বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫

হিজাবের বিমানবিকীকরণ

প্রায় মাসখানেক আগে হিজাব নিয়ে একটা খবর দেখেছিলাম। তেহরানের কোর্টে দুইজন নারীকে হিজাব ঠিকমতো না পরার কারণে নব্বুই লাখ রিয়াল জরিমানা করেছে। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় বিশ হাজার টাকার সমান। ১৯৭৯ সালের মুসলিম বিপ্লবের পর থেকে ইরানের নারীরা বাইরে বের হলে হিজাব করা বাধ্যতামূলক। সম্প্রতি এরকম অনেকগুলো মামলা হয়েছে হিজাব ঠিকমত না করার অভিযোগে, যার প্রায় প্রতিটাই দোষী নারীকে জরিমানা বা অন্যান্য শাস্তি দেয়া হয়েছে। যেমন পুলিশ যদি গাড়ি চালানোর সময়ও কোন নারীকে ধরে, যার হিজাব খোলা বা ঢিলেঢালা, তাহলে তার গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

এটা তো গেল ইরানের কথা। বাংলাদেশে নারীদের হিজাব করার ব্যাপারে এমন কোন আইন নেই। যদিও সামাজিকভাবে অনেক নারীই স্বেচ্ছায় বা পরিবারের পুরুষদের চাপে পড়ে হিজাব করেন। আবার পশ্চিমা বিশ্বে, ইউরোপ বা আমেরিকায় মুসলমানরা হিজাব করতে গিয়ে সামাজিক নিগ্রহের শিকার হন। ফ্রান্সের মত কিছু কিছু দেশে যেমন জনসমক্ষে হিজাব পরা নিষিদ্ধ। একমাত্র তিউনিশিয়াতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জনসমক্ষে হিজাব করা নিষিদ্ধ।

হিজাব নিয়ে নানারকম ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামত আছে। দেশ, জাতি, ও সংস্কৃতিভেদেও নানাবিধ যুক্তি ও পাল্টাযুক্তিও শুনেছি। হিজাব নিয়ে নারীবাদ এবং সেক্যুলার মতধারা থেকে শুরু করে শরিয়া এবং ইসলামিক মতধারা পর্যন্ত বিভিন্ন ‘স্কুল অফ থট’ বিভিন্ন কথা বলে থাকেন। তাই এই বেলা বলে রাখছি এই লেখার উদ্দেশ্য সেই নানা কথার ভেতরে না ঢোকা, বরঞ্চ সমাজে নারী ও পুরুষের মাঝে হিজাবের প্রভাব নিয়ে একটু চিন্তা উস্কে দেয়ার প্রচেষ্টামাত্র।

হিজাবের প্রবক্তাদের প্রধান যুক্তি এই পোশাক নারীর শালীন আব্রু হিসেবে কাজ করে। একই সাথে তা মুসলিম পুরুষকেও পর্দা করতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। হিজাব নারীর সৌন্দর্যকে আড়াল করে পুরুষের কামনাকে প্রতিহত করে। পুরুষের চোখে নারী জনসমক্ষে হয়ে ওঠে কামনারহিত অবয়ব, নারীর প্রতি তার আচরণ হয় সুসভ্য। কিন্তু আসলেই কি তা ঘটে? ইরানের এক নারীর বয়ানে জানা যায়, “আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশকে ঢেকে রেখেও যৌন-লাঞ্ছনা কমে না, ...বরং বাড়ে।” রাস্তায় হিজাব পরে বের হলেও চারপাশ থেকে ভেসে আসে অশ্লীল হিসহিস শব্দ, টিটকারি, ইঙ্গিতপূর্ণ শিসের ধ্বনি।

ব্যাপারটা কি উলটপুরাণ মনে হচ্ছে? অস্বাভাবিক হলেও একটু ভেবে দেখলে এর কারণ বুঝতে পারা যায়। এক মুহূর্তের জন্য হিজাবের ধর্মীয় পটভূমির কথা ভুলে যান। ধরুন, এটি শুধুই একরঙা একটি কাপড়ের অংশ। হিজাব একজন মানুষের শরীরকে ঢেকে দিয়ে প্রকারান্তরে তার মানবিক অবয়বটাকে আড়াল করে। হিজাব-পরিহিতের বিমানবিকীকরণ (dehumanization) ঘটে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমরা সকলেই জানি যে প্রতিটি হিজাবের নিচে রক্তমাংসের একজন মানুষ আছেন। কিন্তু এমনভাবে ঢেকে দেয়ার কারণে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের আড়ালে চলে যায়। ঠিক একই ধরণের বিমানবিকীকরণ ঘটে সামরিক বাহিনীতে, পুলিশ বাহিনীতে, জেলখানায়, কল-কারখানায়। মূলত যে কোন উর্দি-পরিহিত ‘মানুষ’কে আমরা আর “স্বতন্ত্র মানুষ” বলে চিন্তা করি না। তারা হয়ে ওঠে ‘বস্তু’। সামরিক বাহিনী হয় হাঁটু-বাহিনী, পুলিশ হয় ঠোলা। মুখাবয়ব দেখা যাওয়া সত্ত্বেও স্রেফ উর্দির আড়ালটুকুতেই বিমানবিকীকরণ সহজ হয়ে ওঠে। তাহলে হিজাবের মত সর্বাঙ্গ ঢাকা কাপড়ের নিচে মানুষকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়? দর্শকের চোখে তাই হিজাব-পরিহিত নারী হয়ে ওঠে চলমান কাপড়ের ঢিবিবিশেষ। এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হিজাবের আড়ালের মানুষটির সুখ-দুঃখকে অনুধাবনের সুযোগটুকুও খেয়ে ফেলে। সবচেয়ে ভয়াবহ যে ব্যাপারটি ঘটে, তা হলো হিজাব-পরিহিতাকে লাঞ্ছিত ও নিপীড়ন করার সুযোগ করে দেয়, কারণ ‘ওটা’ তো কাপড়ের ঢিবি, কোন জলজ্ব্যান্ত মানুষ না!

বাংলাদেশে নারীশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের নারীর অংশগ্রহণের কারণে এই প্রতিবন্ধকতাকে কিছুটা হলেও সীমিত করা গেছে। তবে ইরানের মতো দেশে যেখানে নারীর হিজাব বাধ্যতামূলক এবং আইনের চোখে হিজাব না করা অপরাধ, সেখানে পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। নারী পুরুষের মাঝে সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরত্ব। ছোটবেলায় স্কুলে শিশুরা একসাথে পড়াশোনা করলেও বড় হবার পরে নারী ও পুরুষের গণ্ডি আলাদা হয়ে যায়। কিছুদিন আগেই ইরানি পুলিশ কফিশপ আর রেস্তোরাঁয় নারীদের কাজ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তেহরানের মিউনিসিপ্যালিটিতে কোন পুরুষ কর্মকর্তার সেক্রেটারি নারী হতে পারে না। এর কারণে গুরুতর একটা প্রভাব পড়েছে সমাজে। ইরানের এক নারীর মতে
, নারী ও পুরুষ যেহেতু একেবারেই পাশাপাশি কাজ করে না, সেহেতু হুট করে কোন পরিস্থিতিতে একজন নারী ও একজন পুরুষকে কোন কাজ করতে হলে খুবই জড়সড় এবং বিদ্ঘুটে মিথস্ক্রিয়া ঘটে। যেন প্রতিটা আলাপই কোন না কোনভাবে প্রচ্ছন্ন যৌনতার সাথে জড়িত। স্বাভাবিকভাবে নারী বা পুরুষ কেউই কাউকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না, তাদের চোখে শুধুই বিপরীত লিঙ্গের পরিচয়টা প্রকট ও মুখ্য হয়ে ওঠে।

ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা মিথস্ক্রিয়ার কারণে নারী এবং পুরুষ উভয়ের মানুষ পরিচয়ের লঘুকরণ ঘটে। তারা একে অপরকে লিঙ্গপরিচয়ে সনাক্ত করে, আর হাজার বছর ধরে বয়ে চলা সংস্কৃতির থাবার নিচে বেড়ে চলে প্রেজুডিস। হিজাবের অন্যতম উদ্দেশ্য নারী ও পুরুষের মাঝে লৈঙ্গিক রাজনীতি ও টানাপোড়েন কমানো। কিন্তু প্রকারান্তরে হিজাব, হিজাবের সামাজিক ভূমিকা ও নারী-পুরুষ গণ্ডি আলাদা করার মাধ্যকে লৈঙ্গিক টানাপোড়েন বেড়েই চলে। সমাজে হিজাব ও পর্দাপ্রথার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে হিতকর ও গঠনমূলক করে তোলার কথা ছিল। কিন্তু দিনশেষে সেই সম্পর্ক পুরুষ নারীকে কী চোখে দেখছে (না-মানুষ, নাকি মানুষ) তার ওপরেই নির্ভর করে।

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

মুখোশের মুখ্য বৈশিষ্ট্য

তার ভেতরে অচেনা কেউ একজন বসবাস করে
মাঝে মাঝে আয়নায় তার মুখ দেখে সে, তার মুখ ফুঁড়ে
আবার হঠাৎই হারিয়ে যায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

থেকে থেকে মনে পড়ে ফকির লালন এরকম
কিছু একটা বলেছিল, তোমার ঘরে বাস করে কারা
ও মন জানো না। সে জানে না অজানা কেউ তার
ঘরে কীভাবে এলো তাকে চেনে না সে, বাড়ছে
এখন সদাভয় সদাসন্ত্রস্ততা ও তটস্থ সংশয়!

তারপর সকালে ঘুম ভেঙে গেলে সে টের পেল
আরেকজন কথা বলছে কণ্ঠ চুরি হয়ে গেছে
পথে দেখা হলো কারো কারো সাথে, তারা
হাত মেলালো, হাসিমুখে কিঞ্চিৎ বাতচিত
করা শেষে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপহীন চলে গেল।

বাসে ঝুলে অফিসে যাচ্ছে সে, আচমকা ব্রেক
কারো গায়ে হুমড়ি খেলে স্যরি বললো আরেকজন,
লোকটা তার দিকে কিড়মিড় করে তাকালো,
সে বাস থেকে তড়িঘড়ি নেমে ফুটপাতে উঠে দেখে
আরেকজন হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে তার দেহটা নিয়ে।

সারাদিন আরেকজন তার হয়ে কথা বলে, তার হয়ে
খ্যাক খ্যাক করে হাসে কলিগের অশ্লীল রসিকতায়
ভরাট রিসেপশনিস্টের দিকে আড়চোখে তাকায়
লাঞ্চে কামড়ে কামড়ে খায় চিকেন তন্দুরি, আর
তার হয়ে মোড় থেকে চা সিগারেট খায়।

লিফটের আয়নায় সে দেখে আরেকজনের চেহারা
সেই ভাঁজে ভাঁজে সে নিজেকে আর দেখতে পায় না,
কাজের ফাঁকে বাথরুম পেলে ইউরিন্যালে আরেকজন
নিচে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে, দৃষ্টি সরাতে গেলে
সে টের পায় আরেকজন তার চোখের দখল নিয়ে নিলো।

বাসায় ফেরে সে আরেকজনের মতো, দুঃস্বপ্ন মনে হয়
তার কাছে। দেখে দরজায় ক্লিপে সাঁটা ভাড়ার নোটিস
আরেকজন ভেতরে ফিক ফিক করে হাসে, টের পায়,
স্বয়ংক্রিয়ের মতো আরেকজন ভাত খায়, খাবারের স্বাদ
নিয়ে নেয় আরেকজন, সে ভাবে সে খড় চিবাচ্ছে।

শোবার আগে দাঁত মাজতে গিয়ে সে একইসাথে শোনার
ও ছোঁয়ার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে, অথচ এবার যেন
ভাবান্তরহীন আরেকজন তার বিছানায় শুয়ে পড়ে।
এর পরে সে শুধু মনে করতে পারে চোখ বোঁজার আগে
প্রাণপণে ছাদের ফাটল দিয়ে অজস্র মাকড়শা নেমে আসছিল। 

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৫

এখানে কেউ থাকে না এখন

কবিতার প্রতি আমি নিষ্ঠুর অবহেলা দেখিয়েছি।


ঘটনাটা কীভাবে ঘটলো বলি। আমি কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম। দিনরাত কবিতা পড়তাম। নতুন কবিতা। পুরাতন কবিতা। চর্যাপদের বিলুপ্ত বাংলায় লেখা কবিতা। ইংরেজি মিডিয়াম বিদেশি শব্দ ভারাক্রান্ত কবিতা। ভেবেছিলাম এত এত কবিতা পড়তে থাকলে প্রেম উড়ে চলে যাবে। বিরক্তি ধরে যাবে কবিতার ওপর। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম চব্বিশ ঘন্টা ধরে এলোমেলো উড়ো পঙক্তি মগজে ঘুরে বেড়াচ্ছে... জোনাকপোকার মতো জ্বলছে... নিভছে...


কবিতার প্রতি এই অদ্ভুত ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতাম। আমাদের জনপদে কবিতা হাসিঠাট্টা আর মকারির বিষয়। কবিতা হোপলেসরা লেখে। কবিতা লুজাররা পড়ে। তাই আমি এই প্রেম লুকিয়ে রাখলাম। অমন প্রবল প্রেম এসব কথায় কমে নাই।


কীভাবে অবহেলার শুরু হলো তা ঠাহর করতে পারি না। এমন নয় যে কোনো এক সকালে উঠে কবিতাকে ঠেলে বিছানা থেকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছি। এমনও ঘটে নি কখনো, কবিতা এসে মগজে ঘাই মেরেছে আর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। হয়তো হিংসুটে সময় আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, কিংবা বারবার কবিতা নিয়ে সবার মিথ্যে কথাগুলো শুনতে শুনতে শুনতে আমিও বিষিয়ে গিয়েছি। হেমলকের পাত্রের কোষেও তো কিছু বিষ চুঁইয়ে চুঁইয়ে মিশে ছিল হয়তো...


অথবা হতে পারে এগুলো মিথ্যে অজুহাত, হতে পারে আমি নিজেই ভেঙে চুরে দুমড়ে ছুঁড়ে দিয়েছি কবিতাকে। কবিতার অনেক দাবি। সময় দাবি করে সে, দাবি করে মনোযোগ, তার হাতে লম্বা বাজারের ফর্দ থাকে প্রায়ই, মাঝে মাঝে সে চিৎকার করে ওঠে রাগে... তাই আমি নিজেই সরে গেছি দূরে! কাপুরুষ সাহস করে বিদায়টাও নিতে জানে না।


তারপর কেটে গেছে দিনরাত কবিতাবিহীন উন্মাদনাহীন হীন-দীন দিনযাপনের ফাঁকে টের পাই না কবিতার অনুপস্থিতি। মনের ভুলে দুয়েকটা পঙক্তি মাথায় সেঁধিয়ে যেতো, হুট করে চোখে পড়ে যেতো কারো লেখা কোন অপূর্ব কথামালা, অজান্তেই তাকিয়ে থাকতাম কোন ছন্দোমত্ত স্তবকে...


...শিহরণ!


পুরনো প্রেম কাছে টানে পুরনো কিছুই আর সেরকম নাই যদিও। বদলে গেছি আমি বদলে গেছে কবিতা, তাও সে কাছে ডাকে দুঃসময়ে আর নিরুপায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কোন পথ খোলা থাকে না!

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০১৫

একজন রাখালের কথা, কিংবা ভেড়া হবার আটটি ধাপ

ভূমিকাঃ

মানব সভ্যতার বয়স খুব বেশি না। আমরা জানি যে মানুষ চাষবাস শুরু করেছিল মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগে, এভাবেই মানব সমাজ গড়ে উঠেছিল। এই স্বল্প সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা গেছে প্রায়ই কয়েকজন একত্র হয়ে দল বা জোট গড়ে তোলে। বৈচিত্র্যময় সমাজের মধ্যে তারা মূলত একটি নির্দিষ্ট মতবাদকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই মতবাদ সমাজের প্রচলিত এক বা একাধিক নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। যেমন, এরকম দল বা জোটের একটি প্রচলিত উদাহরণ হলো ধর্ম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে একেকটি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। ছোট গোষ্ঠীতে কিছু প্রথা ও নিয়ম সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ভেতরেই ধর্মগুলো এক ধরণের পরিবর্তন সাধন করেছে। ক্রমেই মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা নিছকই কৌতূহল থেকে সেইসব নিয়মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, দল বা জোট বড়ো হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, একটা সময়ের পরে ধর্মীয় জোটগুলো প্রকাণ্ড প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মানুষ নেতার জায়গা নিয়ে নেয় ধর্মের মতবাদ বা ডকট্রিন। তখন নতুন দীক্ষিত ব্যক্তিকে পুরাতন অনুসারীই সেই ডকট্রিনের শিক্ষা দিতে পারেন, আদি নেতার বা প্রবর্তকের দরকার পড়ে না। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উদ্ভব ঘটে।

এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন দল গড়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ্য যে নিছকই বিনোদন বা শখের উদ্দেশ্য গড়া কোন দলের সাথে এখানে আলোচিত দলকে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। বিনোদন বা শখের ভিত্তিতে গড়া দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে মানুষের ফলিত চাহিদা পূরণ। সমাজের মূল কাঠামোকে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত না করেও এসব দল তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে। পাড়ায় বইপড়ুয়াদের দল, গানবাজনা দল, কিংবা মামুলি মুভি-থিয়েটার দেখা গোষ্ঠী এসব দলের আওতায় পড়ে। অন্যদিকে উপরে যে দলগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বা চাহিদার উন্নয়নে সাহায্য করে। সমাজের বর্তমান অবস্থায় ব্যক্তি মানুষ যে সীমাবদ্ধতা অনুভব করে, নিজের উন্নতির সুযোগ না পেয়ে যে ব্যক্তি হতাশ, দুর্নীতি ও অনাচারের প্রতাপে যে ব্যক্তি অতিষ্ঠ, তাকে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যও বিভিন্ন সময়ে এসব দল গড়ে ওঠে। এই দল হতে পারে রাজনৈতিক, হতে পারে ধার্মিক, হতে পারে আদর্শিক, অথবা এই সবকিছুর মিশেল। এসব ফলিত ও মৌলিক দলগুলোর মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলে উভয় দলে ব্যক্তির ভূমিকা। ফলিত শখের দলে প্রতিটি ব্যক্তিই নিজস্ব চর্চাকে লালন করতে পারেন, কিন্তু মৌলিক নিয়মের দলে নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিসর খুবই সংকীর্ণ।

অনেক সময়ই নির্দোষ ভেবে বুঝে ওঠার আগেই এমন দলের অংশ হয়ে যেতে পারি। তাই এসব দলের চরিত্র জানার পাশাপাশি এটাও জানা জরুরি যে, এদেরকে চিহ্নিত করার উপায় কী? প্রথমেই দেখতে হবে এরা ঠিক কীভাবে নতুন সদস্যকে দলে নেয়। একেক দলের কাজ করার প্রক্রিয়া একেক রকম, কিন্তু বিশ্লেষণ করলে মোটামুটি আটটি ধাপ পাওয়া যায়।

প্রথম ধাপঃ নির্দোষ দাওয়াত

কথায় বলে, উঠতি মুলো পত্তনে বোঝা যায়। দলে নেয়ার প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে সক্রিয় কর্মীদের কেউ আপনাকে কোন একটা অনুষ্ঠানে আসতে বলবে। না, তাদের বার্ষিক বা মাসিক গেট-টুগেদারে না। নেহাতই নির্দোষ এবং সাধারণ কোন অনুষ্ঠান হতে পারে সেটা। হতে পারে শুক্রবারের চায়ের দাওয়াত, হতে পারে ফেব্রুয়ারি মাসে বনভোজনে সাভার যাওয়ার দাওয়াত ইত্যাদি। শুরুতেই যদি বলে, "দিন-দুনিয়া পরিবার-স্বজন ছেড়ে দলে যোগ দাও", তাহলে তো আপনি মানে মানে কেটে পড়বেন! এজন্য 'বাজিয়ে' দেখার জন্যেই প্রথমে নিরামিষ কোন অনুষ্ঠানে ডাকা হয় সম্ভাব্য নতুন সদস্যকে। এই ধাপটাকে চিহ্নিত করা খুবই কঠিন, নিতান্তই সন্দেহপ্রবণ মন না হলে ধরাও যায় না। কারণ অন্যান্য শখের বশে গড়ে ওঠা গ্রুপগুলোও এরকম ধরণের অনুষ্ঠানেই দাওয়াত দেয়। আপনার যদি আবৃত্তি করার শখ থাকে, কিংবা গান গাওয়ার শখ থাকে, তাহলে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাকলে কি আপনি যাবেন না? আগ্রহী হবেন না? অবশ্যই হবেন। তারপরও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, কারণ এর পরের ধাপ থেকেই দুই ধারার দলগুলো আলাদা আচরণ করতে শুরু করে।

দ্বিতীয় ধাপঃ স্নেহ-ভালোবাসা কারে কয়? 

অনুষ্ঠানের দাওয়াত তো নিলেন, সেজে-গুঁজে আগ্রহ নিয়ে গেলেনও। তারপর দেখলেন দলের পুরানো সদস্যরা দারুণ মাইডিয়ার টাইপের। সবাই হেসে হেসে কথা বলছে আপনার সাথে, আগ্রহ নিয়ে শুনছে আপনি কী বলেন বা ভাবেন, কয়েকজন বারবার খোঁজ নিচ্ছে আপনার কিছু লাগবে কি না, খাওয়া-দাওয়া আরামের ব্যবস্থা হচ্ছে কি না ইত্যাদি। আপনি তো মনে মনে এমন আদর পেয়ে লাটে উঠে যাচ্ছেন। আসলে খাতিরদারি কে না ভালোবাসে! আপনি যদি খুব আত্মকেন্দ্রিকও হন, তাও এমন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলে, একটু একটু খুশিই লাগে। এর পেছনের সাইকোলজিটা হলো, দলের সদস্যরা সচেতনভাবে আপনার মনের স্মৃতি ট্যাম্পারিং করছে। আজকের দিনের ঘটনাবলীর সাথে ভালো লাগার বিরল অনুভূতিকে জুড়ে দিচ্ছে। দুয়েকমাস পরে যখন দলের কাজকর্মে বিরক্ত হতে যাইতেন, সেসময় এই প্রথম দিনের স্মৃতি মনে করে আপনার মনের বিরক্তি দূর হয়ে যাবে। মনে মনে নিজেকে বুঝাবেন, "আসলেই তো এরা কতো ভালো ব্যবহার করেছিল আমার সাথে!", আর নিজেকে নিজেই দলের সাথে জুড়ে রাখবেন। অতো দূরের কথাই বা কেন বলি, প্রথম দিনের এই ভালো ব্যবহার ও আপ্যায়নের কারণেই পরের দাওয়াতে আপনি আগ্রহ নিয়ে অংশ নিবেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো সময়ের সাথে সাথে এই মেকি উচ্ছ্বসিত ব্যবহার ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে আপনি দলের অংশ হয়ে যাচ্ছেন, এবং পুরানো সদস্যরাও আপনাকে অন্য পন্থায় কব্জা করছে।

তৃতীয় ধাপঃ পুরষ্কারের মুলা, নাকের সামনে ঝুলা  

ধীরে ধীরে বিভিন্ন দাওয়াতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সম্ভাব্য নতুন সদস্যের পরিচিতি ও স্বচ্ছন্দ বাড়তে থাকে। এর পরের পর্যায় থেকেই অপেক্ষাকৃত সিরিয়াস ধাপগুলো আসতে থাকে। আরেকটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো আপনার পক্ষে পুরোপুরি সম্পর্ক চুকিয়ে দল থেকে বেরিয়ে আসার এটাই নিরাপদতম পর্যায়। কারণ এর পরের ধাপগুলোতে যতই এগুবেন, দল ত্যাগ ততই ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে আপনার জন্য। এই ধাপে দলের এক বা একাধিক পুরনো সদস্য আপনাকে মহা-আরাধ্য কামনার বস্তু "পুরষ্কারের" কথা বলবেন। এই দলের মূল কার্যক্রম ব্যাখ্যা করবেন। দলের সাথে সম্পৃক্ত হলে আপনি কী কী সুবিধা পাবেন তা ধীরে ধীরে আকারে ইঙ্গিতে বা সরাসরি আপনাকে বলা হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা আপনার মানসিক বা সামাজিক দুর্বলতাকে টার্গেট করবে। এখানে লক্ষণীয় যে, এই পুরষ্কারের প্রতি যদি আপনার আগ্রহ না থাকে, তাহলে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আর ঘটবে না। পুরষ্কারের বৈশিষ্ট্যকে আপনি মনে-প্রাণে কামনা করলেই শুধুমাত্র পরের ধাপ সামনে আসবে। অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা জন্ম হতে হবে আপনার মনে, লক্ষ্য তারা তুলে ধরলেও আপনি এক বিভ্রান্তিতে থাকবেন যে এই লক্ষ্য আপনি নিজে নিজেই ঠিক করেছেন।

পরবর্তী ধাপে আপনি পিছু হটার চেষ্টা করলে পুরানো সদস্যরা একটু মনে করিয়ে দিবে যে এক সময় আপনি নিজেই এই লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। নিজেই নিজের বিরোধিতা করা বা নিজেকে পরাস্ত করা হাজারগুণ কঠিন কাজ। তাই পুরাতন সদস্যদের এই সূক্ষ্ণ চালাকিটুকু আপনার দলে সামিল থাকার জন্য জরুরি।

চতুর্থ ধাপঃ দাও দাও, মোরে আরো দাও

পুরষ্কারের আশার পাশাপাশি আপনাকে বেশ কিছু সাফল্যের গল্প শোনানো হবে। অমুক আপনার মতই পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে এসে এই দলে যোগ দিয়েছিল। আপনার মতই সে এটা ওটা চাইতো। তারপর অনেক পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফলে সে একদিন সেটা অর্জন করতে পেরেছে। এখন তারা সুখে শান্তিতে বাস করছে। অমন সুখ কি আপনি পেতে চান? আপনিও কি চান তাদের মত সফলকাম হতে? যদি চান, তাহলে বলুন আপনি কীভাবে সেই পথে যাবেন? এরকম পর্যায়ে নতুন সদস্যের মনে যেন কিছুতেই দ্বিধার জন্ম না হয়, সেজন্য দলের পক্ষ থেকে এমন সফল কাউকে কাউকেও নিয়ে আসা হয়। স্বভাবতই তার বা তাদের সাথে কথা বলতে বলতে নতুন সদস্যের বিচার-ক্ষমতা প্রভাবিত হতে থাকে। উক্ত সফলদের সফলতাই যে তার নিজস্ব সফলতা নয়, কিংবা তারা যা বলছে সেটাও যে স্ক্রুটিনির প্রয়োজন আছে, সেটা নতুন আপনি চিন্তা করে দেখার সময়ই পাবেন না। ততদিনে আপনার সামনে সাফল্যের হাইওয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, এখন সময় দ্রুত সেই পথে ছোটার। আশেপাশে একটু জিরিয়ে চিন্তা করে দেখার সময় কই?

পঞ্চম ধাপঃ দল আগে, না তুমি আগে?

নতুন সদস্য হিসেবে আপনি অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন। দলের পুরানো সদস্যদের সাথে আপনার জোট যথেষ্টই দৃঢ়। বড়শি আপনি ভালোভাবেই গিলেছেন। এরকম "শিওর সাকসেস" অবস্থায় দলের কেউই চায় না আপনি ছুটে যান। এমনকি আপনিও যে পরিমাণ সময় ও চিন্তা লগ্নি করেছেন তাতে আপনিও চান না দলের বাইরে পড়তে। এই ধাপে এজন্য দল থেকে আপনার কাছে দাবি-দাওয়া আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। বেশি সময় ধরে দলের পেছনে দিতে হবে। এমন কিছু কাজ করতে হবে যেগুলো মন থেকে সায় দিতে পারবেন না। হয়তো আপনাকেই পাঠানো হবে নতুন সদস্য ধরে নিয়ে আসতে। এর মাঝে যদি আপনি বিন্দুমাত্রই উসখুস করেন, বাকিরা আপনাকে আল্টিমেট লক্ষ্যের কথা মনে করিয়ে দিবে। "এরকম ঢিলাঢালাভাবে চললে কখনই সফল হতে পারবে না"। এই পর্যায়ে আপনার যে কোন কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থতাকে বাজেভাবে ট্রিট করা হবে। শুরুর সেই মধুর আচরণ ভুলে যান, এখন আপনি দলের নিয়মকানুন মেনে না চললে যথেষ্ট বিপাকে পড়বেন।

হয়তো ভাবছেন এই ধাপেই তাহলে কেন বেরিয়ে আসবো না? বাস্তব হলো, বহু কারণেই আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন না। প্রথমত, আপনি নিজের অনেকটা সময় এই দলের সাথে দিয়ে ফেলেছেন। এটা আপনার দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক অভ্যাসের অংশ হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, দলের বিভিন্ন সদস্যের সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক । এটা হুট করে কাটিয়ে দূরে সরে যাওয়া সম্ভব না। শুরুতে যখন আপনার ইনভলভমেন্ট কম ছিল, তখন সম্ভব হতো। কিন্তু এখন আপনি প্রায় প্রতিদিনই সবার সাথে দেখা করছেন, সবাই আপনাকে চেনে, জানে, বাসা-বাড়ি, কাজের জায়গা কোথায় এগুলো জানে। কেউ কেউ আপনার বাসায়ও এসেছে, আপনিও গেছেন তাদের বাসায়। এতোগুলো সম্পর্ক চাইলেই কাটানো যায় না। তৃতীয়ত, এই নতুন সম্পর্কগুলোর কারণে আপনার পুরানো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন দূরে সরে গেছেন। আপনি নিজেই সরিয়ে দিয়েছিলেন এতোদিন। আজকালকার যুগে এসব সম্পর্ক মেরামত করা খুবই দুরূহ। চতুর্থত, আপনার নিজস্ব সফলতা বা সুখের লক্ষ্যটাকে পুরোপুরি বিসর্জন দিতে হবে। দলের ঠিক করা আইডিয়া লালন করতে করতে আপনি এখন নিজেকে তা থেকে আলাদা করতে পারেন না। এত বড়ো আত্মত্যাগ প্রায় কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না।

ষষ্ঠ ধাপঃ অনুতাপের দহন

এই ধাপটি নতুন সদস্যের জন্য সবচেয়ে পীড়াদায়ক। আগের ধাপে ক্রমশ বেড়ে চলা দায়িত্ব ও টানাপোড়েন এই ধাপে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। আপনার মনে দ্বিধা বাড়তে শুরু করেছে। বারবারই পুরানো দিনের কথা মনে পড়ছে, মন চাইছে এইসব ছেড়েছুঁড়ে ফেলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে। কিন্তু এই পর্যায়েই দলার বাকি সদস্যরা আপনার হাবেভাবে বিরক্ত হতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে তারা আপনাকে লজ্জা দিতে শুরু করবে। আপনি দলের প্রতি, আদর্শের প্রতি, মতবাদের প্রতি নিবেদিত নন - এই বিষয়টি উঠে আসবে। অনেকেই আপনার সাথে আগের সৌহার্য্যপূর্ণ সম্পর্ক শীতল করে দিবে। প্রায়ই আপনার উপস্থিতিকে উপেক্ষা করবে। সমসাময়িক সময়ে অন্য সদস্য যারা যোগ দিয়েছে, তাদের কাউকে কাউকে বেশি ফোকাস করা হবে, কারণ তারা দলের প্রতি অনেক বেশি নিয়োজিত। সাফল্যের পথে তারাই আছে, আপনি সরে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে জন্ম নিয়ে ব্যর্থতার অনুভূতি। এরকম পর্যায়ে আপনি মানসিকভাবে সম্পূর্ণই ভেঙে পড়বেন এবং স্বতন্ত্র চিন্তাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। আপনার মনে হবে, মতবাদকে প্রশ্ন করে ভুল করেছেন, মনে হবে দলের সবার কথা না শোনা ঠিক হয় নি। এটাও মনে হবে যে সেই পুরষ্কার আপনি ডিজার্ভ করেন না, দলের সাহায্যই আপনার একমাত্র সম্বল। তারাও এখন মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনি আর কোনদিনই কিছু অর্জন করতে পারবেন না।

এই ধাপে আপনার শোচনীয় অবস্থা থেকে দল লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ এর ধাপের পরেই আপনি সম্পূর্ণভাবে এই মতের কেনা দাস হয়ে যাবেন। দলের সদস্যরা উঠতে বসলে উঠবেন। বসতে বললে বসবেন। কখনই অথরিটির কোন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার চিন্তাও আপনি আর মাথায় আনবেন।

সপ্তম ধাপঃ পুরষ্কার বনাম তিরষ্কার

ষষ্ঠ ধাপের অনুতাপের ভেতর দিয়ে যদি পার হতে পারেন, তাহলে এক পর্যায়ে দলের বাকিদের মতই আপনার "দলীয়করণ" সম্পন্ন হয়ে যাবে। প্রক্রিয়ার শুরুর আনন্দ ও উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। মাঝের কার্যক্রম আপনাকে কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছে। আর কর্তাদের পদ্ধতিকে প্রশ্ন করার বা বিরোধিতা করার যৎসামান্য ইচ্ছা যা আপনার বাকি ছিল, তাও গত দুই ধাপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। এখন আপনি দলের পোড় খাওয়া নিয়মিত অংশ। সবাইকে চেনেন, কী হয় না হয় জানেন। এই পর্যায়ে খুবই মৌলিক দুটো পথে সবকিছুকে বিচার করা হবে। আপনার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে পুরষ্কার, কলিগ ও পিয়ারদের কাছে শ্রদ্ধা-সম্মান-প্রশংসা। আর পালন করতে ব্যর্থ হলে ধমক-তিরষ্কার-তাচ্ছিল্য। আপনিও দল ছাড়বেন না ঐ পুরষ্কারের আশা আর শাস্তির ভয়ে। দলও আপনাকে ছাড়বে না কারণ সে আপনাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারবে।

অষ্টম ও শেষ ধাপঃ অস্তিত্ব ও পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ

এটাই মূলত আপনার ও দলের সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতি। মতবাদ ও দল আপনাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। প্রতিটি কাজ আপনি সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন। পুরানো সদস্যদের কাতারের কাছাকাছি চলে এসেছেন। দলে নতুন সদস্যদের কারো কারো দায়ভারও আপনার হাতে পড়ছে। নেতৃত্বের কাঠামোকে আপনি আর প্রশ্ন করেন না, হাতে যে কাজ দেয়া হয়, তার পেছনের কারণকেও আর প্রশ্ন করেন না।

তারপরেও অনেকে এতোগুলো পর্যায় পার হয়েও দল থেকে ছুটে যেতে পারে। সেজন্য আরো কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। কোন কোন দল তার সদস্যদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। দলের সদস্যই হয়ে ওঠে তার একমাত্র পরিবার। অন্য অনেক দলে সদস্যদের মাঝে কৃত্রিম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কে বেশি নিবেদিত তা প্রমাণের পরীক্ষা নেয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন দলে বিভিন্ন পরিবেশে নানারকম উদ্ভাবনী উপায় কাজে লাগানো হয়।

তবে সেসব আরো বিস্তারিত ও বহুবিধ ব্যাপার। আমি নিজেও তার সবকিছু বুঝে উঠি নি। এইখানে মূলত ভেঙে ভেঙে দেখানো হলো যে আদর্শিক ও মতবাদভিত্তিক ক্রিয়াশীল দলগুলো কী উপায়ে মানুষকে দলের সদস্যে পরিণত করে। মোটা দাগে, কাউকে যদি এরকম খপ্পরে পড়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেন, তাহলে বিচার করে দেখতে পারেন যে কীভাবে সে এই দলের খোঁজ পেল, এবং কীভাবে সে এই দলের সদস্যে পরিণত হলো। কম-বেশি এই আটটি ধাপ সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন। 

শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৫

"সক্রেটিসের মৃত্যু"

[এই লেখাটি খেয়ালবশে ফেসবুকে লিখে রেখেছিলাম। ব্যক্তিগত কাজের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে। প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠি। কলুর বলদের মত ঘানি টানছি - এমন মনে হতে থাকে। তখন অবশতা কাটাতে এরকম কিছু জিনিস প্রায় সঞ্জীবনীর কাজ করে। খেয়ালবশে লেখার পরেও মনে হচ্ছিল পুরো ব্যাপারটা তুলে আনতে পারি নি। এটা সে লেখার সম্পাদিত ও বর্ধিত অংশ।]
====

====
এই চিত্রকর্মটির নাম "সক্রেটিসের মৃত্যু"। আজ থেকে প্রায় তিনশ তিরিশ বছর আগে (খ্রি. ১৭৮৭) ফ্রান্সের শিল্পী জাঁক-লুই ডেভিড এই ছবিটা আঁকেন। ছবিটার গল্পটা সবারই জানা। সক্রেটিসের সামনে মেলে ধরা হয়েছে হেমলক বিষের পাত্র, সক্রেটিস সেটা নির্দ্বিধায় পান করছেন। ছবির ডান দিকে তার শিষ্যরা শোকে, ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। সক্রেটিসের বামে যে লোকটি হেমলকের পাত্র এগিয়ে দিচ্ছে, তার নিজের মুখও লজ্জায় ঢাকা, এমন জ্ঞানী একজন মানুষের মৃত্যু তার মাধ্যমে হচ্ছে, হয়তো সেই কারণেই।

সক্রেটিসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিল অ্যাথেন্সের কোর্ট। অভিযোগগুলো ছিল, অ্যাথেন্স রাষ্ট্রের দেবতাদেরকে তিনি স্বীকার করেন নি, অলৌকিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব দর্শন অনুসারে, এবং  শহরের তরুণ সমাজকে নিজের দর্শন দ্বারা বিপথে চালিত করেছেন। যথেষ্ট গুরুতর অভিযোগ। এমন অভিযোগ কেন আনা হয়েছিল? বিচার ও শাস্তির পটভূমিটা জেনে নিলে সেটা বুঝতে সুবিধা হবে। সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৩৯৯ এর মাঝামাঝি। নানাবিধ টানাপোড়েনে অ্যাথেন্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন টালমাটাল। কিছুদিন আগেই অ্যাথেন্স স্পার্টার সাথে যুদ্ধে নিদারুণভাবে হেরে গেছে (পেলোপনেশিয়ানের যুদ্ধ)। অমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরে ক্ষমতাশীল দল রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু জনমত তখনকার অ্যাথেন্সের রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের ওপর ক্রমেই ভরসা হারাচ্ছিল। সক্রেটিস নিজেও ছেড়ে কথা বলছিলেন না। শাসকদের সমালোচনা করতে গিয়ে চিরশত্রু স্পার্টাদেরও রাষ্ট্রনীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি। একই সাথে তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন গণতন্ত্রের নামে অ্যাথেন্সের শাসকগোষ্ঠীর ক্রমেই দমনমূলক হয়ে ওঠার সমস্যাগুলো।

স্বাভাবিকভাবেই এটা হর্তাকর্তাদের ভাল লাগে নি। তাই তাকে উপরের বর্ণিত অপরাধে অভিযুক্ত করা হলো। শুরু হলো বিচার। যথারীতি জুরিবোর্ডের সামনেও দুর্বিনীত আচরণ করলেন তিনি। সক্রেটিসের অন্যতম শিষ্য জেনোফোনের মতে, তিনি যেন ইচ্ছা করেই জুরি আর বিচারকদের ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করছিলেন, যেন তাকে মৃত্যুদণ্ডই দেয়া হয়। হতে পারে যে তিনি নষ্টভ্রষ্ট সমাজের প্রতি একেবারেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেই ব্যবস্থাকে ক্রমাগত আঘাত করতে চাচ্ছিলেন। কোন সমাজ যখন পচে যায়, যখন ক্ষমতার মোহে অন্ধ সমাজের নেতারা যে কোন মূল্যে নিজেদের দোষ ঢাকতে চায়, যখন গণতন্ত্রের নামে শাসনযন্ত্র হয়ে ওঠে পীড়নকারী, যখন সমাজে জোর যার মুল্লুক তার নিয়ম চালু হয়, তখন একজন দার্শনিক ও শিক্ষকের হতাশার কোন সীমা থাকে না। এমন সংশোধনের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া সমাজে আর থাকতে চান নি সক্রেটিস। দার্শনিক হিসেবে অমিত প্রজ্ঞার অধিকারী এই মানুষটির কাছে নিশ্চয়ই অসীম বেদনার ব্যাপার ছিল এটা। নিজের চোখের সামনে সভ্যতার উন্নতির শিখরে থাকা একটা রাষ্ট্রকে এভাবে ধীরে ধীরে মাস্তানির কাছে ক্ষয়ে যেতে দেখা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার না।



দেখা যাচ্ছে, সক্রেটিসের ডান হাত বিষের দিকে বাড়ানো। হেমলকের পাত্র এগিয়ে দেয়া লোকটির হাত নিচে, এবং সক্রেটিসের হাত ওপরে। হাতের এই তুলনামূলক অবস্থানও নির্দেশ করে যে সক্রেটিস নিজের ইচ্ছাতেই বিষপাত্র গ্রহণ করছিলেন। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কেন তিনি আগ্রহভরে মৃত্যুকে বেছে নিলেন। যদিও দণ্ড দিয়েছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা, তবু এই ঘটনাটা যেন আত্মহত্যারই শামিল। কেন? সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, মৃত্যু মানব-আত্মার সর্বোচ্চতম রূপান্তর। জন্মের পর থেকে মানুষের জ্ঞানাহরণের ক্রমোন্নতির শেষ ধাপ আসে মৃত্যুর মাধ্যমে। হেলাফেলার বিষয় না এটা। জন্মের ওপর আমাদের কারও হাত নেই, জন্মের পরপর আমাদের জ্ঞান থাকে শূন্য। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের মস্তিষ্কের উন্নতি হতে থাকে। একজন মানুষ তার পরিপার্শ্ব থেকে শিক্ষা নেয়, সেই শিক্ষাকে হিতকর প্রয়োগের মাধ্যমে করে তোলে সভ্যতার উন্নতির অংশ। তার অবদানে উপকৃত হয় তার পরিপার্শ্ব। কিন্তু মহত্তম সেই মানুষ, যিনি কর্মের ভেতর দিয়েই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারেন। সক্রেটিস মূলত একজন শিক্ষক ছিলেন, তাই নিজের মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটিই দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। শিক্ষাটি কী, তা একটু পরে বলছি।



ছবিটায় আবার ফিরে আসি। সক্রেটিসের বাম হাত উপরের দিকে কিছু একটা নির্দেশ করছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, এই কারাগারে উপরের বাম কোণ থেকে আলো এসে পড়ছে, সক্রেটিসের তর্জনীও সেই আলোর দিকে ধরা।



ছবির একদম বামে শাদা পোষাকের বসে থাকা লোকটি হলো প্লেটো। এখানে জাঁক-লুই ডেভিড শিল্পীর নিজের কল্পনাকে সামনে নিয়ে আসলেন। প্লেটো সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় সেখানে ছিলেন না, ঐতিহাসিকভাবে তাই এই ছবিটা ভুল। কিন্তু প্লেটোর এই ছবিতে থাকার কারণ আছে। সক্রেটিসের সকল শিক্ষা, যা তিনি তার শিষ্যদের শিখিয়ে গিয়েছিলেন, পরে তা লিপিবদ্ধ করেন এই প্লেটো। এমনকি তার মৃত্যুর ঘটনাও প্লেটোর বর্ণনা থেকেই আমরা জেনেছি। একদিক দিয়ে দেখলে, সক্রেটিস সক্রেটিস হতেন না, যদি না প্লেটো তাকে সংরক্ষণ করতেন, বাঁচিয়ে রাখতেন। সেজন্যই প্লেটো রূপক অর্থে এখানে উপস্থিত। এবং তার অবস্থান অন্য শিষ্যদের চেয়ে দূরে, কারণ অন্য শিষ্যদের মতো আবেগে ভেঙে না পড়ে তিনি সক্রেটিসের কর্মকে, বাণীকে, শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়ার সংকল্প নিয়েছিলেন। হয়তো তার পাশেই মাটিতে রাখা স্ক্রলটাও সেটার রূপক-চিহ্ন!



প্লেটোর পাশাপাশি আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য ক্রিটোকেও একটু দেখা যাক। কমলা পোষাকের যে শিষ্যটি সক্রেটিসের পা ধরে বসে আছেন, সেই লোকটা হলো ক্রিটো। সক্রেটিস নিজে ক্রিটোকে অনেক পছন্দ করতেন। বিচারের পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরে সক্রেটিস কিছুদিন জেল-হাজতে ছিলেন। সেসময়ে ক্রিটো লাইন-ঘাট করে তাকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সক্রেটিসকে অনুরোধও করেন, "গুরু পালিয়ে যান। নিজেকে বাঁচান।" কিন্তু সক্রেটিস সেটা শোনেন নি। তার সিদ্ধান্তকে ক্রিটোর পক্ষে পুরোপুরি বোঝা কিংবা মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। গুরুকে হারাতে কেইবা চায়। তাই সক্রেটিসের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে, শোকে বিহ্বল হয়েও ক্রিটো তার পায়ের কাছে বসে আছেন। কেমন নুয়ে পড়া, বেঁকেচুরে ভেঙে পড়া অবয়ব। এক হাতে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছেন এত শ্রদ্ধার মানুষটিকে। আমি খুব খেয়াল করে ক্রিটোর চেহারার ভাঁজগুলো দেখি। আমার বুকের ভেতরে শ্রদ্ধার মানুষটিকে হারানোর প্রবল শোক তোলপাড় করে।

শিল্পী ডেভিড এই ছবির দুটো জায়গায় নিজের নাম স্বাক্ষর করেছেন। একটা হলো ক্রিটোর বসে থাকা পাথরটির গায়ে, আরেকটা হলো প্লেটোর বসে থাকা পাথরে। মনে হতে পারে, তিনি সম্ভবত সক্রেটিসের এই দুই শিষ্যের মাঝে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি হয়তো সক্রেটিসের প্রতি দুই ধরনের আবেগই ধারণ করেন। একদিকে যেমন তার স্বেচ্ছামৃত্যুতে শোকগ্রস্ততা, অন্যদিকে তার দর্শন ও শিক্ষাকে ধারণ করার স্থিরতা। শিল্পীর এই অবস্থানের সাথে আমরা নিজেরাও একাত্ম হতে পারি। আকস্মিক শোক ও বেদনা কেটে গেলে মৃতের কর্ম ও শিক্ষার প্রতি নিবিড় অনুশীলন প্রয়োজন, কারণ একমাত্র সেভাবেই আমরা তাকে অমর করে তুলতে পারি।

লেখা শেষ করি সক্রেটিসের মহত্তম সেই শিক্ষার উল্লেখ করে। তার মৃত্যুর মুহূর্তে পৌঁছানোর আগের ঘটনাগুলো চিন্তা করলে দেখা যায় যে একাধিকবার তিনি মৃত্যুকে বাদ দিয়ে জীবদ্দশা বেছে নিতে পারতেন। ক্ষমতাশীলকে না ক্ষেপিয়ে চুপচাপ নিরাপদ নিরপেক্ষ হতে পারতেন। ক্ষমতাশীলদের ভুলে ক্ষেপিয়ে দেয়ার পরেও হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে নিতে পারতেন। এমনকি বিচার শুরু হবার পরেও নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে পারতেন। এমন শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন, ওভাবে ক্ষমা চাইলে বাকি সবার চোখে তার দৃঢ় চরিত্রের সুনাম নষ্ট হতো, আর তাতে ক্ষমতাশালীরা খুশিই হতো। আচ্ছা, সব না হয় বাদই দিলাম। অনমনীয়তার শেষ মুহূর্তে ক্রিটোর বাতলানো পথে চুপিসারে পালিয়েও যেতে পারতেন। নির্বাসন নিয়ে অন্য দেশে গিয়েও তার দর্শন প্রচার ও শিক্ষা দিতে পারতেন। কিন্তু এতোবার সুযোগ পাওয়ার পরেও তিনি আপোষ করেন নি। তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন। এর পেছনে কারণ, সেই মহত্তম শিক্ষা দেয়ার অন্তিম বাসনা। এই শিক্ষার জন্যই সক্রেটিস মরেও অমর। আর সেই শিক্ষাটা হলো, মানুষের নিরর্থক তুচ্ছ জীবনের একমাত্র অর্থবোধকতা আসতে পারে, যদি সেই জীবন কোন হিতকর আদর্শের জন্য উৎসর্গিত হয়। তা নাহলে এই জীবনের সকল কর্ম বৃথা।

সক্রেটিসের দিকে আরেকবার তাকান। তার সেই উঁচু করে তুলে ধরা আঙুলের দিকে তাকান। এই ভঙ্গিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমার নিজের ধারণা, সক্রেটিস যে আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গ করছেন, এই তুলে ধরা আঙুল সেই আদর্শকেই নির্দেশ করছেন। মানুষের তুচ্ছ ও নিরর্থক জীবনের চেয়ে অনেক অনেক উঁচুতে এমন আদর্শের স্থান। সে আদর্শের কাছে মানুষের জীবনের আদৌ কোন মূল্য নেই। চারপাশের বাকি সবার অবনত মাথার চেয়েও উঁচুতে ওঠানো এই তর্জনী তাই উচ্চতম সে আদর্শেরই অনবদ্য রূপক!

বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০১৫

ইশতেহার

মাঝে মাঝে এমন একেকটা দিন আসে সব রিক্ততা এক সাথে জড়ো হয়। যারা মানসিকভাবে দুর্বল, কিংবা কোন নেশার খপ্পরে আটক হয়ে আছেন, তাদের জন্য এমন একটা স্লোগান আছে বলে শুনেছি - "ওয়ান ডে অ্যাট এ টাইম"। জীবনের ভার যাদের জন্য দুর্বিষহ, তাদের জন্য এই স্লোগান একটা টনিকের মতো কাজ করে। অনুপ্রেরণার মতো সাহস জোগায়। তাদের দুর্বল কাঁধে জোর আসে। হয়তো তোমার দিনটা সকাল থেকেই খারাপ যাচ্ছে, মন উচাটন, বিক্ষিপ্ত, যাই করছো ভজঘট পেকে যাচ্ছে, মনের ভেতর ফিরে ফিরে আসছে ব্যর্থতার দুঃখ... ঝেড়ে ফেলে দাও এসব চিন্তা। ভাবো, "ওয়ান ডে অ্যাট এ টাইম"। ভাবো, আজকের দিনটা খারাপ, কিন্তু সেটা কেবল আজকের দিনের জন্যই। কালকে আবার নতুন দিন। নতুন সম্ভাবনা। ঘটে যেতে পারে অসম্ভব সুখের ঘটনা। ঘটতেই পারে। তাই আজকের খারাপ দিনটা কোনমতে পার করে দাও। "ওয়ান ডে অ্যাট এ টাইম"...

আজ সকাল থেকে বরফ বৃষ্টি হচ্ছে। পানির বিন্দু শীতের বাতাসের চোটে মাটিতে পড়তে পড়তেই বরফ হয়ে যাচ্ছে। এমন বরফ যা দেখা যায় না। পিচ্ছিল সর্পিল মরণফাঁদ। পা ফস্কে হাড় ভাঙতে পারে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটাতেও পারে। তাই দুপুর পেরুনোর আগেই ভার্সিটি বন্ধ। ক্লাস ক্যানসেল। রাস্তা ঘাট শুনশান। অযাচিত ছুটি।
এমন হুট করে ছুটি হলে বিপাকে পড়ে যাই। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না, তাই মগজের কোষে কোষে তোলপাড়। বাইরে থমথমে ছাই মেঘ, ধীরে ধীরে কুয়াশার মতো রঙহীন বরফ কালো রাস্তায় শীতল আততায়ীর মতো জমে উঠছে। দেখতে দেখতে মনে হলো, এটা আসলে আমাদের দিনকালের খবর। ছুটির ভাল খবর আসে খুনের পিঠে। ঘাতকের ছুরি সরিয়ে নিলে আসে তুচ্ছ খেলার ক্ষণিক আনন্দ।

"ওয়ান ডে অ্যাট এ টাইম"...

এসব হায়-হুতাশ একটা সময় পরে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে সবার জন্যেই। কারো শরীরে একটা জায়গায় বারবার গুঁতো দিতে থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরীহ মানুষটাও একসময় খিটখিট করে ওঠে। তাই একদম মুডকিলার হিসেবে বদনাম হয়ে যায় কারো কারো। "হি ইজ সাচ এ ডাউনার! সারাক্ষণ সেই একই প্যাচাল?" শোকের তীব্রতা হয়ে যায় বেহুদা কাসুন্দি।

স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের মতো কোন এক বিশেষ জাতীয় দিনে বিটিভি'র প্রোগ্রাম দেখছিলাম। এটা সে'সময়ের কথা যখন গণ্ডায় গণ্ডায় চ্যানেল ছিল না। না দেশি, না বিদেশি। বিটিভি সরকারি প্রোপাগান্ডা অতোটা চালু হাতে দেখাতো না। দেশে নতুন নতুন গণতন্ত্র এসেছে। জাতীয় দিবসের বক্তৃতা/বক্তব্য কিছু একটা দেখাচ্ছে। আমার কাছে বড়ই একঘেঁয়ে লাগছিলো সেটা। স্পষ্ট মনে আছে, আমি সেই বিরক্তি খুব তীব্রভাবেই প্রকাশ করেছিলাম। "কী সব সেই একই প্যাচাল? প্রত্যেক বছর এই একই কথা। কোন নতুন কিছু নাই?" আমার নানু খুব শান্ত স্বরে বলেছিলেন, "এগুলো প্যাচাল না। এরা অনেক কষ্ট করেছে। ওরা নাই বলেই তুই আছিস, তোরা আছিস।" আমি এতোটাই অ্যারোগেন্ট ছিলাম যে নানুর কথা বুঝতে পারি নাই। ফোঁস করে একটা শব্দ করে অন্য ঘরে চলে গিয়েছিলাম। নানুর সেই শান্ত স্বরের কথাগুলো আজ কোন্‌ অন্ধ কুঠুরি হতে ফিরে এলো? "ওরা নাই বলেই তুই আছিস", আসলেই তো! এতো প্রিভিলেজড জীবন যাপন করেছি, করছি, অথচ বিন্দুমাত্র মনে করি না অসামান্য পূর্বপুরুষ কী নির্দ্বিধায় সব কিছু দিয়ে দিয়েছিলেন!

দুপুরে "House of Cards" দেখছিলাম। দৃশ্যটা ছিল একজন অ্যাক্টিভিস্ট আর আমেরিকার ফার্স্ট লেডির মধ্যে। রাশিয়ার জেলে আটক আমেরিকান অ্যাক্টিভিস্টকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন ফার্স্ট লেডি। সামান্য কিছু কথা মিডিয়ার সামনে বললেই রাশান সরকার তাকে ছেড়ে দিবে। দেশে গিয়ে সে আবারও তার সংগ্রাম শুরু করতে পারবে। কিন্তু সে কিছুতেই মানছে না। এক পর্যায়ে দুর্বিনীত অ্যাক্টিভিস্টটা বলেই বসলো, "আপনি কি কখনো কোন আদর্শকে এতোটা সত্য বলে মেনেছেন, যার জন্য আপনি জীবন দিতে পারেন?" ফার্স্ট লেডির মুখে কথা সরলো না।
আসলে ফারাকটা হয়তো এটুকুই। আমরা মানুষ হিসেবে, সামাজিক জীব হিসেবে, কমপ্রোমাইজ করার নিয়ম শিখি। সবচেয়ে কম ছাড় দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভ করার হিসেব কষা শিখি। আমাদের ঝুঁকিগুলো হয় মাপা। বিপদগুলোও হয় ছক কাটা। সেই বিপদ থেকে উত্তরণের রাস্তাও সামনে বিছানো থাকে। আমাদের জন্য এমন নির্ভেজাল আবেগ মোটেই ভাল নয়। আদর্শের জন্য নিজের সবচেয়ে মূল্যবাদ সম্পদ, এই জীবনটাকে হাসতে হাসতে বিলিয়ে দেয়াকে তাই আমরা বোকামি বলি।

গত বৃহস্পতিবার হতে এই অবস্থান থেকে সরে এসেছি।

সোমবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

অভিমান

যে পথে হেঁটে এসেছি এতদূর, কত দূর পায়ে পায়ে এসে দেখি ভিন্‌ দেশ, অচেনা নগর টেনেছে কাছে বিমোহিত আলাপে কেটেছে প্রহর, হঠাৎ পড়েছে মনে ফেরার বেলা হলো, হঠাৎ পড়েছে মনে পেছনে ফেলে আসা জীবনের গান, হেঁটে আসতে আসতে কেউ পিছুটানে ডাকে নি ভেবে বাষ্পাকুল হলো দু'চোখ, হয়তো তাই ফিরে তাকালে দেখি পেছনে পথ ক্রমেই অপসৃয়মান...

বৃহস্পতিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

আমাদের কথা

তোমার সাথে মিশে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত
অঝোর বৃষ্টির মাঝে অলৌকিক বাসের প্রতীক্ষা
বাস এলে উঠে পড়া যায়, দরজা খুলে গেছে
কিংবা তোমার জন্য আরেকটু দাঁড়াতেও পারি

মঙ্গলবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৫

শাহবাগ

মাঝে মধ্যে অবাক হইয়া ভাবি শাহবাগ যেন জোঁকের মুখে নুন হইয়া গেছে!
প্রায় তো দুই বছর হইতে চললো। তেরো সালের ফেব্রুয়ারি থেকে-
এখন অব্দি কম তো গালি খায় নাই শাহবাগ। নিরীহ মাসুম চৌরাস্তার মোড়টারে
কী পরিমাণ এবিউজের শিকার হইতে হইলো - ভাবলেই মায়া লাগে।
কে না তারে গালি দিছে! কাদের মোল্লার পুত্র থেকে গোলামাজমের পুত্র,
লন্ডনের বড়ো গণতন্ত্র থেকে ব্যারনেস ভার্সি,
কমেডি সার্কাস জাতিসঙ্ঘের নাভি পিল্লাই পর্যন্ত
অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়া ভরাইয়া দিছে।
(আমার মতে বিদেশিগুলান ঠিক মতো ভরাইতে পারে নাই
তাগোর ভাষা বিদেশি আর আমরা ফকিন্নির পুত ইংরিজি বুজি না)
তারা একটু ওপরে থাকেন আর দেবতাগো মতো মিষ্টমধুর গালি দেন।
সোজাসাপ্টা কইতে পারেন না। এই খামতিটা পুষায় দিছে বঙ্গপুঙ্গব চ্যালাচামুণ্ডা।

প্রথমে গালি দিল রাজনীতিবিদ, শাহবাগ তাগোর কথা শোনে না।
পলিটিকাল গালি যদিও পলিটিকালি কারেক্ট হইতে হয়
তাই সেডা বেশি দিন গায়ে লাগে নাই।

তারপর গালি দিল মাদ্রাসাত্থোন আসা অপগণ্ডরা।
বান্দররে নাকি ছাইড়া দিলে পবিত্র ঘরেও দরজা-জানালা
ভাইঙ্গা মুইতা রাখে। এই গল্পখানা মনে পড়লো মে মাসের পাঁচ তারিখ।
রাইতের আন্ধারে বান্দরের গণহত্যা! কী কমু সেই বিভীষিকার কথা! থাউক...

তারপর সবকিছু শান্ত হইয়া আসলে রাজনীতিবিদরা গিয়া কইলো
"বহুত হইছে এলা ক্ষান্ত দেও", বইলা শাহবাগ ভাইঙ্গা দিল।
আমরা বুঝলাম গালি অপেক্ষা লাঠি অধিকতর শক্তিশালী।

কিন্তু... এর পরে আইলো কিন্তু পার্টি। ল্যাখক কোবি কিন্তু পার্টি।
এই পার্টির সদর দফতর মতিচুরপাড়া। ফোন দিয়া এডিটর
কয় ভাই একটা ল্যাখা দ্যান, কয় আপা একটা ল্যাখা দ্যান।
হাইয়ে ল্যাখে, ফাল্গুনিতে ল্যাখে। ঘুরায়া প্যাঁচায়া দুই চারটা
কলামিস্টও ল্যাখে। শাহবাগরে গালাইতেই হইবো।
হেতিরে গালাইয়া শুয়াইয়া দেও।
শাহবাগ এইসব দেখে হাসতে হাসতে দুইটা পাদ মাইরা দিল।
সে সুগন্ধে মতিচুরপাড়া গন্ধ গন্ধ হইয়া গেল।

শেষ রাতে ঘুম ভাইঙ্গা গেলে বারান্দায় গিয়া দাঁড়ায়া ছিলাম।
বৈদেশের হাড়কাঁপানি শীতে আন্ধারটা মিশমিশা হইয়া থাকে।
তারপর আস্তে আস্তে সূর্যটারে উঠতে দেখলাম। ভাবতেছিলাম,
"প্রায় তো দুই বছর হইতে চললো"। ভাইবা মনটা উদাস হইতেছিল।

তখন দেখি ওই দূরে দুই বছরের গান্ধাগালির জামা গায় দিয়া শাহবাগ মিটিমিটি হাসতেছে

সোমবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৫

আত্মজৈবনিক

এবং কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলে খেয়াল হলো যে কবিতা লিখি না
মাথার ভেতর এই খেয়াল মাটিতে পড়ার আগেই আমি দুই ভাগ হয়ে
তর্কে নামলাম। এক ভাগ বলে ওঠে হয়তো আপ্নে কখনই
কবিতা লিখতে পারতেন না। শুনে অন্য ভাগ তেড়ে আসে,
বেশি বুঝেন ইচ্ছা হয় না তাই লিখি না নাহলে দেখিয়ে দিতাম।
আমি দুই ভাগের তর্ক শুনি, কমলার জুস খাই
জুস বেশ তেতো লাগলে ভাবি একটু চিনি মেশালে মন্দ হতো না।

অর্ধেক আমার সাথে বাকি আধখানা আমি
গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে-
একাকার, তর্ক চললো কয়েকশ’ বছর

তারপর টের পাই এ তর্কে নষ্ট সময় – নষ্ট জীবন – নষ্ট আয়ু
ভেতরে তখন দুই ভাগের জোড়াতালি লাগে, সেলাই করে দেই।
দুই ভাগ মিলে এক ভাগ হয়ে কবিতা না লেখার কারণ লিস্টি করতে বসে-
লিস্টিতে যোগ হয় উদয়াস্ত ব্যস্ততা
লিস্টিতে যোগ হয় একটু বুড়িয়ে যাওয়া
লিস্টিতে যোগ হয় স্নায়বিক চাপ
লিস্টিতে যোগ হয় প্রবাস-জীবন
লিস্টিতে যোগ হয় চিরচেনা নিরর্থকতা
লিস্টিতে যোগ হয় ভিন্ন পরিবেশ

লিস্টিতে ঢুকে পড়ে খাবি খাওয়া মাছের মতো একটি উপমা
লিস্টির তলে জমতে থাকে গ্রোশারির লিস্ট
লিস্টির আগে চলে আসে ট্যাক্স রিটার্নের ডেডলাইন
লিস্টিটাকে ওয়ালেটে রেখে ভুলে থাকার চেষ্টা করি।

কবিতা অনেকটা পূর্বজন্মের মতোন,
বিদ্যুচ্চমকের গতিতে ফিরে আসা স্মৃতির গাঁইতি শাবল