বুধবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১১

এপিক্যুরাস ভনে...

আজকাল খুব স্পিরিচুয়াল মানুষজন দেখি চারপাশে। মহাত্মা মহাত্মা লাগে তাদেরকে। খুশি হই যে আমি খুব ভাগ্যবান, আমার চারদিকে প্রতুল বিশ্বাসী মানুষ। বিশ্বাসের চাকাটায় নানা অপবিশ্বাস ও অপবিজ্ঞান এসে জুড়ে যাচ্ছে। এগুলো ভালো-খারাপ আপেক্ষিক। (মানে আমার কাছে খারাপ, আর অনেকের কাছে ভালো) তবে জরুরি হলো এগুলোকে কেউ যাচাই বাছাইও করছে না। ব্যধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয় - তাই ভাবছি একটু স্বাস্থ্যবটিকা ছড়াই। যুক্তিবিদ্যা আর দর্শন আমাদের সিলেবাসেই নাই। কেউ পড়ি নাই। আর পড়ি নাই বলে জানি না আমরা কুয়োর তলদেশের শ্যাওলামাখা ব্যাঙ! 
 
এপিক্যুরাসকে মনে পড়ছে। দুই হাজার দুইশ' সাত বছর আগে হেজে মজে গেছে। গ্রিক। এরিস্ততল, প্লেতো, দেমোক্রিতাসের পরে জন্মাইছেন। কাউরে সেভাবে পাত্তা দেন নাই। আর পাত্তা দেন নাই বলেই নতুন কিছু দিয়ে গেছেন জগতে মানবের জন্য। যুগে যুগে যতো মণীষী, আগের মানুষজনরে পাত্তা দেয় নাই বেশিরভাগই। ভাগ্যিস!

একটা সোজা কথা দিয়ে শুরু করিঃ
প্রজ্ঞাবান, নীতিবান আর ভালো হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া কেউ সুখের জীবন কাটাতে পারবে না, এবং সুখের জীবন না কাটিয়ে কেউ প্রজ্ঞাবান, নীতিবান আর ভালো হয়ে বাঁচতে পারবে না। যখনই কোনো একটার অভাব ঘটবে, যেমন কেউ যদি প্রজ্ঞাবান না হয়, তাহলে যতোই সম্মান আর নীতির সাথেই চলুক না কেন, সে কখনই সুখী হবে না।
চেনা চেনা লাগে? এইটাই গোল্ডেন রুল অফ এথিকস। অন্যরে এমনভাবে ট্রিট করো যেমনে তুমি নিজে ট্রিটেড হইবার চাও।
এপিক্যুরাস এইটা বললেন। বলেই থামেন নাই। টুকটাক যুক্তি দিয়ে বুঝায় দিছেন যে এইটা সত্য। (সত্য মানে ব্যক্তিগত সত্য না, সার্বিক সত্য, সকল যুগে, সকল কালে, জাত-পাত নির্বিশেষে)

আরেকদিকে যাই চলেন। এপিক্যুরাস লোকটি দেমোক্রিতাসের মতো বিশ্বাস করতেন পরমাণুর চাইতে ছোট কণা নাই। atomos, অবিভাজ্য। তবে তিনি দেমোক্রিতাস থেকে একটু ভিন্ন মতের ছিলেন। তিনি বলেছেন যে পরমাণু সবসময় সরল পথে চলে, তবে মাঝে মাঝে তারা পথ বিচ্যুত হয়, মাঝে মাঝে তারা swerve করে। এই খানে কেন তিনি এভাবে মত পাল্টালেন? কারণ নিয়ে একটু ভাবি, আসুন। "পরমাণু অবিভাজ্য আর সর্বদা সরলপথেই চলে" - এই বক্তব্যটা কেমন আদেশ আদেশ লাগে না? এই লাইনেই চলবি, এর বাইরে যাবি না। ব্যস। এইটা মানুষের ক্ষেত্রে - সমাজের ক্ষেত্রে খাটাই চলুন। গোষ্ঠি থেকে বড়ো হতে হতে রাষ্ট্র বানালো গ্রিকরা। সেই খানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো determinism, কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে বাঁচতে হবে - বলে দিলো দার্শনিক - নেতা - রাজনীতিবিদ - সিনেটর - প্রিফেক্ট এরা। বেশ। তবে মানুষের freewill কোথায় যাবে? গ্রিকরা মোটামুটি নিয়তি-বিশ্বাসী ছিলেন। মনে আছে, ইলিয়াড আর অডিসির নায়কদের কথা? বিশ্ববীর - অদম্য তারা, তারপরেও শেষ নিয়তি করুণ, দুঃসহ। সিসিফাসের কথাও মনে পড়ে। এই সবের মাঝে মানুষের কোন ক্ষমতা নাই নিজের নিয়তি বেছে নেয়ার। নাকি আছে? এপিক্যুরাস লোকটা সেই প্রশ্ন উস্কে দিলেন। অবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কোনকিছু 'আছে' আর 'সবাই মানে' বলে আমাকেও মানতে হবে? না। যাচাই করে দেখি। দেখা গেলো, মানুষেরও ফ্রি-উইল আছে। যেমন আছে পরমাণুর মাঝে মাঝে বেঁকে যাবার অধিকার!

বলে কী পাগল (কেউ কেউ ছাগলও বলেছিলো তাঁকে!)! জানেন, দুই হাজার মোটে বছর গেলো। আর ম্যাক্স প্লাঙ্ক নামক এক 'জর্মন' বিজ্ঞানী বের করে ফেললেন, পরমাণু আসলেই বেঁকে যায়।

এই রে, এখন ভাবছেন, এই ব্যাটা এপিক্যুরাস তো অবিশ্বাসী বুঝলাম, হু হু, তার মানেই ব্যাটা পাঁড় নাস্তিক। (হারেরেরে! ধর ব্যাটারে। করবো কতল!)

শুনুন শুনুন। একটু শান্ত হোন। ভয় নাই, এপিক্যুরাস 'নাস্তিক' ছিলেন না। নঞ+আস্তিক = স্রষ্টার অস্তিত্বে না তিনি বলেননি। তাহলে কেমন গুব্লেট খেয়ে গেলো। দেখি চতুর-এপিক্যুরাস কী বললেন -
The gods are immortal and blessed and men who ascribe any additional qualities that are alien to immortality and blessedness are, according to Epicurus, impious.
আমরা সবাই ভাবি, ভালো কাজে পুরষ্কার আর খারাপ কাজে শাস্তি দিবেন স্রষ্টা(রা)। সব হিসেব রাখা হচ্ছে ডান কাঁধে, বাম কাঁধে। মরলেই বিচার অনিবার্য। এপিক্যুরাসের মতে, "স্রষ্টারা মর্ত্যের মানুষের কাজকর্ম খেয়াল রাখেন না। যে মানুষ সকলের জনমতে মেনে চলা স্রষ্টাকে অমান্য করে, সে অধার্মিক নয়। বরং সবাই মিলে স্রষ্টার যে গুণাগুণ চাপিয়ে দেয় সেগুলো যে মানুষ মানে, সে-ই অধার্মিক।"

হুমম, ভাবনায় পড়ে গেলেন। ভজে গেছে মন ভজন গানে, তারে কেমনে বুঝাবেন খোদার রূপ? আসুন একটু অবসর করে ভাবি। ভাবলে তো কেউ দোষ দিবে না। মারতেও আসবে না। এপিক্যুরাস খালি এমনি এমনি বললে কেউ মানবে কেন। তাই তিনি একটা যুক্তি দিলেন। নির্জলা যুক্তি। তাঁকে যদি খুব বেশি খারাপ না লাগে, তাহলে আরেকটা কথা বলছিলেন সেইটা বলতে পারি।
একটি পবিত্রতম ও অক্ষয় সত্ত্বার কোন ঝুটঝামেলা নাই, সেই সত্ত্বা অন্য কারো জন্য ঝামেলা তৈরি করে না; সুতরাং সে সকল ক্রোধ ও পক্ষপাত থেকে মুক্ত, কারণ ক্রোধ ও পক্ষপাত, দুর্বলতা।
আরেকটা যুক্তিও দিলেন ধাঁধার আড়ালে। ধাঁধাটার সরল সমাধান এখনও কেউ দিতে পারে নাই। আফসোস!
Is God willing to prevent evil, but not able?
Then he is not omnipotent.
Is he able, but not willing?
Then he is malevolent.
Is he both able and willing?
Then whence cometh evil?
Is he neither able nor willing?
Then why call him God?


বড়ো মুশকিল! বড়ো মুশকিল! যুক্তিতে চুকে যাচ্ছে চুক্তি! মর্ত্যের মানবের তরে এ কী আজব শর্ত!


এপিক্যুরাসের দর্শনের সবচেয়ে সুন্দর অবদান কী জানেন? তাঁর দর্শনের প্রবল প্রভাব আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে রয়ে গেছে। এপিক্যুরাসের মতে, সকল হিত ও অহিতের উৎস হলো সুখ ও যাতনার উদ্দীপনা (sensation)। আমরা যা কিছুতে সুখ পাই, সেগুলো ভালো, আর যা কিছুতে কষ্ট পাই, যা কিছু যন্ত্রণাময়, তা খারাপ।* ভালো খারাপের এই নীতিগত পার্থক্যের ব্যাপারে এপিক্যুরাস প্রথম বললেন। যদি কখনও কেউ সেধে যাতনা বেছে নেয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই যাতনার ফলশ্রুতিতে রয়েছে প্রচণ্ড সুখের সম্ভাবনা। এখানে অনেকে ভুল বুঝতে পারেন, এপিক্যুরাস হয়তো সুখের তাড়নায় যাচ্ছেতাই করার কথা বলেছেন। আসলে ঘটনা ভিন্ন। তিনি মূলত মানুষের যাতনাহীনতার তত্ত্ব-তালাশের কথা বলেছেন। জন্মের পর থেকে আমরা মূলত যাতনার লাঘব চাই। এই জন্ম এক নিরন্তর তাড়না, আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যাতনাহীন সুখের দিকে। সুখ আসলে যাতনার অ্যাবসেন্স। কষ্ট যতো কমে আসবে, ততো সুখের পরিমাণ বাড়বে। সদ্যজাত সন্তানের মুখ দেখে মা হেসে ফেলেন কেন? নাড়ী ছেঁড়া ব্যথাও তার কিচ্ছুটি মনে হয় না, কেন? ভাবুন তো!

এপিক্যুরাসের এই যাতনালাঘবের দর্শন জেনেছিলেন বিথাইনিয়া শহরের ডাক্তার অ্যাসক্লেপ্যেদিস। তিনি রোমে গিয়ে চালু করলেন সৌহার্দ্যপূর্ণ, সহানুভূতিশীল চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি। এর আগে মানসিক রোগীদের আটকে রাখা হতো, সামাজিকভাবে 'পতিত' করে রাখা হতো। অ্যাসক্লেপ্যেদিস এর অবসান ঘটালেন। তাদেরকে অন্যান্য রোগীদের মতো সেবা দেয়া শুরু করলেন। মানবিক থেরাপির গুণে কেউ কেউ অনেকটাই প্রকৃতস্থ হয়ে উঠলো! এই যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, যার কারনে এখনও ডাক্তারের হাসি দেখে আমরা ভরসা পাই, মারাত্মক অসুখেও সাহস হারাই না, তার কারণ এই অ্যাসক্লেপ্যেদিসের পদ্ধতি। তাঁকে সাইকোথেরাপি আর ফিজিকাল থেরাপির ডাক্তাররা কী সম্মান করেন, কাউকে পেলে জিগাইয়েন!
সেদিন থার্টি ফার্স্টের পরে গালগল্পে শুনলাম, বন্ধুদের পার্টির কথা। তরলের তোড়ে কয়েকজন ভেসে গেছে। অনভ্যাস বলি, বা অতি-পান, তাতে পরের দিন আর কারো গা-নড়ানোর উপায় নাই। হ্যাংওভার। কেন হলো? অতিরিক্ত পান। এখন ভাবুন তো, এমন ধারা হ্যাংওভার আর কখন কখন ঘটে। যখন আমরা অতিরিক্ত ঝাল খাই, অতিরিক্ত মিষ্টি খাই, (আর বাদ দেই কেন, যখন অতিরিক্ত পেট ঠেসে খাই), যখন শরীরকে অতিরিক্ত খাটাই, যথেচ্ছাচারে মাতি, তখন কেমন লাগে! যখন কাউকে ভালোবাসতে বাসতে আমাদের অবসেশন তৈরি হয়, কান্নাকাটি, অবসাদ, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যা পর্যন্তও গড়ায়। সবই এক ধরনের হ্যাংওভার - মানসিক - শারীরিক।

এই অমিত-সুখ ভালো নয়। এপিক্যুরাস খুব জোরেশোরেই এইটার প্রতিবাদ করেছিলেন।
No pleasure is a bad thing in itself, but the things which produce certain pleasures entail disturbances many times greater than the pleasures themselves.
তাহলে কোথায় সীমানা, কোথায় গিয়ে থামবো আমরা? কীভাবে বুঝবো এই সুখের খোঁজ এর পরে আমাদের যাতনার দিকেই নিয়ে যাবে? ইঙ্গিত আছে ওই এপিক্যুরাসেই।
Bodily pleasure does not increase when the pain of want has been removed; after that it only admits of variation. The limit of mental pleasure, however, is reached when we reflect on these bodily pleasures and their related emotions, which used to cause the mind the greatest alarms.
কামনার যাতনা চলে গেলেই শারীরিক সুখ বাড়ে না; বরং তা বিচিত্র দিকে যায়। তবে, যখন আমরা শারীরিক সুখ আর তার সাথে জড়ানো আবেগগুলোকে পুনরায় তুলে আনি, তখন আমরা মানসিক সুখের সীমানায় পৌঁছে যাই, এই আবেগগুলো আমাদের মনে এর আগে খুব সতর্কতা তৈরি করে দিতো।
শেষ করি মৃত্যু দিয়ে। হায় আমার প্রিয় টপিক। তোমাকে ছাড়া আমার সব কাজ অর্থহীন কারণ তুমি নিজেও অর্থহীন!

আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ মৃত্যুকে বালিশ কাঁথা বানিয়ে ফেলেছিলেন, মাঝে মাঝে উটের গ্রীবা। আমি সে'রকম ভাবতাম, মৃত্যুকে আটপৌরে বানাইলে আর ভয় লাগে না তেমন একটা। অভ্যস্ত ভয় খুব একটা চমকেও দেয় না! ধারণা বদলে গেলো কয়দিন পরে এপিক্যুরাসের দেখা পেয়ে।

মৃত্যু আমাদের কাছে কিচ্ছু না এমন একটা ধারণার সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠো, কারণ সব ভালো-খারাপ মূলত উদ্দীপনার মাঝে নিহিত। এবং মৃত্যু মানে সকল উদ্দীপনার নিরসন। সুতরাং সঠিকভাবে বুঝে নেয়া যে মৃত্যু আসলে আমাদের কাছে কিছুই না, এই বোধ আমাদের মরণশীল জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে, অসীম আয়ু যোগের মাধ্যমে না, বরঞ্চ অমরত্বের প্রতি কাঙ্ক্ষা দূর করার মাধ্যমে। সেই মানবের কাছে জীবনের কোনকিছুই দুঃসহ না, যে বুঝে গেছে যে বেঁচে না থাকার মাঝে কোন ভয়ঙ্কর কিছু নেই। একারণেই, যে মানব বলে যে, মৃত্যুর যাতনার জন্য নয় বরং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা যাতনাময় বলে সে মৃত্যুকে ভয় পায়, সে বোকা। যা এসে পৌঁছুলে আমাদের কোন সমস্যা হবে না, তার জন্য অপেক্ষা করা এক ধরনের অলস অপচিন্তা। তাই, মৃত্যু - ভয়ঙ্করতম ভয়ঙ্কর - আদতে আমাদের কাছে অর্থহীন, কারণ আমাদের অস্তিত্ব যতোক্ষণ, ততোক্ষণ মৃত্যু অনুপস্থিত, আর যখনই মৃত্যু আসবে, তখন আমরা থাকবো না। এই মৃত্যু জীবিত কিংবা মৃত সকলের কাছেই মূল্যহীন, কারণ জীবিতের জন্য এটা অবাস্তব, আর মৃতের নিজেরই কোন অস্তিত্ব নাই।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। এপিক্যুরাস " বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি"র উদ্ভাবক। তিনি না বললে, আমাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতির হয়তো আরো অনেক বছর লাগতো ঠিকঠাক কাঠামো দাঁড় করাতে! তাঁর জন্য অবিমিশ্র শ্রদ্ধা!


=0=


*এখানে এই তত্ত্বটি বিশদে বলা গেলো না। আগ্রহী যে কেউ এখানে কিছু আলোচনা পাবেন। আর নেট জুড়ে আরো অসংখ্য আলোচনা আছে, আমি যেগুলো ঠিকঠাক বর্ণনাও করতে পারবো না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন