের কাগজের মত
তাই তোমার নিঃশব্দ চিৎকারে গলা ভেঙে যায়
তাই তোমার চোখ দিয়ে নিষ্ফল অশ্রু ঝরে
তাই তুমি জ্ঞান হারাতে গিয়েও হারাও না
তাই তারা অট্টহাসি হাসে তোমাকে উলঙ্গ করে
তাই তুমি টের পাও তোমার কোমরের নিচে কোন বোধ নাই
তাই তুমি বিস্ফোরিত হয় নক্ষত্রের মতো



We are all nothing but stardust!

আমি তোমাকে মিস করি। প্রায় রাতেই আমি তোমার মুখ দেখি। আমি তা কাউকে বলি না। এই অনুভূতি আমি কোথায় নিয়ে যাব? কাকে শোনাবো? আমি তোমাকে মিস করি। আমি রোজ সকালে ঘুম ভেঙে তোমার চোখ দেখতে পাই। আমি চোখ মুছি, সবাই ভাবে ঘুমের চোখে ময়লা হয়তো। আমি মাঝে মাঝে একা একাই কেঁপে উঠি। কান্নাটুকু পাচার করে দিই। তুমি নেই। এই কান্নাটুকু তোমার জন্য। তুমি আর কখনই আসবে না এখানে। তোমার মৃত্যুর কথা কেউ জানে নি। আমি জানি। তাই আমি তোমাকে মিস করি। আমার মৃত্যুর পরে তুমি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। ভেবে ভাল লাগে। তুমি আর আমি এই পৃথিবীর বাইরে আরেক পৃথিবীতে দেখা করবো। আমি তোমাকে দেখে ঠিক চিনে ফেলবো এতো বছর পরেও। তুমি হয়তো আমাকে চিনবে না। তুমি তো অনেক আগেই চলে গেছো। আমি হেসে দিয়ে তোমার পেরেকগাঁথা হাত দুটো ধরবো। আঘাতে হাত বুলিয়ে দিব আলতো করে। তুমি হয়তো বুঝে ফেলবে আমি কে। ক্ষতি নেই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবে। আমরা কোন কথা বলবো না...

বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১

মনে হয় করতলে আছি...

রেখেছি বিমূঢ় শোক - পুরে মুঠোর ভিতর
প্রায় দু'মাস, এতদিনে এই শোকটুকু,
ফোঁটায় ফোঁটায় জমে ওঠা স্থিরচঞ্চল জল
হয়ে গেছে, মুঠোবন্দী করে রেখেছি, স্পর্শে
টের পাচ্ছি কোমল শোকের স্পন্দন - করতলে
নানাস্থানে যাই, কারো সাথে পরিচিত হলে
বিব্রতবোধ করে মুঠোহাত এগিয়ে দেই,
হাত মেলানোর প্রথাপালন দুষ্কর হয়ে পড়ে,
ব্যক্তিগত শোকের খবর কেন সদ্যপরিচিতকে দিব?
দৌড়ুতে দৌড়ুতে বাসে উঠি, সাবধানে
আমার কলার মুঠো পাকড়ে টেনে তোলে
কনডাক্টরের শক্ত বলীয়ান হাত - সে'যাত্রা বেঁচে যাই
ভাগ্যিস মুঠো খুলে শোকাংশ বিলিয়ে দেই নি বাসের হাতলে
বাসায় ফিরলে জামা খুলতে কষ্ট হয়, এক হাতে কষ্টেসৃষ্টে
খুলে নিতে পারি শার্টঃ বহিরাঙ্গের ধুলো ও কয়লা,
ঘরের মানুষেরা কিছু বলে না, মেনে নেয়
মুঠো করা হাত দেখে কিছুটা মূক ও অপরিচিত বনে যায়
এভাবে শোকের পালন এ'জনপদে বিরল
অনেকেই আগ্রহী হন, কৌতূহলে বেড়ালের মত
গা ঘেঁষে আসেন। হে একান্ত শোক আমার!
অজান্তেই আমাকে বিখ্যাত করে তুলছো,
আমি কৃতজ্ঞ আমি নতজানু তোমার সাহচর্যে,
অনেকের কাছে আমি আরাধ্য হয়ে উঠছি
মাঝে মাঝে তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুঠোর ঘ্রাণ নেই
গা শিউরে ওঠে এই অতলান্ত শোকস্পর্শে
বুঝিবা আমার হাতটুকু ধীরে ধীরে অবাস্তব হয়ে গেছে
কিংবা শোকটুকু মিলিয়ে গেছে বাষ্প হয়ে -
অ নে ক আ গে ই
আমি ভুলেভালে মুঠো বন্ধ করে ভ্রমে বুঁদ
শিওর হতে পারি না, ডিলেমার কর্কট ক্রমশ
মুঠোগামী আমি ভয়ে তাড়িয়ে দেই তাকে,
"ভাগ্‌ শালা জোচ্চর কনফিউশন, ভাগ্‌ এবেলা!
জারিজুরি করে শোকে ভাগ বসাবি,
জানি তোর দুরভিসন্ধির অলিগলি!"
প্রায়ই ভাবি এ'দুঃসহ ভার ফেলে দিব আজই
মুঠো খুলে ধুয়ে নিব কলের শীতল জলে
হাত মেলে দেখব কোন শোকের ছায়াও নেই
মনে হবে পুরোটাই মনের মস্ত এক ভুল ছিল
মনে হবে পৃথিবীতে আমার কোন শোক ছিল না
তারপর মনে হবে হয়তো ছিল কিছু কোনও এক কালে
ভুলে গেছি সেইসব একান্ত ব্যক্তিগত শোক
খামাখাই কবরের মতো স্মৃতিচিহ্নের দরকার নেই বলে
এই হাতটি নতুন পেয়েছি বলে মনে হবে আমার
তারপর পুরনো আটপৌরে হাত, সেই বন্ধ করা মুঠো
ও শোকসন্তপ্ত করতলের শোকে আমি আবারও মুঠো বন্ধ করে ফেলবো...



৩০ মে, '১১