মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০২২

Spin

 

"সাদাত ভাই, আপনি একটু মীমাংসা কইরা দেন।"
 
"ঘটনা কি?"
 
"আচ্ছা, বিশ্বের সেরা স্পিনার কে বলেন তো? আজিম বলতেছে শেন ওয়ার্ন, সে কারে কারে কতবার আউট করছে - এইসব স্ট্যাট দিচ্ছে। কিন্তু আমার কথা হলো মুরালীধরন সবচেয়ে বেশি উইকেট পাইছে। এখন আপনিই বলেন।"
 
সাদাত ভাই প্রশ্নটা শুনেই মুখে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। আমার পাশে আজিম দাঁড়ানো, তার দিকে বারকয়েক তাকালেন। বললেন, "তোরা এই সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক করছিস কেন? এটার উত্তর তো সহজ। এরা কেউই বিশ্বের সেরা স্পিনার না।"
 
আমরা থতমত খেয়ে গেলাম। আজিম বললো, "তাহলে কে ভাই? আশ্বিন?" 
 
এবার সাদাত ভাই জোরে হেসে দিলেন, "আরে ধুর, ও হতে যাবে কোন দুঃখে! সেরা স্পিনার হলো কালাম চাচা।"
 
"মানে? কালাম চাচা ক্রিকেট খেলেন নাকি?" আমরা দু'জনেই তড়বড় করে বলে উঠলাম। 
 
"কালাম চাচা রোজ বিকালে যখন জিলাপি বানাতে থাকে, তখন কখনো পাশে বসে দেখেছিস? এত বড় কড়াইটায় টগবগ করে তেল ফুটছে, নিচের স্টোভ থেকে হলকা হলকা গরম গায়ে এসে লাগছে, চারপাশে এত আওয়াজ শোরগোল, রাস্তায় রিকশা-গাড়ি-জ্যাম, মানুষের ভিড়। সবাই এসে তাড়াহুড়া করে ইফতারি কিনছে। এসব কিছুর মধ্যে বসে নির্বিকারভাবে কালাম ভাই চিকন চিকন জিলাপি বানায়। চারপাশের কোনো অস্থিরতাই তাকে স্পর্শ করে না। আর কী নিখুঁত তার হাতের ঘূর্ণি! ঠিক মাপা আড়াই প্যাঁচের একেকটা জিলাপি, কোনোটা পাশাপাশি লেগে যায় না, সবগুলো একই মাপের হয়, বড়-ছোট হয় না, গোল গোল হাত ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে। এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা একটানা হাত ঘুরিয়েও তার জিলাপি সব একরকম। পারবে তোদের ওয়ার্ন বা মুরালি?" 
 
সাদাত ভাইয়ের এত কথার পর আমাদের মুখে আর কথা সরলো না। তবে কেন জানি হঠাৎ করেই খুব জিলাপি খেতে ইচ্ছা করছে!
 

শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০২২

Relief

"No, you can't use that, you have to buy something first." The droopy-eyed guy replied with a monotone voice. 
 
"ব্যাটা চামার কোথাকার!", I think to myself, "Okay, give me a moment."
 
(কী কেনা যায়? ওয়ালেটটাও ভুলে গাড়িতে ফেলে আসলাম। ফোন দিয়ে পে করা লাগবে। আচ্ছা, কিন্তু কী কিনবো? চিপ্স? না, থাক। এসব খেয়ে গ্যাস হবে একগাদা। তাইলে একটা কোক নেই? কিন্তু ঠাণ্ডাটা কি আরো জেঁকে বসবে না? একটা স্প্রিং ওয়াটার নিয়ে নেই বরং। পানি তো পানিই, খাওয়া হবেই। কিন্তু ওটার দামও তো চার ডলার! ট্যাক্স ধরে-টরে আরো বেশি পড়বে। পানি এত টাকা দিয়ে কিনে খাবো? বিড়ি-সিগারেটের অভ্যাস থাকলে ভাল হইতো। সেটাও নাই!)
"How much are those bananas?" 
 
I point to the fruit basket beside the counter. Some brown-spotted ripe bananas are sitting with a couple of green apples. 
 
"$2.30", the answer came with the same non-chalance.
 
"Okay, I'll take those. Now give me the key. Please." 
 
....
 
I add the extra please before he changes his mind. Then I rush down the aisle to the end. In big black lettering it says, RESTROOM. I say to myself, "ত্যাগেই মুক্তি, ত্যাগেই মোক্ষ!"

শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১

স্লো রাইড

অনেক আগে একবার এক নাম-না-জানা পথে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিকেল পড়ে আসছিল দ্রুত। গন্তব্যে ফেরার তাড়া কাজ করছিল কিন্তু যার সাথে এসেছিলাম তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম সে হয়তো অন্য কোনো পথে চলে গেছে। চারপাশে ত্রস্ত দু'চোখে তাকে খুঁজছিলাম, কোনো এক পথের ফাঁকে বা বাঁকে তাকে দেখা যাবে এই আশায়। এভাবে দিগভ্রান্ত ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে দেখলাম এক লোক রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। সে যেখানে বসে আছে সেটা একটা তিন-মাথার মুখ - তিন দিক থেকে তিনটা রাস্তা এসে মিলেছে। আর লোকটা বসে ছিল তিন পথের দিকে পিঠ দিয়ে চতুর্থ দিকে মুখ করে। সেদিকে কোনো পথ নেই, শুধু রাস্তার ঢাল খাড়া নেমে গেছে অনেক গভীরে। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছিল অমনই আরেক তে-মাথা জাংশন। সেইখানে বসে ছিল আরো একজন। আলো কমে আসায় তার মুখাবয়ব ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছিল না। শুধু বোঝা যাচ্ছিল এই লোকের মতনই সে বসে আছে, ঠিক যেন আয়নার প্রতিবিম্ব। সে কি নারী নাকি পুরুষ সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছিল তার একটানা নাকি কান্নার অস্পষ্ট শব্দের ঢেউ। দেখতে দেখতে আমার দেখাদেখি পাশে আরো গুটিকয়েকজন জড়ো হয়ে গেল। একজন বলাবলি করছিল, দ্যাখেন পাগলের অবস্থা। চাল নাই চুলা নাই, ভর-বিকালে বইসা বইসা কানতেছে। কীসের জন্য কানতেছে কে জানে?! 

আরেকজন শুনে বলে উঠল, কানতেছে ওই যে, ওই পাগলটার জন্য। এই দুইটারে এক করে দেয়া গেলে ভাল হইতো। দুই পাগলে মিলেমিশেই থাকতো। 

এ'কথা শুনে প্রথম জন আবার বলল, কিয়ের মিলমিশ? দেখা হইলে এই দুইটা নখ দিয়ে আঁচড়ায়া মাইরা কাইটা শেষ কইরা দেয়। ভালোই হইছে দুইটারে দুই জায়গায় সরায় দেয়া হইছে। 


পাতলা চাদরের মতন ভিড়টা কিছুক্ষণ পর পাতলা হতে শুরু করে। সেই চাদর ফুঁড়ে একজন আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। হয়তো আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে তার কিছু বলতে ইচ্ছা করেছে। সে বললো, আসলে যা শুনলেন অমন কিছু না। এইখানে একটা মেঠো রাস্তা ছিল। যখন ইটের ভাঁটায় কাঁচামাল দরকার হলো তখন সেই রাস্তাটা উঠিয়ে ফেলা হল। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। যোগাযোগ বন্ধ, মানে কথা বলা, একে অপরের বাসায় যাওয়া, আনন্দ-বিষাদ সব প্রতিবেশির সঙ্গে ভাগ করে নেয়া - এসবই এক নিমিষে খতম। হয়তো পাগলটা, থুক্কু, স্যরি ভুল বলেছি, হয়তো মানুষটা এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারে নি। 


এই লোকটার ব্যাখ্যা শুনে কিছুটা উত্তর পেলাম আর বাকিটা নিজে নিজে বানিয়ে নিলাম। তে-মাথায় বসা একাকী অপ্রকৃতস্থ লোকটা হয়তো আমাদের চেয়ে বেশি ভারসাম্য-পূর্ণ। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই অকস্মাৎ বিচ্ছেদ সে মেনে নিতেই পারে নি। দূরে বসে বসে আবছা হয়ে আসা মানুষটার দিকেও তাকালাম। যোগাযোগ-হীনতায় পীড়নে-যন্ত্রণায় দু'জনই কাঁপছে। কিন্তু মুখে কিছু শব্দ করা ছাড়া তাদের কোনো ভাষা নেই। ঠিকমত খেয়াল করলেও মনে হয় এসব শব্দের কোনো অর্থ হয় না। দুই বিন্দুর মাঝে ক্ষুদ্রতম দূরত্ব একটি সরলরেখা। সেই রেখার দুই প্রান্তে বসে দু'জন - যাদের মুখে কথা নেই - শুধু অস্পষ্ট কান্না, প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা। তারা কি এই বিচ্ছেদের জন্য কাঁদছে? নাকি এই যে মাঝখান থেকে ব্রিজটা তুলে নিয়ে গেল, সেই ব্রিজের তিরোধানের শোক পালন করছে? লোকটির যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অশ্রু-ভেজা ভেঙেচুরে আসতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কেন কাঁদছে সেটা জরুরি না একেবারেই।

বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১

ঘুলঘুলি

গতকালের বৃষ্টির পর আজ আবার গুমোট গরম। সকালের হালকা ভেজা ভেজা আমেজ শেষ হয়ে গেল, সূর্য তেতে উঠতে সময় লাগলো না। সেই ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে সারাদিন কেটে গেল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। ওয়েটিং রুমের অপেক্ষার দীর্ঘ শ্লথ মুহূর্তগুলোয় আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথা মনে পড়ে। সময়ের গতি আসলে নির্দিষ্ট কিছু না। এটা সময়ভেদে বাড়ে-কমে। অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করতে হলে সময় প্রলম্বিত হয়ে যায়। আর ব্যস্ততার মাঝে থাকলে ঘটে উল্টোঘটনা। আজ আরেকটা নতুন জিনিস খেয়াল করলাম। ওয়েটিং রুমের সামনেই রিসেপশন ছিল। সেখানে যারা আসছিল, তাদেরকে প্রথম সম্ভাষণে খুব উচ্ছ্বাসমাখা কণ্ঠে আপ্যায়ন করছিল রিসেপশনিস্টগণ। যেন বহুকালের পুরনো বন্ধু, অনেকদিন পর দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে। এই সুরটা এতো আপন যে এর মেকিত্বটুকু প্রথমে ধরা পড়ে না। অনেকবার শুনতে শুনতে গলার স্বরের সূক্ষ্ণ যান্ত্রিক টানটুকু চট করে কানে এসে বাজে। আজকে অনেকবার শুনতে শুনতে মনে হলো এই মেকি আপন ভাবটা কি আসলে ভাল, না খারাপ? সবসময় জেনে এসেছি যে মেকি যে কোনোকিছুই খুব একটা ভাল কিছু না- মেকি কথা, মেকি স্বভাব, মেকি প্রতিজ্ঞা - এসবই তো মিথ্যার আরেক রূপ। কিন্তু আজ মনে হলো এই খানে এমন মেকিত্ব শুধু দরকারিই না, আবশ্যিকও বটে। এখানে যারাই আসছে, তাদের সকলেরই নিশ্চয়ই অনেক দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ কেটে যায় রিসেপশনিস্টদের সাথে কথা বলার পর। তারা এই 'আহ্লাদ'টুকু হয়তো উপভোগই করেন। এই মেকিত্ব বাদ দিয়ে রিসেপশনিস্টরা যদি তাদের ক্লান্তি, অবহেলা, দুশ্চিন্তা, কিংবা স্রেফ অন্য কোনো কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে থাকলে সেটার বিরক্তি প্রকাশ করে দিতো, তাতে তো কেউই খুশি হতো না। বিকেলে একটা ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে গেলাম। বিশাল সুপারস্টোরের ভেতরে এক কোণে ফার্মেসি- সেখানেও কয়েক মিনিটের অপেক্ষাপর্ব। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ওপরে তাকিয়ে দেখি হালকা ঘিয়েরঙা করুগেটেড ছাত, মানে ঢেউটিনের মতন অনেকটা। কেমন যেন ওয়্যারহাউজ ওয়্যারহাউজ মনে হয়। স্টোরের ভেতরে সারি সারি সারিবদ্ধ জিনিস। সারির সংখ্যাই একশ'র ওপর। তাহলে জিনিস কত আছে মোটমাট? তাও সবাই মিলে কিনে-কেটে আমরা শেষ করে দিচ্ছি হরদম। কী এক দক্ষযজ্ঞ! আর এসবের ওপরে নিশ্চুপ ঢেউটিন। সেই বিস্তৃত ঢেউটিনের মাঝে বেশ দূরে দূরে কিছু অংশ বর্গাকারে কেটে সেখানে কাচ লাগানো আছে। সেই বর্গের ভেতর দিকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যের আগে কনে-দেখা-আলোয় আকাশ প্রায় কমলালেবুর রঙ ধারণ করেছে। ফ্লুরোসেন্ট লাইটে আলোকিত দোকানটির ভেতরে সেই অল্প চারকোনা প্রাকৃতিক আলো যেন পথ ভুলে ঢুকে পড়ছে। এখানে সে আলো অপাংক্তেয় খুব। তাই লজ্জায় রাঙা হয়ে যাচ্ছে সে। সেই লজ্জাকে কিছুটা আড়াল দিতেই হয়তো চোখ সরিয়ে নিলাম। থরে থরে সাজানো অজস্র ভোগ্যপণ্য আর আহারাদি দেখতে থাকলাম।

ক্যাটস অ্যান্ড ডগস



মঙ্গলবার সকাল থেকে বাংলাদেশের বর্ষাকাল পথ ভুলে চলে এসেছিল। আকাশ-ভরা থমথমে কালো মেঘ, আর নিরন্তর বৃষ্টি। কখনো একটু ধরে আসলেও পুরোপুরি থামে না। মাঠ-ঘাট থেকে রাস্তা-দালান সব ভিজে চুপচুপে। পানি ধোয়া গাছগুলো সবুজতম সবুজ - যেন চৌকস ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সের অ্যানিমেটেড রঙ গুলিয়ে কেউ তাদের পাতায় পাতায় লেপে দিয়েছে। এমন দিনে গুটিশুটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এদিনে কোথাও যেতে হবে না, জানালার ব্লাইন্ডগুলো খুলতে হবে না, জামায় চাদরে ঘুমের বাসি গন্ধ মেখে শুধু এপাশ-ওপাশ। কিন্তু এসব বিগত-বিলাস, এই জগতে তার স্থান নেই, এই মনে ওসব ইচ্ছা ঘুণাক্ষরেও উঁকি দেয় না। ঘর থেকে বেরিয়ে মহাসড়কে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বৃষ্টির বেগ তীব্র হয়ে উঠলো। ওয়াইপার ব্লেড কর্মতৎপর; সর্বশক্তিতে এপাশ-ওপাশ করেও উইন্ডশিল্ডে আছড়ে পড়া বৃষ্টির বিন্দুগুলোকে সরিয়ে সারতে পারছে না। কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো বোধহয় দূরে কোথাও। সেসবে ভ্রূক্ষেপ নেই আমাদের কারোরই, গাড়িগুলো সারি বেঁধে ছুটছে অন্ধ বাইসনের মতন, একটার পেছনে আরেকটা। প্রবল বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া মিলে মনে হলো চারপাশে কেউ যেন শাদা চাদর টেনে দিয়েছে। সেই চাদর ফুঁড়ে জায়গায় জায়গায় লাল টেইল-লাইট বেরিয়ে এসে পথ দেখাচ্ছে। এসময় মহাসড়কের ওপর জমে থাকা পানি আর তেলে মিলে এক পিচ্ছিল মসৃণ পথ তৈরি করে ফেলে। কোথায় যেন শুনেছিলাম এর ব্যাখ্যাটা - গাড়ি থেকে একটু একটু করে চুঁইয়ে পড়া তেল রাস্তায় পড়ে রোদে শুকিয়ে থাকে। এমন বৃষ্টিতে সেই তেল পানি পেয়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু তেল আর পানি তো আর মিশবে না, তাই পানি চলে যায় রাস্তার পিচের কাছাকাছি আর ওপরে ভেসে ওঠে তেল। এজন্যই গাড়ির চাকা পিছলে পিছলে যেতে থাকে। ব্যাখ্যাটা সত্যি নাকি মিথ্যা জানি না, কিন্তু এই প্রবল বর্ষণের সকালে লেইন বদলাতে গিয়ে টের পাই যে ব্যাখ্যা সঠিক। ছোটবেলায় খুব উঁচু কোনো স্লাইড থেকে পিছলে পড়ার মুহূর্তের ক্ষণিক ভরহীনতার স্মৃতি ফিরে আসে। স্টিয়ারিংয়ে হাতের আঙুল শক্ত হয়ে চেপে বসে। ভ্রূ কুঁচকে যায়, চোখের দৃষ্টি যেন সেই সামনের টেইল-লাইটের সাথে সাঁট করে আঠার মতো আটকে থাকে। জগতের সকল বস্তুই শক্তির নিম্নতম স্তরে থাকতে পছন্দ করে, তাই গাড়ির চাকার ঘূর্ণনশক্তির সাথে রাস্তার তেল-পানির সংলগ্নতার দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন হয়। ধীরে ধীরে হাতের আঙুলও নিশ্চিন্ত হয়। দুর্ঘটনার গহ্বরের সীমানা দেখে ফিরে এসে মস্তিষ্কের কোষে কোষে অ্যাড্রিনালিনের জোয়ার বইতে থাকে। এই প্রবল বর্ষণকেও তখন সুন্দর মনে হয় - তীব্রবেগে আছড়ে পড়া পানির ফোঁটা সুন্দর, ওয়াইপারের ঘটঘট আসা-যাওয়া সুন্দর, গাড়ির ভেতরে ঈষদুষ্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসের ঘ্রাণ সুন্দর, এমনকি চারপাশ শাদা করে দেয়ার অন্যতম কৃতিত্বের অধিকারী যে সামনের গাড়িটি, তার পানি-ছিটানো চাকাগুলোও ভীষণ সুন্দর। ভালো লাগতে থাকে পরিচিত এক্সিটের সাইনবোর্ড - এই তো, প্রায় এসে গেছি। আর মাত্র চার মিনিট। গ্যারেজ থেকে একটু ধরে আসা বৃষ্টিতে ছাতা ধরে গা বাঁচিয়ে সোজা দালানে ঢুকে পড়া। নিজের ডেস্কে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেই। কিছুটা সবুজ, কিছুটা সামনের লাল ইটের দালানের দেয়াল, আর কিছুটা কালচে ঘোলাটে মেঘ নিয়ে একটা বৈসাদৃশ্যময় কম্পোজিশন। বড্ড বেমানান। বড্ড খাপছাড়া। এখানেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুবাতাস। কিন্তু আমার দম আটকে আসে। মনে হয় নাকে-মুখে কেউ নল ঢুকিয়ে দিয়েছে। শ্বাস নিতে গেলে নলের প্লাস্টিকের ঘষা অনুভব করছি যেন। ঘরের আলোও পর্যাপ্ত, চারপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এই আলোকিত ঘরের চেয়েও শাদা চাদরে ঢেকে যাওয়া মহাসড়কের প্রাণপ্রাচুর্য আর গতিময়তাকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে। এই নিস্তরঙ্গ শান্তিময় জীবন বা জীবনের ভাগ তো চাই-ই নি।

বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

অরাজবাদ নিয়ে

২০১০ সালে হ্যারি ক্রিসলারের 'পলিটিক্যাল অ্যাওয়েকেনিংস: কনভার্সেশন উইথ হিস্ট্রি' বইয়ে নোম চমস্কির এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এটা চমস্কির 'অন অ্যানার্কিজম' বইতেও সঙ্কলিত হয়। নিচে পুরো সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনো মতামত সাদরে গৃহীত হবে।

প্রশ্নঃ আপনার কী মনে হয়, আপনার বাবা-মা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিতে কতটা ভূমিকা রেখেছেন?

চমস্কিঃ বেশ কঠিন প্রশ্ন। কারণ আমার মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করলে আমার ওপর তাদের মন-মানসিকতার প্রভাব যেমন আছে, তেমনি তাদের কিছু কিছু দিকের বিরোধিতাও আমার ভেতরে আছে। এই দুইয়ের সমন্বয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। কোনটা তাদের প্রভাবে ঘটেছে আর কোনটা বিরোধিতা করে ভেবেছি তা বোঝা মুশকিল। আমার বাবা-মা অভিবাসী ছিলেন। এদেশে এসে কীভাবে কীভাবে যেন দু'জনেই ফিলাডেলফিয়ায় এসে থিতু হয়েছেন। সে সময় ফিলাডেলফিয়া শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা হিব্রু বা ইহুদি বস্তি (ghetto) গড়ে উঠেছিল, সত্যিকারের বস্তি না, বলতে পারেন সাংস্কৃতিক সংঘের মতো কিছু একটা।

আমার বাবার পরিবার এদেশে এসে প্রথমে বাল্টিমোরের দিকে মাথা গুঁজেছিল। এখানকার আত্মীয়রা ছিল অতি-গোঁড়া। এমনকি বাবা এটাও বলতেন যে ইউক্রেনের শ্তেত্‌ল্‌-এ থাকতে তাদের পরিবার এতো গোঁড়া-ধার্মিক ছিলো না। সাধারণত অভিবাসীদের কোন কোন অংশের মধ্যে এই প্রবণতাটা দেখা যায়, ভিন্ন পরিবেশে এসে তারা অনেকেই নিজেদের সংস্কারগুলোকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। সম্ভবত নিজেদের স্বকীয়তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে এমন ঘটে।

অন্যদিকে আমার মায়ের পরিবার এসেছিল পেল অফ সেট্‌ল্‌মেন্টের[১] আরেক অংশ থেকে, তারা ডেরা বেঁধেছিল নিউ ইয়র্কে। তারা ছিল ইহুদি কর্মজীবী শ্রেণীর অংশ - খুবই প্রগতিবাদী। তাদের জীবনধারায় ইহুদি প্রথাগুলো ছিলো না বললেই চলে। সময়টা ছিল তিরিশের দশক, সেসময়ের প্রবল সামাজিক আন্দোলনের অংশ ছিলেন তারা অনেকেই। এই আত্মীয়দের মধ্যে যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন তিনি সম্পর্কে আমার খালু হতেন। আমি যখন সাত-আট বছর বয়সী তখন তিনি আমার এক খালাকে বিয়ে করেন। তিনি বড় হয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের এক গরীব এলাকায়। নিজে স্কুলে চার ক্লাশের বেশি পড়াশোনাও করেন নি। তার তারুণ্যের বছরগুলো বলতে গেলে রাস্তায় রাস্তায় কেটেছে। টুকটাক জেলেও গেছেন। শারীরিকভাবে একটু পঙ্গু ছিলেন তিনি। তিরিশের দশকে শারীরিকভাবে অক্ষম বা পঙ্গুদের সহায়তার এক সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে কিছু সাহায্য পান। সেটা দিয়ে নিজের একটা পত্রপত্রিকার দোকান দেন। নিউ ইয়র্কের ৭২ নম্বর রাস্তায় তার দোকান ছিল, আর কাছেই ছোট এপার্টমেন্টে থাকতেন তারা। ছোটবেলায় অনেকটা সময় আমি সেখানে কাটাতাম।

সেসময়ে ইউরোপ থেকে আসা এমেগ্রে'দের (émigré) বুদ্ধিজীবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল তার এই দোকান, যেখানে বহু জার্মান ও অন্যান্য জাতীয়তার অভিবাসীরা আসতেন। আমার ওই খালু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব একটা পান নি, কিন্তু তার মতো শিক্ষিত মানুষ আমি আর দেখি নাই। স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি। তার দোকানে গভীর রাত অবধি বিভিন্ন বিষয়ের প্রফেসর আর বিদগ্ধ পণ্ডিতরা তর্কাতর্কি আড্ডাবাজি করতেন। দোকানে কাজ করেও দারুণ আনন্দ পেতাম। দোকানটা ব্যস্ত শহরের মধ্যিখানে জ্ঞানতাপসদের ভিড়ে এক প্রাণবন্ত ছোট জায়গা হয়ে উঠেছিল। মনে আছে, অনেকদিন পর্যন্ত আমি ভাবতাম 'নিউজিন্‌মিরা' নামের কোনো এক জনপ্রিয় পত্রিকা আছে, খুব কাটতি ছিল সেটার। সকাল সকাল সবাই সাবওয়ে স্টেশন থেকে নেমে দোকানে এসে নিউজিনমিরা কিনতে চাইতো, আর আমি তাদেরকে দুইটা কাগজ একসাথে ভাঁজ করে দিতাম। পরে বুঝতে পারলাম এগুলো হলো 'দ্যা নিউজ' আর 'দ্যা মিরর' পত্রিকা, একসাথে বলতে বলতে নিউজিনমিরা হয়ে গেছে। এটাও মনে আছে যে কাগজদুটো হাতে নিয়েই তারা প্রথমে খেলার পাতাটা খুলতো। আট বছরের কিশোরের দুনিয়া! দোকানটায় খবরের কাগজই মূলত বিক্রি হতো, কিন্তু আমার মনে দাগ কেটে গেছে এই বিক্রিবাটা ঘিরে ঘটে চলা আলাপ-আলোচনাগুলো।

খালু এবং আরো অনেকের মাধ্যমে তিরিশের দশকের প্রগতিশীল আন্দোলন দিয়ে আমি খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম। সে জীবন ছিল হিব্রুভিত্তিক, জায়নিস্ট-কেন্দ্রিক, ইজরায়েল হওয়ার আগের প্যালেস্টাইন-কেন্দ্রিক জীবন। আমার জীবনের অন্যতম ভাল সময়। আমার বাবা-মায়ের মতোই আমি বড় হয়ে হিব্রু শিক্ষক হলাম, পাশাপাশি হয়ে উঠলাম জায়নিস্ট তরুণ নেতাকর্মী। ভাষাতত্ত্বের জগতে আসার হাতেখড়ি এসময়েই ঘটেছিল।

প্রশ্নঃ আপনি তো দশ বছর বয়সে প্রথম প্রবন্ধ লিখেছিলেন, স্পেনের গৃহযুদ্ধের ওপরে।

চমস্কিঃ মানে, বুঝতেই পারছেন, দশ বছর বয়সে কেমন প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এখন সেটা হাতে পেলেও আমি পড়তে চাই না। কী নিয়ে লিখেছিলাম সেটা মনে আছে কারণ বিষয়টা আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। সময়টা ছিল ঠিক বার্সেলোনার পতনের পরপর [জানুয়ারি, ১৯৩৯], যখন ফ্যাসিবাদী শক্তিরা বার্সেলোনা দখল করে মূলত গৃহযুদ্ধের যবনিকাপাত ঘটিয়েছিল। আমার প্রবন্ধটি ছিল ইউরোপে ফ্যাসিবাদের বিস্তার নিয়ে। শুরু করেছিলাম মিউনিখ আর বার্সেলোনায় কীভাবে এই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটলো সেই বিষয় থেকে, আর কীভাবে নাৎসিশক্তি ছড়িয়ে পড়লো তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম। এসব আমার জন্য তখন খুবই আতঙ্কের ঘটনা ছিল।

এখানে আরেকটু ব্যক্তিগত ভূমিকা দিতে চাই, ছোটবেলায় আমরা যে এলাকায় থাকতাম সেটা মূলত ছিল আইরিশ আর জার্মান ক্যাথলিক পাড়া। সেখানে আমরাই ছিলাম একমাত্র ইহুদি পরিবার। পাড়াটায় যারা থাকতো তারা মূলত নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, প্রায় সকলেই ইহুদিবিদ্বেষী এবং বেশ নাৎসি-সমর্থক। এরা কেন এমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়, আইরিশরা তীব্রভাবে ব্রিটিশদের ঘৃণা করতো, আর জার্মানরা ঘৃণা করতো ইহুদিদের। যখন ইউরোপে প্যারিসের পতন হলো [জুন, ১৯৪০], তখন আমাদের পাড়ায় এদের ঘরে ঘরে বিয়ার-পার্টি হয়েছিল। পুরো ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বর্ণবাদের এই কালো মেঘ আমাদের ভীষণভাবে শঙ্কিত করেছিল। বিশেষ করে আমার মায়ের আচরণে তা বোঝা যেত স্পষ্টভাবে যে সে তীব্র আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলোও বেশ ভয়ের ছিল। বুঝতে পারতাম রাস্তাঘাটে বা খেলার মাঠে অহরহই বিদ্বেষের শিকার হচ্ছি। আজও ভাবলে অবাক লাগে যে এতকিছুর পরেও আমি বা আমার ছোটভাই এগুলো বাসায় কখনো বলি নি। কেন বলি নি কে জানে! আমার মনে হয় না আমার বাবা-মা টের পেতেন যে পাড়াটা কতোটা ইহুদিবিদ্বেষী ছিল। কিন্তু রাস্তায় ফুটপাত দিয়ে হয়তো হাঁটছি বাস ধরবো বলে, বা মাঠে খেলতে গেছি বিকালে, সারাক্ষণই এক চরম ভীতির মধ্যে থাকতে হতো। ব্যাপারগুলো এমন যে আমি নিজেও বুঝতে পারতাম যে এগুলো তাদেরকে বলা যাবে না। পরেও কখনো কোনোদিন বলি নি। কিন্তু এই ভয়ানক অন্ধকার যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, দিনে দিনে এর প্রকটতাও বাড়ছে - এটা নিয়ে আমার মা সচেতন ছিলেন। সেসময় প্রায়ই তাকে দেখতাম খুব মন খারাপ করতেন - বাবাও দুশ্চিন্তা করতেন অনেক যদিও বেশি প্রকাশ করতেন না আমাদের সামনে। সব মিলিয়ে ঘরে ও বাইরে আমার জন্য খুব খারাপ ছিল সময়টা।

যাই হোক, সেসময়েই আমি স্পেনের অরাজ (anarchist) আন্দোলন এবং গৃহযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু ঠিক আগে আগে সেখানে দেশ জুড়ে এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দশ-এগারো বছর বয়েস থেকে আমি একা একা সাবওয়েতে চড়ার অনুমতি পেলাম। তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে সাবওয়ে করে নিউ ইয়র্ক গিয়ে খালাখালুর বাসায় থাকতাম। ইউনিয়ন স্কয়ার আর ফোর্থ এভিনিউয়ের অরাজবাদী বইয়ের দোকানগুলোয় গিয়ে সময় কাটাতাম। এসব দোকানে দেখতাম সেইসব ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসীদের। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক সব মানুষ ছিলেন। কিশোর আমি মনে করতাম এরা বুঝি নব্বুই বছরের বুড়ো, কিন্তু আসলে তাদের বয়স ছিল সম্ভবত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ভিতরে। একটা মজার ব্যাপার হলো তারা প্রায় সবাই তরুণদের সাথে আড্ডা দিতে উৎসাহবোধ করতেন, আমার বয়েসীদের চিন্তাচেতনা আর মতামতকে আগ্রহ নিয়ে শুনতেন এবং প্রয়োজনে সেসব নিয়ে বিস্তর আলোচনাও করতেন। এদের সাথে কথা বলেও আমি অনেক কিছু শিখেছি।

প্রশ্নঃ আপনি বলছেন এই অভিজ্ঞতাগুলোই আপনাকে ভাষাতত্ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, কিন্তু এর পাশাপাশি এগুলোই তো আপনাকে চারপাশের জগত এবং রাজনৈতিক ভাবনার ব্যাপারেও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আপনি একজন উদারনৈতিক অরাজবাদী (libertarian anarchist)। এই মতবাদের নাম শুনলেই এদেশে যে চোখে দেখা হয়, তাতে সবাই আপনার ব্যাপারে ভুল ধারণা পেয়ে থাকে। দয়া করে এটা একটু ব্যাখ্যা করুন।


চমস্কিঃ বাকি বিশ্বে এইসব ধারণা যেভাবে উপলব্ধ হয়, যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পূর্ণ বিপরীত বা ভিন্নভাবে বিষয়গুলো দেখা হয়ে থাকে। যেমন "উদারবাদী" বলতে যুগ যুগ ধরে বিশ্বের সবখানে যা বুঝানো হয়, এই দেশে আমরা তার একেবারে উল্টো অর্থ করি। ইউরোপের আধুনিক কালে উদারবাদী (libertarian) বলতে বোঝায় সমাজতান্ত্রিক অরাজবাদী। সেখানের শ্রমিক আন্দোলন আর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যে অংশটা রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতার বিরোধিতা করতো তাদের মতাদর্শ ছিল এটা। যুক্তরাষ্ট্রে এসে এই মতাদর্শ হয়ে গেলো অতি-রক্ষণশীলতার আরেক রূপ, যার প্রবক্তা হয়ে গেলো আয়'ন র‍্যান্ড আর প্রতিনিধি হলো কেটো ইনস্টিটিউটের মতো সংস্থা। যা শুধুই যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত বিশেষ সংজ্ঞা আর শ্রেণিকরণ। যুক্তরাষ্ট্রের ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের নেতারাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঘটনাবলী নানাদিক দিয়েই অনন্য, এই বিশেষ সংজ্ঞাও তার অংশ। ইউরোপে এই ধারণাকে সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রযন্ত্রবিরোধী উপধারা মনে করা হয়, আমিও সেটা মনে করি। উদারনৈতিক অরাজবাদী সমাজ একটা অতি-সুশৃঙ্খল সমাজ, যেখানে বিশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। পুরো ব্যবস্থাটা আপাদমস্তক গণতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ এমন সমাজের প্রতিটি গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, কাজের ক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রীয় দপ্তরসমূহ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে চলে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা এর ভিত্তি। এই ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপিত হতে পারে। এটাই চিরায়ত বা আদর্শ অরাজবাদ। এখন যে কেউ নিজের ইচ্ছামতো শব্দটার নেতিবাচক অর্থ ধরে নিতে পারে, বুঝলেন? কিন্তু এই ব্যাখ্যাটাই চিরায়ত অরাজবাদের বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞা।

এই ধারণার জন্ম হয়েছিল শ্রমজীবী শ্রেণী-আন্দোলনের ভেতর, যা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনেও একইভাবে এসেছিল। একটু পেছনে ফিরে তাকাই, ধরুন ১৮৫০-এর দশকের দিকে, শিল্প বিপ্লবের একদম সূচনালগ্নে। আমার ছোটবেলার অঞ্চল পূর্ব ম্যাসাচুসেটসে তখন বস্ত্রশিল্পের কারখানার শ্রমিকরা ছিলো মূলত গ্রামের খামারগুলো থেকে উঠে আসা একঝাঁক তরুণী। তাদের বলা হতো 'ফ্যাক্টরি গার্লস'। তারা আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের খামারবাড়িগুলো থেকে চাষবাসের জীবন ছেড়ে শহরে এসে কারখানায় কাজ নিয়েছিল। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলো বোস্টনের আইরিশ অভিবাসী। তাদের খুবই সমৃদ্ধ নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল। তারা অনেকটা আমার সেই খালুর মতোই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন একটা শিক্ষিত ছিলো না, কিন্তু হয়তো অনেকেই নিজে নিজে আধুনিক সাহিত্য পড়ে ফেলেছিলো। তারা ইউরোপের প্রগতিশীলতা তত্ত্ব জানতো না। কিন্তু তারপরও এখানকার শিক্ষিত সমাজের অংশ ছিলো তারা। এবং সমাজব্যবস্থা আসলে কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনাও গড়ে উঠেছিল।

এই কারখানার নারীরা নিজেরা পত্রপত্রিকা ও খবরের কাগজ ছাপাতো। আমার মতে সেই ১৮৫০-এর দশকই ছিল যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে স্বাধীনতম সময়। সেই দশকে লোয়েল শহরের এসব পত্রপত্রিকা ও খবরের কাগজের জনপ্রিয়তা নগর ছাড়িয়ে রাষ্ট্রপর্যায়ে সুপরিচিত ছিলো। এই স্বাধীন পত্রিকাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছাপাতে শুরু করেছিলো তারা - কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই। এসব পত্রিকার লেখক-সাংবাদিকরা হয়তো মার্ক্স অথবা বাকুনিনের নামই কখনো শোনে নি, কিন্তু তাঁদের ধারণাগুলো ভিন্ন আঙ্গিকে এসব লেখায় উঠে আসতো। কারখানার মালিকের কাছে নিজেকে ভাড়া দেয়াকে তারা নাম দিয়েছিলো "মজুরির দাসত্ব"। যে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তখন পুরো দেশ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই মজুরির দাসত্ব তাদের কাছে সেই দাসপ্রথার সমতুল্যই ছিলো। এই যে মজুরির জন্য চাকরি করা, অর্থাৎ নিজেকে একজন মালিক বা মালিকপক্ষের হাতে বিকিয়ে দেয়াকে তারা অপমানজনক মনে করতো, বলতো এই দাসত্ব ব্যক্তির স্বকীয়তাকে নষ্ট করে দেয়। সেসময় ধীরে ধীরে চারপাশে যে কারখানাভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠছিল তা নিয়ে তীব্র ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ছিল তাদের মাঝে। এই সমাজ তাদের সংস্কৃতি, তাদের স্বাধীনতা, তাদের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে দিচ্ছিল। তাদেরকে ধনী মালিক বা প্রভুর অধীন করে দিচ্ছিল।

আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রবাদের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। মানে, এই রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই আমরা স্বাধীন নাগরিক। বলা যায় পৃথিবীর ইতিহাসেই এ ধারণা নতুন ছিল। শিল্পবিপ্লব এই স্বাধীনতা তুচ্ছ ও খর্ব করে দিচ্ছিল - এটাই ছিলো শ্রমিক আন্দোলনের মূল দাবি। শ্রমিকরা এটাও মনে করতো যে এসব কলকারখানায় তারা যা উৎপাদন করছে তার প্রকৃত মালিকানা তাদেরই হওয়া উচিত। শিল্পবিপ্লবের একটা চালু স্লোগান ছিলোঃ "নতুন যুগের প্রেরণাঃ সম্পদ গড়ো, স্বত্তা ছাড়া সব ভুলে যাও" - এই ধারণার বিরুদ্ধে তারা স্লোগানও দিতো। এই যে নতুন প্রেরণা - নিজের চারপাশের সব মানুষের সাথে সম্পর্ককে অবহেলা করে স্বার্থপরের মতো সম্পদ আহরণ করা এবং যেনতেনভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করাকে তারা মনুষ্যত্বের লঙ্ঘন বলে মনে করতো।

এই সমৃদ্ধ আমেরিকান সংস্কৃতিটাকে নিষ্ঠুরভাবে শেষ করে দেয়া হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের ইতিহাস ইউরোপের চেয়েও বহুগুণে রক্তাক্ত এক অধ্যায়। এক লম্বা সময় ধরে তীব্র আক্রোশের সাথে একটু একটু করে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। এই আন্দোলন যখন আবার ১৯৩০-এর দশকে দানা বাঁধতে শুরু করে, আমি তার শেষদিকটাকে পেয়েছিলাম। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই আন্দোলনকে দমন করা হয়েছে। এখন যা পুরোপুরি বিলুপ্ত ও বিস্মৃত। যদিও আমার ধারণা এটা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি, মানুষ একেবারে ভুলে যায় নি, তাদের যৌথ চেতনায় এটা সুপ্তভাবে এখনো রয়ে গেছে।

প্রশ্নঃ আপনার গবেষণায় এই বিষয়টা এসেছে, কীভাবে মানুষ ইতিহাস ও প্রথা ভুলে যায়। নতুন কোন অবস্থানকে চিহ্নিত করতে কেন পেছনে তাকিয়ে পুরানো প্রথাগুলোকে দেখা জরুরি?

চমস্কিঃ এটাই বলতে চাচ্ছি যে এই বিষয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের আলাপ আলোচনা থেকেই শুধুমাত্র বিলুপ্ত হয়েছে। জনমানসে বা সংস্কৃতিতে কিন্তু এগুলো এখনও জাগরুক। আমি দেখেছি যখন কর্মজীবী শ্রেণীর কোন সমাবেশে যখন এসব কথা বলি তখন তারা সাড়া দেয়, তাদের কাছে এগুলো খুব স্বাভাবিক ধারণা বা মতবাদ। এটা সত্যি যে কেউ প্রকাশ্যে এগুলো নিয়ে আলাপ করে না। কিন্তু আপনি যদি এই আদর্শ ও মতবাদের প্রসঙ্গ তোলেন দেখবেন তারা সাড়া দিচ্ছে। তারা জানে যে তারা নিরুপায় হয়ে মালিকের হুকুমের দাস হয়েছে, নিজেদের অন্যায্যমূল্যে বিকিয়ে দিচ্ছে। তারা উৎপাদন করছে অথচ সেটার মালিকানা পাচ্ছে না - এটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক। এজন্য কঠিন কঠিন তত্ত্ব পড়া লাগে না।

প্রশ্নঃ আপনি এই ধারণা ও মতবাদ ছোট থেকেই চর্চা করেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন, বিশ্বাসও করেন। তাহলে আপনার মতে এই মতবাদ অনুযায়ী বৈধ ক্ষমতা কাকে বলে? কিংবা কোন পরিস্থিতিতে আপনি কোন ক্ষমতাশালীকে ন্যায়সঙ্গত ভাববেন?

চমস্কিঃ আমি যতটুকু বুঝি, তাতে অরাজবাদের ধারণার মূলমন্ত্রই হলো যে ক্ষমতা সর্বদাই অবৈধ, এবং নিজেকে বৈধ প্রমাণের দায় ক্ষমতাবানের ওপরই বর্তায়। এই ব্যবস্থায় যারাই নিজেদের ক্ষমতাবান বলে দাবি করবে তাদেরকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে তারা অন্য সকলের ওপর ছড়ি ঘোরানোর উপযুক্ত কিনা। যদি সেটা করতে না পারে, তাহলে তাদের পদচ্যুত করা হবে।

এখন প্রশ্ন হলো এটা কি আদৌ কেউ প্রমাণ করতে পারবে? হ্যাঁ, এটা প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য এবং দুরূহ ব্যাপার, কিন্তু আমার মনে হয় সদিচ্ছা থাকলে তা করা সম্ভব। যেমন একটা উদাহরণ দেই, ধরুন আমি আমার চার বছরের নাতনিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছি। হঠাৎ করে সে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে দৌড় দিতে গেলো। আমি করলাম কি, তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে বসলাম। এটা তার উপরে আমার ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব প্রয়োগের একটা ছোট উদাহরণ হতে পারে। কেন প্রয়োগ করলাম তার একটা সরল যুক্তিও দাঁড় করাতে পারবো। এমনভাবে হয়তো আরো অনেক জায়গায় দেখানো সম্ভব যে কেউ অন্য কারো ওপর যুক্তিযুক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আমাদের সবসময় যে প্রশ্নকে প্রাধান্য দিতে হবে তা হলো, "এই ক্ষমতাকে আমরা মেনে নেবো কেন?" যারা ক্ষমতা দেখাচ্ছে তাদের দায় হলো সেই ক্ষমতার বৈধতার প্রমাণ দেয়া। তাদের ক্ষমতা যে বৈধ না সেটা প্রমাণ করা জনগণের দায়িত্ব নয়। মানুষের সমাজে যদি ক্ষমতার অসাম্য থাকে, কেউ কারো চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে তাহলে প্রথমেই সেটাকে অবৈধ ধরে নিতে হবে। তুমি যদি সেটাকে বৈধ হিসেবে প্রমাণ করতে না পারো তাহলেই তুমি গেছো।

আরেকভাবে দেখলে এর সাথে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অস্ত্রের প্রয়োগের যে নিয়ম তার মিল আছে। অমন পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষ যদি আগে আঘাত হানে তবে বাকি বিশ্বের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয়, যথাযথ কারণ দেখাতে হয়। কোন কোন সময় তারা হয়তো অমন কারণ দেখাতেও পারে। আমি গোঁড়া শান্তিকামী নই, তাই কিছু পরিস্থিতিতে আমিও মেনে নেই যে, হ্যাঁ, এখানে এক পক্ষের শক্তি প্রয়োগের যথেষ্ট কারণ ছিল। যেমন আমিও ছোটবেলায় সেই প্রবন্ধে লিখেছিলাম যে পশ্চিমা বিশ্বের উচিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। এখনোও আমি তা মনে করি। কিন্তু পরে আমি আরো অনেক কিছু জেনেছি বড় হয়ে। আমি জানতে পেরেছি যে শুরুতে পশ্চিমারাই আসলে ফ্যাসিবাদ সমর্থন করেছিল। ফ্র্যাঙ্কো, মুসোলিনিসহ অনেক ফ্যাসিবাদীকে তারা সমর্থন দিয়েছিল। এমনকি হিটলারকেও একটা সময় পর্যন্ত তারা সমর্থন দিয়ে গেছে। তখন এসব জানতাম না। এখনও আমি মনে করি যে ফ্যাসিবাদের মহামারী ঠেকাতে যুদ্ধ শুরু করলে সেটা যুক্তিযুক্ত ও বৈধ হবে। তবে তার আগে অবশ্যই মিত্রপক্ষকে যথাযথভাবে দাবি প্রমাণ করতে হবে।

প্রশ্নঃ আপনি এক লেখায় লিখেছিলেন, "ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের বিভিন্ন কারণ ও ব্যাখ্যা যে কেউ দাঁড় করাতে পারেন, তা কেবলই তার ধারণা বা মতামত হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু রসায়নের কোন গবেষক আজ একটি ভুল প্রকল্প প্রস্তাব করলে আগামীকালই কেউ না কেউ সেটা ভুল প্রমাণ করে দিতে পারে।" বিজ্ঞানী হিসেবে প্রকৃতিকে বিশ্লেষণের এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আপনার রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে কীভাবে ও কতটুকু প্রভাবিত করেছে?

চমস্কিঃ প্রকৃতি এক নিষ্ঠুর অধ্যক্ষের মতো। এর সাথে মশকরা করা যায় না, ভুলভাল কথা বলে পার পাওয়া যায় না। তাই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চর্চায় সৎ হওয়া আবশ্যিক, অন্য জ্ঞানের শাখাগুলোয় এই মান এতটা কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। কিছু কিছু মানদণ্ড থাকে কিন্তু সেগুলো খুবই নাজুক। আপনার প্রস্তাব যদি আদর্শিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, অর্থাৎ স্থাপিত ক্ষমতার ব্যবস্থাকে সমর্থন দেয় তাহলে আপনি অনেক আজগুবি প্রস্তাব দিয়েও পার পেয়ে যেতে পারবেন। মূলত ক্ষমতার বিরোধী সমালোচকের মতামতকে যে মানদণ্ডে বিচার করা হয় আর তার সমর্থনকারীর মতামতকে যে মানদণ্ডে যাচাই করা হয় তাদের পার্থক্য আকাশপাতাল হয়ে থাকে।

যেমন, আমি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছি। আমার মতে সন্ত্রাস যে ক্ষমতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত তা খুব সহজেই প্রমাণ করা যায়। ব্যাপারটা বিস্ময়কর কিছু না। যে রাষ্ট্র যত বেশি ক্ষমতাধর, সে সাধারণত তত বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে। এই সংজ্ঞানুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হবার কারণে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাস করে থাকে। এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাকে প্রচুর প্রমাণাদি যোগ করতে হবে। এটা ন্যায্য কথা, তাই আমি মেনে চলি। আমার মতে এই দাবি যারাই করুক তাদের বক্তব্যকে চুলচেরাভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত। তাই আমি বিস্তর প্রমাণ জড়ো করি, আভ্যন্তরীন গোপন নথি থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য - সবই তুলে ধরি। এর মধ্যে যদি একটা কমা বা সেমিকোলনও এদিক সেদিক করি তাহলে সেটা খতিয়ে দেখা ভালো। আমার মতে এই মানদণ্ডই ঠিক আছে।

খুবই ভালো কথা। এবার চলুন জনপ্রিয় মতামতের বেলায় কী হয় দেখি। আজ আপনি এমন কিছু বললেন যা ক্ষমতার ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, সেটার বেলায় কিন্তু আপনাকে খুব বেশি যুক্তিপ্রমাণ দেয়া লাগবে না। যেমন ধরেন আমি ঘটনাচক্রে একদিন রাতে নাইটলাইন [২] অনুষ্ঠানে গিয়েছি, উপস্থাপক জিজ্ঞেস করলেন আমি গাদ্দাফিকে সন্ত্রাসী মনে করি কিনা। আমি জবাব দিলাম, হ্যাঁ, গাদ্দাফি অবশ্যই একজন সন্ত্রাসী। এটা বলতে আমার কোনো প্রমাণ দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু ধরুন আমি বললাম, জর্জ ডব্লিউ বুশ একজন সন্ত্রাসী। এইবার কিন্তু সবাই প্রমাণ চাইবে আমার কাছে। জিজ্ঞেস করবে তাকে কেন আমি সন্ত্রাসী বললাম।

সংবাদ মাধ্যমের অবকাঠামোটা এমনই যে এখানে প্রমাণ দেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। এটার একটা নাম আছে, নাইটলাইনের একজন প্রযোজক জেফ গ্রিনফিল্ড আমাকে বলেছিলেন - "concision" (সংক্ষেপণ)। তাকে কোনো এক সাক্ষাৎকারে একজন জিজ্ঞেস করেছিল কেন আমাকে নাইটলাইনে আমন্ত্রণ জানায় না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "প্রথমত তিনি এক উদ্ভট ভাষায় কথা বলে যার অর্ধেক কথাই আমরা বুঝি না, আর দ্বিতীয়ত তাঁর ভেতরে কাটছাঁটের বালাই নাই।" উনি ভুল কিছু বলেন নাই। নাইটলাইনে ডেকে প্রশ্ন করলে আমি যে উত্তর দিবো, যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো তা এক বাক্যে তো বলা সম্ভব না। কারণ সেসব তাদের জনপ্রিয় ধর্মের বিরুদ্ধে যায়, সেসব কথাই পুনরায় বলতে চাইলে অন্য কাউকে লাগবে, যিনি দুইটা বিজ্ঞাপন বিরতির মাঝের দশ মিনিটে তা বলে সারতে পারবেন। যদি আপনি প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয় তাহলে আপনাকে বিশদ প্রমাণ দিতে হবে, আর সেটা ওই দশ মিনিটে বলা সম্ভব না।

আমার মনে হয় প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর জন্য এইটা এক অবিশ্বাস্য কৌশল। কাটছাঁট করার শর্ত দিয়ে দিলে আপনি মোটামুটি নিশ্চিত করে দিলেন যে সবাই দলমতের ধ্যানধারণাই বারবার বলতে থাকবে। আর কিছু বলার বা শোনার কোনো পথই খোলা থাকবে না।

প্রশ্নঃ যারা আপনার মতোই চিন্তিত, আপনি যে চিন্তাধারা সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন সেটা তারাও ধারণ করে, যারা এই বিরোধিতায় সম্পৃক্ত হতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে আপনার উপদেশ কী?

চমস্কিঃ তাদের সংগঠিত হতে হবে দেড়শ বছর আগের লোয়েল টেক্সটাইল প্ল্যান্টের ওই ফ্যাক্টরি গার্লসদের মতো। একা একা এই বিষয়গুলো করতে যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে যদি কেউ তিন বেলা খাবার নিশ্চয়তার জন্যে সপ্তাহে পঞ্চাশ ঘণ্টা চাকরি করে তার পক্ষে এসব অসম্ভব চিন্তা। আপনার মতো আরো অনেকের সাথে যুক্ত হন তাহলে একত্রে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এর এক বিশাল গুণক প্রভাব (multiplier effect) আছে, যে কারণে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পুরোভাগে ইউনিয়নসমূহ সর্বদাই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এরা গরীব ও শ্রমজীবীদের একত্র করে, একে অপরের কাছ থেকে শিখতে সাহায্য করে, নিজ নিজ তথ্যের উৎস হয়, এবং একত্রিতভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সবকিছু একমাত্র এভাবেই বদলেছে সবসময় - যেমন নাগরিক অধিকার আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, সংহতি এবং শ্রমিক আন্দোলনসমূহ ইত্যাদি। আজকে যে আমরা গুহায় বাস করি না তার কারণ মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে পরিবর্তন এনেছে। তখনও যা উপায় ছিল, এখনও সেই একই উপায় আছে। আমার তো মনে হয় গত চল্লিশ বছরের প্রভূত উন্নতি আর পরিবর্তনের এটাই মূল কারণ।

১৯৬২ সালে এসব কিছুই ছিল না। তখন নারীবাদী আন্দোলন ছিল না, মানবাধিকার আন্দোলনও সবে শুরু হয়েছিলো। পরিবেশবাদী আন্দোলন, যা মূলত আমাদের উত্তরসূরীদের কাছে অধিকারের আন্দোলন, সেটাও তখন ছিল না। এখন আমরা চারপাশে দেখছি সবাই এই অধিকারের দাবিতে একত্রিত হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয়, লাতিন আমেরিকান ও ফিলিপিনো শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্ব সংহতি আন্দোলনও তখন ছিল না। অ্যাপার্থেইড-বিরোধী আন্দোলনের নামও তখন কেউ শোনে নি। সোয়েটশপ-বিরোধী আন্দোলনও এর অনেক পরের ঘটনা। তার মানে এখন আমরা যেসব বিষয় ন্যায্য অধিকার বলি এবং যে বিষয়গুলোকে অন্যায় বলে চিহ্নিত করতে পেরেছি তার অনেকগুলোই মাত্র চল্লিশ বছর আগে ছিলো না। তাহলে অধিকারগুলো কীভাবে এলো? আকাশ থেকে কোনো ফেরেশতা এসে দিয়ে গেছে? অন্য কেউ উপহার দিয়েছে? না, এগুলো আমাদের সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়েছে। জনসাধারণের যৌথ সংগ্রামে হাসিল হয়েছে, যারা প্রত্যেকে অন্যের জন্য নিজের শ্রম ও মেধা বিনা পারিশ্রমিকে বিলিয়ে দিয়েছেন একেকটি দাবি আদায়ে। তাদের সম্মিলিত আত্মত্যাগের কারণেই আমরা এখন এক অধিকতর সভ্য ও উন্নত সমাজে বসবাস করছি। অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এখানে এসেছি, সামনে আরো লম্বা পথ পড়ে আছে। এই সংগ্রাম নিরন্তর চলবে।

প্রশ্নঃ আপনি মনে করেন যে কোনো আন্দোলনের বিখ্যাত নায়কদের কেন্দ্রবিন্দু করা আসলে ভুল, কারণ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হলো নাম না জানা অসংখ্য কর্মীরা। তারাই আন্দোলনকে সফল করেন।

চমস্কিঃ হ্যাঁ। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কথাই ধরি। যখন আপনি এই আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলবেন সবার আগে আসবে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নাম। এই আন্দোলনে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে তিনিই সবার আগে বলতেন যে তিনি স্রেফ ঘটনাক্রমে আন্দোলনের জোয়ারের সামনে চলে এসেছিলেন। আরও বলতেন যে এসএনসিসি'র [৩] কর্মী, 'ফ্রিডম রাইডার'রা, আর অজস্র মানুষ যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, মিছিল করেছিল, পদযাত্রা করেছিল, প্রতিদিন পুলিশের মার খেয়েছিল তারাই আন্দোলনের মূল নায়ক। এদের অনেকে মৃত্যুবরণও করেছিলো আন্দোলনের সময়। এদের সম্মিলিত উদ্যোগেই একটা আবহ তৈরি হয়েছিল আর কিং তার ভেতর থেকেই সম্মুখে চলে এসেছিলেন। এখানে আবারও বলি তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন, আমি তা মোটেই ছোট করে দেখছি না। তিনি যা করেছেন তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাকি যাদের নাম আমরা ভুলে গেছি তারা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এটা কিন্তু সব আন্দোলনের বেলাতেই সত্য।

প্রশ্নঃ এতোকিছু দেখার পরে আপনার কি মনে হয় যে মাঝে মাঝে এসব আন্দোলনের সফলতা অতি অল্প হয়, কিন্তু যেটুকু আদায় করা যায় তা খুব গুরুত্বপূর্ণ?

চমস্কিঃ আমার মনে হয় না আমাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে হাল ছেড়ে দেয়া উচিত। ১৮৫০-এর লোয়েলের 'ফ্যাক্টরি গার্লস'দের সাথে আমি একমত। আমিও মনে করি মজুরির দাসত্ব আমাদের মৌলিক মানবাধিকারের ওপর আঘাতস্বরূপ এবং কারখানায় যারা কাজ করে উৎপাদিত পণ্যের মালিকানা তাদেরই হওয়া উচিত। আমি আরও মনে করি সেই "নতুন যুগের প্রেরণাঃ সম্পদ গড়ো, স্বত্তা ছাড়া সব ভুলে যাও" স্লোগানের বিরোধিতা আজও জারি রাখা প্রয়োজন। হ্যাঁ, এগুলো সবই অপমানজনক ও ধ্বংসাত্মক, দীর্ঘমেয়াদে যা একদিন ভুলুণ্ঠিত হবেই। কবে হবে তা জানি না, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস একদিন হবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা ভয়াবহ সব সমস্যার সম্মুখীন, যেমন প্রায় তিন কোটি আমেরিকান তিন বেলা পর্যাপ্ত খাবার খেতে পায় না, কিংবা পৃথিবীর অনেক জায়গায় মানুষ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় আছে এবং আমাদের সামরিক বুটের চাপে পিষ্ঠ হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এসব স্বল্পমেয়াদী বর্তমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। ছোট ছোট প্রাপ্তি বা অর্জনে ক্ষতি নেই। ষাটের দশক থেকে এখন পর্যন্ত যেমন অনেক ছোট ছোট প্রাপ্তির কথা বলছিলাম এতোক্ষণ। এগুলো সবই মানুষের জীবনে অসীম গুরুত্ব রাখে। এর মানে এই না যে বিরাট লক্ষ্যগুলো জরুরি না, ওগুলোও জরুরি, তবে নাগালের মধ্যের লক্ষ্যগুলোতেও মনোযোগ দেয়া যেতে পারে।

এই একই দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানেও প্রচলিত আছে। আপনি হয়তো বড়ো প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চান, যেমন মানুষের সকল ক্রিয়ার পেছনে মূল কারণ কী ইত্যাদি। কিন্তু এখন আপনাকে কাজ করতে হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের একদম সীমানার কোনো ছোট প্রশ্নের উত্তর নিয়ে। একটা মজার গল্প আছেঃ এক মাতাল একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজাখুঁজি করছিল। এক লোক এসে জিজ্ঞাসা করলো, "ভাই, কী খোঁজেন?" সে বললো, "হাত থেকে পেন্সিলটা মাটিতে পড়ে গেছে, সেটা খুঁজি।" তখন লোকটাও তাকে খুঁজতে সাহায্য করার জন্য জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় পড়েছিল?" মাতাল উত্তর দিলো, "ওহ, পড়ছে রাস্তার ঐ পারে।" লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তাইলে এখানে খুঁজতেছেন কেন?" মাতাল জবাব দিল, "কারণ আলোটা যে এখানে ভায়া। ওপারে তো ঘুঁটঘুটে অন্ধকার!" বিজ্ঞানের কার্যপ্রণালীও এরকম। হয়তো আপনার প্রশ্নের উত্তর আছে রাস্তার ওপারে, কিন্তু আপনাকে কাজ করতে হবে এপারে আলোর নিচে। আলোটুকু একটু একটু করে বাড়াতে থাকলে একদিন রাস্তার ওপারে পৌঁছে যেতেও পারে।

[সমাপ্ত]



১। Pale of Settlement: রাজতন্ত্র চলাকালীন সময়ে (১৭৯১ - ১৯১৭) রাশিয়ার পশ্চিম প্রান্তে ইহুদিদের বাসস্থান। এই নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে ইহুদিদের বসবাস করা নিষেধ ছিল।
২। Nightline, ABC নেটওয়ার্কের একটা সংবাদ বিশ্লেষণমূলক অনুষ্ঠান।
৩। SNCC: Student Nonviolent Coordinating Committee.

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৯

অরোরা

শনিবার বিকেলে একরাশ উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তি ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠলো অরোরার হার্টবিট। হাতের তালুতে রাখা যায় এমন মাউসের মতো একটা যন্ত্র ছিল আমাদের, ওটা দিয়ে হার্টবিটের আওয়াজ শোনা যেতো। বিছানায় শুনে দীর্ঘ দুই মিনিট ধরে এক, দুই, তিন করে বারবার মাপলাম। সব ঠিক আছে তো? বিকেলের আলো ঢলে পড়তে পড়তে নিশ্চিন্তির বাতাস বইতে শুরু করলো। তখনও আমরা জানতাম না সামনে কী নাটকীয় সব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

দিন চারেক আগে শেষ চেক-আপের সময় ডাক্তার বলেছিল রবিবারে ব্যাগ বেঁধে ক্লিনিকেই চলে আসতে। রবীন্দ্রনাথকে কাঁচকলা দেখিয়ে কন্যার মা আর সবুর করিতে পারিতেছে না। কন্যার বাপ তো আগে থেকেই রাজি, যেহেতু গর্ভবহনের কায়ক্লেশে তাকে পড়তে হয় নি তাই তার মতামত এই ব্যাপারে নগণ্য। কন্যা ওদিকে ভেতরে বসে জাতীয় খেলা হাডুডু আর বিজাতীয় খেলা ফুটবল ও সাঁতারে দিন দিন অলিম্পিকের সোনা-জয়ী হয়ে উঠছে। তার হুটোপুটিতে আমরা যারপরনাই উচ্ছ্বসিত, ব্রীড়া ও জড়তার মাথা খেয়ে জনে জনে বলে বেড়াচ্ছি আর আগ্রহী অনাগ্রহী নির্বিশেষে সবার হাত ধরে পেটের ওপর রেখে 'কিক' খাওয়াচ্ছি। রবিবারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে দিনগুলো চুইংগামের মতো লম্বা হয়ে গেল। সেই রাতে আবারও হার্টবিট এলোমেলো হয়ে গেল। কেমন একটা শিরশিরে ভয় হচ্ছিলো। আধুনিক মানুষ কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলতে পারি, কিন্তু মারফির সূত্রকে অস্বীকার করি কেমন করে? তাই নিশিরাতে অন্ধকার রাস্তায় নামলাম দুইজনে। বাসা থেকে ক্লিনিক দশ-পনের মিনিটের পথ কিন্তু রাতের অন্ধকারে শুধু দু'টা শাদা হেডলাইটের আলোয় হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিলো অনন্তকালের পথে যাত্রা করছি আমরা। সামনে নিকষ কালো অন্ধকার আর অনিশ্চয়তায় ভালো করে বেশি দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির ভেতরে নিস্তব্ধতায় অনিয়মিতভাবে ধুকপুক করছে তিন-তিনটে হৃদপিণ্ড!

রাত তখন সাড়ে দশটা। এতো রাতে সারা ক্লিনিকে কোথাও তেমন শোরগোল নেই, ডাক্তার নার্স বহিরাগতদের আনাগোনা নেই, শুধু শেষমাথায় লাইটবোর্ডে লাল কালিতে এমার্জেন্সি লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। আমাদের চোখে-মুখের উদ্বিগ্নতা দেখে নার্সদের বেশি কিছু বোঝার বাকি নেই। নাম-ধাম লিখে দিতেই যা দেরি, দেখলাম তিনজন নার্স মিলে স্বর্ণাকে একটা বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। মনিটরে শোনা যাচ্ছিলো অরোরার ধুকপুক ধুকপুক হৃদস্পন্দন। ১৩০। ১৩৫। ১৪০। ১৫০। ১২৫। ১২০। একেকটা মিনিট যায় আর আমার মনে হতে থাকে সমুদ্রতীরে বসে অবিরাম স্রোত আছড়ে পড়ার শব্দ শুনছি। শাদা পর্দা দুলে ওঠে। হাসিমুখে স্ক্রাব পরা ডাক্তার এসে বসেন, আমরা তো অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, কোন চিন্তা করো না, সবকিছু স্বাভাবিক আছে। পাশে নার্সও স্মিত হাসে, ফার্স্ট টাইম, রাইট?

ফেরার চিরচেনা পথটাও অদ্ভুত অচেনা মনে হচ্ছিল। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে ততোক্ষণে, রবিবার শুরু হয়ে গেছে। আহ, বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই রবিবার! পুরো রাস্তায় গাড়ির নামগন্ধ নেই। পরদিন সবারই অফিস বলে আমাদের পাড়া-গাঁয়ের সবাই তখন নিশ্চিন্তে ঘুমের কোলে বিশ্রাম নিচ্ছে। শুধু আমরা দুইজন তৃতীয়জনের অপেক্ষায় দম আটকে বসে আছি। সিগন্যালের সবুজ-হলুদ-লাল লাইটগুলো জ্বলে নেভে, একেকটা সিগন্যাল পেরিয়ে অলিগলি ঘুরে বাসায় পৌঁছে যাই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো। শরীর অবসন্ন দু'জনেরই, তাই শুয়ে পড়ার পরও ঘুম আসে না অনেকক্ষণ। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে হাজারটা চিন্তা চলতে থাকে ঝড়ের গতিতে।


ক্লিনিকটার নাম উইলো ক্রিক। চারপাশে সবুজ টিলার পাদদেশে একটু নিচু সমতলে দো-তলা বিল্ডিং। চারপাশে আরো কয়েকটা ছোটখাটো বিল্ডিংয়ে ফার্মেসি, এডমিন ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গত নয় মাসে বারবার এখানে চেক-আপের জন্য আসতে আসতে দরজা-জানালাগুলোও পরিচিত লাগে এখন। হাইওয়ে থেকে নেমে সোজা রাস্তায় সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে একদম পেছনের দিকে লেবার অ্যান্ড ডেলিভারি। রবিবার বিকেলে বড় একটা ড্যাফেল ব্যাগে তল্পিতল্পা তুলে এনে উঠলাম আমরা। অতি-চিন্তিত মুখে কাগজে সই-সাবুদের কাজ সেরে সব গুছিয়ে বসতে বসতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো।

আধো-ঘুমে আধো-জাগরণে ভোর হয়েছিল আমাদের, সকাল জেগে উঠে আড়মোড়া ভাঙার সময় স্বর্ণার কনট্র্যাকশন শুরু হয়ে গেলো। শুরুটা শান্ত পুকুরে ঢিল ছোঁড়া ঢেউয়ের মতো, দুপুর গড়াতেই তা হয়ে গেল প্রমত্তা পদ্মা। সন্ধ্যার দিকে ডাক্তার এসে বলে গেলো এখন থেকে আর কোনো শক্ত খাবার দেয়া যাবে না, শুধু বরফকুচি। ততক্ষণে ব্যথার মাত্রা বেড়ে গেছে।

দুপুরে আপু এসেছিল একগাদা খাবার-দাবার নিয়ে। সেগুলো বাসায় ফ্রিজে পড়ে রইলো। কেবিনে থিতু হয়ে বসে খুচরো গল্পগুলো খোলামকুচির মতো উড়ে উড়ে সঙ্গ দিচ্ছিলো আপু চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর শুধু আমরা দু'জন এই হলুদাভ আলোয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি মনিটরে প্রেশার মেশিনে ক্যানুলায় জড়িয়ে বসে রইলাম। ঘরজুড়ে সশব্দে হৃদস্পন্দন বাজছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তবুও অনেক ভয় পাচ্ছে। বাম হাতের আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম। কিছু কিছু সময় হয়তো নীরবতাই সোচ্চারে কথা বলে। গত রাতের সেই অন্ধকার হাইওয়েটা আমার কাছে আবার ফিরে এলো নিকষ অন্ধকারের কালি ছড়াতে ছড়াতে। হাতের ভাঁজে সুঁই গাঁথা, সেটা দিয়ে বিন্দু বিন্দু করে আসছে মহৌষধি। ভারিক্কি চেহারার অন-কল ডাক্তার এসেছিলেন একটু আগে, ওর তো প্রি-এক্লামশিয়া হয়ে গেছে। ব্লাড প্রেশার অনেক বেশি ওঠানামা করছে। একটা লাইনে ম্যাগনেশিয়াম স্টার্ট করে দেন, ডাক্তার নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন। তার গলার স্বরে একটু দুশ্চিন্তা ঠাহর করলাম কিনা তা বুঝে ওঠার আগেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ম্যাগনেশিয়াম সরাসরি শিরায় দেয়া হবে। বাচ্চার শরীরেও চলে যাবে। বাচ্চা হওয়ার পর যদি দেখেন সে ঘুমে ঢলে পড়ছে তাহলে সেটা এই ওষুধের প্রভাবে। শুনে মনে হলো খারাপ সংবাদকেও কীভাবে মধুমাখা বাক্যে বলা যায় তা এদের কাছ থেকে শেখা দরকার। এ এক অদ্ভুত প্রতিভা। দুরুদুরু বুকে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। বললাম, বরফকুচি খাবে? দিবো? ডাক্তার চলে যাওয়ার পরে ও বললো, একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি, খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি ওর হাত ধরে বসে থাকলাম।

উইং জুড়ে নতুন জীবনের অপেক্ষা আর সদ্য বাচ্চাদের খুচরো আওয়াজ কানে আসে। কেবিনের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকি। তার চোখ বোঁজা মুখের দিকে দেখি, ডান হাতে লাগানো প্রেশার মেশিনে অসম্ভব সব সংখ্যা দেখায়, বাম হাতে চলা সরল পর্যায়বৃত্ত ড্রিপ - টপটপ করে রক্তে মিশে যাচ্ছে। সন্তর্পণে দরজা খুলে আসে মারিয়া, মধ্যবয়স্ক মেক্সিকান নার্স, পেছনে চুল টেনে শক্ত করে বাঁধা। মারিয়াকে দেখলেই ভরসা লাগে, কী সুন্দর শান্ত গলায় কথা বলে, ঝটপট কাজ করে, এক হাতে টান দিয়ে বিছানা সোজা করে ফেলে শুয়ে থাকা রোগীকে না জাগিয়েই। আমাকে বসে থাকতে দেখে বলে, চিন্তা করো না, সব ঠিকঠাক হবে। কিছু খেয়েছো? আমি হুঁ ঠিক আছে বলে পাশ কাটাই। স্বর্ণা চোখ খুলে বলে, ব্যথা বেড়ে গেছে। তখন মধ্যরাত। ডাকাডাকির পর ডাক্তার বললো, এপিড্যুরাল নিয়ে নাও, কষ্ট কমে যাবে। শোয়া থেকে উঠিয়ে সোজা করে বসিয়ে মেরুদণ্ডদের হাড়ের ফাঁকে একটা ধাতব সুঁই ঢুকে গেলো, মাংস ফুঁড়ে দুই কশেরুকার মাঝের ফাঁক দিয়ে গিয়ে নরম মেরুরজ্জুতে ঢেলে দিলো স্নায়ুবশের ওষুধ। ডাক্তার দেখলেন না, পাশ থেকে আমি দেখলাম ব্যথার তীব্রতায় ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এক হাতে আমাকে আর অন্য হাতে মারিয়াকে শক্ত করে ধরে আছে, অথচ একটা টুঁ শব্দ না করে নিঃশব্দে কাঁদছে। ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বালির বিষ, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

আধ ঘণ্টা পরে এপিড্যুরালের সুতোর মতো নলটা পিঠের ঠিক মাঝখানে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো স্বর্ণা। আমি বললাম, ২৫ তারিখ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে, এখন সোমবার রাত দুইটা। স্বর্ণা বললো, দেশে কয়টা বাজে? আহা দেশ। পরানের গহীন ভেতরের সবাই যেখানে, অর্ধেক পৃথিবীর ঘুরে জুলাইয়ের উষ্ণ দুপুরের রোদ যেখানে হয়তো সবকিছু তাতিয়ে দিচ্ছে - সেই দেশ চোখ বুঁজলে দেখতে পাই। সে কল্পনা কতটুকু সত্য, কতটুকু আমার উইশফুল থিঙ্কিং - তা কে জানে! একটু কল দাও তো, খুব মন কেমন করছে। উপগ্রহে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে মুহূর্তেই সেই নীরব নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহর রাতের কেবিনে উৎকণ্ঠিত দেশ বেজে উঠলো, স্বর্ণা, কেমন আছো? কেমন লাগছে? অনীক, ওর কী অবস্থা? ডাক্তার কী বলেছে? অরোরা কেমন আছে? সবকিছু ঠিক আছে তো! পরিস্থিতি সামলাতে হয়, বাস্তবতায় রঙ চড়িয়ে বলতে হয়। এ যেন এক দুর্ভেদ্য মায়ার ঝিল্লি, যার এপাশ থেকে ওপাশে সব ছবি সব কথা বদলে যেতে থাকে।

এমনকি সবচেয়ে গাঢ় তিমির রাত্রিও একদিন শেষ হয়, তাই আধো ঘুম আধো জাগরণের সেই প্রতীক্ষার রাত শেষ হয়। জানালার পাশে কিছুক্ষণের জন্য পিঠ সোজা করে শুয়েছিলাম। ব্লাইন্ডের ফাঁক গলে নরম নীল আলো এসে জানান দেয় সকাল হয়ে গেছে। মারিয়া এসে কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ঝুলিয়ে বলে, বাচ্চা ঘুরে গেছে, ওকে ধীরে ধীরে সোজা করতে হবে, নইলে নরমাল ডেলিভারি হবে না। স্বর্ণাকে এক কাত করে শুইয়ে কাধ ধরে রাখলাম আমি। অন্যদিকে মারিয়া স্থির হাত বুলিয়ে আশ্চর্য ম্যাজিক শুরু করলো। নিমগ্ন ধ্যানী চোখ প্রায় নিমীলিত, গ্লাভস পরা দশ আঙুলে ছুঁয়ে ধরে আছে আমার অপত্যকে। খেলার ছলে যে ঘুরে গেছে অনেকটাই, এদিকে ওর যে জেগে ওঠার সময় হয়েছে তা খেয়ালই নেই হয়তো। দমবন্ধ দুই মিনিট পর ধীরে ধীরে সরতে শুরু করলো সে, ঘুমের ঘোরে। জাদুমন্ত্রের মতো ভেলকিতে ঘুরে যেতে থাকলো সূর্যঘড়ির ছায়ার মতো, পৃথিবীর ঘূর্ণনের মতো। সে এক নিবিড় সাঁতার জাগরণের দিকে।

ঘড়িতে তখন মধ্যদুপুর ছুঁই-ছুঁই। ডাক্তার ডিউক এসে পড়লেন, লেটস গো। স্বর্ণাকে দেখে মনে হলো যেন ট্র্যাপিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আর নিচ থেকে ওকে সঙ্কেত দিলো কেউ। জগত-সংসারের সকল শক্তি তার ভেতরে জড়ো হলো।

লেটস পুশ!

ওয়ান!

টু!

থ্রি!

ফোর!

ফাইভ!

সিক্স!

সেভেন!

এইট!

নাইন!

টেন!

...

নাউ ব্রিদ!

... ...

এগেইন!




আমার মনে হচ্ছিল উত্তাল ঝড়ের মধ্যে একটা ছোট ডিঙি নৌকায় চড়েছি আমরা। চারিদিকে থই থই পানি - সে পানির রঙ কালচে সবুজ। জন্মনালিকা বেয়ে নেমে এসেছে প্রবল খরস্রোতা সে নদী। সেই নদীর ওপর দুলছি আমরা, ডুবছি, ভেসে উঠছি, ফের ডুবছি। ওর হাত প্রচণ্ড জোরে ধরে রাখি। এই ঝড়ের মুখে এক মুহূর্ত ঢিল দিলে ওকে হারিয়ে ফেলবো। মাঝে দুয়েকবার বরফকুচি দেই ওর শুষ্ক-তপ্ত ঠোঁটে। পুশ এগেইন! আবার নিঃশ্বাস বন্ধ করে ডুব দেই দু'জনে। দশ সেকেন্ড পর ভেসে উঠি। ওর সারা শরীরে ঢেউয়ের মতো অ্যাড্রিনালিন বইতে থাকে। চোখমুখ থেকে হাতে, হাত থেকে পেটে, পেট থেকে পায়ে, আবার উজানে। রক্তের নদীতে জোয়ার ওঠে যেন আর সেই সুউচ্চ পর্বতসম ঢেউয়ের চূড়ায় দেখি চিকচিক করছে কালো চুল। মারিয়া বলে, শি হ্যাজ এ লট অফ হেয়ার! আমার ঘোর লাগে দু'চোখে। দেখি চূড়া থেকে দুর্দান্ত গতিতে নেমে আসছে সে। পুশ! ওয়ান! টু! থ্রি! ফোর! ফাইভ!!! ডাক্তার বলে, শি ইজ হিয়ার!



তীব্র চিৎকারে সেই কেবিনের বাতাস পাতলা কাগজের মতো চিরে যায়। আমার শক্ত করে ধরে রাখা হাতে টান পড়ে। স্বর্ণা আমাকে ডাকে। আমার কোলে রক্ত-মাতৃকাজলে মাখা একজন হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে, হয়তো মায়ের কাছে যাওয়ার জন্যেই। আমি ওর নরম তুলতুলে শরীরটা আস্তে করে স্বর্ণার বুকে তুলে দেই। ডাক্তার হাসিমুখে বলে, কাঁদছো কেন? আজকে তো খুশির দিন! মারিয়া গত রাতে আমাদের কাছে বাংলা শিখেছিল, সে আধো আধো বাংলায় বলে, সোন্দর বেবি!

বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৯

সিফিলিজ্‌ড ইয়ার্বল্‌স্‌

ইশকুলে কাঠের চেয়ার-বেঞ্চিতে বসে ইংরেজি ভাষাটা শেখার সময় কুশনের অভাবে আমাদের পাছা ব্যথা করছিল বলে ঠিকমতো শেখা হয় নাই এবং ভিন্‌দেশি শব্দগুলো কানে ঢুকলেও মাথায় ঢোকে নাই তাই কমপ্রিহেনশনে আমরা বরাবরই কাঁচা

আর আঙুল বাঁকা করে ঘি তোলা শিখি নাই বলে জটিল শব্দের গভীর অর্থকে টেনে পিটিয়ে সোজা করে অভ্যেস তাই স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি যেখানে নির্জলা আপ-ডাউন-আপ-ডাউন আল্ট্রাভায়োলেন্সের চাইতে দর্শন বা বিজ্ঞান নিয়ে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার আলাপ আড্ডা পরিতৃপ্তি দেয়ার কথা বলে তা এই বেলা বঙ্গজনপদে এসে হইয়া যায় চটুল ইনফোজাহিরের বাহানা কিংবা খোঁচাখুঁচির বিষয়

রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৯

নোনা দিন

কোন কোন দিন শ্যাওলা ভরা পুকুরে পদ্মপাতার মতো, তার পাশে জমে থাকা ঘন কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে কোন্‌ পুরনো গ্লানি ঘুরে বেড়ায় - তা কে জানে! ওপরে বিস্তীর্ণ আকাশে থমথম করে মেঘ, সবুজ ঘাসে ছাওয়া নরম কাদামাটিপাড় দিয়ে হাঁটে শাদা শাদা হাঁস, কমলা ঠোঁটে কৌতূহল আর কৌতুক তাদের।

শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৯

চিরকুট

কোন কোন দিন ভাঙা মার্বেলের মতো - মসৃণ মাটিতে বাঁকা হয়ে পড়ে থাকে আর একটু ঢালু পেলে গড়াতে শুরু করে। কিন্তু সব দিক সুষম গোলকের মতো গোল গোল থাকে না বলে তার চলন হয় বড়ই বেখাপ্পা। যেন কেউ বলে নি গড়িয়ে যাও, সেই দিনটা তবু প্রাণপণে যেতে চাইছে। গরমে, ঘামে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে পড়তেও পড়ছে না।
এরকম দিনে সকালে উঠে মনে হয় কেউ সদ্য লাল আটার রুটি ভেজে দিলো, সাথে একটা ডিম পোচ। পাশে এক কাপ ধূমায়িত চা। চুমুক দিতে দিতে রোদ এসে পড়বে পায়ের পাতায়, চড়াক করে একটা চড় কষাবে। এরকম দিনে অনেক কাজ থাকে - জোড়াতালি দিয়ে রিপু করে কাজের শরীরে ধানক্ষেতের মতো চৌকো চৌকো খোপ খোপ তালি বসে, মাঝের আইলে আইলে সেলাইয়ের ফোঁড়। কাজ দাঁড়িয়ে যায়। 

এমন দিনে দুপুরের থমথমে বাতাসে শহরের বাসগুলো রাস্তা দখল করে থাকে, আর গগনবিদারী আহ্বানে ক্ষুধার্ত স্নান করা পরিপাটি বেশভূষা নিয়ে সকলে ভিড় করে উপাসনালয়ে। সেখানে কেউ বলে না কীভাবে মাত্র পৌনে দুই সপ্তাহে ধর্ষণ হয়েছে দুই কুড়ি। তিন লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার শিশু ঘরে ও বাইরে কাজ করতে গিয়ে ঠাশ ঠাশ চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি লাথি খেয়েছে। স্বচ্ছ কাচের মত নিষ্প্রাণ চোখে পাশ ফিরে উপুড় হয়ে মুখ ফিরিয়ে নীরবে ব্যবহৃত হয়েছে আড়াই কোটি নারী - যাদের ফার্স্ট নেম মিসেস লাস্ট নেম আহমেদ কিংবা ইসলাম কিংবা রহমান কিংবা চৌধুরি। গত অগ্রহায়ণে মরে যাওয়া কিশোরকে কেউ মনে রাখে না, তার অর্ধভগ্ন মা ছাড়া। কোনো কোনো দিন হুট করে তাদের কথা মনে পড়ে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার আগে। 

সেসব দিনে ভাঙা মার্বেলটির মতো গড়িয়ে কোন্‌ অতলে পড়ে যাচ্ছিলাম আমি? সমতল ব্যস্ততা পেলে ভালো হতো। হয়ও। শ'য়ে শ'য়ে ব্যস্ততা ঘিরে ধরে ধারালো ছনের মতো, ঘাসের মতো। পড়ে থাকি তথৈবচ। পড়ে থেকে দেখি শোরগোল, হইচই। ভুলে যাই আমি ভাঙা মার্বেল, সকালের চড়চড়ে রোদ। সন্ধ্যে নামার আগে দেখি কেউ বরফশীতল পানির বোতল কিনে পাঁচিলের নিচে বসে অপেক্ষা করছে। আমার একইসাথে তৃষ্ণা পায় আর চামড়া জ্বলতে থাকে। আপুকে মনে পড়ে। শ্মশানের মতো ধু ধু প্রান্তরে একটা কাকতাড়ুয়া লাগাই। এখন আপুকে আসতে দেয়া যাবে না। একটা ফোন এসে বাঁচিয়ে দেয়। কংক্রিটে গড়াচ্ছি ভাঙা মার্বেলের মতো ঘড়্‌ঘড়্‌ ঘড়্‌ঘড়্‌, যন্ত্রের মতো জরুরি মাপা মাপা কথা বলি। গ্রীবা উঁচিয়ে লোকটা পানি খায়। ওর বাড়ি নেই। আমি বাড়ি ফিরে চলি। রাতে খুব ঝড় আসে। 

আর কোনোদিন খুঁজে না পাওয়ার নিশ্চয়তায় ভাঙা মার্বেল হারিয়ে যায়।