শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১১

একটি বিশেষ সংবিধিবদ্ধ দ্রষ্টব্য

এই গ্রহতে আমাদের অস্তিত্ব যেন অযুত নক্ষত্রচূর্ণের নিরুদ্দেশ উড়ে বেড়ানোর মতো, যেন অযথা অহেতুক। আমাদের ধারণা আমাদের জন্ম, মৃত্যু, ভালোবাসা, প্রেম, যৌনতা, হিংসা, দ্বেষ, বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো না কোনো মানে আছে। আছে গূঢ়তর অর্থ, নিজের এবং অপরাপর মানুষের জীবনে। অথচ এ সবই দীর্ঘশ্বাসের টুকরোর সাথে হারিয়ে যাবে মহাশূন্যে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের মত, নভোবিশ্বের ধূলিঝড়ের মত এক লহমায় নিশ্চিহ্ন হবে সকল আয়োজন, পরমুহূর্তে খোঁজ করলে কেউই বুঝতেই পারবে না কোনো রঙের হাট কিংবা কোনো মনের মেলা কোথাও বর্তমান ছিল। অনিবার্য হলেও এমন হারানোর নিয়ম নেই - নেই উদার-আগ্রহ কারো। আমাদের হঠাৎ ইচ্ছা করতে পারে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই। ইচ্ছা করতে পারে এই অনিশ্চিত অর্থহীন ক্ষণিক জীবনের কষ্ট মিটিয়ে ফেলি। যা কিছু সঞ্চয়, যা কিছু অপচয় এগুলো ঝেড়ে ফেলি, হিসাব চুকিয়ে দেই।

আমরা জানি যে স্থাবর সম্পত্তির অভিমান নেই। এভাবে সব ত্যাগ করলে শুধু জমানো স্মৃতিই দিশেহারা হবে, ধীরে ধীরে মৃয়মাণ রোদ ঘুমিয়ে যাবে অক্ষিকোটরে। নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে যাবে শোরগোল। হয়তো পাততাড়ি গুটিয়ে নেবে প্রকৃতিও; প্রাণ যেখানে নেই, সেখানে কীসের বসত, কীসের মায়া? তখন সেই নিরাক নিস্তব্ধ এলাকায় কোন অনুভব সৃষ্টি হতে পারে? নৈঃশব্দের জন্ম হয় শব্দ ফুরোলে, অন্ধকার জমে জমে থিতু হয় আলোর অভাবে। তেমনই কি অপ্রাকৃতিক কোন অনুভব সৃষ্টি হয় প্রাণহীন ভূমিতে? সেই অভাবনীয় সৃষ্টি কতোটা সুন্দর, কতোটা কুৎসিত, তা আমাদের চিন্তাতেও আসে না। কিন্তু নৈঃশব্দ যেমন সত্য, অন্ধকার যেমন অলঙ্ঘনীয়, তেমনি এই অপ্রকৃতিও প্রাকৃতিক। এই অনুভবের অস্তিত্ব জানান দেয় সন্তর্পণে, খুব সচেতন খেয়াল না থাকলে তা টের পাওয়া দুষ্কর!

নিভু নিভু হয়ে আসছে মোমবাতির আলো। শাদা হলুদাভ একাকী মোমবাতিটার দিকে থির চোখে তাকিয়ে আছে সে। তার চোখের তারায় আগুনের প্রকম্প শিখাটি প্রতিফলিত হচ্ছে। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ টলটলে চোখ, উত্তল ভূমিতে পিছলে যাচ্ছে রশ্মিকণা। মোমবাতিটি জানে না, তার আলোর কণায় খুব অল্প জায়গাই আলোকিত হচ্ছে। আর ক্রমশ রশ্মির তেজ কমে আসছে, তার শরীরে আর জমাট মোম বেশি বাকি নেই। সলতের প্রান্তে যে নীলাভ-হলুদ শিখা, সহসাই তা ঝলসে উঠলো যেন। অন্তত তাকিয়ে থাকা চোখ দুটোয় আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম - নিষ্পলক একাগ্রতায় কোনো কাঁপন নেই, ওই মোমের শিখা আর ওই স্ফটিকস্বচ্ছ দৃষ্টির মাঝে যেন এক টানটান লড়াই! যেহেতু তার দৃষ্টি কাঁপছে না, তাই মোম-শিখাটাই যে হেরে যাচ্ছে, এ সিদ্ধান্তে সহজেই পৌঁছানো যায়। কিন্তু হেরে যাবার আগেও যোদ্ধার শিরায় রক্ত নাচে, খরস্রোতার তোড়ে যে শক্তি, তেমনই তোড়ে জেগে ওঠে বীরক্রম। জেগে ওঠে শেষ আঘাতের সঘন শ্লেষ, মনে এসে ভর করে অসুরিক জিঘাংসা। তাই সে ঝলসে ওঠে, ক্ষেপে ওঠে। মনে হয় সে এক ঝটকায় উড়িয়ে দিতে চাইছে প্রতিপক্ষকে। প্রতিপক্ষ সে, যার চোখ স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, তার চোখের তারায় ঝিলমিল করছে মোমালো, সে প্রায় জিতে যাচ্ছিল। অথচ খুব অবহেলায় সে চোখ সরিয়ে নিল। মোমের আলোটুকু নিভে যাবার আগেই আলতো পলক ফেলে সে অন্যদিকে তাকালো। যেন এই যুদ্ধে তার কোনো মন নেই, যেন এ কেবল মিছে খেলা, নিরর্থক ভ্রান্তি! তার এই নিস্পৃহতায় মোমের আলোটুকু বিস্মিত হয়, কিছুটা আহতও হয় এমন অনাগ্রহে। যে প্রাণপণ সংগ্রামে তার শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, সেটা প্রতিপক্ষের কাছে কিছুই না? এতোটাই তুচ্ছ তার লড়াই, এতোটাই অনর্থক তার অস্তিত্ব?

চোখের ফিরিয়ে নেয়া দৃষ্টির রেখা এখন মোমালোর বলয় থেকে অনেক দূরে, সুদূরতম ঘরের দিকে ফিরে আছে। চোখটি অদ্ভুত, অপ্রাকৃতিক তার আচরণ। প্রায়ই সে নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সাধারণত চোখগুলো যেমন হয়, যেভাবে তারা যোগাযোগ করে, যেভাবে বার্তাবহন করে, অনুভুতিলাভ করে, কাঁদে, কিংবা রাগে, এই চোখ দুটো তেমন নয়। এর চরিত্রে কোন অস্থিরতা নেই। আদিম ও অকৃত্রিম স্থৈর্যে সে তাকিয়ে থাকছে। এখন যেমন মোমের আলোর প্রতি তার আর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, এক অবিচলতায় তার দৃষ্টি চলে গেছে একটি ঘরের দিকে। ঘরটি দক্ষিণে, পানির ওপর ভাসছে। স্রোতের টানে ঘরের খড়ের চাল কেঁপে কেঁপে ওঠে। যে ঢেউগুলোর ওপর ঘরটি ভাসছে, সেগুলো অপত্যস্নেহে দুই হাতে যেন তাকে ধরে আছে। ছোট্ট শিশুকে যেমন কোলে তুলে আলতো দোলায় দোল দেয় মা, ঠিক তেমনি করে লহরের শীর্ষে দুলছে ঘর। ঘরের মেঝে কাদা মাটি পানিস্পর্শে আঠালো প্যাচপ্যাচে। গলে গলে মিশে যাচ্ছে নোনা পানিতে। মোমের মতই এই ঘরের জীবন স্বল্পায়ু। প্রবল পরাক্রমী নোনাজল তাকে খেয়ে ফেলবে। চোখ দুটো যেদিকে তাকায়, খালি ক্ষয়ে যাওয়া জীবন ও জড়ের প্রাচীর দেখে। এই প্রাচীর তার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘিরে থাকে। গোল অক্ষিগোলক ঘুরিয়ে এটুকুই দেখা যায়, উর্ধ্ব-অধঃ-ঈশান-নৈঋত দশ দশ দিকে সন্তর্পণে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চোখ। পাপড়ি খুলে আসে এমন মূলভেদী ঘূর্ণির টানে। ছেঁড়া পরিত্যক্ত ইলাস্টিকের মত পড়ে থাকে নিচে।

এতোটা নিচে চোখের দৃষ্টি সরে না, তাই সে বিচ্ছিন্ন পাঁপড়ির শোক ভুলে যায়। যে অংশ গত হবার চেতনা নেই, সে অংশ কখনো ছিল না। সে অংশের বিভিন্ন বিকৃতি ও আকৃতি পাওয়া যায়, কারণ তার সঠিক আকার সে জানেই না। অধুনাবিস্মৃত এই পাঁপড়ির অনৈস্তিত্বে বিশ্বাস করতে করতে চোখ ক্রমাগত ঘুরতেই থাকে। তার ত্বরণে মোমের শরীরের লুপ্তি চকিতেই বর্তমান; তার ঘূর্ণিবেগের ঝটকায় অতিকায় ঘরটি পানিমধ্যে লীন। পারিপার্শ্ব-ক্ষয়ে অবিচল নিস্পৃহতায় চোখ ঘুরছে। এই গতির উদ্দেশ্য নেই। এই গতির কারণ নেই। এই গতি ধীরে ধীরে ক্রমশ বেড়েছে, নিষ্কারণ তার প্রসার। তাই অগোচরে অক্ষিগতির রোধ করে নি সে কিংবা অন্য কেউ! বিশ্ব চরাচরের সকল বস্তু ও পরমশূন্যতা একদিন বিলুপ্ত হয়। চরাচর নামক কোন কিছুর অস্তিত্বই আর থাকে না। চোখের তারায় তখন এক অপ্রাকৃতিক নৃত্য স্থাপিত হয় নৃশংসসুন্দর ছন্দে!

মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

আমার সন্তানের সন্তান যেন পাকিস্তান পছন্দ না করে

আমি মূলত রাজনীতি বুঝি না। আমি খুব দ্রুত মানুষকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করি। যে পরিবারে আমি জন্মেছি, সেখানে নব্বুইভাগ মানুষ খুব ভাল। তারা একান্ত স্বার্থহানি না হলে কারো ক্ষতি করে না। নিজের লাভ দুই শতাংশ কম নিয়ে হলেও তারা খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। তাদের মাঝে কেউ রাজনীতিতে নাই।
আমি ছোটবেলা থেকে পাকিস্তানকে ঘৃণা করি। যে বয়সে মানুষ ডালিমকুমার আর সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্প শুনে বড়ো হয়, আমি সে বয়সে পাকিস্তানের গল্প শুনতাম। পাকিস্তানের গল্প শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে স্বপ্ন আকারে পাকিস্তানিরা আসতো। সেই স্বপ্ন আমার কাছে বিজাতীয় এবং দুঃস্বপ্ন মনে হতো। তখন থেকে আমি পাকিস্তানকে ঘৃণা করি।
পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে করতে আমার মাঝে অনেক রিপু কমে এসেছে। আমি নিজের পাশবিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি। আমি মদ ও মাংস নিয়ে স্বেচ্ছাচারকে ঘৃণা করেছি। আমি শিখেছি যে নারীকে মর্যাদা দিতে হয়, সম্মানের সাথে কথা বলতে হয়। পাকিস্তানে নারীকে মর্যাদা দেয়া হয় না। আমি আরো জেনেছি যে মানুষকে হত্যা করা ঠিক না। অনেক দৈবসংযোগে মানুষ জন্ম নেয়, এবং প্রতিটা মানুষ অমিত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। তাই তাকে মারা খারাপ। প্রতিটা মানুষের সাথে আরো কিছু মানুষ জুড়ে থাকে, সে মারা গেলে তারাও কষ্ট পায়। তাই মানুষ মারা খারাপ। পাকিস্তান একটি দুইটি না, তিরিশ লাখ মানুষকে মেরে ফেলেছে। এবং তারা এই হত্যাকে জাস্টিফাই করেছে ধর্ম দিয়ে। তারা মাফ চায় নি। তাদের বিচারও হয় নি।
এগুলো জানার পরে আমি পাকিস্তানকে প্রবল ঘৃণা করতে থাকি। তারপর বড়ো হয়ে আমি মাঝে মাঝে জেনেছি যে পাকিস্তানের সবাই খারাপ না। তাদের মাঝেও ভাল মানুষ আছে। আমি তখন 'ভাল'র নতুন সংজ্ঞা শিখলাম - নির্যাতিত হলেই তাকে ভাল বলা হয়। কিন্তু স্কুলে শিখেছিলাম, "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে"। স্কুলের শিক্ষা মাথায় গেঁথে গেছে। তাই আমি পাকিস্তানের সেই 'ভাল' মানুষদের তৃণের চাইতেও কয়েকগুণ বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলাম!
আজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আমার সন্তানকে এই ঘৃণাশিক্ষা দিয়ে যাব। বাংলাদেশ এমনিতেই অনেক পিছিয়ে আছে - ভ্রাতৃপ্রেমের বাণী শিখে আর এগিয়ে না গেলেও চলবে। এবং আমি শিখিয়ে যাব যে আমার পৌত্রকেও যেন সে এই ঘৃণার শিক্ষা দেয়। পাকিস্তানকে ঘৃণা করে যে পূণ্যলাভ হবে, তাতে আমি যে স্বর্গ-বেহেশ্‌ত ও পরপারের সকল পুরষ্কার পাবোই - এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সুতরাং নিজের লাভের জন্যই আমি এই কাজ করছি। কেউ ভেবে বসেন না যেন, যে দেশপ্রেমের মত বায়বীয় ও সংজ্ঞাহীন মতবাদে আমি আদৌ বিশ্বাস করি!

শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১১

চোখ নিয়ে কিছু চোখা কথা

ঈদের ছুটি শেষ হয়ে এলো। আগামিকাল থেকে আবার চিরপুরাতন নিয়মে ফিরে যাবো। বাসায় কিছু ডিজিটাল যন্ত্র যন্ত্রণা দিচ্ছিল - প্রিন্টার প্রিন্ট করে না, ল্যাপটপের মাইক্রোফোন বিদ্ঘুটে শব্দ করছে, এইসব। তো, এগুলো নিয়ে আইডিবি গেলাম, তারপর দুপুরে লাঞ্চ সেরে ভাবলাম পুরান ঢাকার দিকে যাই। বিউটির শরবতের নাম শুনেছি, খাওয়া হয় নি। হল-এ থাকতে কেউ একবার আওয়াজ দিলেই হতো, এখন তো আয়োজন করে এদিকে আসতে হয়। তাই ভাবলাম, ঘুরে আসি। বঙ্গবাজারের চৌরাস্তা থেকে আরেকটু ভিতরে যেতে হয়, গাড়ি রেখে হেঁটেই যাচ্ছি। একটু চিকন রাস্তা, দুইদিক থেকে রিকশা চলছে। পাশে ফুটপাতও নেই, তাই সামলে সুমলে হাঁটছি। আমার সামনেই একটি মেয়ে হাঁটছিল, সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরা। আমি একটা প্রজেক্ট নিলাম। অপরদিক থেকে যারা হেঁটে আসছে, তাদের সবার চোখের দিকে খেয়াল করবো। প্রথমেই শাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরা একজন লোক, দেখলাম তিনি এগিয়ে আসছেন এবং আমার সামনের মেয়েটিকে পেরুনোর আগে আগাপাশতলা যেন স্ক্যান করে ফেললেন। একটু চমকে গেলাম, পোশাক-আশাক যে মানুষকে ভাল বানাতে পারে না সেটা আবারও বুঝলাম। র‍্যানডম স্যাম্পল হিসেবে মাত্র একজনকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না, তাই ভাবলাম, আরেকটু দেখি। এলেন আরেকজন, লাল-কালো চেকশার্ট পরনে, মধ্যবয়স্ক, মাথায় চুল কম, খানিকটা মোটা, তিনিও দেখলাম যাবার সময় এক ঝলক চোখ বুলালেন। এলো আরেকজন, ইনি লুঙ্গিপরিহিত, চোয়ালভাঙা চেহারা, তিনিও মেয়েটির মুখের দিকে তাকালেন আর তারপর বুকের দিকে। না, প্রিয় পাঠক, মেয়েটি ওড়না পরেই ছিলেন, শুধু তাই না, ওড়নাটি "ঠিকভাবেই" পরে ছিলেন। তারপরেও এই স্ক্যানিং।

মোড় থেকে দোকান পর্যন্ত দূরত্ব যতোটুকু, সেখানে আমি প্রায় দশজনকে দেখলাম মেয়েটিকে ক্রস করলো। তাদের সকলেই, হ্যাঁ, সকলেই একইভাবে তাকে স্ক্যান করেছে। যেন এদের সবাইকে স্কুলে পড়ানো হয়েছে "যে কোন নারীকে রাস্তায় পার হবার নিয়মাবলী"। যেমন আমাদের শেখানো হতো রাস্তা পেরুনোর নিয়ম – “প্রথমে ডানে দেখুন, তারপর বামে, তারপর আবার ডানে দেখে রাস্তা পার হউন”। ঠিক তেমনি, “আপনার উল্টোদিক থেকে কোন নারী হেঁটে এলে প্রথমে তার মুখের দিকে তাকান, তারপর তার বুকের দিকে তাকান, তারপর তার শরীরের অন্য কোন অঙ্গ যথা কোমর, পাছা, উরু, পা ইত্যাদি নিয়ে আপনার ফেটিশ থাকলে সেদিকে তাকান, তারপর তাকে পেরিয়ে যান”। এই নিয়মাবলীর সাথে সতর্কতা হিসেবে থাকবে –

কোনো অবস্থাতেই মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে সামনের দিকের খেয়াল হারাবেন না, কোন গাড়ি বা ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে।

আমি আরো একটু এগিয়ে চিন্তা করলাম। এই দাড়িটুপিওয়ালা লোকটি বাসায় ফিরবে, তার যা বয়স তাতে বিবাহিতই হবেন। তিনি নিশ্চয়ই ধর্মমতে বিয়ে করেছেন, বউয়ের সাথে সহবত করবেন এবং সে'সময় তার মাথায় এই মেয়েটির কথা ভেসে উঠবে। এমন হতে পারে যে তার বউ গ্রামের বাড়িতে আছে, সেক্ষেত্রে তিনি বাসায় বা মেসে ফিরে টয়লেটে পায়খানার ওপর বসে হাত মারবেন। তারপর বাসায় ফোন করে বউ ও বাচ্চাদের খবরাখবর নিবেন। রাত্রে আবার উত্তেজনা এলে হাত মেরে ভাত খেয়ে ঘুমাতে যাবেন। একই সূত্রে লাল-কালো শার্ট পরিহিত ব্যক্তি কিংবা পরের ব্যক্তিগুলোও নিশ্চয়ই তাদের নিজ নিজ কাম-চরিতার্থ করবেন। কেউ বউকে, কেউ প্রেমিকাকে, কেউ গণিকাকে লাগিয়ে ঠাণ্ডা হবেন। নভেম্বর এসে গেল, তবু তাপমাত্রা কমলো না!

আমার চিন্তার দৌড় এই অবধি এসে থেমে গেলে আমি খুশি (!) হতাম। বাস্তবে যা দেখি, সেটা আরো খারাপ। এভাবে ওড়নার ফাঁকফোকর দিয়ে স্ক্যান করতে করতে এদেরই কেউ কেউ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন। অবদমিত তীব্র কামনা সামাজিক ভগিজগি মানে না। মগজে প্রশ্ন ওঠে, "কিসের সমাজ, কিসের আইন, এই মাইয়ামাগী সব দ্যাখায়া চলতাসে ক্যান?" তখন তারা রাতের অন্ধকার, কিংবা নির্জন জায়গা পেলে আক্রমণ করে ধর্ষণ করেন, কিংবা ভীড়ভাট্টার সুযোগ নিয়ে নিদেনপক্ষে নারীর শরীরে হাত চালান, পাছায় বা বুকে একটা টিপ দিলাম - আহ!

অনেকে এহেন আক্রমণের পরে মেরেও ফেলেন, কী দরকার প্রমাণ রেখে? আমার কেন জানি মনে হয় মেরে ফেলে ভালই হয়। সুবিধা নানাবিধ। এই যেমন ধর্ষিতাকে যে পরিমাণ সামাজিক নোংরামো ও কৌতূহলের শিকার হতে হয়, সেটা থেকে রেহাই মেলে। আবারও ধর্ষিত হবার ঝুঁকি কমে যায়। পাশাপাশি, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা একজন কমে গেল। কী চমৎকার, তাই না!

ধর্ষণের খবর জেনে আমরা যারা আহা-উহুঁ করি, কিংবা ক্ষেপে উঠি, কিংবা সরকারের মুণ্ডপাত করি, তারা সবাই-ই এহেন স্ক্যানিং করে থাকি। এখানে স্বীকার করার দরকার নাই রে ভাই। আবার অস্বীকার করারও দরকার নাই। যার যার স্ক্যানিং, তার তার কাছে। আপনি নিজেই জানেন আপনি কবে কোন মেয়ের দিকে কোন চোখে তাকিয়েছেন। আর এটা জানেন বলেই আপনার মতো চোরের বড়ো গলা শোনা যায়! আপনি ক্রমাগত দোষের তীরটি ঐ মেয়েটার দিকে তাক করছেন। তার জামাকাপড়ের দিকে, তার চলাফেরার দিকে, এমনকি তার আচার-আচরণের দিকেও! যদিও আপনি জানেন যে আপনার নজর ঠিক নাই। আপনার হাঁটাচলা, বানরের মতো ব্রেইনে চলমান যৌনচিন্তা ঠিক নাই। এগুলো অসুস্থ। সারাক্ষণ সেক্স-ডিপ্রাইভড হতে হতে আপনার চিন্তা ও চেতনা খালি ধোনের গোড়ায় ঘুরঘুর করে।

এই নোংরামো কীভাবে দূর হবে? আমি দুটো পথের কথা ভাবছি। এতোদূর যখন পড়েই ফেলেছেন, আরেকটু ধৈর্য ধরে সেই দুটোর কথাও শুনুন।

প্রথমটি মেয়ে তথা নারীদের জন্য। ‘অবলা’, ‘গৃহিনী’, ‘মায়ের জাত’ ইত্যাদি ফালতু সেন্টিমেন্টাল বিশেষণ তো শুনেছেন। আপনি কি নিজেকে সেটাই মনে করেন? আপনি কি মনে করেন যে আপনার জন্ম হয়েছে একজন ঊন-মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে, যে সারাজীবন অন্য পুরুষের নজর এড়ানোর জন্য ঢেকেঢুকে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে বসবাস করবে? কিংবা আপনি মনে করেন, যে সর্বংসহা ইমেজটি ২০ বা ৩০ বছরে গড়ে তুলেছেন – এটাই আপনার জীবনের সেরা(?) কীর্তি। আপনি পড়াশোনা করেছেন, ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার একটি ব্রেইন আছে। কেবল লিঙ্গ নারী বলে আপনি ব্রেইন ব্যবহার করেন না, অন্যে যা বলে, বইয়ে উপন্যাসে যা শেখায়, সেই নারীরূপটাই আপনার কাছে সব। আপনি যে একটা মানুষ এবং অন্য আরেকটা পশু যে আপনার উপরে হামলা করলে তাকে পালটা আঘাত করার শক্তি ও অধিকার আপনার আছে, তা আপনি ভুলে গেছেন। হয়তো সারাজীবনে শিখেনও নাই। এর মূল দোষ সমাজের এবং আপনার পরিবারের, আর খানিকটা দোষ আপনার নিজেরও বটে। আপনার উপর দিয়ে ইচ্ছামত মাড়িয়ে একজন টয়লেটে গিয়ে হাত মারে, এই চিন্তাটা কি মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয় না? দিলে আপনি কতো বড়ো কাওয়ার্ড* যে সেটা দূর করতে কোন চেষ্টাই করেন নাই (*এই শব্দটার বাংলা ‘কাপুরুষ’। হায়! ভাবখানা এই যে নারী তো এমনিতেই কাওয়ার্ড, তার জন্য আবার আলাদা শব্দ লাগবে কেন? পুরুষ হবে সাহসী, তাই কেউ যদি সাহসী না হয়, তবে সে পুরুষই নয় = কাপুরুষ!)  ভাবুন। এই আক্রমণ, এই নীরব ধর্ষণ ঠেকাতে আপনি কী করতে পারেন, ভাবুন। খুলির ভিতরে ব্রেইনে দুয়েকটা ভাঁজ ফেলেন। ফেসবুকে শাহরুখ খানের প্রোফাইলে সাবস্ক্রাইব না করে একটু গুগল করুন বিদেশে মেয়েরা নিজেদের সেল্ফ‌ ডিফেন্সের জন্যে কী কী ব্যবস্থা নেয়। সেগুলোর কয়েকটা ব্যবস্থা সময় নিয়ে গড়ে তুলতে হয়, আর কয়েকটা পন্থা একেবারেই সহজ। সামান্য একটু সাহস আর বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেন এই বিষয়ে?

দ্বিতীয় পথটি পুরুষদের জন্য। এই বদমায়েশি থেকে শুরু করে নোংরা আক্রমণ, গ্রোপিং ও ধর্ষণ পর্যন্ত অপরাধগুলো যারা ঘটান, তাদের বাইরে হয়তো অনেকে আছেন, যারা একজন মেয়েকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখেছেন। অনেক পরিবারে ছেলে ও মেয়েকে সমান অবস্থান শেখানো হয়, পরষ্পরকে কেবল মানুষ হিসেবে যে সম্মান দেয়া উচিত, সেটা সেখানো হয়। বিবর্তিত হতে হতে আমরা হোমিনিড থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি হয়েছি, আর আদিম জিনের নিয়ন্ত্রণ করার নিয়মও শিখেছি। সাধারণ ভাষায় এটাকে বলে সভ্যতা, ভব্যতা, সৌজন্যবোধ। এগুলো হারিয়ে ফেলা ওই দাড়িটুপি, লালশার্ট, লুঙ্গি পরা আদিম জিনের বাহকদের বিলুপ্তি হওয়া দরকার। শুভবুদ্ধির উদয় তাদের আদৌ হবে কি না জানি না, তবে যারা অন্তত এই নোংরামোর বিপক্ষে, তারা সরব হোন। কাউকে এভাবে তাকাতে দেখলে অন্তত একটা ‘হৈ’ বলে আওয়াজ করেই দেখুন না মজা! লোকটি বিব্রত হবে, ছিটেফোঁটা লজ্জা অবশিষ্ট থাকলে হয়তো আর এমন করবে না। (উপজাত হলো আপনি একটু মজার সার্কাস দেখতে পেলেন)। পাশের একজন পুরুষের মতামত ও বিরোধিতা যদি এইসব ব্রেইনলেসের মাথায় ঢোকে (কারণ নারীকে তো তারা মাংশ মনে করেন, নারীদের বিরোধিতার হয়তো ভ্রূক্ষেপও করবে না, উল্টা মেয়েটিকেই গালাগালি খেতে হবে)।

আশা করতে পারি, খারাপকে খারাপ বলার চর্চাটি সামাজিকভাবে আবার আমাদেরই চালু করতে হবে। পুতুপুতু লুলুবাবু হয়ে তো কচুও কাটা শিখি নাই। এখন দুয়েকজন কাম-কাতর লুঙ্গি-বানরের রাডারটিকে যদি নিষ্ক্রিয় করতেও না পারি, তাহলে আর কীসের শিক্ষা, কীসের মনুষ্যত্ব?

মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১১

বিনির্মাণ

মাঝে মাঝে কোলাহল মুখ ফিরিয়ে নেয় জলের প্রবাহের মতো শব্দের ঢেউ এলোমেলো যত্রতত্র হঠাৎ খুলে যায় স্রোতমুখ তার অন্যদিকে কোন অন্য মানুষের দিকে
কোলাহলে পিঠ রেখে অন্ধকার দেখি
গাঢ় বিশুদ্ধ অন্ধকার জ্বলছে মেরুদণ্ডহীন
লতানো গাছের মতো নমনীয়, নতজানু
জড়িয়ে আছে বিদ্যুল্লতা
একা একা তীব্র মৌন
নেই আপত্তি নেই অভিযোগ
নেই পুরানো হিসাব মেটানোর দায়
একটা ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরে ফটফট করতে করতে পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে উঠে দেখি ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে দুইজনে দেয়াল ভাঙছে। দুম দুম করে কেঁপে উঠছে দরজা জানালা মেঝে - এমনকি এলিভেটরের কাঠামোও! কাঁপতে কাঁপতে হাতড়ে একটা অবলম্বন খুঁজি। আশেপাশে কোন চেয়ার কিংবা শক্ত কোন বাক্স, ভর দিয়ে একটু কাঁপুনি সামলে নিবো। ফর্সা তন্বী দেয়ালে কালো লোহার ছেনির আঘাতে চাপড়া চাপড়া প্লাস্টার খসে পড়ছে। সিমেন্টের গুঁড়ো, ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে বাঁকাত্যাড়া ইটগুলো বেরিয়ে আসছে। দাঁতাল শুয়োরের মত হাসছে। দুইজনে পিটিয়ে দরজার পাল্লাগুলো খুলে ফেলছে। দরজা কপাট হাট হয়ে গেল - বেআব্রু। দেয়ালে গাঁথা দুয়েকটা পেরেক, ছবি ঝুলেছিল হয়তো সেখানে। সেগুলো নেই। শুধু ছবির ফ্রেমের কালো দাগ। হাতুড়ির বাড়িতে তুবড়ে গেল...
সুইচবোর্ড খুলে গেল, পিভিসি পাইপের ভেতর জড়ানো লাল-নীল তার। অমন তারগুলো গলায় জড়িয়ে কোন কোন মেয়ে যেন ঝুলে পড়েছিলো। মনে পড়ে না আর। মৃত্যুর খাতার চাপা পড়া পৃষ্ঠা হারিয়ে ফেলেছি।
রাজমিস্ত্রিদের গায়ে কালো জামা। এই বাসায় ফ্যান নেই, জানালাগুলো চোরের ভয়ে বন্ধ আর গুমোটে ভরে আছে ঘামের নোনা গন্ধ। পিছলে পিছলে চকচকে ঘাম মুছে তারা হাতুড়ি চালায়। দেয়াল ভাঙছে, চাঙড় চাঙড় ইট খুলে আসছে দেয়াল থেকে। দুম দুম শব্দের ঢেউ আমার বুকের মধ্যে ভরে যায়। সারাদিনমান একলা হয়ে যাই আর ভাঙা দেয়ালের মত চোয়াল - বয়ে বেড়াই মৃত্যুর আদুরে আবছায়া, হাতুড়ির মত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যার।

অবচেতন

আর ওই ঘন সুদূরের ঘ্রাণ
দেখ মিশে গেছে ঘাসের শিরায়,
বিমর্ষ স্মৃতি
ঘ্রাণ খুলে নাও।
অমূল্য সুতোয় বেঁধে রাখো, রাখো যতনে,
গোপনে, রাখো নিদ্রা চিরন্তনে।
স্বপ্নের ভিতর যে বাড়ি, যে ঘর,
যেখানে মৃত্যু ও তাবত ক্লান্তি নেই,
সেখানে স্মৃতিগুলো অমল ধবল
সেখানে তুমি কখনো যাবে না।
তুমি ভেবে নিবে বিলুপ্ত কাল
কিংবা অতীত বিস্মৃতি
ভেবে নিবে তারা নেই - সেখানে বা অন্য কোন খানে
তোমার বিভ্রান্তির ফুল খুব অমলিন ফুটে থাকবে!

বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১১

যা চলে, যা চলে না

আর সদ্য কর্ষিত জমি
ও রাজপথ একই রূপ,
এ কী অপরূপ!
ধুলো ওড়ে মিউ মিউ
মিউনিসিপ্যালিটি
অ্যাপলিটিক্যাল
প্যালপিটিশনে ভোগা
উড়ে উড়ে ছাতে বসে
তীক্ষ্ণ কাকের মতে
ধুলো অক্ষয়
এবং জানালাগুলো
আমরা জানি
জানালা ভাঙা যায়
বেশ অবলীলায়
তা, খুব ভাল কথা
ভেঙে দিলে কোন
ক্ষতি আছে কি?
ক্ষতি আপেক্ষিক,
কার হচ্ছে সেটা জানা জরুরি
আমার না হলে আর তোমার না হলে
ক্ষতির গুষ্টি মারি
তো, আমরা ধুলোয় ছিলাম
আর ওই সদ্যলাঙুলে জমি
সুশুষ্ক, অনাবিল...
আরো কিছু প্রপঞ্চ আনা হোক
রোল কলের খাতা কই
লাগবে না, ডাক দিন
মেঘ নাই, বাতাস নাই
রোদ এসেছে, সাথে গুমোট
খাতা সাথে আনে নি তারা
তিন চারটে ফালতু ফল
ওগুলো কামড়ে খাব,
খেতে বেশ রসালো
দাঁত বসাবো দাঁতের দাগে
শির শির করে
উঠবে শিরদাঁড়া
ভয় নাই বেশিক্ষণ না
উত্থান হবে স্বল্পায়ু
রোদ ও গুমোট আবার ঘুমাবে
দুয়েকটা বড়ি খেয়ে
আমি এসব ঠিক বুঝি না
কেন তোমার আমার মধ্যে
কিসু কিসু প্রপঞ্চ প্রবঞ্চকের মত
আনতেই হবে?
সজোর বৃষ্টির ফোঁটা
দুদ্দাড় ছুটে এল এলাকায়
রোদ পালাল
গুমরে গুমখুন গুমোট
এখন বাইরে তাকাও
আবার এদিকে, কেউ নেই
মুখ ফিরিয়ে দেখ
হ্যাঁ, আবার তাকাও
দেখো আমি নাই

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১১

ডুইবা গেলে মিইশা যাবো, ভাঙ্গা ঝিনুকের দেশে...

এক
একটা গল্প লিখছি। সম্প্রতি ছোটগল্প লেখার ও লেখা নিয়ে নিরীক্ষা করার একটা ভাল পেইজ দেখেছি, যেখানে ধাপে ধাপে গল্প তৈরি করার শর্টকাট এবং ডিটেইল দুই রকমের নিয়মকানুন দেয়া ছিল। একদম সিদ্দিকা কবীরের রেসিপি যেন! মালমশলা জোগাড় করে নিয়মমাফিক মাখালেই গল্প তৈরি, যা পাঠক-আকর্ষী, নিরীক্ষামূলক ও অভিনবও হতে পারে। সেই নিয়ম দেখে আগ্রহ হলো - লিখতে বসলাম, এবং যথারীতি এক পর্যায়ে ধরা খেলাম। গল্পের বিস্তৃতি ও কাঠামো এতোটাই ব্যাপক যে আমার ক্ষুদ্র আঙুলে সেটার জায়গা হলো না। যতোই আঁকড়ে ধরতে যাই, বালুতটের মুঠোভর্তি বালুর মত আঙুলের ফাঁক দিয়ে গ'লে পড়ে যায়। আর মুঠোর ভিতরে জমে থাকে ছাই ছাই ধুলো। তাই আপাতত ক্ষান্ত দিয়ে বসে আছি। বুঝতে পারছি যে গল্প লেখার গল্প মূলত নিজেই আলাদা গল্প হয়ে ওঠে।

দুই
নিরন্তর বর্ষণ। আমি উচু এলাকায় থাকি বলে পানি জমে রাস্তাগুলো নদী হয়ে যায় নি। তবে কাছাকাছি এলাকায় ডিভাইডারে ভাগ করা নদী জন্মে গেছে। নদীতে নৌকাস্বরূপ বাস চলছে। প্রচুর ট্যাক্সি ও গাড়ি ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বিকল হয়ে নদীতে ভাসছে। আর মানুষজন নদী ডিঙিয়ে ভিজে ভিজে যাতায়াত করছে। দেখতে ভিন্ন আর অসুন্দর লাগছে। আমরা একটা কর্মফলের শহরে বাস করছি। গত চল্লিশ বছরের অনাচারের কর্মফল ফেটে ফেটে যাচ্ছে ফুলের মতো। পরাগরেণুর মতো আমাদের পূর্বপুরুষের অবিমৃশ্যতার পাপ দেখতে পাচ্ছি রাস্তায় ও আইল্যান্ডে, পার্ক ও শপিং মল জুড়ে। দরজির কাছে কিছু কাপড় দেয়া ছিল। ফোন করে জানা গেল, 'কাজ হয়ে গেছে - এসে নিয়ে যেতে পারেন'। উত্তরে বলা হলো, 'নদীতে ভাসায় দেন, ভেসে ভেসে ঠিক এই ভাটিতে আমার বাসায় চলে আসবে। আমি জাল ফেলে কুড়িয়ে নিবো'।

তিন
ম্যালথাস বাংলাদেশে জন্মালে কিশোর বয়সেই তত্ত্বটি দিয়ে দিতেন। মানুষ এত বেড়ে গেছে যে অচিরেই নিজে নিজে মারবে, একে অপরকে মারবে। আমিও একমত সহমত অ-অমত। আদমশুমারিতে জনসংখ্যা এসেছে চৌদ্দ কোটি। প্রকৃতি বললেন, 'রসো বেটা, কেটেছেঁটে চৌদ্দই সই!' এই দেখুন ৪১ টি সদ্যকিশোর মারা গেল। এরা বেঁচে থাকলে বিয়ের করতো আরো ৪১ জনকে, ৪১ দু'গুনে ৮২ সন্তানের জন্ম দিতো। জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ ঠেকাতে ট্রাকখানা ধ্বংস হলো। ভালই হয়েছে! না রহিবে বাঁশি, না বাজিবে বাজনা। এই যে সেদিন মিলনকে পিটিয়ে মেরে ফেললো, এটাও ওই ক্ষমাহীন অ্যাক্ট অফ নেচার। স্বতস্ফূর্তভাবে আমরা একে অপরকে মেরে ফেলবো। সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট। কেউ বলে নি এটা সারভাইভাল অফ দ্যা গুড, কিংবা রাইট, কিংবা জাস্ট। ফিট হতে হবে, নইলে পগারপার। পরকালে গিয়ে সারভাইভ করো। আর পরকাল না আসা পর্যন্ত মাটির নিচে কবরে।

চার
কেউ মরে গেলে আমরা যে সামাজিক নিয়ম মেনে তার সৎকার করি। ভেবে দেখলাম, মৃতের কাছে এর কানাকড়িও মূল্য নেই। যে মরে গেছে, যে চলে গেছে, তার তো জানার কোন উপায় নেই যে তার মৃত্যুর পরে কোথায় কী হচ্ছে! এগুলো তাকে আর বিন্দুমাত্র নাড়া দিচ্ছে না। কে কী বললো তাকে নিয়ে তাতেও তার কিছু আসে যায় না। তবে আমাদের আসে যায়, আমরা যারা বেঁচে থাকি। আমরা যারা মৃতের স্মৃতি বহন করি। আমাদের কষ্ট হয়, একক কষ্ট, গোষ্ঠীবদ্ধ কষ্ট, মিলিত কষ্ট...। এই কষ্ট প্রশমনের জন্যেই যতো আয়োজন। মৃত্যুকবলিত ভাঙা মন নিয়েও আচার পালন করো। প্রথা মেনে শোক প্রদর্শন করো। দেহ পুড়াও, মাটি দাও কিংবা দান করে দাও। উইল ভাঙো, দেখো কে কী পেয়েছে, কাকে কতো দিয়েছে। এই সব রীতিনীতির মাঝে দুয়েকটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আর অসহনীয়তার নির্বাক শব্দ হারিয়ে যায়।

পাঁচ

ছয়
পাঁচ নম্বরটা খালি থাক। এই ঘনবসতি আর জঞ্জালের মধ্যে মনে কিছু জায়গা খালি রাখি। সময় পেলে, সেখানে খুব আপন কিছু রাখা যাবে 'খন!

সাত
রোজার মাস। শরীরে ক্ষুধা বয়ে চলাটুকুই সবচেয়ে সোজা কাজ। বিস্ময়ে দেখি যে সোজা কাজটাই খালি আমরা পারি। বাকি সকল উপদেশ, নিষেধ আর নিয়মকে তুড়ি বাজিয়ে যথেচ্ছাচার, অপচয় আর নোংরামো করে চলেছি। ভাল লাগে ভণ্ডামোর চূড়ান্ত রূপটি। প্রায়ই ভাবি, যে এর চেয়ে বেশি ভণ্ড হওয়া সম্ভব না। তারপর নতুন কোন ভণ্ডামোর উদাহরণ দেখি আর বলিহারি যাই! আমার কাছে মনে হয় এই উপোস* থাকার রিচুয়ালটি বেশ ট্রিকি। ক্ষিধে পেটে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে। অথচ মেজাজটাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে শরীরে আরাম চাই, যা কিনা ক্ষিধে না মিটলে আসছে না। চৌদ্দঘন্টার বেশি সময় গরমে, ঘামতে ঘামতে রোজা রাখুন। পানিশূন্যতার কারণে শরীরে গোলযোগ। রক্তে সুগার কমে যাওয়ায় ব্রেইন ফাংশন কমে আসা। সেদিন এক ছাত্র পরীক্ষার মাঝে বলছে, 'মাথা কাজ করছে না। সব পড়েই এসেছিলাম কিন্তু এখন অর্ধেক মনে পড়ছে'। রাস্তায় জ্যামে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সবাই। তীব্র হর্ন বাজছে। হর্নগুলোকে কেউ রোজা রাখায় না কেন?

আট
দেখতে দেখতে এই বছরের অষ্টম মাসে চলে এসেছে। মাসের প্রথম সপ্তাহের রবিবার বন্ধুদিবস ছিল। সূর্যের হিসাবে দিন হয় বলে বাংলাদেশে বসে এই দিনটি শুরু হলো ছয় ঘন্টা আগেই, তারপর চললো সোমবার দুপুর অবধি! প্রায় দেড় দিনের বেশি সময় ধরে বন্ধুদের শুভেচ্ছা দিতে, নিতে, পেতে দেখলাম। দূরে থাকা বন্ধুদের জন্যে কান্নাকাটি করতে দেখলাম। এই সুযোগে বাবা-মা-ভাই-বোন-প্রেমিক-প্রেমিকা-স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি সম্পর্কিত মানুষদেরকেও বন্ধু বানিয়ে দিবসে জুড়ে নিলো কেউ কেউ। পরের দিন এক বন্ধুকে অনলাইনে টোকা দিয়েছি, কিছুটা কাজের দরকারে আর কিছুটা আলাপ সারতে। সে অনুযোগ করলো, 'গতকাল একবারও আমার খোঁজ নিলি না, উইশও করলি না। তুই আমারে আর বন্ধু ভাবিস না!' জবাবে বললাম, 'নালায়েক, বন্ধু দিবসে হিসাব করে তোকে কার্ড পাঠাবো আর উইশ করবো কেন? তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব সোয়া এগার বছর। কবে এইসব উইশ-ফুইশের ধার ধেরেছি?' জবাবে নালায়েক কিছু বলে নি।

নয়
কিছু সম্পর্কের সাথে প্রকৃতির নিয়ম মেনেই বিযুক্তি এসে গেছে। এটা বোধহয় নিয়তি। too good to be true এর মতো প্রপঞ্চ এইসব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্যেই বানানো হয়েছে। এমন নয় যে আমি সেই সম্পর্কগুলোকে মিস করছি, বা তাদের সাথে বিযুক্তিতে আমার কোন হা-পিত্যেশ আছে। তবে কি না, মানুষের মন, তাই মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। তখন আমি দীর্ঘ ঘুম কামনা করি। ভাবি, একদিন রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের মতো ঘুমিয়ে পড়বো কোন ঘাসে ছাওয়া পাহাড়ের পাদদেশে। তারপর বিশ বছর কেটে যাবে। ঘুম ভেঙে দেখবো আমার চেনাপরিচিত কেউ নেই। আমি সম্পূর্ণ একা, এবং বন্ধুবিহীন, এবং আত্মীয়বিহীন, এবং প্রচণ্ড প্রচণ্ড স্মৃতিকাতর!

দশ
ছোটবেলায় একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটু মারাত্মকভাবে কেটে গেল। অনেকখানি জায়গা, মালাইচাকির জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে একাকার। ক্ষতগুলো বেশ গভীর, প্রায় তিন-চার মিলিমিটার পর্যন্ত। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার পরে সেখানে গজ-তুলো কীটনাশকে ভিজিয়ে চেপে ধরা হলো। রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, তাই কাটা গর্তের মধ্যে নুড়ি, ধুলো ঢুকে গেছে। পরিষ্কার না করে উপায় নেই, কিন্তু যে যন্ত্রণা সেটা সহ্য করাও কঠিন। আমাকে আবার ততোদিনে শেখানো হয়েছে যে কান্নাকাটি করা ঠিক না। কষ্ট সইতে হবে দাঁতে দাঁত চেপে। আমি আরো এক ডিগ্রি বেড়ে ক্ষতের দিকে চেয়ে থাকলাম। দেখি কেমন করে পরিষ্কার করে! লাল লাল রক্তভেজা গজ-তুলো সরিয়ে নিলে ভিতরের মাংশ দেখে কেমন অদ্ভুত লাগলো। আমার ভিতরটা এমন? এ যে বড়ো বিস্ময়কর! এই রক্ত-মাংশের ভিতর আমি কই? লাল লাল রক্ত আর দপদপ করতে থাকা যন্ত্রণার মাঝে পড়ে থেকে ওই অস্তিত্বের আকুতি আজকালও আমাকে জ্বালায়। অনেক সময় দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার মুহূর্তে অমন ছাল-ছাড়ানো অনুভূতি হয়। যেন কেউ আমার মাংশ উদোম করে দিয়েছে! বাতাস আর ধুলোবালি এসে ঝাপ্টা দিচ্ছে। আর আমি দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিচ্ছি...


শূন্য পাঁচ
... শূন্যতার ঘরে শুধুই তুমি... সেখানে আর কোন কথা...সুর...গান স্থান পায় না!...
*উপোস = রোজার গড়পড়তা সামাজিক রূপ, যেখানে একান্ত ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আচরণ ক্রমশ সামাজিক উন্মাদনা ও ধরপাকড়, কিংবা জোর-জবরদস্তিতে পর্যবসিত।

রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১১

ক্ষয়ে যাবার সূত্র

এই শহরে একলা হয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার। নিজের অজান্তেই, একদম হুট করে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মাঝে দুয়েক মুহূর্তের ফাঁক দিয়ে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাই, নিঃসঙ্গ ও নির্বন্ধু হয়ে যাই। ধীর পরিবর্তন যেমন সহসা নজরে পড়ে না, খুব খেয়াল না করলে টের পাওয়া যায় না, সেরকম পরিবর্তন এটা নয়। একলা হয়ে যাবার কোন গাণিতিক সমীকরণ নেই। আর এই বিষয়ে কোন গবেষণা চলছে বলেও খবর পাই না। তবে এই প্রক্রিয়াটি যে একেবারেই আকস্মিক এবং দ্রুত, সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। ভূমিকম্প বা বজ্রপাতের মতোই, আমরা একা হয়ে পড়ি। বরং বলা চলে, একাকীত্ব আমাদের ওপর সনখ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধারালো আঁচড়ে চারপাশের নিরাপদ বলয় ভেদ করে নখ-দাঁত বসিয়ে দেয় নিঃশব্দে। সেই নিঃশব্দ আঁচড় বুকের গভীরে নিয়ে হতবাক হই – একে অপরের সামনে মুখোশের মতো হাসি লটকে রাখি।

চায়ের বাজার জমে ওঠে বনানীর অলিগলিতে। এই অলিগলিগুলো রাশেদের ভালো লাগে। নম্বর দিয়ে রেখেছে মিউনিসিপ্যালিটি, কিন্তু সেগুলো সে মনে রাখতে পারে না। সে বনানীর অলিগলি দোকানপাট দিয়ে চিনে নেয়, মনে রাখে মোড়ের মার্কেটের পসরা দেখে। কোন রাস্তার খোয়া-ওঠা ছাল দেখে তাকে চিনতে পারে, রাস্তাটি তার দিকে ঘেয়ো কুকুরের করুণ চোখে তাকায়। রিকশায় ঝাঁকি খেতে খেতে তার সম্ভাষণে রাশেদ মাথা এমনিতেই ঝাঁকি খেতে থাকে। রিকশায় দেখা গেলো রাশেদকে, যার সঙ্গে এইমাত্র পরিচিত হলাম আমরা, সে তখন একা বসে আছে। রাশেদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। ধীরে ধীরে তাকে জানার চেষ্টা করবো আমরা। পেঁয়াজের পরতের মতো মানুষের ভেতর অজস্র পরত। সেই ভাঁজে ভাঁজে রাশেদ কেমন হয়ে উঠছে – খুব পাষণ্ড চণ্ডাল হয়ে উঠছে, নাকি খুব অমায়িক ভদ্র হয়ে উঠছে, সেটা জানতে চাইবো। একজন মানুষকে তো পুরোপুরি জানা যায় না, তারপরেও চারপাশ দেখে তাকে বুঝে ওঠা যায়। সে কেন কীভাবে কোথায় চলে যাচ্ছে, কী করে বেঁচে থাকছে, সেগুলোর দিকে বারবার আমরা অনুসন্ধানী ও লোভীর মতো দৃষ্টি ফেলবো। আর এর ফাঁকে ফাঁকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নেয়ার এক অপ্রকাশিত অন্তর্লীন চেষ্টা চালাতে থাকবো। মিলে গেলে গল্প পড়ার সময়টাই উসুল!

পরত পরত অপ্রকাশ্য অসংখ্য মানুষের মাঝ থেকে আমরা রাশেদকে তুলে আনি। হয়তো সে তেমন জরুরি কেউ নয়, সে খুবই সাধারণ, কিন্তু এইখানে এই গল্পে সে প্রধান হয়ে ওঠে। আর সেজন্যেই তাকে আমরা বনানীতে দেখি। বনানীর কোন এক নম্বরহীন গলিতে রিকশার ওপরে রাশেদকে দেখি। রিকশার চালকটি বুড়ো, নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতো শিরা-জেগে-ওঠা জরাগ্রস্ত হাতে রিকশা চালায় সে। বুড়োরা আস্তে ধীরে রিকশা টানে বলে খানা-খন্দগুলো বড়ো বেশি কোমরে লাগে, হাড়গুলো বাজতে থাকে ঝনঝন করে। রাশেদ রিকশার ওপরে বেশ সামলে বসে, কায়দা করে তাল সামলাতে হয় তাকে। রাস্তাটা রাশেদের বেহাল দশায় মজা পায় মনে হয়; যদিও রাস্তার এই অনাবশ্যক রূঢ়তার দিকে নজর দেয়ার সময় নেই ওর। রাশেদের হাতে শক্ত করে ধরা চিঠিগুলো আজকের মধ্যে ডিএইচএল-এ পাঠিয়ে দিতে হবে। সে হলদে-কমলা দোকানের সাইনবোর্ড খোঁজে, মনে মনে ভাবে, ‘এই রাস্তার পরেই বুঝি চোখে পড়বে’। দোকানটা প্রথমদিকে রাশেদ চিনতো না, নিয়ন তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। নিয়নের সাথেই প্রথম এসেছিলো ওখানে, “শোন, এইটা সস্তা কিছুটা। ফেডএক্স অনেক টাকা নিবে। তোর তো বেশ কয়েকটা প্যাকেট পাঠাতে হবে, তাই ডিএইচএল-ই ভালো,” বলতে বলতে নিয়ন ওই কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলো। রাশেদ সেই দোকানটাই এখন খুঁজছে। রিকশার পাশ দিয়ে শিসের মতো মোটর বাইক বেরিয়ে গেলো। চিন্তা-ভঙ্গ। নিয়নের চিন্তাটুকু রাশেদের মাথায় ক্রমশ জড়াতে থাকা সুতো হয়ে উঠছিলো, সেটা ছিঁড়ে গেলো। তখনই রিকশা ডানে মোড় নিয়ে একটু এগোতেই দোকানটা চোখে পড়লো তার।


কাজ সেরে বেরুনোর পরে রাশেদের বেশ খালি খালি লাগতে থাকে। চিঠি পাঠানোর পুরনো উত্তেজনা ফিরে আসে। যদিও এই চিঠিগুলো তেমন ব্যক্তিগত নয়, এগুলো কাগুজে সনদ – তার যাবতীয় পড়াশোনা আর অর্জনের ফিরিস্তি। এগুলো কীভাবে জমেছে, কীভাবে সে পেয়েছে, মাঝে মাঝে নিজেই ঠাহর করতে পারে না। সাদা কাগজে গোটা গোটা করে রাশেদুল হাসানের কৃতিত্ব বা ব্যর্থতার যে ফিরিস্তি সনদগুলো সোচ্চারে ঘোষণা করতে থাকে, সেটা চোখের সামনে রেখেও সে মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে পারে না। তার মনে হয় রাশেদুল হাসান নামের অন্য কোন মানুষের কথা বলছে। আদ্যোপান্ত গাঁজাখুরি বৃত্তান্ত মনে হতে থাকে। কখনো কখনো সে রীতিমত লুকিয়ে রাখে কাগজগুলো। নিজস্ব অর্জন বা ব্যর্থতা অনেক সময় মানুষের কাছে প্রকাণ্ড পাথরের মতো। বুকের ওপর ছোট ছোট মেডেলের ভার কীর্তির পাশাপাশি হয়তো অকৃতকার্যতার অনুভব দেয় হঠাৎ করেই। এই অনুভব খুব বিদঘুটে, মাঝে মাঝে মনে হয় বিচ্ছিন্ন ব্যাপার, নিতান্তই তুচ্ছ, কিংবা ভাবালুতাও বলা চলে। কারো কাছে রাশেদ এগুলোর কথা বলবে, সেই সুযোগ পায় না। এমন বিপন্নতায় তাই একলা লাগার অনুভব তার কাছে ফিরে ফিরে আসে। ডিএইচএল-এর দোকানের বাইরে ধুলোর মধ্যে জুতা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ ডানে বামে তাকিয়ে সে তাই রোদ দেখে, বৃক্ষহীন খোলা মাঠের আশেপাশে গুটিকয় কসরত করতে থাকা বড়োলোক দেখে।

বাইরে রোদের তোড় কমে এসেছে, শীত শীত বাতাস। হামা দেয়া বাচ্চার মতো টালমাটাল ভঙ্গিতে পড়ন্ত সেপ্টেম্বরে শীত এগিয়ে আসছে। এবারেও হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাবে শেষতক, এটা ভাবতে ভাবতে রাশেদ রাস্তার পাশ দিয়ে বাসার দিকে অথবা অন্য কোন দিকে হাঁটতে থাকে। দুঃখিত, আমি ঠিক বুঝতে পারি না, রাশেদের গতিবিধি আমার কাছে কিছুটা অপরিচিত এখনো। আপনার পাশাপাশি আমিও তাকে চিনে ও পড়ে নেয়ার চেষ্টা করছি, আর আপনার চেয়ে একটু এগিয়ে আছি কেবলমাত্র। কিন্তু রাশেদের সেগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই। অন্তত আমাকে বিভ্রান্ত না করেও সে গন্তব্য স্থির করতে পারতো। রাশেদের মাথায় হয়তো তখনও নিয়নের চেহারা জমাট বেঁধে ছিলো। ছিঁড়ে যাওয়া সুতোটা ল্যাতপ্যাত করছিলো মগজের কোন কুঠুরিতে। নিয়ন দেশ ছেড়ে যাবে যাবে করছিলো গত বছর। যাওয়া নিশ্চিত হবার পরে সময় পেয়েছিলো এক মাস, দৌড়াতে দৌড়াতেই সেটা পার হয়ে গেলো। শেষদিকে খুব বেশি দেখা হতো না তাদের। বিদেশে যাওয়ার এই চক্করের মাস ছয়েক আগে ওরা রুম ছেড়ে দিয়েছিলো। অহোরাত্রির সঙ্গী থেকে ব্যস্ত শহরে চাকরি ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে ওরা আলাদা হয়ে পড়ছিলো। এই বিমুক্তি এতোটাই স্বাভাবিক ও সন্তর্পণ, রাশেদ বা নিয়ন কেউই হয়তো অনুভব করে নি। তাই রুম ছেড়ে দেয়ার মাস-ছয়েক পরে নিয়নের বিদেশযাত্রার খবর এলে রাশেদ টের পেয়েছিলো দূরত্ব বেড়েছে অনেক। ঠিক তখন সময়টা এমন যে, ওর চলে যাওয়ার খবরে রাশেদও কেমন কাছিমের মতো গুটিয়ে গেলো, হাত-পা-মুখ সরিয়ে গর্তে ঢুকে পড়লো, ডুব দিলো সেলফোন বন্ধ করে। রাশেদ এটা প্রায়ই করে। কিন্তু ঠিক নিয়নের যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় ওদের দেখা হয়ে গেলো। এমনি হঠাৎ করে হয় নি। রাশেদই গিয়েছিলো দেখা করতে, তখন ব্যাগ বাঁধাছাঁদা করছিলো নিয়ন। খুব স্বাভাবিকভাবেই টুকটাক কথা হলো-

-“সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে ফেলেছিস?”
- “হ্যাঁ, চিঠি এসে গেছে। যাবার পরে আরো ডিটেইলে জানবো।”
- “কোন সমস্যা হয় নাই তো?”
- “নাহ্‌, সমস্যা আর কী হবে? দুনিয়া জুড়েই তো সমস্যা। ওখানে গিয়ে একটা রুমমেট জোগাড় করতে হবে। একা একা ভাড়া দিয়ে কুলাতে পারবো না।”
- “দেখিস, ফিরিঙ্গি দেশে দেখা জায়েজ, তবে ছুঁইলে পুলিশের চাইতে বেশি ঘা খাইতে হবে”, চোখ মটকে বলে রাশেদ।
সাথে সাথে নিয়নও হাজির-জবাব, “ছুঁইলে ঘা’ও হইয়া যাইতে পারে, হে হে হে!”

বিটকেলে হাসি আর তামাশার খড়ের মধ্যে রাশেদ কিছু একটা খুঁজছিলো। সুইয়ের মতো কিছু একটা বিঁধছিলো। এই কথাগুলো, কোন পুরনো নাটকের টুকরো টুকরো সংলাপ যেন, টান টান ছিলায় করে ছুঁড়ে দিচ্ছিলো তারা। কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে – সেটা জরুরি না। আবার লুফেও নিচ্ছিলো একজন আরেকজনের কথা। ঠিক যেন আগের মতো। যেন কিছুই হয় নি। যেন তাদের মাঝে কোন ঝগড়া হয় নি, কোন দূরত্ব নেই। ছিলার টানের মতো টান টান করেই যেন সুতোটা কেউ পাকাচ্ছিলো। রাশেদ টের পাচ্ছিলো, আরেকটু টানে সাঁ করে ছিঁড়ে যাবে। তারপরে দুই দিকে ছুটে যাবে সুতোর মুখ, গোল অন্তর্মুখী প্যাঁচে ভুলে যাবে বাকি অংশের কথা।

রাত একটায় ফ্লাইট। তাই রাতের খাবার খেয়ে নিয়ন আর নিয়নের বাবার সাথে রাশেদ একটা ট্যাক্সিতে চড়ে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে থাকে। সামনের সিটে রাশেদ, পেছনে ওরা দু’জন। মৃদুস্বরে একটু একটু করে উপদেশ দিচ্ছিলেন নিয়নের বাবা। বুড়ো ছাড়া নিয়নের পরিবারে আর তেমন কেউ নেই। রাশেদের সাথে যতদিন পরিচয় হয়েছে, নিয়নের মা ততদিনে ওপারে চলে গেছেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরাও দূরে দূরে, অন্য শহরে। এই একা একা নিয়নের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে রাশেদের খাতিরও হয়ে গেছে এক রুমে পড়ে যাবার পর। নিয়নের বাসায় যতবার গিয়েছে, মৃদুভাষী বাবার সাথে নিয়নের সম্পর্কটা উপভোগ করেছে। পিতাপুত্রের মাঝে যেন এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব; আংশিক লুকানো, আংশিক ব্যক্ত, অনেকটাই ভাসাভাসা যা এক বিকেলের দাওয়াতে ধরা পড়ে না। নিয়নের বাসায় আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গেলে যখন রাশেদ থেকে যেত, রাতের খাবারের পরে বাইরের কোলাহল থেমে যেত, তখন মন্থর সময়ে বুঝতে পারতো নিয়ন আর তার বাবার মধ্যে বন্ধনের গভীরতাটুকু এরকম শান্ত থির না হলে বোঝা যায় না। এই যেমন এখন, ট্যাক্সির ভেতরে নিয়নের বাবা মৃদুস্বরে নানা উপদেশ দিচ্ছেন। উপদেশের ফাঁকে হঠাৎ নীরব হয়ে যাচ্ছেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার কী একটা মনে পড়ে গেছে ভঙ্গিতে হয়তো বলছেন, ‘আচ্ছা শোন, গিয়ে রাতে ঘুমানোর আগে ওষুধগুলো খেতে ভুলবি না’, কিংবা ‘রাস্তা ঘাটে সাবধান থাকিস, অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু খাবি না’। এমন বাক্যগুলো মায়েদের বলার কথা, নিয়নের বাবা কী অবলীলায় বলে বসছেন। সামনের সিটে বসে রাশেদের মজা লাগে। পিছনে না তাকিয়েও সে নিয়নের নিশ্চুপ মাথা নাড়া দেখতে পাচ্ছে। নিয়ন চলে গেলে সবাই একই সাথে একা হয়ে যাবে।

জ্বলজ্বলে এয়ারপোর্ট অসামান্য রাতের আলোয় ঝাঁঝাঁ করছে। নিয়ন ক্লিয়ারেন্সের জন্যে এগিয়ে গেলে রাশেদ আর ওর বাবা বাইরে জায়গা খুঁজে বসে পড়ে। প্লেন ছাড়তে এখনো ঘণ্টা দেড়েক বাকি। রাশেদের উল্টোদিকে জবুথবু নিয়নের বাবাকে বুড়োটে লাগে। এতো জ্বলজ্বলে আলোতে কি আমাদের চামড়ার ওপরের মুখোশটা খসে পড়ে? ভেতরের রূপ আর দুর্বলতা অবধি চোখ পিছলে চলে যায়? এয়ারপোর্টের চকচকে কাচের দেয়ালের ওপাশে ঝাপসা হতে থাকে নিয়ন। এতো সারি সারি কাচ দেয়া চারিদিকে। মানুষের নিঃশ্বাসে সেগুলো হয়তো প্রায়ই ঝাপসা হয়ে ওঠে। এখানে অনেক অশ্রু জমে আছে। নিয়ন যাবার আগে একটা মুচকি হাসি দিয়েছে। তারপর চলে গেছে হনহন করে ক্যারি-অন টানতে টানতে। এখানে তিনজনের মাঝে ওই সবচেয়ে বাস্তববাদী। কাঁদে না। আবেগে ভেসে যায় না। রাশেদ জানে- ও অনেকদূর অবধি যাবে, নিয়নের বাবাও জানেন সেটা। আমরাও হয়তো বুঝতে পারি। দেশ ছেড়ে যারা যায় তারা কেউই অবাস্তব চিন্তায় যায় না। নিয়নের প্লেন ছেড়ে দেয়ার নোটিশ ওপরের বোর্ডে অনেকক্ষণ ঝুলে থাকলো। তারপর আরো কিছুটা সময় নিয়নের বাবা জবুথবু বসে রইলেন। রাশেদ দেখলো ঘড়িতে রাত ক্রমশ ডানে-বামে হেলে পড়ছে নিদ্রায় ঢুলুঢুলু চোখে। ওর বাবাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাশেদ চলে এসেছিলো।

নিয়ন চলে যাবার পর ওর বাবার সাথে রাশেদের একদমই দেখা হয় নি। দেখা করার সামাজিকতা কখনো ছিলো না অথবা দেখা করার তাড়না অনুভব করে নি অথবা দেখা করার অস্বস্তি ও কথা বলার বিড়ম্বনা নিতে চায় নি রাশেদ। যেহেতু আমরা রাশেদকে পুরোপুরি চিনতে পারবো না, সেহেতু দেখা না করার কারণও আমরা নিশ্চিত করে জানতে পারবো না। নিয়নের সাথেও তার যোগাযোগের মাত্রা কমে গেছে ধীরে ধীরে। অনুপস্থিতি এরকম ঘটায়, অনলাইনে বসেও তাই রাশেদ ও নিয়ন কথা বলে না। সহসা নক্‌ করে না একে অপরকে। অনেকদিন পরপর হয়তো টুকটাক কথা হয়, সেগুলো খোলামকুচির মতো উড়ে যায় অল্পেই। নিয়ন অনেক ব্যস্ত থাকে বলে বেশিক্ষণ কথাও হয় না। রাশেদ একসময় বুঝতে পারে ওদের জীবন ধীরে ধীরে দূরবর্তী ল্যাম্পপোস্টের মত দূরে সরে গেছে। হয়তো সেজন্যই রাশেদ এখন উতলা হচ্ছে। হয়তো সেজন্যই সে বাইরে চলে যেতে চাইছে। পরিচিত জগতের জীবন পরিচিতদের ছাড়া দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই জীবনটাকেই পাল্টে ফেলতে চাইছে সে।


তারপর একদিন খবর এলো, নিয়ন পৃথিবীর উল্টো পিঠে এক দুর্দান্ত শহর থেকে সাঁ সাঁ করে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। রাতে কোথাও পার্টি ছিল হয়তো, ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসেই। পার্টি থেকে বেরিয়ে হয়তো প্ল্যান হয়েছিলো কোন রোড-ট্রিপে যাবার। হোস্টেলে ফেরার ইচ্ছা কারোই ছিল না। সেই গাড়িতে তার সাথে আরো দুইজন বন্ধুবান্ধব ছিলো। দুয়েকটা মদের বোতলও ছিলো হয়তো; আর গাড়ির বাইরে ছিলো আদিগন্ত বিস্তৃত রাত। রাতের অন্ধকার বুঝি গাড়ির ভিতরেও প্রবেশ করেছিলো কিছুটা। রাশেদ কল্পনা করতে পারে, এমনটাই ঘটে থাকবে, এমনটাই ঘটেছিলো। সেই অন্ধকারের কারণে নিয়নকে নিয়ে সুউচ্চ খাদ থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেছে গাড়িটা। এমন বিদঘুটে আর দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো নিয়নের লাশ, সনাক্ত করার জন্যে প্যান্টের পকেটে রাখা আইডি কার্ডটাই ভরসা হলো। রাতে তাকে যারা পার্টিতে দেখেছিলো, তারাও পোশাক দেখে সম্মতিই জানিয়েছে। এই সব কথা আর খবর রাশেদ নিজে পেয়েছে আরো তিন-চার দিন পর। নিয়নের বাবার সাথে তার দেখা করার কারণ যে নিয়নের মৃত্যু হয়ে উঠলো, সেই চিন্তায় রাশেদ মাঝেমাঝে ফ্যাক করে হেসে ওঠে।
দ্রষ্টব্যের মতো আমরা আরো জানতে পারি যে নিয়নের দ্রুতগতির গাড়ি যখন গ্লোব ছিটকে খাদে ঢুকে পড়ছিলো, তখন পৃথিবীর এই পিঠে আমাদের আধা-পরিচিত রাশেদ কর্মজ-চিঠিগুলো নিয়ে বনানীতে অলি-গলি খুঁজে মরছিল। এই শহরে ঘনবসতি, এই শহরে কোন খাদ নেই, অনিয়ন্ত্রণ গাড়ি চালানোর ধু ধু সড়কও নেই!

সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১১

এই লেখাটা কেবল আমার জন্যে

এড়িয়ে যাচ্ছি বৃষ্টিপ্রবণ আবহাওয়া, দৃষ্টির সীমানায় সহসা
দেখছি মানুষের মুখ - শ্বাপদস্বরূপ; দাঁত - আক্রোশের আঘাত।

তার নখমূলে অনির্ণেয় লেগে আছে ছিঁড়ে আনা ত্বক, রক্ত,
উপড়ে আনা নিউরনে দেখি থরথর করছে দুয়েকটা স্মৃতি...

শৈশবের বেণী,

শিউলিতলার শুঁয়োপোকাটি,

ঘুমঘুম হিম স্কুলবেলা

কলতলার শ্যাওলা সবুজ

দেখছি কতো অজস্র মানুষের লালাভ ঠোঁটে
অপরূপ
প্রসাধনীর মতো
চিত্রিত সুন্দর
দু'টি হাত
দলা দলা উরুর মাংশ,
গোড়ালির শিরা

দেখি অশ্রু টলোমল থেবড়ে গ্যাছে চোখের কোলে

তালিকা করছি হারানো বিজ্ঞপ্তি,

তার মুখে
মেয়েটির মুখ, কাঁদছে কেন


দ্রষ্টব্য এই যে কিশোর বয়সে দু-চারজন পাণ্ডা হুমকি দিয়েছিল অজানা কারণে

জরুরি এই না-বলা স্মৃতির সিন্দুকে
দ্যাখো নিরীহ কিশোর হুমকি ধমকে মানে নি

তাই দ্যাখো সে মাটিতে পেরেক দিয়ে গাঁথা
তাই তুমি চিৎকার করতে পারো না নিরীহ কিশোর
তাই তোমাকে ধরে বেঁধে চড় মারে কেউ একজন
তাই তোমার মুখে তারা ন্যাকড়া গুঁজে দেয় আর চেপে ধরে
তাই তোমাকে বেল্ট খুলে মারে কেউ একজন
তাই তুমি টের পাও হাজার মানুষ মিলে তোমাকে ছিঁড়ে ফেলছে পুরানো খবরের কাগজের মত
তাই তোমার নিঃশব্দ চিৎকারে গলা ভেঙে যায়
তাই তোমার চোখ দিয়ে নিষ্ফল অশ্রু ঝরে
তাই তুমি জ্ঞান হারাতে গিয়েও হারাও না
তাই তারা অট্টহাসি হাসে তোমাকে উলঙ্গ করে
তাই তুমি টের পাও তোমার কোমরের নিচে কোন বোধ নাই
তাই তুমি বিস্ফোরিত হয় নক্ষত্রের মতো



We are all nothing but stardust!

আমি তোমাকে মিস করি। প্রায় রাতেই আমি তোমার মুখ দেখি। আমি তা কাউকে বলি না। এই অনুভূতি আমি কোথায় নিয়ে যাব? কাকে শোনাবো? আমি তোমাকে মিস করি। আমি রোজ সকালে ঘুম ভেঙে তোমার চোখ দেখতে পাই। আমি চোখ মুছি, সবাই ভাবে ঘুমের চোখে ময়লা হয়তো। আমি মাঝে মাঝে একা একাই কেঁপে উঠি। কান্নাটুকু পাচার করে দিই। তুমি নেই। এই কান্নাটুকু তোমার জন্য। তুমি আর কখনই আসবে না এখানে। তোমার মৃত্যুর কথা কেউ জানে নি। আমি জানি। তাই আমি তোমাকে মিস করি। আমার মৃত্যুর পরে তুমি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। ভেবে ভাল লাগে। তুমি আর আমি এই পৃথিবীর বাইরে আরেক পৃথিবীতে দেখা করবো। আমি তোমাকে দেখে ঠিক চিনে ফেলবো এতো বছর পরেও। তুমি হয়তো আমাকে চিনবে না। তুমি তো অনেক আগেই চলে গেছো। আমি হেসে দিয়ে তোমার পেরেকগাঁথা হাত দুটো ধরবো। আঘাতে হাত বুলিয়ে দিব আলতো করে। তুমি হয়তো বুঝে ফেলবে আমি কে। ক্ষতি নেই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবে। আমরা কোন কথা বলবো না...

বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১

মনে হয় করতলে আছি...

রেখেছি বিমূঢ় শোক - পুরে মুঠোর ভিতর
প্রায় দু'মাস, এতদিনে এই শোকটুকু,
ফোঁটায় ফোঁটায় জমে ওঠা স্থিরচঞ্চল জল
হয়ে গেছে, মুঠোবন্দী করে রেখেছি, স্পর্শে
টের পাচ্ছি কোমল শোকের স্পন্দন - করতলে
নানাস্থানে যাই, কারো সাথে পরিচিত হলে
বিব্রতবোধ করে মুঠোহাত এগিয়ে দেই,
হাত মেলানোর প্রথাপালন দুষ্কর হয়ে পড়ে,
ব্যক্তিগত শোকের খবর কেন সদ্যপরিচিতকে দিব?
দৌড়ুতে দৌড়ুতে বাসে উঠি, সাবধানে
আমার কলার মুঠো পাকড়ে টেনে তোলে
কনডাক্টরের শক্ত বলীয়ান হাত - সে'যাত্রা বেঁচে যাই
ভাগ্যিস মুঠো খুলে শোকাংশ বিলিয়ে দেই নি বাসের হাতলে
বাসায় ফিরলে জামা খুলতে কষ্ট হয়, এক হাতে কষ্টেসৃষ্টে
খুলে নিতে পারি শার্টঃ বহিরাঙ্গের ধুলো ও কয়লা,
ঘরের মানুষেরা কিছু বলে না, মেনে নেয়
মুঠো করা হাত দেখে কিছুটা মূক ও অপরিচিত বনে যায়
এভাবে শোকের পালন এ'জনপদে বিরল
অনেকেই আগ্রহী হন, কৌতূহলে বেড়ালের মত
গা ঘেঁষে আসেন। হে একান্ত শোক আমার!
অজান্তেই আমাকে বিখ্যাত করে তুলছো,
আমি কৃতজ্ঞ আমি নতজানু তোমার সাহচর্যে,
অনেকের কাছে আমি আরাধ্য হয়ে উঠছি
মাঝে মাঝে তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুঠোর ঘ্রাণ নেই
গা শিউরে ওঠে এই অতলান্ত শোকস্পর্শে
বুঝিবা আমার হাতটুকু ধীরে ধীরে অবাস্তব হয়ে গেছে
কিংবা শোকটুকু মিলিয়ে গেছে বাষ্প হয়ে -
অ নে ক আ গে ই
আমি ভুলেভালে মুঠো বন্ধ করে ভ্রমে বুঁদ
শিওর হতে পারি না, ডিলেমার কর্কট ক্রমশ
মুঠোগামী আমি ভয়ে তাড়িয়ে দেই তাকে,
"ভাগ্‌ শালা জোচ্চর কনফিউশন, ভাগ্‌ এবেলা!
জারিজুরি করে শোকে ভাগ বসাবি,
জানি তোর দুরভিসন্ধির অলিগলি!"
প্রায়ই ভাবি এ'দুঃসহ ভার ফেলে দিব আজই
মুঠো খুলে ধুয়ে নিব কলের শীতল জলে
হাত মেলে দেখব কোন শোকের ছায়াও নেই
মনে হবে পুরোটাই মনের মস্ত এক ভুল ছিল
মনে হবে পৃথিবীতে আমার কোন শোক ছিল না
তারপর মনে হবে হয়তো ছিল কিছু কোনও এক কালে
ভুলে গেছি সেইসব একান্ত ব্যক্তিগত শোক
খামাখাই কবরের মতো স্মৃতিচিহ্নের দরকার নেই বলে
এই হাতটি নতুন পেয়েছি বলে মনে হবে আমার
তারপর পুরনো আটপৌরে হাত, সেই বন্ধ করা মুঠো
ও শোকসন্তপ্ত করতলের শোকে আমি আবারও মুঠো বন্ধ করে ফেলবো...



৩০ মে, '১১

সোমবার, ৩০ মে, ২০১১

মনে হয় করতলে আছি

রেখেছি বিমূঢ় শোক – পুরে মুঠোর ভিতর
প্রায় দু’মাস, এতদিনে এই শোকটুকু,
ফোঁটায় ফোঁটায় জমে ওঠা স্থিরচঞ্চল জল
হয়ে গেছে, মুঠোবন্দী করে রেখেছি, স্পর্শে
টের পাচ্ছি কোমল শোকের স্পন্দন – করতলে
নানাস্থানে যাই, কারো সাথে পরিচিত হলে
বিব্রতবোধ করে মুঠোহাত এগিয়ে দেই,
হাত মেলানোর প্রথাপালন দুষ্কর হয়ে পড়ে,
ব্যক্তিগত শোকের খবর কেন সদ্যপরিচিতকে দিব?
দৌড়ুতে দৌড়ুতে বাসে উঠি, সাবধানে
আমার কলার মুঠো পাকড়ে টেনে তোলে
কনডাক্টরের শক্ত বলীয়ান হাত – সে’যাত্রা বেঁচে যাই
ভাগ্যিস মুঠো খুলে শোকাংশ বিলিয়ে দেই নি বাসের হাতলে
বাসায় ফিরলে জামা খুলতে কষ্ট হয়, এক হাতে কষ্টেসৃষ্টে
খুলে নিতে পারি শার্টঃ বহিরাঙ্গের ধুলো ও কয়লা,
ঘরের মানুষেরা কিছু বলে না, মেনে নেয়
মুঠো করা হাত দেখে কিছুটা মূক ও অপরিচিত বনে যায়
এভাবে শোকের পালন এ’জনপদে বিরল
অনেকেই আগ্রহী হন, কৌতূহলে বেড়ালের মত
গা ঘেঁষে আসেন। হে একান্ত শোক আমার!
অজান্তেই আমাকে বিখ্যাত করে তুলছো,
আমি কৃতজ্ঞ আমি নতজানু তোমার সাহচর্যে,
অনেকের কাছে আমি আরাধ্য হয়ে উঠছি
মাঝে মাঝে তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুঠোর ঘ্রাণ নেই
গা শিউরে ওঠে এই অতলান্ত শোকস্পর্শে
বুঝিবা আমার হাতটুকু ধীরে ধীরে অবাস্তব হয়ে গেছে
কিংবা শোকটুকু মিলিয়ে গেছে বাষ্প হয়ে -
অ নে ক আ গে ই
আমি ভুলেভালে মুঠো বন্ধ করে ভ্রমে বুঁদ
শিওর হতে পারি না, ডিলেমার কর্কট ক্রমশ
মুঠোগামী আমি ভয়ে তাড়িয়ে দেই তাকে,
“ভাগ্‌ শালা জোচ্চর কনফিউশন, ভাগ্‌ এবেলা!
জারিজুরি করে শোকে ভাগ বসাবি,
জানি তোর দুরভিসন্ধির অলিগলি!”
প্রায়ই ভাবি এ’দুঃসহ ভার ফেলে দিব আজই
মুঠো খুলে ধুয়ে নিব কলের শীতল জলে
হাত মেলে দেখব কোন শোকের ছায়াও নেই
মনে হবে পুরোটাই মনের মস্ত এক ভুল ছিল
মনে হবে পৃথিবীতে আমার কোন শোক ছিল না
তারপর মনে হবে হয়তো ছিল কিছু কোনও এক কালে
ভুলে গেছি সেইসব একান্ত ব্যক্তিগত শোক
খামাখাই কবরের মতো স্মৃতিচিহ্নের দরকার নেই বলে
এই হাতটি নতুন পেয়েছি বলে মনে হবে আমার
তারপর পুরনো আটপৌরে হাত, সেই বন্ধ করা মুঠো
ও শোকসন্তপ্ত করতলের শোকে আমি আবারও মুঠো বন্ধ করে ফেলবো…

সোমবার, ১৬ মে, ২০১১

অহেতুক যা কিছু


ক্লান্ত সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে শার্ট খুলে দেখি
পিঠে বড়ো বড়ো করে "বেকুব" লেখা
সারাদিন ঠারে ঠুরে চাপা হাসি আর হাহাহিহি
পিঠে ও মুখে আছড়ে পড়েছে নির্বিকার
শার্ট খুলতেই দু'কাঁধ ভেঙে এলো অশ্রু
ঘামে ভিজে পিঠের ওপর লেখাগুলো অক্ষয়
খুব চাপা স্বরে জ্বলজ্বল করছে!




প্রতিদিন একটু একটু করে ময়লা হই
ভিতরে ও বাইরে ময়লা জমে যায়
অবলীলায় অনায়াসে, দিনে রাতে
ময়লাগুলো অযথা অমায়িক অতিথি
রাত একটার পরে ভালো লাগতে থাকে
ময়লা ঘুমিয়ে পড়ে ভিতরে ও বাইরে।




তোমাকে চেনার চেষ্টা চলেছে চারদিন
চারদিন ঘড়ির কাঁটা স্থবির ছিলো, হরতালে
হরতালে জমাট হয়েছে তার সূক্ষ্ণ চাকা
চারদিনে ঘোলা জল স্থির হয়ে ক্রমশ
সুন্দরী স্বচ্ছ সৌম্য হয়ে উঠেছে
মিউজিয়ামের লোকেরা এসে হিসেব করছে
এই জলটুকু আগামিকালকেই প্রদর্শনী যাবে!
চারদিনে তুমি নাগরিক হয়ে গেছো, কর্দমের ফুল...

মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১১

ভোরের ভালোবাসা

ভোরের ব্যাপারটাই ডেঞ্জারাস। কেন বললাম?

যে প্রতিপক্ষকে দেখা যায়, জানা যায় যে সে আক্রমণ করবে, তার সম্বন্ধে সতর্ক হওয়া যায়। কিন্তু যে চুপিসারে আসে, নিঃশব্দে হরণ করে, তাকে কীভাবে ঠেকাবো? কোন উপায়ে সতর্ক হবো?

ভোরের সময়টা ও'রকম। ধীরে ধীরে চুপিসারে এসে উপস্থিত হয়। কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই। খালি কিছু পাখপাখালি জেগে ওঠে সমস্বরে। ওদের কিচির মিচির আমি শুনতে পাই না অনেক সময়, জানালা বন্ধ থাকলে। তবে আজ ভাগ্যক্রমে টের পেলাম। জানালার বাইরে বড়ো বড়ো গাছ। এখন নাম জানি না বলে আফসোস হচ্ছে। পাখিগুলো ডেকে দিলো, ডাক দিলো অমল সুরে। ঘুম ভেঙে জড়তা নিয়ে তাকিয়েছিলাম!

ভোর এসে বোকা বানিয়ে দিলো। কমলা কমলা ভোর। দুয়েকটা একলা একলা পাখি উড়ছে, ডানা ঝাপটানি কম। মনে হয় ওরাও সকাল সকাল উঠে খুব আড়মোড়া ভাঙছে। ডানা ঝাপটানোর ব্যস্ততা নেই। শহরও পাখির মতো। অস্থিরতার আগে কয়েক মুহূর্ত থমকে আছে। তারপর শেকলের মতো, হাঁপরের মতো যান্ত্রিক চলন শুরু হয়ে যাবে।

আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। এই সময়টা উপভোগ করতে ইচ্ছা করে। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে ঘ্রাণ পাই মৃদুমধুর। পাতার ঘ্রাণ। ফুলের ঘ্রাণ। কাল রাতে ছেড়ে রাখা শার্টটার ঘ্রাণ।

চোখ বন্ধ করতেই শব্দ পাই নানারকম। রিকশা নেমেছে বোধহয় একটা, টুং করে বাজিয়ে গেলো। টুইটুই করে উঠলো এখটা পাখি। ক্রোচক্রোচ শব্দ করছে আরেকজন। জানালার পর্দায়ও খসখসে সকালের শব্দ হচ্ছে। ভোর এসে গেলো।

দেখো, ...
আমাদের জীবন ঠিক এই মুহূর্তের পরে একদম অর্থহীন!







===============




কয়েকটা বেহুদা লাইনঃ
রাত চারটে বাজলে একসাথে সবগুলো ডিজিট বদলে যায়
দেখো তিন হয়ে ওঠে প্যাঁচানো চার,
সাপের মতো শরীর গড়ে ওঠে গোলগাল তিনের
আরো দেখো পাঁচ আর নয় পাশাপাশি ছিলো
সুখে দুখে স্বল্পকাল
এক ঝটকায় উবে গেলো তারা শূন্যে মিলায়ে গেলো শরীর
দুটো শূন্য চলে এলো ধপ্‌ করে
দৃশ্যগুলোই তো বদলে গেলো একেবারে!

সোমবার, ২ মে, ২০১১

দু'ফোঁটা জীবন

===================================



শোরগোলের বিকেলে
মন্থরার গলা শুনি কালো রাস্তায়
বাছাইকৃত সুতীক্ষ্ণ হর্ন
বেজে গেল সস্তায়,
দুমড়ে গেল মূক পাখির ডানা


দ্রুত-ছোটা দৃশ্যের
শকট থামিয়ে
পাখিটাকে তুলে নেই
তখনও তার স্পন্দন
টের পাই হাতের তালুতে


বিকেলের রোদ থেকে
দু'ফোঁটা জীবন,
আমি তাকে দেবো ভেবে
দৃশ্যের পর দৃশ্য
অবলীলায় চুরি করি


দৃশ্যের ভেতর বিকেল বিকেলের ভেতর ঘোলা সূর্য ঘুমিয়ে...