শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১০

একটি অগল্প-জনিত প্রয়াস বা বিভ্রম

বাইরে যদি খুব তীব্র আলো থাকে, তাহলে ঘরের ভেতর থেকেও সেই আঁচ টের পাওয়া যায়। জানালাটায় পর্দা দেয়া, তারপরেও সূর্যের আলোর তেজ পর্দার ঘেরাটোপ পেরিয়ে চলে আসে। আমি এরকম দিনে খুব ঘরকাতুরে হয়ে পড়ি, এ'ঘর-ওঘর করি। তারপরেও নিতান্ত দরকার না পড়লে বাইরে বের হই না। এখন কোনো কোনো দিন ছুটি থাকে, কোনো কোনো দিন সারাদিন কাজ। যেদিন কাজে থাকি, নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও পাই না, সেসব দিনে আমি ভালো থাকি। আর নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দিত্বের দিনে আমার কেবলই তাদের কথা মনে পড়ে।

ঝিম ঝিম দুপুর গড়িয়ে গেলে আমার ঘুম ভাঙত। একজন তার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে উঠে চলে গেছে। কামলাগিরি করে বহুজাতিকে, সেখানে দশটা পাঁচটা বলে আদতে আটটা-আটটা খাটিয়ে নেয়। খাটতে খাটতে তার খাটিয়ায় ওঠার দশা। ভোরে বের হয়ে যায়, বাস ঠেলে অফিসে ঢোকে। বের হতে হতে নিশুতি। আবার ফিরে আসতে আসতে তার খাওয়ার ইচ্ছাটুকুও থাকে না। আমরা বাকি দু'জন যখন কোন মুভি'টা দেখা দরকার, বা আজকে আসলে ইন্টারনেটে নতুন সাইটটার ভেতরে ঘোরাঘুরি করার ফন্দি কষি, সে তখন ভোসভোসিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমরা তাকে বিরক্ত করি না, শান্তিতে ঘুমাতে দেই। তারপরে একটু নেট ঘেঁটে বলি, "নাহ, এই ফেসবুক নামের সাইটটা বেশ মজাদার। এতে ঘোরাঘুরি করতেও মজা লাগছে।"

একটু পরে আমরা নাটক দেখতে বসি। ইংরেজি নাটক, যা কিনা মার্কিন মুলুকে সপ্তাহে সপ্তাহে একদিন করে দেখায়, আর আমরা গরীব দেশে সেটা একবছর পরে একবারে সারাবছরের সব পর্ব দেখি। তাতে ক্ষতি নেই, আমাদের মনে হতে থাকে এটা একটা অন্তহীন মুভি। পর্বে পর্বে চমক। আমরা তর্ক করি কেন সুপারম্যান একটা 'গুড-ফর-নাথিং' লানা ল্যাঙের পিছনে ঘুরছে? কেন সে তার পাশেই ক্লোয়ির দিকে একবারও তাকায় না!

তারপর রাত বাড়লে আমাদের ক্ষুধা পায়। আমরা পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে বের হই আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছাউনির নিচে তাওয়ার কাছে গিয়ে বসি। এখানে তেল তেল পরোটা আর আধাকাচা ডিমভাজি পাওয়া যায়। আমরা সেই আগুনেগরম তেল-পরোটা-ডিম-ভাজি দ্রুত মুখে চালান করে দেই। দেরি করলেই আঙুল নয়তো জিব পুড়ে যেতে পারে। একটু খেয়ে আমার সাথে যে ছেলেটা আছে, সে সিগারেট ধরায়। আমি সিগারেট খাই না। খালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার চারপাশের প্রিয় মানুষেরা সিগারেট কেন খায়, এটা নিয়ে ভাবতে বসি। আমরা দেখি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে পরাবাস্তব দৃশ্যের মতোন মহিষের পাল যাচ্ছে। কালো রাস্তার পিঠে কালো কালো মহিষগুলোকে আমাদের অন্যজগতের মনে হয়, কেমন নিঃশব্দ চলাচল তাদের। যেন চোখ বেঁধে নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছে তারা! একবারও ভাবছে না যে কালকেই হোটেলে হোটেলে তাদের মাংস কালাভুনা হয়ে আমাদেরই পেটে চলে যাবে। মহিষের পালের রাখালটাকে আমার ভালো লাগে না, তার চেহারা অস্পষ্ট।

ছেলেটার সিগারেট খাওয়া শেষ হয়। এখন চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠিয়ে আমরা ট্রাফিক সিগন্যালে বসে আছি। জনহীন রাস্তায় সবুজ-লাল বাতি একা একাই জ্বলে! আমরা ভাবি, আবোল তাবোল।



তারপর অনেক দিন পার হয়, এভাবেই। তারপরে আমি ভুলে যাই আমি এরকম দিন কাটিয়েছি। সেই ছেলেটাও ভুলে যায় হয়তো। হয়তো আমি ভুলি নাই পুরাপুরি। ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশ চলে যায়। সিগারেট খাওয়া ছেলেটা বিয়ে করে। বউসমেত বিদেশ যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়। তারপরে আমাদের মাঝে পনের মিনিটের রাস্তা রেখে আমরা চাকরি করতে থাকি। ঘানি টানতে থাকি মহিষগুলোর মতোন। তারপরে আমিও হয়তো অনিশ্চিত কোথাও চলে যাই! কোথায় যাই?



তারপর আর কোন গল্প থাকে না। সেই ফেসবুক নামক চমৎকার সাইটে কয়েকশ বছর আগে তুলে রাখা গোপন অ্যালবামটা ঐ সিগারেটখোর ছেলেটা কোনো এক একলা রাতে খুলে বসে। তারপর সেখানে ছবিতে বসে থাকা মুখগুলো দেখে নিজেকে চেনার চেষ্টা করে। একটু পরে অন্য দু'জন একটা করে নোটিফিকেশন পায়। সবকিছুর মাঝে থেকেও বাকি দুইজনে চুপচাপ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।


*****

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন