মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০

এখানে একটা শিরোনাম বসিয়ে নেন

এখানে 'নতুন ব্লগ লিখুন' লিংকটা একদম মুখের 'পরে, প্রথম পাতায় যাবার পাশেই। তাই মাঝে মাঝে মাউসের ভুলে এদিক ওদিক হয়ে যায়। প্রথম পাতার বদলে আমি খেরো কাগজে চলে আসি। মাউসের মন খুশি হয় একটু। সে এখন রেহাই পাবে কিছুক্ষণের জন্য। খটখট খটখট আঙুল পড়বে কিবোর্ডের ওপর। এই অবসরে মাউসটির মন আরো একটু খুশি হয়। খুশিতে তার লেজ নড়ে। এদিক ওদিক নড়তে থাকে সে। তলায় মাউসপ্যাডটা পুরনো হয়েছে। ঠিকমতো মাউসের পা বসতে চায় না, পিছলে পিছলে যায়। তাই লেজ নড়ে। আমি লেজ নড়া থেকে চোখ সরাই। মাউসটার মুচকি হাসি দেখে কিছু বলি না। কিবোর্ড একটু হতাশ হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

মাঝখানের ইংরেজি হরফগুলো দেখলেও আমার বাংলা হরফ মনে পড়ে। হরফগুলোর সাথে অনেকদিনের সখ্যতা। আমি ব্লাইন্ড টাইপিং পারি না, মানে মনিটরে তাকিয়ে খটাখট লিখতে পারি না। তবে এখন বাংলায় মনে হয় কিছুটা পারি। আমার মগজের কোন এক লোব বা কোন এক গুহায় পুরো হরফের ছবিগুলো ছাপা হয়ে গেছে। আঙুলগুলো একটু উঁচু করে রেখে কোন স্পর্শ ছাড়াই এগুলো নড়াতে পারি। ক খ গ ঙ (ঘ কাজ করে নাই, বেয়াদ্দপ!)

এর পরে অনেকটা লেখা হয়। লেখাগুলো কেন হয় জানি। আমি লিখতে চাই বলে। আমার ক্ষুধা লেগে যায় লিখতে লিখতে। লিখে পেট ভরানো গেলে আমার ক্ষুধা লাগতো না কখনোই। আমি অনেক লিখি। লিখতে লিখতে যখন হাঁপিয়ে যাই তখন একটু অবসর নেই, সেই অবসরেও লিখি। এক লাইন লিখে শেষ করতে করতে মাথার ভেতরের কোনো এক গুহায় তিন চারটা লাইন হারিয়ে গেলো। ধুৎ। এভাবে হয় না। যদি বলে বলে টেইপ রেকর্ডারে সব পুরে ফেলা যেতো, তবে মনে হয় আরো একটু লেখা বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু সেটাও তো সমস্যাজনক। দেখা যায় যে বলতে বলতেই মাথায় আরো কয়েকটা লাইন পুড়ে যায়। সেই পোড়া লাইনগুলো উদ্ধার করতে পারি না। মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ছিঁড়বো না। বেশি নাই। টাক পড়ে যাবে শেষে বিয়েশাদি নিয়ে টানাটানি। টানাটানিতে আরো চুলহ্রাস, শেয়ার বাজারের মতো দাম পড়ে গেলে মুশকিল!

লেখাগুলো জমিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে জমানো লেখা একা একাই মরে যায়। চুপচাপ। তাদের ফিউন্যারেল দেয়া হয় না। একা একা কেমন করে ফিউন্যারেল দেই? কেউ তো দরকার, শোকবার্তা নিয়ে আসবে। একটু কালো পোশাকে কাঁদবে। চোখের কোণ মুছবে শার্টের খুঁট দিয়ে। আমি সেই দৃশ্য দেখে শান্তি পাবো - আমার মৃত লেখার জন্য কারো কান্না পাচ্ছে ভেবে। আমার গর্ব হবে। আমার খুশি লাগবে। গর্ব খুশি মিলে ঝালমুড়ি হয়ে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিবে। আপাতভাবে দেখলে লেখাটার কিছু যায় আসে না। সে মরে গেছে বলে সে জানেও না আমি কেমন কেমন করছি তার জন্য। সব যায় আসে খালি আমার। লেখা মৃত্যুতে কষ্টও আমার, অন্যের কান্না দেখে প্রশান্তিও আমার।

এরপর সময় গড়ায়। ধীরে ধীরে নতুন লেখার জমে ওঠে। সেগুলো এডিটর বক্স ভরিয়ে দিতে থাকে। ভরাতে ভরাতে আর জায়গা কুলায় না। পাশে একটা স্ক্রলার জন্ম নেন। তিনি নীলচে রঙের, নতুন এলেন এডিটর বক্সের পাশে, বক্স তাকে জায়গা করে দিয়েছে। একটু একটু করে এই স্ক্রলারটির আকার ছোট হবে। আর তিনি নিচে নামবেন। অধঃপতন! হা হতোস্মি। নামতে নামতে আর ছোট হতে হতে তিনি অভিশাপ দেবেন - আঃ মরা! এতো ল্যাখে ক্যান শালা!!
কিবোর্ড অভিশাপ শুনে ভয় পাচ্ছে, একটু একটু ধীর হয়ে আসছে। ব্রাউজারটাও ভীতু, বেটা এমনিতে খাইতে খাইতে ভারী হইছে, অথচ সাহস জন্মায় নি একরত্তি। ধরে চটকানা লাগাতে ইচ্ছা করতেছে।

ব্রাউজার এগুলো শুনতে পেয়ে আরো ভড়কে গেলো। ধীরে ধীরে চলছে সে। দেখে শুনে, কখন ঠাশ করে একটা চটকানা মেরে দিবো, এই ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গেলো। আমারও রাগ টঙ হয়ে উঠে বসে থাকে, সহজে নামবে না। রাগের মাথায় কতোগুলো গালিগালাজ করি। সেগুলো টাইপ করে বেচারা কিবোর্ডও গলাখাকারি দেয়, য়্যাহেম। ওর অভ্যাস নাই তেমন। গালি নিয়ে ট্যাবু আছে কিছুটা। নিজে যখন শাপশাপান্ত করে, তখন কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি জোর করে টাইপ করলেই তার টনটনে টনক টিকটিক করতে থাকে। ব্যাটা টিকটিকি!

থাক, মুছে দিলাম। ব্যাকস্পেইস চেপে ধরে রাখলাম যতোদূর পর্যন্ত শাদা না হলে স্বস্তি হয় না ততোদূর। মুছে গেলে সব ফাঁকা হয়ে গেলো। ধবধব করছে ঘরটুকু। ঘরে আসবাব নেই। কার্পেট নেই। ঝাড়বাতি দূরে থাক, টিমটিমে ফিলিপসের বাত্তিও নেই। একটা কালো "ক" ঝুলছিলো বক্সের নিচে, এক কোণে, একা। হাতের চেটোয় ঘাম মুছে ফেলার মতো ওটাকেও মুছে ফেললাম। যাঃ



গতস্য শোচনা নাস্তি। গতস্য শোচনা নাস্তি। যা চলে গেছে, তার জন্য সন্তাপ করো না। কে বলে? কোন উন্মাদের মাথায় এই শ্লোক এসেছিলো? সে কি য়্যাল্‌ঝেইমারের রোগী? সে কি বুঝেই না গতস্যদের জ্বালা। সবচাইতে কড়া মদের চাইতেও বেশি পোড়াচ্ছে সেইসব গতস্য। শোচনা। শোচনা। অনুশোচনা। গ্লানি। "একবার শেষ দেখা যদি পাইতাম"। নাস্তি। নাস্তি। তুই নাচতি? শোচনার পিঠে চড়ে তুই নাচবি নাকি? নাচ, গড়াগড়া দিয়ে নাচাবে তোকে এই ভুরভুরে ভ্রূকূটিল শোচনা। তোর মুক্তি নেই, পায়ে মলমল।

মাঝে মাঝে আমরা ইচ্ছা করে শোচনা তৈরি করি। নিজ হাতে গলা টিপে গ্লানি বাড়াই। হাতের আঙুলের চাপে কতোগুলো নিরীহ অক্ষর মারা পড়ে। অক্ষরের সাথে আমার কিছু স্মৃতি ধুয়ে মুছে যায়। ওগুলো আর ফিরে পাবো না। তাই এক্সপোনেনশিয়ালি আমি শোচনায় ডুবতে থাকবো। কেউ কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না। চুল এলোমেলো করে দিবে না। বলবে না, 'ব্যাপার না'। আসলে তো ব্যাপার। খুব জরুরি ব্যাপার না হলে হয়তো এভাবে মুছতাম না, এভাবে ভুলে থাকতাম না। ভুলে থাকার গুণ রপ্ত করতে কয়টা জন্ম লাগবে? কয়যুগ ঘুমালে মাথার ভেতরের এই শোচনাকুল দিনরাত্রির শ্লোক মুছে যাবে?
- ভোরে ঘুমিয়েছি - দুপুর তাই সকাল - বিকেল তাই আমেজ - - রাত মজে হলো সন্ধ্যা - নিশুতি হয়েছে জেগে থাকা প্যাঁচা -
- ভোর থেকে নিশ্চুপ নীরবতা - এভাবে মুহূর্তের গুণ সময় -
- আর সময়ের গুণ ঘন্টা - মিনিট - অহ্ন -
- এভাবে তার ছিঁড়ে রেখেছে কেউ -
- টাওয়ার বানায় নি তাই দুঃখিত হয় মেয়েটি -
-এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে নাহ -
- যাআহ ফোট্‌ !!! -



******
দ্র - শিরোনাম কৃতজ্ঞতা - কবি আন্দালীব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন