সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১০

প্রতিক্রিয়াশীলতার অ আ ক খ




প্রতিক্রিয়াশীলতা আর প্রগতিশীলতা শব্দ দুইটার শব্দার্থ নিয়ে ভাবতেছিলাম। হয় কি, ভাষাবদলের সাথে সাথে শব্দের আক্ষরিক অর্থের গায়ে আঞ্চলিক, জাতিগত আর ঐতিহাসিক তকমা পড়ে। বাংলাদেশে এই শব্দ দুইটা আজকাল অহরহ ব্যবহার হয়, যেন অনেকটা ডালভাত হয়ে গেছে। এই কারণে অনেক সময় না বুঝেই অনেকে ব্যবহার করে ফেলেন। হাস্যকর ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ সময়েই ব্যবহারকারী নিজেই ঐ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন। তার আশেপাশে যারা বুঝতে পারেন, তারা মনে মনে ঠা ঠা করে হাসতে থাকেন।


প্রগতিশীলতায় যাবার আগে প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ে দুইটা কথা বলি। এটার ইংরেজি করলে দুইটা শব্দ পাওয়া যায়- রিয়্যাকশনারি, কনজারভেটিভ। যদিও কনজারভেটিভের আলাদা শব্দবন্ধ বাংলায় ব্যবহার হয় (রক্ষণশীল), তবুও প্রকৃতি-বিচারে দুইখানায় সহোদর ভাই, তাহাদের জুড়ি নাই! রিয়্যাকশনারি অর্থ – "viewpoints that seek to return to a previous state (the status quo ante) in society"। বাংলায়- আগে কী সোন্দর দিন কাটাইতাম, সেটার থেইকে কেন যে বাইরায়া আসলাম। চল চল চল, আবার ফিরে চল। ফলিত অর্থে – এখন যদি কেউ বলেন, পাকিস্তানি শাসনামলই ভালো আছিলো, বা ব্রিটিশযুগেই ভালো ছিলাম – গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ইত্যাদি চাই, চাই, চাই। বা আরেকটু এগিয়ে কেউ যদি বলেন, এই গণতন্ত্র, আমলাতন্ত্র খুবই খারাপ, বাঙালিকে ডাণ্ডার উপরে রাখতে হয়, এরশাদ্দাদু ভালো ছিলো। এইগুলা খুবই মামুলি উদাহরণ, যারা শব্দটার সাথে একেবারেই পরিচিত নন, তাদের জন্যে দিলাম। কিন্তু বৈচিত্র্য নিয়া আমাদের বসবাস, তাই শব্দার্থে আটকে থাকলে গাড়ি চলবে না। এই প্রতিক্রিয়াশীলতার চর্চা অনেকটা বর্ণবাদের মতোই আমরা অহরহ লালনপালন করতেছি।


কীভাবে?


আচ্ছা, এখনই তেড়ে মেরে এসেন না। আরেকটু গপসপ করি। আগে প্রগতিশীলতার পরিচয়টা বলি, নাহলে তিনি নিজেকে অবহেলিত মনে করতে পারেন। প্রগতিশীলকে ইংরেজিতে বলে প্রগ্রেসিভ, লিবার‌্যাল। আরেকটু খোসা ছাড়াইলে পাই – "Promoting or favoring progress towards improved conditions or new policies, ideas or methods"। খুবই ভালো কথা। তার মানে, বাংলাতে – নিত্যনতুন মতবাদ শুনলে যার মনে হয় "ভালোই তো", যিনি সহজে সামাজিক আর রাজনৈতিক পটবদলকে আত্মস্থ করতে পারেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, 'সভ্যতা ও সংস্কৃতি বদলে যাবেই, রেডিও জায়গায় টিভি, টিভির জায়গায় ইন্টারনেট আসবেই', এরকম বদলগুলো যাকে খুশি করে, স্বস্তি দেয়, তিনি প্রগতিশীল। আরো সহজ করে বললে, বর্তমান সমাজের ত্রুটি বদলাতে পুরনো ধ্যান ধারণার চাইতে নতুন ধ্যানধারণাকে বেছে নেয়ার প্রবণতাকে প্রগতিশীলতা বলা যায়।


সংজ্ঞা শুনে প্রতিক্রিয়াশীলকে পুরোপুরি খারাপ আর প্রগতিশীলকে পুরোপুরি ভালো মনে হচ্ছে, তাই না? তারমানে একটা কালো, আরেকটা আলো। সুতরাং বেছে নেয়া খুউব সোজা। কিন্তু সবকিছু সহজ সরলভাবে হলে তো আমরা সুখে শান্তিতে বাঁচতাম। এই মোটাদাগে বিভাজনের বাইরেও কিছু কিছু এলাকা আছে। আসেন, একটু সেদিকে হাঁটি।





একজন ব্যক্তি যে সমাজে বাস করেন, সেই সমাজের ব্যাপারে তিনি কখনই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এটা দেশ-জাতি-সময় নির্বিশেষে সকলের জন্যে প্রযোজ্য। নিরানব্বুই ভাগ মানুষ নিজের অবস্থানকে নিয়তি ধরে নিয়ে নীরবে দিনযাপন করেন। তারপর বেলা ফুরালে চুপচাপ মারা যান। ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথেই তার সাথে জড়িত সমাজের ধারণা ও উত্তরণের সম্ভাবনার আপাত-সমাপ্তি ঘটে। তারপরে নতুন মানুষ এবং তার সমাজ বদলের নতুন ধ্যানধারণার আগমন। এই চক্র অনাদিকাল ধরেই চলছে। ব্যক্তির হিসাবে এই চক্রাকার পথ কোন ফলাফল দিচ্ছে না, কিন্তু গোষ্ঠীগত বা দলগত হিসাবে চক্রটি ঘোরার সাথে সাথে একটু একটু করে রৈখিক সরণও হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা মূলত আমাদেরকে এই ‘big picture’ দেখার মতো করে গড়ে তোলে না। জীবনযাপনের ন্যূনতম কিছু জ্ঞান আর ধারণা দিয়েই ছেড়ে দেয়। কিন্তু মানুষ নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই ‘অবহেলিত’ এই জ্ঞানটুকু সংগ্রহ করে নেয়। তখন সে বুঝতে পারে যে চাকার মতো এই চলনটা কেমন, সেটা সামনে যাচ্ছে না পিছনে, তার নিজের আউটপুট, সেই চাকার মাঝে তার আপেক্ষিক অবস্থানের স্বরূপ। প্রগতি আর প্রতিক্রিয়া, ব্যক্তির মাঝে দুই আচরণের একটি বা উভয়ের চর্চা, এই বুঝে নেয়ার সাথে জড়িত।


সমাজে প্রাধান্যকারী মতবাদ তৈরি করার জন্যে এই ‘বোধসম্পন্ন’ মানুষদের প্রয়োজন। নিজের সমাজের কিসে ভালো হয়, আর কিসে খারাপ হয় সেটা একমাত্র এই অল্প কয়েকজন মানুষই বুঝতে পারে। বাকিরা ব্যস্ত থাকেন নিজেদের জীবনযাপনে আর পরিবর্তনের সময় এলে, নিজ নিজ ধারণাপ্রসূত মতামত কোৎ করে গিলে সেই পরিবর্তনের গড্ডালিকা প্রবাহে তারা গা ভাসান।


তার মানে কোন ভূখণ্ডের সমাজ-বদল, মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন এই মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে নির্ভর করে। তারা সেই বদলের চাকাটিকে সামনে বা পিছনে নিয়ে যেতে পারেন। এখন বাংলাদেশে বা এই বদ্বীপের নরম মাটিতে সেই চাকার দাগ কোনদিকে গেছে?


(লিখতে লিখতে ক্লান্ত। বাকিটুক কালকে খতম করবো!)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন