মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১০

স্পনটেনিয়াস ইরাপশন


দুনিয়া জুইড়া বিয়াপক গিয়াঞ্জামের খবর মাঝেমাঝেই আমরা রাষ্ট্র করি। আমাগে রাষ্ট্র জুইড়াও বিয়াপক গিয়াঞ্জাম দুনিয়ার মানুষ জানে। এই তো সেইদিন বিজাতীয় টিভিতে দেখতেছিলাম ওয়েলস রাজ্যে সাগরের মধ্য টিলা টিলা দ্বীপ, হেলিকপ্টারে ঘুরে ঘুরে ফোকাস করতেছে। দ্বীপের গায়ে খালি একখান ধবল বকের মতোন বাতিঘর বানায়া রাখছে, দ্বীপে যাওনের ব্যবস্থা অনুপম। খালি একখান সেতু তৈয়ার করছে, যেটা ডাইনে বামে ঝুলে। দেখোনের পরে মনে হইলো একটুসখানি দ্বীপ সেইটারেও আমরা ছাড়ি নাই! কোমল স্তনে কামড়ের মতোন বাতিঘর বানাইতে হইবো মানুষের। দুনিয়া জুইড়া গিয়াঞ্জামগুলান এনট্রপির লাহান বাড়তেছে কেনু কেনু কেনু?...

 
অদ্য খবর পাইলাম একটা চ্যানেল মৃত্যুবরণ করিয়াছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হইয়াছিলো ব্লা ব্লা ব্লা। আগামি কিছুদিন তার মৃত্যু নিয়ে সরগরম থাকিবে তাবৎ মিডিয়াপাড়া, কারওয়ান বাজারের ভ্রান্তিময় নাম কাওরান বাজার। তারপরে আবার বসুন্ধরা সিটি পুড়িয়া গেলে মৃত আত্মার চেহলাম অনুষ্ঠিত হইবে। বিগত মৃতেরা যেমন ১/১১-এর পরে ফিরিয়া আসিয়াছিলো, তেমনি উল্লিখিত মৃতও ফিরিয়া আসিবে। পঞ্চবৎসরাধিক কাল সে টিঁকিয়া থাকিতে পারিবে বলিয়া আশা করি।


ব্লগিংয়ের সবচেয়ে মজার দিকগুলো হলো প্রতিমতের সাথে শান্তি(!)পূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টা। একটা বন্ধ বাক্সে নানা ধরনের গ্যাস ভরে খুব তাপ দিতে থাকলে অণুগুলো যেমন ছুটোছুটি লাগিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে ব্লগীয় মিথস্ক্রিয়াকে আমার সেরকমই মনে হয়। টুশ করে একটু গুঁতো খেলাম তোমার সাথে, তারপরে মাথা ডলতে ডলতে পিছিয়ে আসতে গিয়েই তার সাথে ঢ্যাপ করে ধাক্কা। দু'জনেই মুখে 'মানুম না' আর মনে 'স্যুরি' বলে দুইদিকে হাঁটা দিতেই দেখি বিরাট গোলচক্করে আঠালো ঝগড়া। লুঙ্গি কাছা মেরে, ধুতি মালকোচা মেরে আর শার্টের হাতা গুটিয়ে ধর্মাধর্মের নেতাপোঁতারা হেই হেই করে তেড়ে আসছে! আমরা দুজনে শত্রুতা ভুলে প্রথম পাতা ছেড়ে দৌড় দিলাম!


অনেক মৃত্যু ইদানিং জমা হচ্ছে হালখাতায়। নতুন বছরে পরিচিতের বৃদ্ধ ও আপাতবৃদ্ধ আত্মীয়েরা মারা যাচ্ছেন। সামাজিক বৈশিষ্ট্যে আমরা শোকপালন করছি, এবং কুলখানিতে দেখছি বিলানো হয় বিরিয়ানি, মিষ্টি প্রভৃতি রসনাবিলাস। মৃতের জন্যে আমার খালি লাগে অযথাই!


আজকাল অনেকেই টাকা ধার চায় আমার কাছে। ধার চাইলে আমি 'না' করতে পারি না। নেতিবাচকতা এবং সেই 'না' শুনে তাদের হতাশা আমারে বল্লমের মতোন গেঁথে ফেলে। একবার এমন হওয়ার পর থেকে আমি পিঠে সেই বল্লমের দাগ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আর নয়! এখন থেকে চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবো। টাকা ধার চাহনেওয়ালারা বুঝে গেছে মনে হয়, আমার পকেট থেকে সুতাকৃমির মতোন টাকা টেনে টেনে নেয় তারা। যেন শর্মাহাউজে গিয়ে স্প্যাগেট্টি খাচ্ছেন খুউব, মৌজে!


মজার ব্যাপার হলো, আমার ভেতরে অবিমৃশ্যতার পরিমাণ পর্বতের গায়ের গুল্মের সংখ্যার সমান। হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা, এবং সেই সুবাদে ঝঞ্ঝাট বা ঝামেলার তোড় সামলানোর অভ্যাস আমি রীতিমত চর্চা করি। বেশিরভাগ সময়েই একগুঁয়েমির মাত্রা ছাড়ানো কারণ দেখে আশেপাশের সকলেই আমাকে কাছিম ডাকে। কেউ কেউ ভুল উচ্চারণে কাসিম ডেকে বসে। আমি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সেই অমিতশক্তির ভাতিজা হতে ইচ্ছুক! তিনি এই বঙ্গে না এলে আমি হয়তো নমশুদ্রই হয়ে রইতাম! 


এটেনশন সীকিং ডিজওর্ডার ব্লগারদের মাঝে প্রবল। নাটুকেপনায় ভরা এক একজন ভার্চুয়াল ড্রামাকুইনদের মাঝে আমিও অন্যতম। এই ড্রামা কতো এপিসোড ধরে চলছে, মাঝে মাঝেই যবনিকাপাতের দশা হয় হয়, আবার হেলতে হেলতে টলটলায়মানতা থেকে আবার দাঁড়িয়ে যাই আমরা! এই যেমন ধরুন অতিঅধুনা অভ্র-বিজয় দ্বৈরথে কেউ কেউ বিজয়ের পাশেও দাঁড়াচ্ছেন। কারণ প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ালে তোড়ের অংশ গায়ে লাগে, কী বিষম পুলক উৎপন্ন হয়। শরীরের নরম জায়গাগুলো তাদের উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে, ইয়ে, জানেনই তো, কেমন লাগে? 


কী অদ্ভুত বিকেল। আমাদের শহরের ধুলো আর মানুষগুলো দিন দিন যেভাবে বিবর্ণ হয়ে উঠছে, তাতে এমন বিকেল চোখে পড়ে না। হারিয়েই গিয়েছিলো তারা। আজকে কী ঘোর চেপেছে, কে জানে? প্যালেটে ঘন রঙ গুলে কেউ একজন দামাল তানে মেতেছে খুব। ছোপ ছোপ রঙিন দৃশ্য ফুটে উঠছে। সবুজাভ হলুদে ভেসে যাচ্ছে আকাশ, মেঘের গায়ে ধূসরতা। মেঘগুলো ইশকুল ভুলে এদিকে যলে এসেছে যেন, আনমনে হাঁটতে হাঁটতে। তারপরে বিষম তাড়া করেছে কালো কালো মেঘ- যারা আমার কাছে ইশকুলের দারোয়ান। "অ্যাই অ্যাই ছোকরার দল! ফিরে আয়! ফিরে আয়!" বলে ভাগিয়ে নিয়ে গেলো সাদা তুলো-মেঘদের। তারপর কয়েকটা বেভুলো মেঘ ভয় পেয়ে কেঁদে ফেললো। মাঠের ছেলেগুলো দৌড়ে ছাউনির তলে, খেলা তোলপাড় ভজঘট। দারোয়ানের দাবড়ের চোটে ঠিকমত কাঁদার আগেই উড়ে গেলো বৃষ্টি। হলুদ রঙা সেই বৃষ্টির কিছুটা মাখার জন্যে আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওমা, কী বাউণ্ডুলে দ্যাখো? আমাকে ঝুম করে ভিজিয়েই পালালো। এখন হু হু বাতাসে আমি স্থবির স্থানু......!

(সমাপ্ত)
......
## নতুন ধরনের একটা চিন্তা মাথায় আইলো। একটা ব্লগ লিখুম, যেইটা একটু পর পর আপডেট করতে থাকুম। 

শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১০

একটি অগল্প-জনিত প্রয়াস বা বিভ্রম

বাইরে যদি খুব তীব্র আলো থাকে, তাহলে ঘরের ভেতর থেকেও সেই আঁচ টের পাওয়া যায়। জানালাটায় পর্দা দেয়া, তারপরেও সূর্যের আলোর তেজ পর্দার ঘেরাটোপ পেরিয়ে চলে আসে। আমি এরকম দিনে খুব ঘরকাতুরে হয়ে পড়ি, এ'ঘর-ওঘর করি। তারপরেও নিতান্ত দরকার না পড়লে বাইরে বের হই না। এখন কোনো কোনো দিন ছুটি থাকে, কোনো কোনো দিন সারাদিন কাজ। যেদিন কাজে থাকি, নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও পাই না, সেসব দিনে আমি ভালো থাকি। আর নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দিত্বের দিনে আমার কেবলই তাদের কথা মনে পড়ে।

ঝিম ঝিম দুপুর গড়িয়ে গেলে আমার ঘুম ভাঙত। একজন তার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে উঠে চলে গেছে। কামলাগিরি করে বহুজাতিকে, সেখানে দশটা পাঁচটা বলে আদতে আটটা-আটটা খাটিয়ে নেয়। খাটতে খাটতে তার খাটিয়ায় ওঠার দশা। ভোরে বের হয়ে যায়, বাস ঠেলে অফিসে ঢোকে। বের হতে হতে নিশুতি। আবার ফিরে আসতে আসতে তার খাওয়ার ইচ্ছাটুকুও থাকে না। আমরা বাকি দু'জন যখন কোন মুভি'টা দেখা দরকার, বা আজকে আসলে ইন্টারনেটে নতুন সাইটটার ভেতরে ঘোরাঘুরি করার ফন্দি কষি, সে তখন ভোসভোসিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমরা তাকে বিরক্ত করি না, শান্তিতে ঘুমাতে দেই। তারপরে একটু নেট ঘেঁটে বলি, "নাহ, এই ফেসবুক নামের সাইটটা বেশ মজাদার। এতে ঘোরাঘুরি করতেও মজা লাগছে।"

একটু পরে আমরা নাটক দেখতে বসি। ইংরেজি নাটক, যা কিনা মার্কিন মুলুকে সপ্তাহে সপ্তাহে একদিন করে দেখায়, আর আমরা গরীব দেশে সেটা একবছর পরে একবারে সারাবছরের সব পর্ব দেখি। তাতে ক্ষতি নেই, আমাদের মনে হতে থাকে এটা একটা অন্তহীন মুভি। পর্বে পর্বে চমক। আমরা তর্ক করি কেন সুপারম্যান একটা 'গুড-ফর-নাথিং' লানা ল্যাঙের পিছনে ঘুরছে? কেন সে তার পাশেই ক্লোয়ির দিকে একবারও তাকায় না!

তারপর রাত বাড়লে আমাদের ক্ষুধা পায়। আমরা পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে বের হই আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছাউনির নিচে তাওয়ার কাছে গিয়ে বসি। এখানে তেল তেল পরোটা আর আধাকাচা ডিমভাজি পাওয়া যায়। আমরা সেই আগুনেগরম তেল-পরোটা-ডিম-ভাজি দ্রুত মুখে চালান করে দেই। দেরি করলেই আঙুল নয়তো জিব পুড়ে যেতে পারে। একটু খেয়ে আমার সাথে যে ছেলেটা আছে, সে সিগারেট ধরায়। আমি সিগারেট খাই না। খালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার চারপাশের প্রিয় মানুষেরা সিগারেট কেন খায়, এটা নিয়ে ভাবতে বসি। আমরা দেখি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে পরাবাস্তব দৃশ্যের মতোন মহিষের পাল যাচ্ছে। কালো রাস্তার পিঠে কালো কালো মহিষগুলোকে আমাদের অন্যজগতের মনে হয়, কেমন নিঃশব্দ চলাচল তাদের। যেন চোখ বেঁধে নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছে তারা! একবারও ভাবছে না যে কালকেই হোটেলে হোটেলে তাদের মাংস কালাভুনা হয়ে আমাদেরই পেটে চলে যাবে। মহিষের পালের রাখালটাকে আমার ভালো লাগে না, তার চেহারা অস্পষ্ট।

