রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৪

গল্প আর আমি

আমার বুকপকেটে একটা গল্প আছে। আমি বাইরে যাই, ভেতরে আসি, ঘুমিয়ে পড়ি, জেগে উঠি। দিন নেই রাত নেই, গল্পটা সারাক্ষণ আমার শরীর আঁকড়ে থাকে। বুকের ধুকপুকানির সাথে গল্পের বাক্যগুলো মিশে মিশে থাকে। এ গল্পের কথা আমি কাউকে বলি না। গল্পটা কাউকে শোনাই না। আমি ভেবে নিয়েছি যে এই গল্প নিতান্তই বেরসিক, অন্য কেউ শান্ত হয়ে শুনতেও চাইবে না। হয়তো গল্পের অর্ধেক শুনে উঠে চলে যাবে। আধখানা গল্পের শরীর বিচ্ছিন্ন পড়ে থাকবে। আবার ভেবেছি গল্পটা বলে ফেললে তো আর আমার থাকবে না। একান্ত আপন গল্পটা বারোয়ারি সম্পত্তি হয়ে যাবে।
কয়েক যুগ ধরে গল্পটা বুনোটে বেঁধেছে আমায়। আমার দুঃখ, একদিন এই গল্পটাকে বুকে নিয়েই আমি চলে যাব।

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৪

অন্যজীবন

মাঝে মাঝে মনে পড়ে এ সব অর্থহীন। মানবজন্মের কোন উদ্দেশ্য নেই। কেন জন্ম, কেন বিচলতা - তার ব্যাখ্যা নেই।

যখন মানুষ ধীরে ধীরে চাষবাস শিখে নিচ্ছিল, তখন বিভিন্ন নদনদীর তীরে ডেরা বাঁধছিল। ছোট জীবনের ছোট ছোট স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্ন খুন হতে সময় লাগে নি। সভ্যতার মুঠি এসে সেইসব স্বপ্নের শ্বাসরোধ করেছিল। স্বপ্ন মরে গেলে মানুষ মরে যায়। তাই তার ভেতরে জন্ম নিলো রূপকথা। যে রূপকথা বলে যে তার জীবনের অর্থ আছে, আছে উদ্দেশ্য। সে জন্মেছে এই পৃথিবীতে তার পদচিহ্ন রেখে যেতে, নিরন্তর কর্মের মাধ্যমে কিংবদন্তীসম কীর্তি রেখে যেতে। যদিও সেই কীর্তির কিছুই সে দেখে যেতে পারবে না - সেই সত্যটি রূপকথা বেমালুম চেপে যায়। চেপে যায় অসংখ্য মানুষের ভিড়ে তার ব্যর্থ হবার সম্ভাবনার কথা। চেপে যায় যে পথ চলতে চলতেই সে মরে যেতে পারে, কোন কিছু করে ফেলার আগে, একদম হুট করেই। এমনকি যদি সে খুব কীর্তিমানও হয়ে ওঠে, বা জীবদ্দশায় নিজের কর্মের প্রতিদানও পায়, তারপরেও গন্তব্যের শেষে তার জন্য আছে অবধারিত মৃত্যু। যে মৃত্যু ক্ষমাহীন, নিষ্ঠুর, অবিবেচক। মৃত্যুর সময় কোন কীর্তি, কোন ক্ষমতাই তাকে বাঁচাতে পারবে না। এমনকই পারবে না সে মুহূর্তে বিন্দুমাত্র শান্তি দিতে।

এই রূপকথার ক্ষমতা অপরিমেয়। বুদ্ধিমান মানুষকে সে খোকা-ভুলানো মায়ায় বিভ্রান্ত করে রাখে। কিছু কিছু উদ্ভট পাগল হয়তো ফাঁকিটা ধরতে পারে, কিন্তু সভ্যতা তাদেরকে পাগল তকমা দিয়ে রেখেছে আগেই। এ যেন এক ফুল-প্রুফ সিস্টেম। তাই পাগলদের কথায় না ভুলে মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে অলীক রূপকথার স্বপ্নে।

কিন্তু মাঝে মাঝে এমনই কোন অদ্ভুত সময়ে রূপকথার ঘোর কেটে যায়। অলীক পর্দার আড়াল সরে দগদগে ক্ষতের মতো সত্য সামনে চলে আসে। সে সত্যের চাপে দুমড়ে মুচড়ে যায় চারপাশ - সাজানো ঘরদোর, গোছানো জীবন। সভ্য জগতের শেখানো সূত্রের হিসাব মেলে না। প্রশ্ন উঁকি দেয় - হয়তো এই সভ্যতার বাইরেও অন্য জীবন আছে।  যে জীবনের নিয়ম অন্যরকম। যে জীবনে রূপকথা শেখানো হয় না, অলীক বিভ্রম সর্বদা মুড়ে রাখে না। সে জীবনের নগ্নতা সৎ। নিরর্থকতা সেখানে নিত্য-নৈমিকতা।

কে জানে, হয়তো জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ানোর ক্লান্তি নেই বলে সে জীবন রূপকথাচর্চিত জীবনের চেয়ে বেশি "অর্থপূর্ণ।

বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০১৪

স্মারক

সে কোন ভোরে ভেঙেছে স্বপ্ন, অলীক বিভ্রম
হত-স্মৃতি কেন অপরূপ বিষাদ হয়ে
ফিরে ফিরে আসে? কুহকের মতো ডাকে!
'এই ক্ষণিক বাস্তবে স্বপ্নের স্থান নেই'
এ' সত্য কোন সিলেবাসে পড়ায় না কেউ।

অচকিত লাল ছোট্ট পাখি উড়ে গেলে
ওসব মৃত স্বপ্নের কথা মনে পড়ে-
যেন এক বিগত জন্ম, পরাহত দৃশ্য।

মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৪

লজিকন ডায়রি ২

|আগের পর্ব|

বিবর্তন এবং বুদ্ধিমান প্রাণীর কথা এলেই আমরা সাধারণত ডাইনোসর কিংবা অন্য কোন প্রাণী নিয়ে কথা বলি। যারা দাপটের সাথে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমি বরং তার চেয়ে নিকটের কিছু নিয়ে বলি- আমরা যে গোত্রের প্রাণী, সেই গোত্র নিয়ে। পৃথিবীতে হোমো গোত্রের উদ্ভব হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি বছর আগে। হোমো স্যাপিয়েন্স অর্থাৎ আমাদের উদ্ভব হয়েছে মাত্র দুই লাখ বছর আগে। তার মানে হোমো গোত্রের অন্য প্রজাতির স্তন্যপায়ীরা দুই কোটি আটচল্লিশ লাখ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে বেড়িয়েছে, তারপর একে একে বিলুপ্তও হয়ে গেছে। তাদের হাড়-গোড় দেখে আমরা জানতে পেরেছি যে তারা আমাদের অস্তিত্বের চাইতে অনেক অনেক বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে ছিল। এরা অনেকটা আমাদের মতোই ছিল, আমাদের সাথে এদেরই সবচেয়ে বেশি মিল।

এদের বিলুপ্তি কি নির্দেশ করে যে আমরাও একদিন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবো? অন্য কোন প্রজাতি উদ্ভব হবে নাকি? কিংবা ইতোমধ্যে যেসব প্রাণী আছে সেগুলোর কোন একটি থেকে আরেক বুদ্ধিমান/শক্তিমান প্রজাতি এসে পৃথিবীতে খাপ খাইয়ে নিবে? হতে পারে। এমনও হতে পারে আমরা এই গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহে চলে গেলাম। এই গ্রহকে বিষাক্ত করে বসবাসের অনুপযোগী আমরাই করে তুলছি। পৃথিবী নিজেই নিজেকে সুস্থ করে তোলে, তাই আমাদের দূষণ হয়তো সে শুধরে নিতে পারবে। কিন্তু আমরা যেভাবে সংখ্যায় বাড়ছি, সেটাও তো ভয়ানক। এই হারে বাড়তে থাকলে একসময় ব্যাকল্যাশ অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন দুর্যোগ আর অভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে দিতে পারি।

প্রজাতি হিসেবে এইসব লক্ষণ বলে, আমরা হয়তো ডাইনোসর বা অন্য প্রজাতির চেয়ে খুব বেশি বুদ্ধিমান নই। ভবিষ্যতের অন্য বুদ্ধিমান প্রজাতি যখন আমাদের ফসিল পরীক্ষা করবে, তখন হয়তো একই কথা মনে করবে। দাপুটে, কিন্তু বেকুব।

পৃথিবীতে আমাদের আপেক্ষিক স্থায়িত্ব বুঝতে নিচের ছবিটা ভাল নির্দেশক হতে পারে। বড় করে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।



We love to think we are special, but the history of science suggests otherwise.

আমাদের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো আমরা লিখতে-পড়তে পারি। আমরা আমাদের চিন্তা-ভাবনা-কাজ-সৃষ্টি রেকর্ড করে রাখতে শিখেছি। এই একটি বৈশিষ্ট্যই আমাদের অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে। মানব প্রজাতি গত এক লাখ পঁচানব্বই হাজার বছরে কতোটুকু এগিয়েছিল? আর গত পাঁচ হাজার বছরে কতোটুকু এগিয়েছে? এটা তুলনা করলেই বুঝতে পারি যে আমাদের অভিনবত্ব কোথায় লুকানো আছে। অন্য প্রজাতির থেকে বহু বহু গুণ এগিয়ে এসে আমাদের ভেতরে আত্মম্ভরিতার (self-aggrandizement) জন্ম হয়েছে। আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব ভাবতে শুরু করেছি। এই মিথ্যাটি এতো শক্তিশালী কারণ এটা একজন উচ্চারণ করা মাত্রই যারা শুনছে সবার মগজে একটা আরামের রাসায়নিক ক্রিয়া হয়। আমি জানি না প্রথম কোন মানুষ এই কথাটা বলেছিল, কিন্তু যারা তার আগে এভাবে ভাবে নি, তারা এটা শোনামাত্রই ভাবতে শুরু করেছিল, সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ধীরে ধীরে এটা ধর্মীয় বাণী হয়ে গেছে! অনড়, অটল, অলঙ্ঘনীয়! কিন্তু উপরেই ব্যাখ্যা করেছি যে আমরা আসলে অন্য প্রজাতির চাইতে খুব বেশি এগিয়ে নাই, এবং আমাদের বিলুপ্তিও just around the corner!

ভবিষ্যত বিলুপ্তি ছাড়াও আরেকটি যুক্তিতে ব্যাখ্যা করতে পারি যে আমরা আসলে ততোটা স্পেশাল কিছু না। এই পরীক্ষাটা ডোরিওন স্যাগান তার বইতে ব্যাখ্যা করেছেন, আমি তুলে দিচ্ছি। ধরুন, এই মুহূর্তে স্পেসশিপে চড়ে কোন উন্নত বুদ্ধিমত্তার এলিয়েন আসলো পৃথিবীতে, যেমন বিভিন্ন হলিউডি মুভিতে দেখায়। তাদের হাতে প্রফেসর শঙ্কুর এনাইহিলিশন গান, যে বন্দুকের গুলিতে টার্গেট হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ধরি এলিয়েনরা আমাদের একটুও পছন্দ করলো না। আমাদের দিকে গানটা তাক করে প্যারামিটার সেট করলো "এনাইহিলেট হোমো স্যাপিয়েন্স"। চিন্তা করুন তো গুলি করা মাত্রই আমরা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবো। কিন্তু আমাদের শরীরের ভেতরে বসবাস করা কোটি কোটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ইত্যাদি কোথায় যাবে? বন্দুকে তো তাদের মারতে বলা হয় নি। গুলি করা মাত্র আমাদের কোষ-কলা-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উবে যাবে। কিন্তু আমাদের অবয়বের আদলে ওসব প্রাণী রয়ে যাবে। আমাদের ত্বকের ভেতরে থাকা ভাইরাস, পেটের ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়া, আর সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অণুজীব কিলবিল করতে থাকবে আগের মতোই। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এরা প্রায় সকলেই মানব-দেহের ওপর নির্ভরশীল, খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য। আমাদের শরীরটা না থাকলে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। তার মানে আসলে আমরাও এসব প্রাণী ছাড়া টিকতে পারবো না। টেকা দূরের কথা, এরা আমাদের শরীরে আছে বলেই আমরা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারি, নাহলে জন্মের সাথে সাথেই আমাদের মৃত্যু হতো। জন্মই হতো না, শুক্রাণু আর ডিম্বাণু মিলে জাইগোটটাই তৈরি হতো না, বাকি সব তো দূরের কথা। তার মানে আমরা আমাদের যে অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার করি, তা একেবারেই ঠুনকো। যেসব অণুজীবকে সামান্য বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি, তারা আমাদের জন্মের পরিবেশ তৈরি করে দেয়। শুধু তাই না, বিবর্তনের সময়ের হিসেবে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রজাতি হিসেবে আমরা তাদের বয়সের তুলনায় নেহাতই দুগ্ধপোষ্য শিশু!

তাই পৃথিবীতে প্রাণের অতীত বা ভবিষ্যত দেখলে আমাদের প্রজাতির অস্তিত্ব ও গুরুত্ব তেমন বেশি কিছু না। এই কঠিন সত্যটা মেনে নিতে আমাদের অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু তিক্ত সত্য এটাই।

এখন কথা হলো এইটা এতই জরুরি কেন? কারণ ডোরিওন স্যাগানের মতে আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কম্পাস হারিয়ে ফেলছি। আমাদের তাড়না, প্রেরণার ক্ষেত্র খুব দ্রুত বদলে গেছে। যুদ্ধ একটা বড়ো কারণ, অস্থিরতা এবং অর্থনীতি আরেকটা কারণ। আর রাজনীতি তো আছেই। এসবের প্রভাবে আমাদের সামষ্টিক সমাজে বিজ্ঞান ও গবেষণার চেহারাটা সুখকর বা হিতকর না। প্রজাতি হিসেবে আমরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করছি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে শুরু করে নানাভাবে আমরা একমাত্র বাসস্থানের তেরোটা বাজাচ্ছি। নিজেরাও মারামারিতে এতো ব্যস্ত যে শান্তিমতো বসে চিন্তা করার সুযোগটাও হচ্ছে না। আবার পৃথিবীর বাইরে কোথাও আরেকটা আবাসও সেভাবে খোঁজা হচ্ছে না। আর সব যুদ্ধ থামালেও অচিরেই আমাদের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য প্রজাতি এবং আমাদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর বাইরে কলোনি/আবাস বানাতেই হবে। সেদিকেও কাজ হচ্ছে না। আমরা এই অসীমতুল্য মহাবিশ্বের নামমাত্র বিচরণ করেছি, অতোদূর আমাদের ক্ষমতাও হয় নি এখনো। কিন্তু যেটুকু দেখা হয়েছে, সেটাও পুরোপুরি সঠিকভাবে দেখা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটা ভজঘট।

আর এই আলস্য এবং অপারগতার মূল প্রভাবক আমাদের আত্মতুষ্টি আর আত্মগরিমা। আমরা প্রজাতি হিসেবে ক্ষুদ্র ও সীমিত, এবং ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের পথে আমাদের প্রয়াসগুলো ভুলদিকে যাচ্ছে। এটাকে চিহ্নিত করতে হবে, সত্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। এর মাধ্যমেই হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে এই চেতনা ছড়ানো সম্ভব।

[লেখাটা ডোরিওন স্যাগানের কথা দিয়ে শুরু হলেও শেষের অংশটুকু আমার নিজের চিন্তা চলে এসেছে। তার বই Cosmic Apprentice -এর প্রথম অধ্যায়টা এই লিংকে পাবেন।]

রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

লজিকন ডায়রি

আজকে আমাদের ক্যাম্পাসের "লজিকন" (LogiCon) ছিল। এটা অনেকটা কমিকন-এর মতো উৎসব, মূলত ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে বিজ্ঞান, সংশয়বাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন বক্তা এসেছিল। আমি আগ্রহ নিয়ে গেলাম কারণ কার্ল স্যাগানের ছেলে ডোরিওন স্যাগান আসবেন key-note speaker হিসেবে কথা বলতে। কিন্তু তার চাইতেও ভাল লাগলো আরেকজনের কথা।

সারাদিনের অনুষ্ঠান, কিন্তু ছুটির দিনে সকালে আলস্য নিয়ে উঠতে উঠতেই দুপুর। লাঞ্চের পর গেলাম, দেড়টার দিকে ড্যারেল রে মঞ্চে উঠলেন। বিষয়টা ছিল যৌনতা ও লিঙ্গের বিবর্তন। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার-স্যাপার। অভিজিৎ রায় একটা ব্লগ সিরিজ (পরে যেটা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে) লিখেছিলেন, "সখী ভালোবাসা কারে কয়"। সে সিরিজটা পড়ে কিছু কিছু বিষয়ে জানা ছিল, তবে আজকে ড্যারেলের স্পিচ থেকে আরো নতুন নতুন বিষয়ে জানলাম। বিবর্তনের ধাপে আমাদের মাসতুতো ভাই জানতাম গরিলা আর শিম্পাঞ্জিকে। বোনোবো নামে আরেক মাসতুতো ভাই আছে যার কথা প্রথম শুনলাম। এবং বোনোবোর সাথে আমাদের মিলই বেশি!

ড্যারেল লোকটা খুবই মজা করে কথা বলেন। আরকানসাস একটা গোঁড়া রিপাবলিকান স্টেট। তিনি নিজেও ক্যানসাস স্টেটের মানুষ, আশির দশক পর্যন্ত চার্চের সাইকোলজিস্ট ছিলেন। আর এখন ধর্মত্যাগী মানুষদের কাউন্সেলিং করেন। এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মতই আচরণ করে। সমাজে ধর্মের প্রভাব, কুসংস্কার, বর্ণবাদ, এগুলো অনেক তীব্র। চার্চের সামাজিক ক্ষমতাও প্রবল। এখানে সমকামিতা পাপ, গর্ভপাত অবৈধ। এরকম বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠা যে কারো জন্যই ধর্মত্যাগের জন্য যথেষ্ট মোটিভেশন লাগার কথা। ড্যারেলের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছেড়ে দেয়ার পেছনে তার পেশার অভিজ্ঞতা একটা বড় প্রভাবক ছিল বলে মনে হলো।

পেশার কারণে বিভিন্ন মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্ব নিয়ে সরাসরি কাজ করেছেন তিনি, আর নিজের ভেতরেও এমন ধর্মের দমন-পীড়ন অনুভব করেছেন নিশ্চয়ই। যেমন, যৌনতার সাথে ধর্মের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এজন্য ধর্মের ভেতরে থাকা মানুষ যৌনতা নিয়ে কথা বলতে অসম্ভব লজ্জা, অস্বস্তি এবং বাধা বোধ করেন। ধর্ম যৌনতাকে ধামাচাপা দিতে চায়, যা আসলে প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব্যাপার। এই পীড়ন এতোটাই প্রবল যে নিজের জীবনসাথীর সাথে যৌনতার ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করেন না অনেকে। এই দমনের কারণে শিশু ও কিশোর-বয়সীরা সঠিক যৌনশিক্ষা পায় না। বেশিরভাগই এতটাই অজ্ঞ থাকে যে কোন পারভার্ট যদি সেক্সুয়াল এবিউজ করে, সেটা ঠেকানো তো দূরের কথা, বুঝতেও পারে না। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যেমন, যৌনতার এই অবদমনের কারণে যৌনবিকারগুলোর ছড়াছড়ি দেখা যায় বেশি। দেখা গেছে, যে স্টেটে এই দমনমূলক আচরণ কম, সেখানে বিকারগুলো কম। যেখানে স্কুলে-কলেজে সঠিক যৌনতা শেখানো হয়, সেখানে ধর্ষণ কম, ইন্টারনেটে পর্ন খোঁজার পরিমাণও কম। এসব ডেটা নির্দেশ করে যে যৌনতার আলাপকে ডাল-ভাত খাওয়ার মতো ব্যাপার না বানালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

যারা এরই মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে যৌনতার ট্যাবু কাটাতে পেরেছেন, তাদের মাঝেও অনেক সময় ছোটবেলার শেখা আচরণের কিছু কিছু থেকে যায়। যেমন নিজের শরীর নিয়ে লজ্জা বা অস্বস্তি। অন্য একজন মানুষকে ভালোবাসার আগে নিজেকে ভালোবাসা জরুরি। আমি এই পৃথিবীতে একবারই জন্মাবো, আর এই জন্মে আমার শরীর একটাই। সেই শরীর বোঝা হয়ে গেলে বেঁচে থাকাই তো দুস্কর, তাই না? তাই নিজের শরীরটাকে সবার আগে ভালোবাসা লাগে। এটা আমাদের ধর্মে নিষেধ করে। প্রায় সব ধর্মেই করে। নিজের শরীরকে আরাম দেয়া এক গর্হিত অপরাধ! অথচ কোন যুক্তি হয় না। ধার্মিক হলেও এটা চিন্তা করা উচিত, যে আপনাকে যা মানতে বলা হচ্ছে, তা মেনে আদৌ কোন উপকার হচ্ছে, নাকি ক্ষতি হচ্ছে।

আরেকটা বড়ো ট্যাবু হলো নারীর যৌনতা। এইটা যেন একটা রূপকথার ইউনিকর্ন! যেন নারীর কোন যৌনতা থাকতেই পারে না। সে হবে পুরুষের যৌনতা মেটানোর মাধ্যম মাত্র। অথচ নারী, পুরুষের মতোই যৌনতাবোধ করে। এটা পুরুষকে যেমন জেনে ও মেনে নিতে হবে, তেমনি নারীকেও বুঝতে হবে। নারী বা পুরুষ, সর্বোপরি মানুষ হলে তাকে অপর একজন মানুষের যৌনতার ব্যাপারে নন-জাজমেন্টাল অবস্থান আমাদের প্রজাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষ তো সুবিধাবাদী আর ক্ষমতাবান বলে নারীর ব্যাপারটা বুঝতে চায় না। সেটা তবু আমি বুঝতে পারি। ধনী কখনো গরীবের কষ্ট বুঝে না। দুঃখের ব্যাপার হলো, নারীও বুঝতে চায় না। নারী হয়েও আরেক নারীর যৌনতার প্রকাশকে পুরুষের মতো করেই নিন্দা করে। বেশি দূর যেতে হবে না, আমাদের আশেপাশেই এরকম উদাহরণ পাবেন। নারীর পোশাক ও জীবনধারণ নিয়ে কথা বলার সবচেয়ে বড় ঠিকাদারিটা অন্য নারীরাই নেন। এই ভণ্ডামি আর কতোদিন!  

এই আলাপটা বেশ গুরুগম্ভীর বিষয়, কিন্তু পুরো টক-টা এরকম ছিল না মোটেও। এগুলো ফাঁকে ফাঁকে এসেছে। মূল ফোকাস ছিল এই যে জীবদেহের সবচেয়ে দ্রুত বিবর্তিত জিনগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য এবং বিভিন্নতায় যৌন-জিনগুলোই সবচেয়ে এগিয়ে। অর্থাৎ, প্রাণী ও উদ্ভিদে যৌন-জিন সবচেয়ে তাড়াতাড়ি বিবর্তিত হয়। এই জিনের প্রভাব বাহ্যিক হতে পারে (যৌন-অঙ্গের আকার ইত্যাদি), কিংবা হতে পারে আভ্যন্তরীন (যৌন-আচরণের বিচিত্রতা)। বংশগতি বা heredity এর কারণে নিজের সবচেয়ে সফল জিনকে যেমন আমরা পরের প্রজন্মে দিয়ে দিতে চাই। এই চেষ্টাটা মাধ্যম যৌন-অঙ্গ এবং যৌন -আচরণের ওপর নির্ভর করে বলেই এরা আশেপাশের পরিবর্তনের সাথে দ্রুত বদলে যায়।

একটা মজার জিনিস দেখলাম, আগেও জানতাম, কিন্তু এভাবে খেয়াল করি নি। ফুল আসলে উদ্ভিদের যৌন-অঙ্গ। আমরা যখন কোন গোলাপ নাকে ঠেকিয়ে গন্ধ নিচ্ছি, তখন আসলে ঐ গাছের যৌনাঙ্গে নাক ঠেকাচ্ছি। (এর পরে ফুলের গন্ধ নিতে গিয়ে কারো 'eww' লাগলে আমি দায়ী না!)। আরেকটা "পোয়েটিক" ব্যাপার হলো মানুষ প্রেমের সময় একে অপরকে এই ফুল দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। খুবই ইন্টারেস্টিং না?

গাছের ফুলের মতো প্রাণীর যৌন-অঙ্গ ও আচরণও বিচিত্র রঙ-ঢঙে ভরা। শুধু স্তন্যপায়ী এবং আদি-বানরের উত্তরসূরী চারটা প্রজাতির মাঝেও বিচিত্র সব আচরণ দেখা যায়। এগুলোর প্রায় সবই অভিজিৎ ভাইয়ের ব্লগে চলে এসেছে, আমি আর বিস্তারিত বললাম না। আগ্রহীরা লিংকের সিরিজটা দেখে নিয়েন।

এরকম উৎসবে গেলে অনেক কিছু জানার পাশাপাশি পুরা চিন্তার জগতে একটা ওয়াশিং মেশিন ইফেক্ট হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্স করার জন্য তাই এগুলোর দরকার আছে। ডরিওন স্যাগান সেই জায়গায় একটা টোকা দিয়েছেন। সেটা নিয়ে সামনে লিখবো!

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

বাণিজ্য

[এই পোস্টটি অনেকক্ষণ ভেবে দিচ্ছি। একান্তই নিজস্ব ভাবনা। লিপিবদ্ধ করে রাখা দরকার মনে করি, আর অন্যদের এই বিষয়ে ভাবনা জানারও আগ্রহ হচ্ছে কিছুটা।] 

প্রথমেই রায়হান আবীর মনে করিয়ে দিল স্ট্যাটাসে যে, “আমরা যা, তা-ই আমাদের সংস্কৃতি” (তথ্যসূত্র/কপিরাইটঃ সামাজিক বিজ্ঞান বই)। এই সুযোগে ওকে ধন্যবাদ দিয়ে নিতে চাই। ডামাডোলে ভুলে যাই এসব সহজ সংজ্ঞা। ছোটবেলায় কত দ্রুত এসব মুখস্ত করতাম, এখন জীবনের পথ চলতে গিয়ে পদে পদে এসব সংজ্ঞার পুনঃপাঠে উপকৃত হই। ভাবি, ভাগ্যিস ছোটবেলাতেই শিখেছিলাম! নয়তো এখন বিভিন্ন জটিল মতামতের তোড়ে খাবি খেতে হতো।
প্রথমে একটু ভূমিকা দেই। দশক বিচারে বাংলাদেশের তরুণদের চরিত্র নিয়ে ভাবছিলাম। আশির দশকে বিশ্ববেহায়া আর্মির চোরটার কারণে যে দমন পীড়ন নেমে এসেছিল, তার প্রতিবাদে তরুণ সমাজের ভেতর একটা চাপা বিদ্রোহ সূচিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে সেই বিদ্রোহ ক্ষোভের মতো বেরিয়েও আসতো। রাজনীতি নিয়ে সচেতনতা কতোটা ছিল জানি না, কিন্তু এটা জানি যে বুদ্ধিজীবী সমাজের পা-চাটা কিংবা ভয়ে ভীত হবার স্বভাব তরুণদের মধ্যে ছিল না। তৎকালীন লীগ কিংবা বিএনপির নেতারা কতোটা সক্রিয় ছিলেন, তার কথা জানি না, তবে তরুণদের সাথে তাদের একটা দূরত্ব হয়তো তখন থেকেই তৈরি হয়েছিল। এ কারণে চোর স্বৈরাচারটার বিরুদ্ধের আন্দোলনে সর্বাগ্রে সক্রিয় ছিল ছাত্রসমাজ, রাজনীতিবিদেরা নন। 

নব্বুইয়ের দশক সে তুলনায় বড়ই হতাশার। স্বৈরাচার গেছে, আমলারা এসেছে। প্রাতিষ্ঠানিক দূর্নীতি আর অরাজকতা চেপে বসেছে। ডানপন্থা ধীরে সামরিক উর্দি খুলে ব্লাডি সিভিলিয়ানের পোশাক পরে ভিড়ে মিশে গেছে। জামাত চলে এসেছে সংসদে। শিবির ছড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে। সম্ভবত এই দশক তরুণদের অবক্ষয়ের দশক। সম্মুখে কোন প্রকাশ্য শত্রু নেই। ঘাড়ে হাত দিয়ে যে ছেলে-মেয়ে বসে আছে, গোপনে সে-ই শত্রুশিবিরে নাম লিখিয়েছে। আশির দশকের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে মূলধারার রাজনীতিবিদেরা। তরুণদের সাথে যেহেতু তাদের দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্র মেলে না, তাই তরুণদেরকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্নীতিতে শেখাতে ছাত্র সংগঠনগুলো বটগাছের মতো শেকড় ছড়িয়ে দিল। পলিটিক্স তাই হয়ে গেল খারাপ, রাজনীতিসচেতনতা চলে গেল ক্রায়োজেনিক চেম্বারে।

শূন্য দশকের শুরুতেই আমরা বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রসার দেখেছি, তার পেছনে তরুণদের রাজনীতিমনস্কতার অভাব অন্যতম ভূমিকা পালন করে। এক দশকের অজ্ঞান প্রজন্ম তৈরি করেছে শূন্যস্থান, আর সেই শূন্যস্থানে জায়গা করে নিয়েছে জামাত, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, শিবির, বাংলা ভাই, আবদুর রহমান শায়খরা। বোমার পর বোমা ফেটেছে বাংলাদেশে। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সিনেমা হল অবধি; প্রতিটি জেলায়। এই পুরো সময়টায় স্বৈরাচারী চোরটার মতোই একটা দানবের জন্ম ও বিকাশ হয়েছে। পার্থক্য হলো, স্বৈরাচার চোরটা সামনে ছিল, আর জঙ্গিরা ছিল আড়ালে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই হয়তো তরুণদের এক দশক দেরি হয়েছে। শূন্য দশকের শেষ দিকে এসে যে সামরিক শাসন ফিরে এলো ব্লাডি সিভিলিয়ানের পোশাকে, সেটা দেখেই বোধহয় তাদের টনক নড়েছে। ২০০৮ এর নির্বাচনে তরুণরা তাই চালকের ভূমিকা নিয়েছে আবার। চিন্তা করুন, মাত্র ছয় বছর আগেও যদি কেউ বলতো, বাংলাদেশের মাটিতে জামাতের লিডারকে ফাঁসি দেয়া হবে বিচারের পর, সেটা কি কেউ বিশ্বাস করতো? আপনি নিজেও কি করতেন? আমি অন্তত করতাম না। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে তরুণদের কারণেই। 

গত তিরিশ বছরের সমাজে তরুণদের এই প্রভাবকে তাই উপেক্ষা করার উপায় নেই। গত বছর শাহবাগ দেখে যেমন আমরা বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছি সেটাও তো তরুণদেরই আন্দোলন। কিন্তু এখন, প্রায় এক বছর পরে এসে পেছনে ফিরলে মনে হয় এই আন্দোলনও এক দিনের নয়। কোন একটা আদর্শের রূপরেখা আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর চলনশীল রয়েছে। এক দশকের তরুণরা মধ্যবিত্ত সংসারী হওয়ার সময় সেই আদর্শটিকে পরের দশকের তরুণদের হাতে তুলে দিয়ে যায়। যে নবতরুণ কৈশোরে দর্শক ছিল, তারাই দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। এই চক্র বাংলাদেশে চলমান।



আমরা প্রথম দশকের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছি। ‘৮০, ‘৯০, ‘০০ এর চাইতে ‘১০ একটু আলাদা হয়ে উঠেছে। হয়তো শাহবাগের কারণেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে তরুণদের হৃত রাজনৈতিক চেতনা আবার ফিরে আসছে। তারা সচেতন হয়ে উঠছেন একদম তৃণমূলের রাজনীতি নিয়েও। কোথাকার কোন এমপি কোন এক অনুষ্ঠানে সিগারেট খেয়েছেন, সেই ছবিটি কেমন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ক্ষোভের আঁচে তাকে সর্বসমক্ষে মাফ চাইতে হলো। ঘটনাটি অভূতপূর্ব। আমার জানামতে আমাদের পূর্ববর্তী কোন তরুণ এই পর্যায়ের জবাবদিহিতা আদায় করতে পারে নি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইন্টারনেট সবাইকে একটি কণ্ঠ দিয়েছে, এর সুবিধা তরুণরা সবচেয়ে বেশি গ্রহণ এবং কার্যকরভাবে করতে পারছে। রাজনীতিবিদেরাও দ্রুত অনুধাবন করছেন যে তাদের প্রাইভেট লাইফটি আর প্রাইভেট নেই। এটা পাবলিক হয়ে গেছে। এখন আমরা যেমন খালেদা জিয়ার লুপ্ত প্রাসাদের ছবি গুগল করলেই দেখতে পাই, তেমন হাসিনা পোলাও রান্না করছে সেটাও দেখতে পাই। এমন সহজলভ্যতা আসলে রাজনীতিবিদদের মিথ থেকে মানুষে পরিণত করছে। আমার অনুমান আর দশ বছরের মধ্যেই আমরা এখনকার তরুণদের অনেককে সক্রিয়ভাবে দেখতে পাবো। তাদের ফেসবুক ফলোয়াররাই মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করবে! (একটু বেশি বলে ফেললাম নাকি?)

শাহবাগের কারণে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। সেটা হলো বাংলাদেশি বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের মেরুকরণের তীব্রতা। “জামাত-বিএনপি” মতবাদের বিশ্বাসীরা ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। শাহবাগকে বিভ্রান্ত করতে তাদের সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার ছিল ধর্ম। তারা সেটা সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে। অশিক্ষিতের মতো শাহবাগের পক্ষ-বিপক্ষ সবাই নিজেদের দাড়ির দৈর্ঘ্য এবং পাজামার গিঁটের টাইটনেস মাপতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে আওয়ামী লীগ শাহবাগের নন-পার্টিজান চেহারাকে ভয় পেতো, কিন্তু জামাত-বিএনপির আঘাতের পরে তাদের জন্য এটাকে নিজেদের আন্দোলন বানানো সহজ হয়ে পড়ে। টুপিপরা শাহবাগ তাই হয়ে যায় হাসিনার শাহবাগ। দুর্ভাগ্য যে তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা এখনো ততোটা পোক্ত হতে পারে নি, তাই শাহবাগের নন-পার্টিজান অবয়ব তারা টিকিয়ে রাখতে পারলো না। মাঠে এটা হয়ে দাঁড়ালো লীগ বনাম জামাত-বিএনপির দাবাখেলা। এই খেলাটা বুঝতে পেরে যারা সেই খেলার বিরোধিতা করেছিল, তাদেরকে কল্লা কাটা হলো, জেলে পোরা হলো। যেহেতু এই বুঝদারদের কোন রাজনৈতিক মামা নেই, সেহেতু অসহায়ের মতো এই মৃত্যু আর বন্দিত্ব দেখা ছাড়া আমাদের (হ্যাঁ, আমি নিজেকে নিষ্ক্রিয়ভাবে হলেও, এই অংশের একজন মনে করি।) কিচ্ছু করার ছিল না। ব্লগে ব্লগে প্রতিবাদ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু আসলে কোন লাভ হয়েছে বলে আমার নজরে পড়ে না। সরকার বাহাদুরের যেদিন ইচ্ছা হয়েছে, সেদিন ব্লগারদের ছেড়েছে। যেদিন ইচ্ছা হয়েছে, শাহবাগের মঞ্চ ভেঙে দিয়েছে। জামাত-বিএনপি তাদের নিজেদের নেতাদের বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে গেছে… 

কথায় কথায় প্রসঙ্গ থেকে সরে গেছি। বাংলাদেশি বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের মেরুকরণ নিয়ে বলছিলাম। আমাদের তরুণ সমাজের ভেতরে (অন্তত ইন্টারনেটে সচল অংশে) স্পষ্টতই একটা দূরত্বের জায়গা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের চিন্তা, আরেকদিকে প্রতিক্রিয়াশীল জামাতি চিন্তা। এবার একটু ভেঙে চুরে দেখি।

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের চিন্তা মানে আওয়ামী লীগের চিন্তা না। তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্য করে। এই বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে ‘০৮-’১৩ সরকারের আমলে। রীতিমত কর্পোরেট বাণিজ্য কোম্পানিগুলো যেমন ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ও বিজয় দিবস নিয়ে বাণিজ্য করে, ঠিক তেমনি বাণিজ্য করে আওয়ামী লীগ। যে শেখ মুজিব পুরো জাতির অংশ, সেই মুজিবকে তারা নিজেদের পকেটে পুরে রাখতে চায়। স্পষ্টতই তাদের অন্য কোন অনুকরণীয় নেতা নাই। শেখ মুজিবকে সপরিবারে এবং চার নেতাকে জেলে হত্যা করার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করেছি যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা জন্মাতে পারবে না। আওয়ামী লীগে যা আছে, তা হলো রাজনৈতিক বেনিয়া, যাদের কাজ বাণিজ্য করা। আর তাদের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যের দোসর হলো ভারত। কারো কারো জন্য চীন। আর এই বাণিজ্যে তরুণদের অধিকাংশেরই কোন ভাগবাটোয়ারা নেই। 

প্রতিক্রিয়াশীল জামাত চিন্তা মানে কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা না। এর সাথেও যুক্ত হয়েছে বাণিজ্য। বাণিজ্যটি ধর্ম ও গোঁড়ামোর। বিএনপি এবং জামাত উভয়েই জানে যে এখনকার স্মার্ট তরুণ “সাইফুর রহমান” (কাল্পনিক) খুব বেশি নীতিবাক্য কিংবা ধর্মীয় নৈতিকতা শুনতে চায় না। প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়তে বললে বিরক্ত হয়। কিংবা ভোগবিলাস ছেড়ে সমাজ ও দেশের কাজ করতে বললে, বিদেশ না গিয়ে দেশে সরকারি চাকুরি করতে বললে সে উল্টে দৌড় দিবে। এখনকার স্মার্ট তরুণ “সাইফুর” স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং তার আছে ইন্টারনেটে ফেসবুক। তাই জামাত ও বিএনপি তাকে ধর্মীয় রস দিয়ে কাছে টানে। ওড়না পেইজ দিয়ে কাছে টানে। মুসলমানিত্ব দিয়ে কাছে টানে। কোরানের দুইটা আয়াতের পাশাপাশি সে নারীর পর্দা নিয়ে তিনটা ভুয়া হাদিস শেয়ার দেয়। শাহবাগে মদ গাঞ্জা খাওয়া হয় – এই শেয়ারের পাশাপাশি ইন্ডিয়ার বিএসএফ-এর অত্যাচারের ছবিও শেয়ার দেয়। এই ফেসবুক জীবন জামাত-বিএনপির কাজ অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। 

আমি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের চিন্তা বলতে যে অংশটির চিন্তাকে চিহ্নিত করছি, যারা আওয়ামী লীগের এই বাণিজ্যের খেলার বিরোধিতা করে এবং জামাত-বিএনপির ধর্মের মুলার সাথে বাংলাদেশি মুসলমানিত্বের বাণিজ্যের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয়। মুক্তিযুদ্ধ ‘সময়ের প্রয়োজনে হয়েছিল’, কিংবা ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়েছিল’ এবং জনপ্রিয় মতবাদের সাথে আমি একমত না। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ গড়ার আকুতি থেকে। প্রত্যক্ষ কারণ ছিল পাকিস্তানের আর্মির গণহত্যা, যুদ্ধের আগে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ। কিন্তু অন্তর্নিহিত আকুতিটি ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার, যেখানে সংখ্যালঘু বলে কোন জাতিগোষ্ঠী বা নাগরিককে নির্যাতিত হতে হবে না। বুঝতেই পারি, সেই রাষ্ট্রের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে, আর বাস্তব হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক হত্যা, অ্যাসাসিনেশন, জেলহত্যা, সামরিক শাসন, আমলাতন্ত্র ও রহমান ডাইনেস্টিদ্বয়ের শাসন। এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নকালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরে আসতে হবে। আর এজন্যই শাহবাগ জরুরি। শাহবাগ সেই কণ্ঠস্বরটিকে স্থান দিয়েছে। সূচনা হয়েছে জামাত-বিএনপির বাংলাদেশি মুসলমান তত্ত্বের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্বের। জামাত-বিএনপির তত্ত্ব ছড়াতে সময় লেগেছে প্রায় ২৪ বছর বা দুই যুগ। আশা করি, ধর্মনিরপেক্ষতার জয় আর দুই যুগের আগেই হবে!

জয় বাংলা! 

[পরিশিষ্টঃ লিখতে বসেছিলাম এক বাণিজ্য (ক্রিকেট ও সঙ্গীত) নিয়ে, লিখে ফেললাম আরেক বাণিজ্যের (রাজনীতি) কথা। পারপেচুয়াল আউট অফ টপিক অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে মনে হয়!]

মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০১৪

অর্থহীনালাপ

আমি আমার বন্ধুদের অতীত অবয়বগুলোর জন্য প্রবল আকুতি ও বেদনাবোধ করি।


তাদের বর্তমান অবয়ব আমার সাথে মেলে না। শুধু অমিলই না, রীতিমত বিপরীত প্রবণতা দেখি তাদের ভেতরে। এজন্য আমি প্রথম প্রথম খুব ক্ষুব্ধ হতাম। কারণ অতি-পরিচিত এই বন্ধুদের সাথেই তো বেড়ে উঠেছি। আমার সত্ত্বার সাথে তারা মিশে আছে। আমার চিন্তাভাবনার অনেকটাই তাদের ঘিরে গড়ে উঠেছে। এখন হয়তো আমার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু আমি বেড়ে ওঠার সময়টায় তাদের প্রভাবকে কখনই অস্বীকার করি না। অথচ এখন পৃথক ব্যক্তিত্বের কারণে দেখি যে তাদের সাথে আমার মানসিক দূরত্ব যোজন যোজনের। এরকম দূরত্বের কারণে প্রায়ই সম্পর্ক খারাপ হয়। দেখা যায় বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থেকে তর্ক, সেই তর্ক শেষ হয় কথা বন্ধে। যেহেতু আলাপটা সামনাসামনি না, সেহেতু মীমাংসা হয় না। আমার ধারণা মুখোমুখি আলাপে আমি যতোটা মিশুক বা নমনীয়, ভার্চুয়াল জগতে ততোটা না। তাই বিকট তর্কের শেষে সম্পর্কটা টানাপোড়েনে পড়ে যায়। ভার্চুয়াল জগতের কারণে একটা ভ্রান্তিও কাজ করে, যার কারণে এই ক্ষতিটা গায়ে লাগে না। অবধারিতভাবে আমি ব্যস্ত হয়ে যাই আমার জীবনযাপনে। তারা ব্যস্ত হয়ে যায় তাদের জীবনে। হয়তো অনেকদিন পর খেয়াল করি যে সেই বন্ধুদের সাথে আর কোন আলাপের বিষয়ও নেই। তাদের বর্তমান চেহারাটা এতোটাই অপরিচিত লাগে যে আমি বুঝতেও পারি না কীভাবে পুনরায় যোগাযোগ করা যায়। আমি নিশ্চিত, আমার চেহারাটাও তাদের কাছে অচেনা লাগে। এভাবে অনেকগুলো অপরিচিত মানুষ আমার চারপাশ ঘিরে রাখে। প্রতিটা মানুষের পুরানো একটা রূপ আমার খুব প্রিয়, নানা কারণে। সেই রূপগুলো আর ফিরে পাই না। আস্তে আস্তে স্মৃতিও ফিকে হতে শুরু করবে। ভালো হতো যদি তাদের বর্তমান রূপের স্মৃতি ফিকে হতো, আর পুরানো স্মৃতিগুলো টিকে থাকতো। কিন্তু ঘটে উল্টোটা। নতুন রূপ এসে হটিয়ে দেয় পুরানো রূপ।

আজকাল রাতের খাবার একটু আগে আগে খেয়ে নিই, সন্ধ্যা হতেই। সন্ধ্যার পরের সময়টা একটু লম্বা হয়ে যায় এতে। কাজকর্ম বাকি থাকলে সেরে ফেলা যায়। মাঝে মাঝে এরকম বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে দেশের কথা ভাবি। দেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমার কাছে দেশ ছেড়ে আসার চেহারাটাই স্থির হয়ে আছে। দেশের পরিবর্তন কল্পনায় যেমন ভাবি, সেভাবে নিশ্চয়ই ঘটছে না। যেভাবে যা ঘটছে, সেগুলোর একটা বিশেষ চেহারা অনলাইন থেকে দেখতে পাচ্ছি। হয়তো খবরের ওয়েবসাইটে, কিংবা টিভির খবরের ভিডিওতে, কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে। এগুলো আসলে খণ্ডিত অংশ। এবং আমার নিজের চিন্তাভাবনায় সেগুলোর প্রবেশ ঘটে নিজের মতো একটা অবয়ব দাঁড় করাচ্ছে যা বাস্তব থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। এটা আমি একেবারেই মেনে নিতে পারছি না।

আমার কাছে বিদেশ একটা ছন্নছাড়া অনুভূতি ছাড়া কিছুই না। ছোটবেলা থেকে বাইরে বাইরে থাকার কারণে অভিযোজিত হতে সময় লাগে নি। আর পশ্চিমা বিনোদনের সুবাদে অনেক কিছুই পূর্বপরিচিত ছিল। যে সংগ্রাম বা সয়ে নেয়া, সেটাও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে দ্রুতই। কিন্তু দেশের জন্য পেট পোড়া কমছে না। একটা ভাগ হলো বাবা-মা-বোন এবং সংসারের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর সাথে সাময়িক বিচ্ছেদের কষ্ট, আরেকটা ভাগ হলো দেশে থাকার আপন স্বস্তি। জ্যাম ঠেলে বইমেলায় যাওয়া, কিংবা কোন কাজে শাহবাগের আশেপাশে গেলে আজিজে একটু আড্ডা দেয়া, অথবা অফিসের পরে বাসায় ফিরে মিরপুরের আড্ডা। মজার ব্যাপার হলো এই ভাগটা ভার্চুয়াল জগতের কারণেই তৈরি হয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হলো এই জগতের পরিচিত আপন আপন লাগা মানুষগুলোর সাথে যতো আত্মিক যোগাযোগ বেড়েছে, ততোই আমার পুরানো বন্ধুদের নতুন অবয়বের সাথে দূরত্ব বেড়ে গেছে। সমান্তরাল মসৃণ প্রক্রিয়া।

এগুলো আসলে অভিযোগের মতো শোনালেও আসলে তা নয়। আমি ভাগ্যবান যে বিদেশ আমার ভেতর লালসা তৈরি করতে পারছে না। বিদেশের প্রতি জঘন্য লাগার অনুভূতিটা দিনে দিনে বাড়ছে। একইসাথে দেশে ফিরে থিতু হবার আকর্ষণটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এটা ভাল লক্ষণ। আমি চাই না এই দেশে বাকি জীবন কাটাতে। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লে গাঢ় ঘুম হয়। সেই ঘুমের ভেতরেই ঢাকা শহরকে দেখি। ঢাকার রোদ। ধুলা। জ্যাম। ভিড়। ধাক্কা। যখন ফিরে যাবো ঢাকা আরো অনেক বদলে যাবে। ঢাকায় আরো কয়েক বছর থেকে একদিন মৃত্যুও হবে। আমার হাড়মাংস মিশে যাবে ঢাকার মাটিতে, যে মাটি থেকে জন্মেছিলাম, সেখানে ফিরে যাবো। চক্র পূর্ণ।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আবর্তমান

জানালার বাইরে নিশুতি আঙুল
তুড়ি বাজিয়ে ডাকে আয়, আয়।
যেন অচেনা কৈশোরক-স্মৃতি,
বুকের ভেতরে অহমিকা মহাদেশ আর
ভ্রূকুঞ্চনে জমে থাকে অভিমান।

চকিতে শুনতে পাই বিবিধ দীর্ঘশ্বাস
ধুলোঝড়ের স্মৃতি আর শিশিরমাখা ঘাস।

এসব রিক্ত পাহাড়ি গ্রামে ওসব বেমানান।



*****

(শুভ জন্মদিন জীবনানন্দ। তুমি এসে বুকে ক্ষুধা জাগিয়ে দিলে। এক বুক ক্ষুধা নিয়ে তাই তোমার কাছেই ফিরে আসি বারবার।)