মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬

নট সেইফ ফর ওয়ার্ক | N.S.F.W.

প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ! দোহাই লাগে ওদেরকে ভালোবাসার ঠাপ দিন। ভালোবাসার ঠাপের অভাবে ওরা ধুঁকছে পুরনো দশটনী ট্রাকের এঞ্জিনের মতন। প্রতিটি ভালোবাসার ঠাপ দশ টাকা। কীভাবে ভালোবাসার ঠাপ দিতে হয় সেই ম্যানুয়াল পড়ে নিন অনলাইন সেলিব্রেটিদের লেখায়। তারা বিস্তারিত লিখেছেন কীভাবে ভালোবাসার ঠাপই আইসিসের জঙ্গিদের একমাত্র চাওয়া। এই ঠাপ খেলে তারা বন্দুক হাতে হাসিমুখে ছবি তুলবে না। এই ঠাপ পেলে তারা আর বেকারিতে ঢুকে আস্তে আস্তে জবাই করবে না সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে। চলুন আমরা খুঁজে বের করি আরও অনেক ঠাপাভাবে দুস্থ জঙ্গিকে। যারা এখনো আশা করে আছে কেউ এসে তাদেরকে ঠাপাবে। তবে দ্রুত ঠাপ না পেলে ভালোবাসা না খেলে তারা এদের মতই বন্দুক হাতে ছবি তুলবে। অচিরেই ঢুকে পড়বে অন্য কোন খাবারের দোকানে কিংবা সুপার-মলে কিংবা আবাসিক বারান্দায় কিংবা সংসদে কিংবা পাবলিক বাসে কিংবা এয়ার-কন্ডিশন্ড অফিসঘরে। গলা কেটে দিবে নারীদের কিংবা কিশোরদের কিংবা বৃদ্ধদের কিংবা স্লিভলেস পরিহিতাদের কিংবা শ্বেতাঙ্গদের কিংবা ছাত্রদের কিংবা বন্ধুদের কিংবা মানুষের! আরিফ কিংবা ফারুকী কিংবা আনিসুল কিংবা তাদের লেখায় লাইক চাপা তিন লাখ ভালোবাসার ঠাপ দিতে উৎসাহী বাংলাদেশি তাদেরকে ঠাপায় নি কোনোদিন।

তাই আসুন এই ভালোবাসা দিবসে আমরা ইভেন্ট খুলি। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মিলমিশিয়ে দেই ঠাপাভাবে ভুগতে থাকা এইসব দুস্থ জঙ্গি আর ঠাপাতে আগ্রহীদের। দাতা-গ্রহীতার এই অবোধ্য পাশবিক মিলন ঘটুক আর আমরা বেঁচে যাই বরং!

মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬

রূপবান!

আজকে একটা দরকারে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার কাছে কিছু বিষয় জানার দরকার ছিল। অপেক্ষাগৃহে বসে নামধাম পূরণ করার কিছুক্ষণ পরে ডাক এলো। হাসিমুখে ডাক্তার এসে কথা বললেন। শান্তভাবে সমস্যার কথা জানানোর সময় কম্পিউটারে লিখে নিচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্নও করছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে সমাধান আর করণীয় ব্যাখ্যা করলেন। কী কী করতে হবে বলার সময় পাশে রাখা একটা নোটপ্যাড নিয়ে লিখে দিচ্ছিলেন। খেয়াল করলাম, ডাক্তার বাঁহাতি। সামনে বসে বাঁহাতি কারো লেখালেখি দেখতে বেশ মজা লাগে, কারণ বেশিরভাগ মানুষই (প্রায় ৮৭-৯২%) ডানহাতি। সচরাচর দেখা যায় না বলে হাতের আঙুলের নড়াচড়াগুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগে। যখন ক্যাডেট কলেজে পড়তাম, তখন আমার আগের ক্যাডেট নম্বরের বন্ধু বাঁহাতি ছিল। ভর্তি হবার পরে আমাদেরকে ক্যাডেট নম্বর অনুযায়ী থাকতে হতো। পরে এলোমেলো হলেও ছয় বছরের তিন বছরই এই বন্ধুর পাশের জায়গাতেই থেকেছি। প্রথম দিকে ওর লেখার সময় হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, স্রেফ কৌতূহল থেকেই। ও কেমন করে অক্ষরগুলো লিখছে, দেখতে মজা লাগতো।

বাংলাদেশের সমাজে অজস্র কুসংস্কারের মধ্যে একটা হলো যে বামহাত = খারাপহাত, আর ডানহাত = ভাল হাত। কে কবে কীভাবে এই ফালতু নিয়ম আবিষ্কার করেছে, কে জানে! (আমার আজকাল ধারণা হয় বাঙালিদের কুসংস্কারগুলো পায়খানাঘরে গেলে তৈরি হয়। হাগু করতে করতে অলস সময়ে এসব 'হাগু-ক্যাটাগরি'র আইডিয়া মাথায় আসে।) মানুষ একটা চমৎকার প্রাণী, যার দুইহাতই সমান কর্মক্ষম। আজ আমরা জানি যে বামহাত ডানহাতের কোন ভাল-খারাপ নেই। যে যে হাতে দক্ষ, সে সেই হাতে কাজ করতে পারে। বামহাতকে 'খারাপ' বলার মূল কারণ বাঁহাতিদের স্বল্পতা হতে পারে। সাধারণত বাঁহাতির সংখ্যা ১০%-এর মতো, অর্থাৎ গড়ে প্রতি নয়জনে একজন বাঁহাতি হবে। যেহেতু এটা সচরাচর দেখা যায় না, তাই ওই নয়জনের ডানহাতি হওয়াটাই 'স্বাভাবিক' আর একজনের বাঁহাতি হওয়াটা 'অস্বাভাবিক' বলে মিথ্যা নিয়ম বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। এই নিয়মের চক্করে পড়ে আমাদের দেশের অনেক বাঁহাতিকেই ছোটবেলায় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হতে হয়। বাঁহাতে লেখা বা ধরার সময় মেরে-পিটিয়ে তাকে ডান হাত ব্যবহার করতে শেখানো হয় (আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই এমন ঘটনা আছে)। আজ আমরা জানি যে শিশুকে তার দক্ষ হাত ও পা ব্যবহার করতে না দিলে সেটা  তার মস্তিষ্কের উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে যতটা চটপটে হতে পারতো, ততটা হতে পারে না। চিন্তা করুন এভাবে কত মানুষকে কষ্ট করে নিজের কম দক্ষ হাতে লিখতে, খেতে, ধরতে শিখতে হয়েছে!

মানুষ হবার একটা সীমাবদ্ধতা হলো আমরা অন্যের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারি না। এজন্য অনেকসময়ই তাদের অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ মনে করি। এই হাতের সক্ষমতা তার একটা ভাল উদাহরণ - সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ হবার পরেও পরিসংখ্যানে কম পাওয়া যায় এমন বৈশিষ্ট্য থাকায় একজন মানুষের ওপরে নানাভাবে আমরা অন্যায় বোঝা চাপিয়ে দেই। কখনো বুঝেশুনে দেই, কখনো অজান্তেই দেই। এরকম আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই কালো বা বাদামি বর্ণের। এই রঙের কোন ভাল-খারাপ দিক নেই। তারপরেও যারা অতিরিক্ত কালো বা অতিরিক্ত সাদা, তাদেরকে নানাভাবে হেয় করা হয় না? বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই গড়ে সাড়ে পাঁচ থেকে পৌনে ছয় ফুট (পুরুষ) আর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট (নারী) হয়ে থাকেন। এই সীমার বাইরে যারা অতিরিক্ত লম্বা বা অতিরিক্ত বেঁটে, তাদেরকে কি হেয় করা হয় না? বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান। এর বাইরে যে যে ধর্মের মানুষ আছেন, তাদেরকে কি নানাভাবে হেয় করা হয় না? এই বৈশিষ্ট্যগুলো কিন্তু কেউ বুঝেশুনে বেছে নেয় না, বা খেটেখুটে অর্জনও করে না। জন্মের আগেই আমাদের ডিএনএ'র সংকেতের মধ্যে লেখা হয়ে যায় আমরা পুরুষ-নারী, লম্বা-বেঁটে, ফর্সা-কালো, ডানহাতি-বামহাতির মধ্যে কোনটা হবো। আমাদের বাবা আর মায়ের জিনের বৈশিষ্ট্যকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই! আর জন্মের পরপরই ঠিক হয়ে যায় আমরা কোন ধর্মের মানুষ হবো। এরকম random, arbitrary, coincidental, accidental বৈশিষ্ট্য দেখে আমরা কত সহজেই মানুষকে অপমান করি, তুচ্ছ করি। 

কী অদ্ভুত পরিহাস! যেটা আমরা নিজেরা বেছে নেই না, যাতে আমাদের নিজেদের কোন হাত নেই, তার কারণে সারাজীবন কষ্ট পেতে হয়। এটাই সমাজের নিয়ম! অথচ যে বিষয়গুলো আমরা নিজেরা ভেবেচিন্তে বেছে নেই, সেগুলোর কারণে আমাদের এতোটা জ্বালা-যন্ত্রণা পোহাতে হয় না।

নিজের ইচ্ছায় বেছে না নেয়া আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে, আমাদের লিঙ্গ (sex) আর যৌন-পছন্দ (sexual preference)।  মনে করার চেষ্টা করুন তো, বয়ঃসন্ধিতে যে মানুষটিকে ভাল লাগতো, সেটা কি আপনি নিজের ইচ্ছায় বেছে নিতেন? নাকি ব্যাখ্যার অতীত এমন এক অনুভূতি এসে আপনাকে টালমাটাল করে দিতো? আপনি ছেলে বা মেয়ে বা বৃহন্নলা, যাই হন না কেন, কাউকে ভাল লাগার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আপনি বড়োজোর বলতে পারেন পছন্দের মানুষটির কোন কোন দিক আপনার ভাল লাগে। আমাদের যৌন-পছন্দ প্রধানত শারীরিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা অন্য মানুষের শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হই। কিন্তু এটাই একমাত্র নিয়ম না। আমাদের মধ্যেই কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাদের যৌন-পছন্দ মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। শারীরিকভাবে আপনি যতই আকর্ষণীয় হন না কেন, যদি তারা মানসিক আকর্ষণ বোধ না করে, তাহলে আপনাকে ততটা পছন্দ করতে পারবে না। যদি আপনি প্রথম গ্রুপের  হয়ে থাকেন, তারপরেও মানসিক আকর্ষণের প্রভাব কিছু পরিমাণে আপনার মধ্যেও আছে। অনলাইনে বা ফোনে যখন কারো সাথে পরিচিত হয়ে আকর্ষণ বোধ করেন, কাউকে সামনাসামনি না দেখেই, সেটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? শুধুমাত্র গলার স্বর বা টাইপকরা অক্ষর দেখেই কি আকৃষ্ট হন না? পরে হয়তো শরীরের টান ছাপিয়ে যায়। অন্য গ্রুপের ক্ষেত্রে উল্টোভাবে ঘটে - সামনাসামনি দেখে ভাল লাগা হতে পারে, কিন্তু প্রচণ্ড আকর্ষণ তৈরি হয় মানসিক স্টিমুলেশনে, যা শুধু অন্যজনের কথা বা চিন্তাতেই সম্ভব। এই দুই ভাগ ছাড়াও আরও বিচিত্র ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভাগ আছে।

এখন বলুন, এদের মধ্যে কোনটা খারাপ? আর কোনটা ভাল?

নিয়মটা কি আপনি ভেবেচিন্তে তৈরি করেছেন? নাকি অন্য কেউ আপনার জন্য তৈরি করে রেখেছে? যে তৈরি করেছে, সে যে সবকিছু জানে বা বোঝে  - এমন তো নাও হতে পারে। আগেই দেখলাম যে আমরা অন্যের অভিজ্ঞতা বুঝতে অক্ষম, তাই জেনে না-জেনে অপরকে অপমান করি। ওটা যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এটাও ভুল। অন্যের অভিজ্ঞতা যেহেতু আপনি জানেন না, সেহেতু আপনার কোন অধিকার নেই তাকে হেয় করার। খেয়াল করে দেখবেন, অন্যরা কিন্তু আজ এসে আপনাকে বলছে না যে আপনি নিজের পছন্দমতো কাউকে ভালবাসতে পারবেন না (আজকাল বাবামায়েরাও অনেক সময় বলতে পারে না)। যারা বলে, যারা জোর করে চাপিয়ে দেয়, তখন আপনার কেমন লাগে? খুব খারাপ লাগে না? ভালোবাসার মানুষকে না পেলে সবারই খারাপ লাগে।

আমরা যেসব পুরানো ক্লাসিক গল্পতে মজা পাই, তার প্রায় সবগুলোই প্রেম-ভালবাসার। আর সেসবের অধিকাংশই কোন না কোন কারণে বাধা পেয়েছিল। কখনো পরিবার, কখনো সমাজ, কখনো বয়স, কখনো যুদ্ধ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভালোবাসার মাঝে। মুনীর চৌধুরীর "রক্তাক্ত প্রান্তর" মনে আছে? ইব্রাহিম কার্দি আর জোহরার প্রেম? কিংবা লাইলী-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট, দেবদাস-পার্বতী, অমিত-লাবণ্য, কুবের-কপিলা? এরকম অসংখ্য দুর্দান্ত গল্পের মিল কোথায় বলুন তো? এগুলো সবি মানুষের বিচিত্র, অব্যাখ্যাত, বর্ণনাদুঃসাধ্য ভালোবাসার জয়ের গল্প। পাত্রপাত্রী মোরে গেলেও যেখানে ভালোবাসা জিতে যায়। এগুলোকে আপনি accept করে নিতে পারছেন কীভাবে? পারছেন কারণ এদের প্রেমে আপনার কিছু যায় আসে না। এরা বিয়ে করলে আপনি টাকা পাবেন না, এরা মরে গেলেও আপনার চাকরি চলে যাবে না। সুতরাং কোন দুজন রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষের প্রেমের মাঝখানে বাগড়া দিয়েন না। তারা যদি সরাসরি আপনার কোন ক্ষতি না করে, তাহলে তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিন। কড়াভাষায় যাকে বলে, "নিজের চরকায় তেল দিন"।

আর তারপরেও হয়তো আপনি ভাবছেন, "আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু তবু এটায় সমাজের ক্ষতি, মূল্যবোধ অবক্ষয়, সংস্কৃতির অপমান" ইত্যাদি। তাই আমি এই বিষয়ের বিরোধিতা করবোই", তাহলে বলতেই হয়, যে আপনি আসলে একজন *** ভাই। আপনার জীবনে কাজের এতোই অভাব যে আপনি অন্যের ভাল থাকা দেখতে পারেন না। পায়খানায় বসে বসে ফন্দি আঁটেন কীভাবে অন্যের ভাল থাকায় বাগড়া দেয়া যায়। সমাজে আপনার ইনপুট অতোটুকুই! আপনি মরে গেলে মাটির তলে পঁচবেন বা আগুনে ভস্ম হবে। দুইক্ষেত্রেই আপনাকে কয়েকদিন পরে সবাই ভুলে যাবে। আর যাদের ক্ষতি করেছেন, বা যাদের কুৎসা গেয়েছেন, তারা উঠতে বসতে গালি দিবে, "শালা একটা *** ভাই আছিলো। মরছে ভাল হইছে!"

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

খেলাখেলি

ছোটবেলা থেকেই আমি খেলাধুলায় তেমন একটা ভাল না। যে কয়টা খেলা শিখেছি, তার কোনটাতেই আমি খুব ভাল করি নাই কখনো। যে দেশে মাঠে-ঘাটে পোলাপান ফুটবল আর ক্রিকেট খেলে, সেখানে আমার ভাল লাগতো ক্যারম আর টেবিল-টেনিস। তবু দেখা যেতো, আমি বারবার হেরেই যাই। সেই হেরে যাওয়া নিয়ে যে খুব দুঃখ লাগে, অমনও না বিষয়টা। এজন্যই কোন খেলাতেই আমি খুব বেশি পারদর্শী হতে পারি নাই।

প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে একটা সূক্ষ্ণ হিংস্রতা (ভালো অর্থে) আছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে জিতে যাওয়ার আনন্দও আছে। সেই আনন্দের জন্যই খেলোয়াড় আর দর্শকরা এতোটা মশগুল হয়। এই হিংস্রতাকে ভাল বলছি, কারণ এর সাথে আমাদের জিনের ভেতরে টিকে থাকার সঙ্কেতের সম্পর্ক আছে। প্রকৃতির প্রতিকূলতা একসময় আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল। এর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে আমাদের টিকে থাকতে হতো।

এখন আমরা সেই প্রকৃতিকে বশ করে ফেলেছি। হুট করে কোন দুর্যোগেও সাময়িক বিপদ কাটিয়ে আমরা সামলে উঠি। কিন্তু জিনের ভেতরে সেই লড়াইয়ের নির্দেশ তো আর এতো সহজে মুছবে না! তাই লড়াইটা নিজেরা একে অপরের সাথে করাই লাগে। এই লড়াইয়ের সবচেয়ে বাজে রূপ হলো ক্ষমতার লড়াই, তথা যুদ্ধবিগ্রহ। নিজের প্রজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লোভে খুন করার এই অভূতপূর্ব "মাইন্ড-বগ্লিং" কাজটা আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। আজ যদি বাইরে থেকে কোন বুদ্ধিমান প্রাণী আমাদের মাঝে আসে, তাহলে খুবই অবাক হবে যখন দেখবে যে আমরা মাটিতে কিছু কাল্পনিক দাগ কেটে সেই দাগের দুই পাশে দাঁড়িয়ে পরষ্পরকে কেটে ফেলছি।

এই লড়াইয়ের ভাল রূপ হলো খেলাধুলা। খেলায় জয়-পরাজয়ের হিসেবটা আরোপিত। খেলার নিয়ম-কানুনও আরোপিত। অর্থাৎ আমরা নিজেরাই ভেবে ভেবে এগুলো সৃষ্টি করেছি। আমাদের জিনের হিংস্রতম প্রবৃত্তিটাকে চেপে না রেখে যতটা কম হিংস্রভাবে বের করে দেয়া যায়, সেই চেষ্টাই আমরা সাধারণত করে থাকি। এখানে উল্লেখ্য যে খেলার নামে মেরে ফেলার খেলাও আমরা একসময় খেলতাম। তবে এখন সেগুলো বাতিল হয়েছে, রক্ষা!

আদিম প্রবৃত্তিকে খেলার মাধ্যমে বের করে আনা তো গেল। কিন্তু খেলা শেষ হলে সেটাকে আবার বাক্সে পুরবে কে? এ যেন প্যান্ডোরার বাক্সের মতো, খুললেই বেরিয়ে আসে ক্রোধ, ভেদাভেদ, হিংস্রতা, ঘৃণা, জিঘাংসা, জিগীষা।... সাথে আরও আসে সতীর্থ খেলোয়াড়দের প্রতি একাত্মতা, দলের প্রতি প্রতিজ্ঞা, অধিনায়কের প্রতি আনুগত্য, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেমের মতো হিতকর অনুভূতি। এই সবকিছুরও দুইটা ভাগ করা যায় তাহলে - খারাপ আর ভাল অনুভূতি। প্রথমে যেগুলো বললাম, সেগুলোকে আমি খারাপ অনুভূতি মনে করছি। কারণ এই অনুভূতি একদিকে মনকে বিষিয়ে তোলে, অপর মানুষকে শুধুমাত্র একটা প্রতীকে পরিণত করে। মানুষ হিসেবে আপনি আরেকজন মানুষকে শুধুই একটা প্রতীকে চিন্তা করতে পারেন না। যখনই তা করবেন, তখন এক পিচ্ছিল পথ ধরে পড়ে যাবেন। যে পথ দিয়ে আপনার আগে আরো অনেকেই পড়েছে। যে পথের শেষে আছে অপরকে খুন করে সে রক্তে উল্লাসের গন্তব্য। সে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আগে ফিরে আসুন। আপনার যদি নিজের দেশকে সমর্থন দেয়ার অধিকার থাকে, তাহলে অপর একজন মানুষেরও অধিকার আছে তার দেশকে সমর্থন দেয়ার। সে যদি ঐ পিচ্ছিল পথে যেতেও চায়, যাক। আপনি কেন যাবেন সে পথে?

পরে যেগুলো বলেছি, সেগুলো হিতকর অনুভূতি। কারণ এর প্রতিটিই আপনাকে আরেকজন মানুষের সাথে ঐক্যের অনুভূতি দেয়। আপনি বোধ করেন যে আপনার সতীর্থরা আপনার কাছের মানুষ। তাদেরকে আপনি আপনার সমান মনে করেন। দেখবেন এই অনুভবটা খুব সুখের, যা দৈনন্দিন কষ্টকেও কমিয়ে দেয়। খেলোয়াড়রা এই অনুভূতিগুলো সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভব করে, দর্শকরাও করে কিছু কম মাত্রায়, তবে করে বৈ কী! এই যে একতাবদ্ধতা, এই যে অপর মানুষকে সমান ভাবা - এর থেকে আপনার মনে সহমর্মিতার (empathy) সৃষ্টি হয়। আমাদের বিবর্তনে এই অনুভূতিটাই সবচেয়ে হিতকর এবং উচ্চমানের অনুভূতি। প্রতিপক্ষকে হারানোর চেয়েও নিজপক্ষকে জেতানোর দিকে তখন মনোযোগ দেয়া যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন খেলায় যারা সেরার সেরা, তাদের বক্তব্যগুলো একটু খেয়াল করে দেখবেন, তারা কেউই প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে কিংবা হারিয়ে-জুতিয়ে-মাড়িয়ে ফেলতে চায় নি। তারা শুধুই নিজেদের কৌশল, পারদর্শিতা, দক্ষতাকে সুউচ্চে নিতে চেয়েছেন। যে কোন খেলার গ্রেটদের মাঝে এটা কমন বৈশিষ্ট্য। এটাকে আমরা অনেক সময় বিনয় বলে ভুল করি। যাদের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য নেই, তারা সেই খেলায় গ্রেট হতে পারে নি। কোনদিনও পারবে না। লিখে দিলাম, চেক করে দেখতে পারেন।

[২]

খেলা চলছে। খেলার উত্তেজনায় অনেক কিছুই আমরা বলি। ভেতরের কালি বেরিয়ে আসে, যা দিয়ে লিখি উল্লসিত অক্ষর। কিন্তু খেলার পরে সেগুলো থেকে নেতিবাচক অনুভূতিগুলো প্লিজ সরিয়ে ফেলুন। আপনার নিজের জন্যই। ইতিবাচক অনুভূতিগুলোকে সাজিয়ে রাখুন। সেটাও নিজের জন্যই। দেখবেন ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভাল অনুভূতিগুলোকেই মনে পড়বে।

চারপাশে অনেকেই নেতিবাচকতাকে উসকে দিচ্ছেন। নিজের উগ্র জাতীয়তাবাদের সাপটা ফোঁসফোঁস করছে। সেই সাপকে জাস্টিফাই করছেন "ওরাও তো অমুক তমুক করেছে/বলেছে/লিখেছে/এঁকেছে" ইত্যাদি বলে। সেই পিচ্ছিল পথ! একটা খারাপ তুলনা দেই এ'বেলা। অনেকটা এমন যে, কেউ ল্যাট্রিনের গু তুলে সারা পাড়া মাখিয়ে বেড়াচ্ছে বলে আমিও কিছু গু হাতে তুলে নিলাম। আপনি নিজেও হয়তো বুঝতে পারছেন যে আপনার কথাগুলো উগ্র, এবং এটার সমর্থক অল্প। আপনি যে বা যার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে এমন করছেন, তারাও 'অধিকাংশ' না, অত্যন্ত ছোট একটা গ্রুপ। আপনারা দুই গ্রুপই বারবার করে এমন করছেন কেন? যাতে দলে ভারী হতে পারেন। একইভাবে বিভিন্ন রাজনীতিবিদও বারবার করে এধরণের কথা বলেন। আস্তে আস্তে তারা দলে ভারী হয়। কেউ উঠে দাঁড়িয়ে তাদের থামতে বলে না। খেলার উত্তেজনা একদিন জাতিগত উন্মাদনায় পরিণত হয়।

প্রতিটি উন্মাদনাই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। কপাল খারাপ হলে চিরস্থায়ী। আজ এশিয়ার উপমহাদেশে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের অসংখ্য কামড়াকামড়ি দেখে ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রেতাত্মারা ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে! কী যাদু করিলাম রে বন্ধু - বলে একে অপরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। নাতির ঘরের পুতি বুড়ো হয়ে গেল, তবু জাতি-ধর্ম-বর্ণবিদ্বেষ কাটাতে পারলো না। সামান্য সাড়ে তিন ঘন্টার খেলার খোঁচায় দগদগে ঘা বেরিয়ে গেলো!..

[৩]

এই নেতিবাচকতা থেকে মুক্তি অচিরেই আসবে বলে মনে হয় না। দূরে থাকার চেষ্টা করছি যতোটা পারি। আজকে বাংলাদেশ পুরুষ দলের খেলা নেই। তবে বাংলাদেশ নারী দলের খেলা আছে। গত ম্যাচের আগে তাদের ছোট ছোট সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। জাহানারা, ফাহিমা, রুমানা, সালমা, আয়েশাদের চোখে মুখে দীপ্ত বিশ্বাস - বিশ্বপ্রতিযোগিতার দরবারে তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন। নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনবেন। বাংলাদেশের সমাজ নারীদের জন্য ক্রিকেট খেলা বা যে কোন খেলাই পেশা হিসেবে নেয়ার পথে অসংখ্য প্রতিকূলতার কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। তাদের নিবৃত্ত করতে, হতাশ করতে আমরা চেষ্টার কোন ত্রুটিই রাখি না। এই চর্চা ঘর হতে বাহির পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপরেও সেসব কাঁটার তোয়াক্কা না করে তারা এতোদূর পৌঁছে গেছেন। অথচ অবাক ব্যাপার কি জানেন? তাদের বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। তারা শুধুই আপনার সমর্থন চান। ভেবে দেখুন, এই প্রতিকূলতার ভগ্নাংশ আপনার স্বপ্নপূরণের পথে থাকলে আপনি কতোটা নালিশ করতেন! তারা সেসব কিছুই না করে নিজেদের স্বপ্নটুকুই সার্থক করতে চলেছেন। (আবারও সেই নেতিবাচক বনাম ইতিবাচকের পাল্লা এবং ইতিবাচকতার জয়)। আজ তাই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের জন্য শুভকামনা জানাই!

দুটো বিশ্বকাপ চলছে। পুরুষদল ছোট প্রতিপক্ষকে হারালেও বড়োদের এখনো হারাতে পারে নি। মনে মনে আশা করছি নারীদল বড়ো প্রতিপক্ষকে হারাবে আজ। সেই উদাহরণ থেকে পুরুষদলও জয়ের মুখ দেখবে! জয় বাংলা!

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

দেশ

একাকী ছাইগোলা ঘোলাকাশে ধূসর বিমান উড়ে যাচ্ছিল। বিবর্ণ বৃক্ষের বাহু উর্ধ্বপানে বিস্তৃত- আকুল প্রার্থনারত মরণোন্মুখ বৃদ্ধকে মনে পড়ে। মনে পড়ে গত জন্মের ছেড়ে আসা ঘর ফেলে আসা উঠান মুছে যাওয়া ব্যালকনি। সে ঘরে কেউ নেই, সে উঠানে নেই পত্রপল্লবিত ঝিলিমিলি ছায়া, ব্যালকনিতে নেই টাঙানো দড়িতে ভেজা কাপড়ের সারি। মনে পড়ে কোন এক জনপদে আমি ছিলাম। সে জনপদ আর আমি একে অপরকে ক্রমেই ভুলে যাই।