ছেলেটার সিগারেট খাওয়া শেষ হয়। এখন চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠিয়ে আমরা ট্রাফিক সিগন্যালে বসে আছি। জনহীন রাস্তায় সবুজ-লাল বাতি একা একাই জ্বলে! আমরা ভাবি, আবোল তাবোল।



তারপর অনেক দিন পার হয়, এভাবেই। তারপরে আমি ভুলে যাই আমি এরকম দিন কাটিয়েছি। সেই ছেলেটাও ভুলে যায় হয়তো। হয়তো আমি ভুলি নাই পুরাপুরি। ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশ চলে যায়। সিগারেট খাওয়া ছেলেটা বিয়ে করে। বউসমেত বিদেশ যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়। তারপরে আমাদের মাঝে পনের মিনিটের রাস্তা রেখে আমরা চাকরি করতে থাকি। ঘানি টানতে থাকি মহিষগুলোর মতোন। তারপরে আমিও হয়তো অনিশ্চিত কোথাও চলে যাই! কোথায় যাই?



তারপর আর কোন গল্প থাকে না। সেই ফেসবুক নামক চমৎকার সাইটে কয়েকশ বছর আগে তুলে রাখা গোপন অ্যালবামটা ঐ সিগারেটখোর ছেলেটা কোনো এক একলা রাতে খুলে বসে। তারপর সেখানে ছবিতে বসে থাকা মুখগুলো দেখে নিজেকে চেনার চেষ্টা করে। একটু পরে অন্য দু'জন একটা করে নোটিফিকেশন পায়। সবকিছুর মাঝে থেকেও বাকি দুইজনে চুপচাপ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।


*****

সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১০

প্রতিক্রিয়াশীলতার অ আ ক খ




প্রতিক্রিয়াশীলতা আর প্রগতিশীলতা শব্দ দুইটার শব্দার্থ নিয়ে ভাবতেছিলাম। হয় কি, ভাষাবদলের সাথে সাথে শব্দের আক্ষরিক অর্থের গায়ে আঞ্চলিক, জাতিগত আর ঐতিহাসিক তকমা পড়ে। বাংলাদেশে এই শব্দ দুইটা আজকাল অহরহ ব্যবহার হয়, যেন অনেকটা ডালভাত হয়ে গেছে। এই কারণে অনেক সময় না বুঝেই অনেকে ব্যবহার করে ফেলেন। হাস্যকর ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ সময়েই ব্যবহারকারী নিজেই ঐ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন। তার আশেপাশে যারা বুঝতে পারেন, তারা মনে মনে ঠা ঠা করে হাসতে থাকেন।


প্রগতিশীলতায় যাবার আগে প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ে দুইটা কথা বলি। এটার ইংরেজি করলে দুইটা শব্দ পাওয়া যায়- রিয়্যাকশনারি, কনজারভেটিভ। যদিও কনজারভেটিভের আলাদা শব্দবন্ধ বাংলায় ব্যবহার হয় (রক্ষণশীল), তবুও প্রকৃতি-বিচারে দুইখানায় সহোদর ভাই, তাহাদের জুড়ি নাই! রিয়্যাকশনারি অর্থ – "viewpoints that seek to return to a previous state (the status quo ante) in society"। বাংলায়- আগে কী সোন্দর দিন কাটাইতাম, সেটার থেইকে কেন যে বাইরায়া আসলাম। চল চল চল, আবার ফিরে চল। ফলিত অর্থে – এখন যদি কেউ বলেন, পাকিস্তানি শাসনামলই ভালো আছিলো, বা ব্রিটিশযুগেই ভালো ছিলাম – গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ইত্যাদি চাই, চাই, চাই। বা আরেকটু এগিয়ে কেউ যদি বলেন, এই গণতন্ত্র, আমলাতন্ত্র খুবই খারাপ, বাঙালিকে ডাণ্ডার উপরে রাখতে হয়, এরশাদ্দাদু ভালো ছিলো। এইগুলা খুবই মামুলি উদাহরণ, যারা শব্দটার সাথে একেবারেই পরিচিত নন, তাদের জন্যে দিলাম। কিন্তু বৈচিত্র্য নিয়া আমাদের বসবাস, তাই শব্দার্থে আটকে থাকলে গাড়ি চলবে না। এই প্রতিক্রিয়াশীলতার চর্চা অনেকটা বর্ণবাদের মতোই আমরা অহরহ লালনপালন করতেছি।


কীভাবে?


আচ্ছা, এখনই তেড়ে মেরে এসেন না। আরেকটু গপসপ করি। আগে প্রগতিশীলতার পরিচয়টা বলি, নাহলে তিনি নিজেকে অবহেলিত মনে করতে পারেন। প্রগতিশীলকে ইংরেজিতে বলে প্রগ্রেসিভ, লিবার‌্যাল। আরেকটু খোসা ছাড়াইলে পাই – "Promoting or favoring progress towards improved conditions or new policies, ideas or methods"। খুবই ভালো কথা। তার মানে, বাংলাতে – নিত্যনতুন মতবাদ শুনলে যার মনে হয় "ভালোই তো", যিনি সহজে সামাজিক আর রাজনৈতিক পটবদলকে আত্মস্থ করতে পারেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, 'সভ্যতা ও সংস্কৃতি বদলে যাবেই, রেডিও জায়গায় টিভি, টিভির জায়গায় ইন্টারনেট আসবেই', এরকম বদলগুলো যাকে খুশি করে, স্বস্তি দেয়, তিনি প্রগতিশীল। আরো সহজ করে বললে, বর্তমান সমাজের ত্রুটি বদলাতে পুরনো ধ্যান ধারণার চাইতে নতুন ধ্যানধারণাকে বেছে নেয়ার প্রবণতাকে প্রগতিশীলতা বলা যায়।


সংজ্ঞা শুনে প্রতিক্রিয়াশীলকে পুরোপুরি খারাপ আর প্রগতিশীলকে পুরোপুরি ভালো মনে হচ্ছে, তাই না? তারমানে একটা কালো, আরেকটা আলো। সুতরাং বেছে নেয়া খুউব সোজা। কিন্তু সবকিছু সহজ সরলভাবে হলে তো আমরা সুখে শান্তিতে বাঁচতাম। এই মোটাদাগে বিভাজনের বাইরেও কিছু কিছু এলাকা আছে। আসেন, একটু সেদিকে হাঁটি।





একজন ব্যক্তি যে সমাজে বাস করেন, সেই সমাজের ব্যাপারে তিনি কখনই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এটা দেশ-জাতি-সময় নির্বিশেষে সকলের জন্যে প্রযোজ্য। নিরানব্বুই ভাগ মানুষ নিজের অবস্থানকে নিয়তি ধরে নিয়ে নীরবে দিনযাপন করেন। তারপর বেলা ফুরালে চুপচাপ মারা যান। ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথেই তার সাথে জড়িত সমাজের ধারণা ও উত্তরণের সম্ভাবনার আপাত-সমাপ্তি ঘটে। তারপরে নতুন মানুষ এবং তার সমাজ বদলের নতুন ধ্যানধারণার আগমন। এই চক্র অনাদিকাল ধরেই চলছে। ব্যক্তির হিসাবে এই চক্রাকার পথ কোন ফলাফল দিচ্ছে না, কিন্তু গোষ্ঠীগত বা দলগত হিসাবে চক্রটি ঘোরার সাথে সাথে একটু একটু করে রৈখিক সরণও হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা মূলত আমাদেরকে এই ‘big picture’ দেখার মতো করে গড়ে তোলে না। জীবনযাপনের ন্যূনতম কিছু জ্ঞান আর ধারণা দিয়েই ছেড়ে দেয়। কিন্তু মানুষ নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই ‘অবহেলিত’ এই জ্ঞানটুকু সংগ্রহ করে নেয়। তখন সে বুঝতে পারে যে চাকার মতো এই চলনটা কেমন, সেটা সামনে যাচ্ছে না পিছনে, তার নিজের আউটপুট, সেই চাকার মাঝে তার আপেক্ষিক অবস্থানের স্বরূপ। প্রগতি আর প্রতিক্রিয়া, ব্যক্তির মাঝে দুই আচরণের একটি বা উভয়ের চর্চা, এই বুঝে নেয়ার সাথে জড়িত।


সমাজে প্রাধান্যকারী মতবাদ তৈরি করার জন্যে এই ‘বোধসম্পন্ন’ মানুষদের প্রয়োজন। নিজের সমাজের কিসে ভালো হয়, আর কিসে খারাপ হয় সেটা একমাত্র এই অল্প কয়েকজন মানুষই বুঝতে পারে। বাকিরা ব্যস্ত থাকেন নিজেদের জীবনযাপনে আর পরিবর্তনের সময় এলে, নিজ নিজ ধারণাপ্রসূত মতামত কোৎ করে গিলে সেই পরিবর্তনের গড্ডালিকা প্রবাহে তারা গা ভাসান।


তার মানে কোন ভূখণ্ডের সমাজ-বদল, মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন এই মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে নির্ভর করে। তারা সেই বদলের চাকাটিকে সামনে বা পিছনে নিয়ে যেতে পারেন। এখন বাংলাদেশে বা এই বদ্বীপের নরম মাটিতে সেই চাকার দাগ কোনদিকে গেছে?


(লিখতে লিখতে ক্লান্ত। বাকিটুক কালকে খতম করবো!)

রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১০

অব্যয়িক


এবং প্রকারান্তরে আমি কাশফুল ভালোবাসি
কিংবা উন্মোচনের শরৎ
ঋতুসমূহ আলোচনার উপসংহারে
সেই মত বিবেচিত হয়নি
তাই আদিগন্ত ধূসর গ্রীষ্ম, গাঢ় কাজল হয়
এই ভাবালু অভিমান বেহুদাই
শহরবাসীর ঋতু বিষণ্ণ ওয়ালপেপারের বেশি নয়
এর চেয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম ভালো-
মৎস্য-সন্তরণ আমাদের, ক্লোরিনের শরীরে
ঘটনাবাহুল্যে আজ ও ইদানিং ভুলে যাই কোথায় রেখেছি সুর ও শূন্যতার শব্দ

শুক্রবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১০

রাতচারণ


দুপুর নিয়ে আমার প্রবল উন্মাদনা আছে। উন্মাদনা, অর্থাৎ সাধারণ্যের সমাজ ও প্রথানিয়ন্ত্রিত আচরণের বাইরে আচরণ। আমি এমন করি, জেনেশুনেই বুক-পকেটে উন্মাদনাসমূহ লালন করি বিবিধ বিষয়ে। জাগতিক তাড়না দিয়ে যেগুলো ইস্যু আমার হিস্যা নিয়ে নেয়- অর্থ, চাকরি, খাওন-দাওন এগুলো আমাকে উন্মাদ করে না। আমি হিসেবি ও খেয়াল করে দেখি এটিএম বুথের ভেতরে ছক ছক নম্বরের জোরে আমার প্রাপ্য খটাখট আমার করতলে চলে আসে। পাতলা হয়ে থাকা ওয়ালেটের ভেতরে শৌখিন রোলার স্কেটিং করে নোটগুলো জমা পড়ে।




অথচ আমি দুপুরের আলোতে উন্মাদ হই। জ্ঞান হবার পর থেকে আমি এই উন্মাদনাকে সহজাতভাবেই পেলেপুষে বড়ো করেছি। কখনো বেখাপ্পা লাগেনি নিজের কাছে, মনে হয়নি ভদ্রসমাজে এমন আচরণের কথা ভাবাও অভব্যতা। দুপুর অর্থাৎ দ্বিপ্রহর; সেই সময়টুকু পাহাড়ের চূড়ায় পত্‌পত্‌ করে উড়তে থাকা নিশানের মতোই কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। তারপরে হঠাতই গড়িয়ে পড়ে হারিয়ে যায়। হারানোর আগে আগে, স্পষ্ট দেখি দুপুরের ঝিম ধরা আলোর ভেতর থেকে একটা মুচকি হাসি আমার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকাচ্ছে। তাকে পুরোপুরি পড়ে নেয়ার আগেই বিকেল চলে আসে। বিকেলের প্রতি আমার কোন মমত্ব নেই। বিকেলে মরা বিড়াল আবিষ্কার হয়।




আরেক দ্বিপ্রহরও আমাকে উন্মত্ত করে, সে নিকষ, সে তিমির, সে শুনশান। আর আমি সেই অনুভবের স্বরূপ চিনতে পারি নীরবতার মাঝেও, নিঃসন্দেহে বুঝি যে এটা অস্বাভাবিক। এমন স্তব্ধসময়ের প্রতি আমার উন্মাদনা মানায় না। এখন দরকার ধ্যানজ স্থিরতার, পানির উপরিতলের নিস্তরঙ্গতার। মনকে শান্ত করো, ইন্দ্রিয়গুলোর মুখ বুঁজে দাও। মোমের প্রলেপ দিয়ে দাও চোখে, তুলো দিয়ে মুছে দাও ত্বকের প্রদাহ। তারপরে নিঝুম ঘুম! কিন্তু আমি বড়ো বেখেয়ালি হয়ে পড়ি এ'সময়ে। বুঝতে পারি আমার ভেতরের ভাঙন রাত দ্বিপ্রহরকে ছুরির ধারে কাটছে। দেয়ালের ছবি আর মুখগুলো ধীরে ধীরে ধুয়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিবর্ণতায় আমারও কেমন মরাটে লাগে। বিভ্রম হয়, মনে হতে থাকে এখন বেলা দুপুর। তীব্র ঝমঝমে রোদে পুড়ে যাচ্ছে রঙ। মরা পাতা খটখটে পাঁপড়ের মতো হয়ে উঠছে।




দেয়ালও একটা সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। যেভাবে দুপুর আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলো, যেভাবে বিকেল এসে আমাকে তীব্র ঠাট্টাভরা অবহেলা করে চলে গিয়েছিলো, যেভাবে সন্ধ্যা খুব সন্দেহজনক হয়ে উঠেছিলো আর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার সবকিছু ছিনতাই করে চলে গিয়েছিলো, পুলিশবেশী রাত অনেক দেরি করে এসেছিলো- ঠিক সেভাবেই রাত দ্বিপ্রহর আমাকে ফেলে চলে যায়। রাত বাড়তে থাকে তন্বী-কিশোরীর বেণীর মতোন। তার ভঙ্গিমা আমার কাছে অপরিচিত লাগে, দূর্বোধ্য লাগে। আমি আবারও চেষ্টা করি চোখ-কান বুঁজে সমাধির ভেতরে ডুবে যেতে। কিন্তু পারি না। সাঁড়াশির মতো দুটো কঙ্কাল হাত আমার হা-কোটরের ভেতরে আঙুলের হাড় ঢুকিয়ে সেটা খুলে রাখে। চোখবিহীন চোখে আমি চরাচরে রাতের লীলা দেখি। নিশিক্লান্ত অনেক অনেক মরদেহ মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে, খেলা করে। তাদের ক্লান্তি কমে না। তারা শ্রান্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে একসময় আবার নিজেদের শয়ানে শিশির হয়ে যায়।


হে আমার দেয়ালের মুখ, হে বিবিধ উন্মাদনা, আমাকে ঘুমুতে দাও!




***

সোমবার, ১২ এপ্রিল, ২০১০

সেলাই#৩


বিকেলের আলোমাখা টেবিলে আমরা দুজনে বসে
তোমার খয়েরি চোখের গাঢ় কাজল দেখলাম
চোখের পাঁপড়িগুলো নেই
(কেউ এসে তুলে নিয়ে গেছে)
ডান চোখের কিনার থেকে লাল ঠোঁটের প্রান্ত অবধি ছুরি দিয়ে চিরে দিয়েছে কেউ
ঠোঁট থেকে হাসির কিছু টুকরো কণা চোখের দিকে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাচ্ছে


তোমার কষ্ট লাগছে। তোমার ব্যথা লাগছে। তুমি হাসছো না। তুমি কাঁদছো না।


আসো আমরা এদিক-ওদিক তাকাই। দু’জনের মাঝে কিছু লতাগুল্ম আদরে বেড়ে উঠেছে। তোমার আঙুলে আশ্রয় নিয়েছে তারা। টেবিলের পেট ফুঁড়ে নদী জেগে উঠছে। নদীতে আমি ডুব দিলাম, সাঁতরে ভুস করে ভেসে উঠলাম। তোমার স্ফীত উদরের কাছাকাছি। এই তীরে প্রবল জলের ক্রন্দন।


মৃত-আলোয় নদী থেকে বিন্দু বিন্দু পানি উঠে আসছে তোমার কোলে, আমি সেখানে মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম, মাটির ভেতরে শামুক, শামুকের খোলে সে, তার হাতখানা ছোট, হাতের মুঠিতে তোমার চোখের পাপড়িগুলো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লো সেই নদীতে