শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১১

অ্যালেন গিনসবার্গের Howl...

====================
howl [হাউ্‌ল্‌] n. বিশেষত নেকড়ের একটানা হুঙ্কার; (মানুষের) আর্তনাদ; (অবজ্ঞা, কৌতুক ইত্যাদির) চিৎকার।
====================
কিছু কিছু ছবি গুগলের কাছে নিয়ে যায়। ছবি দেখা শেষ হলে, ইচ্ছা করে একটু পিছনের গল্পটা জেনে নেই। কতোটুকু সত্যিই ছিল, কতোটুকু পরিচালকের সিনেম্যাটিক বাস্তবতা, কতোটুকু দর্শক হিসেবে আমার অনুমান। গুগল করে অনেককিছু জানা যায়। অনেকে অজানা খবর ঠিক ঠাক বুঝা যায়। তারপর আবার কিছু কিছু ছবি থাকে, দেখার পরে গুগল করার ইচ্ছা হলেও করি না, তাতে সিনেমার মজাটা হারিয়ে যেতে পারে। অতিবিশ্লেষণ মাঝে মাঝে রসভঙ্গ দেয়। ভাং খাওয়ার পরে কেউ ভাঙের রাসায়নিক কম্পোজিশন কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করলে যেমন লাগে, তেমন। Howl দেখার পরে আমি এই দুইদিকের টানাটানিতে পড়ে গেলাম। সিনেমা খুব ভালো লেগে গেছে। ভীতিকর স্বপ্নের মতো ভালো লেগেছে। যেমন স্বপ্ন ঠিক ঠিক দুঃস্বপ্ন না, কারণ দেখার সময় পানিতে পড়ি নাই, স্বপ্নে কোন দুর্ঘটনাও ঘটে নাই। কিন্তু ঘুম ভেঙে সেই স্বপ্নের কথা ভাবলে একটু একটু ভয় হচ্ছে। সেই ভয়ের সাথে আবার অজানা আনন্দও মিশে আছে। আবার সেই ভয়ের অনুভবের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। 
ছবিটা বিস্ময়কর। একটি কবিতাকে সিনেমায় তুলে আনা দুরূহ কাজ। বেশিরভাগ উপন্যাসকে সিনেমায় আনতে গিয়েই অনেকে হিমশিম খায়, সেখানে গল্প বা উপন্যাস নয়, একেবারে কবিতা! পরিচালকের কি মাথা খারাপ হয়েছিলো? তাও এমন কবিতা যা পঞ্চাশের দশকে পুরো একটা জাতির একটা প্রজন্মকে মোটামুটি তুলে আনতে পারে? কবিতা ছাড়েন, কবির নামটাও আমাদের অজপাড়াদেশের বেশিরভাগ মানুষ জানেন। সেই সুবিখ্যাত কবি, সেই (কু)খ্যাত আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সিনেমার দৃশ্য বয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিনতম কাজের একটা। তাই পরিচালক অতিবাস্তব কল্পনার কাছে আশ্রয় নিলেন। সিনেমার অর্ধেক অংশ হলো কবি অ্যালেন গিনসবার্গের সাক্ষাতকার এবং কবিতার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মামলার শুনানি। বাকি অর্ধেক অংশ কবির কবিতা পাঠ এবং কবিতার পাশাপাশি কবিতাদৃশ্য। এই দৃশ্যগুলো অ্যানিমেটেড। এছাড়া উপায়ও নেই, বরং এটাই সর্বোত্তম উপায়। কবিতার দৃশ্যকে সেলুলয়েডে বাস্তব চিত্র দিয়ে তুলে আনা যায় না। সেখানে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ভরসায় না থেকে পরিচালকেরা সরাসরি অ্যানিমেশনে চলে গেছেন। মাঝে মাঝে বাস্তব জগতের ভেতর থেকে ফুঁড়ে বেরুচ্ছে অ্যানিমেশন, মাঝে মাঝে অ্যানিমেশন মিশে যাচ্ছে সাদাকালো আলোর অ্যালেনের পাঠরত অবয়বের সাথে। চশমাটা একটু ঠিক করে নিয়ে আবার পাঠ শুরু করছেন অ্যালেন, একটু দম নিয়ে নিচ্ছেন দুই স্তবকের মাঝে। উদ্দাম কণ্ঠ ছাড়া ছোট হোটেলের পাটাতনে সবাই নিশ্চুপ। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে, নীরবতার মাঝে শোনা যাচ্ছে টুং টাং গেলাসের আওয়াজ। সব কিছু ছাপিয়ে এক টানা নেকড়ের আর্তনাদ, Howl!! 
পরিচালক দু'জনের নাম রবার্ট এপস্টিন এবং জেফ্রি ফ্রিডম্যান। দু'জনেই এর আগে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন। এই ছবিটা ঠিক ডকুমেন্টারি নয়, একটু পুরোদস্তুর মোশন পিকচার। তবে বৈশিষ্ট্য হলো, এই ছবির সকল সংলাপ, বাস্তব। কেউ না কেউ, কখনো না কখনো, কোথাও না কোথাও বলেছেন। যেমন সাক্ষাতকার নেয়ার দৃশ্যে অ্যালেনের বলা সকল কথাই বাস্তবে বলেছেন তিনি। যেমন কোর্টরুমে শুনানির সময় বলা সব কথাই সত্যি। সেইদিক থেকে সিনেমার ভেতরে সংলাপগুলো কল্পনার নয়। তবে তার বাইরে মূল অংশ যে কবিতা, যে কবিতার আলাপ, সেগুলো কল্পনার রঙ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে বার বার। এবং দর্শকের চোখে, মনে, মগজে ছাপ ফেলে দেয়ার মতো দৃশ্য। এই দৃশ্য তৈরির জন্য এরিক ড্রুকারকে ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে!
কবিতার শরীরের ভেতর দিয়ে অ্যালেনের জীবন-ছবি ফুটে উঠতে থাকে। ছোটোবেলা, কিশোরবেলা, আবেগ। কিশোরবেলা-যুবকবেলা, প্রেম। অ্যালেন সমকামী ছিলেন, যাদের ভালোবাসতেন, তাদের জন্য তাঁর আকুতির মাঝে আমি কোনো ভেদাভেদ পাই না। অনুভবের কোন লিঙ্গ নাই, তাই একজন বিষমকামী যেভাবে প্রেয়সীকে কামনা করে, যেভাবে কাতর হয়, যেভাবে তার বিনিদ্র রাত জুড়ে থাকে একজনের চুলের সুবাস, ঠোঁটের বাঁকানো হাসি, তেমনভাবেই অ্যালেন তাড়িত হন। সেই উন্মাতাল সময়, মাদক-ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া বাস্তবতা, আর পরাবাস্তব কবিতার সময়ের মধ্যে অ্যালেন জন্মেছিলেন আরেক জন্ম। সেই সময় আমেরিকায় একটা পুরো প্রজন্ম বেড়ে উঠছিলো, অবয়ব পাচ্ছিলো, যাদের নাম বিট জেনারেশন। অ্যালেন সেই জেনারেশনের পুরোধা কবি। 
Howl And Other Poems বইটা অ্যালেনের প্রথম বই। এই কবিতার দায়ে বইটা অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়। মার্কিন আদালতে মামলা চলে প্রকাশক এবং সরকারি পক্ষের মধ্যে। সেন্সরশীপ, অশ্লীলতা নিয়ে সীমারেখার আলাপ উঠে আসে সেই মামলায়। বিভিন্ন অধ্যাপককে জবানি দিতে হয় এই বইয়ের সাহিত্যমূল্য বা সাহিত্যিক গুরুত্ব নিয়ে। এই অংশটুকু মজাদার। বেশ কিছু বুড়োটে প্রতিক্রিয়াশীল হামবড়া বুড়ো-জোয়ান প্রফেসর দেখতে পাই। তারা প্রথাগত কোটরে বন্দি, চোখের সামনে প্রথাগত ঠুলি। ঠুলি চোখে Howl তাদের কাছে অশ্লীল, নোংরা, অশ্রাব্য, হোমোসেক্সুয়াল, ট্যাবু। তাই এই কবিতার নানা অংশ নিয়েই তাদের প্রশ্ন উঠে গেছে। শব্দের শুদ্ধবাদিতা নিয়ে এঁড়োতর্কও জুড়ে দিয়েছেন তারা। এই অংশটা দেখে মজা লাগলো কারণ এখনও চারপাশে এই এঁড়ো ষাঁড় প্রচুর পয়দা হয়ে আছে। এই যুগে এসেও যারা ভাষার গায়ে পোশাক ও অলঙ্কার নিয়ে চিন্তিত। একটা শব্দেই তাদের শুচিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

ভাগ্যিস সেই অত্যাচার বেশিক্ষণ সইতে হয় নি। কালো ফ্রেমের চশমা পরা অ্যালেন এসে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। জেমস ফ্র্যাঙ্কোকে চিনেছি সেই স্পাইডারম্যান (২০০২) থেকে। তবে এই বছরে তার ছবিগুলো প্রশংসার দাবিদার। "127 Days", "Howl", "Eat Pray Love" সবগুলোতেই ফ্র্যাঙ্কো ধীরে ধীরে নিজের জাত চিনিয়ে দিচ্ছেন। যেমন ২০০৮-এ Milk ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হোমোসেক্সুয়াল চরিত্রের জন্যে ফ্র্যাঙ্কো বাঁধা পছন্দ হয়ে যাবেন মনে হয় পরিচালকদের। 
সবকিছু ছাপিয়েও, শেষমেশ ছবি জুড়ে একটা কবিতাই জ্বলজ্বল করছে। অ্যালেন গিনসবার্গকে আমরা সবাই 'যশোর রোড' দিয়ে চিনতাম, এবার আমি 'হাওল' দিয়ে চিনলাম। এবং এই পরিচয় আরো গভীর, প্রোথিত আবেগের, মানবিক, প্রেমাকুল। এক নেকড়ের দীর্ঘ আর্তনাদের মতোই এক টানা জান্তব, অথচ তীব্র কামনাময়!

====================

সম্পূর্ণ কবিতাঃ এখানে
সম্পূর্ণ সিনেমাঃ এখানে

====================






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন