শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

অপত্যগাঁথা

যে গল্পটি জরায়ু থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে, সে গল্পটি অশ্রুর মতো সুন্দর, বেদনার মতো সত্য। গল্পটির শরীর নরম ও নাজুক, হাড়-মাংস কিছুই তেমনভাবে তার গায়ে লাগে নি। তাই গড়নে হালকা-পাতলা এবং হিলহিলে দেখায় তাকে। আমি বলছি দেখায়, কারণ আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পারছি সে টলমল করছে, দু'পায়ে ভর রাখার চেষ্টা করছে, কোনোমতে তাল সামলে নিচ্ছে। গল্পটির জন্য আমার কেমন এক অপত্য মায়া হতে থাকে। আহারে! পায়ে জোর নেই, সহায় নেই, সম্বল নেই, দিশেহারা একটি গল্প। পিটপিট করে তাকাচ্ছে মনে হলো। কাউকে খুঁজছে, খুব ব্যাকুল চোখে এদিক ওদিক তড়পাচ্ছে গল্পটা। নতুন শরীরে ভিন্নজগতের একটা গন্ধ লেগে আছে ওর। আমার মনে হয় ওকে আরেকটু সময় দেয়া দরকার ছিল। ওর গায়ে এখনো মাতৃকার আঁশটে গন্ধ। মাছের মত সাঁতরে বেড়ানোর বয়স ওর। চোখ বন্ধ করে নিভৃত আদরে ঘুমিয়ে থাকবে জলজ শয্যায়। নিশ্চিন্তে বড় হবে, পুষ্টি পাবে। অথচ এমন নিরাপদ মুহূর্তে সে এতটুকুন স্বস্তিও পাচ্ছে না। আঁশটে-গন্ধা শরীরেই টলমল দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু সময় পেলে ওর শরীর তরতাজা হতো, শক্তপোক্ত হতো। সেই সুস্থ সবল নিয়তি মনে হয় ওর কপালে নেই। এ এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা, কোন সন্দেহ নেই!
সোমার দুই ফ্যালফ্যাল চোখের দিকে তাকিয়ে আরিফের মনে হলো দু'চোখে গ্রানাইটের পেরেক পুঁতে দেয়া হয়েছে। সোমা আনান, আরিফ আনানের বউ, তাকিয়ে আছে। ধবধবে শাদা টাইলসের ওপর এক বিন্দু ময়লাও নেই। ওপরে এনার্জি-সেভিং লাইটগুলো প্রখর আলোতে ঝলসে দিচ্ছে চারদিক। সোমার শরীরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে আরিফ, কিন্তু গ্রানাইটের পেরেক থেকে চোখ সরাতে পারে না। আমরা, যারা গল্পটিকে দেখছিলাম, তারা টাইলসের ওপর দেখতে পাই বিশুদ্ধ রক্তিম নদী। সোমার পাললিক জমিন থেকে দ্রুত পরিণত হচ্ছে খরস্রোতা নাব্যতায়। গন্তব্য আরিফের পায়ের কাছে অবস্থিত ঝাঁঝরি, গহন গভীর।