বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১০

অব্যাখ্যাত কলাম...

লুই আর্মস্ট্রঙের একটা গান আছে। হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড। মানুষ হিসেবে আমরা তো নগণ্য, ক্ষণিক জীবন আর তার যাতনাতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে থাকি। তাই চোখ মেলে অনেক সময় চারপাশের সৌন্দর্য দেখা হয় না। এ পার্থিব জগত কতো সুন্দর! কতো নৈর্ব্যক্তিকভাবে সুন্দর! অর্থহীন এ প্রবল আবেগ, এ নদীর স্রোতের মতো দৃশ্য। কুলকুল করে বয়ে চলছে চোখের সামনে। চোখ মেলে দেখতে দেখতে একটা সময় দৃশ্যগুলো সব কিছু নিস্পৃহ করে দেয়। মুগ্ধতার পারদ সীমা ছাড়িয়ে গেলে বোধহীন জড়ের মতো চোখ মেলে রাখি। সেখানে কোনো রূপ-রস আর তাড়না জন্মাতে পারে না। তখন একটু চোখ ঝাপটানো লাগে। মানুষের চোখের পলক ফেলার গতি শুনছি খুব বেশি। দ্রুততায় চোখের পলক ঝাপটানো - তারপর আবার দৃশ্যরাজি।

আমি মনে করি দৃশ্যের কোন ভালো খারাপ নাই। সৌন্দর্য ও রূপের কোনো সংজ্ঞা নাই। অপার্থিব বলেও কোনো কিছু ব্যাখ্যাত নাই। আমরা যা দেখি, যা বুঝি, যা অনুভব করি, সবই পার্থিব। অপার্থিব, ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কোনো জায়গা নাই। তবে অব্যাখ্যাত অনুভব আছে আমাদের। কারণ আমাদের ভাষা শক্তিশালি না। এই ভাষার দৌর্বল্যে আমরা দুর্বল অনুভবের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি। একটা কিছু 'ফীল' করলে, সেইটারে সংজ্ঞায়নের মধ্যে ফেলি, দেখি খাপে খাপে মিলে কি না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এটা ফিট করে না। কোনো সংজ্ঞাতেই মিলে না। তখন নিজেরে বুঝ দেই যে এইটা 'অপার্থিব'। যে জগত আমরা দেখি নাই, জানি নাই, সেইটার নাম দিয়ে দিলাম অনায়াসে। ভাবলামও না, এ যেন ওই চোখের পলক ফেলার মতো একটা রিফ্লেক্স। কিন্তু এইটা ঠিক না। পার্থিব অনুভবকে নাম দিতে না পেরে, আমরা সেটা অপার্থিব কোয়াড্রেন্টে পাঠায় দিতেছি!

তাই আমি এখন অব্যাখ্যাত নামে একটা কলাম বানাইলাম। এই কলামে রাখবো ভাষিক সীমানার বাইরের সব কিছু।


একদিন রাস্তায় পা হড়কে পড়ে যাবার সময় যে পতনের অনুভব হলো - সেটাকে এখানে রাখলাম। এলোমেলো হেঁটে যাবার সময় আজকাল মাঝে মাঝে অমন করে পড়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু যদি প্ল্যান-প্রোগ্রাম ঠিক করে পড়ে যাই, তাইলে তো আর সেটার মতো হইলো না। তাই অপেক্ষা করি, কোনো একদিন তো আবার বেখেয়ালে পড়ে যাবো। ফুটপাতে ব্যস্ত পায়ের খটাখট চলে যাবার মধ্যিখানে আমি স্থানুর মতো পড়ে থাকবো। দ্রুত পায়ে দৃশ্যগুলা সরে সরে যাবে। আমার অস্থির লাগবে, মনে হবে তাড়াহুড়া, কোথাও যাওয়ার ছিলো, ভুলে গ্যাছি। মগজের রুমে রুমে আঁতিপাতি করে খুঁজবো, "কোথাও যাওনের কথা ভুইলা গেলাম!"

তারপর একদিন ক্লাসে অমনোযোগি। দেখা গেলো সেইদিন স্যারের চোখ আমার উপরেই পড়লো। দাঁড়া করায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "এতোক্ষণ কী বলসিলাম?" মুখ ফসকে বেরুচ্ছিলো, "তা আমি কী জানি?", সামলে নিয়ে বলে দিলাম কিছু একটা। তারপরে অপমান হয়ে গেলাম অনায়াসে, স্লোমোশনে স্যার শিকে বিঁধায়ে রোস্ট করলেন। ক্লাস জুড়ে হাসির কল্লোল। উল্টোদিকের করিডোর থেকে দুয়েকটা মাথা ঘুরে তাকালো, ভেতরে ঠাট্টারসে ভিজে ভিজে আমি দাঁড়ায়ে থাকলাম। সেদিন সারাদিন ধরে সেই ঠাট্টারস গায়ে চ্যাটচ্যাটে লেগে রইলো। মোছার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই গ্যালো না। ক্ষণে ক্ষণে আমাকে দেখে চত্বরের গাছগুলাও পরিহাসের হাসি হেসে উঠছিলো!

অথবা যেদিন শীতের মধ্যেও হেঁটে হেঁটে শহর পাড়ি দিলাম। অনেকগুলো সিএনজি, রিকশা আর বাস আমাকে ডাকাডাকি করছিলো। মাফলার জড়ানো, কোট চাপানো মানুষগুলো হেলে দুলে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়ছিলো সেগুলায়। আমি পিছায়ে রইলাম। আমার হুড়োহুড়ি করতে ভালো লাগছিলো না। আমার কোথাও পৌঁছানোর তাড়া ছিলো না। অস্থির এই দৃশ্যটা আমার ভালো লাগছিলো, তাই আমি দেখছিলাম। দেখতে দেখতে অনেকগুলা বাসহাতিঘোড়া চলে গেলো। তারপর আমি হুড তুলে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার আগেপিছে কিছু মানুষও হাঁটছিলো হনহন করে। আমি অতোটা জোরে আগাই নাই। ধীরে বহে যমুনা। রাস্তা পেরুলাম বিনা সিগন্যালে, শরীর বাঁচায়ে। গাড়িগুলোর কৃপা আমারে ধাক্কা দ্যায় নাই। চারপাশে শা শা করে অনেকগুলা গাড়ির ভীড়। শীতের রাত এই সন্ধ্যা নামতেই! মৃদু কনকনে, তাই জবুথবু বাঁকা হয়ে আমি এগোতে থাকি। ফুটপাতগুলো এখানে ফাঁকা, হকারদের তাড়ায় দিছে কেউ। হাঁটতে গিয়ে এলোমেলো লাগে। নানা কিছু ভাবি। একদম একা বলে কেউ ভাবনায় ভাগ বসায় না। চারপাশে বড়ো বড়ো দোকানের আলো জ্বলে উঠছে। জ্বলজ্বলে শহর ক্যামন কাতর চোখে তাকায়। আমারে ডাকে, আমি আজ তার ভোক্তা হইলে, রাতের কামাইটা পুরা হয়। আমি এই সম্ভাষণে ভুলি না, বুঝতে পারি এইটা মেকি। আমারে সে চেনেও না। গত পঁচিশ বছরেও চেনে নাই, আর চিনবেও না। এই শহর কাউরেই চিনতে পারে না।


এই সব অব্যাখ্যাত অনুভবগুলারে সাজাইতে সাজাইতে কলাম ভরে ওঠে। উপচায়া পড়ে। তার অনেক পরে একটা সময় আমি বাড়ি পৌঁছায় যাই। নিজের ঘরে ঢুকতেই অনেকগুলো কোলাহল জাপটায় ধরে। আমার একটুও ভালো লাগে না!

মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০

এখানে একটা শিরোনাম বসিয়ে নেন

এখানে 'নতুন ব্লগ লিখুন' লিংকটা একদম মুখের 'পরে, প্রথম পাতায় যাবার পাশেই। তাই মাঝে মাঝে মাউসের ভুলে এদিক ওদিক হয়ে যায়। প্রথম পাতার বদলে আমি খেরো কাগজে চলে আসি। মাউসের মন খুশি হয় একটু। সে এখন রেহাই পাবে কিছুক্ষণের জন্য। খটখট খটখট আঙুল পড়বে কিবোর্ডের ওপর। এই অবসরে মাউসটির মন আরো একটু খুশি হয়। খুশিতে তার লেজ নড়ে। এদিক ওদিক নড়তে থাকে সে। তলায় মাউসপ্যাডটা পুরনো হয়েছে। ঠিকমতো মাউসের পা বসতে চায় না, পিছলে পিছলে যায়। তাই লেজ নড়ে। আমি লেজ নড়া থেকে চোখ সরাই। মাউসটার মুচকি হাসি দেখে কিছু বলি না। কিবোর্ড একটু হতাশ হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

মাঝখানের ইংরেজি হরফগুলো দেখলেও আমার বাংলা হরফ মনে পড়ে। হরফগুলোর সাথে অনেকদিনের সখ্যতা। আমি ব্লাইন্ড টাইপিং পারি না, মানে মনিটরে তাকিয়ে খটাখট লিখতে পারি না। তবে এখন বাংলায় মনে হয় কিছুটা পারি। আমার মগজের কোন এক লোব বা কোন এক গুহায় পুরো হরফের ছবিগুলো ছাপা হয়ে গেছে। আঙুলগুলো একটু উঁচু করে রেখে কোন স্পর্শ ছাড়াই এগুলো নড়াতে পারি। ক খ গ ঙ (ঘ কাজ করে নাই, বেয়াদ্দপ!)

এর পরে অনেকটা লেখা হয়। লেখাগুলো কেন হয় জানি। আমি লিখতে চাই বলে। আমার ক্ষুধা লেগে যায় লিখতে লিখতে। লিখে পেট ভরানো গেলে আমার ক্ষুধা লাগতো না কখনোই। আমি অনেক লিখি। লিখতে লিখতে যখন হাঁপিয়ে যাই তখন একটু অবসর নেই, সেই অবসরেও লিখি। এক লাইন লিখে শেষ করতে করতে মাথার ভেতরের কোনো এক গুহায় তিন চারটা লাইন হারিয়ে গেলো। ধুৎ। এভাবে হয় না। যদি বলে বলে টেইপ রেকর্ডারে সব পুরে ফেলা যেতো, তবে মনে হয় আরো একটু লেখা বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু সেটাও তো সমস্যাজনক। দেখা যায় যে বলতে বলতেই মাথায় আরো কয়েকটা লাইন পুড়ে যায়। সেই পোড়া লাইনগুলো উদ্ধার করতে পারি না। মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ছিঁড়বো না। বেশি নাই। টাক পড়ে যাবে শেষে বিয়েশাদি নিয়ে টানাটানি। টানাটানিতে আরো চুলহ্রাস, শেয়ার বাজারের মতো দাম পড়ে গেলে মুশকিল!

লেখাগুলো জমিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে জমানো লেখা একা একাই মরে যায়। চুপচাপ। তাদের ফিউন্যারেল দেয়া হয় না। একা একা কেমন করে ফিউন্যারেল দেই? কেউ তো দরকার, শোকবার্তা নিয়ে আসবে। একটু কালো পোশাকে কাঁদবে। চোখের কোণ মুছবে শার্টের খুঁট দিয়ে। আমি সেই দৃশ্য দেখে শান্তি পাবো - আমার মৃত লেখার জন্য কারো কান্না পাচ্ছে ভেবে। আমার গর্ব হবে। আমার খুশি লাগবে। গর্ব খুশি মিলে ঝালমুড়ি হয়ে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিবে। আপাতভাবে দেখলে লেখাটার কিছু যায় আসে না। সে মরে গেছে বলে সে জানেও না আমি কেমন কেমন করছি তার জন্য। সব যায় আসে খালি আমার। লেখা মৃত্যুতে কষ্টও আমার, অন্যের কান্না দেখে প্রশান্তিও আমার।

এরপর সময় গড়ায়। ধীরে ধীরে নতুন লেখার জমে ওঠে। সেগুলো এডিটর বক্স ভরিয়ে দিতে থাকে। ভরাতে ভরাতে আর জায়গা কুলায় না। পাশে একটা স্ক্রলার জন্ম নেন। তিনি নীলচে রঙের, নতুন এলেন এডিটর বক্সের পাশে, বক্স তাকে জায়গা করে দিয়েছে। একটু একটু করে এই স্ক্রলারটির আকার ছোট হবে। আর তিনি নিচে নামবেন। অধঃপতন! হা হতোস্মি। নামতে নামতে আর ছোট হতে হতে তিনি অভিশাপ দেবেন - আঃ মরা! এতো ল্যাখে ক্যান শালা!!
কিবোর্ড অভিশাপ শুনে ভয় পাচ্ছে, একটু একটু ধীর হয়ে আসছে। ব্রাউজারটাও ভীতু, বেটা এমনিতে খাইতে খাইতে ভারী হইছে, অথচ সাহস জন্মায় নি একরত্তি। ধরে চটকানা লাগাতে ইচ্ছা করতেছে।

ব্রাউজার এগুলো শুনতে পেয়ে আরো ভড়কে গেলো। ধীরে ধীরে চলছে সে। দেখে শুনে, কখন ঠাশ করে একটা চটকানা মেরে দিবো, এই ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গেলো। আমারও রাগ টঙ হয়ে উঠে বসে থাকে, সহজে নামবে না। রাগের মাথায় কতোগুলো গালিগালাজ করি। সেগুলো টাইপ করে বেচারা কিবোর্ডও গলাখাকারি দেয়, য়্যাহেম। ওর অভ্যাস নাই তেমন। গালি নিয়ে ট্যাবু আছে কিছুটা। নিজে যখন শাপশাপান্ত করে, তখন কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি জোর করে টাইপ করলেই তার টনটনে টনক টিকটিক করতে থাকে। ব্যাটা টিকটিকি!

থাক, মুছে দিলাম। ব্যাকস্পেইস চেপে ধরে রাখলাম যতোদূর পর্যন্ত শাদা না হলে স্বস্তি হয় না ততোদূর। মুছে গেলে সব ফাঁকা হয়ে গেলো। ধবধব করছে ঘরটুকু। ঘরে আসবাব নেই। কার্পেট নেই। ঝাড়বাতি দূরে থাক, টিমটিমে ফিলিপসের বাত্তিও নেই। একটা কালো "ক" ঝুলছিলো বক্সের নিচে, এক কোণে, একা। হাতের চেটোয় ঘাম মুছে ফেলার মতো ওটাকেও মুছে ফেললাম। যাঃ



গতস্য শোচনা নাস্তি। গতস্য শোচনা নাস্তি। যা চলে গেছে, তার জন্য সন্তাপ করো না। কে বলে? কোন উন্মাদের মাথায় এই শ্লোক এসেছিলো? সে কি য়্যাল্‌ঝেইমারের রোগী? সে কি বুঝেই না গতস্যদের জ্বালা। সবচাইতে কড়া মদের চাইতেও বেশি পোড়াচ্ছে সেইসব গতস্য। শোচনা। শোচনা। অনুশোচনা। গ্লানি। "একবার শেষ দেখা যদি পাইতাম"। নাস্তি। নাস্তি। তুই নাচতি? শোচনার পিঠে চড়ে তুই নাচবি নাকি? নাচ, গড়াগড়া দিয়ে নাচাবে তোকে এই ভুরভুরে ভ্রূকূটিল শোচনা। তোর মুক্তি নেই, পায়ে মলমল।

মাঝে মাঝে আমরা ইচ্ছা করে শোচনা তৈরি করি। নিজ হাতে গলা টিপে গ্লানি বাড়াই। হাতের আঙুলের চাপে কতোগুলো নিরীহ অক্ষর মারা পড়ে। অক্ষরের সাথে আমার কিছু স্মৃতি ধুয়ে মুছে যায়। ওগুলো আর ফিরে পাবো না। তাই এক্সপোনেনশিয়ালি আমি শোচনায় ডুবতে থাকবো। কেউ কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না। চুল এলোমেলো করে দিবে না। বলবে না, 'ব্যাপার না'। আসলে তো ব্যাপার। খুব জরুরি ব্যাপার না হলে হয়তো এভাবে মুছতাম না, এভাবে ভুলে থাকতাম না। ভুলে থাকার গুণ রপ্ত করতে কয়টা জন্ম লাগবে? কয়যুগ ঘুমালে মাথার ভেতরের এই শোচনাকুল দিনরাত্রির শ্লোক মুছে যাবে?
- ভোরে ঘুমিয়েছি - দুপুর তাই সকাল - বিকেল তাই আমেজ - - রাত মজে হলো সন্ধ্যা - নিশুতি হয়েছে জেগে থাকা প্যাঁচা -
- ভোর থেকে নিশ্চুপ নীরবতা - এভাবে মুহূর্তের গুণ সময় -
- আর সময়ের গুণ ঘন্টা - মিনিট - অহ্ন -
- এভাবে তার ছিঁড়ে রেখেছে কেউ -
- টাওয়ার বানায় নি তাই দুঃখিত হয় মেয়েটি -
-এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে নাহ -
- যাআহ ফোট্‌ !!! -



******
দ্র - শিরোনাম কৃতজ্ঞতা - কবি আন্দালীব

অচেনা ইলিয়াস...

কেউ যে চরিত্রে বা আচরণে স্বচ্ছন্দ নয়, সেখানে তাকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। নতুন নতুন মনে হয় তাকে। এবং অস্বাচ্ছন্দ্য বলে, খুব সজাগ হয়ে আছে সে। বুঝতে পারি সে অপরিচিতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে চারপাশের সাথে যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছে। এভাবে তাকে বিপাকে পড়তে দেখে আমার ভালো লাগে। তাকেও ভুলভ্রান্ত মানুষ মনে হয়। যে কাজগুলো সে অনায়াসে করতে পারে, সেগুলো দেখে দেখে মনে ঈর্ষা জন্মেছিলো, সমীহ করার, মাথা ও মন অচিরেই নুয়ে পড়ার অনুভব তৈরি হয়েছিলো। সেটা ধীরে ধীরে কেটে যায়। তাকে আর ওভাবে শ্রদ্ধা ও সমীহ করতে হবে না জেনে আমি হাঁফ ছাড়ি। এখন থেকে তাকে আমার আরো একটু আপন মনে হবে। ফর্মালিটি কারই বা ভালো লাগে, তাই না?

তো, যার কথা বলছিলাম, 'তুমি' সম্বোধন করলেও সে অনেক বড়ো লেখক। গুণী তো বটেই, তারচে'ও বেশি প্রচণ্ড তার প্রকাশ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বাংলা উপন্যাস আর গল্পকে অনেকাংশে ট্যাবুহীন করেছেন তিনি। পুতুপুতু যে ভালোমানুষি গদ্য, সেখানে বাবুমশাই ব্রিটিশ আমলে ধুতি পড়তেন আর পাকিস্তান আমলে পড়তেন পাজামা-পাঞ্জাবি। সেইখানে প্যান্ট-হাফশার্ট অথবা লুঙ্গি পরা লোকগুলোকে চিৎকার করার জায়গা করে দিয়েছেন ইলিয়াস। এবং সে ভাবেই তিনি পরিচিত হন, সবাই তাকে সেভাবেই চেনে।

আজকে বই নাড়তে নাড়তে তাঁর কবিতা খুঁজে পেলাম। অবাক অবাক কৌতূহল জেগে উঠলো। খুব বেশি কবিতা লেখেন নি তিনি। হাতে গোনা কয়েক পাতা। বেশিরভাগই সম্ভবত তার সন্তানের জন্য, শিশুতোষ ছড়ার মতো কবিতা। শুধু দু'তিনটে কবিতা নজর কাড়লো, ইলিয়াসীয় ঢঙ, ঝাঁজ আর ভাষার ব্যবহারের কারণে। সেই উপন্যাসে পাওয়া কথাগুলোই অন্যচেহারায় ফিরে এলো।


স্বপ্নে আমার জন্ম
ঘুম
শুধু ঘুম
আমরা ছিলুম
সাত বিলিয়ন সাতাশশো ভাই;
শান্ত প্রবল তীক্ষ্ণ হাওয়া এলোমেলো
শিশির শরম, পূর্ব থেকে নরম আলো,
আমার বাবার মোমবাতিকে সবুজ কাঁপাই।
লবণ-লালে বলকানো পাপ আব্বা দিলো শান্ত সাঁতার
কাঁপা কাঁপা, অল্প তবু কি উদ্‌ভ্রান্তি গভীর ব্যথার
হাজারটা ভাই আকাশ উপুড় ওম্বে গাইছে তারার ফোঁটা,
জ্যোৎস্না রাতে ভাসছি সবাই এশার আজান হাওয়ায় লোটা।
গোলাপ থেকে, আপেল আমের আদর থেকে আগুন থেকে মায়ের ফেনা
নিষিদ্ধ সব গলি বেয়ে দিন রাত্রি বয়ে আনে, জীবন নামক জানাজাটা
'তারচে চলো শেষ হয়ে যাই।' ক্রেজি কণ্ঠ কাতর হলুম, 'ভাল্লাগেনা ভাল্লাগেনা'
বলতে বলতে ওয়েনিঙ স্বর তারার মতোন আত্মহত্যা করলো ওরা,
সাধও হলো, বিলীন হলো, দ্যাখো দ্যাখো নেই মানুষের নীরব ঝরা।
'আমিই একা, কী-যে করবো, হায় হায় এই চোপসানো ও লুপ্ত বুকে
ক্লান্ত ক্লাউন, আঁকাবাকা আঁধার ওম্বে একাই মরি ধুঁকে।
আম্মা তখোন বিবমিষায় উপুড় হলো দন্তবিহীন মুখে।
সাগর-শোষা, আগুন আওয়াজ, কোরান-কালো আলোর গ্রহে
ল্যাজ গুটানো, নেই নেই লোম, ছিন্ন শিশ্ন, কুঁজো হয়ে
এদিক ওদিক করুণ তাকাই, গলিয়ে পড়ি,
সে উনিশশো তেতাল্লিশের ফেব্রুয়ারি।
বমির টুকরো মোহিত মগ্ন
ঘুমের মধ্যে ঘামি
লোনলি লগ্ন
আমি।


====================


এলেমজির জন্য শোক
আমার এলএমজি, এলএমজি, এলেমজি আজ
কোথায় গিয়েছ তুমি? কতোদূর, বলো কোন লোকে
নিরুদ্দেশ যাত্রা করো? শীতল শরীরে রক্ত শিখা
জ্বেলে দাও অন্ধকারে, ব্রাশ করো কোন সেক্টরে?
তোমার ট্রিগারে কার কিশোর তর্জনী টানে গান,
পূর্বজন্ম, মৃত্যু, সাধ? সুপ্তশিশ্ন ব্যারেলের কাম
এ্যামবুশ করে কার রক্তে? তুমি কার অধিকারে?
এলেমজি, তুমি ছিলে হাত জোড়া, বুক জুড়ে, বুক ভরে ছিলে।
তুমি ছিলে, ক্রোধ ছিলো; প্রতিহিংসা ছিলো; হৃৎপিণ্ডে
ঘৃণা; বাঁচবার নির্লজ্জ স্পৃহা। যাবার বেলায়
মহারাজ, ঠাণ্ডা ঠোঁটে শুষে নিলে সব, তুমিই তো
একদিন দিয়েছিলে। তুমি নাই, প্রতিহিংসা নাই;
ঘৃণা নাইল তুমি নাই, ক্রোধশূন্য বুক আজ ফাঁকা।
হৃৎপিণ্ড নিদারুণ খালি, বুক নাই, চাঁদে চাঁদ
নাই। স্পৃহাশূন্য হাতে কেউ এসে গুঁজে দেবে - নাই।


====================
মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষেরা অস্ত্রগুলো হাতে না পেলে হয়তো একাত্তরে এতোটা আত্মত্যাগী হইতে পারতো না। অস্ত্র হাতে আসার আগে আমরা ভীরু, পলায়নপর, ম্রিয়মাণ জাতি হিসেবে বেড়ে উঠেছি, অস্ত্র সরে যাবার পরে আবারও সেই রকম হয়ে গিয়েছি ধীরে ধীরে। (দীর্ঘশ্বাসের ইমো) ...

বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১০

ভালো কাজ

বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে গিয়ে "মনের মানুষ" ছবিটা দেখে আসছি। গৌতম ঘোষ পরিচালক, দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনার ছবি। অনেক আগে গৌতম ঘোষ পদ্মা নদীর মাঝি বানিয়েছিলেন। দেখে হতাশ হয়েছিলাম। কোন উপন্যাসের লাইন বাই লাইন দৃশ্য রচনা করে জুড়ে দিলেই সেটা চলচ্চিত্র হয়ে যায় না। এইটা গৌতম ঘোষ জানলেও, মানেন না। এদিকে "মনের মানুষ" বইটা পড়া হয় নাই (সুনীল গাঙ্গুলির লেখা), তাই ভাবলাম ছবিটাই দেখে ফেলি। কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁইয়ের জীবন নিয়ে বানানো ছবি।

লালনের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ, লালনের গুরুর ভূমিকায় রাইসুল ইসলাম আসাদ। এখানে গিয়েই বিপত্তি বাঁধলো। এরই মধ্যে লালন হিসেবে আসাদের চেহারা ও অভিনয় মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো। সেখানে প্রসেনজিৎকে বসানো খুব কঠিন। আর যেহেতু ওপারের পরিচালক (এবং লেখক) সেহেতু গল্প শুরু হলো লালনের পোর্ট্রেট করছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর - এই দৃশ্য থেকে। সেখান থেকে ফ্ল্যাশব্যাক। লালনের তরুণ জীবন। বিবাহিত ও সুখী লালন, সরলসোজা, গান গায়, বৈষয়িক তাড়না নাই, গাঁয়ের মোড়ল বা কর্তার ঘোড়ার দেখভালের দায়িত্ব পেলো। দৃশ্যধারণের এই খাপছাড়াভাব দেখে সুনীলের বইটা পড়ার শখ হলো। এখানে কেন এরকম? 'সেইসময়' উপন্যাসে যেমন সুনীল জাম্প-কাট করতেন, সেরকম ভাবে এই বইটাও কি লিখেছেন নাকি? গৌতম ঘোষ কেন এভাবে শুরু করলেন।

ভাবতে ভাবতেই লালনের অসুখ। জলবসন্ত, চিকিৎসাহীন ও নিরাময়হীন। তাই সবাই মিলে গঙ্গায় (পদ্মায়) ভাসিয়ে দিলো। বাঁশের ভেলার ওপর মশারি, শাদা চাদর গায়ে মুমূর্ষু লালনের দেহখানা ভেসে চলছে। ঢেউ ছাড়া চরাচরে কোন শব্দ নাই। এইখানে দৃশ্যের সাথে শব্দের যে মিল, সেটা চমকে দিলো। এখানেই বলে রাখি কারিগরি দিক থেকে ছবিটি দারুণ লেগেছে। লালনের ছবিতে যদি শব্দধারণ ভালো না হতো, তাহলে ভালো লাগতো না। চিত্রগ্রহণের ব্যাপারেও একই কথা, ভোরের কুয়াশামাখা নদীর পাড়, অথবা রাতের চন্দ্রালোকিত কুটির - সবই অদ্ভুত আলো-ছায়া-রহস্যমাখা মনে হয়েছে! লালনের নাম ও জীবনের সাথে যে রহস্যময়তা, সেটা এখানেই ফুটে উঠেছে!

ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত জমজমাট ছবি। গান, সুর, অভিনয়। আসাদ-চঞ্চল-পাওলী দাম, তিনজনের চরিত্র খুব চমৎকার লেগেছে। লালনের স্ত্রীর চরিত্রের অভিনেত্রী এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রও টেনে নিয়ে গেছেন। ডুবিয়ে দিয়েছেন লালনের মায়ের চরিত্রে চম্পা (তার একটা খুব ক্রুশিয়াল দৃশ্যের অতি-অভিনয়ে হলের ভেতরেই লোকজন হাসতে শুরু করলো, অথচ দৃশ্যটা খুবই সিরিয়াস ছিলো), এবং পরে লালনের সেবাদাসী হিসেবে এক অভিনেত্রী। বিশেষ করে পরের জনকে কেন কাস্ট করা হয়েছে তা বুঝলাম না। একেবারেই অভিব্যক্তি নাই!

গৌতম ঘোষের মূল দূর্বলতার জায়গা দেখলাম ক্লাইম্যাক্স এবং ফিনিশিংয়ে। ছবির আমেজ অনেকটাই কেটে গেলো শেষে এসে। তবু কিছু ছবি দেখে এসে যেমন সেই ছবির ভেতরের জীবনধারা নিয়ে আগ্রহ লাগে, একটু গুগল করতে ইচ্ছা করে, একটু জানতে আর পড়তে ইচ্ছা করে, এই ছবিটাও সে'রকমই। গানের মাঝে সবগুলোই ভালো লেগেছে। দুয়েকটা গান শেষে গিয়ে একই থিমের কারণে একটু ধরে আসলেও অসুবিধা নাই। উপরি পাওনা, চঞ্চলের কমেডি। ধীরে ধীরে বাংলা সিনেমার এই ধরনের রোলগুলো তিনি কব্জা করে নিচ্ছেন!

এখন লালনের গানগুলো শুনছি। কিছু কিছু জিনিস অনেকদিন পর শুনলে মন ধুয়ে মুছে যায়। মাঝে হয়তো মনে অনেক শ্রান্তি আর ক্লেশ জমে গেছিলো। সব কেটে যাচ্ছে!

বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১০

এ বিট অফ...

আজকে সারাদিন ভ্যানভ্যানে বৃষ্টি হইছে। আমি সকাল সকাল উঠছি। তারপর থেকে মুড ঠিক করার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে ঠিক হৈছে, তারপরে আবার বিগড়ায় গেছে। কী করবো, ফুয়েল নাই।
শেষে আমার শেষ সম্বল ইউটিউবে ঢুকলাম। এখানে ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায়। চার্লি বিট মাই ফিঙ্গার, আর ফ্রিকের মতো হাসে এমন দুইটা পিচ্চিকে তো আগেই সবাই দেখছেন। সেগুলোর মতো চিজদের পাইলেই আমি দেখে শুনে রাখি। এরা বেশি স্পেশাল।
এরা ছাড়াও আরো কিছু লোকজন আমার খুব ভালো লাগে। একজন জর্জ কারলিন, স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান। এরকম আরেকজন আছে, রাসেল পিটার্স । জর্জ কারলিন অনেক পলিটিক্যাল, সোশ্যাল ট্যাবু আর ইস্যু নিয়ে পঁচায়। রাসেল তার বহুসাংস্কৃতিক ও বহুজাতিক বাস্তবতা নিয়ে পঁচায়। এই সুযোগে আরো কিছু কমেডিয়ানের স্ট্যান্ডআপ দেখা হয়ে গেলো।
তবে এদের সব কিছুর চেয়েও ক্লাসিক হলো ব্রিটিশ কমেডি। হলিউড যতোই স্পেশাল ইফেক্ট দিক আর চেষ্টা করুক না কেন, ব্রিটিশ কমেডির মতো দম ফাটানো এবং পেটে খিল ধরিয়ে দেয়ার মতো কমেডি বানাতে পারবে না। ব্রিটিশ কমেডিগুলোর তেমন চাকচিক্য নাই, প্রিন্টও খারাপ। কিন্তু সংলাপ বা ম্যাটেরিয়ালের দিক থেকে এতো দুর্দান্ত কিছু নাই!

 অনেকে House, M.D. সিরিজের অভিনেতা Hugh Laurie - কে চিনতে পারেন। বেরসিক, কাঠখোট্টা, ড্রাগঅ্যাডিক্ট এরকম ডাক্তার রিয়েল লাইফে থাকলে তাকে সবাই ধরে মাইর দিতো। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানে না যে হিউ লরির অভিনয় জীবনের সেরা কাজ এই হাউসে না। হিউ লরি তার নিজের সেরা অভিনয় দেখিয়েছে ব্রিটিশ কমেডিগুলোতে। ব্ল্যাক অ্যাডার-এর তৃতীয় সীজন থেকে শুরু। আর পুরোদমে হিউ লরির ক্যারিশমা দেখলাম A Bit of Fry & Laurie সিরিজে।


মাত্র দুইজন অভিনেতা - Stephen Fry আর Hugh Laurie। "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানে যেমন ছোট ছোট স্কিট দেখায়, ছোট ছোট ঘটনা বা জোকস, এই পুরো অনুষ্ঠানটাই সেরকম নানা অংশে ভরা। একেকবার তারা দুইজন একেক সাজে আসে। সাজের সাথে সাথে মুখের ভাষা আর অ্যাকসেন্ট বদলে যায়। আর বেশিরভাগ অনুষ্ঠান শেষ হয় হিউ লরির একটা করে গান দিয়ে। খুব পপুলার একটা পাঞ্চ লাইন ছিলো - ফ্রাই বলতেন, "Please Mr. Music, will you play?" তখন দেখা যেত এক এক রকম সাজে পিয়ানোর সামনে হিউ, বাজাচ্ছেন তার নিজেরই লেখা কোন গান, অথবা কোন বিখ্যাত গানের রিমেক করে বারোটা বাজাচ্ছেন! আজকে অসংখ্য ছোট ছোট স্কিট না দিয়ে খালি গানগুলো দিলাম। পুরাই বিনোদন!!
America: 
=====================================
Mystery:

 =====================================
Little Girl:

 

মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১০

নতুন বাজার

মোড়ের কোমরের কাছে বেঁকে গেছে। গাড়ির হর্ন আর রিকশাওলাদের ক্যাচাল। শীত শীত আরাম বাতাস। একটু আগেই রোদ ছিলো, এখন মেঘ ঢেকে আছে। আমি বেশ ভেঙে ভেঙে এখানে পৌঁছেছি। পকেটে ভাংতি ছিলো না বেশি। রিকশাভাড়া হিসেব করে করে এলাম। মাঝের রাস্তায় মোড়ের এক পার থেকে রিকশা নিলে এক রেট, আরেক পারে গেলে পাঁচ টাকা কম। তাই হেঁটে পার হইলাম ওই মোড়টা।

তো, মোড়ের পরে মোড়, কোমরের বাঁকগুলোকে অবহেলায় এড়িয়ে এসে, আমি নতুন বাজারে বসে রইলাম। সকাল দশটা বাজে। অনেকটা ঘুরে ঘুরে এসেছি। পথে শীতের বাতাস শার্টের বোতামে আটকে গেছে। তারপর সেগুলোর জট ছাড়াতে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম মোড়টায়। এখানে রিকশা, সিএনজি আর মিশুকের খ্যাপ-স্টেশন। জন প্রতি দশ টাকা গুলশান দুইয়ের মোড়। সব পক্ষ খুশি থাকে এরকম বন্দোবস্তে। একসাথে গিজগিজ করে সিএনজি-মিশুকে উঠে যাচ্ছে মোটা-শুকনা লোকগুলো। ভাড়া করা সিএনজি দেখে দেখে অভ্যস্ত চোখে একটু খটকা লাগে। এখানেও এক সিএনজি নানাজনকে টেনে নিচ্ছে পেটের ভেতর। কোনো একজন যদি একা একা যেতে চায় বনানী, কিংবা মহাখালি, এরা যাবে না। পলিগ্যামি!! টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না!

আমি একটু হেঁটে শীত আমেজটা কাটিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। এখনও একটু পরপর বাতাস দিচ্ছে। মোড়ের ওপর চায়ের দোকানে ব্যানার দিয়ে আড়াল করা। বাতাস ঠেকাচ্ছে। দেখে পদ্মার নৌকার কথা মনে পড়লো, আরিচা ঘাট থেকে নগরবাড়ি ঘাট। পালতোলা নৌকার মতো ফুলে উঠছে এই ব্যানারটা। ব্যানারে ছাত্রলীগের দেয়া কুরবানির হাটের খবর লেখা। আমি কুরবানির হাটকে পিঠে রেখে বসলাম, "মামা, একটা চা করেন", চায়ের দোকানদারের হাতের চামচ নড়তে থাকে। দোকানদারের নাম কেরামত। গালে থুতনিতে অল্প দু'গাছা দাড়ি। গলায় মাফলার, পরনের কাপড় পুরনো এবং শীত মানবে না আর কয়দিন পরেই। "নতুন লিকার বসাইসি, একটু ধাগ কম হইবো", বললেন তিনি, "এখনই খাবেন নাকি আরেকটু পরে দিমু?" আমি বললাম, "ঠিকাছে মামা, পরেই দেন। দশ মিনিট।"

দশ মিনিট পরে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সামনের ওভারব্রিজটাকে দেখি। দুপাশ দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, রাস্তার ওপারেও একই রকমের সিঁড়ি। দেখে হঠাৎ মনে হয় এই নতুন বাজারে একটা শীর্ণ লোক বুকডন দিচ্ছে। দুই পাশের ফুটপাতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে, আর পিঠ উঁচু করে রেখেছে, যাতে তলা দিয়ে সারসার বাস-ট্রাক-গাড়ি-রিকশা চলে যেতে পারে! নিজের চিন্তায় নিজেই হেসে উঠলাম। পাশে একজন বিড়ি ফুঁকতেছিলাম। হাসতে হাসতে তার বিড়ির দমবন্ধ গন্ধটাও ভালো লাগলো!

চা শেষ হইলো। পাঁচ টাকা হইছে, মামা। এই নেন রাখেন। আমার পকেটে শেষ পাঁচ টাকার কয়েনটাও দিয়ে দিলাম। এখন হালকা লাগছে। কড়কড়ে দুইটা এক হাজার টাকার নোট আছে। এটা এখন আর কেউ ভাঙিয়ে দিবে না। এক হাজার টাকার নোটের মেরুদণ্ড বাংলাদেশের সব চাইতে শক্ত শিশ্নের চাইতেও শক্ত। [অ্যাঅ্যাই! কেউ আমাকে খারাপ ভাববেন না, প্লিজ। আমি বাংলাদেশির মেরুদণ্ডের সাথে তুলনা করছি না বলে দোষ ধইরেন না। ওটা স্পঞ্জের মতো নরম, মুরগির কচি হাড়ের চাইতেও তুলতুলে। ওর সাথে কি 'অভাঙনযোগ্য' হাজার টাকার নোটের তুলনা করা যায়?]

পৌনে বারোটা বাজে। সূর্য বেশ চড়া। এখন আর শীত লাগছে না। ওম ওম উষ্ণতা। কেরামত ভালো থাকুক। ওভারব্রিজটাও ভালো থাকুক। আমি ফিরে চললাম!

সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১০

দুঃস্বপ্ন

খুব বাজে দুঃস্বপ্ন দেখাটা একটা অভিশাপের মতো। দুঃস্বপ্ন সন্তর্পণে এসেছে। ঘুমিয়ে ছিলাম, আর ঘুমটাও এমন যে টের পাচ্ছিলাম অনেকক্ষণ ধরে অনেক আরামের ঘুম হচ্ছে। ঘরে এই পড়ো পড়ো শীতে হালকা করে ফ্যান ঘুরছে। গায়ে পাতলা কম্বল গায়ে দিয়েছি। বাতাস টের পাচ্ছি, কিন্তু শীত লাগছে না। এই ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ দুঃস্বপ্নটা আক্রমণ করে বসলো। মনে হলো, কেউ বুকের বাঁ পাশে গনগনে লোহার বর্শা গেঁথে দিয়েছে। ফুসফুসের কুঠুরিতে সেই গরম বর্শার ফলা বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষে জরজর হয়ে আমি দুঃস্বপ্নটা দেখতে থাকি। সেলুলয়েডের মতো একটানা চোখের যামনে বয়ে চলছে। এ খুব অবাক ব্যাপার, সুখস্বপ্নগুলো এতো ভিভিড হয় না। ছেঁড়া ছেঁড়া, খণ্ডদৃশ্যের মতো হয়। ঘুম ভেঙে সেগুলো ঠিক ঠাক জোড়া দেয়া যায় না। মাঝে মিসিং লিংক থাকে অনেক। কিন্তু দুঃস্বপ্নগুলো একদম ডিটেইল। আমার বুকে জমে থাকা বাতাস ফুরিয়ে যেতে থাকে। আমি ঘুমের মধ্যেই ছটফট করি। নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করি। আর আমার শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জন্য আঁকুপাকু করে। জগদ্দল শরীর। অযথা বেহুদা ক্লেশ। শেষ হয়ে গেলে আমি হালকা হয়ে যেতাম, শালিকের মতো। এই অচকিত ভাবনাটাও গরম তাপে মোমের মতো গলে যায়। দুঃস্বপ্নকে এখন আর স্বপ্ন মনে হচ্ছে না। মনে হতে থাকে এটা বাস্তব। আমার যাপিত জীবন!

আমার চোখ ফেটে জল আসে। আমি বুকের শেষ শ্বাসটুকু ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠি। আমার হাত মুঠো হয়ে ওঠে। আমার গলা ভেঙে যেতে থাকে। আমি চিৎকার করতেই থাকি। কে যেন থাইয়ের কাছে করাত দিয়ে পা কেটে ফেলছে। চিৎকারের শব্দ হারিয়ে যায়। আমার শরীর বেঁকে চুরে যাচ্ছে। চিৎকার দিতে দিতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।

ঘর অন্ধকার।

ফ্যান সরসর সাপের মতো ঘুরছে।

আমার গায়ে পাতলা কম্বল।

আমি খুব জোরে চিৎকার করছিলাম, গলা ভেঙে গেছে।


আমি বেঁচে আছি, কিন্তু আমি মরে গেলেই বেঁচে যেতাম।



এখন এই অবশ্যম্ভাবী দুঃস্বপ্নটা সত্যি হওয়া পর্যন্ত আমি সেটা যাপন করবো।

রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১০

পুরোনো ত্রয়ী

সংকট

হাতের উল্টোপিঠে তারাদের ছাপ তৈরির বিষয়টা অস্বস্তিকর; বড়ো বিস্ময়েরও বটে। আমি যদ্দুর জানতাম, ওরা আজকাল এখানে বাসা বাঁধে না। জমি বিক্রি বন্ধ সেই আদ্যিকাল থেকে, যুদ্ধেরও কয়েক বছর আগে হইতে! তখন খোলা প্রান্তরেও তামাবর্ণ মানুষের হাতে উল্কির মতো, কুষ্ঠের মতো, শ্বেতীর মতো তারাবাজি খেলা করতো। তারপর বহুদিন আগে কোন্‌ দুর্ঘটনায় আদিম তারার নির্দেশে মানুষের করতল থেকে মুছে গেলো উল্কিময় কারুকার্য। তারাদের কাছে আমরা হলাম অপাংক্তেয়।

অথচ আমার হাতের পিঠে সেদিন পুড়ে গেলো চামড়ার তল, অপতলে ফুটে উঠলো বিম্বিত নক্ষত্র! যখন কাঠ, খড়, তুষের সম্বল নিয়ে তারকা-নেতা এলেন, পেছনে সারি বেঁধে এলো তারাসকল, আমি খুবই অবাক বিব্রত ঘাম মুছে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উদোম হাতের পিঠে ছাই হয়ে গেলো সুন্দরবনের মতো মানচিত্র...


***

ভালোবাসা

শীৎকারগুলো দেয়ালে গেঁথে আছে চিত্রশিল্পের মতো
আর তাদের দুজনের মাথা দুটো, দুভাগ করা লেবুর মতো
দুদিকে এলিয়ে পড়ে আছে। তবুও তাদের রমণ বেগ
অমন্দন গতিশীল নিরাবেগ। যান্ত্রিকও কিছুটা, তাদের
ঘুমের ভেতর বিনিময় হয়ে যায় হাত ও পায়ের আঙুল
নিদ্রাতটের জলদস্যুতায়, তারা চুরি করে
একে অপরের মস্তিষ্ক চিরতরে

আর সকালের রোদে দেখা গেলো তাদের মুখের চামড়া খুলে
ঝুলছে অপরজনের চেহারায়।

টেড হিউজের একটি কবিতা অবলম্বনে

***

একটি নিছক আটপৌরে ঘটনা

যারা রাস্তায় থাকে তাদের কাছে আলোবিহীন সড়ক ভূতুড়ে নয়; তেমন একটা। কিন্তু আমরা যারা দালানকোঠায় বাস করি, আমাদের যাপিত জীবনে আঁধার ও বৈকল্য এক সাথে আসে। আজ কয়েকজনকে দাওয়াত করেছিলাম। নিছক অনেকদিন বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাত নেই, ফোনে কথা বলে মনের আশ বা প্রাণের সাধ কোনোটাই মিটছে না। নেহাত বাইরের কোন ফাস্টফুড বা হ-য-ব-র-ল রেস্তোরাঁ আমার পছন্দ না বলে সবাইকে বাসায় ডেকেছি। সবাই বলতে ওরা পাঁচজন, এখন যারা আমার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে খুব। তারা হাসি ঠাট্টায় জমে উঠতে উঠতেই হুট করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলো। ধুপ করে সব কালো। চোখ সয়ে এলে আবছা একটা আলো চোখে পড়ে। নীলচে-কালচে আলোতে দেখি বিছানা-চেয়ার মিলিয়ে ওরা চারজন অনাহূত অন্ধকারে কথা থামিয়ে দিয়েছে।

আড্ডা থিতিয়ে এলে জায়গা বা বিষয়বদল দরকার। আমি সফল হোস্ট হতে চাওয়ার লোভে ভুগছি। ভাবছি আজকের গেট-টুগেদারের গপ্পো যদি আগামি এক সপ্তা না চলে, তাহলে আমার এই উইক-এন্ডটাই মাটি! ফেসবুকে ছবি আর নোটিফিকেশনের ঝড় ওঠা চাই। কমেন্টের ফুলঝুরি আর ওয়াল পোস্ট চাই। কিন্তু ছবি তুলবো কীভাবে, কারেন্টই তো নেই! ভেবেই মেজাজ ফট্টিনাইন হয়ে যাচ্ছিলো। তারপর নিজেকে সামলে নিলাম, হোস্ট হয়ে অন্ধকারের মাঝে ঘোস্ট হওয়ার দরকার নেই। বরং জায়গা বদলে দেই। "অ্যাই, তোরা কি ছাদে যাবি?", বলামাত্রই ওরা শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালো। হুড়হুড়িয়ে সবাই ছাদে উঠে গেলো। তেরো তলার উপরে ছাদ। একদিকে এরকমই লম্বা একটা হাইরাইজ ছাড়া বাকি তিনদিকে খালি, মিষ্টি বাতাস বইছে, বসন্ত-সমীরণ।

আমার বন্ধুরা অবশ্য বাতাস উপভোগ করে না। তারা গুমোট বিকল লোডশেডিং থেকে মুক্ত হয়েই খুশি। সবাই মিলে ছাদের রেলিংয়ের দিকে ছুটে গেলো। নিচে তাকিয়ে একজন গাড়িঘোড়া দেখছে। মানুষগুলো পিঁপড়ের মতো। আমাদের বন্ধুদের মাঝে যে সবচেয়ে বিটলা, সে থুক করে একদলা থুতু ফেললো। আমরা 'ইয়াক', 'ঈঊ' করে উঠলাম, "এ কী ধরনের অসভ্যতা! ম্যানারলেস! ক্রাস!" থুতুর মতোই ওর দিকে কতোগুলো গালি ছুঁড়লাম আমরা। ও নির্বিকার হাসলো। যেন এই গালিগুলো আমাদের দিয়ে বলিয়ে নিতেই সে এমনটা করেছে। ওর কারণেই হোক, অথবা নিচের গাড়িমানুষের লিলিপুট ভার্সন একঘেঁয়ে ওঠার কারণেই হোক, আমরা রেলিং থেকে সরে এলাম। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ছাদের কুসুমগরম মেঝেতে বসে পড়লাম সবাই। একটু আগেই বিকেল মরে জেগে ওঠা সন্ধ্যাটা মরে গেছে। চারদিকে আজান তোলা শেষ। এখন খালি রাস্তার আবছা কোলাহল আর নিঃস্তব্ধতা। আমাদের পাঁচটে দেহবিহীন আত্মা তেরো তলার ওপর চৌদ্দ তলা ছাদ থেকে বার বার লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবার কসরত করছে।


***

শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১০

ওন্দস্কান

মাথা ভার ভার করছে সারাদিন ধরে। অনেক কাজ করছি সারাদিন ধরে। বেশিরভাগ সময় কম্পিউটারের সামনে যারা কাটান, হঠাৎ করে পুরো একটা দিন বা সারা সপ্তাহ ইন্টারনেট আর কম্পিউটার না ধরলে তাদের কেমন লাগবে? ভাবছিলাম। কিছু কিছু ব্যাপার যেমন কল্পনাতেও আসে না, ফ্যান্টাসির চাইতেও বেশি অসম্ভব বলে মনে হয়, এই ব্যাপারটাও মনে হয় সেরকম! আমি প্রায় দশ বছর ধরে নিজের কম্পিউটার ব্যবহার করছি, হঠাৎ করে এক দিন বা দুই দিন কম্পিউটার সচল না পেলে মাথার সার্কিটে কোন একটা 'গিয়াঞ্জাম' লেগে যায় (আগে গিট্টু লাগতো, গিট্টুর পরের দশা হলো গেরো, আর গিয়াঞ্জাম হলো শেষ অবস্থা!)। মনে হতে থাকে একটা হাত নাই; অথবা পেটের ভেতরে পাকস্থলী নাই - খাবার খাইলে সরাসরি তলপেটে চলে যাচ্ছে। এই ধরনের উদ্ভট শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে মনে হতে থাকে যে আমি বোধহয় আসক্ত। নেশাগ্রস্ত।

অনেক আগে একটা ছবি দেখেছিলাম মনিটরের ভেতরে মাথা ম্যাট্রিক্সের মতো গলে গলে ঢুকে যাচ্ছে আর বাকি শরীরটা টার্মিনেটর টু-এর মতো এলুমিনিয়ামের মতো গলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তেমন লাগে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এটা যে অস্বাভাবিক বা সমস্যা, তা বুঝতে পারি না। স্বাভাবিক মনে হয়। অভ্যস্ত হলে অপ্রাকৃতিক আচরণও ন্যায্য মনে হয়।



কিছু ছবি দেখার পরে অতীতের কথা মনে পড়ে। আমার স্বল্পায়ু অতীত। সুইডেনের ছবি ওন্দস্কান (Ondskan), মানে হলো Evil, শয়তান। ছবিটা যার কাছ থেকে নিয়েছি, সে বলেছিলো যে ক্যাডেট কলেজের কথা মনে পড়বে, দেখেন, মজা পাবেন (সে নিজেও এক্স-ক্যাডেট)। দেখা শুরু করার ২০ মিনিট পরে একটু থামলাম। একটা দৃশ্য দেখালো, বোর্ডিং হাউজে আসার পরে রুমমেটের সাথে কথোপকথন। রুমমেট বেশ পড়ুয়া, ভালো ছাত্র, তবে খেলাধুলায় ভালো না, একটু পৃথুল শরীরের। যে সিনিয়র প্রিফেক্ট নতুন ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে, সে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু হালকা ঝাড়ি দিয়ে গেলো। নতুন ছেলেটাই গল্পের মূল নায়ক, রাগী, বয়ঃসন্ধির রাগ, পেটা শরীর, সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। আমি থেমে গেলাম কারণ আমি নিজেও খুব একটা ভালো ছিলাম না খেলাধুলায়। খেলতাম, খুব এনজয় করেই খেলেছি দুই তিন বছর। কিন্তু যতো সিনিয়র হয়ে গেছি ততোই খেলাধুলার দিক থেকে মন সরে গিয়েছে। খুব প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমার কখনই ভালো লাগে না। ওপেন চ্যালেঞ্জ, জিগীষার যে খাপ-খোলা-রূপ খেলার মাঠে ফুটে ওঠে, সেটা আমাকে কিছুটা সন্ত্রস্ত করে।

ছবিটা মূলত এই বোর্ডিংয়ের জীবন-যাপন নিয়ে নয়। বরং আরো অনেক গভীর মনস্তত্ত্বে গিয়ে নাড়া দিয়েছে। আর এখন যদি ব্যাখ্যা করতে যাই, পারবো না। এতোটাই সূক্ষ্ণ-উদ্দীপন, যে ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা নাই। ছবিটার নামে যে শয়তানের কথা বলেছে, সেটা আমাদের ভেতরের পাশবিকতা। হিংস্র জানোয়ারের মতো আমরা মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে, নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাই। সামনে পরা মানুষটাকে আর মানুষ বলে মনে করি না। ভায়োলেন্স আসলে খুবই "সাপেক্ষ" আচরণ। যা কিনা পরিবেশ, মুহূর্ত এবং আরো অনেক প্রভাবকের ওপর নির্ভর করে। গিয়ারের দাঁতের মতো, অনেকগুলো ছোটবড় চাকার দাঁত মিলে গেলে ঘোটঘোট করে ঘুরতে থাকে ভায়োলেন্সের চাকা। এর সাথে যুক্ত হয় মব-ফিয়ার, দলগত-হিংস্রতা। কোন র‍্যাশনাল বা ক্রিটিকাল সমালোচনা এখানে তুচ্ছ।

আরেকটা জিনিস খুব ঘটতে দেখেছি, যে কোন বদ্ধ-আবাসিক ব্যবস্থায়। সেটা হলো ব্যবস্থার নিজস্ব একটা চালু 'সিস্টেম' থাকে। এটা অনেকটাই সপ্রাণ। আর প্রাণের বৈশিষ্ট্যই হলো বিবর্তন। সিস্টেম ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়। অনেক বুঝে শুনে নিয়মকানুন বানালেও নিজে নিজে সিস্টেমটা মানুষগুলোকে দিয়ে আরেকটা আলাদা নিয়মকানুনের ইশতেহার বানিয়ে ফেলে। যেন সে বুঝতে পারছে কোনভাবে চললে, কোন নিয়মে চালালে সবচেয়ে স্থিতিশীল সিস্টেম তৈরি করা যাবে। যতোই 'রেড বুক' বা 'নীতিমালা' বানাই না কেন, শেষতক সেই সিস্টেমের-বানানো-নিয়মটাই টিকে থাকবে। এটা যেন নিজেই নিজের জন্য সীমানা তৈরি করে!

আর মানুষ খুবই ফালতু সৃষ্টি। কারণ অধিকাংশ মানুষ এই সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যারা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারে থাকেন, তারাও পারেন না। সিস্টেমের হাতে তারাও এক একটা ঘুঁটি। এখানেও লজিক্যাল কোন ডিডাকশন নাই। মেনে চলো। সুখী হবে। এই যে 'সুখ', এটাও সিস্টেম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঠিক ওই ম্যাট্রিক্সের মতোন!

যাস্‌সালা, ঘুরে ফিরে সেই তো গোড়ায় ফিরে এলুম! এই কী গেরো! ( আশার কথা, গিয়াঞ্জাম কেটে 'গেরো'তে এসেছি, গিট্টুতেও চলে আসতে পারবো নিশ্চিত!)

বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১০

স্মৃতি ও বিস্মৃতি

ডিসেম্বর এলে আস্তে আস্তে শীত বাড়ে। আমার এই শীতকাল খুব মেলাঙ্কলিক লাগে। যে স্মৃতিগুলোকে আগের জন্মের বলে মনে হয়, সেই কৈশোরের সময়টা মনে পড়তে থাকে। সেই সময়ের 'আমি'কে নিজের সত্ত্বা বলতে চিনতে পারি না। অচেনা মানুষের সাথে পরিচয়ে আমি বরাবরই অমিশুক, সন্তর্পণ। তাই সহজ হতে পারি না, চুপচাপ তার কাজকর্ম দেখি। কাজকর্ম দেখি মানে সেই সময়ে 'আমি' কি কি করতাম সেগুলো মনে করার চেষ্টা করি। জীবন যাপন করা তখনও অনেক কঠিন মনে হতো। অথচ তখন যদি জানতাম, এখনের জীবন এমন, এই রূপ, তাহলে হয়তো সেই কষ্টগুলো আর কষ্ট বলে গায়েই লাগতো না!

শীতের সময়ে সম্ভবত আমার প্রথম স্মৃতি তৈরি হয়েছিলো। দুইদিন আগে আমার এক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, জন্মের পরে প্রথম স্মৃতি কোনটা, কতোদূর পষ্টভাবে মনে করা যায়? বন্ধুটি বেশ শিল্পমনা, রুচিশীল। এমনিতে ফেসবুকে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কথাবার্তাকে তেমন আমল দেই না। তবে তখন ভাবনা যোগালো, মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রথম স্মৃতি। বোনের জন্ম মনে আছে, সেটার বয়স চার। তার আগে? ময়মনসিংহে একতলা বাসায় থাকতাম, বাসার সামনে ইট-বিছানো উঠান ছিলো, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই পাঁচিল ঘেঁষে আকাশছোঁয়া গাছ ছিলো। বাসার সামনের বারান্দা পার হলে বাম কোণে কলতলা ছিলো, টিউবওয়েল ছিলো কিন্তু আমি ওটা চাপতে পারতাম না। নানী ছিলো, ওটাকে চাপকল বলতেন। আমি তাঁর সাদা আঁচল আঁকড়ে ধরে হেঁটে বেড়াতাম।

এগুলো সবই তরতাজা স্মৃতি। ময়মনসিংহের বাসাটায়, আমি যে দেয়াল ভর্তি করে অ আ ক খ লিখতাম, সেটাও চার বছরের স্মৃতি। আরো পিছে যাই। ঝাপসা ঝাপসা লাগে। এর আগে সাভারে ছিলাম, স্মৃতিসৌধে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঝাপসা খোপ খোপ স্মৃতিসৌধ, ভয় পেয়েছিলাম। মোটেই ছবির মতো সুন্দর বাঁকানো সুউচ্চ মনে হয় নি। আতঙ্কের স্মৃতি খুব সহজে ছাপ ফেলে। আমি বোধহয় স্মৃতিসৌধের ভেতরে ঢুকে কেঁদে ফেলেছিলাম ভয়ে। তারপরে বেরোনোর পরে সামনের ঝিলে শাপলা দেখে একটু থেমেছি, শান্ত হয়েছি। দাদী ছিলেন সাথেই। তবে তার কথা মনে নেই, ছবি দেখে বুঝি এখন।

সাভারের আগে ঢাকায় থাকতাম, সেগুলো ধুয়ে মুছে গেছে। মানুষের এই স্মৃতিগুলো থাকে না কেন? আমার ভাগ্নে আরাভ বড়ো হচ্ছে। বাসায় আমরা মামা-খালা-চাচারা এলেই তাকে নিয়ে নানা আদর-সোহাগ। এগুলোর অমূল্যতা সে কোনোদিন মনে রাখতে পারবে না! আমি জানি আজ থেকে পনেরো বছর পরে তার সাথে আমার এই যোগাযোগ, এই নিবিড়তা থাকবে না। তখন হয়তো এই স্মৃতিগুলো পেলে তার খুব ভালো লাগতো!

জর্নাল জিনিসটা চমৎকার। রোজ রোজ ভাবনার ভার ক্লান্ত করে। আজকের ক্লান্তি একটু কমে গেলো। এখন থেকে লিখবো। অনেক অনেক শব্দ, যেগুলো আদতে একদমই মূল্যহীন! 

মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১০

এলোমেলো ...

বনানী থেকে ফার্মগেইট হয়ে কাঁটাবনে মাত্র বিশ মিনিটে পৌঁছে গেলে সন্দেহ হয়ঃ ঘড়ি বিকল হয়েছে, অথবা এ শহরে মৃতদের বসবাস। অযুত মাল্টিভার্সের কোনো একটায় হয়তো এটা সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু আমি যে শহরে থাকি, সেখানে পথেই আনন্দ!


টুকরো জিনিসগুলোর জন্যে মায়া হয়। অনেক বছর ধরে ওরা আমার সাথে আছে। দিনে দিনে ক্ষয়ে গেছে, সময় খুবলে খুবলে নিয়ে গেছে শরীর-মহার্ঘ্য। আমি কেবল খোলনলচে আগলে রেখেছি - পুরাতন স্মৃতির মতো। টুকরো জিনিসগুলোর ফিডেলিটির কোনো দাম দেয় না কেউ।


চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। কোন্‌ কালে পৃথিবীর উদর থেকে ছিটকে গিয়ে জন্মেছে, নাড়ী কেটেছে ভ্যাকুয়াম। তারপরে মায়ের নাড়ীর টানে ঘুরছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে পড়ে, তবে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না।


মানুষ স্বভাবতই স্ক্র্যুড-আপ। আমি, তুমি, সে, তারা, আমরা, ও, ওরা, তারা, উনি, আপনি, উনারা, আপনারা। সব সর্বনাম বিশিষ্টজন নামসর্বস্ব হলেও, তারা সবাই মূলত স্ক্র্যুড-আপ। আমরা খালি ভড়ঙ আর ভান ধরি, মুখোশ পরি, পরিহাস্যের যাপনকাল।


সেদিন কম্পুখানা মারা গেলো। পাঁচশো গিগাবাইটের স্মৃতি মুছে গেলো এক মুহূর্তেই। জমে থাকা কথাগুলো, চিঠিগুলো, ছবি ও তোমার হাতে ধরে তিরতিরে প্রদীপ - মুছে গেলো। হারিয়ে গেলো খুনসুটির বছর, কান্নার দুইশ বিনিদ্র রাত। তার সাথে চলে গেলো জমিয়ে তোলা সবকিছুই।


সুঁইয়ের ছ্যাদায় সুতো ভরার মতো জীবনের এক ফুটো দিয়ে সব ঘটনা-রটনা পুরে দেয়ার চেষ্টা করছি। ঘটনাগুলোর বেখাপ্পা গড়নের কারণে বারবার হড়কে যাচ্ছে, ঠিকঠাক ঢুকছে না। মাঝে মাঝে করুণ রস জিবে করে ওগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছি, নরম করে দিচ্ছি। তারপর ক্রুদ্ধ উৎকণ্ঠা, এবারে নিশ্চয়ই জীবন গুছিয়ে যাবে, মৃত্যুর আগেই জিতে যাবো শ্বাসরুদ্ধ।


এভাবে হয় না জেনেও ছেলেটা চেষ্টা করছে। চারপাশে অনেকে হা হা হা হা করে হাসছে তার ব্যর্থতায়। কিন্তু তারা খেয়াল করছে না এই সব ব্যর্থতা এক বিশালকায় স্তুপ তৈরি করে ফেলছে। দূর থেকে দেখলে সেটা পাহাড় বলে বিভ্রম হয়।

শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১০

বোদলেয়ার ও মানিকের সাথে টুকরো আলাপ...

যতো প্রযুক্তিই আসুক আর বাংলাদেশে বাস করে যতোই ডিজিটাল হয়ে উঠি না কেন, সেই ছাপার অক্ষরের বইয়ের কাছে ফিরতেই হয়। সেদিন খোলামকুচির মতো বিনা পয়সায় পাওয়া এক বিকালে বেশ মোটা আর গরম মানিব্যাগ নিয়ে বইয়ের দোকানে ঢুকেছি। যে নেশায় ডিভিডি কিনি, তার চেয়েও অবাধে বই কিনতে ইচ্ছা হলো। দুই হাতে বইলে টনটন করে য়্যাতো গাদা বই কিনে আনলাম।

তাদের সাথে উল্টেপাল্টে কথা হয়। এক টানা কোনোটাই বেশি সময় পড়তে পারি না, অন্যজন বেশ লাস্যময়ী 'লুক' দেয়, 'হিন্ট' দেয়। তাই বই থেকে বইয়ে ভাসি। ছাপার অক্ষরগুলো বালিশের সাথে লেপ্টে যায়, আমার সাথেই রাত ফুরোলে ঘুমায়।

বোদলেয়ারের "ক্লেদজ কুসুম" পড়েছিলাম যৌবনের শুরুতে, টগবগে রক্তে আগুন আর মদ ঢুকে গিয়েছিলো কবিতার ছদ্মবেশে। আর এতোদিন পরে হাতে পড়লো "প্যারিস স্‌প্লীন"। বিষণ্ণ কবির মুক্তগদ্য, তথা গদ্য কবিতা। উপমা আর দৃশ্যকল্পে ঠাসা, ছাড়া ছাড়া বুনোটের বাক্য দিয়ে এক একটা লেখা। অনুবাদ পশ্চিম বঙ্গীয়, এবং বঙ্গদেশের বাজে অনুবাদের গৌরব বজায় রেখে এক্কেবারে যাচ্ছে তাই। পড়তে পড়তে ফরাসি ভাষা না জানার আফসোস কামড়ে কামড়ে ধরলো, শেষে ইংরেজি অনুবাদগুলো পড়লাম। বাংলা অনুবাদকারীকে শাপশাপান্ত করতে করতে অগত্যা রস খেলাম অন্যের হাতে, ভিন ভাষায়! তবে বোদলেয়ার-পাঠের আনন্দে এই ভাষা-পথের দূরত্বটাকে পাত্তা দিলাম না।

বোদলেয়্যারের সাথে বাতচিতে মজে আছি, এমন সময় ওপাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পর্দার আড়াল থেকে ডাক দিলেন। "অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়" বইটা কিনেছি। ডায়েরি - চিঠির যে জঞ্জাল মানিক ফেলে রেখে গেছেন, তার মাঝে নাক ডুবিয়ে দিলাম। বিয়িং জন ম্যালকোভিচের মতো মনে হলো নিজেকে। ডায়েরি পড়তে পড়তে হোঁচট খেতে হয়, দিন পরম্পরা নেই, বিষয় পরম্পরা নেই, গল্পের প্লটের পরেই বাজারের ফর্দ, তার পরেই ডাক্তারের কাছ থেকে 'কিনতে হবে' ওষুধের লিস্টি, পরের পাতাতেই তিন বছর পরের ঘটনা লিখে রাখা (সেদিন বোধহয় ধর্মঘট হয়েছিলো)! মানিকের লেখার সাথে পরিচয় প্রায় দশ বছর, কিন্তু এখন যেন আরেক মানুষকে চিনলাম। রক্তমাংসে গড়া, জ্বল জ্বল করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন, রোগে ভুগছেন, খকখক করে কাশছেন, ধুতির খুটে চশমা মুছছেন। আবার এসবের মধ্যেই দুর্দান্ত কোনো গল্পের প্লট লিখে রাখছেন তিন চার বাক্যে!! সুপারম্যান-ক্লার্ক কেন্ট, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ!!

বোদলেয়ার ততোক্ষণে রুষ্ট কিছুটা। ডেকে নিয়ে এক চোট বকলেন। তারপরে নিচের লেখাটা পড়লাম। থমকে গেলাম মানুষের বর্ণনায় - - - -

Le Chien et le Flacon
"— আমার সুন্দর সারমেয়, আমার কোমল কুকুর, আমার প্রিয় কুতুয়া, এগিয়ে এসে শোঁকো তো, শহরের শ্রেষ্ঠ আতরও'লার কাছ থেকে কেনা এই অপূর্ব আতর!"
কুকুরটা খুব লেজ নাচিয়ে এগিয়ে এলো, মনে হয় আদতে এটা এই অবলা প্রাণীদের স্মিত হাসি আর বক্রোষ্ঠীর প্রকাশ, কৌতূহলভরে এগিয়ে এসে ওর ভেজা নাকটা ডুবিয়ে দিল আতরদানির খোলা মুখে, তারপর হঠাৎই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়ে আমার দিকে চেয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো, যেনো নিন্দা করছে।
"— ওরে ও হতভাগা কুত্তা! তোকে যদি আমি একদলা বিষ্ঠা দিতাম তবে তো তুই মহানন্দে শুঁকতি, হয়তো গিলেও নিতি, তুই এমনই আমার বিষণ্ণ জীবনের অযোগ্য সঙ্গী। তুই ঠিক ভিড়ের মানুষগুলোর মতোন, যাদের কোন সুগন্ধি দিতে নেই, তাতে ওরা অতিষ্ঠ হয়, ওদের দিতে হয় বাছাই করা গু।"

মূল লেখা


আমি নিজেও ভিড়ের মানুষ। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কুকুরের মতো আমরা একে অপরের বগলে-ঘাড়ে ঘামের গন্ধ নিই। ওটাই আমাদের সয়। ফরাসি সৌরভে নাক জ্বালাপোড়া করে।

বোদলেয়ারের কথা শুনে মানিকও তার চশমা ঠিক ঠাক করে গলা খাকারি দিলেন। হাট করে খুলে গেলো নববর্ষের পাতা, ১৯৪৯ সালের, আজ থেকে ৬১ বছর আগের পহেলা জানুয়ারি...


১ জানুয়ারি, ১৯৪৯, শনিবার

এবারও কি সুরুতেই শেষ হবে? দেখা যাক। ডায়েরি রাখতে পারি না কেন? বোধ হয় এই ধারণা থেকে গেছে বলে যে ডায়েরি মানেই নিছক ব্যক্তিগত কথা! কয়েকদিন লেখার পর আর উৎসাহ পাই না।
ট্রামের প্রথম শ্রেণীর ভাড়া এক পয়সা বাড়লো! যাত্রীরা চটেছে মনে হলো না। বেশ খানিকটা হাল্‌কা ভাবেই বৃদ্ধিটা গ্রহণ করেছে। বরং যাত্রীদের এই উদাসীন ভাবে কণ্ডাক্টররা ক্ষুব্ধ — অশ্রদ্ধার সুরে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য শুনলাম দু'একটা, ভাবটা এইঃ কিছু হবে না এদের দ্বারা! মর তোমরা — আমাদের কি! ট্রাম ধর্মঘট ফেঁসে যাবার পর যাত্রীদের এভাবে ভাড়া বৃদ্ধি মেনে নেয়ার ফলে সংগ্রামী ট্রাম কর্মীদের এইরকম মনোভাবই স্বাভাবিক।
আসলে, বাবু যাত্রীদের তলিয়ে হিসার করা নেই — একবার টিকিট কাটতে মোটে এক পয়সা — আজকাল একটা পয়সা সামান্য! এই এক একটা পয়সা থেকে কোম্পানী যে গলা কেটে কতো মোটা লাভ করবে সেটা খেয়ালে আসে না। মনে পড়লেও গ্রাহ্য নেই — ভদ্রলোক তো — নিজের কথাই বড়োঃ আমাকে তো মোটে একটা করে পয়সা দিতে হচ্ছে — মরুক গে যাক! নীতিটা বড়ো নয় — অন্যায় করে একটা পয়সা কেউ আদায় করলে সেটা সহ্য করাও যে কতো বড়ো অন্যায় সে ধারণা নেই। ট্রামে ভীষণ ভীড়!

---০---


মানিক ঠিক ধরেছেন। ধ্বজভঙ্গ মধ্যবিত্তের নীতিবোধ দিনে দিনে আরো সুচারু এবং চালাক হয়ে গেছে। এখন আমরা নীতি নামক বস্তুটিকে জাদুঘরে তুলে রেখে দিয়েছি। ওটাতে তেল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়, মাঝে মাঝে সপ্তা-এন্ডে জাদুঘরে ঘুরতে গেলে ওটা শিশুদের দেখিয়ে বিস্মিত করে দিই আমরা বয়োজ্যেষ্ঠ মধ্যবিত্তেরা।




মানুষে মানুষে মিল বা অমিল নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও চিন্তা বরাবরই ভিন্ন। সেরকম একটা গল্পের প্লট লিখে রেখেছেন, সময়াভাবে হয়তো লিখে শেষ করেন নি, বা করতে পারেন নি। প্লটঃ


গল্পের প্লটঃ বিশ্বাসী নির্ব্বিকার পূজারী — কিছুতেই বিচলিত নন — সন্তানের মৃত্যুতেও নয় — ঈশ্বর অবিশ্বাসী অন্যজন ধর্ম্মের কোন ব্যাপারে বিচলিত নয় — বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় প্রথম জনের শোক — সন্তানের মরণে দ্বিতীয় জনের শোক — দুজনের শোক একরকম —


---০---


ডটডটঃ ভাবছি, বোদলেয়ার আর মানিক এই যুগে ব্লগ লিখলে কেমন বেসামাল অবস্থা হইতো?!

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১০

নগরাত্মিক


আমি যে শহরে বাস করি, সেখানে ফুটপাতে প্রায়ই পাগল পাওয়া যায়। আপনি যদি ভাবেন এটা উল্লেখযোগ্য কোন বিষয়ই নয়, তবে আপনি ভুল করবেন। পৃথিবীর আর কোথাও এমন বৈচিত্র্যময়, উদ্ভিন্ন পাগল আপনি ফুটপাতে ফুটপাতে বিজ্ঞাপিত হতে দেখবেন না। পৃথিবীর পথেঘাটে এভাবে তাদেরকে ছেড়ে রাখা হয় না। তারা মানব প্রজাতির অমূল্য সম্পদ, তাই তাদেরকে কড়া রক্ষণাবেক্ষণে রাখা হয়। প্রজাতিটির বর্তমান চালু নমুনাগুলো চায় না তাদের এই উন্নত জেনেটিক্স থেকে আরেকটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হোক। তাই তারা জননরোধী হয়ে উঠেছে, পাগলের মস্তিষ্কের জিন যেত প্রবাহিত হতে না পারে সকল পাগল-জরায়ু এবং অপাগল-জরায়ুতে, এজন্য তারা পাগলদের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।

সে যাক গে, যা বলছিলাম, আমার শহরে এমন কোন সতর্কতা নেয়া হয় নি। ভবিষ্যতেও হবেও না, মেয়রসাহেব সেদিন বললেন। তাই এখানে দেদারসে পাগল ঘুরে বেড়ায় রাস্তাঘাটে। বিভিন্ন আইল্যান্ডগুলোতে তারা ছাপড়া ঘর তুলবে কয়েক বছরের মধ্যেই - এমন চালু গুজব তাই ফুটপাত থেকে ঘোর তপ্ত বাতাসে মিশে পাক খাচ্ছে আজকাল। আমি বেশ পরিপাটি হয়ে রাস্তায় বেরুলে টের পাই বাতাসভর্তি গুজবগুলো আমার গালে ঠাশ ঠাশ করে চড় মারছে। মাঝে মাঝে আমাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেয়ার চেষ্টাও করে, আমি সতর্ক থাকি। কিন্তু আমার শহরের মানুষগুলো তেমন একটা সতর্ক না, তারা প্রায়ই ল্যাঙ খেয়ে আছাড় খায় ফুটপাতের ওপর। অনেকে হন হন করে হাঁটার সময়ে ভুল করে, উড়ে গিয়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে। তখন কোনো এক পাগল চালক বিনা দ্বিধায় গাড়ির চাকাটা ওই মানুষটার পেটের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। ভগ্ন পেট নিয়ে মানুষটা ল্যালব্যাল করে উঠে দাঁড়ালেও বেশিদিন টিকতে পারে না। আমরা অনেকে এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আরেকটা জননাঙ্গ কমে গেলো!

এর পরে আছে আরো নানারকমের বিপদ, আর বলবেন না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় খালি ফুটপাতেই পাগল পাওয়া যায়, কিন্তু আসলে এই সব পাগলের পাগলামি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এরা আমাদের দূর্বলতা বুঝে গেছে। বুঝে গেছে যে আমরা বেশ আত্মবিশ্বাসী। স্যুট টাই পরে আমাদের বুক গর্ব ও টাকার গরমে ফুলে ফুলে উঠছে। প্রতিদিন রাতে আমাদের বেশ ভালো জননকার্য এবং ঘুম মিলছে, তাই আমরা পরদিন সকাল সকাল জগিং করতে পারি। শরীরটাকে ফিট রাখতে আমরা কোনো ছাড় দেই না। তারপরে ঘরে ফিরে ফ্রেশ কমলার জ্যুস খাই আমরা। তারপরে সানস্ক্রিন মেখেটেখে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়ি। পাগলের এতোকিছু কপালে জুটে না, তাই তারা তক্কে তক্কে জ্বলতে থাকে। হিংসাও করে আমাদের, ঈর্ষাও করে আমাদের। এই হিংসা, ঈর্ষা, জিঘাংসা মিলেমিশে একটা খিচুড়ি-ক্ষোভ তৈরি হয় তাদের। তারা মাঝে মাঝে আমাদেরকে ওভারব্রিজের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। গাড়ি চালানোর সময়ে আমরা একটু বেখেয়াল হলেই এক্সেলেটর চেপে ধরে জোর করে আমাদের গাড়ি-দূর্ঘটনা ঘটায়। এরকম ঘটনা সারাদিন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তাই তো, শহরের বিখ্যাত দৈনিকটির পাতার পর পাতা ভরে থাকে এইসব খবরে। আমরা যারা ধাক্কা খাইনি, বা গাড়ি চালানোর সময়ে দূর্ঘটনায় পড়িনি, তারা আজকাল জগিং করে এসেই খবরের কাগজ ওল্টাই। ভয়ে আমাদের পেটের নাড়িভূঁড়ি সেঁধিয়ে যায়। ওই লোকটা বা সেই লোকটার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম, এটা ভেবে আমরা ভয় পাই।

আমাদের মাঝে আমি সহ অনেকেই এই খবর কাগজ পড়ার কাজটা টয়লেটে সারি। এই শুনুন, নাক সিঁটকাবেন না। প্রাতঃকালীন কর্মটিকে অবহেলা করবেন না। নিষ্কাশ না হলে খাওয়া দাওয়া ভালো হয় না, জানেন? নিয়মিত সেই কর্মটির সুবিধা করতে খবরের কাগজ বেশ উপাদেয় প্রভাবক। এটা আমাদের বৃহদান্ত্রকে ভয় পাইয়ে দেয়, ওই যে বলছিলাম - নাড়িভূঁড়ি সেঁধিয়ে যাওয়া, সেজন্যেই তো আমরা সুস্থ থাকতে পারি। ধাক্কা খেয়ে তিন তলা উঁচু ওভারব্রিজ থেকে পড়ে যাওয়া মানুষ বা রাস্তার ফুটপাতের পাশে দুমড়ে মুচড়ে থাকা টয়োটা গাড়ির চালকের জীবন আমাদের কাছে ইউসুফগুলের ভূষি হয়ে উঠেছে ইদানিং। আমরা খুশি হই, কিন্তু এটা ভুলে যাই যে পাগলেরা ধীরে ধীরে জিতে যাচ্ছে। কে বলেছে, "সহিংসতা নিরুপায়ের শেষ অস্ত্র"? আমি তো দেখছি, পাগলেরা সহিংসতার পিঠে লাগাম দিয়ে দিব্যি আমাদের কোণঠাসা করে ফেলছে।

আর গত কিছুদিন ধরে নতুন পদ্ধতি শুরু করেছে চালাক পাগল-গোষ্ঠী। রক্তারক্তির ঝামেলায় না গিয়ে তারা এখন ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে ছিনতাই শুরু করেছে। যাবার সময়ে ওয়ালেটের পাশাপাশি তারা আমাদের সকল জরুরি কাগজ, আর গোপন খবর নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা এমন দুয়েকটা বিছিন্ন ঘটনায় খুব একটা বিচলিত হই নি। উটকো সন্ত্রাস ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু একদিন হুট করে দেখা গেলো, ছিনতাই হওয়া লোকটা পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম (এখানে তার পরিচয় প্রকাশ করছি না)। জানতে পারলাম তিনি গত সপ্তাহের রবিবার রাতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন। শহরের খুব দামি এলাকায দিয়ে ফেরার সময় তার ছিনতাই ঘটেছে। কয়েকজন দুরাত্মা তার মানিব্যাগ, ব্রিফকেইস এবং মুখের চামড়া তুলে নিয়ে চলে গেছেন। নাঃ, ভয় পাবেন না, শিউরে উঠবেন না। মানিব্যাগ আর ব্রিফকেইসটাই দুশ্চিন্তার কারণ, চামড়া তো দুয়েকদিন গেলেই আবার গজিয়ে ওঠে। (আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এটাই এখানে প্রথা)।

তো, যা বলছিলাম, রবিবার রাতে ছিনতাই হলেন তিনি। বাড়ি ফিরলেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায়, তার স্ত্রীটিকে দেখা গেলো বেশ ব্যস্ত হয়ে তার পরিচর্যা শুরু করতে। মানিব্যাগ ও ব্রিফকেইসের শোকে তিনি তখন মৃতপ্রায়। ধীরে ধীরে স্ত্রীর উৎকণ্ঠার সামনে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। মানসিক যন্ত্রণার প্রকোপে কেঁদেই ফেললেন প্রায়, স্ত্রীটিও ব্যাকুল হয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন, "কেঁদো না লক্ষ্মীটি, সব ঠিক হয়ে যাবে"। চামড়াহীন মুখে জর্জেটের শাড়ি ঘষা লাগছিলো, লোকটির আর সহ্য হলো না, "ছাই ঠিক হবে, মুখপুড়ি। চুপ কর্‌! তুই ক্যামনে জানিস আমার কতো ক্ষতি হলো?" স্ত্রীটি বেশ থতোমতো খেয়ে গেলেন, চুপ করে উঠে গেলেন। যাবার আগে লোকটির ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। সে রাতটি তারা দুজনেই সঙ্গমহীন কাটালেন। আমিসহ বাকিরা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, আরেকটি বন্ধ্যা রাত কেটে গেলো।

সোমবার পেরিয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত লোকটির চামড়া ঠিক হয়ে এলো, সেই সাথে মনের গভীরের ভয়টুকু কমে আসতে লাগলো। ইনস্যুরেন্স থেকে তার ব্রিফকেইসের কাগজপাতি উদ্ধার করতে পারলেন, ভাগ্যি সবকিছু ব্যাকআপ রাখা ছিলো! মানিব্যাগের শোক সহজে সারার না, তাই সেই শোক মনে চেপেই তিনি শহরের বিখ্যাত বারে রাত একটা পর্যন্ত মদে চুর হয়ে রইলেন। স্ত্রীটির কাজ এই সময়ে বেড়ে গেলো, রাত দুটোর দিকে দেখা গেলো তিনি বার থেকে মদে ঢুলু ঢুলু স্বামীটিকে টেনে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি নিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন। উবু হয়ে জুতো ও মোজা খুলে দিচ্ছেন, টাই খুলছেন ও হাত ঘড়িটিও খুলছেন। এসব খুলতে খুলতে তার থরো থরো হাত ও বুক আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। আমাদের ভালো লাগে, "আহা, কতোই না পতিব্রতা স্ত্রী! ব্যাটার আসলেই রাজভাগ্যি।"

হঠাৎই শুক্রবার নাগাদ ছিনতাইকারী পাগলদের পুরো চক্রান্ত লোকটি বুঝতে পারলেন। টের পেলেন যে কেবল ছিনতাই করেই তারা ক্ষান্ত হয় নি, আরো বড়ো ক্ষতি ঘটে গেছে তার। সেদিন আর সব শুক্রবারের মতোই তিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিলেন। জগিং সেরে এসে কমলার জ্যুস খেয়েছেন। তারপরে খবরের কাগজখানা বাগিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেছেন। পাগলদের হাতে মানুষের হত্যার খবর পড়তে পড়তে চুক চুক শব্দও করে থাকবেন হয়তো! তারপর "আমি একটু বাইরে থেকে আসছি" বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। সারাদিন তিনি বেশ কিছু জায়গায় গেছেন, যেগুলোর বিবরণ আমরা জোগাড় করতে পারি নি।

সন্ধ্যার পরে তাকে আমরা দেখতে পেলাম সেই বারে বসে আয়েশ করে মদ গিলছেন। আমরা ভাবলাম, এখন প্রায় ঘন্টা কয়েকের জন্যে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি আর কোথাও যাবেন না, এখানেই রাত একটা পর্যন্ত মদ খাবেন। আমাদের অনুমান ভুল হয় নি, রাত একটার দিকেই দেখা গেলো তার স্ত্রীটি আবার তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখি ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাটা ফটাস করে দুই খণ্ড হয়ে গেলো, যেন নীলনদ। আমরা দেখি মাথার ওপরে জ্বলতে থাকে স্ট্রীট লাইটগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সেই আলোতে স্ত্রীটিকে আমরা চিনতে পারি না। আমাদের ভুল হয়, আমরা মনে করি কাঠের স্বামীকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাত বিড়ির মতো দ্রুত শেষ হয়ে আসে। আর গিসগিস করতে থাকা শহরে একটু পরে বিড়ির মোথার মতো রাতের শেষ পরশটুকু পড়ে থাকে। শনিবার আরো একটা ছুটির দিন হয়ে খুব কষ্ট করে জেগে উঠতে থাকে, আমি হঠাৎ টের পাই যে পাগলেরা রাতে ঘুমায় নি। আমরা খুব নিশ্চিন্তে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম, আর পাগলরা সারা রাত জেগে ছিলো ফুটপাতে ফুটপাতে। তাদের জন্য আমার কেন জানি সেই সকালে একটু মায়া হয়। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের প্রতি মায়া দেখানো একেবারেই নিষিদ্ধ, তবু আমি চুরি করে একটু মায়া দেখাই। এক পলকের জন্য ভুলে যাই যে এরা আমাদের শত্রু। হঠাৎ চোখে পড়ে, সেই বিখ্যাত বারের পেছনের দরজার কাছে একটা শরীর দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। শরীরটি যে বেশ ব্যায়াম করে নিয়মিতই, তা বুঝতে পারি। আরো বুঝতে পারি, সেটি কোন পাগল নয়। পরিপাটি শার্ট, ঢিলে না হওয়া টাইয়ের কোনা দেখা যায়, প্যান্টখানাও নিপাট। দোকানের লোকগুলো ঘুমুচ্ছে হয়তো এখনো। তাই আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। চেহারাটা দেখতে পারছি না, শরীর উল্টে পড়ে আছে অ-পাগল।

আরো প্রায় ঘন্টাখানেক পরে লোকটির ঘুম ভাঙলো। যেন অচৈতন্য থেকে সে একটু একটু করে জেগে উঠছে। হাত পেঁচিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম আমাদের ছিনতাই হয়ে যাওয়া লোকের মুখ। হুবহু একই চোখ, একই চোয়াল, একই এলোমেলো হয়ে থাকা চুল। চমক ভাঙতে না ভাঙতেই বুঝতে পারলাম গত রাতে এই লোকটি বাসায় ফেরে নি। গত রাতে সে এই বারের পেছনের দরজার বাইরে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলো। আমিসহ আমাদের ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। এটা আমাদের সতর্কতার পূর্বাবস্থা। খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টা বুঝে গেলাম বলে আমি বাকিদের সাথে বেশ উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে শুরু করি। তাদের বুঝাতে চেষ্টা করি যে এক গভীর ষড়যন্ত্র ঘটে গেছে রাতের আধারে। আমাদের শহরের পাগলেরা একটা বিরাট চাল চেলেছে, একই চালে তারা আমাদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। এখনই সময় আমাদের সতর্ক হওয়ার!

