সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১০

জগা বললো - জগাখিচুড়ি!


সময় খুব অদ্ভুত জিনিস। এই মুহূর্তে যা ভাবছি, সেই কথাটা হুশ করে আমার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে! এই পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে বন বন করে, সেই ঘূর্ণনের বেগ জানি কতো? ১৬০০ কিলোমিটার প্রতিঘন্টায়! আমি থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকলেও সটান জোরে চলে যাচ্ছি কতো দূরে। এই দূরত্ব অমোচনীয়। আবার দ্রুততায় মিশে যাচ্ছি কারো কারো সাথে। আমাদের এই পরিচয়, এই ক্ষণিকের মিলন ঠিক একটা দেয়াশলাইয়ের অগ্নিকণার সমান। ফপ করে নিভে গেলে ঘুটঘুট্টি।

সময় নিয়ে ভাবতেও সময় লাগে। সেই সময়ের কথা লিখতে আরো একটু সময় চলে যায়। আজ – অদ্য তাই আলসেমি। আড়মোড়া ভাঙি না, ভাঁজ করে রেখে দিই। সময় জানে, আমার সাথে লড়াইয়ে সে সবসময় জিতবে। তাই মুচকি হাসে, তাচ্ছিল্য।

সময় চলে যাচ্ছে এটা হ্যান্নার মুখের দিকে চাইলেও বুঝতে পারি। হ্যান্না ডাকোটা ফ্যানিং। এই তো ক’দিন আগে দেখলাম ছোট্টমণি। সবার সাথে কথা বলে গিড়বিড়-কলকল। কেউ একটু মুখ ভার করে কিছু বললেই ছলোছলো হয়ে ওঠে, টলমল করে কচুপাতার ওপরে একবিন্দু শিশিরের মতো। আবার স্মিত হাসি দিতেই খিলখিল! সেই হ্যান্নার শিশুমুখ কিছুতেই ভুলতে পারি না। সেও বড়ো হয়ে যাচ্ছে তরতর করে – সুইট সিক্সটিন। সেদিন তার ছবি দেখলাম – হাউন্ডডগ। দেখার সময় বারবার মনে পড়ছিলো টেইকেন-এর পিচ্চি অ্যালি’কে। দুটো ছোট ছোট বেণী দুলিয়ে আধো আধো বোলে কথা বলতো মিষ্টি মেয়েটা, আর এখন কেমন গহীন অন্ধকার সব চরিত্র করছে। মানুষের ভেতরের কুৎসিত দিকগুলোর শিকার হচ্ছে রূপালি পর্দায়, তারপরে সেই নীল চোখে তার অশ্রু...। সেই অশ্রু আর টলমল করে না, চোখেই শুকিয়ে ফেলে সে। তারপরে চোয়াল শক্ত করে। পৃথিবী চুরমার হয়ে ঘুরছে, তার সাথে পাল্লা দিতে হবে না! তাই হ্যান্না বড়ো হয়ে ওঠে...

বার বার মনে হয়, এ আমি মানি না।

সেই বেদনাতেই কি না। পৃথিবী ঘুরে ঘুরে আমার সাথে দেখা করিয়ে দেয় এক গাড়ি চোরের। নাম – মিশেল পোয়কার্ড। তার সাথে ঘুরতে ঘুরতে দেখা পাই প্যাট্রিসিয়ার। এরা দুইজনে দেড় ঘন্টা বক বক করে, ঝগড়া করে, মারপিটও করে কিছুটা। দৌড়ে বেড়ায় সাঁজেলিসে'র এভিন্যু ধরে। গাড়ি চুরি করে মিশেল, সেই গাড়িতে চড়ে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে যায় প্যাট্রিসিয়া। আর সবচেয়ে ভালো লাগে ৩৯ মিনিট ধরে ছোট একটা ঘরের ভেতর তাদের কথাবার্তা। দুজনে বিছানায় বসে কথা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। এরই মাঝে ক্রমাগত সিগ্রেট ফোঁকে মিশেল। আবোল তাবোল অসংলগ্ন আলাপ।

আপনার কি কখনও এমন হয় নি, কারো সাথে অর্থহীন, লক্ষ্যহীন কথা বলেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। কথা বলার পরে ভুলেও গেছেন যে কি বিষয়ে কথা শুরু করেছিলেন? মিশেল – প্যাট্রিসিয়ার গল্পটাও সেরকম। ছবির শুরুতে একটা খুন করেছে মিশেল, এক পুলিশ ড্রাইভারকে দূর্ঘটনাক্রমে গুলি করে মেরে ফেলেছে সে। তার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্যারিসে ফিরে এসেছে জেলের খাঁড়া মাথায় নিয়ে শুধু প্যাট্রিসিয়ার জন্যে। তাকে নিয়ে সে পালিয়ে যেতে চায় ইতালি। সেখানে গিয়ে দুইজনে থাকবে। কিন্তু প্যাট্রিসিয়া যেতে চায় না। গড়িমসি করে। সেই এক ঘরের দৃশ্যে জানায়, তার ভেতরে আরেকজন আসছে। মিশেল আর তার সন্তান। এর জন্যে প্যারিসে থাকতে চায় সে। আর মিশেল তাকে নিয়ে চলে যেতে চায়।

খুব একটা রুদ্ধশ্বাস কিছু নেই। তারপরেও ছবির নাম – ব্রেথলেসজাঁ-ল্যুক গ’দার পরিচালক। সম্ভবত ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিচালক। পঞ্চাশ বছর আগে তার তৈরি এই ছবিটা দেখে রুদ্ধশ্বাস হয়েই বসে থাকি।

পৃথিবী কেন বন বন করে ঘোরে। কেন সে একটু থম ধরে দম নেয় না। চারপাশে এতো বাতাস, এতো হাহাকার মিশে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাঝে!

আমি একটু নির্জলা বাতাস চাই, বিশুদ্ধ অক্সিজেন না হলেও চলবে। খালি একটু ভেজাল মেশানো, কোমল পানীয়ের মতো, বাতাস ফুসফুসে টেনে নেবো। তারপর একটু সময় বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখবো। এভাবে আমার মনে হবে আমার চারপাশে আর কিছু নেই। কেউ নেই। কোন কিছু সত্যি সত্যিই আমাকে আর স্পর্শ করতে পারছে না। এই ভাবনা গাঢ় হওয়ার আগে হুট করে সেই বাতাসটুকু ছেড়ে দিবো। তাহলে মনে হবে আমি বেঁচে আছি। আমি ব্রেথলেস নই। আমার ভেতরে ফুসফুস সর্‌সর্‌ করে কাজ করছে। পেঁচিয়ে উঠছে ধমনীতে রাগ-ক্ষোভ-ভোগের স্রোত। গ’দার জানেন না, তিনি যে বছর মারা গেছেন সেই বছরেই আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম। আর এতোটা সময় পরে, তিনি আমাকে ব্রেথলেস করে দিলেন জাম্প-কাট করা ছবির শেষ দশ মিনিট দিয়ে।

সবকিছু আসলে লাটিমের মতো ঘুরছে, এই পৃথিবী, তার মেরুরেখা-বিষুবরেখা, সমুদ্র-হিমাচল, আমাদের খবরের কাগজের প্রথম পাতা, আমাদের মুখ- প্রমুখ সকল কিছুই ঘূর্ণিতে মিশে হারিয়ে যাবার ঠিক আগে আগে ঝলসে উঠছে। এই বিশ্ব-চরাচরে তার অস্তিত্বের চে’ আর জরুরি কিছু নাই!



*****

২১.৯.১০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন