শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আসেন সমকামিতা নিয়ে মতামতগুলো ভাঙি তো!

ভূমিকাঃ
প্রতিটা জিনিসের পিছনে নির্দিষ্ট ও ব্যাখ্যাকৃত কারণ আছে। কার্যকারণ ছাড়া কোনকিছু ঘটে না। আমরা ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাই সেই কারণগুলো বের করার। কারণ না পেলে সাধারণ প্রবণতা হলো সেটাকে 'অলৌকিক', 'অতিপ্রাকৃতিক', 'অশরীরী', 'কুদরত' ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করে মূল প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া। এই প্রবণতা বুদ্ধিনষ্টকারী, চিন্তাহানিকারক। তাই সর্বদা পরিত্যাজ্য। সম্প্রতি সমকামিতা নিয়ে চতুর্মাত্রিকের একটা পোস্টে ও কমেন্টে উঠে এলো নানা দিক। নানা প্রচলিত ধারণা যা হয়তো ভুল, কিংবা অমীমাংসিত, সেগুলো বিস্তারিত বলার জন্য এই পোস্ট। এই লেখার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অভিজিৎ রায়ের লেখা 'সমকামিতা' গ্রন্থটির (প্রকাশক - শুদ্ধস্বর, ২০১০)। বইমেলায় আগ্রহীরা পাবেন, মুক্ত-মনা ব্লগেও সম্ভবত অনলাইনে আছে, খুঁজে দেখুন। আমি চেষ্টা করছি যথাসম্ভব সরল ভাষায় বৈজ্ঞানিক গবেষণাপ্রাপ্ত বিষয়গুলো উপস্থাপন করার। আমার আলোচনার কেন্দ্রে জেনেটিকস। পাশাপাশি আসবে পরিবেশ, কারণ জিন একা কাজ করে না, পরিবেশের প্রভাবে তার অন-অফ ঘটে থাকে।
যারা একটু বড়ো পোস্ট পড়তে চান না, তাদের জন্য সারসংক্ষেপ শুরুতেইঃ

ক. সমকামিতা মানসিক বা শারীরিক রোগ না।
খ. সমকামিতা এক ধরণের যৌনপ্রবৃত্তি, যা প্রতিটি মানব জনগোষ্ঠীতে দশ জনে এক জনের মাঝে থাকে (প্রকাশ্য বা গোপন)। এই প্রবণতা কম বেশি আমাদের সবার মাঝেও আছে, বিষমকামীদের প্রকট প্রবণতা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, কিন্তু কেউই ১০০ভাগ বিষমকামী বা ১০০ভাগ সমকামী নয়।
গ. সমকামিতা একটা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য (প্রকরণ বা ভ্যারিয়েশন) বলে মীমাংসিত হয় নি। গবেষণা চলছে। এটি জেনেটিক রোগও না।
এবারে বিস্তারিত আলাপঃ
মানুষ মস্তিষ্ক দিয়ে চলে। আমাদের সকল অনুভূতি এই মগজ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। সমকামিতা নিয়ে যে চিন্তা সেটাও আমরা মগজ দিয়ে করি। তো, সমকামিতা নিয়ে আমাদের মগজে আসা মতামতগুলোর ক্যাটাগরি করি -
১। ইহা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, বিবর্তনের ফলাফল।
২। ইহা জেনেটিক সমস্যা/রোগ, বিবর্তনের ফলাফল (মিউটেশন) তবে নিরাময় সম্ভব।
৩। ইহা জেনেটিক কিছু না। সমাজ বা পরিবেশের প্রভাবে ঘটে।
৪। ইহা জেনেটিকও না, সমাজের প্রভাবেও ঘটে না। সম্পূর্ণ নিজস্ব চয়েসে যে কেউ সমকামী হতে পারে।
শেষেরটির ব্যাপারে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা সম্ভব না। কারণ যদি সমকামিতা একটি ব্যক্তিগত চয়েস হয়ে থাকে, তাহলে হাজার উপাত্ত বিশ্লেষণ করেও একজন মানুষের ওরিয়েন্টেশন নির্ধারণ সম্ভব নয়। এবং কোন সিদ্ধান্তে আসাও সম্ভব নয়, বিধায় এটা আলোচনার বাইরে থাকবে।
১. ইহা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, বিবর্তনের ফলাফলঃ
১.১ সমকামী মানুষের মগজ বিপরীত লিঙ্গের মত কাজ করে, তাই তারা সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়ঃ
এই গবেষণায় মগজের যে জায়গাটা আলোচনায় আসে, সেটার নাম হাইপোথ্যালামাস। এই অঞ্চলটা মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। হাইপোথ্যালামাস বিশাল এলাকা, সেই এলাকাতেও নির্দিষ্ট করে খুঁজলে পাওয়া যায় INAH নামের এলাকা, ইন্টারস্টিশিয়াল নিউক্লিই অফ দ্যা অ্যান্টেরিওর হাইপোথ্যালামাস। আশির দশকে পাওয়া গেল - এই INAH এলাকার নিউক্লিয়াসের মধ্যে ৩ নম্বরটা (INAH3) ছেলেদের মধ্যে মেয়েদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড়। দেখা গেল, সমকামী পুরুষদের INAH3 বিষমকামী মেয়েদের সমান।
এটা পেয়ে একটা প্রচলিত স্টেরিওটাইপিং বেশ বাতাস পেয়ে গেল। সেটা হলো 'সমকামী পুরুষদের মধ্যে মেয়েলিভাব বেশি' 'A female spirit in a male body'। কিন্তু পুরো বাতাস পাওয়ার আগে আরেকটা পর্যবেক্ষণ এসে সেই ধারণাকে ভণ্ডুল করে দিল। হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রাকিয়াস্ম্যাটিক নিউক্লিয়াস (SCN Nucleus) এলাকাটা ছেলেদের ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে আকারে বড়ো থাকে। উপরের হিসাব অনুযায়ী সমকামী ছেলেদের এই এলাকা মেয়েদের সমান হওয়ার কথা, কিন্তু দেখা গেল তাদের মগজে এটার আকার বিষমকামী ছেলে, মেয়ে সবার চাইতেই আকারে অনেক বড়।
এই পুরো গবেষণায়, মেয়ে সমকামীদের মগজে কোন প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায় নাই। সুতরাং এই ধারণাটা আর ধোপে টিকলো না।
১.২ সমকামীদের এক বিশেষ জিনের কারণে তারা সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়ঃ
সোজা বাংলায় গে জিন। গে জিন থাকলে মানুষ গে হয়, লেসবিয়ান হয়। গে জিন না থাকলে হয় না। এই ধারণাটি পরখ করতে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। মূলত দুইটা ফিল্ডে কাজ হচ্ছে। একটা হলো পারিবারিক ইতিহাস দেখা, লিনিয়েজে সমকামী থাকা/না-থাকা'র কারণে উত্তরবংশে সমকামী হওয়া/না-হওয়ার পরিসংখ্যান। দেখা হচ্ছে জমজদের মধ্যে (আইডেন্টিকাল ও ফ্র্যাটার্নাল) একজন সমকামী হলে অন্যজনের সমকামী হবার সম্ভাবনা কত। এই গবেষণায় যেটা বেরিয়ে এসেছে, সেটা হলো মায়ের দিক থেকে এই প্রবণতা প্রবাহিত হয়। সেক্স ক্রোমোজোম (ছেলেদের বেলায় X ও Y, এক্স দেয় মা, ওয়াই দেয় বাবা; মেয়েদের বেলায় X ও X, এক্স দেয় মা, অন্য এক্স দেয় বাবা) দুটার মধ্যে এক্স ক্রমোজোমের মাধ্যমে এটি আসে। যেহেতু মেয়েদের বেলায় দুটাই এক্স, সেহেতু বুঝাই যায় যে ওয়াই ক্রোমোজোম এটাকে বহন করলে দুনিয়াতে কোন মেয়ে সমকামী থাকতো না। এখন খুঁজতে হবে যে এক্স ক্রোমোজোমের কোন জিন বা জিনগুলো এই বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দেয়।
১৯৯৩ সালে ডিন হ্যামার এই গবেষণা করেছিলেন, তার উপাত্ত ছিল ৪০ জন সমকামী, যাদের ৩৩ জনের এক্স ক্রোমোজোমের প্রান্তসীমায় Xq28 নামক জায়গা পাওয়া গেল। এই মার্কারটা বিষমকামীদের মধ্যে নাই। বাকি ৭ জন সমকামীর মধ্যেও নাই। তাই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো না। তবে এটা একটা সিগনিফিক্যান্ট ডাটা। বলা যেতে পারে যে সমকামিতার প্রবণতায় Xq28 অত্যাবশ্যকীয় জিন না, তবে এর প্রভাবে সমকামিতা ত্বরান্বিত হয়, প্রভাবিত হয়। ডিন হ্যামারের বয়ানে-
এই অংশটির দৈর্ঘ্যে চার মিলিয়ন বেইজপেয়ারের সমান, যা সমগ্র জিনোমের শতকরা ০.২ ভাগের চাইতেও ছোট। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই অংশে অবলীলায় কয়েকশ জিন এঁটে যেতে পারে। এই এলাকায় সমকামিতার নিয়ামক জিন খুঁজে বের করা অনেকটা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতোই। হয় আরো বেশি স্যাম্পল নিয়ে কাজ করতে হবে, নয়তো সম্ভাব্য সকল এলাকার ডিএনএ'র অনুক্রমের সম্পূর্ণ তথ্য চাই।
ডিন হ্যামারের পরে ১৯৯৫ সালে একইরকম ফলাফল পেয়েছেন এস হু, এ এম পাত্তাউচি, সি প্যাটারসনরা। আবার ১৯৯৯ সালে কানাডার জর্জ রাইস উপাত্তের সংখ্যা বাড়িয়ে পরীক্ষা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তর্কাতর্কিও শুরু হয়ে গেছে কারণ এমন বলা হচ্ছে যে রাইসের পরীক্ষার শুরুতেই তিনি গে জিনের ব্যাপারে নেগেটিভ মতামত দিয়েছিলেন। এমন সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এতকিছুর পরে, গে জিনের ব্যাপারটি বিজ্ঞানীমহলে 'অমীমাংসিত মামলা'। এখনো গবেষণা চলছে, দেখা যাক সেই গবেষণায় কী বেরিয়ে আসে। গবেষণা চলছে এপিজেনেটিক্সের পথেও। যে পথে উপরের সমস্যা বা বিভ্রান্তির একটা ইন্টারেস্টিং সমাধান দেয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে কোন জিন একা একা কাজ করতে পারে না। এরা কাজ করে পরিবেশ থেকে পাওয়া সংকেতের মিথস্ক্রিয়ায়। অনেকটা লাইটবাল্বের মত। পরিবেশের সংকেত জিনকে অ্যাক্টিভ করে বা ডিঅ্যাক্টিভ করে। এ প্রক্রিয়ার নাম মিথাইলেশন। যার কারণে আইডেন্টিকাল টুইনদের জেনেটিক কোড এক হওয়া সত্ত্বেও তারা একই মন মানসিকতার হয়ে ওঠে না। তাই একই জেনেটিক কোড থাকা সত্ত্বেও কোন মানুষ সমকামীও হতে পারে, বিষমকামীও হতে পারে সেই জিনের অ্যাক্টিভেশন বা ডিঅ্যাক্টিভেশনের কারণে। এই ধারণার সপক্ষে কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে। সমকামী সন্তানের জন্ম দেয়া মায়েদের এক্স ক্রোমোজোমের সক্রিয়তা অন্যদের চেয়ে বেশি। এই বেশি হওয়াটাও নির্ভর করছে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোল। এই হরমোনের আধিক্য সমকামী সন্তানের জন্মদাত্রী মায়েদের এক্স ক্রোমোজোমের সক্রিয়তাকে প্রভাবিত করেছে।
খুব খিয়াল কৈরাঃ
এই জেনেটিক গবেষণা এখনো অসম্পূর্ণ। এর সিদ্ধান্তগুলো তত্ত্বের মর্যাদা পায় নি। তাই সরল অঙ্কের মত ইহা=উহা ধরে নিবেন না। কারণ সে যুক্তি ধোপে টিকবে না। আমাদের করণীয় হলো নিজেদের ভুল ধারণাকে প্রাপ্ত জ্ঞানের সাপেক্ষে শুধরে নেয়া। এবং অপরকেও অবহিত করা।
সমকামিতা নিয়ে ৩নং ধারণা ("ইহা জেনেটিক কিছু না, সমাজ বা পরিবেশের প্রভাবে ঘটে।") নিয়ে অলরেডি বলে ফেলেছিঃ অমীমাংসিত ব্যাপার, গবেষণা চলছে। এবারে বলব সবচেয়ে বিতর্কিত ধারণাটি (২নং) নিয়ে।
২. ইহা জেনেটিক সমস্যা/রোগ, বিবর্তনের ফলাফল (মিউটেশন) তবে নিরাময় সম্ভবঃ
শুরুতেই বলি, এটাকে বিতর্কিত বলার কারণে এই ধারণার ভিত্তিতে অসংখ্য মানুষকে সিস্টেমেটিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে, অনেকে মারাও গেছেন। উগ্র ধর্মবাদীরা তো আব্রাহামিক ধর্মের শুরু থেকেই ছিলেন, সেইসাথে জুড়েছিলো মনোবিজ্ঞানী নামক চিজেরা। রিচার্ড ফ্রেইহার ইবিং-এর সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস (১৮৮৬) বইটা সমকামীদের মানসিক রোগী বানিয়ে দিয়েছে, সেই ধারণা এতকিছু আবিষ্কারের পরেও দূর হয় নি। সিগমান্ড ফ্রয়েড এই ধারণাকে সমর্থন দেন নি। তিনি সমকামিতাকে যৌন প্রকরণ (sexual variation) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যদিও তার মত জনপ্রিয়তা পায় নি। বহু কনভার্শনের চেষ্টা হয়েছে, বহু ট্রিটমেন্ট হয়েছে, বহু নারকীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে (ইলেকট্রিক শক, অ্যাভারশন থেরাপি, পুরুষাঙ্গে শক দেয়া, মরদেহ থেকে পুরুষাঙ্গ কেটে সমকামীর দেহের ভেতর স্থাপন করা হতো টেস্টোস্টেরন বাড়ানোর জন্য ইত্যাদি)। এই ঘটনাগুলো জানলে তীব্র বিবমিষাই জেগে উঠবে।

কম্পিউটার সায়েন্সের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান ট্যুরিংকে সমকামিতার অপরাধে ১৯৫২ সালে শাস্তি দেয়া হয়। তাকে জেল কিংবা "চিকিৎসা" বেছে নিতে বলা হয়। সেই চিকিৎসা হলো তাকে এস্ট্রোজেনসহ বিভিন্ন হরমোনাল ড্রাগ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেয়া হতো। প্রায় দুই বছর ধরে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে এই ড্রাগ নিতে হয়েছে। এর প্রভাবে তার শরীরে ইম্পোটেন্সি ঘটে, তিনি যে পর্যায়ের গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তা ব্যাহত হয়, এবং তার শরীরে গাইনোকোম্যাস্টিয়া নামের অসুখ দেখা দেয়। অসুখটা কী, তা লিখতে রুচি হচ্ছে না, আগ্রহীরা গুগল করে দেখতে পারেন। এই "চিকিৎসা" সহ্য করতে না পেরেও ট্যুরিং ১৯৫৪ সালে সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এছাড়াও ১৯৬২ সালে এই অ্যাভারশন থেরাপির শিকার হয়ে ক্যাপ্টেন বিলি ক্লেগ হিল নামের এক রোগী কোমায় চলে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন। অবশেষে ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন স্বীকার করে নিয়েছে যে,সমকামিতা কোন রোগ নয়, এটা যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। [ বিস্তারিত ]
যাক গে সে কথা। বহু চিল্লাফাল্লা করে মনোবিজ্ঞানীরা তো থামলো। কিন্তু আরেকদল দাঁড়িয়ে গেল সমকামিতাকে জেনেটিক ডিফেক্ট হিসেবে দেখানোর জন্য। কিন্তু এই যে আপনি, পাঠক, পোস্ট পড়ছেন, আপনার কি এখনো মনে হচ্ছে জেনেটিক কারণে সমকামিতা ঘটে এটাই প্রমাণিত? প্রমাণিত না। সমকামিতার সাথে জিনের সম্পর্কই তো ঠিকমত প্রমাণ হয় নি। গে জিন বলে কোনোকিছু এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। এর সাথে হিসাবে আনতে হবে পরিবেশ, এপিজেনেটিক্স। তাই এখনই সমকামিতাকে পুরোপুরি জেনেটিক দাবি করা যায় না। আর জেনেটিক রোগ বলা তো দূরের কথা!
সমকামিতা একটা জেনেটিক প্রকরণ, বা ভ্যারিয়েশন। যেমন নীল চোখ, বা সোনালি চুল একেকটা ভ্যারিয়েশন। বাংলাদেশে কটা চোখের কাউকে রোগাক্রান্ত বলা যা, সমকামীদের রোগাক্রান্ত বলাও তা। এটা আপনাকে, আমাকে বুঝতে হবে আগে।
এটা একটা জেনেটিক মিউটেশন বটে। এখন ভাবি, এটা কি ভাল মিউটেশন নাকি খারাপ? সিদ্ধান্ত নেয়া যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর ভরসা রেখে। যে সকল মিউটেশন অনুপযুক্ত বা ক্ষতিকর, সেটা আপনা আপনিই বাতিল হয়ে যায়। কারণ ক্ষতিকর মিউটেশনবাহী জীব বংশবৃদ্ধি করার আগেই মৃত্যুবরণ করে, ফলে উত্তরাধিকার থাকে না। কিন্তু যে মিউটেশন আমাদের বাড়তি সুবিধা দেয় (যেমন দুই পায়ে দাঁড়ানোবা মগজের বড় আকার ইত্যাদি) কিংবা নিরপেক্ষ (যেমন নীল চোখ বা সাদা হাড়) সেগুলো নির্বাচনে টিকে যায়। সমকামিতা যদি সত্যিই জেনেটিক ডিফেক্ট হত, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাঁকনিতে আটকে বহু আগেই বিলুপ্ত হত। কিন্তু এটা লক্ষ লক্ষ বছর টিকে আছে, খালি মানুষেই না, প্রাণিজগতের আরো হাজার হাজার প্রাণীর মধ্যে।
সমকামিতা যে রোগ না, তার আরেকটি যুক্তি হলো সংখ্যাধিক্য। আলবার্ট কিনসে'র রিপোর্ট অনুযায়ী যে কোন জনগোষ্ঠীর দশ ভাগ সমকামী। বিজ্ঞানীরা বলেন, জেনেটিক রোগের ডিগ্রি অফ রেয়ারিটি ঠিক করা হয় দুইটা ঝামেলাযুক্ত ফ্যাক্টরকে হিসাবে এনে। একটা হলো মিউটেশনের মাধ্যমে ফর্মেশন, আরেকটা হলো ন্যাচারাল সিলেকশনের দ্বারা বর্জন। এই দুইটা মারামারি করে যে হিসাব পাওয়া যায় তাকে বলে "মিউটেশন-সিলেকশন সাম্যাবস্থা"। এই ফিটনেস টেস্ট অনুযায়ী যদি কোন বৈশিষ্ট্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে সেটা ১ মিলিয়নে ১বার ঘটে। এটা হলো (১০০%ফিটনেস) জেনেটিক রোগ। রোগের তালিকায় পড়ে এমন বৈশিষ্ট্যের বেলায় (৫% ফিটনেস) হিসাব হলো ৫০ হাজার জনে ১। সেখানে সমকামিতার হিসাব ১০ জনে ১। সুতরাং এই হিসাবে এটাকে রোগ বলা যায় না।

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ডিলেমা

আত্মা বলে কিছু নেই, যা সচলসক্রিয়, তা আমাদের মস্তিষ্ক
হৃদয় বলে কিছু নেই, হৃৎপিণ্ড কেবল রক্তসঞ্চালনে আগ্রহী
হৃদয় বললে বুঝি ওই মস্তিষ্কই!
দ্বিমুহূর্ত পরের মুহূর্তে -
এ সত্য শুরুতে কদর্য লেগেছে।
এ সত্য এক লহমায় সকল উপমা, দৃশ্যকল্প, চিত্রকল্প ও রূপককে
ফাটা বেলুনের মতো ছিন্নভিন্ন করে দিল।
মাধ্যাকর্ষণের টানে ওগুলো ধ্রুব ত্বরণে পড়ে গেল, সুউচ্চ কল্পনার চূড়া হতে।
সত্য উদঘাটিত হলে কদর্যই লাগে। ডিনায়্যাল। অস্বীকৃতির ক্রোধ জাগে। তারপর বার্গেইন করি, মুলামুলি, টানাটানি। ফিরিয়ে দে অলীক রূপকগুলো, আমার বিভ্রান্তিকর মিথ্যা সুখ। ফিরিয়ে দেয় না কেউ। তাই কদর্য সত্যগুলোর দিকে ভ্রূকূটি করে তাকাই। ধীরে ধীরে তারা অবয়ব নিতে থাকে। অ্যামিবার মতো নড়ে চড়ে। পর্দা সরে যায়, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে রূপ। তখনই দেখি বিস্ময়কর দেহের ভেতর কারুকার্য।
সত্যের মতো সুন্দর এই মস্তিষ্কের ভাঁজ, যেন বয়ামে রেখে দেয়া কিছু। জান্তব। সচলসক্রিয়। নিউরনে বিদ্যুতের বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ে। মস্তিষ্ককে চিনে নেয়ার তথ্যটাও জমা পড়ে মস্তিষ্কেই। মস্তিষ্ক ভাবে মস্তিষ্ককে নিয়ে এবং সেই ভাবনা জমা রাখে নিজের ভেতর। আবার মস্তিষ্কের ভাবনার ভেতরেও থাকে মস্তিষ্কই। ইনসেপশন। ঘুলঘুলি।
একটি কথোপকথন -
: জানার কোন শেষ নেই। জানতে কেউ নিষেধ করে নি। জানতে চাওয়া ভুল না। কোরানে কোথাও বলে নি জানতে পারবা না। আল্লাহ বলেন নি যে প্রশ্ন করতে পারবা না।
: কিন্তু সীমানা তো নির্দিষ্ট করে দেয়া। প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্র ঠিক করে দেয়া। সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। নিষেধ করা হয়েছে, তাই না?
: কোথায়? বলো। কোথায় নিষেধ করা হয়েছে?
: উমম, যদি বলি - নিষেধ করা হয়েছে আল্লাহকে নিয়ে প্রশ্ন করতে? যদি বলি তার অস্তিত্বকে মেনে নেয়ার একচ্ছত্র অধিকারকে অস্বীকার করা নিষেধ?
: হ্যাঁ, তা বটে। ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ। আল্লাহর অস্তিত্বে নিঃশর্তে বিশ্বাস করতে হবে। প্রমাণ খুঁজলে পাবে না। পেলেও দেখবে, সংশয় দূর হবে না, সারাজীবন এই সংশয়েই কাটাতে হবে। তাই সংশয় দূর করো। বিশ্বাস স্থাপন করো।
: কিন্তু আমি তো এই প্রশ্নের উত্তর চাই। নিরেট, নির্ভেজাল সত্য।
: উত্তর আছে তো! বলা আছে - এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ, সর্বশক্তিমান, অসীম দয়াময়, পরম করুণাময়।
: কিন্তু এটা চাপিয়ে দেয়া উত্তর। সিদ্ধান্ত। এটার প্রমাণ নেই। উপাত্ত নেই।
: (নিশ্চুপ)
ডিলেমা কাটলো না। বিভ্রান্তি দূর হলো না। সংশয় আরো গাঢ় হয়ে উঠলো। ঈশান কোণের মেঘের মতো ঘন থরথরে মেঘ জমে উঠলো। এই সংশয় আমার কাছে কদর্য লাগে, মাঝে মাঝে। যদি সৎবাক্য বলি - হ্যাঁ, মাঝে মাঝে লাগে। কৃষ্ণমেঘ পুষি মনের কোণে। না, না, ভুল হলো - মস্তিষ্কের কোষে। সেখানে লালন-পালন করি সংশয়ী মেঘ। প্রশ্ন আছে - উত্তর নেই। উত্তরহীনতার মাতৃকা মেখে প্রশ্নগুলো হাসে। সে হাসি নিরাবেগ। আমার সে হাসি ভাল লাগে। থাকুক প্রশ্নগুলো, বৃথা রহস্যময়তা আর অত্যাশ্চর্য মিরাকলের আবর্জনায় না মেখেই প্রশ্নগুলো থাকুক। একদিন এদের উত্তর বের হবে - মীমাংসিত সত্য সুন্দর উত্তর। সেই উত্তরের জন্য এক জীবন অপেক্ষা করা যায়। সেই উত্তরের অপেক্ষায় এক জীবনও তুচ্ছাতিতুচ্ছ!

বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

নিবিড় নিশীথ

নিশীথ বানানটা কি ঠিক লিখলাম? দীর্ঘ ঈ-কার হবে? নাকি হ্রস্ব ই-কার? ভাবছি। ইদানিং বানান-ফোবিয়া হয়েছে। বাটে পড়ে কিছু লেখায় বানানশুদ্ধি করতে হয়েছে। ফলে লাভের চাইতে ক্ষতি হলো বেশি। যা বানান ঠিকঠাক জানতাম, শুদ্ধ করতে গিয়ে সেগুলো এখন ভুল জানি। ভুলভাল করে তারপর নিজেই নিজেকে অবোধ দেই, দার্শনিক হয়ে যাই। সক্রেটিস বলেছেন পৃথিবীতে ভুল শুদ্ধ কিছু নাই*। চালাইতে পারলে সবই ঠিক, চালাইতে না পারলে সবই ভুল। কিশোর কুমারের গানের মত ‘ভুল, সবই ভুল’।
ইদানিংকালের কথা বলছিলাম। ছোটবেলায় ইশকুলের মাঠে যেসব খেলা খেলতাম, সেগুলোর একটা কমন ফ্রেম ছিল। খেলার কোন না কোন পর্যায়ে একটা ছক বা গণ্ডির মধ্যে ঢুকতে হত। যে গণ্ডির মধ্যে নিরাপত্তা কিংবা গণ্ডির বাইরে নিরাপত্তা। যেমন ছোঁয়াছুঁয়িতে সেফ-প্লেস থাকত, কিংবা মেয়েদের বউচি টাইপের খেলা। আমার মনে হয় ছেলেবেলায় ওভাবে খেলতে খেলতে সবার আচরণে এটা ঢুকে যায়। গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা। তুচ্ছ একটা দাগ মাটিতে। হয়ত নিজেই দিয়েছি। কিন্তু কী এক অজানা কারণে সেটা পেরুতে পারছি না। নিজেই নিজেকে আটকে বসে আছি! আবার মনের এক কোণে চিন্তাও হচ্ছে – যদি পেরুতে পারতাম, কতোদিন গণ্ডির বাইরে পা রাখি না। আজব ডিলেমা।
ইদানিং বেশি বেশি এই ডিলেমা ফিরে আসছে। বেশিরভাগ সময় মূল কাজটুকু করার আগে পরের এই ডিলেমা নিয়ে ডিল করতেই বেশি সময় আর চিন্তাভাবনা নষ্ট হচ্ছে। ইংরেজিতে মনে হয় এটাকেই প্রোক্র্যাস্টিনেশন বলে। বড়োলোকের রোগ গরীবের হলে সেটাকে বলে ঘোড়া রোগ। আমি শালার হাম-যক্ষা-ম্যালেরিয়া-হুপিং কাশি কিছুর হাতে ধরা খেলাম না, খেলাম তো খেলাম, শেষমেশ ঘোড়া রোগের হাতে!

গণ্ডির মধ্যে ঢুকে থাকলে একটা ইল্যুশন তৈরি হয়। মনে হয় কোন সাবানের বুদবুদের মত বাইরের কিছু আর আমাকে স্পর্শ করতে পারছে না। ‘এই বেশ ভালই আছি’ টাইপের ধারণা হয়। গণ্ডির বাইরের যে দৃশ্যগুলো দেখি, দেখি চারপাশের মানুষ, সাধারণ, মামুলি মানুষ, তারা তাদের সাধারণ চাকুরি, টাকা, জমি, দেনা ও খাবার দাবার নিয়ে দিনাতিপাত করছে। দেখে ভাল লাগে। আমার একটা মস্তিষ্ক আছে এবং সে মস্তিষ্ককে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি – এটা ভেবে ভাল লাগে। চিন্তা করি নানা কিছু নিয়ে, সেগুলোর সব প্রকাশ করার উপায় নেই। প্রকাশ করতে যে সময় লাগবে, সেই সময়ে আরও কয়েক কোটি চিন্তা করে ফেলবো – সেগুলোর কী হবে? তাই আমি চারপাশ দেখি আর ভালোলাগা জমাই।
গত সেপ্টেম্বর থেকে জীবন একটু বদলে গেছে। পাঁচ মাস ধরে পার্টনার ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে – খবরদারি করে। অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এখন মস্তিষ্ক আমার সাথে একটু বিট্রে করেছে। নিজে নিজে গণ্ডি সম্প্রসারণ করে পার্টনারকে ভিতরে এনেছে – এখন চিন্তাভাবনাগুলো শেয়ার করা লাগে। কিছু কিছু মিলে যায় – সহমত। বেশিরভাগই মিলে না – উপভোগ্য তর্ক। তর্কের এক পর্যায়ে ক্ষান্ত দেই, ঘোড়া রোগের রোগীদের বেশি তর্ক করতে নাই। এ কারণেই বোধহয় ব্লগিং কমিয়ে দিয়েছি। একটা সময়ের পরে সবই রিকারেন্স – সেই একই আলাপ, একই হাসি-তামাশা-ঝগড়া। মতামতের মিল কিংবা মতের অমিল। নিজের কথাও বারবার বলতে ভাল লাগে না, তাই অনেক ক্ষেত্রে নীরবতা শ্রেয় অপশন মনে হয়।
খুব সম্প্রতি আরেকটা বেশ বড়ো ব্যাপার হলো – আমার এই বন্ধুটার সন্তান জন্মালো। ব্যাপারটা কী ভয়াবহ, সেদিনের পুঁচকা, আমার লগে ঝগড়াঝাটি করত, এখন কি না এক পোলার বাপ। এমন না যে সে আমাদের ইনটেকের প্রথম বাপ, এর আগে অনেকেই বাপ হয়েছে, একজন তো দুইবার এই কৃতিত্ব অর্জন করে ফেলেছে এরই মধ্যে। কিন্তু ওর বেলায় আসলে আমার অন্যরকম অনুভূতি হলো। এতো দিনের বন্ধু, বাবা হতে যাচ্ছে, খবরটা পেয়েই খুশি হয়েছিলাম! ওর সবচেয়ে বড়ো গুণের একটা হলো পিতৃসুলভ বৈশিষ্ট্য। বটগাছের মত দাঁড়ায় যায়, ক্রাইসিসে একদম ইস্পাত-স্নায়ু। এরকম সবার হয় না, সবাই পারে না। নতুন অতিথির আগমনী বার্তায় তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। আমিও একদিন পার্টনারকে নিয়ে গেলাম, ছোট ছোট জামাকাপড় কিনে নিয়ে এলাম বন্ধুপুত্রের জন্য। ঘরোয়াভাবে একটা অনুষ্ঠানও হয়ে গেল ওর বাসায়!
ভবিতব্য খুব নিষ্ঠুর ধরণের অদ্ভুত আচরণ করে! তাই ওর ছেলে জন্মানোর এক মাস আগে, ওর আব্বা মারা গেলেন। যেন কিছুই হয় নি, হুট করেই। সকালে বেরিয়েছিলেন বাজার করতে। বাজার পর্যন্ত পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই স্ট্রোক। বড়ো ছেলের ঘরে নাতি আসছে – নাম ঠিক করে রেখেছিলেন… সব শেষ।
আমার বন্ধুটিকে আমি এরপরও ভেঙে পড়তে দেখি নি। এক মাস পরে সন্তানের জন্ম। বন্ধুপত্নী বললো, ছেলের নাম রাখবে দাদার নামে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীটা একেবারে খারাপ জায়গা না। ভুল শুদ্ধ বলেও তাই, তেমন কিছু নাই!