মানুষের দলের আমাদের মাঝে অনেকেই আমার কথা মানতে পারলো না। আমি যে অবিশ্বাস্য কথা বলছি, আমি যে উদ্ভট কথা বলছি সে বিষয়ে অনেকেই তখন নিঃসন্দেহ। তাদের চোখে আমার আচরণ কিছুটা অপ্রকৃতস্থ বলে মনে হচ্ছে -- এই কথাও ব্যক্ত করলো কেউ কেউ। আমি অসহায় বোধ করলাম। পাগলদের সাথে যুদ্ধে আমরা হেরে যাবো, এই ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আমার বিপন্নতা বেড়ে গেলো। আমি জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলাম কী বিপর্যয় ঘটে গেছে। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ব্যাপারটা, তাও কেউ কেন বুঝতে চাইছে না? আশ্চর্য!

তারা খুব দ্রুত একটা সভা করে নিলো আমার অভিযোগ নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতি যাচাই করে আমাদের নেতারা বললেন প্রমাণবিহীন এই অভিযোগ সত্যি হবার সম্ভাবনা খুবই কম। বলতে গেলে নগণ্য। তাই আমার এই অতি-আশঙ্কা, এই অতিকল্পনার কোন ভিত্তি নেই। আমি যে এমন পাগলের মতো আচরণ করছি, এটাই এক ধরণের অসুখ। পাগল হয়ে যাবার আগে এরকম উপসর্গ দেখা দেয়। এই শহরে এরকম সময়ে কোন চিকিৎসা হয় না বললেই চলে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কতোজনেই তো পাগল হয়ে গেলো এভাবে! তাই সভাসদরা ঠিক করলেন আমাকে অতিসত্ত্বর বিদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। এই শহরে পঁচে পঁচে পাগল হয়ে যাবার আগেই আমার বিদেশে চলে যাওয়া উচিত। সেখানে চিকিৎসালয় আছে। বিশাল সুরম্য অট্টালিকাগুলোকে চিকিৎসালয় বানিয়ে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পাগলদের চিকিৎসা করা হয়। তাদের ঘুমের বড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এখানে থাকলে আমাকে সারা রাত জেগে থাকতে হবে, আমি আর সুস্থদের মতো রাতে ঘুমুতেই পারবো না। তারপরে একদিন পাগল হয়ে ফুটপাত ঘেঁষে রাত কাটাবো।

আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমার ভালো চান। তাই আমি মুখ বুঁজে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো হঠাৎ আমার কাছে সিনেমার পর্দার মতো মনে হয়, ত্রিমাত্রিক মানুষগুলোকে চ্যাপ্টা লাগে, সামনের টেবিল চেয়ারগুলোকে মনে হয় দেয়ালে এঁকে রেখেছে কেউ। সিনেমার মতোই তারা মাথা নাড়ে, ঘন ঘন হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখে। তারপরে নিজেরা নিজেরা ফিসফিস করে কী কী যেন বলে, আমাদের দিকে তাকিয়ে পেশাদার হাসি দেয়। কাগজের খসখসাখস শুনতে পাই।

আমার চোখে কোন একটা সমস্যা হয়েছে মনে হয়। ঠিক এই দৃশ্যগুলোর ভেতর দিয়েও আমি লোকটিকে দেখতে পাই। বারের পেছনের দরজার কাছে এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখা লোকটিকে না, গতরাতে যে লোকটি স্ত্রীয়ের কাঁধে চেপে চলে গেছে সেই লোকটিকে দেখি। দেখতে পাই গত রাতেও তার স্ত্রীটি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে, তারপরে জুতো ও মোজা খুলে দিয়েছে। সারা রাত লোকটি ঘুমায় নি যদিও, চোখ বুঝে পড়ে ছিলো (আমি নিশ্চিত)। তারপরে সকালে উঠে ঠিকঠাক অভিনয় শুরু করে দিয়েছে।

আমার সামনের সিনেমার দৃশ্যে আটকে থাকা মানুষেরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে আমি চেয়ার বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু একটু মাথা দোলাচ্ছি, আর পাগলের মতো হা হা হা করে হাসছি!

বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১০

এই লেখাটা তার জন্য...

সে আসবে জেনে আমি তেমন কোন আবেগ বোধ করি নি প্রথমে। জেনেছি সে আসছে, খুশি হয়েছি যে খুব তাড়াতাড়ি এই অক্টোবরেই তার সাথে দেখা হবে। সে আসলে তার সাথে বেশ খাতির জমাবো ঠিক করে রেখেছিলাম। এমনিতেই আমি বেশ হাসিখুশি মিশুক মানুষ। প্রাথমিক জড়তা থাকে অপরিচিতের সাথে, সেটা কেটে যেতে একটু সময় লাগে। কিন্তু তারপরে আমি ভীষণ মিশে যেতে পারি কারো কারো সাথে। যাদের ভালো লাগে, তাদের দেখলেই ভালো লাগে। তাই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যে যদি তাকে আমার ভালো লাগে, তাহলে আমি তার সাথে বেশ খানিকটা সময় কাটাবো।

অক্টোবরে বাংলাদেশ খুব সুন্দর হয়ে ওঠে সাধারণত। আমি জানি এই কথার তেমন কোন প্রামাণ্য ভিত্তি নাই। তবে আমার ভালো লাগে। বাংলাদেশ ছোট হতে হতে আমার কাছে এখন খালি ঢাকা শহর হয়ে উঠেছে। আর ঢাকা শহরটাও পুরোটা আমার কাছে নেই, বাসস্থান আর দপ্তরের রাস্তাকতক এদিক সেদিক, দু'তিনটে গাছপালা, কয়েকটা ঘুপচি গলি-উপগলির মোড়, আর অবিরাম যানজট মিলিয়ে এই নগর সংকুচিত এখন। তো যখন অক্টোবর আসে, বৃষ্টি থেমেই গেলো প্রায়। শুকিয়ে এলো ড্রেন নামের নালাগুলো। গাছগুলো একটু হাঁফ ছাড়বার সুযোগ হারালো। ছাতা গুটিয়ে জবুথবু কেরানিগুলো আবার তেলচিটে শার্ট পরে ঘামা শুরু করলো। আমি অবশ্য এগুলোকে তেমন পাত্তা দেই নি। এদের এড়াতে আমি উপরে আকাশের দিকে তাকিয়েছি। তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। থরে থরে শরতের আকাশের হুবহু নকল যেন! অথচ এখন হেমন্ত যায় যায়। ধানক্ষেত তো নেই আশেপাশে, তাই টের পাই না কার্তিকের ঘ্রাণ। খালি সিএনজি গ্যাসে ভরা গাড়ি নাকে ঢুকে যায়। তেল পোড়ে হেঁশেলে, গ্যাস স্টেশনে। মাঝে মাঝে অক্টোবরের বিকেলে বাতাস নামে শহরে, আমি সে সময়ে ঘরের বাইরে থাকি বলে টের পাই... শহরটা গিজগিজ করছে দীর্ঘশ্বাসের তৈরি মানুষে। এই মানুষের ভীড় একেবারে খারাপ না - বৈচিত্র্যময় দারুণ।

তারপরে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে সে আসছে। একদিন হঠাৎ জানতে পেলাম গভীর শেষ রাতে আসবে সে। যখন খবর পেলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারো পার। আমি ঠিক করলাম যে খুব ভোরে উঠে তার সাথে দেখা করতে যাবো। ততোক্ষণে সে নিশ্চয়ই বেশ ধাতস্থ হয়ে যাবে ঢাকা শহরের চারপাশে। 'ভালোই হবে', ভেবে আমি 'ঘুমুতে গেলাম, যাচ্ছি' করছিলাম। ঠিক তখনই ফোন এলো যে জরুরি খবর - সে আসছে সময়ের একটু আগেই। আমি তড়িঘড়ি তৈরি হলাম, দেরি করা যাবে না। রাতের ঘুমের নিকুচি - তার সাথে দেখা করেই ঘুমাবো 'খন। সাথে করে ক্যামেরাখানা নিয়ে বের হলাম, যদি তার সাথে প্রথম দেখার সময়টা ধরে রাখতে পারি তো বেশ হয়।


মধ্যরাত পেরিয়ে পৌঁছালাম হাসপাতালে, জরুরি বিভাগ - কাচের দরজা - খুলে ঢুকতেই দেখি কান্নার শোরগোল। একটু আগেই একজন প্রৌঢ় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। হাসপাতালে আনতে আনতেই ভবলীলা...। তার পুরো পরিবার শোকে থরথর। মনে একটু কু-ডাক দিলো। মৃতের পরিবারের একজন আবার আমার ভাইয়ের পরিচিত। টুকটাক কথা বিনিময় হলো। আমরা শোকার্ত পরিবার পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। কু-ডাক লাপাত্তা হলো তার মায়ের মুখ দেখে। তিনি বেশ চুপচাপ। অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তাটুকু প্রকাশ করছেন না। আমি সেই মা হতে চলা আপুকে ডাকি পলিটিশিয়ান, আমার বেশ বড়ো তো, তাই আপুর বুদ্ধিতে বরাবরই ধরা খাই। বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। উৎকন্ঠা কমে না। প্রক্রিয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ সবসময়। কয়েকবার করে ডাক্তার দুইজনের সাথে কথা বলে বলে একটু শান্ত হওয়া গেলো।

রাত ধীরে ধীরে চুইংগামের মতো লম্বা হচ্ছে। সেই রাতটুকুকে চিবুতে চিবুতে হঠাৎ খেয়াল করলাম প্রায় দুইটা বাজে। একটু খিদে লেগে গেলো। লাজশরমের মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আর কারো পেট ডাকছে নাকি। পেটুকের দলের কোন লজ্জা থাকে না, এই বাক্য প্রমাণ করে ভাই, দুলাভাই ঈষৎ মাথা দুলালো। সে আসুক, নির্ভার হয়ে খাদ্যের ভার নেয়া যাবে। এই অপেক্ষার মধ্যে হাসপাতাল নিশ্চুপ। লোকজন নেই, আমরা কয়েকজন বসে রইলাম। আমি, আপুর ছোটভাই, দুলাভাই, আপুর মা-বাবা-শাশুড়ি। আপুর মা বাবা দুইজনই এই প্রথম নানা নানি হতে চলেছেন। তাই তাদের উদ্বেগ কয়েক হাত দূরে বসেও দিব্যি টের পাচ্ছি। আমি একটু হাল্কা করতে আপুর মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে তার কীভাবে দেখা হলো। শুনে একটু হাসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, 'তোকে দেখে প্রথমে বুঝতেই পারি নি। হাসপাতালের কেবিনে এসে দেখি কাঁথার ওপরে একটা বাবু হাত-পা ছুঁড়ছে। ভেতরে গিয়ে তোর মায়ের দেখা পেলাম, তারপরে সে জানালো বাইরের ঘরে রাখা কাঁথার ওপরের মানুষটাই তুই।' একটু হাসলেন তিনি। অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে গেলো তার। ভালোই হলো, একে একে বাকিদের খবর বেরিয়ে এলো। কে কীভাবে এসেছে, আপুর মায়ের সব মনে আছে। আমি এক মনে শুনছিলাম।

একটু পরে দুলাভাইকে ডেকে নিয়ে গেলো ভেতরে। সময় হয়ে গেছে তার আসার। আমরা দ্বিগুণ উৎকণ্ঠায় বাইরে পায়চারি করছি। আপুর ভাইটা একটু বেশিই অস্থির। ঢোক ঢোক পানি খাচ্ছে, কারণ যদি রক্ত দেয়া লাগে। পানি খাওয়া শুরু হয়েছে সন্ধ্যা রাত থেকেই। এই কারণে একটু পরে পরে নিম্নচাপ - 'এক্সকিউজ মি, বাথরুমটা কোন্দিকে?' আমি বললাম, 'একটু সুস্থির হয়ে বোস। সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।' ঝামটা এলো উত্তরে, 'আরে তুমি জানো কচু। সাবধানের মাইর নাই। রেডি থাকা ভালো।'

অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা একটু খুলে ছিলো। আমি বুদ্ধি করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যদি আওয়াজ পাওয়া যায়, সে এলেই টের পাবো। মাঝে মাঝে আপুর বাবাকে দেখছি খালি করিডোরে পায়চারি করছেন। হাতে তসবি, নিবিষ্ট চোখে প্রার্থনা।

হঠাৎ একটা চিল চিৎকার। রাতের সময় বলে চারিপাশে আর কোন সাড়াশব্দই নাই। 'সে কি এলো?' আমরা একটু শশব্যস্ত হয়ে উঠি। ভেতর থেকে একজন দ্রুত বেরিয়ে পাশে NICU -তে ঢুকে পড়লো। 'নাটক করছে কেন এরা, বলে দিলেই পারে!' ভেতর থেকে সাড়া নেই। অস্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকারটা একটু পরে আবার শোনা গেলো, স্পষ্টতর, সুতীক্ষ্ণ। 'সে কি এলো?'

আপুর মায়ের চোখে একটা হাসি ঝিলিক দিয়েই উদ্বেগের ভারে চাপা পড়লো। আপুর বাবার হাতের আঙুলে তসবি শ্লথ। আরো তিনচার মিনিট পেরিয়ে গেলে দুলাভাই বেরিয়ে এলেন। মুখে হাল্কা নীল মুখোশ। চোখে হাসি। মাথাটা হাল্কা উপরে নিচে দুলিয়ে বললেন, 'ছেলে'।

আপুর বাবা তখন একদম তৈরি, আজান এই দিলেন বলে। নার্স জানালো আরেকটু অপেক্ষা করেন। নিয়ে আসি তাকে। 'বাচ্চার মা কেমন আছে?' 'এখনো সেন্সলেস, তবে স্টেবল'। পাথর চাপা দুশ্চিন্তা ফুরফুরিয়ে উড়ে গেলো!...


থিয়েটারের ভারি কাচের দরজা ঠেলে সে বেরিয়ে এলো, এসে ড্যাবড্যাবে চোখে টিউব লাইট দেখছে। এতো রাত হয়েছে, কিন্তু ঘুম নেই দেখি! সারা শরীর আঁটোসাঁটো কাঁথায় মুড়ানো। মাথায় তুলোট টুপি। গোলগোল রক্তাভ গাল, ছোট এক্টুস পাতলা ঠোঁট। আর বড়ো বড়ো চোখ। পুরো চোখ খুলতে পারছে না সে। আর একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে শীতে। আমি বেশ কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে বেশ অদ্ভুত দৃষ্টি দিলো এক পলক। তারপরে অন্য দিকে চাইলো একটু। এদিক সেদিক। জঠরের উত্তাপ খুঁজছিলো বোধহয়। তাই তাকে আবার ভেতরে নিয়ে গেলো নার্সটা।

তাকে এক পলক দেখেই আমার মনে হলো তার সাথে আমার আরো অনেক অনেক বার দেখা হবে। কিন্তু তার বিশ মিনিট বয়সের সেই পরিচয়ের মুহূর্তটা আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। সাক্ষাতে দুইপক্ষের সমান আগ্রহ বা মনোযোগ থাকে না জানি। এই সাক্ষাতটাও তেমনি। সংক্ষিপ্ত - সরল - সরাসরি। এই লেখাটা তার জন্যে। অক্টোবরের আধা রাত আধা ভোরে যে এই শহরে এলো, এবং এখন থেকে সে এখানে জল-কাদা-বাতাসে বড়ো হয়ে উঠবে। তার জন্যে।

একটু পরে ফুরফুরে মনে আমরা তিন জন, খেতে বেরুলাম। পেটে ইদুর ডনবৈঠক দিয়ে অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে। তারে দাফন করে আমরা বেশ খানাদানা করলাম। খাবারের দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তার মাথায় পুব দিকে দেখলাম সূর্যলাল হয়ে উঠছে। মেঘগুলো রঙচঙে হয়ে গেছে বেশ। এতো সাজ! পাখির কিচিরমিচির। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভাঙা ভাঙা আলো। পৃথিবীতে আজ সুন্দর ভোর...

এই সুন্দর পৃথিবীতে তোকে সুস্বাগতম জানাই...!!!

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১০

সান্ধ্যচিন্তা... অপ্রাথমিকতা ও অবিকলতা

=====
ফিলোস-ফিক্যাল
=====
শোনেন, বেশি বুইঝেন না। আর যা বুঝেন না,
সেইটা নিয়া ফটর ফটরও বেশি কইরেন না।
একদিন না একদিন ধরা খাইবেন,
জারিজুরি ফাঁস হইবো
পাবলিক আইসা গদাম মাইর দিবো
যারা শান্তিকামী গান্ধীবাদী,
তারা আপনের বেকুবিতে হাহাহিহি হাসবেন
ফিলোসোফিকে উল্টায় দিলেও ফিলোসফিই থাকে, বুঝছেন?
=====
=====
বেচাল-বিড়াল
=====
জাদুবিদ্যায় পারদর্শী এক অখ্যাত বিড়াল বসে আছে
কমলা কমলা কুমড়োর ওপরে, ক্যামেরার দিকে
আছে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে, মাথায় কালো টুপিটা
ধার নিয়েছে তার চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে,
আর পাশের বাড়ির সুন্দর মুন্দর মেয়েটা
ওড়না দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে অবিশ্বাস্য এক সুপার হিরো!
ক্যামেরাটা ছিলো ভুলোর হাতে, সে রেডি হতেই
ভুলো বলল, "ঘেউ", আর শাটার দিলো চোখটিপ -
ছবিবন্দী হলো পৃথিবীর সেরা জাদুবিদ-অতিনায়ক!
=====
=====
উৎচারণ
=====

তোমার্‌ আমার্‌ এই ভালোবাশাবাশি খুব্‌ এক্‌টা ওভিনবো কিছু না। সবাই যেমোন্‌, তেমোন্‌ ভালোবাশে নানাভাবে অ-ভালোবাশিক্‌ কথাবার্ত্তা বোলে বোলে আবাশিক্‌ জিবোন্‌ কাটাচ্ছে। অ্যাতো কিছু বুঝ্‌তে গ্যালে সারাদিনও জেগে থাক্‌তে হবে। বরোঞ্চ আম্‌রা চোখ্‌ মুদে চলো ভালোবাশাবাশি কোরি!
=====

একটি চুমুতে দ্বিধা জমে ছিলো বাতাসে শুয়ে,
সেখানে সেদিন গটমটে বাঘ ঢুকে দাঁড়ালো ঘাড় ফুলিয়ে।
ঠোঁট বাঁকাতেই বকের গলা, ভ্রূকূটিতে সন্ধ্যা,
বাইকের পেছনে তুমি আর ঘন ঘন ব্রেক।
ঢাকার রাস্তা আস্তাবলে ঘোড়ারা ঘুমায়,
আঁকাবাঁকা গাড়িগুলো অমল ধবল চিত্রলেখ!
=====

১৯.১০.১০

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১০

পাখি মন্ত্রণা

আর কতোকিছুই তো ভালো লাগে কাঁপনে মিশে থাকে এইসব দিনরাত্রির গান অজস্র কোলাহল আন্তরিক টানটান হলাহল ডুবে থাকে চুলের ভেতর, মৃদু সৌরভ…

আমাকে প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কেমন আছি। আমি খুব সরলমুখে বলে দেই, আমি ভালো আছি; অথবা বলি, এই তো চলতেছে; কিংবা বলে ফেলি, ভালোই আছি। এরকম বেশ কিছু টেমপ্লেট জবাব তৈরি থাকে – বলে ফেলতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। তারপর ভুলে যাই, অন্য বিষয়ে চলে যাই। তাকেও হয়তো পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেও ভালো থাকার কথা জানিয়ে দেয়। আমরা দুইজনেই তখন ভালো থাকতে থাকতে অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের তুচ্ছ ভালো লাগার চাইতে এইসব মানুষিক ব্যাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো কোথাও বাজ পড়ে। হয়তো কোন একটা গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ে, ডালের খাঁজে বাসা বেঁধেছিলো কোন খয়েরি পাখি, বাসার ভেতরে ছিলো তিন চারটে নতুন শিশু পাখি। ডাল ভেঙে যখন মাটিতে নেমে আসে, পাখিগুলো উড়ে চলে যায়… দূরে, অনেক অনেক দূরে…! এই পাখিরাও ভালো থাকে হয়তো, আমার সাথে যদি দেখা হতো, তাহলে আমি তাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছেন? তারা স্মিতমুখে বলতো, ভালো আছি। আপনার কী খবর? আমি হাতে একটু ভঙ্গি করে বলতাম, ‘এই তো চলতেছে’।

পাখিগুলো মারা গেছেন সবাই। মৃতের সরকারি সংখ্যা ৪, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি ডালে বসবাসকারী পাখি জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা ৫। সরকার একটি পাখির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে নাই। তারা মনে হয় ভুলে গেছে গুনতে। আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্যে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে ফোন দিলাম। অনেকক্ষণ রিং হচ্ছিলো, কিন্তু কেউ ধরছিলো না। ঘাম-শুকানো দুপুরে আমি চাতালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কানে রিসিভার চেপে ধরে রাখলাম। একঘেঁয়ে স্বরে রিং বাজছে, ট্রিং ট্রিং…

এভাবে অনেকক্ষণ, জানি না ঠিক কতোক্ষণ, রিং বাজার পরে একজন ফোন ওঠালেন। আমি চমকে গেলাম, কানের ভেতরে বাজতে থাকা ট্রিং ট্রিং ততোক্ষণে মাথার ভেতর বাজতে শুরু করেছে। সেই বাজনায় চকিত ছন্দপতন। ‘হ্যালো’, খ্যানখ্যানে স্বর শুনে একটু দমে গেলাম। আমি ফোন করেছি সরকারি হিসাবের ভুল ধরতে। যে লোকটি ফোন ধরেছে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমি পরিষ্কার দেখছিলাম লোকটা পেটমোটা কুমড়োপটাশের মতো। একটু আগে দুপুরে ভাত খেয়ে এসেছে, সাথে ঝোল ঝোল তরকারি আর সবজি ছিলো। ভাত খেয়ে মোড়ের দোকান থেকে একটা পান কিনেছে। পান চিবাতে চিবাতে এসে আয়েশ করে চেয়ারে বসে ফোন ধরেই গলা খাকারি দিয়েছে, ‘হ্যালো’। মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে তেমন কাজ নেই বোধহয়! তাই তারা এতো ঢিলাঢালা।

আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ভুল রিপোর্ট নিয়ে ফোন করেছি’, একটু থেমে আবার বলি, ‘গতকাল খবরে মৃত পাখির সংখ্যা ভুল বলেছেন আপনারা, আসলে মোট ৫টা পাখি মারা গেছেন – আপনারা লিখেছেন ৪টা। একটা পাখির হিসাব দেন নি’। লোকটা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেছে, পান চিবানোর শব্দ পেলাম না, বরং দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল, ‘হতে পারে একটা পাখির হিসাব মিলে নাই। তাতে কি হইছে? গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’


তার তীব্র স্বরে আমি মারা গেলাম। প্রশ্নটা অশ্লীল লাগছে। প্রশ্ন করার ফাঁকে তার দাঁত চিবানো বা পান চিবানো অশ্লীল লাগছে। রিসিভার বেয়ে কানে পৌঁছে যাওয়া তার কণ্ঠস্বর অশ্লীলতায় থকথক করছে। আমি যে হাতে রিসিভার ধরে ছিলাম, সেই হাতটাকে কোনো ঘিনঘিনে কমোডের ভেতরে ডুবিয়ে রেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এই প্রবল অনুভূতিগুলো আমাকে মূক করে রাখলো। টেলিফোন সেটটায় কি কোন সমস্যা আছে? লোকটা ফোন ধরার আগে কানে ট্রিং ট্রিং প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো। আর এখন তার শেষ প্রশ্নটা গনগন করছে কানের ভেতর।

‘গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

‘বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

‘আপনের কি?’

‘কি?’

আমি একদম নিথর হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাইরে স্তব্ধ দুপুর আর ঘোলাটে হলদে আলোটা অনেকটা সময় আমার সাথে স্থির হয়ে থাকলো। তারপরে প্রশ্নটা আমার ফুসফুসে পৌঁছে গেলে আমি রিসিভার আলতো করে নামিয়ে রাখলাম। তারপরে চুপ করে বসে রইলাম। পাখিটি মারা গেছেন। পাখিটি বাজ পড়ে গতকাল মারা গেছেন। আজকে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয় তাকে ভুল হিসাব করে গোনায় ধরে নি। পাখিটি ডালের ফাঁকে পাতার গভীরে শুয়ে আছে। তার পেলব বুকে একটা স্পন্দনও আর বাকি নেই। কয়েকটা সবুজ পাতা পুড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আরো কিছু পাতা এখনও সবুজ হয়ে আছে।

হঠাৎ কেমন বাতাস হলো, মৃদুমন্দ শিহরণ। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবুজ পাতা কয়টি পাখির স্পন্দনহীন দেহটিকে ঢেকে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

*****

১৪.১০.১০

শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১০

জগাখিচুড়ি দুই নম্বর!

 ক্রেজ অর্থাৎ উন্মাদনা টের পেলাম ফেইসবুক থেকে। আমার খোমাখাতা-বন্ধুমহলে অনেকেই তার ভক্ত বলে দেখলাম নতুন গানের খবরাখবর জানতে সবাই ইচ্ছুক। প্রায় দুই বছর হয়ে গেলো তাই সবাই জানতে চাইছে কবে নতুন গান - নতুন অ্যালবাম আসবে। আমিও ইতস্তত ঘুরঘুর করলাম অর্ণবের ফেইসবুক পাতায়। কিছুদিন পরে জানলাম, 'রোদ বলেছে হবে' অ্যালবামের নাম। রিলিজ পেলো এই গত সপ্তাহে। আমি কিনলাম গতকাল।

অর্ণবের গান নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়ে গেছে। গত চার-ছয় বছরে একটা নির্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে তার। 'বাংলা' ব্যান্ডের গীটারিস্ট আর ভোকাল অর্ণব যখন 'সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছে ঘর' অথবা 'তুই গান গা' গেয়েছেন, তখন থেকেই তিনি পরিচিত। এরপরে 'সে যে বসে আছে' থেকে যে তুঙ্গ খ্যাতি সেটুকু সরিয়ে তার সাথে নিবিড় পরিচয় হলো "চাই না ভাবিস" অ্যালবামে। অ্যালবামটিকে আমি একশব্দে বলি, 'ভিন্ন', আরেক শব্দে বললে 'অগতানুগতিক'। সেটা অর্ণবের গলা, বা গায়কী ঢঙকে বাদ দিলেও গানের কথা আর সুরের কারণেও অনেকটা, বেশিরভাগটা। সম্ভবত ভার্চুয়াল জগতে আমার দেখা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গানের কলি "হারিয়ে গিয়েছি" গানটি থেকে নেয়া।

সে যাকগে। অসংখ্য তারিখ-না-জানা রাতের নিঃস্তব্ধতায় যেসব গান সঙ্গ দিয়েছে, সেগুলো না হয় নিজের জন্যেই তোলা থাক। তবে অর্ণব খুব ধুমধাড়াক্কা নন। রক-মেটাল রক জঁরার বাংলা গানগুলো যেমন ব্যান্ডভিত্তিক চর্চিত হয়, সেভাবে দেখলে নতুন বা ভিন্ন ঘরানায় আধুনিক গান ছাড়া কিছু ছিলো না। সেই ক্লিশে গানের কথা, তুমিয়ামির জলো বাতচিত ফেলে দেয়ার সময় অনেক আগেই হয়ে গেছে। ফিউশন থেকে ভাটিয়ালি বা পল্লীগানকে তুলে এনে রিমিক্স করা হচ্ছে নানাভাবে, সেখানেও মৌলিকত্ব হারায় অতিরিক্ত যন্ত্রের মন্ত্রণায়। তাই চুপচাপ অনেকেরই অর্ণব প্রিয়।

"চাই না ভাবিস" -এর পরে "হোক কলরব" আর "ডুব" একদিকে যেমন অনেক রকম খেয়াল খুশিতে গানবাজনা তুলে আনছে, সেখানে অর্ণবের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে দিনে দিনে। 'ডুব'-এর বেশ কিছু গান শুনে মনে হয়েছে কিছুটা কি জনপ্রিয়তার ভূতে ধরলো? কিছুটা কি তরুণ চাপল্যে পেলো তাকে? যে সুরগুলো জমে জমে শ্রোতার ভেতরে জায়গা করে নেয়, তারা এবারে হয়তো একটু লঘু হয়ে উঠেছে। "ডুবে"র পরে তাই আশা করছিলাম পরের অ্যালবামে অর্ণব আরেকটু সচেতন হবেন। সঙ্গীতের এতো এতো দিক, বিচিত্র গলিঘুপচি যেখানে খুঁজলে দারুণ দারুণ সব মণিমুক্তা পাওয়া যায়। তিনি না হয় সেই পথেই হাটুক। প্রথাগত চটুল জনপ্রিয়তা গানবাজনার বারোটা না বাজাক।


তাই "রোদ বলেছে হবে" নিয়ে বেশ আগ্রহ জন্মালো। খাপের ভেতরটা একটু আলাদা। একটা ছোট লিফলেটের মতো বই, লিরিক ভেবেছি। কিন্তু শেষ চারপাতায় পেলাম গানের লিরিক, তার আগের পাতাগুলো অদ্ভুত সুন্দর একটা গল্পে সেজে আছে। অর্ণবের লেখা, ছবিগুলোও তার আঁকা। অর্ণবের আঁকাআঁকি আগে দেখার সুযোগ হয় নি, তাই রীতিমত মুগ্ধই হলাম। ডিজিটাল পেইন্ট নিয়ে দেখাশোনা কম, গ্রাফিক্সের কাজ দেখে তাই আসলেই ভাবছিলাম মানুষের কল্পনা কতো বিচিত্রই না হয়! অনেকটা অর্ণবের মাথার ভেতরে ঢুকে পড়েছি মনে হচ্ছিলো। (Being John Malcovich!) আর যে গল্পটা অর্ণব বললেন, একটা সোনার হরিণ, সেই স্বপ্নপোকা, মায়াঘাত মাখা তীর, দুটো তীব্র আঁধার চোখের আক্রমণের, সেই গল্পটা আমি বলতে চাই না এখানে। কোন অ্যালবামের মাঝে এমন কিছু পাওয়ার জন্যে শ্রোতামন প্রস্তুত ছিলো না!

শেষ কথাগুলো বারবার ভাবছি...


সব সবুজ...
লাল হয়ে উঠছে ...
রোজ
আমার চারপাশে
বাক্স বাক্স ...
আহাম্মক বাক্সের দল!

CD তে মোট বারোটা গান। প্রতিধ্বনি, চিঠি পাঠাও, রোদ বলেছে হবে, মাথা নীচু, ইনিয়ে বিনিয়ে, বিড়ি, কে আমি, আমি যদি, মন খারাপ, একটা মেয়ে, মেঘ ফেটে গেছে, তোমরা যা বলো।

তুলনামূলকতা চলে আসে, প্রিয় গান শুনতে গেলে। তাই প্রতিধ্বনি শুনতে শুনতে হোক কলরব অ্যালবামের ঢঙ মনে পড়লো। গীটারের টোনের দিক থেকে খুব সজীব একটা আমেজ তৈরি হতে থাকে। অবশ্যই তো। তুমি একটা গানের যাত্রা শুরু করছো, সেটা কেন বিষণ্ণভাবে শুরু করবে? আসো, পথে নামি, রওনা দেই।

ঘাসফড়িং ও পাখির বুকে স্বপ্ন যতো
প্রাচীন কিছু সংগ্রহের গান হয় নিহত
সঙ্গীবিহীন সব হারানোর দুঃখ জেনে
রূপকথা তার সময় মতো নিয়ম মেনে।
(কথাঃ রাজীব আশরাফ)

অ্যালবামের সেরা গান সম্ভবত "চিঠি পাঠাও"। বিক্রম সিংয়ের লেখা গানটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগে গেছে। গানের মেজাজ সেই পুরনো 'চাইনা ভাবিস'-এর মতো মনকাড়া। প্রতিধ্বনি গানের রেশ কাটতে না কাটতেই অর্ণব হুট করে টেনে নিয়ে গেলেন রাতের বিস্রস্ত একাকীত্বের মধ্যে। সেখানে আমার সাথে কেবল আমি। চারপাশে নিশ্চুপ হয়ে আসা স্ট্রীটলাইটের ক্ষীণ আলো। এই সময়ে আর কিছু দরকার নেই, কিছুই না!

"শীতলপাটি চিনেছে রাত চিরকাঙাল
চির কাঙাল স্নেহের মতো একটু দিন
ভেঙেছে কতো নষ্ট ঢেউ উন্মাদের
কতো না মেঘ মেঘের কাছে বেড়েছে ঋণ।
মেঘের নীচে চাদোয়া নীল মফঃস্বল
মেঘের নীচে হেসেল ঠেলে বিষণ্ণতা।।"
এমন নিবিড় কথা, কবিতাই তো। একই সাথে গোপন আর সৎ, একই সাথে অভিমানি আর নিস্পৃহ। আমি এই গানটিই বারবার ঘুরে ফিরে শুনছি।

এর পরে শিরোনামের গান ''রোদ বলেছে হবে", এবং এই গান হতাশ করেছে 'ডুবের' গানগুলোর মতো। হয়তো ভিন্ন মুডের সাথে এই গানের অন্য চরিত্র ধরা পড়তে পারে, তবে আমার কাছে তেমন একটা আহামরি মনে হয় নি। এটার কথা রাজীব আশরাফের লেখা। তবে 'প্রতিধ্বনি'র কারণে তাকে আর দোষ দিলাম না।

এর পরের গান (মাথা নীচু)-এর কথা সাহানা বাজপেয়ীর। 'স্বপ্ন দেবে ডুব' যেমন ভাবিয়েছিলো, উস্কে দিয়েছিলো অনেক অনেক চিন্তার উনুন, তেমনি এই গানটিও ভাবাচ্ছে। সুরের দিক থেকে একটা থমথমে আবহের সাথে গানের কথাগুলো মিলেমিশে একটা অস্বস্তিকর অনুভব দেয়, যে অনুভব আমাদের বাস্তবতার একটা নিয়মিত অনুষঙ্গ। যেমন প্রতিক্রিয়াহীনভাবে আমরা খানিকটা বিযুক্ত হয়ে আছি আমাদের বাস্তবতায়, সেটারই ছবি এই গানে।
কথার বেড়া গেঁথে দিয়ে গেছে, কবেকার কোন কবি
বলবার কিছু বাকি নেই আর, নিথর নীরব এ ছবি

"ইনিয়ে বিনিয়ে" চমৎকার গান। তাল লয় মিলিয়ে সেই খাপছাড়া অর্ণব। মজা লাগে, এমন বেখাপ্পা তালের গানে মিশ খেতে খেতেও যেমন বেলাইন হয়ে যাওয়া, পাগলামি ঘরানার এই সুরটুকু জমতে জমতে আইসক্রিমের মতো গলে যেতে থাকা। পাহাড় থেকে বরফখণ্ডের গড়িয়ে পড়া বা উঠে উঠে আসা ধোঁয়ার মতো গান। জোহাদের সাহায্যভোকালটাই খালি বাজে লেগেছে। অর্ণবের গলার সাথে মিশেও নাই, পরিপূরকও হতে পারে নাই।

এই সুযোগে অর্ণবের গলা নিয়ে কিছু কথা বলে রাখি। এই অ্যালবাম শুনে মনে হচ্ছে হয়তো তিনি গলার যত্ন কম নিচ্ছেন। ফলস নোটে এতো বেশিবার চলে যাওয়া, লিরিক বেশিরভাগ জায়গাতেই অস্পষ্ট হয়ে ওঠা পীড়া দিয়েছে। হুট করে লিরিক হাতে না নিয়ে গান শুনতে বসে শব্দ বুঝতে না পারা শ্রোতার কাছে বিরক্তিকর, গায়কের জন্যে বিব্রতকর। তার এই দিকে আরো সচেতন হওয়া দরকার। আর ভুল উচ্চারণও পীড়াদায়ক ভীষণ। বানান ভুল যেমন একটা সুন্দর লেখার বারোটা বাজায়, তেমনি ভুল উচ্চারণের গানের আমেজের ক্ষতি করে। বিদেশে দেখি বুড়ো বুড়ো গায়কেরাও কী চমৎকার গলা ধরে রেখেছেন, আমাদের দেশের গায়কেরা কেন গলার বারোটা বাজান? সেটাকে ঠিকঠাক না রাখলে যতোই ভালো সুর আর কথা হোক না কেন, গান শুনতে ভালো লাগে না।

"বিড়ি" গানটার শিরোনাম যতোটা চমক দেয়, গানটি ততোটা মুগ্ধ করেনি। বিড়ি খেলে হয়তো আরো একটু রিলেট করতে পারতাম, তবে সে ব্যাপারেও সন্দিহান। প্রথম লাইন (হাত থেকে বিড়ি পড়ে যায়) ছাড়া বিড়ির গুরুত্ব বুঝলাম না। তাই এটাকে দ্রুত পেরিয়ে যাই।

অ্যালবামের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর গান সম্ভবত "কে আমি"। এমনকি লিরিকের হিসেবেও প্রাণবন্ত (রাজীব আশরাফ আবারও)। এই গানে বিশেষ করে যেটা কানে বেজেছে সেটা হলো গীটারের নির্দিষ্ট একটা প্রগ্রেশন। অর্ণবের অ্যালবামে এমন দুয়েকটা গান থাকেই, সেগুলো বাজনার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে। 'কে আমি' সেই কানের ক্ষিধেটা খুব ভালোভাবেই মিটিয়ে দিয়েছে। আর এই গানটা শুনে মনে হয়েছে লংড্রাইভে দারুণ মানাবে!

"রোদ বলেছে হবে"তে অর্ণব নিজে দুটো গান লিখেছেন। তার প্রথমটা "ইনিয়ে বিনিয়ে", আর পরেরটা "আমি যদি"। কিছুটা ফোক ঘরানার লিরিক, তেমন নজর কাড়ে নি, তবে এই গানটা অর্ণবের গাওয়ার গুণে একেবারে খারাপ লাগছে না!

বৃষ্টিমুখর দিনে শুনছিলাম, সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো বলে করার কিছু ছিলো না। তাই রাজীব আশরাফের তৃতীয় গানটা খুব ভালো লেগে গেলো। "মনখারাপের একটা সকাল, শূন্য আকাশ সফেদ নীলে, ক্লান্ত কোন চিলের প্রতি, তুমি কি আজ দিয়েছিলে? একটা অচীন ছায়াও তখন তোমার পাশে গোপনে, দাঁড়িয়ে ছিলো একান্তে ঠিক খুঁজতে তোমায় অনুরণে।" মন খারাপ সময়গুলোতে যেসব গান বালিশে ওয়াড়ে মিশে থাকে, আদর করে, সেগুলোকে তো ফেলে দিতে পারি না। সেগুলো মনের ভেতরে, ত্বকের গভীরে সেঁধিয়ে যায় খুউব!

ভালো লাগার দিক থেকে তিন চার নম্বরে যে গানটা, সেটা এর পরেই, শিরোনাম "একটা মেয়ে"। এই গানটার লিরিক এক কথায় অসামান্য লেভেলে ভালো লেগেছে। মেয়েটা হয়তো জানে না, তাকে নিয়ে কি অদ্ভুত গান গাইছে আরেকটা ছেলে। এই অনুভূতিপ্রবণতা, এই অন্যকে বুঝে ওঠার নিরন্তর চেষ্টা মানুষ এখন অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে মনে হয়। ভার্চুয়ালি কতো কতো দূরত্ব পাড়ি দিয়েছি আমরা, তাই তো পৌঁছুতে চাই মনের গহীনে। কী আছে তোমার মনে, মেয়ে? এক এক শব্দে উঠে আসছে টুকরো টুকরো মেয়েটা।
একটা মেয়ে/ কাক ভেজা রোদ/ রোদ পোড়া ঘাস/ কাশফুল/ দীর্ঘশ্বাস/ পথের পাশ/ মনের ভুলে/ রঙিন ফুল

তবে কাব্যিকতায় সবগুলো গানকে ছাড়িয়ে গেছে - মেঘ ফেটে গেছে। এবং আমি খুশি হয়েছি যে এই গানের কথা সাহানা বাজপেয়ীর লেখা দেখে। হুট হুট করে এমন কিছু লেখেন, মুগ্ধ হয়ে যাই!
"কোপাই'র মেটে জল থেকে, বুনো গন্ধে ভিজে
বকের ওই দলটা উড়ে এলো আমার দিকে
গত বিকেলের বার্তাসহ, ডানায় নিয়ে কাশফুলের রোঁয়া।
এই বেশ ভালো
মেঘ ফেটে গিয়ে চুঁইয়ে পড়া একটুখানি আলো"
একু্য়স্টিক গীটারে একেবারে খালি গলায় গান! আহা! চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম, কোন বৃষ্টিশেষের বিকেলে বন্ধুরা মিলে গোল হয়ে এলোমেলো বসে আছে। আর পুরো দলের মাঝে একজনের হাতে গীটার, সে মেঘধোয়া আকাশের দিকে চেয়ে আনমনেই এই গানখানি গাইছে। বাকিরাও হয়তো তার সাথে মিলে মেঘফাটা সেই একটুখানি আলোর দিকে তাকিয়ে আছে!

আর শেষ গানখানা রবিবাবুর। আর অর্ণবের সেই পাগলা অ্যারেঞ্জমেন্ট। সেই বেখেয়াল উদাম গলা, যে গলায় সাধারণত অন্য গানগুলো সে গায় না। ভালোও লাগছে, আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আসল অ্যারেঞ্জমেন্টটাই ভালো ছিলো। যতোগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন পর্যন্ত অর্ণব গেয়েছেন, সেগুলোর সবগুলোতেই আমার এই রকম মনে হয়েছে। তবু, এই প্রচেষ্টাটুকু 'রক ইউদ রবীন্দ্রনাথ' টাইপের আবালামির চাইতে অনেক ভালো!


(*পুরো অ্যালবামের কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশটা বাংলায় দেয়ার জন্যে অর্ণবকে ধন্যবাদ। সবাই কেন যে এটা ইংরেজি দেয় আমি বুঝি না। বাংলার মানুষ, বাংলায় গান গেয়ে যদি ইংরেজিতে ধন্যবাদ জানায়, তবে কেমন উটকো আচরণ বলে মনে হতে থাকে। সেটা এখানে ঘটে নি।)

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১০

জগা বললো - জগাখিচুড়ি!


সময় খুব অদ্ভুত জিনিস। এই মুহূর্তে যা ভাবছি, সেই কথাটা হুশ করে আমার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে! এই পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে বন বন করে, সেই ঘূর্ণনের বেগ জানি কতো? ১৬০০ কিলোমিটার প্রতিঘন্টায়! আমি থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকলেও সটান জোরে চলে যাচ্ছি কতো দূরে। এই দূরত্ব অমোচনীয়। আবার দ্রুততায় মিশে যাচ্ছি কারো কারো সাথে। আমাদের এই পরিচয়, এই ক্ষণিকের মিলন ঠিক একটা দেয়াশলাইয়ের অগ্নিকণার সমান। ফপ করে নিভে গেলে ঘুটঘুট্টি।

সময় নিয়ে ভাবতেও সময় লাগে। সেই সময়ের কথা লিখতে আরো একটু সময় চলে যায়। আজ – অদ্য তাই আলসেমি। আড়মোড়া ভাঙি না, ভাঁজ করে রেখে দিই। সময় জানে, আমার সাথে লড়াইয়ে সে সবসময় জিতবে। তাই মুচকি হাসে, তাচ্ছিল্য।

সময় চলে যাচ্ছে এটা হ্যান্নার মুখের দিকে চাইলেও বুঝতে পারি। হ্যান্না ডাকোটা ফ্যানিং। এই তো ক’দিন আগে দেখলাম ছোট্টমণি। সবার সাথে কথা বলে গিড়বিড়-কলকল। কেউ একটু মুখ ভার করে কিছু বললেই ছলোছলো হয়ে ওঠে, টলমল করে কচুপাতার ওপরে একবিন্দু শিশিরের মতো। আবার স্মিত হাসি দিতেই খিলখিল! সেই হ্যান্নার শিশুমুখ কিছুতেই ভুলতে পারি না। সেও বড়ো হয়ে যাচ্ছে তরতর করে – সুইট সিক্সটিন। সেদিন তার ছবি দেখলাম – হাউন্ডডগ। দেখার সময় বারবার মনে পড়ছিলো টেইকেন-এর পিচ্চি অ্যালি’কে। দুটো ছোট ছোট বেণী দুলিয়ে আধো আধো বোলে কথা বলতো মিষ্টি মেয়েটা, আর এখন কেমন গহীন অন্ধকার সব চরিত্র করছে। মানুষের ভেতরের কুৎসিত দিকগুলোর শিকার হচ্ছে রূপালি পর্দায়, তারপরে সেই নীল চোখে তার অশ্রু...। সেই অশ্রু আর টলমল করে না, চোখেই শুকিয়ে ফেলে সে। তারপরে চোয়াল শক্ত করে। পৃথিবী চুরমার হয়ে ঘুরছে, তার সাথে পাল্লা দিতে হবে না! তাই হ্যান্না বড়ো হয়ে ওঠে...

বার বার মনে হয়, এ আমি মানি না।

সেই বেদনাতেই কি না। পৃথিবী ঘুরে ঘুরে আমার সাথে দেখা করিয়ে দেয় এক গাড়ি চোরের। নাম – মিশেল পোয়কার্ড। তার সাথে ঘুরতে ঘুরতে দেখা পাই প্যাট্রিসিয়ার। এরা দুইজনে দেড় ঘন্টা বক বক করে, ঝগড়া করে, মারপিটও করে কিছুটা। দৌড়ে বেড়ায় সাঁজেলিসে'র এভিন্যু ধরে। গাড়ি চুরি করে মিশেল, সেই গাড়িতে চড়ে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে যায় প্যাট্রিসিয়া। আর সবচেয়ে ভালো লাগে ৩৯ মিনিট ধরে ছোট একটা ঘরের ভেতর তাদের কথাবার্তা। দুজনে বিছানায় বসে কথা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। এরই মাঝে ক্রমাগত সিগ্রেট ফোঁকে মিশেল। আবোল তাবোল অসংলগ্ন আলাপ।

আপনার কি কখনও এমন হয় নি, কারো সাথে অর্থহীন, লক্ষ্যহীন কথা বলেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। কথা বলার পরে ভুলেও গেছেন যে কি বিষয়ে কথা শুরু করেছিলেন? মিশেল – প্যাট্রিসিয়ার গল্পটাও সেরকম। ছবির শুরুতে একটা খুন করেছে মিশেল, এক পুলিশ ড্রাইভারকে দূর্ঘটনাক্রমে গুলি করে মেরে ফেলেছে সে। তার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্যারিসে ফিরে এসেছে জেলের খাঁড়া মাথায় নিয়ে শুধু প্যাট্রিসিয়ার জন্যে। তাকে নিয়ে সে পালিয়ে যেতে চায় ইতালি। সেখানে গিয়ে দুইজনে থাকবে। কিন্তু প্যাট্রিসিয়া যেতে চায় না। গড়িমসি করে। সেই এক ঘরের দৃশ্যে জানায়, তার ভেতরে আরেকজন আসছে। মিশেল আর তার সন্তান। এর জন্যে প্যারিসে থাকতে চায় সে। আর মিশেল তাকে নিয়ে চলে যেতে চায়।

খুব একটা রুদ্ধশ্বাস কিছু নেই। তারপরেও ছবির নাম – ব্রেথলেসজাঁ-ল্যুক গ’দার পরিচালক। সম্ভবত ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিচালক। পঞ্চাশ বছর আগে তার তৈরি এই ছবিটা দেখে রুদ্ধশ্বাস হয়েই বসে থাকি।

পৃথিবী কেন বন বন করে ঘোরে। কেন সে একটু থম ধরে দম নেয় না। চারপাশে এতো বাতাস, এতো হাহাকার মিশে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাঝে!

আমি একটু নির্জলা বাতাস চাই, বিশুদ্ধ অক্সিজেন না হলেও চলবে। খালি একটু ভেজাল মেশানো, কোমল পানীয়ের মতো, বাতাস ফুসফুসে টেনে নেবো। তারপর একটু সময় বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখবো। এভাবে আমার মনে হবে আমার চারপাশে আর কিছু নেই। কেউ নেই। কোন কিছু সত্যি সত্যিই আমাকে আর স্পর্শ করতে পারছে না। এই ভাবনা গাঢ় হওয়ার আগে হুট করে সেই বাতাসটুকু ছেড়ে দিবো। তাহলে মনে হবে আমি বেঁচে আছি। আমি ব্রেথলেস নই। আমার ভেতরে ফুসফুস সর্‌সর্‌ করে কাজ করছে। পেঁচিয়ে উঠছে ধমনীতে রাগ-ক্ষোভ-ভোগের স্রোত। গ’দার জানেন না, তিনি যে বছর মারা গেছেন সেই বছরেই আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম। আর এতোটা সময় পরে, তিনি আমাকে ব্রেথলেস করে দিলেন জাম্প-কাট করা ছবির শেষ দশ মিনিট দিয়ে।

সবকিছু আসলে লাটিমের মতো ঘুরছে, এই পৃথিবী, তার মেরুরেখা-বিষুবরেখা, সমুদ্র-হিমাচল, আমাদের খবরের কাগজের প্রথম পাতা, আমাদের মুখ- প্রমুখ সকল কিছুই ঘূর্ণিতে মিশে হারিয়ে যাবার ঠিক আগে আগে ঝলসে উঠছে। এই বিশ্ব-চরাচরে তার অস্তিত্বের চে’ আর জরুরি কিছু নাই!



*****

২১.৯.১০

বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০

সম্প্রতি অথবা-নগরে


কাচের জানালায় জমা হচ্ছে ড্রিজ্‌ল বিন্যাস, সন্ধ্যা খুব মোলায়েম শ্বাপদের ঢঙে হেলে পড়ছে
পুড়ছে দেয়ালে ঘোলাটে রোদের বাকি অংশ – যা জমে ছিলো – জমে থাকে


খোলা চোখে যা যা দেখা যায়, দেখা যেতে পারে, সে সব বিপুল বিভ্রম
গণিতের মতো প্রতিপাদনের উপায় নেই, আমাদের সময় কেমন রঙিন ওড়না হয়ে ভাসছে


গহন শহর ইটের পরতে অযুত গল্প লিখিত হয়, কোনো ইতিহাসে যার লিপি থাকবে না
জানা হবে না, কিভাবে স্ট্যাটাস বদলে যায় কোমল কিশোরীর, ছায়াহীন-নগরের পিঠে


ঘেঁয়ো কুকুরটি গতকাল থেকে ভাসমান ভিক্ষুকদের পিছু পিছু হাঁটছে, পেরিয়ে যাচ্ছে
শামুক–আইল্যান্ড, হৃদয়–ট্রাফিকের গরম চোখ, শহরে গরম ফ্যানের খাদকের অভাব নাই


'ঙ' -তে ব্যাঙ, যে ব্যাঙের গল্প ভাঁটাগুলোর ধোঁয়ার সাথে পাক খায়, নিঃসীমে উড়ে যায়
সেই রাজকুমার আজ মলিন কাচপুর ব্রিজের ওপর দীর্ঘ গাড়িজটে আটকা পড়ে হাই তুলছে


চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর দুটো টিকেট পেয়েছি, তোমার সাথে আমি চলচ্চিত্রের চর্চা করবো
অ্যারোনোফস্কির ছবি আমি বুঝি না, ঘোর ঘোর লাগে। তার চে' তোমার কোমল বাহুর উষ্ণতা শ্রেয়


ছবি দেখার সময়ে তুমি, কেন জানি, আমাকে দেখো না, ছবির দিকেই তাকিয়ে থাকো
তখন আমি তোমার পাশে বসেই তিন মুহূর্তে অসংখ্য দৃশ্যকল্প খুন করি


জঙ্গল কমে গেছে নগরে, তারপরেও হঠাৎ বড়োলোকপাড়ার গহীন গলিতে
আমার শীত লাগে, গাছের ছায়ার তলে আমি রূপকথা মাপি, ঘেয়ো কুকুরের চোখ চাটি


'ঝিনুক নীরবে সহো' বলে দিলে কবির কিছুই হয় না, সে তারপরে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে
খালি ফেঁসে যায় নির্বাক ঝিনুক, ডুবুরি না এলে পরে মুক্তোটাকে তার কুৎসিত লাগে


ঞ্যামন নাঁকে নাঁকে কঁথা বঁলছে জেল-আটক বাবর, তেল চুপচুপে চুলগুলো তার, অনাদরে ধূসর,
ক্রমশ পর্দাজুড়ে বেলেল্লার ফ্রেম – আর সেখানে গোলাপি শাড়ির সাথে ইফতার খায় পাজামা দাড়ি



****

রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০১০

স্মৃতিবিমুখ, প্রমুখ মুখ

চিলতে রোদে পাখনা ডুবাই, মুচকি হাসে শহরতলি
রোজ সকালে পড়ছে মনে, এই কথাটা কেমনে বলি?


- “বল, জোরে জোরে বল, ক’য়ে আ-কারে কা, ম’য়ে আ-কারে মা, ন — কামান”
ওপাশে খানিক নিশ্চুপ বিরতি, তার চোখের দৃষ্টি ফ্যালফ্যালে। বোবা।
- “কি হলো? চুপ করে আছিস কেন? কি বললাম, পড়্‌!”

ফ্যালফ্যালে চোখের সামনে শক্ত ঝুঁটি ঝলসে ওঠে। সেই সাথে ঝলসে ওঠে বছর দশ বয়েসী কোমল ধবল হাত। হাতের মুঠোয় ধরা বরইয়ের ডাল নেমে আসে ফ্রকের প্রান্তে। ফ্রকটার বয়েসও মাত্র সাত কিংবা আট। আসলে ফ্রকের নয়, ফ্রক-পরিহিতার। আমাদের সামনে চিরন্তন ফ্রেমে আটকে প্রাগৈতিহাসিক হয়ে উঠতে থাকে দৃশ্যটা। ঝুঁটিবাঁধা মেয়েটার হাতে একটু একটু মার খায় সামনে বসা আরেকটা মেয়ে। ওই মার খাওয়া মেয়েটার কোন দোষ নেই। ওর সামনে খোলা প্লাস্টিকের রঙজ্বলা বই, সেই বইয়ের একটা অক্ষরও সে বুঝতে পারে না। ‘কামান’ শব্দটা সে আগেও শুনেছে। এই তো সেদিন রাতে সবাই গোল হয়ে বসে টিভিটার সামনে। সেখানে শিঙার ফুঁকের সুরে নাটক শুরু হয়েছিলো। সেই নাটকে শুনেছে, “কামান দাগো!” তারপরে টিভির পর্দায় খালি ধোঁয়া ধোঁয়া, আর জোরে একটা শব্দ হয়েছে, দুড়ুম! ঐ কালো কালো নল দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে টিভির পর্দা সাদা করে দিয়েছিলো। মেয়েটার মনে হয় এই ধোঁয়া হয়তো বসার ঘরটাকেও ঢেকে ফেলবে।

তাই আজকে দুপুরে শুনশান ব্যালকনিতে ওর আপুর হাতে ধরা বরইয়ের ডাল যখন সপ সপ করে নেমে আসে, মেয়েটা খুবই অবাক হয়ে যায়! আপু তাকে মারছে কেন! সে কি কোন দোষ করেছে? বা কোন ভুল করেছে? নাহ। ও তো ভাবছিলো কামানের নল, ধোঁয়া আর টিভিটার কথা। আপুর মারগুলো ওর হাঁটুর নিচে এসে পড়ছে আর ওর বুকের ভেতরে গুম গুম করে উঠছে। এক হাত দিয়ে অন্য পায়ের আঙুল চেপে ধরে মেয়েটা চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে। আমার তৈরি করা ফ্রেমটা গলে অতলান্তিক হয়ে যায়!

সেদিন বিকেলে ওদের শহরতলিতে বড়ো বড়ো কামান আসে। বরইয়ের ডালটা এলোমেলো করে দিয়ে খটাখট বুটের শব্দ উঠে আসে। ওদের বাসা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়! মেয়েটা দৌড়ে বাসার পেছনে কুয়োর ভেতরে লুকায়। ওকে দুদ্দাড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো ওর আপুটাই। তারপরে একটা কচুরির ঢিপি মাথায় চাপিয়ে কুয়োর ভেতরে নামিয়ে দিয়েছিলো।


কুয়োর ভেতরে মেয়েটা বসে ছিলো সন্ধ্যা অব্দি। তারপরে কুয়োর বাইরে লাল লাল আগুন জ্বলে উঠলে ও বেরিয়ে দেখে ওদের বাসার জানালার পর্দাগুলো পুড়ছে। সেদিন থেকে মেয়েটা পুড়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। আজ সকালে, এতোগুলো বছর পরে সেই মেয়েটি মারা গেছে। গত তিন বছর সে অ্যালঝেইমারে ভুগছিলো। স্মৃতি কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছিলো স-ও-ব। মাথার ভেতরে কী এক কীট ছিলো তার, কেউ কি পুরে দিয়েছিলো? তারপরে হঠাৎই আজ সকালে, যখন একটু একটু করে আলো ফুটছে, তখন সে মশারির ভেতরে যেন সব ফিরে পেলো। আমি পাশে বসে ছিলাম। মশারির ভেতর থেকে কাঁপা কাঁপা একটা হাত বেরিয়ে এলো – রুগ্ন, থরথরে। নিঃশ্বাস নিতেও যার কষ্ট হয়, সে হঠাৎ যেন কী অসুরিক জোর পেয়ে গেলো! আমার হাতের আঙুল জোরে আঁকড়ে ধরে এক দমে বলে উঠলো,
- “বাবু, বাবু! বল তো, জোরে জোরে বল, ক’য়ে আ-কারে কা, ম’য়ে আ-কারে মা, ন — কামান”



*****
- অনীক আন্দালিব
২২.৮.১০

বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০১০

যৌনকর্মীঃ একজন পেশাজীবীর স্বীকৃতি ও তদসংলগ্ন ছেঁড়া চিন্তা

গত পরশু (১৮/৮/২০১০) বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটু খবরের শিরোনামে এসেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলবৎ করার ব্যাপারে মূল আলোচনা বা বিতর্কের জায়গায় ছিলো সুপ্রীম কোর্ট। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটাকে পুনর্বহাল করেছিলো তারা। আর এখন নির্বাচন কমিশন ভোটার আইডি'তে যোগ করেছেন বেশ কিছু পেশা। তাদের বক্তব্য, নতুন যোগ করা পেশাগুলোকে আগে চিহ্নিত করা হতো না। সেই পেশাজীবী মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতেই এই উদ্যোগ।

লিস্টিটা দেখলাম- যৌনকর্মী, ইমাম/পুরোহিত/যাজক(clerics), সেবিকা, হেয়ার-ড্রেসার, ধোপী, কাজের লোক (মেইড), মালী, ক্লিনার, বাবুর্চি, দর্জি, ড্রাইভার। তবে এই পেশাগুলোকে নিয়ে তেমন আলোচনা তৈরি হয় নি। বাঙালি মধ্যবিত্তের মননে 'তোলপাড়' তুলে ফেলেছে কেবল যৌনকর্মী পেশাটি। এই নিয়ে এরই মাঝে কিছু ব্লগে কয়েকটা লেখা দেখলাম, মূলত খবরটার প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আশা করেছিলাম যেমন, ঠিক তেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সকলেই আমার ধারণাটিকে বদ্ধমূল করেছেন যে বাংলাদেশের সামাজিক চালচিত্র মোটেই এই পদক্ষেপের জন্যে অনুকূল নয়।

যৌনকর্মী সংক্রান্ত প্রাথমিক 'বুকিশ' আলোচনার দিকে যাবো না, সেদিকে আমি আপনার চাইতে বেশি কিছু জানি না। তাই চলুন একটু অন্যদিকে চোখ ফেরাই। ঐ যে বলছিলাম, নির্বাচন কমিশন এবং সুপ্রীম কোর্ট নিয়মিতই কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের মাঝে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে। এই উঠে আসার কারণ হয়তো তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের সাথে আমাদের মনন, সামাজিক প্রথাবদ্ধতার অমিল মূলাংশে দায়ী। ধর্মপ্রবণ এবং মোটামুটি অশিক্ষিত এই জনপদে গিজ গিজ করছে মাথা, সেই মাথায় চুল গজায় আবার ঝরে পড়ে টাক বিস্তৃত হয় কিন্তু খুলির ভেতরে ধূসর-বস্তুতে খুব বেশি আলোড়ন ওঠে না। যে খুলিগুলোতে কিছুটা রসদ থাকে, সেগুলো ড্রেন দিয়ে বা প্লেনে চড়ে পাচার হয়ে যায় ফর্সা-চামড়ার দেশে। তার এখানকার কালো, কুৎসিত, কুশিক্ষিত মানুষের মনন একটা আধা-ধর্মান্ধ-আধা-সুশীল অবস্থানে আটকে থাকে (আছে)। এই অবস্থায় আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা পরপর দুটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। "যুগের অন্ত" আক্ষরিকার্থেই! কারণ, জন্মাবধি কাগজে কলমেও বাংলাদেশ সাড়ে চার বছরের বেশি সময় ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পারে নি।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সময়ে যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছিলো যে এই ইসলামিক রাষ্ট্রটি ১০০ বছর বাঁচবে, যুগে যুগে এইখান থেকে তৈরি হবে নব্য-মুসলিম স্কলার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে ও সভ্যতার উৎকর্ষে তারা অবদান রাখবেন; সেই সুখ কল্পনা ছেঁড়া কাথার ফুট দিয়ে পালিয়েছে। পেছনে ছিলো সামরিক লাঠির বাড়ি। আধামূর্খ-আধামুসলিম বাঙালিত্বের লুঙ্গি খুলে খুলে যখন পাক-পবিত্র পাকিস্তানিরা চেক করেছে, তখনই বোঝা গেছে পলিমাটিতে মরু-রুক্ষ ইসলাম জমবে না। এখানে পীর-আউলিয়াদের হাত ধরে আগত ইসলাম কেবল আচারে, প্রথায় রাখা যেতে পারে, তার বেশি মানুষ তা মানবে না।

বাঙালি তখন লুঙ্গি ছেড়ে সবে রাস্তাঘাট বানাচ্ছে আর শার্ট-প্যান্টের সাথে জুলপি রাখতে শিখেছে। তাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার গ্রহণযোগ্যতা একটা সামাজিক-রাজনৈতিক উল্লম্ফন ছিলো। কিন্তু পুরো শরীর এক সাথে না লাফালে যেমন গোত্তা খেয়ে পড়তে হয়, তেমনি সাড়ে চার বছরেই ধর্মনিরপেক্ষতার ঝুমঝুমি হাত ফস্কে গেছে, একেবারে নিচতলায়, বেইসমেন্টে ধুলো মেখে। আমরা শনৈ শনৈ সামরিক উন্নয়নে ডুবে গেছি, বন্যায় ডুবেও রাস্তাঘাট আর খাল কেটে স্বস্তি পেয়েছি। ব্রিটিশ জুতো, পাকিস্তানি জুতোর পরে বাংলাদেশী জুতোর পাড়া খেতে আমাদের কালো দেহে মন্দ লাগে নি। পরিবারতন্ত্রের রাশান রুলেৎ খেলা "রহমান ডাইনেস্টি" দুটোর ভগিজগিও গত বিশ বছরে সামরিক শাসনের 'সমসাময়িক' হয়ে উঠছে। তো, এবারে নতুন শতকের এক দশক পেরিয়ে গেলে কোন দৈববলে আবার সেই মানিকরতন ফিরে এলো, তাকে নিয়ে আমরা কী করবো; কোলে রাখবো নাকি ছুঁড়ে ফেলবো, এটাই এখনো ঠিকঠাক ঠাহর হচ্ছে না।

তার ওপরে নির্বাচন কমিশন চাপিয়ে দিলেন পেশা-স্বীকৃতির এই 'অভাবনীয়' বিজ্ঞপ্তি! এবারে আমাদের পুরুষালী রোম খাড়া হয়ে গেছে। এই উত্তেজনায় বাকি সবগুলো পেশাজীবীকে বাদ দিয়ে আমরা যৌনকর্মীদের নিয়ে পড়েছি। এমনিতেই তাদের ব্যাপারে ট্যাবু, চাপা-আগ্রহের কোনই কমতি নাই, তার ওপর নিঃকঃ এসে পেশা হিসেবে উন্মুক্ত করে দিলো যেন। এখন হিসেব উঠে আসছে, ঢাকায় ঠিক কতোজন যৌনকর্মী আছেন, ঠিক কোন কোন জায়গায় তাদের ডেরা, বাংলাদেশেই বা কতোগুলো 'নিষিদ্ধপল্লী' আছে ইত্যাদি।

খেয়াল করলাম, যে পেশাগুলোকে নতুনভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই নারীর পেশা। ইমাম/পুরোহিত/যাজক, মালী এবং ড্রাইভারের পেশাতে এখনও পুরুষের একচ্ছত্রতা। সেবিকা, যৌনকর্মী, কাজের লোক এগুলো পেশায় নারীর একচ্ছত্রতাও উল্লেখ করি। বাদ বাকি পেশাগুলোতে ধীরে ধীরে নারীকে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। এই সবগুলো পেশার মধ্যে মিল হলো সচরাচর এগুলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র 'চিনতে' চায় না। কাজের লোককে নামমাত্র বেতনে রাখা হয়। ইংরেজি খবরে "ক্লিনার" বলে সম্ভবত মেথর ও জমাদার বুঝিয়েছে, তাদেরকেই বা কতোটা দ্রষ্টব্য ভাবা হয়? সেবিকাদের নামের আশে পাশে 'মহামতি ফ্লোরেন্সে'র নাম নিয়ে তাদেরকেও শ্রমের ন্যায্যমূল্য দেয়া হয় না। হয়তো শুভ্র পোশাকের সেবিকাদেরকে ততোটা 'খেটে খাওয়া' বলে মনে করতে আমাদের 'সুশীল' চোখ অভ্যস্ত নয়। আর সেই সুশীল চোখের কাছে যৌনকর্মীর নাম দূরে থাক, উল্লেখমাত্রই একেবারে অচ্ছুৎ।

তবু নিষিদ্ধের কৌতূহল আর বিকৃত আগ্রহ আমরা নিশ্চিত লালন করি। তাদের জীবন ও জীবিকার খবর জানতে, পরিসংখ্যানের ভেতরে আরো খতিয়ে জানতে অনেকেই উৎসুক। এই ঔৎসুক্য জন্মেছে পারিবারিকভাবে শেখানো ঠুঁটো নিষিদ্ধতার কারণে। যৌনতা এ অঞ্চলে ট্যাবু হলেও অন্তরীণ নয়। সকলেই চর্চা করেন, এখন তথ্যপ্রবাহের ঢেউয়ে তার অনেকটাই জানা যায়। নারী বা পুরুষ কেউই এই চর্চার বাইরে নেই। হয়তো অংশগ্রহণের স্বাভাবিকতায় নারী যুগযুগ জিইয়ে রাখা জড়তা এখনও কাটাতে পারে নাই, তবু প্রায় সমানে সমানেই (আড়ালে বা প্রকাশ্যে) যৌনতার লালন ঘটছে।

সুতরাং এখানে কোন উন্নাসিকতার উপায় নেই, সুযোগ নেই উপেক্ষার। স্বীকার করেই নিতে হয় যে এই আদিমতম পেশাটি বঙ্গ-জনপদে প্রাচীনকাল থেকেই আছে, আছে এর "ভোক্তা" (পুরুষ) ও "কর্মী" (নারী)। সমাজে পুরুষ নিজের সামাজিক প্রতিপত্তি আর পরিচয়ের জন্যে রেখেছে স্ত্রী, আর ভোগ ও লালসার জন্যে রেখেছে যৌনকর্মী। এবং নিজেদের 'সম্মান' ধরে রাখতে এই কর্মীদের নাম দিয়েছে 'পতিতা', 'বেশ্যা' ইত্যাদি। নামগুলো দেখুন, নিছক শব্দ হিসেবেই প্রথম শুনেছিলেনঃ কিশোর বয়সের কথা মনে করুন। তারপরে শিখে গেছেন, এগুলো কতোটা নিকৃষ্ট শব্দ, অশ্লীল, অসভ্য, কুৎসিত। তারপরে পরিচিত হয়েছেন এই শব্দগুলো যাদের সাথে ব্যবহার করা হয়, তাদের সাথে - সেই নারীদের সাথে যারা পতিত, অস্পৃশ্য, নিষিদ্ধ ইত্যাদি। অথচ তারা কোথায় থাকে, কি করে, কারা তাদের কাছে যায় এটা জিজ্ঞেস করলে নিশ্চিত বড়ো একটা ধমক খেতেন। 'চুপ' বলে চেঁচিয়ে উঠতো আপনাকে আদর্শলিপির পাঠ দেয়া 'পুরুষ' চরিত্রটি।
এই চর্চা, আবহমান সংস্কৃতির মতো চলে আসছে। পুরুষ কখনই যৌনকর্মীর কাছে যাওয়া থামায় নি, এবং নিয়মিত খদ্দেরকেই দেখা গেছে তাদের বিপরীতে উচ্চকণ্ঠে। এই দ্বিমুখী আচরণ আসে কুশিক্ষা থেকে, প্রথাবদ্ধতা থেকে, অন্ধের মতো ক্ষমতা দখলের লিপ্সা থেকে। এখানে কেন ক্ষমতার কথা আনলাম? একটু ভেবে দেখলে আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন।

সমাজের ক্ষমতার পিরামিডে এই নারীদের অবস্থান কতোটা নিচে! হয়তো সবার নিচে। এমনিতেই অনগ্রসর ও দরিদ্র জনপদে গড়পড়তা নারীরা ২য় শ্রেণীর নাগরিক, তার ওপরে তাদের মধ্যে যারা দেহব্যবসার সাথে জড়িত, তারা না পান পরিচয়, না পান মূল্য - সামাজিক অবস্থান তো দূরাস্ত। এ অবস্থায় তাদেরকে আলাদাভাবে কেন 'পতিত' বলে চিহ্নিত করা হলো? কারণটা কি খুব স্পষ্ট না? কারণ সমাজের পুরুষের দুশ্চরিত্রের অনেকটা চেহারাই তাদের কাছে উন্মুক্ত। ভ্রষ্ট প্রথা মেনে সমাজে প্রতিপত্তি গড়ে তোলা উপরতলার বেশির ভাগ পুরুষ এই সকল নারীর ভোক্তা। কাঁচা বাজারে গেলে তারা যেমন প্যান্ট উঁচু করে চলেন, কাদা মাড়ালে যেমন তাদের নাক কুঁচকে যায়, সেই সকল উন্নাসিকের গতায়াত এই অঞ্চলে অহরহ। আর সেজন্যেই, যৌনকর্মীদেরকে সমাজের নিচু থেকে নিচুতলায় ঠেলে দিলে এই সব পুরুষদের স্বস্তি হবে। এতোটা নিচুতলা থেকে তারা আর কিইবা বলবে, আর সেটা কে-ইবা শুনবে?

বিষয়টা প্রবলভাবে রাজনৈতিক - ক্ষমতার বন্টনের মতো। কিন্তু সে দিকে না তাকাই। আমরা বরং 'আম' জনতা সেজে থাকি। অন্ধকারে আমাদের মাঝে কে কে এই পল্লীতে এগুবেন সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। আমরা সেখানে কোন জাজমেন্টাল অবস্থান নিতে চাই না।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। যুগের পর যুগ ধরে তাদের প্রতি জমে ওঠা অবহেলা, নাক সিঁটকানোর স্বভাবটাকে বদলাতে তারা সমাজের আরো পাঁচজন পেশাজীবীর কাতারে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন। এই পদক্ষেপটি যাদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তারা স্বভাবতই উপরে উল্লিখিত মানুষদের মতো মন-মানসিকতা ধারণ করেন। যতোক্ষণ তাদের সেই কূপমণ্ডুক, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব তারা নিজেদের ভেতর রাখছেন, ততোক্ষণ সেটা নিয়ে মনে হয় না কারো মাথাব্যথা আছে। কিন্তু যখনই তারা গলাবাজি করে সমাজের নৈতিকতা, এবং অনুশাসনের বুলি আওড়াতে যাবেন, তখন মনে করিয়ে দেয়া জরুরি যে এই নারীদের পেশাবৃত্তির ভোক্তাশ্রেণীটি কারা।

যৌনকর্মীদের পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াটা মূলত পুরুষ ভোক্তাদেরকে ভোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সমতূল্য। এই বিষয়টিই হয়তো কাঁটার মতো গলায় বিঁধছে অনেকেরই। তাদের জন্যে প্রেসক্রিপশন, দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার পুরুষতান্ত্রিকতার গলায়, মানবতার ফোরসেপ দিয়ে কাঁটাটি না তুললে অচিরেই সেপটিক হয়ে যাবে। তখন না গোটা গলাটাকেই কেটে ফেলতে হয়!


***
[*নির্বাচন কমিশনে এবং সরকারি কর্তাব্যক্তিদের মাঝে কোটি কোটি দোষত্রুটি আছে। এই সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন খাতে ব্যর্থতার পরিচয় 'সগৌরবে' রেখেছে। তারপরেও এরকম কিছু দুরন্ত উদ্যোগের জন্যে তারা সাধুবাদ দাবি করেন। বাংলাদেশে সামরিক ও ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়াশীলতার পিঠে এরকম প্রগতিশীল পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই!]

রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০১০

'অমানবিক' !

আমার ঘরে কিছু স্পর্শকাতর মানুষ বাস করে। তারা সামাজিক জীবঃ একা একা চলতে পারে না। থমকে যায়, দু'পা এগোয়, তারপরে থামে আর হোঁচট খায়।


আমার ঘরে কিছু অনুভূতিপ্রবণ মানুষ বাস করে। তারা সাংস্কৃতিক জীবঃ প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। তারা সংস্কৃতি খায়। মাখে। ঘুমায়। চোষে। আমের আঁটির মতো সংস্কৃতির গায়ে কমলা কমলা মাংস কামড়ায়।


আমার ঘরে কিছু বাঙালি-চেতনায় গাঢ় মানুষ বাস করে। তারা হাজার বছরের বাঙালিত্ব লালন করে। বাঙালিত্বের ভারে তারা শ্বেত-শুভ্র হয়ে যাচ্ছে, বাংলায় হাসছে, বাংলায় নিন্দা করছে, বাংলা দিয়ে বাংলাদেশকে করছে।


আমার ঘরে এমন চমৎকার মানুষের ভীড়ে আমি ক্রমশ বর্ণবাদী হয়ে উঠছি। বর্ণবাদী সুশীলীয় শব্দ, এটাকে গালি মনে হয় না। বরং বলতে পারি, আমি রেসিস্ট হয়ে উঠছি। এটা বলামাত্রই মানুষগুলো শিউরে উঠলো, তাদের চোখে আমি নিজের ছায়াকে ধীরে ধীরে এনার্কিস্ট হয়ে উঠতে দেখলাম।


স্পর্শকাতরেরা সামাজিকভাবে আমাকে বয়কট করলো, এই হলো তাদের একুশ শতকের আন্দোলন।
অসহযোগের মতো দাবানল ছড়িয়ে গেলো তাদের মাঝে।


অনুভূতিপ্রবণেরা কমলা সংস্কৃতি খেয়ে রেগে লাল হয়ে উঠলো, তারা পথনাটক আর জনগানে
আমার বিরুদ্ধে মোর্চামিছিল নামিয়ে দিলো গতকাল সাঁঝে।


বাঙালিত্বে উজ্জ্বল মানুষেরা আমাকে বাংলায় তিরস্কার করলো, বাংলায় লিখলো পাতা-পাতা
স্মারকলিপি, প্রতিবাদ-বিবৃতি, রেগে উঠলো বাঙালি ঝাঁজে।


আমি তাদের সবাইকে আমার ঘরে রেখে বেরিয়ে এলাম
বাইরে তখন হলুদ হলুদ রোদ মেখে আকাশ খুব হাসাহাসি করছিলো নীল মেঘের ওড়না ধরে!


***

৮.৮.১০

মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০১০

মুঠোজুড়ে একান্ত গান

don't know what to say, don't know how to say...
let me just be silent, and beside you I stay...

মানুষের জীবন এক ক্ষণিক আচরণ, মুহূর্তিক আবেশ
কাটতেই টের পাই হাতের তালুতে জলকঙ্কাল ছাড়া
আর কিছু নাই। কেউ নাই।

আমাদের জীবনে কিছু নাই আর, স্মৃতিভার ব্যতীত
কিছুই রাখি নাই যত্নে মুঠোর ভেতরে ছিলো তারা
সুখে, সমৃদ্ধিতে, একান্ত গোপন আনন্দে ছড়িয়ে
কণা কণা বালুর মতো নিশ্চিন্ত আনত নয়নে

আশৈশব লুকোচুরির ভয় – চোখের আড়ালে গেলেই
হয়তো পৃথিবীর ঘূর্ণনে হারিয়ে যাবে তুমি, হারানোর নয়
হাতের মুঠোর এই স্মৃতিগুলো। এই স্বাভাবিক পতন
মেনে নিতে পারি, তবু হারানোর ভয় পৃথিবীর ঘূর্ণিতে
হারিয়ে গেলে খুশি হই।

এই মুহূর্তটি কেটে গেলে হয়তো তুমিয়ামি ভুলে যাবো গতকালের গান, আগামীকালের শোক ও আজকের হাস্য-কোলাহল। তারপরেও ভোর হবে, তোমারামার দিন ফুরোবে, পৃথিবী থেকে মুছে যাবে স্মৃতি, হর্ষ ও শ্লোগানসমূহ...


***

৩.৮.১০

রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০১০

আলো অন্ধকারে যাই...

না হয় আমি তুচ্ছ আর তুমি গুরুত্বপূর্ণ, তা বলে কি আমার হৃদয় নেই? হৃদয় কোথায় থাকে তা তো তুমিও জানো না। যদি বলো আমার হৃদয় নেই, তাহলে তোমারও হৃদয় নেই। তোমার কেবল একটা হৃৎপিণ্ড আছে যা খালি ধুকপুক ধুকপুক করে রক্ত পাম্প করছে; বিরতিহীন। সে জানেও না তোমার হাতের একটু ছোঁয়ার জন্যে আমি কতোটা কাতর।

সেই স্পর্শ হঠাৎ অঘটনে পেয়ে গেলে আমার ভেতরে কী তোলপাড় হয়! মনে হয় টেবিল চেয়ার বাবদ এই বাস্তব চরাচর দুমড়ে মুচড়ে উঠছে কাগজের মতো। কেউ নির্বিকার আমার জগতটা কুড়ানো কাগজের মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে। তুমি যখন না বুঝেই হেসে ফেলো আমাকে দেখে, যখন আমি তোমার হুটহাট তীব্র কথার জবাব দিতে পারি না, থতমত খাবি খেতে থাকি- তখন তোমার ঐ শাদা দাঁতের হাসি দেখা যায়।

তুমি অবিরাম হাসো আর দাঁতের কামড়ে খুঁড়ে ফেলো আমার শরীর। উড়িয়ে দিতে পারো, কিন্তু আমি সত্যিই টের পাই এই বেদনাবোধ। আমি টের পাই তুমি কীভাবে আমার ভেতরে ভাঙচুর করছো আর আমি হাসিমুখে তোমার দিকে চেয়ে আছি। একটা পলকের জন্যেও বুঝতে দিচ্ছি না আমি কতোটা ফুরিয়ে গেছি। তুমি একটু পরে বিরক্ত হয়ে গেলে, আমার চাহনি আর তোমার ভালো লাগছে না। তোমার দমবন্ধ লাগছে তাই তুমি জানালা খুলে দিলে। তিনতলার জানলা হাট করে খুলতেই দমকা বাতাস উড়ে এলো।

নিচের রাস্তায় দুয়েকটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো- যাদের দেখে তুমি স্মিত হাসলে।

তুমি কি জানো তোমার ঐ এক চিলতে স্মিত হাসির কতোটা কাঙাল আমি? আমি একটু পেছন থেকে দেখলাম তোমার চোখের রঙ বদলে যাচ্ছে। মেয়েদের ওড়নার রঙে ঘোলা হয়ে উঠছে মণি। তুমি বারকয়েক পলক ফেলতেই দেখলাম তুমি নেই! উদামখোল জানালা গলে চলে গেছে ওড়নার ভাঁজে। তোমার ঐ খিলখিলে মেয়েগুলোকে ভালো লাগে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো মেয়ে হাঁটছে আর তুমি তাদের দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে চলে যাচ্ছো।

আমার সামনে জানালা খোলা। আমার সামনে তুমি নেই।

আমার সামনে ঘোলাটে চোখ নেই। হাসির ছুরি নেই। ঝকঝকে শাদা দাঁতগুলো আমাকে আর কাটছে না। তোমার মাথায় যে এলোমেলো মেঘ ভেসে বেড়াতো, সেটাও এখন অনেক দূরে ঐ আকাশে উড়ে যাচ্ছে। আমার হঠাৎ খুব সাধ হলো, জানো? আমি তো ঐ মেয়েগুলোর ওড়নাকে ভালোবাসি না, কখনো বাসি নাই। আমি খালি তোমার কাঙাল হয়ে গেছি বহুদিন ধরে। আমি খালি তোমাকেই দেখি, তুমি মাঝে মাঝে আমাকে ছুঁয়ে দিলে আমি বারবার মারা যাই। আজ হঠাৎ কী যে হলো? আমার খুব মরতে ইচ্ছা হলো। আমি বারবার তোমার হাতে মরতে চাই না আর। আমার ক্লান্ত লাগে।

আমার তো আর কেউ নাই। আমার মতো আর কেউ নাই। তুমিও আমার নও, আমার মতো নও।

আমি কেবলই আমার মতো, আর আমি জানি এই কথাটা তুমি জানো না। তাই আমি আজকে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেলাম। জানালাটা হাট করে খোলা, আমি সেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানালা বললো, "তুমি কেমন আছো ছেলে?" আমি বললাম, "আমি ভালো আছি, জানালামনি।" তোমার মাথার চুলের মতো মেঘগুলো ভাসতে ভাসতে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ থমকে গেলো আমার এই মিথ্যা শুনে। তারা ভীষণ অবাক! বললো, "তুমি তো ভালো নেই ছেলে। তুমি বার বার মরে যাচ্ছো। তোমার শরীরে ঐ ছেলেটার দাঁতের দাগ দেখতে পাচ্ছি আমরা।" আমি হঠাৎ হেসে ফেলি, এতো দুখেও ফিক করে বলি, "বোকা মেঘ, তোমরা জানো না শরীরে কেন দাগ পড়ে। তোমাদের শরীরে কেউ দাগ ফেলে না। এই দাগগুলো আমি ভালোবাসি। বুঝলে?" মেঘগুলো মাথা নেড়ে চলে গেলো। আর জানালাটাও চুপ করে কী কী যেন ভাবছিলো। আমি হেসে বললাম, "আমাকে নিয়ে এতো ভেবো না জানালামনি।" ফিসফিস করে বললাম, "আমি ভালো আছি। আমি ভালো আছি।"

আমি খুব তুচ্ছ আর আমার একটা হৃদয় আছে। সেটা কিচ্ছু শেখে নি, সেটা কেবল তোমাকে চায়। তুমি তা জানো না। তুমি জানলেও আমাকে চাইতে না। আমি খুব তুচ্ছ।