শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১০

ওন্দস্কান

মাথা ভার ভার করছে সারাদিন ধরে। অনেক কাজ করছি সারাদিন ধরে। বেশিরভাগ সময় কম্পিউটারের সামনে যারা কাটান, হঠাৎ করে পুরো একটা দিন বা সারা সপ্তাহ ইন্টারনেট আর কম্পিউটার না ধরলে তাদের কেমন লাগবে? ভাবছিলাম। কিছু কিছু ব্যাপার যেমন কল্পনাতেও আসে না, ফ্যান্টাসির চাইতেও বেশি অসম্ভব বলে মনে হয়, এই ব্যাপারটাও মনে হয় সেরকম! আমি প্রায় দশ বছর ধরে নিজের কম্পিউটার ব্যবহার করছি, হঠাৎ করে এক দিন বা দুই দিন কম্পিউটার সচল না পেলে মাথার সার্কিটে কোন একটা 'গিয়াঞ্জাম' লেগে যায় (আগে গিট্টু লাগতো, গিট্টুর পরের দশা হলো গেরো, আর গিয়াঞ্জাম হলো শেষ অবস্থা!)। মনে হতে থাকে একটা হাত নাই; অথবা পেটের ভেতরে পাকস্থলী নাই - খাবার খাইলে সরাসরি তলপেটে চলে যাচ্ছে। এই ধরনের উদ্ভট শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে মনে হতে থাকে যে আমি বোধহয় আসক্ত। নেশাগ্রস্ত।

অনেক আগে একটা ছবি দেখেছিলাম মনিটরের ভেতরে মাথা ম্যাট্রিক্সের মতো গলে গলে ঢুকে যাচ্ছে আর বাকি শরীরটা টার্মিনেটর টু-এর মতো এলুমিনিয়ামের মতো গলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তেমন লাগে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এটা যে অস্বাভাবিক বা সমস্যা, তা বুঝতে পারি না। স্বাভাবিক মনে হয়। অভ্যস্ত হলে অপ্রাকৃতিক আচরণও ন্যায্য মনে হয়।



কিছু ছবি দেখার পরে অতীতের কথা মনে পড়ে। আমার স্বল্পায়ু অতীত। সুইডেনের ছবি ওন্দস্কান (Ondskan), মানে হলো Evil, শয়তান। ছবিটা যার কাছ থেকে নিয়েছি, সে বলেছিলো যে ক্যাডেট কলেজের কথা মনে পড়বে, দেখেন, মজা পাবেন (সে নিজেও এক্স-ক্যাডেট)। দেখা শুরু করার ২০ মিনিট পরে একটু থামলাম। একটা দৃশ্য দেখালো, বোর্ডিং হাউজে আসার পরে রুমমেটের সাথে কথোপকথন। রুমমেট বেশ পড়ুয়া, ভালো ছাত্র, তবে খেলাধুলায় ভালো না, একটু পৃথুল শরীরের। যে সিনিয়র প্রিফেক্ট নতুন ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে, সে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু হালকা ঝাড়ি দিয়ে গেলো। নতুন ছেলেটাই গল্পের মূল নায়ক, রাগী, বয়ঃসন্ধির রাগ, পেটা শরীর, সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। আমি থেমে গেলাম কারণ আমি নিজেও খুব একটা ভালো ছিলাম না খেলাধুলায়। খেলতাম, খুব এনজয় করেই খেলেছি দুই তিন বছর। কিন্তু যতো সিনিয়র হয়ে গেছি ততোই খেলাধুলার দিক থেকে মন সরে গিয়েছে। খুব প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমার কখনই ভালো লাগে না। ওপেন চ্যালেঞ্জ, জিগীষার যে খাপ-খোলা-রূপ খেলার মাঠে ফুটে ওঠে, সেটা আমাকে কিছুটা সন্ত্রস্ত করে।

ছবিটা মূলত এই বোর্ডিংয়ের জীবন-যাপন নিয়ে নয়। বরং আরো অনেক গভীর মনস্তত্ত্বে গিয়ে নাড়া দিয়েছে। আর এখন যদি ব্যাখ্যা করতে যাই, পারবো না। এতোটাই সূক্ষ্ণ-উদ্দীপন, যে ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা নাই। ছবিটার নামে যে শয়তানের কথা বলেছে, সেটা আমাদের ভেতরের পাশবিকতা। হিংস্র জানোয়ারের মতো আমরা মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে, নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাই। সামনে পরা মানুষটাকে আর মানুষ বলে মনে করি না। ভায়োলেন্স আসলে খুবই "সাপেক্ষ" আচরণ। যা কিনা পরিবেশ, মুহূর্ত এবং আরো অনেক প্রভাবকের ওপর নির্ভর করে। গিয়ারের দাঁতের মতো, অনেকগুলো ছোটবড় চাকার দাঁত মিলে গেলে ঘোটঘোট করে ঘুরতে থাকে ভায়োলেন্সের চাকা। এর সাথে যুক্ত হয় মব-ফিয়ার, দলগত-হিংস্রতা। কোন র‍্যাশনাল বা ক্রিটিকাল সমালোচনা এখানে তুচ্ছ।

আরেকটা জিনিস খুব ঘটতে দেখেছি, যে কোন বদ্ধ-আবাসিক ব্যবস্থায়। সেটা হলো ব্যবস্থার নিজস্ব একটা চালু 'সিস্টেম' থাকে। এটা অনেকটাই সপ্রাণ। আর প্রাণের বৈশিষ্ট্যই হলো বিবর্তন। সিস্টেম ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়। অনেক বুঝে শুনে নিয়মকানুন বানালেও নিজে নিজে সিস্টেমটা মানুষগুলোকে দিয়ে আরেকটা আলাদা নিয়মকানুনের ইশতেহার বানিয়ে ফেলে। যেন সে বুঝতে পারছে কোনভাবে চললে, কোন নিয়মে চালালে সবচেয়ে স্থিতিশীল সিস্টেম তৈরি করা যাবে। যতোই 'রেড বুক' বা 'নীতিমালা' বানাই না কেন, শেষতক সেই সিস্টেমের-বানানো-নিয়মটাই টিকে থাকবে। এটা যেন নিজেই নিজের জন্য সীমানা তৈরি করে!

আর মানুষ খুবই ফালতু সৃষ্টি। কারণ অধিকাংশ মানুষ এই সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যারা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারে থাকেন, তারাও পারেন না। সিস্টেমের হাতে তারাও এক একটা ঘুঁটি। এখানেও লজিক্যাল কোন ডিডাকশন নাই। মেনে চলো। সুখী হবে। এই যে 'সুখ', এটাও সিস্টেম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঠিক ওই ম্যাট্রিক্সের মতোন!

যাস্‌সালা, ঘুরে ফিরে সেই তো গোড়ায় ফিরে এলুম! এই কী গেরো! ( আশার কথা, গিয়াঞ্জাম কেটে 'গেরো'তে এসেছি, গিট্টুতেও চলে আসতে পারবো নিশ্চিত!)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন