বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

খেলাখেলি

ছোটবেলা থেকেই আমি খেলাধুলায় তেমন একটা ভাল না। যে কয়টা খেলা শিখেছি, তার কোনটাতেই আমি খুব ভাল করি নাই কখনো। যে দেশে মাঠে-ঘাটে পোলাপান ফুটবল আর ক্রিকেট খেলে, সেখানে আমার ভাল লাগতো ক্যারম আর টেবিল-টেনিস। তবু দেখা যেতো, আমি বারবার হেরেই যাই। সেই হেরে যাওয়া নিয়ে যে খুব দুঃখ লাগে, অমনও না বিষয়টা। এজন্যই কোন খেলাতেই আমি খুব বেশি পারদর্শী হতে পারি নাই।

প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে একটা সূক্ষ্ণ হিংস্রতা (ভালো অর্থে) আছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে জিতে যাওয়ার আনন্দও আছে। সেই আনন্দের জন্যই খেলোয়াড় আর দর্শকরা এতোটা মশগুল হয়। এই হিংস্রতাকে ভাল বলছি, কারণ এর সাথে আমাদের জিনের ভেতরে টিকে থাকার সঙ্কেতের সম্পর্ক আছে। প্রকৃতির প্রতিকূলতা একসময় আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল। এর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে আমাদের টিকে থাকতে হতো।

এখন আমরা সেই প্রকৃতিকে বশ করে ফেলেছি। হুট করে কোন দুর্যোগেও সাময়িক বিপদ কাটিয়ে আমরা সামলে উঠি। কিন্তু জিনের ভেতরে সেই লড়াইয়ের নির্দেশ তো আর এতো সহজে মুছবে না! তাই লড়াইটা নিজেরা একে অপরের সাথে করাই লাগে। এই লড়াইয়ের সবচেয়ে বাজে রূপ হলো ক্ষমতার লড়াই, তথা যুদ্ধবিগ্রহ। নিজের প্রজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লোভে খুন করার এই অভূতপূর্ব "মাইন্ড-বগ্লিং" কাজটা আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। আজ যদি বাইরে থেকে কোন বুদ্ধিমান প্রাণী আমাদের মাঝে আসে, তাহলে খুবই অবাক হবে যখন দেখবে যে আমরা মাটিতে কিছু কাল্পনিক দাগ কেটে সেই দাগের দুই পাশে দাঁড়িয়ে পরষ্পরকে কেটে ফেলছি।

এই লড়াইয়ের ভাল রূপ হলো খেলাধুলা। খেলায় জয়-পরাজয়ের হিসেবটা আরোপিত। খেলার নিয়ম-কানুনও আরোপিত। অর্থাৎ আমরা নিজেরাই ভেবে ভেবে এগুলো সৃষ্টি করেছি। আমাদের জিনের হিংস্রতম প্রবৃত্তিটাকে চেপে না রেখে যতটা কম হিংস্রভাবে বের করে দেয়া যায়, সেই চেষ্টাই আমরা সাধারণত করে থাকি। এখানে উল্লেখ্য যে খেলার নামে মেরে ফেলার খেলাও আমরা একসময় খেলতাম। তবে এখন সেগুলো বাতিল হয়েছে, রক্ষা!

আদিম প্রবৃত্তিকে খেলার মাধ্যমে বের করে আনা তো গেল। কিন্তু খেলা শেষ হলে সেটাকে আবার বাক্সে পুরবে কে? এ যেন প্যান্ডোরার বাক্সের মতো, খুললেই বেরিয়ে আসে ক্রোধ, ভেদাভেদ, হিংস্রতা, ঘৃণা, জিঘাংসা, জিগীষা।... সাথে আরও আসে সতীর্থ খেলোয়াড়দের প্রতি একাত্মতা, দলের প্রতি প্রতিজ্ঞা, অধিনায়কের প্রতি আনুগত্য, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেমের মতো হিতকর অনুভূতি। এই সবকিছুরও দুইটা ভাগ করা যায় তাহলে - খারাপ আর ভাল অনুভূতি। প্রথমে যেগুলো বললাম, সেগুলোকে আমি খারাপ অনুভূতি মনে করছি। কারণ এই অনুভূতি একদিকে মনকে বিষিয়ে তোলে, অপর মানুষকে শুধুমাত্র একটা প্রতীকে পরিণত করে। মানুষ হিসেবে আপনি আরেকজন মানুষকে শুধুই একটা প্রতীকে চিন্তা করতে পারেন না। যখনই তা করবেন, তখন এক পিচ্ছিল পথ ধরে পড়ে যাবেন। যে পথ দিয়ে আপনার আগে আরো অনেকেই পড়েছে। যে পথের শেষে আছে অপরকে খুন করে সে রক্তে উল্লাসের গন্তব্য। সে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আগে ফিরে আসুন। আপনার যদি নিজের দেশকে সমর্থন দেয়ার অধিকার থাকে, তাহলে অপর একজন মানুষেরও অধিকার আছে তার দেশকে সমর্থন দেয়ার। সে যদি ঐ পিচ্ছিল পথে যেতেও চায়, যাক। আপনি কেন যাবেন সে পথে?

পরে যেগুলো বলেছি, সেগুলো হিতকর অনুভূতি। কারণ এর প্রতিটিই আপনাকে আরেকজন মানুষের সাথে ঐক্যের অনুভূতি দেয়। আপনি বোধ করেন যে আপনার সতীর্থরা আপনার কাছের মানুষ। তাদেরকে আপনি আপনার সমান মনে করেন। দেখবেন এই অনুভবটা খুব সুখের, যা দৈনন্দিন কষ্টকেও কমিয়ে দেয়। খেলোয়াড়রা এই অনুভূতিগুলো সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভব করে, দর্শকরাও করে কিছু কম মাত্রায়, তবে করে বৈ কী! এই যে একতাবদ্ধতা, এই যে অপর মানুষকে সমান ভাবা - এর থেকে আপনার মনে সহমর্মিতার (empathy) সৃষ্টি হয়। আমাদের বিবর্তনে এই অনুভূতিটাই সবচেয়ে হিতকর এবং উচ্চমানের অনুভূতি। প্রতিপক্ষকে হারানোর চেয়েও নিজপক্ষকে জেতানোর দিকে তখন মনোযোগ দেয়া যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন খেলায় যারা সেরার সেরা, তাদের বক্তব্যগুলো একটু খেয়াল করে দেখবেন, তারা কেউই প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে কিংবা হারিয়ে-জুতিয়ে-মাড়িয়ে ফেলতে চায় নি। তারা শুধুই নিজেদের কৌশল, পারদর্শিতা, দক্ষতাকে সুউচ্চে নিতে চেয়েছেন। যে কোন খেলার গ্রেটদের মাঝে এটা কমন বৈশিষ্ট্য। এটাকে আমরা অনেক সময় বিনয় বলে ভুল করি। যাদের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য নেই, তারা সেই খেলায় গ্রেট হতে পারে নি। কোনদিনও পারবে না। লিখে দিলাম, চেক করে দেখতে পারেন।

[২]

খেলা চলছে। খেলার উত্তেজনায় অনেক কিছুই আমরা বলি। ভেতরের কালি বেরিয়ে আসে, যা দিয়ে লিখি উল্লসিত অক্ষর। কিন্তু খেলার পরে সেগুলো থেকে নেতিবাচক অনুভূতিগুলো প্লিজ সরিয়ে ফেলুন। আপনার নিজের জন্যই। ইতিবাচক অনুভূতিগুলোকে সাজিয়ে রাখুন। সেটাও নিজের জন্যই। দেখবেন ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভাল অনুভূতিগুলোকেই মনে পড়বে।

চারপাশে অনেকেই নেতিবাচকতাকে উসকে দিচ্ছেন। নিজের উগ্র জাতীয়তাবাদের সাপটা ফোঁসফোঁস করছে। সেই সাপকে জাস্টিফাই করছেন "ওরাও তো অমুক তমুক করেছে/বলেছে/লিখেছে/এঁকেছে" ইত্যাদি বলে। সেই পিচ্ছিল পথ! একটা খারাপ তুলনা দেই এ'বেলা। অনেকটা এমন যে, কেউ ল্যাট্রিনের গু তুলে সারা পাড়া মাখিয়ে বেড়াচ্ছে বলে আমিও কিছু গু হাতে তুলে নিলাম। আপনি নিজেও হয়তো বুঝতে পারছেন যে আপনার কথাগুলো উগ্র, এবং এটার সমর্থক অল্প। আপনি যে বা যার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে এমন করছেন, তারাও 'অধিকাংশ' না, অত্যন্ত ছোট একটা গ্রুপ। আপনারা দুই গ্রুপই বারবার করে এমন করছেন কেন? যাতে দলে ভারী হতে পারেন। একইভাবে বিভিন্ন রাজনীতিবিদও বারবার করে এধরণের কথা বলেন। আস্তে আস্তে তারা দলে ভারী হয়। কেউ উঠে দাঁড়িয়ে তাদের থামতে বলে না। খেলার উত্তেজনা একদিন জাতিগত উন্মাদনায় পরিণত হয়।

প্রতিটি উন্মাদনাই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। কপাল খারাপ হলে চিরস্থায়ী। আজ এশিয়ার উপমহাদেশে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের অসংখ্য কামড়াকামড়ি দেখে ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রেতাত্মারা ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে! কী যাদু করিলাম রে বন্ধু - বলে একে অপরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। নাতির ঘরের পুতি বুড়ো হয়ে গেল, তবু জাতি-ধর্ম-বর্ণবিদ্বেষ কাটাতে পারলো না। সামান্য সাড়ে তিন ঘন্টার খেলার খোঁচায় দগদগে ঘা বেরিয়ে গেলো!..

[৩]

এই নেতিবাচকতা থেকে মুক্তি অচিরেই আসবে বলে মনে হয় না। দূরে থাকার চেষ্টা করছি যতোটা পারি। আজকে বাংলাদেশ পুরুষ দলের খেলা নেই। তবে বাংলাদেশ নারী দলের খেলা আছে। গত ম্যাচের আগে তাদের ছোট ছোট সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। জাহানারা, ফাহিমা, রুমানা, সালমা, আয়েশাদের চোখে মুখে দীপ্ত বিশ্বাস - বিশ্বপ্রতিযোগিতার দরবারে তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন। নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনবেন। বাংলাদেশের সমাজ নারীদের জন্য ক্রিকেট খেলা বা যে কোন খেলাই পেশা হিসেবে নেয়ার পথে অসংখ্য প্রতিকূলতার কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। তাদের নিবৃত্ত করতে, হতাশ করতে আমরা চেষ্টার কোন ত্রুটিই রাখি না। এই চর্চা ঘর হতে বাহির পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপরেও সেসব কাঁটার তোয়াক্কা না করে তারা এতোদূর পৌঁছে গেছেন। অথচ অবাক ব্যাপার কি জানেন? তাদের বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। তারা শুধুই আপনার সমর্থন চান। ভেবে দেখুন, এই প্রতিকূলতার ভগ্নাংশ আপনার স্বপ্নপূরণের পথে থাকলে আপনি কতোটা নালিশ করতেন! তারা সেসব কিছুই না করে নিজেদের স্বপ্নটুকুই সার্থক করতে চলেছেন। (আবারও সেই নেতিবাচক বনাম ইতিবাচকের পাল্লা এবং ইতিবাচকতার জয়)। আজ তাই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের জন্য শুভকামনা জানাই!

দুটো বিশ্বকাপ চলছে। পুরুষদল ছোট প্রতিপক্ষকে হারালেও বড়োদের এখনো হারাতে পারে নি। মনে মনে আশা করছি নারীদল বড়ো প্রতিপক্ষকে হারাবে আজ। সেই উদাহরণ থেকে পুরুষদলও জয়ের মুখ দেখবে! জয় বাংলা!