বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১২

মানবচরিত বিষয়ক পরীক্ষা

বেশ অনেকদিন হলো একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। অনার্স লেভেলের পড়াশোনা শেষ করে পড়াতে ঢুকেছিলাম, তারপর থেকে এই কাজটাই ভাল লাগে। অনেকের কাছে শিক্ষকতা একটা "বোরিং জব", অনেকের কাছে এটা কেবলই একটা চাকরি, কোচিং করিয়ে টাকা উপার্জন ছাড়া মোটা দাগে এর থেকে পাওয়ার কিছু নেই। সত্যি বলতে কি, এই চাকরিটাকে শুরুতে আমিও এরকমই ভেবেছিলাম। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে পড়াতে ভাল লাগতো। সেই ছোটবেলা থেকে (এসএসসি পাশের পর থেকে) ছাত্র পড়াচ্ছি। নিজে একটা কিছু মোটামুটি বুঝতে পারছি এবং সেটা আরেকজনকে শেখাতে আমার মজা লাগে। মনে হয় ইলেকট্রন ট্রান্সফার হচ্ছে (খুবই হাস্যকর চিন্তা) দুইজন মানুষের মাঝে! কিন্তু আমি পেশা হিসেবে এটা নিয়ে ভাবি নি। চাকরিতে ঢোকার পরে দুই তিন টার্ম (প্রায় পাঁচ ছয় মাস) তাই এক ধরণের 'চাকুরে' মানসিকতা নিয়ে কাজ করেছি। তারপর হলো কি, বেশিদিন একটা জায়গায় থাকলে কেমন মায়া জন্মে যায়, আমারও তেমনি মায়া জন্মে গেল। একটা সময় পরে দেখলাম আমি এই পড়ানোর কাজটাকে এনজয় করছি।

আমাদের সমাজে শিক্ষকদের কোন স্ট্যাটাস নাই। মুখে মুখে প্রচুর ভাল ভাল কথা বলা হয়, কিন্তু মনে মনে এক টাকার সম্মান দেয়া হয়। শিক্ষকরাই এজন্য দায়ী। আজকের ছাত্রকে গড়ে পিটে মানুষ করার দায়িত্বটা তারা পালন করেন না, যার ফলে বড়ো হয়ে সেই মানুষটা সম্মান দেয়া শেখে না। একইভাবে শিক্ষকদের নিজেদের মনুষ্যত্ব ও বিবেকবোধ নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। প্রচুর নিম্ন-মাঝারি মানুষ টিচার হয় যাদের একাডেমিক রেকর্ড হয়তো ঈর্ষণীয় কিন্তু টিচার হিসেবে তারা জঘন্য। নীতি-নৈতিকতার বিবেচনায় তারা হয়তো আড়তদার হবার যোগ্য (নো অফেন্স টু সাকসেসফুল আড়তদারস)। কথাটা এলিট শোনাচ্ছে, শ্রেণীচেতনা ইত্যাদি বিবেচনায় আপত্তিকরও মনে হচ্ছে। তবে আমি মনে করি ভুল শিক্ষকের চেয়ে বিপদজনক আর কিছু নাই। প্রতিটা ভয়ানক নীতিহীন মানুষ বেড়ে ওঠার পেছনে খোঁজা হলে কোনো না কোন শিক্ষককে পাওয়া যাবে (অথবা কোন শিক্ষককেই পাওয়া যাবে না)! কোন দিক দিয়ে দেশ ও দশের চৌদ্দটা তারা বাজান, সেটা শনাক্ত করাও দুঃসাধ্য, কারণ তাদের এই প্রভাব পরোক্ষ।

সে যাকগে, আমি মোটামুটি একটা ধারণে পেয়ে গেছি এই সোসাইটির। এখানে যেমন হাসিখুশি প্যাঁচহীন মানুষ আছেন, তেমনি ঘোরালো-মনের ধান্দাবাজেরও অভাব নেই। গলার জোরে বা প্রভাব খাটিয়ে তারাই বেশি আওয়াজ করেন। পাশাপাশি ছাত্রচরিত নিয়েও খুব মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি যেখানে পড়াই, সেখানে মূলত মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষজন ছেলেপুলেকে পড়াতে পাঠান। খুব বেশি ঠাট-বাট নেই, টিউশন ফি-ও তুলনামূলকভাবে কম। আমাদের সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে শস্তা জিনিস আসলে ফালতু জিনিস। আমরা ভাবি বেশি দাম দিয়ে কিনলেই "খুব জিতলাম"। সেই ধারাতেই আমরা ভাবি, "অনেক কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে তিন-চার বছর পড়ে যে ডিগ্রিটা পেলুম, সেটা বেশ দামি"। কিন্তু প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোর কর্তাব্যক্তিরা ছাত্রদের মতো ভাবেন না মোটেও। মুখে প্রচুর বারফাট্টাই করা লোকজন আসলে ভিতরে ব্যবসায়ী। ব্যবসার শর্তটা হলো আয় বাড়াও। দাম বাড়াও। ছাত্ররা সব হলো নধর প্রোডাক্ট। আর তারা ছাত্রও পান ভাল। পাবলিক ভার্সিটির সেশনজটে পড়ে আমাদের মতো আবলুস কাঠ কেউ আর হতে চায় না। যাদের সামর্থ আছে, তারা পয়সা খরচ করে টেনেটুনে হলেও প্রাইভেটেই পড়ে। সেইসাথে আছে ভার্সিটিগুলোর নানাবিধ চমৎকার বিজ্ঞাপন ও প্রজ্ঞাপন। এদিক দিয়ে যারা নিজেদের একটা ইমেজ দাঁড় করাতে পারে নি বা চায় নি, তারা স্বভাবতই কম ছাত্র পায়, তুলনামূলক খারাপ ছাত্র পায়।

আমার ভার্সিটিটাও ছোটখাট। ছাত্রগুলো মেরিটের দিক থেকে একেবারেই মাঝারি। মর্নিং শিফটের ছাত্রদের মধ্যে মাঝে মাঝে খুব বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্র পাই। প্রচুর পড়তে পারে এবং মেধার দিক থেকে তুখোড় ছাত্র। এদের জন্য সে'সব কোর্সে খাটুনি বেড়ে যায় (হেহেহে)। কিন্তু গড়পড়তা ছাত্ররা মোটামুটি একই মানের, এবং তাদের প্রায় সবাই-ই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে একেকজন মুখস্তবিদ। আমি যে সময় চাকরিতে ঢুকেছি, তখন দেখলাম পরীক্ষাগুলোতে বেশ নকল হচ্ছে। একটা কারণ যে প্রশ্নগুলো প্রথাগত। ক্লাশে যা পড়ানো হচ্ছে বা বইয়ে যা আছে, সেগুলোই যদি পরীক্ষায় আসে, তাহলে নকলের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাছাড়াও শিক্ষকরাও বেশ উদাসীন ছিলেন বা ছাত্ররা বেপরোয়া ছিল হয়তো (কারণ কোন ব্যবস্থা নেয়া হতো না)। আমাদের সিনিয়র দুই-তিনজন ভাইয়াও লেকচারার হিসেবে ছিলেন। সবাই মিলে নকল-উৎপাটনের প্রজেক্ট (!) হাতে নিলাম। পরীক্ষাক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল। প্রতি পরীক্ষায় সাত-আটটা নকল ধরা পড়তে শুরু করলো। আমরা সেগুলো থ্রু করে দিলাম কর্তাব্যক্তিদের কাছে। ফলাফলে দুয়েকজন ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো। এর পরেই একটু একটু করে নকল করার চল একেবারেই কমে এলো। পরীক্ষার হল আবার শান্ত। নতুন যারা লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছিল, তারাও মোটামুটি সেই মান বজায় রাখলো। আমার এখনও মনে হয় এই কাজটা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে করেছিলাম। ক্লাশে যতোটা ভাল বা বন্ধুভাবাপন্ন হবার চেষ্টা করেছি, পরীক্ষার সময় ঠিক ততোটাই কঠোর। তারপরেও বেশ কিছুদিন চলে গেছে, প্রায় বছর দুয়েক হলো এমন চণ্ডমূর্তি ধরতে হয় না।

সেদিন একটু ভিন্ন কিছু করতে গিয়ে অভিনব অনুভব হলো। বেশ তাড়াহুড়া ছিল। আমার একটা কোর্সের ছোট্ট একটা কুইজ নিতে হবে। সন্ধ্যার এই কোর্সটায় ছাত্রসংখ্যা ৪২, বেশ ভরভরন্ত অবস্থা। তাই পরীক্ষা নেয়ার আগে চেয়ারগুলো দূরে দূরে সাজানো লাগে। কিন্তু তাড়াহুড়ায় আমি বলতে ভুলে গিয়েছি, ক্লাশে গিয়ে দেখি সবাই বেশ ঘন হয়ে পাশাপাশি বসে আছে। এদিকে আমি প্রশ্ন এনেছি একটাই সেট, সবার একই প্রশ্নের পরীক্ষা। কী করি? প্রশ্ন দেয়ার আগে একটু বুদ্ধি করলাম। বললাম, "আজকে সবাই এভাবেই কাছাকাছি বসে পরীক্ষা দিবেন, তবে যদি কেউ পাশের জনের খাতার দিকে তাকান, তাহলে সবার নম্বর শূন্য হয়ে যাবে"। বলার সাথে সাথেই সমস্বরে সবার প্রতিবাদ, "না স্যার!", এটাই আশা করছিলাম। আমি তবু আমার সিদ্ধান্তেই অটল। মাঝ থেকে এক ছাত্র বললো, "স্যার, যে আজকে ভাল পড়ে আসে নি, সে তো ইচ্ছা করে দেখে সবাইকে শূন্য পাইয়ে দেবে"। একটু ভেবে বললাম, "বেশ, যার কারণে আপনারা বাকিরা শূন্য পাবেন, তার নামটা বলে দেব"। ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। যে অপরের খাতা দেখবে, তার কপালে গণ-মাইর নিশ্চিত! আমিও একটু কৌতূহল নিয়েই পরীক্ষাটা শুরু করলাম।

এখানে বলে রাখি, ওপেন-ক্রেডিট সিস্টেমের কারণে সব কোর্সেই অনেক ব্যাচের ছাত্র থাকে। সবাই সবার ক্লাসমেট না, বন্ধুও না, অনেকে পরিচিতও না। সুতরাং অপরের ওপর ভরসা ও অপরের সততার ওপর ভরসার একটা অভাব এদের মাঝে থাকতে পারে। আমি আরো ভাবছিলাম যে যদি সত্যিই সবাইকে একজনের কারণে শূন্য দিয়ে দেই, এবং তারপর যদি সে কোনোভাবে মার খেয়ে যায়, তাহলে তো সেটা ঠিক হবে না। শিক্ষক হিসেবে এই দিকটাও বিবেচনা করতে হবে। আবার এটাও ঠিক যে একবার যেহেতু বলে ফেলেছি, ক্রেডিবিলিটির প্রশ্ন উঠে যাবে যদি ফলো-আপ না হয়। এসব ভাবনার পাশাপাশি খুব কৌতূহলবোধ করছিলাম যে আসলেই কি এই ডানে-বামে-তাকানোর যুগে এই পরীক্ষাটা সফল হবে কি না।

এসব ভাবতে ভাবতেই দশ মিনিটের পরীক্ষা শেষ। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, কেউ ঘাড় ঘোরালো না, পাশের জনের খাতার দিকে তাকালো না, এমন কি নিজের খাতা থেকে মাথাই তুললো না। পরীক্ষা শেষ করে অনেকে সময়ের আগে খাতাও দিয়ে দিল! একদম শেষ মুহূর্তে খাতা নেয়ার সময় দুইজনকে দেখলাম পাশের জনের খাতা দেখার চেষ্টা করছে (এটা মনে হয় একটা প্যানিক রিফ্লেক্স!)। মনটা ভরে গেল। পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রদের ধন্যবাদ দিলাম, এতোটা আমি আশা করি নি। ওদের বললাম, "আপনারা আজকে যেভাবে পরীক্ষা দিলেন, সেটা আজকালকার যুগে প্রায় অসম্ভবের জায়গায় চলে গেছে। এই তুচ্ছ কুইজের উত্তরে আসলে কারোই তেমন কিছু আসবে যাবে না হয়তো। বেস্ট ফোর আউট অফ ফাইভ গোনা হবে, হয়তো এই কুইজের নম্বরটা গোনাই হবে না। কিন্তু এই পরীক্ষাটা আপনাদের মোরালিটির ব্যাপারে অনেক বড়ো একটা সিদ্ধান্ত দিল। সেটা হচ্ছে- আপনারা ছাত্র যে যেমনই হন না কেন, চাইলেই আপনারা কারো অনৈতিক সাহায্য ছাড়া পরীক্ষা দিতে পারেন। সদিচ্ছা থাকলে আমার এখানে এতোকিছু বলতেও হতো না। তার মানে আপনাদের মধ্যেই ভালোত্বের শক্তি বিরাজ করছে। অথচ পরের ক্লাসের পরীক্ষাতেই আপনারা ঠিক আগের মতো হয়ে যাবেন। আফসোস এটাই যে আপনারা অবলীলায় যে মোরাল ফাইবার ধরে রাখতে পারেন, সেটাকে উপেক্ষা করেন!"

দেখাদেখি করা ওই দুইজনের জন্য বাকিদের শূন্য পাওয়ার কথা ছিল (আমার কথা মতো)। ভেবে দেখলাম, আমাদের সামাজিক জীবনে এই ঘটনাটা অহরহ ঘটছে। আমরা সবসময় কয়েকজন কালপ্রিটের জন্য ভুগে চলেছি। আমাদের একটা চোর ইঞ্জিনিয়ারের কারণে সেতু ভেঙে এই সেদিনই কতোজন মারা গেল! কয়েকজন মহান নেতার কারণে দেশটা আখের ছোবড়া হয়ে গেছে। এমনই উদাহরণ ভুরি ভুরি দেয়া যাবে। অথচ সেই কালপ্রিটদের কিছু হয় না। ক্ষতি হয় বাকিদের। তাই ঠিক করলাম, সবাইকে যার যার প্রাপ্য নম্বরই দেব। তবে ওই দুইজনকে কৃতকর্মের ফল পেতে হবে।

দেশ-দশের দুর্দশা নিয়ে মিথ্যে বানোয়াট ফুলঝুরি ছুটিয়ে অনেকে মুখে মুখে হাতি ঘোড়া মেরে ফেলেন। তিনজন বাঙালি এক জায়গায় হলে দশ মিনিট সরকারকে গালি দেয় (যে সরকারকে তাদের মাঝে দুই জন ভোট দিয়েই এনেছে)। তারপর "এ-দেশের কিস্যু হবে না" বলে হা হুতাশ করতে থাকে। তিনজনের মাঝে একজন হয়তো ফোলানো-ফাঁপানো উপদেশের কথা বলে - আদর্শ, দেশপ্রেম, বিবেক (উচ্চমাধ্যমিক পাঞ্জেরি বাংলা গাইড দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি মিশিয়ে একটা ঝালমুড়ি বানায়। সেই ঝালমুড়ি খেয়ে বাকি দু'জন মাথা নাড়ায়। ঘটনা শেষ। আসলে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি। একচুলও নড়ি নি। প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীও নিজের অক্ষে শত শত মাইল সরে গেছে ততোক্ষণে। কিন্তু আমরা সেখানেই আছি। কিন্তু আমাদের একটু একটু করে হলেও এগুতে হবে। আমি প্রচণ্ডরকম নিরাশাবাদী চিন্তার জায়গা থেকেও মনে করি, বাঙালির সহজাত ভালোত্ব যে কোন জাতির নিঃস্বার্থবাদী বৈশিষ্ট্যের সাথে পাল্লা দিতে পারবে। একে অপরকে না চিনেও আমরা সাহায্য করতে পারি। নিজের সাময়িক ক্ষুদ্র লাভের চিন্তা না করে সবার ভাল ভাবতে পারি। খালি একটু প্রণোদনা দরকার, একটু ঠ্যালা, একটু বকা।