মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০

অচেনা ইলিয়াস...

কেউ যে চরিত্রে বা আচরণে স্বচ্ছন্দ নয়, সেখানে তাকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। নতুন নতুন মনে হয় তাকে। এবং অস্বাচ্ছন্দ্য বলে, খুব সজাগ হয়ে আছে সে। বুঝতে পারি সে অপরিচিতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে চারপাশের সাথে যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছে। এভাবে তাকে বিপাকে পড়তে দেখে আমার ভালো লাগে। তাকেও ভুলভ্রান্ত মানুষ মনে হয়। যে কাজগুলো সে অনায়াসে করতে পারে, সেগুলো দেখে দেখে মনে ঈর্ষা জন্মেছিলো, সমীহ করার, মাথা ও মন অচিরেই নুয়ে পড়ার অনুভব তৈরি হয়েছিলো। সেটা ধীরে ধীরে কেটে যায়। তাকে আর ওভাবে শ্রদ্ধা ও সমীহ করতে হবে না জেনে আমি হাঁফ ছাড়ি। এখন থেকে তাকে আমার আরো একটু আপন মনে হবে। ফর্মালিটি কারই বা ভালো লাগে, তাই না?

তো, যার কথা বলছিলাম, 'তুমি' সম্বোধন করলেও সে অনেক বড়ো লেখক। গুণী তো বটেই, তারচে'ও বেশি প্রচণ্ড তার প্রকাশ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বাংলা উপন্যাস আর গল্পকে অনেকাংশে ট্যাবুহীন করেছেন তিনি। পুতুপুতু যে ভালোমানুষি গদ্য, সেখানে বাবুমশাই ব্রিটিশ আমলে ধুতি পড়তেন আর পাকিস্তান আমলে পড়তেন পাজামা-পাঞ্জাবি। সেইখানে প্যান্ট-হাফশার্ট অথবা লুঙ্গি পরা লোকগুলোকে চিৎকার করার জায়গা করে দিয়েছেন ইলিয়াস। এবং সে ভাবেই তিনি পরিচিত হন, সবাই তাকে সেভাবেই চেনে।

আজকে বই নাড়তে নাড়তে তাঁর কবিতা খুঁজে পেলাম। অবাক অবাক কৌতূহল জেগে উঠলো। খুব বেশি কবিতা লেখেন নি তিনি। হাতে গোনা কয়েক পাতা। বেশিরভাগই সম্ভবত তার সন্তানের জন্য, শিশুতোষ ছড়ার মতো কবিতা। শুধু দু'তিনটে কবিতা নজর কাড়লো, ইলিয়াসীয় ঢঙ, ঝাঁজ আর ভাষার ব্যবহারের কারণে। সেই উপন্যাসে পাওয়া কথাগুলোই অন্যচেহারায় ফিরে এলো।


স্বপ্নে আমার জন্ম
ঘুম
শুধু ঘুম
আমরা ছিলুম
সাত বিলিয়ন সাতাশশো ভাই;
শান্ত প্রবল তীক্ষ্ণ হাওয়া এলোমেলো
শিশির শরম, পূর্ব থেকে নরম আলো,
আমার বাবার মোমবাতিকে সবুজ কাঁপাই।
লবণ-লালে বলকানো পাপ আব্বা দিলো শান্ত সাঁতার
কাঁপা কাঁপা, অল্প তবু কি উদ্‌ভ্রান্তি গভীর ব্যথার
হাজারটা ভাই আকাশ উপুড় ওম্বে গাইছে তারার ফোঁটা,
জ্যোৎস্না রাতে ভাসছি সবাই এশার আজান হাওয়ায় লোটা।
গোলাপ থেকে, আপেল আমের আদর থেকে আগুন থেকে মায়ের ফেনা
নিষিদ্ধ সব গলি বেয়ে দিন রাত্রি বয়ে আনে, জীবন নামক জানাজাটা
'তারচে চলো শেষ হয়ে যাই।' ক্রেজি কণ্ঠ কাতর হলুম, 'ভাল্লাগেনা ভাল্লাগেনা'
বলতে বলতে ওয়েনিঙ স্বর তারার মতোন আত্মহত্যা করলো ওরা,
সাধও হলো, বিলীন হলো, দ্যাখো দ্যাখো নেই মানুষের নীরব ঝরা।
'আমিই একা, কী-যে করবো, হায় হায় এই চোপসানো ও লুপ্ত বুকে
ক্লান্ত ক্লাউন, আঁকাবাকা আঁধার ওম্বে একাই মরি ধুঁকে।
আম্মা তখোন বিবমিষায় উপুড় হলো দন্তবিহীন মুখে।
সাগর-শোষা, আগুন আওয়াজ, কোরান-কালো আলোর গ্রহে
ল্যাজ গুটানো, নেই নেই লোম, ছিন্ন শিশ্ন, কুঁজো হয়ে
এদিক ওদিক করুণ তাকাই, গলিয়ে পড়ি,
সে উনিশশো তেতাল্লিশের ফেব্রুয়ারি।
বমির টুকরো মোহিত মগ্ন
ঘুমের মধ্যে ঘামি
লোনলি লগ্ন
আমি।


====================


এলেমজির জন্য শোক
আমার এলএমজি, এলএমজি, এলেমজি আজ
কোথায় গিয়েছ তুমি? কতোদূর, বলো কোন লোকে
নিরুদ্দেশ যাত্রা করো? শীতল শরীরে রক্ত শিখা
জ্বেলে দাও অন্ধকারে, ব্রাশ করো কোন সেক্টরে?
তোমার ট্রিগারে কার কিশোর তর্জনী টানে গান,
পূর্বজন্ম, মৃত্যু, সাধ? সুপ্তশিশ্ন ব্যারেলের কাম
এ্যামবুশ করে কার রক্তে? তুমি কার অধিকারে?
এলেমজি, তুমি ছিলে হাত জোড়া, বুক জুড়ে, বুক ভরে ছিলে।
তুমি ছিলে, ক্রোধ ছিলো; প্রতিহিংসা ছিলো; হৃৎপিণ্ডে
ঘৃণা; বাঁচবার নির্লজ্জ স্পৃহা। যাবার বেলায়
মহারাজ, ঠাণ্ডা ঠোঁটে শুষে নিলে সব, তুমিই তো
একদিন দিয়েছিলে। তুমি নাই, প্রতিহিংসা নাই;
ঘৃণা নাইল তুমি নাই, ক্রোধশূন্য বুক আজ ফাঁকা।
হৃৎপিণ্ড নিদারুণ খালি, বুক নাই, চাঁদে চাঁদ
নাই। স্পৃহাশূন্য হাতে কেউ এসে গুঁজে দেবে - নাই।


====================
মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষেরা অস্ত্রগুলো হাতে না পেলে হয়তো একাত্তরে এতোটা আত্মত্যাগী হইতে পারতো না। অস্ত্র হাতে আসার আগে আমরা ভীরু, পলায়নপর, ম্রিয়মাণ জাতি হিসেবে বেড়ে উঠেছি, অস্ত্র সরে যাবার পরে আবারও সেই রকম হয়ে গিয়েছি ধীরে ধীরে। (দীর্ঘশ্বাসের ইমো) ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন