বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১০

অব্যাখ্যাত কলাম...

লুই আর্মস্ট্রঙের একটা গান আছে। হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড। মানুষ হিসেবে আমরা তো নগণ্য, ক্ষণিক জীবন আর তার যাতনাতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে থাকি। তাই চোখ মেলে অনেক সময় চারপাশের সৌন্দর্য দেখা হয় না। এ পার্থিব জগত কতো সুন্দর! কতো নৈর্ব্যক্তিকভাবে সুন্দর! অর্থহীন এ প্রবল আবেগ, এ নদীর স্রোতের মতো দৃশ্য। কুলকুল করে বয়ে চলছে চোখের সামনে। চোখ মেলে দেখতে দেখতে একটা সময় দৃশ্যগুলো সব কিছু নিস্পৃহ করে দেয়। মুগ্ধতার পারদ সীমা ছাড়িয়ে গেলে বোধহীন জড়ের মতো চোখ মেলে রাখি। সেখানে কোনো রূপ-রস আর তাড়না জন্মাতে পারে না। তখন একটু চোখ ঝাপটানো লাগে। মানুষের চোখের পলক ফেলার গতি শুনছি খুব বেশি। দ্রুততায় চোখের পলক ঝাপটানো - তারপর আবার দৃশ্যরাজি।

আমি মনে করি দৃশ্যের কোন ভালো খারাপ নাই। সৌন্দর্য ও রূপের কোনো সংজ্ঞা নাই। অপার্থিব বলেও কোনো কিছু ব্যাখ্যাত নাই। আমরা যা দেখি, যা বুঝি, যা অনুভব করি, সবই পার্থিব। অপার্থিব, ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কোনো জায়গা নাই। তবে অব্যাখ্যাত অনুভব আছে আমাদের। কারণ আমাদের ভাষা শক্তিশালি না। এই ভাষার দৌর্বল্যে আমরা দুর্বল অনুভবের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি। একটা কিছু 'ফীল' করলে, সেইটারে সংজ্ঞায়নের মধ্যে ফেলি, দেখি খাপে খাপে মিলে কি না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এটা ফিট করে না। কোনো সংজ্ঞাতেই মিলে না। তখন নিজেরে বুঝ দেই যে এইটা 'অপার্থিব'। যে জগত আমরা দেখি নাই, জানি নাই, সেইটার নাম দিয়ে দিলাম অনায়াসে। ভাবলামও না, এ যেন ওই চোখের পলক ফেলার মতো একটা রিফ্লেক্স। কিন্তু এইটা ঠিক না। পার্থিব অনুভবকে নাম দিতে না পেরে, আমরা সেটা অপার্থিব কোয়াড্রেন্টে পাঠায় দিতেছি!

তাই আমি এখন অব্যাখ্যাত নামে একটা কলাম বানাইলাম। এই কলামে রাখবো ভাষিক সীমানার বাইরের সব কিছু।


একদিন রাস্তায় পা হড়কে পড়ে যাবার সময় যে পতনের অনুভব হলো - সেটাকে এখানে রাখলাম। এলোমেলো হেঁটে যাবার সময় আজকাল মাঝে মাঝে অমন করে পড়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু যদি প্ল্যান-প্রোগ্রাম ঠিক করে পড়ে যাই, তাইলে তো আর সেটার মতো হইলো না। তাই অপেক্ষা করি, কোনো একদিন তো আবার বেখেয়ালে পড়ে যাবো। ফুটপাতে ব্যস্ত পায়ের খটাখট চলে যাবার মধ্যিখানে আমি স্থানুর মতো পড়ে থাকবো। দ্রুত পায়ে দৃশ্যগুলা সরে সরে যাবে। আমার অস্থির লাগবে, মনে হবে তাড়াহুড়া, কোথাও যাওয়ার ছিলো, ভুলে গ্যাছি। মগজের রুমে রুমে আঁতিপাতি করে খুঁজবো, "কোথাও যাওনের কথা ভুইলা গেলাম!"

তারপর একদিন ক্লাসে অমনোযোগি। দেখা গেলো সেইদিন স্যারের চোখ আমার উপরেই পড়লো। দাঁড়া করায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "এতোক্ষণ কী বলসিলাম?" মুখ ফসকে বেরুচ্ছিলো, "তা আমি কী জানি?", সামলে নিয়ে বলে দিলাম কিছু একটা। তারপরে অপমান হয়ে গেলাম অনায়াসে, স্লোমোশনে স্যার শিকে বিঁধায়ে রোস্ট করলেন। ক্লাস জুড়ে হাসির কল্লোল। উল্টোদিকের করিডোর থেকে দুয়েকটা মাথা ঘুরে তাকালো, ভেতরে ঠাট্টারসে ভিজে ভিজে আমি দাঁড়ায়ে থাকলাম। সেদিন সারাদিন ধরে সেই ঠাট্টারস গায়ে চ্যাটচ্যাটে লেগে রইলো। মোছার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই গ্যালো না। ক্ষণে ক্ষণে আমাকে দেখে চত্বরের গাছগুলাও পরিহাসের হাসি হেসে উঠছিলো!

অথবা যেদিন শীতের মধ্যেও হেঁটে হেঁটে শহর পাড়ি দিলাম। অনেকগুলো সিএনজি, রিকশা আর বাস আমাকে ডাকাডাকি করছিলো। মাফলার জড়ানো, কোট চাপানো মানুষগুলো হেলে দুলে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়ছিলো সেগুলায়। আমি পিছায়ে রইলাম। আমার হুড়োহুড়ি করতে ভালো লাগছিলো না। আমার কোথাও পৌঁছানোর তাড়া ছিলো না। অস্থির এই দৃশ্যটা আমার ভালো লাগছিলো, তাই আমি দেখছিলাম। দেখতে দেখতে অনেকগুলা বাসহাতিঘোড়া চলে গেলো। তারপর আমি হুড তুলে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার আগেপিছে কিছু মানুষও হাঁটছিলো হনহন করে। আমি অতোটা জোরে আগাই নাই। ধীরে বহে যমুনা। রাস্তা পেরুলাম বিনা সিগন্যালে, শরীর বাঁচায়ে। গাড়িগুলোর কৃপা আমারে ধাক্কা দ্যায় নাই। চারপাশে শা শা করে অনেকগুলা গাড়ির ভীড়। শীতের রাত এই সন্ধ্যা নামতেই! মৃদু কনকনে, তাই জবুথবু বাঁকা হয়ে আমি এগোতে থাকি। ফুটপাতগুলো এখানে ফাঁকা, হকারদের তাড়ায় দিছে কেউ। হাঁটতে গিয়ে এলোমেলো লাগে। নানা কিছু ভাবি। একদম একা বলে কেউ ভাবনায় ভাগ বসায় না। চারপাশে বড়ো বড়ো দোকানের আলো জ্বলে উঠছে। জ্বলজ্বলে শহর ক্যামন কাতর চোখে তাকায়। আমারে ডাকে, আমি আজ তার ভোক্তা হইলে, রাতের কামাইটা পুরা হয়। আমি এই সম্ভাষণে ভুলি না, বুঝতে পারি এইটা মেকি। আমারে সে চেনেও না। গত পঁচিশ বছরেও চেনে নাই, আর চিনবেও না। এই শহর কাউরেই চিনতে পারে না।


এই সব অব্যাখ্যাত অনুভবগুলারে সাজাইতে সাজাইতে কলাম ভরে ওঠে। উপচায়া পড়ে। তার অনেক পরে একটা সময় আমি বাড়ি পৌঁছায় যাই। নিজের ঘরে ঢুকতেই অনেকগুলো কোলাহল জাপটায় ধরে। আমার একটুও ভালো লাগে না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন