বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১২

আমরা যেমন-

প্রথমেই বলি এটিও আগেরটির মতো একটি ফাঁকিবাজি পোস্ট। অর্থাৎ কাজে ফাঁকি দিয়ে লেখা পোস্ট।
পোস্টের শিরোনাম লিখতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলাম। পাঁচমেশালি পোস্ট বলে শিরোনাম ঠিক করা একটু কঠিন মনে হচ্ছিল। শেষমেশ 'আমরা যেমন-' ঠিক করলাম। তার কারণ গত চার মাসে কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা ঘুরে ফিরে আমাকে নিজের এবং আমার চারপাশের মানুষদের আচরণের ব্যাপারে পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করছে। একে একে বলি:
- প্রথম অভিজ্ঞতাটা হয়েছে সময় নিয়ে। এখানে আসার পর এপার্টমেন্ট ভাড়া করতে হবে। একদিন বাড়িওয়ালার সাথে দুই-তিনটা এপার্টমেন্ট দেখে একটা ঠিক করলাম। পরের দিন বিকেল চারটায় লিজ সাইন করার মিটিং। যে এপার্টমেন্ট ঠিক করেছি, সেখানেই। জেট ল্যাগের কারণে পরের দিন বিকেলে চরম ঘুম দিলাম, তবে ঘড়ির এলার্মের কল্যাণে কোনোমতে তৈরি হয়ে হাজির হলাম দশ মিনিট পরে। বাংলাদেশের হিসাবে এটা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু এখানে দেখি বাড়িওয়ালা সেই রকম খাপ্পা হয়ে গেছে! লিজ নিয়ে কটমট করে রিশিডিউল করে চলে গেল (কারণ তার আরেক জায়গায় আরেকটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে)। সেদিন লিজ সাইন করা হলো না। করলাম পরের দিন। যা বুঝলাম, এখানে সময়ের হিসাবটা একেবারে GMT-6 হিসেবে। সবার ঘড়ি এক জায়গায়, দুয়েক মিনিটও কেউ এদিক-ওদিক করতে চায় না।

কথায় বলে বুদ্ধিমানরা দেখে শেখে, আর বোকারা ঠেকে শেখে। আমি যেহেতু বোকামানুষ, তাই ঠেকেই শিখলাম। এই জিনিসটা আমাদের দেশে মিসিং।
- আমার শিক্ষক এবং সহকর্মীভাগ্য বরাবরই ভাল। দেশেও দারুণ কিছু মানুষের সাথে কাজ করতাম, যদিও শেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (অর্থাৎ বুয়েটের) শিক্ষকদের বেশিরভাগকেই আমার পছন্দ হতো না। এখানে এসে আমার এডভাইজার (অর্থাৎ বস) আর তার পোস্ট-ডক (অর্থাৎ সেমি-বস) দুইজনের সাথে পরিচয় হলো। সামনা-সামনি এই প্রথম কথা হচ্ছে, তাই যা বলার তারাই বেশি বললেন। এখানে কাগজে কলমে ছাত্রদের কাজ করার কথা সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা। কিন্তু কাগজের হিসাব কি আর বাস্তবে মেলে? এই লেভেলে ছাত্র বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট মানেই সারা সপ্তাহ ল্যাবেই পড়ে থাকতে হবে। ক্লাস থাকলে আলাদা কথা, কিন্তু ক্লাস নাই অথচ তুমি ল্যাবে নাই - এরকম দেখলে খবরাছে! এটা মোটামুটি ভালই বুঝিয়ে দিলেন তারা। অভিযোগেরও কিছু দেখি না, কারণ প্রফেসর নিজেই সপ্তাহে ষাট ঘণ্টা কাজ করেন। (আজকে তার অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে গেছি মিটিং শিডিউল করতে, কিছু কাগজ সাইন করাতে হবে। কোনোমতে দশ দিন পরে তিরিশ মিনিট সময় পাওয়া গেল!) সুতরাং আমি কোন তুচ্ছপ্রাণ, কাজ না করে কই যামু? যা বুঝলাম, এখানে গাধার খাটুনি দিতে হবে, তবে গাধার মগজ ব্যবহার না করে মানুষের মগজ ব্যবহার করতে হবে। শুধু গাধার মত খেটে গেলে মাইনক্যা চিপায় পড়া সময়ের ব্যাপার।

আরেকটা ভুল ধারণা আছে দেশের মানুষের মনে, যে পশ্চিমের মানুষ সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করে আর দুইদিন খুব আরাম করে। Not necessarily, sire! এখানে কাজটাই বড়ো কথা। কাজ শেষ না হলে কিসের উইকেন্ড? উইকেন্ডের মজা গজা বানিয়ে খাইয়ে দেবে। বড় কম্পানিগুলো যেমন 'প্রফিট'-ভিত্তিক, এখানে এমন বড়সড় রিসার্চের জায়গাগুলো হলো ডেডলাইন-ভিত্তিক। সামনে ডেডলাইন? নাওয়া-খাওয়া কয়েক সপ্তাহের জন্য ভুলে যেতে পারেন!
- সহকর্মী ছেলেটাকে নিয়ে বলি। খুবই ভাল একটা পোলা। দেখতে অনেকটা দ্যা বিগ ব্যাং থিওরির শেলডনের মত, শুকনা-পাতলা। আমার চেয়ে বয়সে একটু ছোট, কিন্তু পড়াশোনার বহর দেখে আমি রীতিমত টাশকি খেয়েছি। বিজ্ঞানের হেন বিষয় নেই যে বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। থোরিয়াম-রিয়্যাকটর থেকে শুরু করে প্লাজমিওন, জিন-বেইজড চিপ থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিং সব দিকে সমান আগ্রহ। প্রচুর পড়ে, সারাদিন ল্যাবে থাকে, প্রায় আশিভাগ সময়ই সে কাজ করছে। সবচেয়ে ভাল যে দিকটা তার, সেটা হলো খুবই বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনা। দেশে এমন কিছু ছেলেপুলের সাথে আমি যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতাম, যারা তাদের চারপাশটাকে নাম-কা-ওয়াস্তে না নিয়ে ক্রমাগত নিরিখ করে দেখতে চায়। এই লাইনের চিন্তাভাবনা খুব উপকারী। তুমি যেমন মানুষই হও না কেন, তোমার মধ্যে এই গুণ চর্চা করে তৈরি করতে হবে। এই গুণ থাকলে প্রশ্ন করার অভ্যাস হবে। প্রশ্ন করার অভ্যাস হলে যাবতীয় ভুল ধারণা ও ভুল প্রথার অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়বে। আর তখনই কেবল সেগুলো থেকে উত্তরণের রাস্তা বের হতে পারে। এই গুণ থাকলে প্রেজুডিস সহজে তৈরি হতে পারে না। এই ছেলেটার মধ্যেও প্রেজুডিস একেবারেই নেই! বাংলাদেশ নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ। আমাকে প্রায়ই প্রচুর বকবক করতে হয় বাংলাদেশ নিয়ে, আমার ভালই লাগে। এই ধরনের মানুষ আমাদের দেশে খুব কম। সবাই যার যার গণ্ডিতে নিজের ধ্যান-ধারণা নিয়েই বসে থাকি। আর আমরা এমন একটা বয়সে পৌঁছে গেছি যে আর বদলানো সম্ভবও না। তবে নতুন প্রজন্মের পক্ষে সম্ভব চর্চা করে এই গুণগুলো আয়ত্তে আনা। (প্রচুর বাকোয়াজ লেকচার কপচে ফেললাম। ক্ষমার্হ...)
- ছোটবেলায় একটা বিরক্তিকর প্রশ্ন ছিল - 'কাকে বেশি ভালোবাসো - আম্মু না আব্বু?'। এখানে আসার পর থেকে এরকম একটা বিরক্তিকর প্রশ্ন আবিষ্কার করেছি - 'পড়াশোনা শেষ করে প্ল্যান কী? দেশে যাবে না এখানেই থাকবে?'। প্রথম দিকে জবাব দিতাম, "চলে যাবো"। কেন যাবো তার কারণ বর্ণনা করার আগেই প্রশ্নকর্তা(রা) বলেন, "এখন এই কথা বলছো, কিন্তু কয়েক বছর গেলে আর বলবে না। ফিরে যাবার সময় হলে দেখবে আর যেতে ইচ্ছে করছে না"। তারা হয়তো অভিজ্ঞতা থেকেই এমন বলে, তাই আমি তর্ক করি না। মেনে নেই। তবে গোপন কথা হচ্ছে, তাদের সবার এই জবাবগুলো শুনে শুনে আমার জিদ চেপে যাচ্ছে। বেশ ছেলেমানুষি-ভরা একরোখা জিদ। কে জানে, হয়তো তাদের ভুল প্রমাণ করতেই তল্পি-তল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে যাবো! 

বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

ভিন্‌

হেনরি নামের যে বুড়ো লোকটা আমাদের শাটলের ড্রাইভার, তাকে আমার বেশ লাগে। মিশুক গল্পবাজ। একদিন সকালের প্রথম ট্রিপে উঠেছি, ঘুম ঘুম লাগছে আর ভাবছি ল্যাবে ঢুকেই কফি খেতে হবে। হেনরি কী মনে করে কৌতুক বলা শুরু করলো।
দুই ভাই, জন আর স্টিভ। দুইজনেই মহা চামার। প্রচুর পয়সা বানিয়েছে মানুষ ঠকিয়ে। একই শহরে বাস করে তারা, এবং তাদের খারাপ স্বভাবের কারণে শহরের কেউই তাদের দুই চোখে দেখতে পারে না। একদিন স্টিভ মারা গেল। সৎকার অনুষ্ঠানের আগে আগে জন পাদ্রিকে বললো, "দেখেন, আমি জানি আমার ভাইয়ের ওপর আপনি আর শহরের বাকিরা ক্ষেপে আছেন। কিন্তু আমি চাই তার এই অনুষ্ঠানটা ভালোমত হোক। আপনি যদি আপনার বক্তব্যের মাঝে (যাকে ইংরেজিতে বলে ইউলজি) ওর প্রশংসা করেন, তাহলে আপনাকে এক লাখ ডলার দেব।" পাদ্রি পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। একদিকে এতোগুলো টাকার লোভ, আরেকদিকে চার্চের ভেতরে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলতেও মন সায় দিচ্ছে না, তাও আবার পুরো শহরবাসীর সামনে!
যাই হোক, পরদিন অনুষ্ঠানের সময় ইউলজি পাঠ করতে উঠলেন পাদ্রি সাহেব। বলতে শুরু করলেন, "এই স্টিভের মত খারাপ মানুষ হয় না। সে এই শহরের প্রায় সবাইকেই ঠকিয়েছে, মিথ্যা বলতো হরদম, মানুষের সম্পত্তি জবরদখল করেছে। তার পাপকর্মের ইয়ত্তা নাই!...
...
...
...
... কিন্তু তার ভাই জনের অপকর্মের তুলনায় স্টিভ একেবারে ফেরেশতা!"
হেনরি লোকটা সাদাসিধা, হাসিখুশি মানুষ। প্রতিদিন ল্যাবের কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় দশ-পনের মিনিট তার সাথে কথা বলি, সময়টা উপভোগ করি। দেশের কথা তখন আর মনে পড়ে না। বাসায় ফিরে ফেসবুক খুলে দেখি মানুষের ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না। কখনো ফিলিস্তিন আর কখনো আশুলিয়া। হাসি পায় এমন ছেলেমানুষি দেখে। এগুলো করে কী হবে? কিস্যু না। কান্নাকাটি, চিল্লাচিল্লির কোন দাম নাই। সবই ফাঁপা শব্দমালা।