শনিবার, ১১ মে, ২০১৩

রগব্লরগব্ল

একটা সময় ছিল, যখন যা মনে আসতো, লিখে ফেলতাম। হয়তো বিকেল থেকে ভাবছি কিছু একটা নিয়ে, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, খুব তুচ্ছ কোন কিছু। হয়তো রিকশাওয়ালা কিংবা সকালে উঠে রোদ দেখে মন ভাল হয়ে গেছে সে'কথা বিকেলেও ভাবছি, এমন। তারপর একটা ব্লগ খুলে লিখে ফেললাম। সেখানে শীতের সকালের শিউলি ফুলের মত টুপটাপ মন্তব্য। সেইসব ব্লগারদের সাথে মন্তব্যে মন্তব্যে আলাপ...

কিংবা হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি। মাথা ধুয়ে গরম চা নিয়ে বসলাম, বাইরে ঝুম বৃষ্টির শব্দ আর কড়কড় বজ্রনিনাদ। ইচ্ছে হলো, ব্লগ খুলে ফেললাম - নিছকই মধ্যবিত্তের ভাবালুতা। এখন সেগুলো পড়লে লজ্জাই লাগে!
মাঝে মাঝে রাত জেগে আড্ডা হতো। দুই-তিন লাইনের পোস্ট দিতো কেউ, আর সেখানে দুইশ-তিনশ কমেন্ট! একটা কমেন্ট লিখে শেষ করে পেইজ রিফ্রেশ দিতে দিতে দেখা যেতো আরো তিনজন কমেন্ট করে ফেলেছে। একেক কমেন্ট পড়ে হাসি চাপতে চাপতে পেট ব্যথা করতো, এমন তার উইট আর হিউমার। কী দারুণ তুচ্ছ সেসব দিনরাত্রিযাপন।
আজকাল কিছু লিখি না। অনেক কিছু ভাবি, অনেক কথা জমে ওঠে। সেগুলোকে চাতালে তুলে রাখি। অন্য কোন দিন লিখবো বলে টুকে রাখি, অতঃপর বিস্মৃতি। তবু কিচ্ছু যায় আসে না। একটা সময় ছিল যখন তিন-চার লাইনের ড্রাফট ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় হারাতে হয়েছে, ব্যাকআপ রাখি নি বলে, সেই দুঃখে রীতিমত কান্না পেতো। জীবন হয়তো অনেক সহজ ছিল। আর এখন এগুলো গায়ে লাগে না। হয়তো চারপাশের কুটিলপঙ্কা জীবনের চাপে এগুলো সব ছেড়ে দিতে হয়েছে। যে মন ক্রমশ হেরে যাবে জেনেও যুদ্ধ চালিয়ে যায়, তার কাছে না-লেখা লেখার জন্য বিষাদ বিলাসিতা ছাড়া কিছু না।
পেছনে তাকালে দেখি সহজতর জীবন কীভাবে কৌটিল্যে ভরে ওঠে। চারপাশের গাঢ় নোংরামো কীভাবে এগিয়ে আসে। যে বিষয়গুলো চিরন্তন সত্য বলে মানি, সেগুলোকে যখন কেউ মিথ্যা বলে মানে, তখন সন্দেহ হয় বোধ নিয়ে। তাকে ভুল বলার আগে নিজের ভেতরেই তাকাই, বোঝার চেষ্টা করি - আমার বিবেচনা ঠিক আছে তো? আমি কী জেনে শুনে বা নিজের অজান্তেই ভুলকে শুদ্ধ ভাবছি? হতেও তো পারে। আবার তথ্য মিলাই, ইতিহাস বেছে দেখি, সময় ও বাস্তবতাকে বুঝতে চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটার আন্দাজ ও আশঙ্কা মেপে মেপে হিসাব কষি।
দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এ ক্ষণিক বিচলতা। প্রকৃতি ও পৃথিবী আপন নিয়মেই ঘুরে চলবে। আমি ও তুমি একদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না, কিন্তু তাতে এই পৃথিবীর কিছুই যাবে আসবে না। মানুষ প্রজাতিরও কিছু যাবে আসবে না। আমার নিজস্ব বোধ ও চেতনা তুচ্ছ ও অমলিন। তোমার বিশ্বাস ও ক্ষোভ তুচ্ছ ও অমলিন। সত্য ও মিথ্যায় কিছু যায় আসে না। সময়চক্রে সত্য হয়ে যায় মিথ্যা, মিথ্যা হয়ে ওঠে মিথ। সেই পরিবর্তিত সত্য ও মিথ্যার ওপর ভর করে নতুন যুদ্ধ চলে। আজকে যে দুইজন ডান ও বামে দাঁড়িয়ে হাতাহাতি করছে, কালকেই তারা পরষ্পর জায়গা বদলে সেই একই হাতাহাতি করতে থাকবে। দর্শক হিসেবে হাতাহাতিটাই দেখার বস্তু, কে ডান, কে বাম, কে সত্য, কে মিথ্যা, সেটা এই মুহূর্তে জরুরি হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে একেবারেই তুচ্ছ ও অমলিন।
একচল্লিশ দিন ধরে আমার প্রিয় কিছু মানুষকে বিনা দোষে আটকে রাখা হয়েছে। এই একচল্লিশ দিনের মাঝে প্রায়ই আমার সমস্যা হয়েছে ক্রোধ প্রশমন করতে গিয়ে। খুব রেগে গেলে আমি খিস্তিখেউড় করি। গালি তো একটা এক্সপ্রেশন ছাড়া কিছু না, তাই কিছুক্ষণের জন্য ভালও লাগে। তারপর বুঝতে পারি কাজটা খুব স্বার্থপরের মতো হলো তো! ওদের নিপীড়নকারীর জন্য জমে থাকা ক্রোধ প্রশমন করছি, বহন করতে পারছি না। অথচ ওরা বিনা দোষে জেল খাটছে। হবুচন্দ্র রাজা ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীর দেশে শূলে চড়ার লোক পাওয়া যায় না। শেষে ধরা হয় লোভী শিষ্যটিকে, যে মাখন খেয়ে বিশাল-বপু হয়েছিল। আমার দেশের মানুষজন হলো সেই লোভী শিষ্য - রূপকার্থে তারা একদিন শূলে চড়তে যাচ্ছে অচিরেই (কিংবা হয়তো এরই মধ্যে চড়ে বসেছে, পশ্চাতে ধীরে ধীরে লৌহশলাকা গেঁথে যাচ্ছে!)।
[পুনশ্চঃ গল্পের শেষে বুদ্ধিমান গুরুর কারণে শিষ্য বেঁচে যায়, নাকে খত দিয়ে রাজ্য ছেড়ে দেয়। আর শূলে চড়ে স্বর্গবাসী হয় হবুচন্দ্র স্বয়ং। এই সমাপ্তি আদৌ আমাদের বাস্তবতায় হবে বলে মনে সাহস পাই না...]