আর কতোকিছুই তো ভালো লাগে কাঁপনে মিশে থাকে এইসব দিনরাত্রির গান অজস্র কোলাহল আন্তরিক টানটান হলাহল ডুবে থাকে চুলের ভেতর, মৃদু সৌরভ…
আমাকে প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কেমন আছি। আমি খুব সরলমুখে বলে দেই, আমি ভালো আছি; অথবা বলি, এই তো চলতেছে; কিংবা বলে ফেলি, ভালোই আছি। এরকম বেশ কিছু টেমপ্লেট জবাব তৈরি থাকে – বলে ফেলতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। তারপর ভুলে যাই, অন্য বিষয়ে চলে যাই। তাকেও হয়তো পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেও ভালো থাকার কথা জানিয়ে দেয়। আমরা দুইজনেই তখন ভালো থাকতে থাকতে অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের তুচ্ছ ভালো লাগার চাইতে এইসব মানুষিক ব্যাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো কোথাও বাজ পড়ে। হয়তো কোন একটা গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ে, ডালের খাঁজে বাসা বেঁধেছিলো কোন খয়েরি পাখি, বাসার ভেতরে ছিলো তিন চারটে নতুন শিশু পাখি। ডাল ভেঙে যখন মাটিতে নেমে আসে, পাখিগুলো উড়ে চলে যায়… দূরে, অনেক অনেক দূরে…! এই পাখিরাও ভালো থাকে হয়তো, আমার সাথে যদি দেখা হতো, তাহলে আমি তাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছেন? তারা স্মিতমুখে বলতো, ভালো আছি। আপনার কী খবর? আমি হাতে একটু ভঙ্গি করে বলতাম, ‘এই তো চলতেছে’।
পাখিগুলো মারা গেছেন সবাই। মৃতের সরকারি সংখ্যা ৪, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি ডালে বসবাসকারী পাখি জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা ৫। সরকার একটি পাখির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে নাই। তারা মনে হয় ভুলে গেছে গুনতে। আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্যে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে ফোন দিলাম। অনেকক্ষণ রিং হচ্ছিলো, কিন্তু কেউ ধরছিলো না। ঘাম-শুকানো দুপুরে আমি চাতালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কানে রিসিভার চেপে ধরে রাখলাম। একঘেঁয়ে স্বরে রিং বাজছে, ট্রিং ট্রিং…
এভাবে অনেকক্ষণ, জানি না ঠিক কতোক্ষণ, রিং বাজার পরে একজন ফোন ওঠালেন। আমি চমকে গেলাম, কানের ভেতরে বাজতে থাকা ট্রিং ট্রিং ততোক্ষণে মাথার ভেতর বাজতে শুরু করেছে। সেই বাজনায় চকিত ছন্দপতন। ‘হ্যালো’, খ্যানখ্যানে স্বর শুনে একটু দমে গেলাম। আমি ফোন করেছি সরকারি হিসাবের ভুল ধরতে। যে লোকটি ফোন ধরেছে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমি পরিষ্কার দেখছিলাম লোকটা পেটমোটা কুমড়োপটাশের মতো। একটু আগে দুপুরে ভাত খেয়ে এসেছে, সাথে ঝোল ঝোল তরকারি আর সবজি ছিলো। ভাত খেয়ে মোড়ের দোকান থেকে একটা পান কিনেছে। পান চিবাতে চিবাতে এসে আয়েশ করে চেয়ারে বসে ফোন ধরেই গলা খাকারি দিয়েছে, ‘হ্যালো’। মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে তেমন কাজ নেই বোধহয়! তাই তারা এতো ঢিলাঢালা।
আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ভুল রিপোর্ট নিয়ে ফোন করেছি’, একটু থেমে আবার বলি, ‘গতকাল খবরে মৃত পাখির সংখ্যা ভুল বলেছেন আপনারা, আসলে মোট ৫টা পাখি মারা গেছেন – আপনারা লিখেছেন ৪টা। একটা পাখির হিসাব দেন নি’। লোকটা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেছে, পান চিবানোর শব্দ পেলাম না, বরং দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল, ‘হতে পারে একটা পাখির হিসাব মিলে নাই। তাতে কি হইছে? গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’
তার তীব্র স্বরে আমি মারা গেলাম। প্রশ্নটা অশ্লীল লাগছে। প্রশ্ন করার ফাঁকে তার দাঁত চিবানো বা পান চিবানো অশ্লীল লাগছে। রিসিভার বেয়ে কানে পৌঁছে যাওয়া তার কণ্ঠস্বর অশ্লীলতায় থকথক করছে। আমি যে হাতে রিসিভার ধরে ছিলাম, সেই হাতটাকে কোনো ঘিনঘিনে কমোডের ভেতরে ডুবিয়ে রেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এই প্রবল অনুভূতিগুলো আমাকে মূক করে রাখলো। টেলিফোন সেটটায় কি কোন সমস্যা আছে? লোকটা ফোন ধরার আগে কানে ট্রিং ট্রিং প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো। আর এখন তার শেষ প্রশ্নটা গনগন করছে কানের ভেতর।
‘গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’
‘বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’
‘আপনের কি?’
‘কি?’
আমি একদম নিথর হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাইরে স্তব্ধ দুপুর আর ঘোলাটে হলদে আলোটা অনেকটা সময় আমার সাথে স্থির হয়ে থাকলো। তারপরে প্রশ্নটা আমার ফুসফুসে পৌঁছে গেলে আমি রিসিভার আলতো করে নামিয়ে রাখলাম। তারপরে চুপ করে বসে রইলাম। পাখিটি মারা গেছেন। পাখিটি বাজ পড়ে গতকাল মারা গেছেন। আজকে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয় তাকে ভুল হিসাব করে গোনায় ধরে নি। পাখিটি ডালের ফাঁকে পাতার গভীরে শুয়ে আছে। তার পেলব বুকে একটা স্পন্দনও আর বাকি নেই। কয়েকটা সবুজ পাতা পুড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আরো কিছু পাতা এখনও সবুজ হয়ে আছে।
হঠাৎ কেমন বাতাস হলো, মৃদুমন্দ শিহরণ। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবুজ পাতা কয়টি পাখির স্পন্দনহীন দেহটিকে ঢেকে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
*****
১৪.১০.১০
আমাকে প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কেমন আছি। আমি খুব সরলমুখে বলে দেই, আমি ভালো আছি; অথবা বলি, এই তো চলতেছে; কিংবা বলে ফেলি, ভালোই আছি। এরকম বেশ কিছু টেমপ্লেট জবাব তৈরি থাকে – বলে ফেলতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। তারপর ভুলে যাই, অন্য বিষয়ে চলে যাই। তাকেও হয়তো পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেও ভালো থাকার কথা জানিয়ে দেয়। আমরা দুইজনেই তখন ভালো থাকতে থাকতে অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের তুচ্ছ ভালো লাগার চাইতে এইসব মানুষিক ব্যাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো কোথাও বাজ পড়ে। হয়তো কোন একটা গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ে, ডালের খাঁজে বাসা বেঁধেছিলো কোন খয়েরি পাখি, বাসার ভেতরে ছিলো তিন চারটে নতুন শিশু পাখি। ডাল ভেঙে যখন মাটিতে নেমে আসে, পাখিগুলো উড়ে চলে যায়… দূরে, অনেক অনেক দূরে…! এই পাখিরাও ভালো থাকে হয়তো, আমার সাথে যদি দেখা হতো, তাহলে আমি তাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছেন? তারা স্মিতমুখে বলতো, ভালো আছি। আপনার কী খবর? আমি হাতে একটু ভঙ্গি করে বলতাম, ‘এই তো চলতেছে’।
পাখিগুলো মারা গেছেন সবাই। মৃতের সরকারি সংখ্যা ৪, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি ডালে বসবাসকারী পাখি জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা ৫। সরকার একটি পাখির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে নাই। তারা মনে হয় ভুলে গেছে গুনতে। আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্যে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে ফোন দিলাম। অনেকক্ষণ রিং হচ্ছিলো, কিন্তু কেউ ধরছিলো না। ঘাম-শুকানো দুপুরে আমি চাতালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কানে রিসিভার চেপে ধরে রাখলাম। একঘেঁয়ে স্বরে রিং বাজছে, ট্রিং ট্রিং…
এভাবে অনেকক্ষণ, জানি না ঠিক কতোক্ষণ, রিং বাজার পরে একজন ফোন ওঠালেন। আমি চমকে গেলাম, কানের ভেতরে বাজতে থাকা ট্রিং ট্রিং ততোক্ষণে মাথার ভেতর বাজতে শুরু করেছে। সেই বাজনায় চকিত ছন্দপতন। ‘হ্যালো’, খ্যানখ্যানে স্বর শুনে একটু দমে গেলাম। আমি ফোন করেছি সরকারি হিসাবের ভুল ধরতে। যে লোকটি ফোন ধরেছে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমি পরিষ্কার দেখছিলাম লোকটা পেটমোটা কুমড়োপটাশের মতো। একটু আগে দুপুরে ভাত খেয়ে এসেছে, সাথে ঝোল ঝোল তরকারি আর সবজি ছিলো। ভাত খেয়ে মোড়ের দোকান থেকে একটা পান কিনেছে। পান চিবাতে চিবাতে এসে আয়েশ করে চেয়ারে বসে ফোন ধরেই গলা খাকারি দিয়েছে, ‘হ্যালো’। মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে তেমন কাজ নেই বোধহয়! তাই তারা এতো ঢিলাঢালা।
আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ভুল রিপোর্ট নিয়ে ফোন করেছি’, একটু থেমে আবার বলি, ‘গতকাল খবরে মৃত পাখির সংখ্যা ভুল বলেছেন আপনারা, আসলে মোট ৫টা পাখি মারা গেছেন – আপনারা লিখেছেন ৪টা। একটা পাখির হিসাব দেন নি’। লোকটা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেছে, পান চিবানোর শব্দ পেলাম না, বরং দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল, ‘হতে পারে একটা পাখির হিসাব মিলে নাই। তাতে কি হইছে? গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’
তার তীব্র স্বরে আমি মারা গেলাম। প্রশ্নটা অশ্লীল লাগছে। প্রশ্ন করার ফাঁকে তার দাঁত চিবানো বা পান চিবানো অশ্লীল লাগছে। রিসিভার বেয়ে কানে পৌঁছে যাওয়া তার কণ্ঠস্বর অশ্লীলতায় থকথক করছে। আমি যে হাতে রিসিভার ধরে ছিলাম, সেই হাতটাকে কোনো ঘিনঘিনে কমোডের ভেতরে ডুবিয়ে রেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এই প্রবল অনুভূতিগুলো আমাকে মূক করে রাখলো। টেলিফোন সেটটায় কি কোন সমস্যা আছে? লোকটা ফোন ধরার আগে কানে ট্রিং ট্রিং প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো। আর এখন তার শেষ প্রশ্নটা গনগন করছে কানের ভেতর।
‘গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’
‘বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’
‘আপনের কি?’
‘কি?’
আমি একদম নিথর হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাইরে স্তব্ধ দুপুর আর ঘোলাটে হলদে আলোটা অনেকটা সময় আমার সাথে স্থির হয়ে থাকলো। তারপরে প্রশ্নটা আমার ফুসফুসে পৌঁছে গেলে আমি রিসিভার আলতো করে নামিয়ে রাখলাম। তারপরে চুপ করে বসে রইলাম। পাখিটি মারা গেছেন। পাখিটি বাজ পড়ে গতকাল মারা গেছেন। আজকে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয় তাকে ভুল হিসাব করে গোনায় ধরে নি। পাখিটি ডালের ফাঁকে পাতার গভীরে শুয়ে আছে। তার পেলব বুকে একটা স্পন্দনও আর বাকি নেই। কয়েকটা সবুজ পাতা পুড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আরো কিছু পাতা এখনও সবুজ হয়ে আছে।
হঠাৎ কেমন বাতাস হলো, মৃদুমন্দ শিহরণ। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবুজ পাতা কয়টি পাখির স্পন্দনহীন দেহটিকে ঢেকে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
*****
১৪.১০.১০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন