বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১১

ডুইবা গেলে মিইশা যাবো, ভাঙ্গা ঝিনুকের দেশে...

এক
একটা গল্প লিখছি। সম্প্রতি ছোটগল্প লেখার ও লেখা নিয়ে নিরীক্ষা করার একটা ভাল পেইজ দেখেছি, যেখানে ধাপে ধাপে গল্প তৈরি করার শর্টকাট এবং ডিটেইল দুই রকমের নিয়মকানুন দেয়া ছিল। একদম সিদ্দিকা কবীরের রেসিপি যেন! মালমশলা জোগাড় করে নিয়মমাফিক মাখালেই গল্প তৈরি, যা পাঠক-আকর্ষী, নিরীক্ষামূলক ও অভিনবও হতে পারে। সেই নিয়ম দেখে আগ্রহ হলো - লিখতে বসলাম, এবং যথারীতি এক পর্যায়ে ধরা খেলাম। গল্পের বিস্তৃতি ও কাঠামো এতোটাই ব্যাপক যে আমার ক্ষুদ্র আঙুলে সেটার জায়গা হলো না। যতোই আঁকড়ে ধরতে যাই, বালুতটের মুঠোভর্তি বালুর মত আঙুলের ফাঁক দিয়ে গ'লে পড়ে যায়। আর মুঠোর ভিতরে জমে থাকে ছাই ছাই ধুলো। তাই আপাতত ক্ষান্ত দিয়ে বসে আছি। বুঝতে পারছি যে গল্প লেখার গল্প মূলত নিজেই আলাদা গল্প হয়ে ওঠে।

দুই
নিরন্তর বর্ষণ। আমি উচু এলাকায় থাকি বলে পানি জমে রাস্তাগুলো নদী হয়ে যায় নি। তবে কাছাকাছি এলাকায় ডিভাইডারে ভাগ করা নদী জন্মে গেছে। নদীতে নৌকাস্বরূপ বাস চলছে। প্রচুর ট্যাক্সি ও গাড়ি ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বিকল হয়ে নদীতে ভাসছে। আর মানুষজন নদী ডিঙিয়ে ভিজে ভিজে যাতায়াত করছে। দেখতে ভিন্ন আর অসুন্দর লাগছে। আমরা একটা কর্মফলের শহরে বাস করছি। গত চল্লিশ বছরের অনাচারের কর্মফল ফেটে ফেটে যাচ্ছে ফুলের মতো। পরাগরেণুর মতো আমাদের পূর্বপুরুষের অবিমৃশ্যতার পাপ দেখতে পাচ্ছি রাস্তায় ও আইল্যান্ডে, পার্ক ও শপিং মল জুড়ে। দরজির কাছে কিছু কাপড় দেয়া ছিল। ফোন করে জানা গেল, 'কাজ হয়ে গেছে - এসে নিয়ে যেতে পারেন'। উত্তরে বলা হলো, 'নদীতে ভাসায় দেন, ভেসে ভেসে ঠিক এই ভাটিতে আমার বাসায় চলে আসবে। আমি জাল ফেলে কুড়িয়ে নিবো'।

তিন
ম্যালথাস বাংলাদেশে জন্মালে কিশোর বয়সেই তত্ত্বটি দিয়ে দিতেন। মানুষ এত বেড়ে গেছে যে অচিরেই নিজে নিজে মারবে, একে অপরকে মারবে। আমিও একমত সহমত অ-অমত। আদমশুমারিতে জনসংখ্যা এসেছে চৌদ্দ কোটি। প্রকৃতি বললেন, 'রসো বেটা, কেটেছেঁটে চৌদ্দই সই!' এই দেখুন ৪১ টি সদ্যকিশোর মারা গেল। এরা বেঁচে থাকলে বিয়ের করতো আরো ৪১ জনকে, ৪১ দু'গুনে ৮২ সন্তানের জন্ম দিতো। জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ ঠেকাতে ট্রাকখানা ধ্বংস হলো। ভালই হয়েছে! না রহিবে বাঁশি, না বাজিবে বাজনা। এই যে সেদিন মিলনকে পিটিয়ে মেরে ফেললো, এটাও ওই ক্ষমাহীন অ্যাক্ট অফ নেচার। স্বতস্ফূর্তভাবে আমরা একে অপরকে মেরে ফেলবো। সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট। কেউ বলে নি এটা সারভাইভাল অফ দ্যা গুড, কিংবা রাইট, কিংবা জাস্ট। ফিট হতে হবে, নইলে পগারপার। পরকালে গিয়ে সারভাইভ করো। আর পরকাল না আসা পর্যন্ত মাটির নিচে কবরে।

চার
কেউ মরে গেলে আমরা যে সামাজিক নিয়ম মেনে তার সৎকার করি। ভেবে দেখলাম, মৃতের কাছে এর কানাকড়িও মূল্য নেই। যে মরে গেছে, যে চলে গেছে, তার তো জানার কোন উপায় নেই যে তার মৃত্যুর পরে কোথায় কী হচ্ছে! এগুলো তাকে আর বিন্দুমাত্র নাড়া দিচ্ছে না। কে কী বললো তাকে নিয়ে তাতেও তার কিছু আসে যায় না। তবে আমাদের আসে যায়, আমরা যারা বেঁচে থাকি। আমরা যারা মৃতের স্মৃতি বহন করি। আমাদের কষ্ট হয়, একক কষ্ট, গোষ্ঠীবদ্ধ কষ্ট, মিলিত কষ্ট...। এই কষ্ট প্রশমনের জন্যেই যতো আয়োজন। মৃত্যুকবলিত ভাঙা মন নিয়েও আচার পালন করো। প্রথা মেনে শোক প্রদর্শন করো। দেহ পুড়াও, মাটি দাও কিংবা দান করে দাও। উইল ভাঙো, দেখো কে কী পেয়েছে, কাকে কতো দিয়েছে। এই সব রীতিনীতির মাঝে দুয়েকটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আর অসহনীয়তার নির্বাক শব্দ হারিয়ে যায়।

পাঁচ

ছয়
পাঁচ নম্বরটা খালি থাক। এই ঘনবসতি আর জঞ্জালের মধ্যে মনে কিছু জায়গা খালি রাখি। সময় পেলে, সেখানে খুব আপন কিছু রাখা যাবে 'খন!

সাত
রোজার মাস। শরীরে ক্ষুধা বয়ে চলাটুকুই সবচেয়ে সোজা কাজ। বিস্ময়ে দেখি যে সোজা কাজটাই খালি আমরা পারি। বাকি সকল উপদেশ, নিষেধ আর নিয়মকে তুড়ি বাজিয়ে যথেচ্ছাচার, অপচয় আর নোংরামো করে চলেছি। ভাল লাগে ভণ্ডামোর চূড়ান্ত রূপটি। প্রায়ই ভাবি, যে এর চেয়ে বেশি ভণ্ড হওয়া সম্ভব না। তারপর নতুন কোন ভণ্ডামোর উদাহরণ দেখি আর বলিহারি যাই! আমার কাছে মনে হয় এই উপোস* থাকার রিচুয়ালটি বেশ ট্রিকি। ক্ষিধে পেটে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে। অথচ মেজাজটাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে শরীরে আরাম চাই, যা কিনা ক্ষিধে না মিটলে আসছে না। চৌদ্দঘন্টার বেশি সময় গরমে, ঘামতে ঘামতে রোজা রাখুন। পানিশূন্যতার কারণে শরীরে গোলযোগ। রক্তে সুগার কমে যাওয়ায় ব্রেইন ফাংশন কমে আসা। সেদিন এক ছাত্র পরীক্ষার মাঝে বলছে, 'মাথা কাজ করছে না। সব পড়েই এসেছিলাম কিন্তু এখন অর্ধেক মনে পড়ছে'। রাস্তায় জ্যামে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সবাই। তীব্র হর্ন বাজছে। হর্নগুলোকে কেউ রোজা রাখায় না কেন?

আট
দেখতে দেখতে এই বছরের অষ্টম মাসে চলে এসেছে। মাসের প্রথম সপ্তাহের রবিবার বন্ধুদিবস ছিল। সূর্যের হিসাবে দিন হয় বলে বাংলাদেশে বসে এই দিনটি শুরু হলো ছয় ঘন্টা আগেই, তারপর চললো সোমবার দুপুর অবধি! প্রায় দেড় দিনের বেশি সময় ধরে বন্ধুদের শুভেচ্ছা দিতে, নিতে, পেতে দেখলাম। দূরে থাকা বন্ধুদের জন্যে কান্নাকাটি করতে দেখলাম। এই সুযোগে বাবা-মা-ভাই-বোন-প্রেমিক-প্রেমিকা-স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি সম্পর্কিত মানুষদেরকেও বন্ধু বানিয়ে দিবসে জুড়ে নিলো কেউ কেউ। পরের দিন এক বন্ধুকে অনলাইনে টোকা দিয়েছি, কিছুটা কাজের দরকারে আর কিছুটা আলাপ সারতে। সে অনুযোগ করলো, 'গতকাল একবারও আমার খোঁজ নিলি না, উইশও করলি না। তুই আমারে আর বন্ধু ভাবিস না!' জবাবে বললাম, 'নালায়েক, বন্ধু দিবসে হিসাব করে তোকে কার্ড পাঠাবো আর উইশ করবো কেন? তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব সোয়া এগার বছর। কবে এইসব উইশ-ফুইশের ধার ধেরেছি?' জবাবে নালায়েক কিছু বলে নি।

নয়
কিছু সম্পর্কের সাথে প্রকৃতির নিয়ম মেনেই বিযুক্তি এসে গেছে। এটা বোধহয় নিয়তি। too good to be true এর মতো প্রপঞ্চ এইসব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্যেই বানানো হয়েছে। এমন নয় যে আমি সেই সম্পর্কগুলোকে মিস করছি, বা তাদের সাথে বিযুক্তিতে আমার কোন হা-পিত্যেশ আছে। তবে কি না, মানুষের মন, তাই মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। তখন আমি দীর্ঘ ঘুম কামনা করি। ভাবি, একদিন রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের মতো ঘুমিয়ে পড়বো কোন ঘাসে ছাওয়া পাহাড়ের পাদদেশে। তারপর বিশ বছর কেটে যাবে। ঘুম ভেঙে দেখবো আমার চেনাপরিচিত কেউ নেই। আমি সম্পূর্ণ একা, এবং বন্ধুবিহীন, এবং আত্মীয়বিহীন, এবং প্রচণ্ড প্রচণ্ড স্মৃতিকাতর!

দশ
ছোটবেলায় একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটু মারাত্মকভাবে কেটে গেল। অনেকখানি জায়গা, মালাইচাকির জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে একাকার। ক্ষতগুলো বেশ গভীর, প্রায় তিন-চার মিলিমিটার পর্যন্ত। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার পরে সেখানে গজ-তুলো কীটনাশকে ভিজিয়ে চেপে ধরা হলো। রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, তাই কাটা গর্তের মধ্যে নুড়ি, ধুলো ঢুকে গেছে। পরিষ্কার না করে উপায় নেই, কিন্তু যে যন্ত্রণা সেটা সহ্য করাও কঠিন। আমাকে আবার ততোদিনে শেখানো হয়েছে যে কান্নাকাটি করা ঠিক না। কষ্ট সইতে হবে দাঁতে দাঁত চেপে। আমি আরো এক ডিগ্রি বেড়ে ক্ষতের দিকে চেয়ে থাকলাম। দেখি কেমন করে পরিষ্কার করে! লাল লাল রক্তভেজা গজ-তুলো সরিয়ে নিলে ভিতরের মাংশ দেখে কেমন অদ্ভুত লাগলো। আমার ভিতরটা এমন? এ যে বড়ো বিস্ময়কর! এই রক্ত-মাংশের ভিতর আমি কই? লাল লাল রক্ত আর দপদপ করতে থাকা যন্ত্রণার মাঝে পড়ে থেকে ওই অস্তিত্বের আকুতি আজকালও আমাকে জ্বালায়। অনেক সময় দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার মুহূর্তে অমন ছাল-ছাড়ানো অনুভূতি হয়। যেন কেউ আমার মাংশ উদোম করে দিয়েছে! বাতাস আর ধুলোবালি এসে ঝাপ্টা দিচ্ছে। আর আমি দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিচ্ছি...


শূন্য পাঁচ
... শূন্যতার ঘরে শুধুই তুমি... সেখানে আর কোন কথা...সুর...গান স্থান পায় না!...
*উপোস = রোজার গড়পড়তা সামাজিক রূপ, যেখানে একান্ত ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আচরণ ক্রমশ সামাজিক উন্মাদনা ও ধরপাকড়, কিংবা জোর-জবরদস্তিতে পর্যবসিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন