সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

টেবিলিক

ভাঁজ করা কাগজের ভেতরে একটা বিয়ের নেমন্তন্ন লুকিয়ে আছে, চারভাঁজি কাগজে ভাঁজে ভাঁজে বর, কনে, ও তাদের পিতামাতাগণ গা মিশিয়ে শুয়ে আছেন চিড়েচ্যাপ্টা। তাদের পাশেই, কাগজের গায়ে জমছে ধুলো, গত বছরের নেমন্তন্নের চিঠিটা ফেলা হয়নি! একটু দূরে রঙহীন তরল বিষ নিয়ে অ্যারোসলের ধাতবে ঢুকে যাচ্ছি আমি। বিন্দু বিন্দু বিষ, বাতাসে! ঝুম ঝুম ঝুমকার মত ঝুলছে, বাজছে। মুখোমুখি পড়ে আছে রুপালি ঘড়ির শরীর, জড়াজড়ি করছে তার সাথে আমার চাবির গোছা। গোছায় চারটা চাবি- পুরনো হতে হতে কালচে কালচে রঙ তাদের… একটা তোমার চাবি, তোমার ভেতরের গলিঘুপচিতে যাতে না হারাই সেই সংকেত লেখা আছে মোহন রূপেই। আরেকটা চাবিতে খোলে কালোগহ্বর যতো, আমাদের শরীরের মাঝে।


দূরে দেখি মোলায়েম মানিব্যাগখানা পেটমোটা হয়েছে অনেক! পেটের ভেতরে তোমাদের খসখসে ঠিকানাসকল। খাজাঞ্চিখানার নোটগুলোও চকচকে আজকাল, ইদানিং আমি শক্ত একটা কার্ড ঢুকিয়ে দেই তার পেটের ভেতরে আর কড়কড়ে নোটগুলো বেরিয়ে আসে। আজব যন্ত্র এক- শরীরে ধারণ করছে অর্থবিষ, শুনেছি মুদ্রাও তরলিত ক্রমশ!…
আরো আছে মুখ উঁচিয়ে থাকা গোলমুখো ওয়েবক্যাম-জালচোখ! গোলাপি মন্থর আলো জ্বেলে আমাকে দেখছে নিনির্মেখ। আমিও তাকে দেখি, রূপসী গোল চোখের মাঝে তার কোনো তাড়না নেই। ঘোর আছে, নিস্পৃহ ক্লান্তিহীন ঘোরে ফেলা চোখ তার তোমার চোখের চেয়ে অল্প একটু অসুন্দর…


ঝনঝনিয়ে বাজছে সেলফোন, কোষে কোষে তীব্র শিহরণ উঠে গেছে দুদ্দাড় তোড়ে জেগে উঠছে চরাচর। আমি ভাঙছি বাতাস ও নিদ্রার জোট। আলো! ওহ! আহ! চুরমার!

শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৯

টু-ডু লিস্ট অফ টু-ডে

আমার ঘরে খুব বেশি জিনিশ নাই। একটা খাট, খাটের পাশে টেবিল। টেবিলের পাশ দিয়ে চেস্ট অফ ড্রয়ার, তার পাশে দরজা। অন্যদিকে খাটের পাশে জানালা, জানালার পাশে কম্পিউটার, তার পাশে বইয়ের শোকেস। এই।


আমি মাঝে মাঝেই একঘেঁয়ে হয়ে গেলে ঘরের এই লে-আউটটা বদলে ফেলি। এর সাথে আর কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ নেই। আমার হয়তো সবাইকে একটা উল্‌টে পাল্‌টে দিতে ইচ্ছা করে, হয়তো এজন্যেই আমি এভাবে মাঝে মাঝে নিজের ঘর বদলে ফেলি। এবারে আলসেমি লাগছিলো (আমার মতোন অলসেরও আবার আলসেমি লাগে!), তাই আমি কেবল খাট আর কম্পিউটারের মাঝের চেয়ারটা হঠিয়ে দিলাম। তারপরে তার ও মাল্টিপ্লাগসমেৎ পুরো কম্পুবাবাকে টেনে খাটের পাশে নিয়ে এলাম। এখন শয্যা থেকেই অন্তর্জাল! সুতরাং আমার অনেক সুবিধা হলো। অলসতা একটা ভয়ানক আগ্রাসী রোগ।


মশা বেড়ে গেছে আজকাল। আর ক্ষুধার্তের প্রতি আমার করুণাবশত আমিও কিছু বলি না। মশাগুলো রক্ত খেয়ে খেয়ে ভোম হয়ে ওঠে। তারপরে আমি আঙুলে চেপে ধরলেই তার নধর দেহখানা চটকে যায়। আঙুলে আমার রক্তের কিছুটা অংশ লেগে যায়। মাঝে মাঝে আমি নাকের কাছে ধরে গন্ধ নেই। ধাতব ধাতব ঘ্রাণ আসে রক্তের, লৌহকণা আছে নিশ্চয়ই অনেক? আমার গা ঝিম ঝিম করে।


মনমরণের ইতিবৃত্ত পড়ে একজন বললেন আমার লেখায় অনেক ক্লেদ চলে আসছে প্রকাশিত হয়ে। এখন আর সেগুলো উপমা আর রূপকে ঢাকা নেই, বিবিক্ত হয়ে পড়ছে। তার কাছে অবশ্য সেই প্রকাশ দুর্দান্ত লেগেছে। কিন্তু আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম যে এই বদলটুকু ভালো হলো না খারাপ হলো সেটা নিয়ে। নতুনতর হয়েছে মনে করে স্বস্তিলাভের সময় নাই এখন আর, নিজেকে ভাঙতে হবে, টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে। তারপরে ভেঙে দেখতে হবে নতুন নতুন কোনোকিছু তৈরি করা যায় কী না! এমন না হলে আসলেই লেখালেখির কোনো আদত-উদ্দেশ্য হয় না। নিজের তৃপ্তির জায়গাটার বদল না ঘটালে লেখা বৈচিত্র্য পাবে না। আর কূপে আটকে গেলেই বিপদ। সুতরাং আমি প্রকাশিত ক্লেদ ও অনুক্ত উপমা নিয়ে এখন চিন্তিত।


মাথার চারপাশে দুয়েকটা পিনপিনে মশা ঘুরছেন। তারা অনেক জ্ঞানী ও কবির চাইতেও মহৎ। তাদের জন্যে অসীম শ্রদ্ধা!




***
- ১৯.১২.৯

মন মরণের ইতিবৃত্ত

মন মরে যাবার প্রক্রিয়ার সাথে আমি তেমন পরিচিত ছিলাম না।
বিজ্ঞপ্তি ও বিবৃতিতে মানুষের বিদেহী আত্মার কথা শুনেছি কেবল
জেনেছি, কেউ কেউ মরে গেলে দেহ বিয়োজন ঘটে,
আর কোনো কোনো লাশের খবর থাকে না।
ঈর্ষা করেছি যারা আত্মা হয়ে গেছেন, চল্লিশ দিন
ঘুরে বেড়িয়েছেন ভরহীন অশরীরে।


দুঃখ-শোক-সন্তাপ-বিদুরিত-প্রাণে-অপ্রাণে
আর অনেক অনেক বছর পরে, বিদেহীদের পরিচয়
আমার কাছে আটপৌরে হয়ে গেলে, জানতে পেরেছিঃ
দুয়েকজন সৌভাগ্যবানের মন মারা যায়।


মৃত মনের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি নিয়ে তারা বিব্রত হন।
মরা মাছের চোখের মত ফ্যাকাশে বা
আঁইশের মত জ্বলজ্বলে হয়ে তাঁরা
মানসিক পার্লারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন।


এই নগরে এখন মনমরণের খেলা, সারি সারি শবাধারে শূন্যতা আর তার ভেতরে বিশ্রী বিশ্রী পুড়ে যাওয়া মন রাখা আছে। হে নাগরিক, তোমরা তোমাদের সেলফোনগুলো চার্জ দাও, সেখানে অবিশ্রাম তোপধ্বনি হবে আজকের ডে-লাইট-সেইভ্‌ড সূর্য ওঠার পর!
***

সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০০৯

দ্য ওয়েল ট্যাম্পার্ড ক্ল্যাভিয়ের

আমাদের চারপাশের মানুষগুলো কেমন? 

আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমি আজকে এখন পৃথিবীতে না থাকলে কেমন হতো? একেবারে সাধারণ ভাবনায়, শুরুতেই ধরে নেয়া যায় যে এই লেখাটা লেখা হতো না। আমি জানি আমার ভেতরে যে কথাগুলো জন্ম নিচ্ছে সেগুলো আর কেউ কোনোদিন বলে গেছে; তবে আমার মতো করে বলে নি। আর আমার মতো জীবন ঠিক আমার মতো করেও কেউ কাটায় নি। আমি যাদের সাথে মিশে মিশে, যাদের ভালোবেসে এতোটা পথ পেরুলাম তারা আমার সাথেই কেবল তেমনভাবে মিশেছে। “আর কেউ আমার জায়গা নিতে পারবে না”- পদার্থবিজ্ঞানে এই মত জানা আছে আমার। তবে কিনা, পৃথিবী ও মানুষ, তার আবেগ ও ভাবনা সবসময়ে বিজ্ঞানের কথা শোনে না। বড়ো খারাপ ও দুর্বিষহ আচরণ করে তারা অনেকেই। তাই বিজ্ঞান জানিয়ে রাখলেও আমার সন্দেহ হয়, হয়তো আমি না থাকলেও কেউ না কেউ আমার জায়গা নিয়ে নিতো!

এই ভয় থেকেই আমি হয়তো নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা করি। ভয় তো খুব তীব্র মোটিভেটর, তাই না? আমি তাই উর্ধ্বশ্বাসে পালাই আমার হারিয়ে যাবার ভয় থেকে। আমার বিলুপ্তির খাদের কিনার থেকে আমি উলটো দৌড় দিই। আমার ফুসফুসে তেমন জোর নেই বলে সেই দৌড়ের পথে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি বটে। তারপরে হাঁপাতে হাঁপাতেই আমি চেষ্টা করি। নিজের প্রতি কেন এতো প্রেম হায়! নার্সিসাসের জীন, বহন করছি রন্ধ্রে রন্ধ্রে! চারপাশের মানুষগুলো খুব করে আশা করছে, আমি তাদের দিকে তাকাবো, মুখে হাসি হেসে সকল ছল মুছে আমি তাদের কাছে আসবো। কিন্তু আমি কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবছি!

আর আমিও তাদের মতো সাধারণ। তাই আমিও চাই সকলে আমাকে খুব খুব গুরুত্ব দিক, খুব মেনে নিক আমার সকল কথা। আমাকে ভক্তি করুক, আমার কথা আর চৌকস কৃতিত্বে তারা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে এক একটা জ্বলন্ত কাঠ হয়ে যাক। আমি তাহলে এমনই নিষ্ঠুর নাকি! হয়তো তারাও এমনই নিঠুর, আমার মতোই?

আজকে খুব বাখ শুনছি। দ্য ওয়েল টেম্পার্ড ক্ল্যাভিয়ের। পিয়ানোর সুরটা খুব সাধারণ, এলিমেন্টারি। কিন্তু ওই যে বলে না, সহজ কথাই প্রাণে বাজে সবচেয়ে জোরে! রেকর্ডিঙ্গটা খুব ভালো, মনে হয় কেউ কানের কাছে প্রাণের পাশে বসেই বাজাচ্ছে। আলতো আলতো আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে সুর বের হয়ে আসছে। আমি বাকি সব স্তব্ধতার মাঝেও টের পাচ্ছি হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি। শীতে চারিদিক নিঃস্তব্ধ। আমি, বাখের ক্ল্যাভিয়ের, আমার হৃদয়ের স্পন্দন। আর কেউ নেই, কোথাও নেই!

ধুর, চোখে কেনো অযথাই পানি আসে?


***

বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৯

ক্র্যাশ রিপোর্ট

আমার নতুন কম্পিউটারে এরই মধ্যে নানা অদ্ভুতুড়ে আর ভূতুড়ে অসুখ দেখা দিয়েছে। কেনার পরে প্রথমে দুইটা অপারেটিং সিস্টেম বসালাম, এক্সপি, যেহেতু আমি এক্সপি-কে ভালোবাসি; আর উইন্ডোজ৭, কারণ সে তন্বী তরুণীর দেহবল্লরি নিয়ে হাজির হলো। পাইরেসিকে জিন্দাবাদ বলতে আমার কোনই আপত্তি নাই, হীনমন্যতাও নাই; তাই দুইটা ড্রাইভে এক্সপি ও ‘৭’ জায়গা করে নিলো। আমি দুইখানেই যাই, ঘুরি ফিরি ভালো লাগে।


প্রথম সমস্যা শুরু হলো যেদিন থেকে লাইভ মেসেঞ্জারে কয়েকদিন ধরে ঝুলে থাকা নোটিফিকেশনের কারণে আমাকে লগইন করতেই দিলো না! বললো নতুন একটা লাইভ মেসেঞ্জার এসেছে, সেটা নামাও, নামিয়ে ব্যবহার করো। আমি সুবোধ বালকের মতন নামাতে গেলে বলে “তোমার সনাক্ত করার মতো কোন ইন্টারনেট কানেকশন নাই”। চোখ কপালে ওঠার আগেই চেক করে দেখলাম, সুন্দর ১৬কেবিপিএস গতিতে টরেন্ট নামছে! ভূতুড়ে কাণ্ডের এই হলো শুরু! এর পরে লাইভের দেখাদেখি ইয়াহু মশায়েরও মাথা খারাপ হয়ে গেলো। ফলাফল অগত্যা আমার গুগল-টক। আঙুর টক কেমন ও কত প্রকার বুঝলাম! লাইভ বন্ধ হওয়াতে আমার ওয়ান্ডারওয়াল দেখা হয় না! হলিউডি সেলিব্রেটিদের উদ্ভটতাও একটা মিস করার মতো ব্যাপার! শেষে পুরানো প্রেমিকা এক্সপি ছেড়ে ভাবলাম ‘সাত’এর কাছে যাই, পাত্তা পেতেও পারি। সাত- একটু হালফ্যাশন মানেন বলে বাংলা ফন্ট দেখতে খারাপ আসে। কত চেষ্টা করলাম বৃন্দার পাছায় লাথি মারার, ওটা ঘুরে ফিরে চলে আসে! সিয়াম রূপালি আর সোলাইমানলিপি’র মতোন অপরূপ ফন্ট থাকতে কেনো এইটা উইন্ডোজের ডিফল্ট ফন্ট হলো সেই রহস্য আজও বুঝলাম না! তবু দেখলাম এখানে সেটা সহ্য করেও লাইভ আর ইয়াহু দুইটাতেই যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু লাইভে ঢুকে আবারও তাজ্জব হলাম, এমএসএন টুডের ট্যাবটা নাই! আজব কারিগর আমার! তাও কিছুদিন চালানো গেলো সাতে’র অপরূপতা নিয়ে। কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি কথা আর কতদিনই বা ভালো লাগে! তাই ভাবলাম এক্সপি আরেকবার নিয়ে দেখি!


সিডি কিনতে গেলাম যেটা কিনে আনলাম, বলে NLTDR File Missing. Press ALT+CTRL+DLT to reboot!
বুঝলাম উইন্ডোজের সিডিতেও আজকাল ভুয়ামি শুরু হয়েছে। সেটআপ লোড করার প্রথম ফাইলটাই নাই!! তারপরে কচুক্ষেত মার্কেটের অগতির গতি ‘বিজনেস জোন’ নামের দোকান থেকে আরেকটা সিডি কিনলাম। খুব দোয়া পড়তে পড়তে সেটআপ দিয়ে দেখি এইটা পাইরেটেড জেনুইন কপি!!! অর্থাৎ কেউ একজন কিনেছিলেন, কিনে সেইটা জেনুইন করেছেন, নিজে নিজে ভিস্তার নানা আইকন আর থিম বসিয়েছেন, তারপরে কপি করে করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন! কে বলে বাঙালির মেধা নাই, কে বলে আমরা কিছু পারি না? এত নিপুণ ও সুচারী শৈল্পিক চৌর্যবৃত্তি আর কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। আমি তারপরে বসে বসে চুরির আলামত, অর্থাৎ সব থিম ও আইকনগুলো ডিলিট করলাম।


তবে এতোকিছুর পরেও ভবী ভুলবার নয়। এখনো লাইভ, যার জন্যে এত ঝামেলার শুরু, তিনি মুখ ফেরাননি। ভাইরাসের যন্ত্রণায় প্রায় দুইঘন্টা ধরে এভিজি ডাউনলোড করলাম। বেটা মশগুল-চোর, মিডিয়া প্লেয়ার নিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে রাখায় উইনয়্যাম্প চালাতে হচ্ছে। লাইভকে আমার কম্পিউটারে না আনতে পারলে মরেও শান্তি নাই!
যে একাগ্রতায় আমি এই কম্পিউটার নিয়ে বসে আছি সেইটা অন্য কারো জন্যে দিলে সে নির্ঘাৎ আমার ভক্ত হয়ে উঠতো। আসলেই যন্ত্রের মন নাই!

বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০০৯

শব্দ পরিচয়

আমি অনেকদিন ধরেই কিছু লিখতে পারছি না। লিখতে না পারার যন্ত্রণা বা অসহায়ত্বের সাথে আমার অনেকদিনের সখ্য। এমন অনেকদিন হয়েছে, আমি দিনের পর দিন লিখতে পারি নি। আমার চারপাশে যারা লেখেন, তারা খুব চমৎকার লেখা পাতার পর পাতা লিখে ফেলেছেন। আমার তেমন কিছু মনে হয় নি। অন্যের লেখা পড়েও আমি টের পেয়েছি আমার ভেতরে কোনো শব্দ নেই। কোন সুর নেই। তাই আমি চুপচাপ হয়ে গেছি। আরো কিছুদিন পরে একটা সময়ে অনেক অনেক কথা ঘুম ভেঙে আমার মাথায় চলে এসেছে। তখন আমি আবার লিখতে শুরু করেছি। লিখতে লিখতে আমি ভুলে গেছি যে মাঝে কিছুদিন আমি শব্দহীন হয়ে কাটিয়েছিলাম! এমন সময় আসলে তাই আমি এখন একেবারেই বিচলিত হই না। ভাবি, যে কিছুদিন পরেই এই সময়টা কেটে যাবে। কেটে গেলে আমি কী কী লিখবো সেটা নিয়েও অনেক সময়ে আমি চিন্তা করেছি। কিন্তু এবারে কেনো জানি সেই চিন্তাগুলোও হচ্ছে না! আমি টের পাচ্ছি আমার ভেতরে কোনো শব্দ আসছে না। শব্দহীন হয়ে গেলে আমার কানের ওপর কেমন যেনো একটা চাপ পড়ে। মনে হয় একগাদা তুলো দিয়ে কেউ আমার কানে ধুম ধুম হাতুড়ি পেটা করছে।


শীত এলেও আমার এই অনুভব শুরু হয়। মনে হতে থাকে যে মাথায় ড্রামের বাড়ি পড়ছে। বড়ো একটা বিগ-ড্রাম নিয়ে রিজওয়ান যেভাবে তালে তালে বাড়ি দিতো, সেভাবে কেউ একজন বাড়ি দিচ্ছে। আমি রিজওয়ানের পাশেই বাঁশি নিয়ে দাঁড়াতাম বলে টের পেতাম ড্রামের সেই বাড়িগুলো কেমন করে বুকে এসে লাগে। শব্দের শক্তি নিয়ে আমার সকল সংশয় কেটে যেতো! রিজওয়ান এখন ফাইটার প্লেন চালায়। শাঁশাঁ করে ও যখন ছুটে বেড়ায় ‘বাংলার আকাশ রাখিবো মুক্ত’ শ্লোগান নিয়ে, আমার তখন খুব হিংসা হয়। ছেলেটা সারাজীবন শক্তিশালী শব্দ তৈরি করেই গেলো! আমি তেমন পারি না। আমার তৈরি করা শব্দেরা মৃদুমন্দ, লাজুক ও বিনম্র। খুব বেশি চিৎকার করলেও, হা হা করে অট্টহাসি দিলেও, আমি লিখতে গেলে খুব সোচ্চার হতে পারি না। আমার মনে হতে থাকে খুব জোরে বললে হয়তো কথাটার জোর কমে যাবে। হয়তো আমি যা বললাম, তুমি বা তোমরা সেটা বুঝবে না। ধরতেই পারবে না আমি কী অসম-সম্ভব তুলনা বুনছিলাম, রূপকের কত নিখুঁত রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম! খুব জোরে বললে সেটা ঝাপসা হয়ে যায়।


এই শীত আর লেখাহীনতা তাই আমাকে অনেক কাবু করে ফেলছে। বুড়ো দাদুর মত আমি বেঁকে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। এগুলো অর্থহীন বিলাসিতা, আমি জানি। আমার অস্তিত্বের টিঁকে থাকার জন্যে একেবারেই বাতুল-চিন্তা। তাই কাউকে হয়তো বলা হয় না। খুব প্রিয় মানুষটাকেও বলা হয় না। আসলে বলার তেমন কিছু নেইও। এমন না যে বলার সাথে সাথে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বা কারো সাথে এটা আলোচনা করলে, শেয়ার করলে একটা সুরাহা বের হবে। এই সমস্যা এতই বালখিল্য যে এটার গুরুত্ব কেবল আমার নিজের কাছেই। নিজে নিজে বুঝে গেছি, হয়তো একদিন এমনি এমনিই ঠিক হবে, তবে কীভাবে আর কবে হবে এটা আমার জানা নেই। জানা নেই বলেই আমি অপেক্ষা করি। কারো আগমন নিশ্চিত জেনে যে রকম অপেক্ষা করা দরকার, ঠিক তেমন। কান সতর্ক, ইন্দ্রিয় সজাগ করে হিম হিম শীত আর চাপ চাপ নৈঃশব্দ্য পাশে বসিয়ে আমি অপেক্ষা করি। আমি খুব ভালো করেই জানি আমার এই অপেক্ষা খুব শিগগিরই শেষ হবে। তারপরে নানান শব্দ আর সুর, রঙ আর রূপ আমার কাছে চলে আসবে। আমি আবার লিখতে শুরু করবো। প্রতিবার এমন বিরতির পরে আমার লেখা বদলে বদলে যায়। এবারেও যাবে আর আর সেই বদলে যাওয়া লেখাগুলো আমার ভালো লাগবে!


প্রিয় শব্দেরা, তোমরা সশব্দে এসো আমার ঘরে!

মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

ফ্ল্যাশ ব্যাক

আজকে কেমন ঝটিতি দিন কাটছে!


মনে করেছিলাম আজকে সকাল সকাল উঠে ইউনি যাবো। ইউনিতে অনেক টুকরো টুকরো কাজ জমে আছে। বেশ কিছু খাতা দেখা বাকি, ঈদের আগে মিড নিয়েছিলাম। কয়েকটা নতুন লেকচারও বানাতে হবে। গত কয়েদিন ঠিক বারোটার আগে পরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বলে সকাল সকাল উঠে কনফিডেন্স বেড়ে গিয়েছিলো! কিন্তু আজকে আবার পুরানো রোগে পেলো  আমায়। ঘুম আর ঘুম। ঘুম কেটে দিতে দুয়েকবার ফোন বেজে উঠেছিলো ডেক্সটারের থিম-এ। আফরীনের ফোন। আমি নাকি ধরেওছিলাম, ঘুমের মধ্যে ফোন ধরলে, কথা বললে আমার মনেই থাকে না! তারপরে সুবোধ বালকের মতো আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছি কখন। শেষে আবার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ফোন আর আমিও ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠলাম। ঘুমের মধ্যেও তাহলে দেহঘড়ি চালু থাকে? ঠিকই টের পাওয়া যায় যে অনেক দেরি হয়ে গেছে! আজব কারখানা আর তার মহা-আজব ব্যাপার-স্যাপার।


ঘুম থেকে ঝট করে উঠেই দৌড়াদৌড়ি লেগে গেলো। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমি ফিটফাট, বাবু। বাসা থেকে বের হয়ে তাজ্জব হয়ে গেলাম। কুয়াশা কুয়াশা রোদ!! রোদ কেমন ফিল্টার হয়ে এসে গায়ে পড়ছে। আমার চমৎকার লাগলো। রিকশা করে ইউনি পৌঁছানোর পথে বাবুস্কুল। ফিনফিনে শৈশবের সাথে হুটহাট দেখা হয়ে যায় ওখানে। আমি তৃষিতের মতো চেয়ে থাকি। লাল-সাদা ডোরাকাটা জামা পরে একটা বছর পাঁচেকের ছেলে বোনের হাত ধরে যাচ্ছে। দুরন্তপনায় বার বার বোনের হাত ছুটে যাচ্ছে। আমার সাথে ছেলেটার একবার চোখাচোখি হলো, বড় বড় টলটলে চোখ। মাথার চুলগুলো এলোমেলো, আমার খুব আপন মনে হলো ছেলেটিকে। রিকশা পেরিয়ে যাবারও আরো কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত আমি তার কথা ভাবছিলাম!


অফিসে এসে একদণ্ড শান্তি নেই, ঝড়ের বেগে কাজ করতে করতে ভালই লাগছিলো। দুপুরে একটা ফাস্টফুডের দোকানে খেতে গেলাম, হাতে সময় ১৫ মিনিট। ১৫ মিনিটে খেয়েই অফিসে ফিরতে হবে বলে একটা বার্গার আর ফ্রাইড চিকেন বরাদ্দ হলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে কোণের চেয়ারে বসে গপাগপ গিলছি। সামনের টেবিলে একটা ছেলে আর মেয়ে মুখোমুখি বসা, আমি কেবল ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছি। একটু পরে মেয়েটার গলার স্বর চেনা চেনা লাগলো, বাঁকা হয়ে চেয়ে দেখি শান্তা! স্কুল থেকে পরিচয়, ম্যাবস-কোচিঙয়ের কালঃ আটানব্বুই-নিরানব্বুই! ও সম্ভবত আমার অফিসের গলিতেই অন্য কোনো খানে চাকরি করে, আগেও একদিন দেখেছিলাম হন হন করে হেঁটে যাচ্ছিলো। আজকে আমি এতো ব্যস্ত যে কথাই বলতে পারলাম না। বার্গারে মনোযোগ দিলাম। তবে ঘাসপাতা মেশানো মাংশ চিবুতে চিবুতে মনে পড়ছিলো ফার্মগেইট, মোস্তফা, শিশির, রাহুল, ত্রিমিতা, পুষন, আলম…


স্মৃতি বড়ো বেমক্কা! এই তাড়াহুড়ার মাঝে আমাকে স্থবির করে দিলো!

সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৯

শিরোনামহীন দু'খানা




অনেকদিন ধরে ঘুম ঘুম জেগে থাকা আর হঠাৎ জেগেই টের পাওয়ার দুঃসহ কাল কেটেছে তার,
তারপর অনেক ক্লান্ত হয়ে সূর্য ওঠার পরে সে অনায়াসে ঘুমোতে গেছে ভারী নীল পর্দাগুলো টেনে
মাঝে মাঝে এলোবাতাসে কুঁচো রোদ, নীল পর্দার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে
তার ঘুম ভাঙেনি, সারা রাতের ক্লান্তি আঠার মতো পাঁপড়ির ভাঁজে মিশে ছিলো, তবু সে মনে হয়
টের পেয়েছে আলোর আসা-যাওয়া আর চুরি করে তাকে দেখে ফেলাঘুম ভেঙেছে বহুদিন, সন্ধ্যে
পেরিয়ে শহর যখন গাঢ় আঁধার মাখছে, সাথে আরো মাখছে প্রসাধনী রূপসী মেয়েগুলো যেমন মাখে,
ঠিক তখন হঠাৎ চোখ খুলে সে জানালায় গোলানো লাল লালাভ আলো দেখেছেখুব ধীরে জেনেছে
এভাবে রোজ যেমন শহর সেজে ওঠে তখন তার ঘুম ভাঙেআমি আগেই জানি কারণ সবসময়েই তার
অপেক্ষায় থাকি, দুচোখ মেলে কাতর চেয়ে থাকি সে কখন উঠে বসবে, দু'হাত তুলে তার আড়মোড়া
ভাঙার ভঙ্গিতে দারুণ কমনীয় কামনার পালক লেগে আছেদেখো আমি কেমন অজান্তে ভেসে যাচ্ছি
তার ছড়িয়ে দেয়া আঙুলের নখ ছুঁয়েওড়বার বিলুপ্ত সাধ কোন অজানা কোণে লুকিয়ে ছিলো, ঘুম ঘুম!






তিনি দেখলেন দেয়াল ঝাপসা দুলছে
সরল দোলন শিখে ফেলা চোখ দেয়ালের শরীর
চেটে দেখে সেখানে কতটা হিম
কতটা বিভ্রান্ত ত্রুটি ঘটেছে

আজকাল তাঁর চোখের সামনে
মানুষ ও মানুষের মুখ হেসে ওঠে, স্বৈরিণীর মত
ক্রোধগুলো জেগে ওঠে তাঁর, কাটামস্তক
একে একে তুলে আনেন, আমি দেখি গলার নিচে
টপটপ কালো রক্ত ঝরছে

দেয়ালে সারি সারি আমাদের ছিন্ন মাথা ও চোখ তখনো হাসছে

***

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০০৯

নগরভ্রমক ও আমি

"এখানে ফুল তোলা নিষেধ"
নির্দেশ বা বিজ্ঞপ্তি, যাই বলি না কেনো
সেটা পড়ে নগর-পরিব্রাজকের পা ভারি হয়, সে চলতে পারে না
শরীরের ভেতরে ফুলের পাঁপড়ি-ছেঁড়ার-গান
হঠাৎ!
মুষড়ে উঠলে নিঃশব্দেই অযথা ভাঙে
অমলকান্তি শরীর- একহারা গড়নের মধুময় কায়া
টুকরোগুলো ইতস্তত ফুটপাতে


ওখানে অনেক ভীড় বলে অনেকেই গা ঘেঁষে চলে, গায়ে মেখে চলে
তাদের পায়ে পা জড়িয়ে, যায় জট, খুলে যায়
নখের ডগায়, ধাক্কা খেয়ে নগরভ্রমকের টুকরোগুলো
ছিটকে ছিটকে রাস্তায়...
প্রাচীন মেসোপটেমিক-ভিস্তিও'লা নেই- এখানে কাফ্রীর মতো
রোদে পোড়া উস্থূর ন্যাংটো এক ভারসাম্যহীন
-দেখি বনানি'র রেলক্রসিঙয়ে দাঁড়িয়ে একমনে মাথা চুলকায়
সেটা বাসস্ট্যান্ড, বাস ও মানুষের লাইন বেঁকে ধনুর মতো
ছিটকে ছিটকে রাস্তায়...


অ-শরীরে নগরে ঘুরে বেড়ানো ঠিক নয়- তাতে বহুবিধ উদ্বেগ
কালোছাই বুকে মেখে সকালে যারা বেরিয়ে আসে,
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, তাদের জন্যে শারীরিক জয় জরুরি!


নগরভ্রমকের ফুলতোলা আকুতি পায়ে লেগে রাজপথে একা একা পড়ে থাকে।

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০০৯

এসিড

অবিশ্রাম, অবিরাম কোলাহল সমূহ খুব কোমল ফুলের মতো রন্ধ্রবাসী হয়েছে আমার, তারপরে আমি ভুলে গেছি কবে যেনো সেই ফুলগুলো গজিয়ে গেছে শরীরে, ত্বকের বদলে আমি কিছু কোলাহল-ফুল নিয়ে ঘুরি। আমি পথে বেরুলেই সকলে এসে হাসিমুখে ফুলগুলো তুলে নিয়ে যায়, সেসব ফুলের সৌরভ, কোলাহল-সুর, চিৎকার ও তীক্ষ্ণ ক্রন্দন আমার চারপাশে ঘুরতে থাকে, নাচতে থাকে। আমাকে ছেড়ে যেতে তাদের অনেক কষ্ট হয় বোধহয়। আমি খালি আমাকে নিয়েই ভাবি, এই ফুলগুলোর কষ্ট বুঝে ওঠার কোনো চেষ্টা করি না। মাঝে মাঝে, যখন রাত হয়ে আসে চরাচরে, সেখানে আলো থাকে না, ছায়ার মাঝে অজানা মানুষেরা লুকিয়ে থাকে-- পাগল ও উদভ্রান্ত মানুষের সারি সারি স্রোত দেখা যায়, সেইসব রূপকথা-কালে, আমি বাইরে বেরুলে সেই ফুলগুলো হারিয়ে ফেলি। পথের ঠিকানা জানি না সেই পথের। তাই ফিরে গিয়ে প্রিয় সরব ফুলের মৃতশরীর কবর দেয়া হয় না আমার। তারা অনেক দূরের সেই গুপ্তপথে একা একা শুয়ে থাকে; আমি জানি।


তারপরে আবারও অসময়ে নতুন ত্বকে জন্মায় অজস্র কাঁটাহীন পুষ্প, অপরূপ বিষধর আপেল। হলুদ আপেলে লেখা থাকে প্রণয় ও পাপের ইতিহাস, সেখানে আমার নামও দেখি, চোখে পড়ে। দীর্ঘতালিকায় এই নামটিই জ্বলজ্বলে! তারপরে তালিকা থেকে সারি সারি অক্ষরগুলো গড়িয়ে পড়ে... ভারি বিউটেন! খবরে দেখায়, ভূগর্ভের যোনি থেকে তেল ওঠাতে লকলক করছে তাদের জিব। জোরালো জিবে তারা ক্রমাগত খুঁড়ছে, পুলক হবেই জানি আমরা, নিস্পৃহচোখে দেখছি প্রকাণ্ড ব্লো-জব। ভূখণ্ড জুড়ে অজস্র বেতার শীৎকার ভালো লাগে আমার। এই ঐতিহাসিক সময়ে আমি আর তুমি আর বাকি তোমরা সকলে বেঁচে আছি -- এই অস্বাভাবিক চিন্তা আমারকে সেই আকাঙ্ক্ষিত পুলকটি পাইয়ে দেয়!


তারপরেও গল্প চলে, সূর্যহীন দুপুর যেমন মেঘমাখা ঘুম নিয়ে আসে, অন্ধকার নিভৃত নিদ্রায় ঢলে পড়ার আগে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে। ক্যাওস ও এনার্কি হাত ধরাধরি করে চলুক, আমাদের কাঁথার বুননের বাইরে ফুটে থাক কোলাহল-ফুলের দুরন্ত বিস্তৃত বাগান। সেখানে রূপকথা-পুরুষেরা নিষ্কাম জড়িয়ে ধরেছে সাপের শরীর, প্যাঁচানো সাপের মতো শরীর নিয়ে সুকন্যারা রূপকথার পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে গেছে। তারপরে অক্ষরের গ্রীবায় তাদের কাহিনী পড়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি, এমনি এমনি। এই সকল কোলাহল ধ্রুবক জেনে আমরা জেগে উঠি- ঠুঁটো জগন্নাথের মতোন!

মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৯

রোদ ভেঙে যেদিন পেরুলো সবাই অনন্ত রাত

দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরে পিঠের ওপরে সেটা দড়াম করে চিৎকার করে উঠলে রাসেলের মনে হয় এভাবে সব দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাদা-কালো কাচে তৈরি দরজায় এধরনের শব্দ হয় না বলে সে প্রায় ভুলতে বসেছিল, কিন্তু আজ পেছনে দড়াম করে দরজা পড়ার শব্দটা তাকে মনে করিয়ে দিলো প্রত্যাখ্যান কতো নিষ্ঠুর। দুপুরের রোদ বেহিসেবি অ্যাকাউন্টেন্টের মতো অবারিত ভুল তীর ছুঁড়ছে, আর পিঠে থুথুর মতো লেপটে থাকা শব্দটা, যেটা জড়িয়ে ছিলো, সেটাকে এলোমেলো করে দেয়ার চেষ্টা করছে। অদ্ভুতভাবে, এমন কাঠফাটা রোদে, রাসেলের ভেজা ভেজা লাগে।


অনাহিতার টানাপোড়েনের গল্পটা তার থেকেও জটিল, কুটিল। কথার পিঠে কথা বলতে বলতে আমরা যেমন একটা সময়ে ভুলে যাই কোথায় কথা শুরু হয়েছিলো, তেমন করে অনাহিতারও মনে নেই সবকিছু। অনেক কথার গায়ে অনুভূতির ছাপ মারা থাকে, লাল নীল রঙের পোস্টারের মতো অনুভূতির দাগ থাকে বলে সেগুলো মনে পড়ে যায় সহজেই। প্রথম যেদিন 'ভালোবাসি' শব্দটা ফিসফিসিয়ে শোনা যায়, তার প্রতিটা কম্পাঙ্কের সাথে, স্বরের ওঠানামার সাথে সীল-গালা করে কি কি অনুভূতি মিশে যায়! হর্ষ। বিষাদ। আকুলতা। অধীর আবেগগুলো অনাহিতা মনে করতে পারে। এখন যেভাবে রাসেল সবকিছু ভেঙে বেরিয়ে গেলো, তখন তার যাবার ছবিটা দেখতে দেখতেই জোরে দরজা লাগিয়ে অনাহিতার অনেক বেশি মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরে সে আলগোছে সব চিন্তার ঝুলঝুলে ভাঁজে বিড়বিড় করতে থাকে, "তুমি ফিরে আসো, তুমি ফিরে আসো প্লিজ"।


তার ফিসফিসানি একা একা ঘরের চারকোণে প্রতিফলিত হতে থাকে। শব্দগুলো টেনিস বল। দেয়ালে লেগে ফিরে ফিরে অনাহিতার মুখে, চুলে, হাতে মেখে যেতে থাকে।


প্যান্টের ঝুল টানাটানি করা কালো পিচ্চিটাকে রাসেলের উৎকট ঘিনঘিনে লাগছিলো। রিকশায় বসে বসে তার মনে হয় একটা ঝেড়ে লাথি কষানো দরকার। পিচ্চিটার পেছনে বেশি জায়গা নেই, ঠিকমতো লাগলে উড়ে গিয়ে সামনের রিকশার পা-দানিতে পড়বে। কিন্তু লাথি না মেরে শেষপর্যন্ত সে হাঁটুটা একটু নাড়ায়, পিচ্চিটা খানিক পরে হতাশ হয়ে চলে যায়। রোদ কমছে না। দীর্ঘ শ্লথ জ্যামের মধ্যে রাসেল ভাবে কেন সে কচ্ছপ হলো না। খোলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিব্বি গড়াগড়ি দেয়া যেত। গুটিয়ে রাখা হাতার ভেতর ঘাম জমা হচ্ছে, ধীরে ধীরে শিশিরের মতো ভিজে উঠছে, হাতা জুড়ে বদ্বীপ-মানচিত্র। আর ঠিক সেই সকাল সকাল অনাহিতাকেই মনে পড়ে তার। এমন হুটহাট কাউকে মনে পড়ে যাবার ব্যাপারে একটা আইন থাকা উচিত, –ভাবে রাসেল, ঘামের গায়ে কি অনাহিতার নাম লেখা ছিলো? যেভাবে সে শার্টের কোনাটা আঁকড়ে ধরতো, সেভাবে কেন ঝটকা দিয়ে রাসেলের তাকে মনে পড়ে? নাহ, পিচ্চিটাকে লাথি কষালেই ভালো হতো...


সেদিন রোদ ছুঁড়ে রাসেল গাছের ছায়া খুঁজছিলো। সেগুলো এই শহর থেকে হারিয়েই গেছে, নাকি কেউ একদিন ভোজবাজির মতো ডাকাতি করে নিয়ে গেছে কি না কে জানে। তবে রাসেল কোন গাছ খুঁজে পায় না, আর তারপরে সে উদয় টাওয়ারে ঢুকে পড়ে। এখানে তার চাকরি, অর্থাৎ অফিস নামের একটা জীবন। সেখানে সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সে দশঘন্টা কাটায়। এসি'র বাতাসের দমকে দমকে তার মনেও পড়ে না কীভাবে সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে বিকেল হয় বা কীভাবে সে যখন উদয়ের পেট থেকে বের হয় তখন সূর্যের চেহারাও বাইরে নজর পড়ে না। রিসেপশনে সুমাইয়া বসে, পৃথুলা গড়নের সুমাইয়াকে শীতাতপ অফিসে বেশ ভালো লাগে তার। অনাহিতাকে কি তখন একবার মনে পড়ে? নাকি সুমাইয়া বাম হাতে আলগা চুলগুলো গুটিয়ে কানের পেছনে নিলে, তার বিভ্রান্তি বাড়ে আর মনে হয় স্বচ্ছ কাউন্টারের পেছনে দুরন্ত অনাহিতা বসে আছে! তারপরে রাসেলের কেন জানি সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরতে হঠাৎ ইচ্ছা করে। কিন্তু সে'রকম কিছু না করে সে মাথা দুলিয়ে, হাসি মেখে কার্ড পাঞ্চ করে ভেতরে চলে যায়। তার পিঠের পেছনে শ্যানেল ফাইভ মাখিয়ে দেয় সুমাইয়া। এত দামি পারফিউমটা ও কোত্থেকে কিনেছে?


অনাহিতা দুপুরে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুমের মধ্যে তার মনে হচ্ছিলো সে জেগে আছে। জেগে থাকার যে সাধারণ অনুভব, সেগুলো তার হচ্ছিলো বলে সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো যে সে জেগেই আছে। অনাহিতা হাঁটছিলো একটা ফাঁকা করিডোর দিয়ে। করিডোরের একপাশ দিয়ে অনেকগুলো বিছানা, বিছানায় অনেকগুলো শরীর কাতরাচ্ছে। দুয়েকটা শরীর প্রায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। একটা শরীর ঝলসে কালো হয়ে গেছে আর সেটার গা দিয়ে ভকভক করে পোড়া মাংশের গন্ধ পায় সে। তখন তার মনে হয়, এটা স্বপ্ন হলেই ভালো হতো। আর ঠিক এই ভাবনার সাথে সাথেই তার ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে সে বোঝার চেষ্টা করে। জোরে একটা শ্বাস নেয়, উঠে বসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এখন অনাহিতা কাঁদছে অথচ তার কাছে কেউ নেই, কেউ তার পাশে বসে তাকে একটু সান্ত্বনা দেবার নেই, তার শোকের ভার হালকা করবে এমন কেউও নেই। রাসেলকে তার মনে পড়ে খুব, খুব করে সে বারবার ভাবে রাসেল এখন কোথায়? কাঁদতে কাঁদতে যখন সে প্রতিবার নিঃশ্বাস নেবার জন্যে থামে, তখন হয়তো সে আশা করে এই নৈঃশব্দ্য রাসেল ভরাট করে দিবে। কিন্তু সেখানে শুধুই নীরবতা জমে থাকে!


অফিসের ভেতরে গেলে রাসেলের কেবলই মনে হতে থাকে সে কোন শীতল জরায়ুর ভেতরে ঢুকে পড়েছে। যেন সেটার ভেতরে অনেকগুলো প্রকোষ্ঠ, খোপ খোপ করে রাখা। প্রতিখোপে একজন করে শুক্রাণু আর মাঝে মাঝে কোন কোন খোপে ডিম্বাণু হাসিখুশি, খুব ব্যস্ত হয়ে নড়াচড়া করছে। রাসেল দরজা পেরিয়ে নিজের খোপে গিয়ে একটা শুক্রাণু সেজে বসে। অথবা সে ডিম্বাণুও হতে পারে, এ বিষয়ে দ্বিধা ও সন্দেহ পাশাপাশি খেলে।


খোপের দেয়াল কথা বলে ওঠে, "কি খবর রাসেলমিঞা?"।


দেয়ালের ওপাশ থেকে এক শুক্রাণু ইসলাম ভাই বলছেন, "আজকের প্রেজেন্টেশন কদ্দুর?"


রাসেলের কপালে ভাঁজ পড়তে পড়তে মিলিয়ে যায়, নিঃশ্বাস বেঁধে রেখে সে কাগজ গুছিয়ে ইসলাম ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়, "দেখেন তো ঠিকঠাক হইসে কি না?"


নতুন প্রজেক্টের কয়টা দিন এ'রকমের লঘু ব্যস্ততা তার খারাপ লাগে না। আবার মাঝে মাঝে ভুস করে খিদে লেগে গেলে কাজটুকু মুলতবি রেখে তার বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছা করে খুব। রাসেল লাঞ্চ করতে করতে ট্যুরের প্ল্যান করতে চেষ্টা করে। আজকে লাঞ্চের মেন্যু খুব খারাপ, রুই মাছের পেটি ধরনের একটা কিছু ঝোল ঝোল তরকারিসহ ভাসছে। বাটিটা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে তার। তারপরে সেটা থেকে টুকরাটা পাতে নিয়ে সে মোনায়েম ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। মোনায়েম ভাই হাত ডুবিয়ে ঝোল মাখাচ্ছেন, ঝোল টেনে আঙুল চাটছেন, তারপরে বলছেন, "রাসেল, এবারে ট্যুরে যাওয়া হবে না। তোমার ভাবী এক্সপেক্টিং।"


ঝোল চেটে ফেলা দুটো আঙুল দেখিয়ে তিনি বিগলিত হাসেন কিছুক্ষণ। বিজয়ের চিহ্ন দিয়ে তিনি "দুই নম্বর" বুঝালেন, নাকি "জিতে গেছি" বুঝালেন তা রাসেল ঠিক ঠাহর করতে পারে না। তারপরে দেখে কর্পোরেট এফেয়ার্সের তিনটা মেয়ে ঝুমঝুম করে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। মোনায়েম ভাইয়ের "ভি" সাইনের পাশ দিয়ে একটা মেয়ের ডান স্তনটা ঝুলে থাকে। 'ফ্রেমটা রুইমাছের ঝোল মাখা হলে আজকের লাঞ্চ খাওয়া জমতো', এমন ভাবে রাসেল। খাওয়ার পরে তার মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয়। মেয়েটা কেন হাতে মেহেদি মাখে প্রতিসপ্তায় তাও জানতে চায় রাসেল। অনাহিতা কেন মেহেদি মাখতো?


এভাবে প্রায় সারাদিন ধরেই রাসেলের অনাহিতাকে মনে পড়ছে। অনাহিতার গল্পটুকু ঠিকঠাক তার মনে নেই সম্ভবত। অথবা সে সেসব কথা মনে করতে চায় না। কারণ সেগুলো মোটেই জরুরি না। অনাহিতা হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করে সে -- এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার বিকেলের প্রেজেন্টেশনের চাইতেও! সন্ধ্যার পরে উদয় চিরে বের হয়ে রাসেল দেখে সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, পৃথুলা। রাসেলের তাকে রাস্তার আলোতে দেখতে ভালো লাগে, সুমাইয়া ওর দিকে তাকায়। স্মিতহাসি মেয়েটার মুখে এখন একটুও হাসি নেই, সে মনে হয় অনেক ক্লান্ত। রাসেলের খুব ইচ্ছা করতে থাকে এগিয়ে গিয়ে একটু কথা বলার, একটু হাসিমুখে তাকানোর।







তারপরে যখন সন্ধ্যা ভেঙে অনাহিতার কান্না থামে, তখন বাসায় অনেক লোক। আজকে সবার দাওয়াত ছিলো। অনাহিতার জন্মদিন আজকে কিন্তু তার আজ কিছুই ভালো লাগছে না। গত বছর থেকেই জন্মদিনের দিনটায় তার কষ্ট হয়, সে গতবছরেও এভাবে কান্নাকাটি করেছিলো। সেদিনও সবাই ছিলো তার বাসায়, রাসেলও ছিলো। সেদিন রাসেলকে দেখে সে ঠিকমতো চিনতেও পারে নি। একটা মানুষ এতো বদলে যায় কীভাবে! তার চেয়েও বড়ো বিস্ময়, হঠাৎ করে যখন আপন মানুষের বদল টের পাওয়া যায় আর জানা যায় যে এটা অনেকদিন ধরেই ঘটেছে, তখন নিজের বোকামিতে বিস্ময়বোধ করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। পাশাপাশি থাকার সময়ে কি তাহলে খেয়াল ছিলো না? রাসেলের বদলগুলো কেনো তার চোখে পড়ে নি?


প্রথম দিকে অনাহিতা ভেবেছিলো এসবই একটা নিছক দূর্ঘটনা। গত জন্মদিনের সবকিছুই একটা বড়োসড়ো দূর্ঘটনা আর সেই বিশ্বাসে সবার সাথেই সে কথা বলেছিলো সেদিনের ঘটনা জানার জন্যে। টুকরো টুকরো জবানে যা জেনেছে, তাতে তার দ্বিধা কেটে গিয়েছিলো আর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে রাসেল আদতেই তার চোখের সামনে থেকে একটু একটু করে বদলে গিয়েছিলো। মনের কোণে কালো মেঘের মতো যে সন্দেহ জমা হয় সেটার বর্ষণ মানুষকে খুব পোড়ায়। অনাহিতা পুড়ে পুড়ে ঐ লাশটার মতো কালোকয়লা হয়ে গেছে এক বছরে। এখন তার ত্বকে কোন সাড়া লাগে না। মানুষের কথা, সান্ত্বনা, করুণা, সবকিছুই যেনো ভেসে ভেসে চলে যায় আঁচড় কাটতে না পেরে।


:" জীবন তো আর থেমে থাকে না।"
:"আবার সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করো।"
:"এভাবে আর কতোদিন থাকবে? তোমার বয়স কম।"


টুকরো টুকরো কথাগুলো বিষের তীর নিয়ে অনাহিতার দিকে ছুটে আসে, তার মুখে আছড়ে পড়ে। দুপুরের একলা একলা কান্না আবার ফিরে আসতে চায়। কিন্তু সামাজিক মুখোশটা চমৎকার এঁটেছে সে আজকে। তাই হাসিমুখে মুখ টিপে পিছলে যায় অনাহিতা, এসব কথা আঁশের মতো গায়ে লেগে থাকে কিছুক্ষণ। রাতের খাবার খাওয়া হলে, যখন সবাই একে একে বিদায় নেয়, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আবারও কিছু কথা বলে। দুয়েকটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কেউ কেউ গায়ে হাত বুলায় মায়াভরে। তারপরে আবার দরজা আটকে অনাহিতা একা হয়ে যায় আর তার গা থেকে আঁশটে কথাগুলো খুলে ফেলে। মুখের হাসিটা আর মুখোশটা খুলে হালকা লাগে তার। তারপরে আবার দমকে দমকে কাঁদতে থাকে সে। একা।


রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কথা মনে পড়ে অনাহিতার। বন্ধুরা জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো ঈষৎ বিব্রত অনাহিতাকে, ম্যুভিটার নাম ছিল 'রশোমন'। দেখার পর থেকে তার মনে হচ্ছিলো ঘটনাটা এমন বদলে গেলো কেনো সবার কাছে? একইভাবে ভাবলে এমন কি সমস্যা ছিলো? আগে নাম না জানা ম্যুভিটা তারপরে শুধুমাত্র গল্পের জোরেই অনাহিতার মাথায় অনেকদিন ঘুরঘুর করেছিলো। রাসেলের গল্পটাও তার কাছে তেমন জটিল কুটিল হয়ে গিয়েছে তার কাছে। নিজের মনে মাঝে মাঝে অনাহিতা সবটুকু মেলানোর চেষ্টা করে। নিজের মনকে দুইভাগে ভাগ করে যুদ্ধে লাগিয়ে একটা মীমাংসায় আসার অনেক অসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে সে। তারপরে একটা সময় ক্লান্তযুদ্ধ থেমে গেলে টের পায় আসলে কিছুই মিলে নি। কেবল রণভূমি জুড়ে তার রক্ত, তার লাশ কাতর পড়ে আছে। তার একা হয়ে বসে থাকার মাঝেই তার মনে হতে থাকে যে পাশে রাসেল এসে বসেছে। হয়তো সত্যিই রাসেল চলে এসেছে, "এখনও ঘুমাওনি?"


- "নাহ"


-"ঘুমাও", বলে রাসেল তার মাথায় হাত বুলায় হয়তো। একটা শব্দ। একটা ছোট শব্দেই অনাহিতার মনে হয় সবটুকু অশ্রু বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বুঝতে পারে তার পাশে রাসেল নেই। তবে রাসেলের হাতের ছোঁয়াটুকু আছে। অনাহিতা ঘুমিয়ে পড়ে।









গল্পের শুরুটা দরজা থেকে। দরজা দু'পাশে দু'জন মানুষ দাঁড়িয়েছিলো, তারপরে দু'জনেই সেই দরজা ধরে একসাথে টান দিয়েছিলো। অনাহিতার অবাক হয়ে খেয়াল করলো টানা সত্ত্বেও দরজা উল্টো ওকে টেনে নিয়ে গেলো! তারপরে বুঝলো ওপাশের মর্তমান কলাটিই এজন্যে দায়ী। সেই ছেলেটির সাথে এভাবেই তার দেখা হয়েছিলো। আর তার বছর পাঁচেক পরেও তারা একসাথেই ছিলো। তারও কিছুদিন বাদে তারা নিশ্চিত হয়েছিলো যে তারা আর একসাথে থাকতে পারবে না।


রাসেল যখন অসহায় বোধ করে, তখন খুব রেগে যায়। এই উড়নচণ্ডী রাগের কারণে তাকে অনেক সময় বড়োসড়ো ক্ষতিও সহ্য করতে হয়েছে। অনাহিতার সাথে যেদিন তার শেষ দেখা, সেদিন মোটামুটি জোর করেই দেখা করেছিলো। হয়তো বিচ্ছেদ মেনে নিতে তার মন চাইছিলো না, হয়তো এটাকে সে নিজস্ব দোষ ভেবেছিলো। যে'রকমই হোক না কেন, সেদিন খুব রেগে বলা কথাগুলো অনাহিতা এখনও মনে রেখেছে। প্রথম 'ভালোবাসি' বলার সাথে যেমন কোমল শিশিরের মতো অনুভূতিগুলো জড়িয়ে থাকে, সেদিন বলা কথাগুলোও অনাহিতার মনে ছিলো গনগনে আঁচে পুড়ে যাবার মতোই।


তিনদিন পরে সে যখন হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তখনও সেই আঁচভরা কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছিলো। কেন সেদিন অমন করে রাসেল বেরিয়ে গিয়েছিলো? করিডোরে সারি সারি শরীর, গলে ওঠা, ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের ভীড়ে রাসেলের কালো হয়ে যাওয়া শরীরটা খুঁজে পেলে অনাহিতা থেমে যায়। তারপরে স্থানুর মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তারও অনেকগুলো মুহূর্ত পরে অনাহিতার মনে হয় কালো শরীরটা সেই কথার আঁচেই হয়তো পুড়ে গেছে। রাসেলের শরীর জড়িয়ে ধরে সে ফিসফিস করে কী কী বলেছিলো সেগুলো আর শোনা যায় নি।

বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০০৯

সে

এক.
সে আসছে – উদ্দেশ্যবিহীন,
সে দ্রুত হাঁটছে, সে ধীরে মরছে – এমন মরণ!
বাসের গা ঘেঁষে সে চলে যায়, বাস অনড়োস্থির
শেষ জানালায় মাথাটি বেরিয়ে আসে ঘোলাটে থুতু
ছুঁড়লে সে চকিতে হয়েছে ধীর– কিংবা সরল






দুই.
চাঁদ মেঘের পিঠের পেছনে চুপ; উঁকি দিবে না বুঝে
সে খুব অবলীলায় খুন করছে আয়নাজগৎ
টুকরো টুকরো ধুলো আর প্রকাণ্ড রোদ অনায়াসে
নাভিপথে ঢুকে পড়ে! আঃ শীতলরহিত-গমন






তিন.
এসব কয়েনেজ রেখে মাথা নাড়ে সে, এসব ফাঁকিবাজি ছাড়ো
মাথা নাড়ে সে আর বলে, ‘আমার ভেতরে জ্বলে কোমল-সকাম-আমি,
আর এ-সকল কয়েনেজ শিরাভেদী গতিতে আমাকে মারছে’,
মরে গেলো সে, অথচ তখনও মেঘ ও চাঁদ ও বাস ও মাথা ও থুতুটি
উলম্ব ঝুলছিল...






চার.
নদী বেঁকে শুয়ে থাকে, সেটা নিয়ে কারো আপত্তি থাকে না। নদী বেঁকে শুয়ে আছে এরকম দৃশ্য কেউ দেখে নাই। কোনোদিনও! তারপরে এক কবি বলেছেন, নদী বেঁকে শুয়ে আছে। আমরা পড়েছি আর চোখের ভেতর সর্‌সর্‌ করে ময়াল সাপের মতো নদীটা ঢুকে গেছে। মাথায় মগজে এঁকেবেঁকে শুয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে নদীর শরীর মোচড়ায়, আমাদের হৃদয়ে পড়ে টান। শরীর টান টান দুঃখে ভেঙে যায়– নদীর না, আমাদের।


নদীটি বেঁকে শুয়ে আছে, তাতে কারো আপত্তি নাই। নদীকে যেদিন তোমরা ক’জনে মিলে নদীর পাশে শুইয়ে দিলে এলোমেলো করে, সেদিন নদী আরো নিথর হয়েছে। কবি সেখানে ছিলেন না। কেউ ছিলো না (অথবা ছিলো)। তোমরা চলে গেলে, একে একে সকলে সেই আশ্চর্য দৃশ্যটি দেখেছে। নদীর পাশে নদীর বাঁকানো লা–ল টুকটুকে নগ্নশরীর। সবার খুব ভালো লেগেছে। সবার খুব খারাপ লেগেছে।


চিত্রগ্রাহক ছবি তুলেছে। ফুল এক্সপোজারে, দুটা ওয়াইড আর দুটা ক্লোজ শট।


সাংবাদিক রক্তপরিমাণ ও কাপড়পরিমাণ রেশিও করেছেন আঁক কষে।


কবি ছিলো কেবল নিশ্চুপ, সকলের শোরগোলে।

রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৯

কোলাজ



পাতার কান্না শুনি ঝিকমিকে আঁধার নির্জন
সবুজ প্রহার...
এ সবই শীতল দৃশ্যে লেপটে থাকে

ঘুঙুরের শব্দের রঙ দেখে আমি যেভাবে বিস্ময়ে ভাসি
সেভাবে অনেক বছর পরে তোমরা সেই দৃশ্যটি দেখে
নিশ্চয়ই কাঁদবে
হাসবে হাসিমুখ ভেঙেচুরে পাতা হয়ে যাবে
কিংবা হতেও পারো কোলাজরূপী দালান
অদ্ভুত ট্র্যাফিক সিগন্যাল যেটি নীল'
তোমরাও জ্বলবে নিভবে তিন মিনিট পর পর
যেভাবে হাসছো এখন
আমিও হাসছি তোমাদের সাথে

বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০০৯

চুয়ান্নের বাইশে অক্টোবরঃ কবি!

০.
আর কিছুদিন যাক না এমন আরো একটু আশা
এই পৃথিবীর মানুষগুলো বুঝবে আমার ভাষা।



এমন একটা গান আছে।




১.
মাঝে মাঝে কাকতালীয় ঘটনা ঘটে আমাদের জীবনে। কেন ঘটে সেটা আমরা বুঝতে পারি না বলেই হয়তো সেগুলো কাকতালীয়। আমার বিশ্বাস, সবকিছুই একটা বৃহত্তর নকশার অংশ। এখানে 'বিশ্বাস' কথাটা বলার কারণ এই যে এটা আমি প্রমাণ দেখাতে পারবো না। অসংখ্য ঘটনা তুলে আনতে পারি যেগুলো কাকতালীয় ঘটনার পেছনে কারণটাকে ব্যাখ্যা করবে। এবং এটা বুঝিয়ে দিবে যে এগুলো ঘটেছে একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্যসাধনে। তবে তাতে পুরোপুরি বিষয়টা প্রমাণ হয় না। কেবল একটা কুযুক্তির উদাহরণ হয়ে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে।


আমি প্রায়ই আজে বাজে উপমা ব্যবহার করি। এটা নিয়ে আমাকে অনেক কথা আর প্রশ্ন শুনতে হয়। এরকম উদ্ভট উপমা কেনো খাপ-না-খাওয়া চেহারা নিয়ে ঝুলতে থাকবে। বেশিরভাগ সময়েই আমি নিজের কাজকর্মের ব্যাখ্যা দিতে পারি না, লেখার তো আরও পারি না। তবে উপমার ব্যাপারে আমরা একজন বেখাপ্পা কবিকে চিনি যিনি অনায়াসেই আমাদের কাছে অনুমতি পেয়ে যান বিদঘুটে উপমা যথেচ্ছা বসিয়ে দেবার...


তার সাথে আমার পরিচয়ের শুরুতে আমি তাকে খুব বেশি পছন্দ করি নি। শৈশবের অভ্যাস মানুষ সহজে ছাড়তে পারে না, সেটা পাঠের অভ্যাসের বেলায় আরো বেশি খাটে। ছড়াটে-ছন্দ আর মাপা মাপা মাত্রা মাথায় কাঁথার মত সেলাই হয়ে গেছে। যখন বৃষ্টি পড়তো তখন 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' -এভাবেই ভাবতাম আমি। গ্রামে বেড়াতে গেলে নদীর পাড়ে বসে "আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে" ভুস করে শুশুকের মতো ভেসে উঠতো। তারপরে আমি বাংলা মাস হিসেব করে মেলানোর চেষ্টা করতাম-- এখন আসলে বৈশাখ, তাই নদীতে হাঁটু জল। তারপরে আরেক কবি এসে বললেন, সবাই বেশ সমান, নর এবং নারী। আমি ছোট ছোট কিশোর চোখে বোঝার চেষ্টা করি, কেন আমার পাতে বড়ো মুড়োটা পড়ে আর বোনের পাতে লেজ! এভাবে আমি অভিযোজিত হই, আমার সামাজিকীকরণ ঘটে।


এই পর্যায়ে আমার সাথে সেই বেখাপ্পা কবির পরিচয় হয়। তিনি বেশ মৃদুমন্দ, মোটেও সুরেলা নন। আর নিদারুণ দারুণ কাঠখোট্টা। তার নদীটার নাম ধানসিঁড়ি, তার পাখিটি হলো কালো শালিখ! আর বিদঘুটে উপমায় তার জুড়ি নেই- মাঠের ঘাসের মাঝে তার প্রেমিকার চুল আর ঘাম মিশে থাকে, প্যাঁচার ডাকের ভেতরে জীবন (নাকি মরণ) থরে থরে জমে আছে নাকি! এতোটা বিক্ষুব্ধ রচনায় স্বভাবতই মন বসেনি, হাতে পেতে দুয়েকটা কবিতা যা পড়লাম, ছন্দ মেলে না ঠিকঠাক। তারপরে দেখি মাত্রার নাম সনেট (এ কি বিদেশি গোলোযোগ!)। দূরে সরে গেলেন ম্রিয়মাণ কবি চুপিচুপি। দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এলেন ছাড়পত্র নিয়ে অভিযাত্রিক কবিগণ। তার সাথে আমার ফের দেখা আরো অনেক বছর পরে। ... কাকতালীয় নিয়ে বলছিলাম, আসলেই সবকিছু একটা নির্দিষ্ট ছকেই ঘটে বুঝি। তিনি যখন আবার ফিরে এলেন, তার সাথে পরিচয়ের উদ্ভাসে আমিই ভেসে গেলাম। চোখের ওপরে যেন রঙিন কাচ আটকে ছিল, যা দেখছিলাম সব সেপিয়া-পয়েন্টে ঈষৎ বাদামি হয়ে ছিলো। তিনি এসে সেই কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন।


এই কাজটি তিনি খুব সুচারুভাবেই করেছেন, বেশ "সহজ" উপায়ে। আসলেই এটি সোজাসরল-- আমি বুঝলাম।
"আমার এ গান
কোনোদিন শুনবে না তুমি এসে-
আজ রাত্রে আমার আহবান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে-
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
"

বয়ঃসন্ধি কেটে গেলে যেভাবে ঘুম ভেঙে যায়, দুই বেণি ছেড়ে ক্লাসের শীর্ণ মেয়েটি যখন একটা বেণি করে আসলো প্রথম সেটা আমার নজর এড়ায়নি। চোখ খোলাই ছিল, সেখানে মেয়েটির ওড়নার প্রান্ত হু হু করে মগজে সেঁধিয়ে গেলো। সেসময় কানের পাশে তিনি মৃদুস্বরে বললেন এই মেয়েটি তোমার গান কোনোদিনই শুনবে না। তবু তুমি পৃথিবীর কানে, নক্ষত্রের কানে কানে গান গাইবে। এ যেন এক মহান নিরুপায় শাস্তি-- তোমাকে এই গান গাইতেই হবে। সেদিন রাতে আমার ঘুম হলো না, তিনি বড়ো জ্বালালেন। দু'চোখে মণিমুক্তোর মতো দৃশ্যগুলো ভরে দিতে লাগলেন। দেখলাম পঁচিশ বছর পরে আবার আমাদের দেখা হয়েছে। মেয়েটি মধ্য চল্লিশের ভারি শরীর, পাতলা হয়ে আসা চুল নিয়ে সেদিন সামনে দাঁড়ালো। আমিও বুড়িয়ে গেছি, হাতের উল্টোপিঠের দাগগুলো মুখের ভাঁজে ভাঁজে, চোখের কোনায় কোনায় উঠে এসেছে। আমাদের মাঝে কোনো ভণিতা নেই- কৈশোরের নির্মলতা হারালে মানুষ কেমন অথর্ব আর ক্ষয়াটে হয়ে যায়, সেই চেহারা নিয়ে কবি দাঁড়ালেন সামনে, আমাদের মাঝখানে। হলদে তৃণ আর কুয়াশা ভরা মাঠের মাঝে আমি মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়ালাম। কবির চোখে দিব্যি দেখলাম, ম্রিয়মাণ মুখে কী তীব্র জ্বলজ্বলে আলো!






২.
এই কবির জীবন এবং কবিতা নিয়ে বহু বহু কথা হয়েছে। গত সত্তুর বছরে কবি বুড়িয়ে গেছেন, মরেও গেছেন অন্যমনস্ক হাঁটতে হাঁটতে। তার কবিতাগুলো বার বার বইয়ে বাঁধাই হয়ে সকলের বাসার শেলফে জায়গা করে নিয়েছে। তার কবিতার সবচেয়ে বেশি ব্যবচ্ছেদ হয়েছে, খাতায়, পাতায়, পত্র-পত্রিকায়, আড্ডায়, আলোচনায়, ভাষণে, বক্তৃতায়। কবি বেঁচে থাকলে কী করতেন? অথবা তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, তখন কি ভাবতেন তিনি মরে গেলে তাঁকে নিয়ে এমন মেতে উঠবে পুরো একটা জনপদ? তার জন্যে কাতর রাতগুলো নির্ঘুম কাটবে কোনো কিশোরের। মধ্যবয়েসী একজন কেউ প্রবল হতাশ রাতে ঘরের বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবে, আর সেই গনগনে ফুলকিতে দেখবে একটা প্যাঁচা তীক্ষ্ণ তাকিয়ে আছে! তখন তার মনে পড়বে একজন কবি ছিলেন যার কাছে এই প্যাঁচা কত অবলীলায় মানুষের উপমা হয়ে গেছে! আমার সাথে তার পরিচয়ের পর থেকে বারবারই আমার মনে হয়েছে এই কথাগুলো তিনি ভাবেন নি। এমন অসীম কল্পনাপ্রবণ মানুষটি হয়তো কখনোই ভাবেন নি যে তিনি কতজনের মনের কান্না আর চোখের হাসির ঝিলিকগুলো হুট করেই বাইরে নিয়ে আসতে পারবেন তার লেখা কবিতাগুলো দিয়ে। কবিতাগুলো নিরীহ এবং আড়ম্বরহীন সাজ নিয়ে অনেকদিন কাউকে নাড়া দেয় নি সেভাবে। অনেকেই বোঝেন নি হয়তো, এরকম নিভৃতে বসে এমন কবিতাও লেখা যায়।


মৃত্যু খুব প্রিয় বিষয় ছিলো কবির। ঘুরে ফিরে বারবার তার লেখায় চলে এসেছে গহীন কালো শীতল মৃত্যু। এবং তিনি কাতর হন নি। তিনি কখনই বলেন নি, 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে'। আবার মৃত্যুকে আহ্বানও করেন নি। তারপরেও মৃত্যু তার কাছে প্রিয় ছিলো। এবং প্রিয় জিনিসের ব্যাপারে আমাদের একটা বাই-ডিফল্ট আবেগ কাজ করে। অনেক ভীড়ের মাঝে আমরা যেমন হুট করেই আপনজনের চেহারা খুঁজে পাই, তেমনি তার কবিতায় খুঁজলে তিনি কেবল মৃত্যুর চেহারাই দেখতেন। একটা বিষয় খুব বেশি ঘনঘন আমাদের জীবনে ঘটতে থাকলে সেটার অসাধারণত্ব মিইয়ে যায়। আটপৌরে হয়ে পড়ে বার বার তার আসা-যাওয়া। অতিথিকে আমরা যেভাবে আদর-আপ্যায়ন করি, সে বসার ঘরে খাটিয়া পেতে ঘুমুতে শুরু করলে সেটা অচিরেই ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। সে কারণেই মৃত্যুর মত বিশাল বিনাশী ব্যাপারটিকে তিনি ভেঙে চুরে কাঁথা-বালিশ বানিয়ে ফেললেন। ঘাস, পাতা, জানালা, দেয়াল, শিশির, জোছনা, এমন হাজারো অসংখ্য উপাদানের মাঝে টুকরো টুকরো করে মৃত্যু মিশিয়ে দিলেন। আমরা পড়ার সময়ে খেয়ালও করি না, সর্‌সরে ময়াল সাপের মতো মৃত্যুছায়া পুরো পঙ্‌ক্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


এভাবে মৃত্যুকে টেবিল-চেয়ার বানিয়ে ফেলার আরেকটা সুবিধা আছে। অপার্থিব অনুভূতিগুলো খুব সহজেই এই সব উপাদানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। মনে হয় সবাই মিলে একটা স্ট্র দিয়ে মিষ্টি জুসের মতো মৃত্যুকে শুষে খেয়ে ফেলছে! কী অদ্ভুত কল্পনা, তাই না? জীবনের সকল উপাদান যখন তুচ্ছ হয়ে যাবে, আমাদের দপ্‌দপিয়ে দৌড়ে চলা কণিকা যখন ক্লান্ত হয়ে গতি থামিয়ে দিবে, ধুকপুকে হৃৎপিণ্ড অতি ধীরে স্তব্ধ হবে আর শৈত্যের প্রবল থাবা এগিয়ে আসবে, তখন হুট করেই আমার কবিকে মনে পড়বে। মৃত্যু খুব কঠিন কিছু তো নয়! জন্মানোর পরমুহূর্তেই হেঁচকি তুলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠার চাইতেও সহজ শ্লথগতিতে চোখের তারার আলো ফুরিয়ে যাওয়া। এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে হুট করেই ট্রামের সাথে ধাক্কা খাওয়া। এভাবেই মৃত্যু আসে। আমাদের স্তব্ধ করে দিতে, আমাদের জীবনের সবটুকু আলো নিভিয়ে দিতে।




কবির সাথে প্রথম পরিচয়ে মনে হয়েছিলো তিনি বেশ ম্রিয়মাণ। এই চিন্তাটা কতটা অপরিপক্ক ছিলো, তা এখন মনে পড়লে হাসি পায়। আমি একটা নতুন তথ্য জেনেছিঃ অনেক সময় খুব মৃদু স্বরে বলা কথাগুলো সবচেয়ে জোরালো শোনায়, আর উচ্চকিত স্লোগানের চাইতেই তীব্র অনুরণন তৈরি করতে পারে। কবিতায় যতো নিয়ম কানুন বানানোর চেষ্টা হয়েছে, এই কবির লেখার পরে সেগুলো মোটামুটি হাস্যকর প্রস্তাবনা হয়ে গেছে। সবারই মনে হয়েছে এভাবেও কবিতা লেখা যায়। চমক কাটতে সময় লাগেনি, তারপরের সময়টুকু কেবল এই কবির জন্যেই স্তবকে স্তবকে ভরে গেছে। পরে জানলাম এই অনুভূতিটার নাম- আধুনিকতা। প্রথা, সংস্কার এবং জোয়ালের মতো চেপে বসা সমাজে আমরা প্রতিনিয়ত যেভাবে ক্ষয়ে যাই, যেভাবে আমাদের ভেতর থেকে মৃত্যুর চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে জীবন চুরি হয়ে যায়, সেখানে এই কবিই পথ দেখালেন। তার কথাগুলো আমার কাছে নতুন সত্যের মতো ধরা দিলো। অন্ধকার প্রবল হলেও আমার মনে হয়, সেখানে তিনি পাশেই আছেন। আমার কানের কাছে মৃদুস্বরে বলছেনঃ
"আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।...

...ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস -
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
"







কবি মারা গেলেন চুয়ান্নের বাইশে অক্টোবর। আজকে থেকে ঠিক পঞ্চান্ন বছর আগে। ট্রামের চাকার সাথে যেই চিত্রকল্পগুলো হারিয়ে গেলো, যে পঙ্‌ক্তিগুলো নির্বাসনের নির্দেশ পেলো, সেগুলোর জন্যে আমার অনেক রাতেই মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরে অন্ধকারেই কল্পনা করি, কবির হাত মৃদু আমার কাঁধে এসে বন্ধুর মতো ছড়িয়ে আছে। তার মুখ অস্পষ্ট এবং ঘোলা। আমার চোখে অশ্রু। আমার মুখে একচিলতে হাসি। কেউ দেখছে না। কারণ ঘর অন্ধকার।

রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০০৯

টেবিলের চারপাশে

টেবিলে বসে ছিলো একাকী চায়ের কাপ
পাশের পিরিচে ছাইয়ের দাগ, অথবা পিঁপড়ের লাশ
টেবিলের চারপাশে এলোমেলো চেয়ার নির্ঘুম-
যারা চলে গেছে তাদের জন্যে নীরবতা সেখানে আজ।(১)


(কোরাস)
আমাদের যেদিন গিয়েছে চলে, যাবার আগে যায়নি তো বলে
সেদিন কি একেবারে গেছে হারিয়ে, হৃদয়ের সীমানা বহুদূর ছাড়ায়ে||


আমরা জেনেছি পৃথিবীর দিনরাত মানুষের জন্য নয়
পিরিচের ঘূর্ণিতে ছিটকে যাবে জলবিন্দুর স্রোত
মিছে প্রেম, মিছে কথা, শুধু অযথা আলাপে মশগুল
যারা ছিলো টেবিলের পাশে, তারাও জানেনি "সবই ফুরাবে"।


(কোরাস)


সেখানে যেসব একা একা রাত ভরে ওঠে রোদ হাসিতে
বন্ধু-খেলায় মেতেছে যারা, তাদের চোখে হর্ষ জল
তোমরাও রেখে যাবে চিহ্ন অসীম, চায়ের পিরিচে
টেবিলের চারপাশে এলোমেলো চেয়ারে নির্ঘুম।


(পুনঃ১)
(কোরাস)





***
উৎসর্গঃ হেম, তোকে।

সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০০৯

এলোমেলো বসে থাকা

এলোমেলো বসে থাকা- এরকম একটা উপমা শুনেছিলাম, বা পড়েছিলাম কোন এক গল্পে বা কবিতায় বা উপন্যাসে। অথবা আমাকে কেউ শুনিয়েছিলো শব্দ তিনটা কয়েক বছর নাকি কয়েক মাস আগে। শব্দ তিনটা অনেক সময় বলে সবাই, কিন্তু এভাবে একসাথে বলে না। এলোমেলো হয়ে যায় সবাই, এলোমেলো জীবন কাটায় অনেকেই, এলোমেলো দিনরাত পাড়ি দেয় কেউ কেউ। আবার চুপচাপ বসে থাকে, স্থির হয়ে বসে থাকে, নয়তো হয়তো কেবল বসেই থাকে সবাই বা কেউ কেউ। কিন্তু এলোমেলো বসে থাকে বিশেষ কোন মানুষ। এলোমেলো বসে থাকা কেমন সেটা আমি জানতাম না। আমাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। শ্লেটের ওপরে খড়িমাটির চক দিয়ে যেভাবে মাতামহী "স্বরে-অ" লেখা শিখাতেন, -এর গোল পেট টেনে টেনে আঁকতে হতো, কারণ তা প্রায়ই ভুল হতো আমার, মিশে যেতে চাইতো -এর কালো মাথার সাথে। তাই আমি ঈষৎ কাঁপাকাঁপা হাতে চক টেনে টেনে "অ" লিখতাম। এভাবেই শিখতে হয় অপরিচিত প্রণালী, নিয়মে, অধ্যবসায়ে, একাগ্রতায়। কিন্তু আমি কখনো এলোমেলো বসে থাকতে শিখি নি। এমনকি শব্দগুচ্ছটাও আমার অপরিচিত ছিল অনেকদিন। তবু শব্দজোড়া শুনেই আমার মাথায় একটা ছবি তৈরি হয়ে গেল।


আমি তারপর থেকে সেই ছবিটির মতো এলোমেলো বসে থাকার চেষ্টা করতাম। এখনও অবসরে করি। কেউ যদি আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে, তাহলে কি সে অবাক হবে? তার কি মনে হবে এটাকে এলোমেলো বসে থাকা বলে? নাকি তার মনে হবে আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই বসে আছি, আমার বসে থাকায় কোন নতুনত্ব নেই, নেই অগোছালো বিন্যাস। তাই আমি একা একাই নিবিড়ভাবে চেষ্টা করতে থাকি কতটা নিখুঁত করে এলোমেলো বসে থাকা যায়।


এভাবে বসে থাকলে আমার মাথায় বিচ্ছিন্ন চিন্তাগুলো আসতে থাকে। একেবারে গোছানো-চিন্তা কোন কাজের নয়, সেটা আমাকে পাগল করে দেয় না। পড়ার সময়ে, পরীক্ষায় আগে আমি গোছানো-চিন্তা করি। তাতে করে আমার লক্ষ্য স্পষ্ট থাকে। কিন্তু এলোমেলো বসে থাকার কোন উদ্দেশ্য তো নেই, কারো উদ্দেশেও এই বসে থাকা নয়। এ' শুধু আমার জন্যেই, একান্ত আপন। সেজন্যে আমি এভাবে বসে থেকে রাজ্যের কথা ভাবি। ফড়িঙয়ের মতো দুরন্ত হয়ে ওঠে মগজের কোষ, সিন্যাপ্স- যাবতীয় জৈব-রসায়ন। আমি তখন জুলফি বেয়ে ঘাম কেমন ধীরে ধীরে নেমে আসে সেই কথা ভাবি। আরও ভাবি, বুড়ো আঙুলে চটকে দিলে ঘামের কণার স্রোতটা থেমে যাবে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অবশিষ্ট-ঘাম লেপ্টে থাকবে। আর হাতের বুড়ো আঙুলেও কিছু কিছু চলে আসবে নির্ঘাত; আমি সেই হাত জামায় মুছে ফেলবো। ঘামের চলন কতো বিবিধ, বহুবিধ!


তারপরে আমি আরো কত কথা ভাবি এভাবেই বসে বসে। নিয়মবিহীন ভাবনার সুবিধা হলো কাঠবিড়ালির মতো ডালে ডালে লাফিয়ে চলে যাওয়া যায়। মাথা ব্যথা করছে, মাথার ভেতরে রক্তের নাড়ির মতো দপ্‌ দপ্‌ করে উঠছে এক একটা ধাক্কা। ব্যথাগুলো কি চিন্তার কারণে জন্ম নেয়? এই যে দুর্গম এলোমেলো ঘুরছি মগজের কোষে কোষে, তারা হয়তো নিউরনে খবর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। দৈনন্দিন পরিচিত চিন্তার বাইরে তারা বেশি যেতে চায় না। মানুষের মতোই তারা হয়তো অভ্যস্ততা ভালোবাসে! তাই আজ আমার অলস অত্যাচারে তারা বিরক্ত, নাজেহাল, ব্যথিত। এজন্যে এখন সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে স্নায়ুর রাজপথ দিয়ে, ব্যাপন একটা সুচারু প্রক্রিয়া। এলোমেলো বসে থেকে পায়েও ঝিঁঝিঁ ধরে গেলো। অসাড় হয়ে আসছে পায়ের আঙুল, আঙুলের ডগায় একটা কালো পিঁপড়া পিলপিল করে ঘুরছে- অস্থির! আমার চিন্তার মতোই এলোমেলো তার চলন। পিঁপড়াচলনের পথরেখা কেমন হবে? অমিত সম্ভাবনাময় সঞ্চারপথ। আগে থেকে তো বোঝার উপায় নেই পিঁপড়াটা ঠিক কোন দিকে যেতে পারে। আর বোঝা যায় না বলেই যে কোন দিকে চলাচলের এই বিপুল আশ্বাস নিয়ে নিশ্চয়ই পিঁপড়াটি ভাবনায় জর্জর। আবার নাও হতে পারে। হয়তো এমন কষ্টকর চিন্তা যাতে করতে না হয় এজন্যে পিঁপড়ার মগজ খুব কম। একদিকে কম পেলে আরেকদিনে বেশি থাকে। পিঁপড়ার পা অনেকগুলো, ছয়টা পায়ে তরতরিয়ে অসীম সম্ভাবনাময় পথে সে হাঁটছে, চারণভূমি আমার পায়ের নিঃসাড় বুড়ো আঙুল।


অনুভূতিশূন্য হতে পারাও একধরনের সক্ষমতা। এই গুণ সহজাত নয়, অনুশীলনজাত, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। আমি সেটার অনুশীলন করি না, অনেকে করে, আমি তাদের মুখের রেখার সরলীকরণ দেখে মুগ্ধ হই। দুঃখ-তাপে অবিচলতা দেখে আমার সমীহ জন্মায়। প্রচণ্ড বিপদে বা দূর্যোগে তাদের ইস্পাত-কঠিন স্নায়ু দেখে ভক্তিতে আমি প্রায় মাটিতে মিশে যাই। মাটিতে মিশে যেতে যেতেই আমি দেখি আমার শরীর কালো হয়ে উঠছে। রক্ত শুকিয়ে গেলে কালো হয়ে যায়? বোধহয়। শীতলপাটির মতো কালো মাটি সম্ভবত শুষে নিয়েছে রক্তকণা, শ্বেত, লোহিত ইত্যাদি। নিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, আমি ব্যবসা করতে চাই না তাই লাভের বা লোকসানের চিন্তা নেই। এই সকল নেই নেইয়ের মাঝেও মাথার ভেতরে সূক্ষ্ণ চিল-চিৎকার ব্যথা এখনও সরব! মাটিতে শুয়েই ঘাড় এদিক-ওদিক হেলিয়ে আমি ব্যথাপাচার করে দেয়ার চেষ্টা করি। মাটি সব নিলো, রক্ত-ঘাম-শ্লেষ্মা-ত্বক। খালি আমার এলোমেলো বসে থাকার ভঙ্গিটা নিলো না! আমার ক্রমচলনের মগজকীট নিলো না! আমার পায়ের ওপর ঘুরে বেড়ানো পিঁপড়া নিলো না!

শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০০৯

দৃশ্যকর্মী

১,
বড়ো বেখাপ্‌ ঝুলে আছো ছয়তলার ওপরে বিমর্ষ
তবু হাসিমুখ, দেখি তোমার। ঝুলে থাকা থোকা থোকা
হাসিমুখ। রোদে ঝলসে গেছে সেইচোখমুখ, হাসি।
উল্টোবাদুড় ঝোলা হয়ে দুলছো সরল দোলক।
দেখতে লাগছে বেশ, হাসিটি উল্টে গিয়ে বিষণ্ণতা ঝুলছে


বিষাদের ধর্ম নয় তেমন স্থির, সুতরাং ঝুলে ঝুলে নেমে
আসছে রোদার্ত-ক্ষোভ আর ভয়াটে মোমজ জল,
অশ্রুজল। অভিকর্ষ বড়ো প্রয়োজন, প্রিয়তম আকর্ষণটি
উলম্ব।
তাই ঝুলে ঝুলে অশ্রু নামে, হাসি নামে না- উড়ে যায়
সেভাবেই ওঠা কিংবা নামা মেপে মেপে ছয়তলা থেকে
তুমি নেমেই উঠে যাচ্ছো বেশ! তরতর সুপার-হিউম্যান...






২,
বোঝা গেলো নিচ থেকে দেখা সবই কালো কালো লাগে
আলোবার্তা চলাচলের পথ রাজপথ থেকে দূরে, সেই ট্র্যাকে না পড়লে
কি-ছু দে-খা যা-য় না। কি-ছু চো-খে প-ড়ে না।
অন্ধ লাগে নিজেকে। তাই মনে হয় উপরে উঠি,
উপরে উঠলে পুলক পুলক। অর্গ্যাজমের ঝলক।
মাখো মাখো তরলিত মেঘ,
সুশীল ঘাম মোছো সুগন্ধিটিস্যুতে, ভিজে নমোনমো নরোম হয়েছে সেটি
গুটিয়ে ফেলে দাও ঘামসমেত- আস্তাকুঁড়ে। পাশে আস্তাবল ঘোড়ার গন্ধ আসে
তীব্র গন্ধস্রোত নাকের ভেতরে অযৌন-বাসা বাঁধে
হরিৎ!
এবং আমাদের গলি উপগলিতে নালি উপনালিতে থকথক করে ক্লান্তরমণ।

মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০০৯

Antinoüs

দেখা গেলো প্রচুর রোদ। রোদে সেজে গেছে পাতা ও পথ। পথের পাশে পাথর। এসব ভালো লাগে না। জড়বৎ। এদের কোনো ঘটনা নেই। এবং সে কারণেই দুর্ঘটনাও নেই।
নেই বিপদ, আপদ, ঝঞ্ঝাট বা নিরাপত্তাবোধ। একেবারে বোধহীন শিশুও হয় না। তার চেয়েও অথর্ব এগুলো, চারপাশের উপাদানগুলো।


আমরা কেনো তবে এগুলোকে এতটা মূল্য দেই? এতটা নজর দেই। মানুষের দিকে তাকাই না, মেয়েটার জামা দেখি, জামার ওপরে লাল-নীল ফুল দেখি, জামার নিচে ঘনমেঘ দেখার শখ জাগে। শখের নাম সাধ, যেমন অভিলাষ, যেমন খায়েশ, অথবা যেমন কামনা।


ফুটপাতে হেঁটে গেলে রেলিং দেখি- ওখানে হাতের স্পর্শ করেছিলো কে? কারা যেন ওখানে ঠেশ দিয়েও দাঁড়িয়েছিল প্রতিদিন, বহুক্ষণ! আমাদের জানার আগ্রহ এত কম। তারপরে গাড়িগুলো চলে যাবে আমরা দেখবো হাস্যমুখি টেইল-লাইট। আর ট্র্যাফিকের ময়লা সবুজ পুলিশ। বৃষ্টি নামবে এবং তিনি বর্ষাতি খুলে ছাতার নিচে দাঁড়াবেন। আমরা দেখবো আর ভিজবো।


উপাদান ভুলে এখন বৃষ্টিকে ভালো লাগবে। ভিজে গেলে শব্দটা 'সিক্ত', শুনলে সব শীতল হয়ে আসে। বৃষ্টিও জড়- তবু তাকে নিয়ে কবিতা লেখা চাই। কেন। কেন। চাওয়ার কোনো শেষ নেই বোধহয়। তবে চাইলেই পাওয়া ঠিক নয়। পেলে লোভ বাড়ে। লোভের লেজে করে মেয়েগুলো ফিরে আসে।


এই লেখার মাঝে আমি পুরুষ হয়ে উঠি বারবার। মেয়েদের কথা চলে আসে। কেনো আমি ছেলেদের কথা লিখি না। সুপুরুষ ছেলেরাও সুন্দর, তাদের নিয়েও লেখা যায় তো! আমার লিঙ্গের ছায়া কেন শব্দের গায়ে পড়বে? শিশুদের কথাও তো লিখি বেশ, তারা রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে পুরুষেরা কেন রোদে যাবে না? তারা তো কালোই।


রোদগুলো চেনা গেছে। অন্তর্গত আঁধারের ছায়ায় এতক্ষণ চেনা যাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো ধাঁধাঁনো আলো। আলোতে সব রঙ থাকে বলে ভাবিনি লাল, কি নীল, কি সবুজ বা হলুদ হাসছে! এখন আঁধার সরিয়ে দেখি বিচিত্র বিভিন্ন রঙালো। নারী বা পুরুষ বা শিশু সকলে এসে গেছে আমার চোখের মাঝে। গোল গোল চোখের মাঝে তারা সকলে হাসিমুখে সেঁধিয়ে যাবে গতকাল থেকে আজ বা পরশুতক।


তারপর, অনেকদিন বাদে বৃষ্টি নামবে। নামার পরে আমরা সকলে কেঁদে ফেলবো। লিরিসিস্টগুলো ছাগলের মতো কেন বৃষ্টিকে আকাশের কান্না বলেছিলো? বেকুবি উপমা ছাড়াও তো জড়কে চেনা যায়। আকাশ কেন কাঁদবে। আকাশের কি লিঙ্গ আছে! অ্যামিবা কাঁদে না, এমনকি অণুজীবেরাও হর্ষবোধে ডুবে না। তবে আকাশ কেনো কাঁদার মতো নির্লজ্জ অধিকার পাবে।


বরং আমরা কাঁদি। ভ্রূণপর্ব থেকে কান্নার শুরু জলজ মাতৃকায় হাবুডুবু কেঁদেছি আমরা, জরায়ুঘর থেকে সেই অশ্রু হারিয়ে মায়ের শরীরে মিশে গেছে। তারপরে মায়ের চোখেও পানির ফোঁটাগুলো শিশুর মতো গড়িয়ে নামছিলো। আমাদের মা তখন কেনো কাঁদতেন রাত জেগে?


অদ্ভুত মাতৃকা শুকিয়ে গেলে আমাদের অশ্রুরেখা করতলে জমা হয়। সেখানে অনেক রোদ। না! সেখানে অনেক আঁধার।




***
নোটঃ Antinoüs-এর সম্বন্ধে আরো জানতে এখানে এবং এখানে দেখুন।

সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০০৯

পতনের খবর বিষয়ক বিভ্রম

| | ট্রেনের চাকার সাথে সে পড়ছে | |
এটাই সংবাদ ছিল। শিরোনাম ও সংবাদটি একটি লাইনেই
বিবৃত। পরের কথাগুলো অজরুরি, অনুক্ত। শুধু খবরটি জানা গেলোঃ
সে পড়ছে।
ঘূর্ণায়মান চাকার ভেতরের আঁকিবুকি মুছে গেছে
দ্রুতগতিতে- আর সে পড়ছে, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে
পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। চোখে দেখা দৃশ্যঃ সে উঠে আসছে
চোখ বলে এক, মন বলে ভুল। পতনের শব্দ নির্ভুল।
শব্দহীন।
যে ব্যথাগুলো আজীবন পতনের সাথে জড়িত,
তারা জানেও না কবে প্রথম এই অযাচিত পতন,
ত্বকের গহীনে বসবাস শুরু করেছে। কেবল প্রতিক্রিয়ার মতো
ফুটে ওঠা বা জেগে ঘুমিয়ে থাকা, মরণঘুমের ভান।
ক্রিয়ার পরিচয় তখনও জানা যায় না, প্রতিক্রিয়া বুঝে বুঝে ক্রিয়া
চিনতে হয়, সময় সময়। এই পরিচয়পত্রটি ছাড়াও
বেশ ভুলে থাকা যায় এমন স্বরূপ, মাছের মত।


-ক্রিয়াপদ জ্ঞাত ছিল। ডিজওর্ডারমূলক। তা খানিকটা বৈসাদৃশ
মনে হয়।


এই জ্ঞাত শব্দের শরীরে পতনের রাশি রাশি সূত্রাবলি লেখা ছিল
দু'ইঞ্চি কলামের খাতায়, পাতায়
পাতা ঝরে যাওয়া শোক, গাছের কাঠের ভেতরে জমে থাকে।
আমাদের শরীরেও পতন জমে, গাছের মতোন গোল গোল চক্রাকার বর্ষরেখা জমা থাকে। খুলে দেখো, কি চমৎকার মনেৎ! ছবিতে ভুল থাকে না তোমরা জানো, তারপরেও কেন সন্দেহ এতো, সূত্রাবলি নিয়ে? স্বৈরাচারী নির্দেশ-মোতাবেক এসব ঠিক আছে, সত্য আছে। ঘন গভীরে খুঁজে দেখো, পতন ও ক্রিয়ার মাঝে কোনো মিথ্যা নাই।


তার পতনের সাথে আপেক্ষিক, আমরা, তুমি, আমি, সকলে ক্রিয়াপদ হয়ে ঝুলে আছি। হয়তো? আবার এমন সন্দেহমূলক অব্যয়! আমাদের পতন সম্বন্ধে আর কেউ নিশ্চিত নয় বলে ধরে নেয়া যেতে পারে তোমরা স্থির আছো। পড়ছো না এবং তাকিয়ে তাকিয়ে জুলজুল করে তার পতন দেখছো।

শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

রেলের বিশমুহূর্তে জমাট প্রজাপতি

পাতালরেলের ভেতর হঠাৎ দিনের চমৎকার আলো বা রোদ মেখে


(সম্ভবত) দুটো প্রজাপতি ঢুকে পড়ে


ঝকঝকে রেলের কামরায় তারা ছটফটে দুর্দান্ত হেমন্ত নিয়ে আসে


এভাবে কবিতা এবং জীবন জন্ম নেয়


জানালাগুলো নিশ্ছিদ্র বলে


বেরুবার পথ নেই, নেই চলে যাবার অবারিত উপায়


তাতে দুটো বা অনেক প্রজাপতির কোনো ক্লায়কেশ নাই


জানি


দরোজাগুলোয় কড়িবর্গা নেই, নেই চমৎকার কড়ার কণ্ঠ


সেগুলো নিঃশব্দেই খোলে, বিশ কি তিরিশ মুহূর্তের পরে বুঁজে আসে


আবেশে আপ্লুত চোখে


খুব মসৃণ আমি দেখি বা


দেখি না


দরোজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে তারা বেশ নিমরাজি--


ঘুরছে তখনও চাকাবিহীন দুমুখো শকট


স্টেশন স্টেশন পেরিয়ে যায়


পায়ের নিচে বেরিয়ে যায়


এভাবে কতো অনির্ণেয় জাংশনে প্রজাপতি


(দুটোই ছিলো বোধহয়, নাকি অজস্র?)


সংখ্যা ও পরিসংখ্যানের কি বেমালুম প্রয়োজন, নয়!


তাদের কিছু যায় আসে না, মানবিক স্টেশনে


তারা থামতেই চায় না


গতিশীল অনড় চেয়ার


চেয়ারে আমরা বসে থাকি, গন্তব্যের প্রয়োজনে- উদ্দেশে


মনে হয় কিছু নেই? প্রজাপতিগুলোই কেবল


আছে


দিনশেষে রাতের কালোতেও রঙহীন পাখার ঝাপটানি দেখি


এ কেমন বিম্বাধর আকর্ষণে মেতেছে তারা!




দরোজার পাশে দুটো প্রজাপতি জড়াজড়ি উড়ছে না উড়বে না নিথর চুপচাপ শুয়ে থাকে পাখা নড়ে অল্প বেশি জড়াজড়ি পড়ে থাকে জমে থাকে রেলের কামরায়

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

পাথরের ঘ্রাণ!

কেন চলে গেলে দূরে, ভাসায়ে মোরে সুরে
কেন ফিরে এলে আবার, বাড়াতে দুখের ভার।
কোন কোন গান কেমন অন্তরের ভেতরে শিকড় গেড়ে ফেলে, ভাবলে অবাক হতে হয়!
*
ছোটবেলায় বাসার সামনে একটা পাকা রাস্তা ছিলো। সেই রাস্তার পাশে পিচ আর আলকাতরা মেশানো দুয়েকটা পাথর দেখা যেতো। ঠিকমতো জোড়া লাগেনি তারা। বিকেলের দিকে আমি সাইকেল চালাতে শিখে সেই রাস্তাগুলো দিয়ে অনবরত ঘুরে বেড়াতাম। নিরাপদ, শান্ত কলোনি। কবে যেন মায়ের নিশ্চিত ঘুমের ফাঁকে বিকেল পড়ার আগেই দাউদাউ রোদে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। পিঠের ওপর রোদকে পুড়ানোর কাজে চাকরি দিয়ে আমি বেশ আরামেই সাইকেল চালাচ্ছি। পনেরো কি বিশ মিনিটের মাথায় দমের অভাব আর ঘামের প্রাচুর্যে থামতেই হলো। রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর সাইকেল কাত করে রেখে দিয়ে বসে পড়লাম। হাঁপাচ্ছিলাম, কিছু একটা করতে হয় বলে ঘাস টেনে টেনে ছিঁড়ছি, সেসময় চোখ গেলো খুলে আসা কিছু পাথরের দিকে। ফ্যাকাসে ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে চুপচাপ। হাতে উঠিয়ে ঠুকোঠুকি, গোল গোল খেলা শুরু হলো। দম ফিয়ে এলে আর ঘাম শুকিয়ে গেলে, হাফ প্যান্টের পকেটে পুরলাম। সাইকেল ঠেলে বড়ো মাঠে গিয়ে ক্রিকেট কি ফুটবল দেখেছি মনে পড়ে। ছোট পকেটের ভেতর তখন পাথরে পাথরে মিলমিশ।

**
আমার গন্ধ বিষয়ে খুব আগ্রহ। কোনকিছুর গন্ধ শুঁকলে একটা অবয়ব টের পাই মাথায়, স্মৃতির খাতায় কোন একটা অব্যাখ্যাত প্রক্রিয়ায় কোন কোন সূত্র লেখা আছে সবকিছুরই!
মায়ের ঘরে গেলেই একটা আবছা কিন্তু প্রবল গন্ধ পাই! মায়ের কাঁথা জড়িয়ে নাকের কাছে ধরলে অজান্তেই চোখ বুঁজে আসে। খুব শান্তির ঘুম পায় আমার...। তেমনি জানি আমার বালিশেও একটা নিজস্ব গন্ধ ছড়িয়ে আছে। তারপরে ধরা যাক, কাঠের টেবিল বা বাসার দরজার সামনে রাখা টবের গাছগুলোর একটা মাদকভরা গন্ধ আছে, আমাকে টেনে ধরে মাঝে মাঝেই। কুড়িয়ে তোলা সেই পাথর দুটোকেও আমি প্রায়ই হাতে নিয়ে শুঁকতাম। প্রথম দিকে ধুলোমেশা পাথুরে একটা গন্ধ পেতাম। ধীরে ধীরে বাইরের ধুলো কমতে শুরু করলো, আর জমতে থাকলো আমার ঘরের গার্হস্থ্য-ধুলোর আস্তরণ। পাথুরে সেই গন্ধটা কিন্তু পুরোপুরি গেলো না। টেবিলের ড্রয়ারের কোণে রেখে দেয়া পাথরের গায়ে এমন কী গন্ধ পেতাম আমি, কে জানে!

সবকিছুই একটা সময়ে পুরনো হয়। আমার এই অকারণ গন্ধশীলনও কেমন কেমন করে অনভ্যস্ত আচরণ হয়ে গেলো। ভুলে গেছি আমি সেই পাথরদুটোকে। জীবন ব্যস্ত হয়েছে, আমি তার চেয়েও ব্যস্ত হয়েছি। ঝিনাইদহে পড়তাম, ছুটিছাটায় বাসায় আসা হতো। একেবারে চলে আসার সময়ে ও'দুটো পাথর ব্যাগে করে আমিই এনেছিলাম মনে হয়। বাসার বদলেও আমার অজান্তেই সেগুলো তল্পিতল্পার সাথে গুটি গুটি পায়ে চলাচল করেছে। আর সবশেষে আমার ঘরেই তাদের ঠিকানা হয়েছে। আমার আর পুরনো এই পাথরদুটোর কোন দরকার পড়ে না। চারপাশে কতো অসংখ্য গন্ধের উপাদান!
কলেজের পরে এলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সিঁড়ির গন্ধ আর করিডোর পেরিয়ে ক্লাসে ঢোকার পরে যে মৃদু সুবাস পেয়েছিলাম- তা খুব সহজেই মাথায় গেঁথে যায়! সেদিনই প্রথম জানলাম, "মৃদুতার তীব্রতাই বেশি!" তবে পড়ার চাপে, আর কিছুটা পরীক্ষার ভীতিতে মৃদুসুবাস উড়ে গেলো। কলমের কালি হাতের আঙুলে লেপ্টে যেতে লাগলো, সেই হাত ধোয়ার পরেও সেই গন্ধটা যায় না। একটা সময়ে পাট চুকে গেলো ওখানে। চার বছরের শিক্ষা আর এক বছরের অযথা-অলস "পরীক্ষা-পেছানো-ছুটি" কাটিয়ে পাশ করলাম। চাকরি করতে গিয়েও নতুন ধরনের ব্যস্ততা। রোজ যেতে হয়, চাইলেই অলস অনাগ্রহে এড়ানো যায় না- এ এমনই এক গ্যাঁড়াকল। ছুটির দিনগুলোতে ঘুম চেপে ধরে বিছানার সাথে। "ঘুমা ঘুমা, কালকেই আবার অফিসে যেতে হবে।"
রোজ সকালে পরিপাটি হয়ে যেতে হয় কাজে। জিন্‌স আর টি-শার্টের জায়গায় ঘন ঘন পড়তে হয় শার্ট-প্যান্ট-জুতো। দাড়ি কাটতে হয় দু'তিনদিন যেতে না যেতেই। বন্ধুদের উপহারের সুবাদে কয়েকটা বিদেশি পারফিউমও আমার ঘরে আশ্রয় পেলেন। মাঝে মাঝে তাদের মাথা খুলে শরীরে ছিটাই, ঝাঁকিয়ে নেই। ভুরভুরে সুবাসটুকু ভালোই লাগে। তারপরে ফেরার সময়ে রিকশা-সওয়ার হলে সারাদিনের পরে মুছে যাওয়া সৌরভের জায়গায় জেঁকে বসে ঘাম-ধুলো-ক্লান্তি। রিকশাওয়ালা প্যাডেল টানে, আমি মুছে যাওয়া আলোতে, গাঢ় আধারে নানারকম হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। বেশিরভাগই মিলে না। আর মিলে না বলেই অসমাপ্ত হিসাবটুকু পরের দিন চলতে থাকে। রিকশাওয়ালা কিছু টের পান না, জানা কথা। তার হিসাব আরো অনেক সরল এবং কঠিন, জবাবশূন্য এবং জ্ঞাত।
***
জীবনের নিয়মই বোধহয় এমন যে আমরা যা হারিয়ে ফেলি তার শোক ঠিকভাবে বুঝে ওঠার সুযোগ সে আমাদের দেয় না। বেশি কিছু না, নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি এটুকুই আমরা ঠিকমত মনে রাখতে পারি না। প্রাপ্তিও প্রচুর থাকে হয়তো, অন্তত আপাত-প্রাপ্তির মতো ব্যাপারগুলো উপশমের কাজ করে খুব। তাই হারিয়ে যাওয়া মানুষ, স্মৃতি বা হৃদয়-সম্পদের জন্যে শোকটাও স্তিমিত হয়ে আসে। আর সেটা আসে বলেই নতুনভাবেই আমরা আঘাত সহ্য করতে পারি!

স্মৃতির স্বভাবও গন্ধের মতো হয়ে গেছে, দ্রুত ভুলে যাই সবকিছু। আজকে আমার সব অলসতার গায়ে আগুন ধরাতে সকাল সকাল মা চিৎকার শুরু করলো। "ভাদাইম্যা পুলা। কাজকাম নাই। পড়ে পড়ে ঘুমায়। ওঠ্‌! ঘর গুছা। দুইদিন পরে ঈদ, ঘরের কী অবস্থা! টেবিল চেয়ারে ধুলা। এই ঘরে কি মানুষ বাস করে?" গলাবাজির তোড়ে ধুপধাপ উঠে বসি। তারপরে চোখ কচলে মুখ-হাত ধুয়ে চারদিকে তাকিয়ে মনে হয় আসলেই অনেক ধুলো জমে গেছে! একটা ন্যাকড়া নিয়ে ধুলো ঝাড়া শুরু করি। বইগুলো এলোমেলো, গুছালাম। রাজ্যের সিডি, ডিভিডি পড়ে আছে খোলা, একটা একটা করে প্যাকেটে পুরে আলমারিতে ভরলাম। বিছানা-বালিশের চাদর, ওয়াড় গেলো ধোবার জায়গায়, তারপর ঘর ঝাঁট আর মোছা। একেবারে শেষে, টেবিলের ওপরে খাতা, কাগজ, হেডফোন, চার্জার -ইত্যাদি নানাপদের জিনিস গুছাতে শুরু করলাম। খুব পরিপাটি করে এনেছি, এমন সময়ে ড্রয়ার গুছাতে গিয়ে হাতে পাথরদুটো ঠেকলো।
এক মুহূর্তের থমকে যাওয়া। নিঃশ্বাস নেই। হাত টেনে বের করে আনি জোড়াভাইকে। হাতের মুঠোয় বিবর্ণ ধুলোমাখা, ধূসর পাথর! নাকের কাছে নিয়ে খুব ধীরে শ্বাস টেনে নিই। অপরিচিত গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। বহুদিন পরে কারো সাথে দেখা হলে যেমন মনে হয়, "কোথায় যেন দেখেছি", সামনাসামনি দাঁড়িয়ে যেভাবে আমরা অপ্রস্তুত হই কিছুটা, সেরকম একটা অনুভূতি হতে থাকে আমার। পাথর নিশ্চুপ, আমিও। নির্বাক যোগাযোগেও কোন আলোড়ন ওঠে না মনে। এরপর আমার ঠিক কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারি না। দ্বিধায় দোল খেতে খেতে পাথর দুটোকে আবার ড্রয়ার-গহীনেই রেখে দেই।
ড্রয়ার বন্ধ করে দেয়ার পরে বুঝতে পারি আমি নিজের কাছেই অপরিচিত হয়ে গেছি। হাতের তালুতে করে নাড়াচাড়া করা সেই দুটো অমূল্য পাথর আসলে আমি হারিয়েই ফেলেছি! এখানে যা আছে, তা কেবল স্মৃতিভার, কেবল ক্ষয়াটে আলোর মত ভ্রম।

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

ভূমিকম্পের পেছনের গল্প

আজকাল পৃথিবী দুলছে।
প্রবল, স্থিতধী যে পৃথিবীকে খুব বন্‌বন্‌ করে ঘোরার পরেও
স্থির লাগে আমাদের, সেই অচল শরীর দুলে উঠছে।
আমরা ছোটবেলায় নানা ছেলেভুলানো বিজ্ঞান পড়ে জেনেছি
এই শরীরে কত বিলিওন বছরের তাপ-জরা-শোক
নিক্তিতে মেপে পৃথিবী চুপচাপ নির্বিকার, আছে বেশ!
এমনকি ঘুরছে প্রবল, মুহূর্তে পেরিয়ে যাচ্ছে অসামান্য দূরত্ব।
আমাদের মাঝেও হয়তো একারণেই দূরত্ব বাড়ে, নাকি!

হয়তো, হবে-ই বা কোনো অজ্ঞাত কারণে জুঁই ফুলের গন্ধের সাথে মিশে আমাদের দূরত্ব অমর হয়ে যায়। হায় অমরতা, কী আকুল করছো আমাকে, কী প্রগলভ করছে দেখো তোমাকে! তবু এমন সাদামাটা পথেও আমাদের পায়ের নিচে সব চলিত মন্থর গতি থেমেই আছে-- বহুদিন। কতদিন!
সে কারণে আমাদের মনেই পড়ে না যাপনের ক্লেশ। ঘূর্ণনের কথা বলতে গিয়ে পুরাকালীন বৈজ্ঞানিক কী আশ্চর্য তত্ত্ব দিয়েছিলেন–– 'আমরা ঘুরে ঘুরে কেন্দ্রেই ফিরে আসি, যাবতীয় শক্তিক্ষয়ের শেষে'। অন্যেরা বানচাল করে দিলো ওটা, কী জানি কী যুক্তিতে। আমি যুক্তিবোধে হোঁচট খাই বিধায় মাঝে মাঝে বেভুলে বিশ্বাস করিঃ তিনি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন।
আশায় আমাদের চোখের তারায় ফুলফুল সৌরভ জমা হয়, আমরা তবে কাছাকাছি আসছি!
তখনই পৃথিবী দুলে ওঠে, পায়ের তলে।
ঘূর্ণনের ফাঁকে সে ক্লাশের পড়া ভুলে যায়।নিয়ম মুছে যায় পুরাণের চেয়েও পুরাতন স্মৃতি থেকে।
পৃথিবীর মনেও থাকে না এমন বেখাপ্পা নৃত্যে পুড়ে ছাই হতে পারে কয়েকটি মহাদেশ।
আমাদের, অর্থাৎ তোমার আর আমার
দুটো নেহায়েত অযাচক প্রাণের হিসেব করছি না।
কেবল জরুরি হিসেবে, নতুন শিশুগুলোর অমল হাসিও ফুরিয়ে যাবে এসব বেহিসেবি কাঁপনে,
কোলের ভেতরে ভয়ে শুকিয়ে যেতে পারে ঘাসের তৈরি সবুজ শিশুটিও!

তখনই আমি বুঝে যাই এই দোলনে পৃথিবীর কী বিষম স্বার্থ। কম্পাঙ্কের হিসেবে আমাদের কোনই লাভ হবে না, তবু জানা যাবে মোটিভ। ফাঁস হবে তার দুরভিসন্ধি। চাই কি, আমি অথবা তুমি আমাদের অন্তর্গত ক্রূর রাজনীতির চেয়েও গভীর কোনো ষড়যন্ত্রও ফাঁস করে ফেলতেই পারি!...

মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

মডুলেশন ৮৮


মডুলেট মডুলেট! মডুলেট মানে কী? গুণন?
যোগ। বিয়োগ। নাকি উপরিপাতন, অথবা পতন!


এহেন টানাপোড়েন মোটেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। না! কেননা জন্মেই জানা গেছে
মানবজনম বড়ো বিসদৃশ প্রহার। নিরন্তর দুঃখবোধের সীমিত সাধ্যে
কেঁপে যাওয়া। সকল কম্পনেই কোনো না কোনো বৈষয়িক দিনাতিপাত মিশে থাকে।
আমি এবং তুমি ঝুম বৃষ্টিতে পুড়ে যাই
আমি এবং তুমি গতকাল মরেছি রোদের স্রোতে
এমন জীবন, এমন মরণ বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের
আর তোমাদেরও তো অনেক শোক, তাই না?


তোমরাও জেনেছো প্রতিদিন কেন সবাই হাসিমুখে নীরব হয়ে কথা বলে। পাশাপাশি বসে থাকে। গা ঘেঁষে তাপ নেয়। তাপ দেয় অবলীলায়। তাপমাত্রার পারদ একেবারে স্থির থাকে। সকল জলের বাষ্প জমে থাকার ঘটনাও তোমাদের জানা আছে। বিষুবের কাছে হলে, এ'দেশে অনেক রোদ জন্মাতো, রবিশস্যের প্রচুর ফলনে ভরে যেত হাসিমুখ হাসিচোখ।
কিন্তু আমরা কর্কটের পথের পাশেই থাকি, দূরে বিষুবতীরে কালো মানুষেরা কলস্বরে মেতে উঠলে আমরা বিস্মৃত হই ঘাম। ভুলে যাই ধুলো-আর্দ্রতা।


এখানে সকলে গা ঘেঁষে বসে বসেই সবাইকে ভুলে যায়। আর ভুলে যায় বলেই হাসে, উদ্দাম, বিস্রস্ত হাস্য-কলরেখা চকচকে ঝিলিকের মতো আমার চেহারায় প্রসাধন হয়ে থাকে।


'থাকে' বললে নিজস্ব নিরুপায় নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ হয়। বোঝা যায়, এই দুঃসহ কাজ আমার কৃতকর্ম নয়। নেহাত দৈবাৎ। ঘটে গেছে ঘটমান দূর্ঘটনার মতোন। অপরের ভুলে যাওয়া নিয়ে আমার নিদারুণ অবহেলা ও হাসি-উপহাস কেবলই সয়ংক্রিয় নিষ্ঠুরতা। তবে আমি জানি ভাষার মারপ্যাঁচ। কূটনৈতিক শব্দের ছল, কূটিল চরিত্রের শব্দ দিয়ে খুব সহজেই তোমাদের ধর্ষণ করে ফেলা যায়!


কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে আমাদের পারঙ্গমতা প্রকাশ্য। তাই কারিকুলামের বাইরে আমরা অ্যাকটিভ ভীষণ। দেখুন না, কী সুন্দর ভুলে যাই মনে রাখার সিলেবাসসমূহ! পদ্মপাতার কাঁপন লিখে রাখি খালি বইয়ে, সাদা খাতায়। তারপরে দলছুট বিজ্ঞাপনের মতোই বিবিক্ত উল্লাসে আমরা একে অপরের মাঝে সেঁধিয়ে শুয়ে পড়ি। সেঁধিয়ে গেলে খুব আরাম লাগে–– ওঃ!


কোথা থেকে কোথায় গড়িয়ে সরে যায় জলরেখা। নদীপথ। সেরকম আমার ভাষ্যও বিষম দূর্বোধ্য হয়ে পড়ে। ভাষায় অপ্রতুল, প্রকাশে অক্ষম। সেজন্যে শুরুর মডুলেশন খাই খাই করে ওঠে। ঘুণের জোরে কাটতেই থাকে ভেতরে ভেতরে, আমি টের পাই না। কারে কয় মডুলেশন? গুণ করি, যোগ করি। হাতের কড়ের মাঝে গুনতেই থাকে সাংখ্যিক বিয়োজন। হারিয়ে ফেললাম যেসব। খোয়া গেছে যেগুলো। নিশ্চিহ্নির খবর এসেছে যাদের। হারিয়ে যাবার আগে যারা চিৎকার করেছিলো। সেসব হিসেব আমার মডুলেট করতে হয় নিজের ভেতর, ঐ নিজেদের ভেতরে সেঁধিয়ে যাবার মতোই। ব্যথা লাগে–– কিন্তু কী আর করা!


কেউ কি জানে মডুলেট কেমন হয়? কি হয় এভাবে বদলে গেলে? কর্কটের পাশের ফুটপাতে কোন কোন বাষ্পকণায় আমার এবং তোমার কথা লেখা থাকে?