শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১০

বোদলেয়ার ও মানিকের সাথে টুকরো আলাপ...

যতো প্রযুক্তিই আসুক আর বাংলাদেশে বাস করে যতোই ডিজিটাল হয়ে উঠি না কেন, সেই ছাপার অক্ষরের বইয়ের কাছে ফিরতেই হয়। সেদিন খোলামকুচির মতো বিনা পয়সায় পাওয়া এক বিকালে বেশ মোটা আর গরম মানিব্যাগ নিয়ে বইয়ের দোকানে ঢুকেছি। যে নেশায় ডিভিডি কিনি, তার চেয়েও অবাধে বই কিনতে ইচ্ছা হলো। দুই হাতে বইলে টনটন করে য়্যাতো গাদা বই কিনে আনলাম।

তাদের সাথে উল্টেপাল্টে কথা হয়। এক টানা কোনোটাই বেশি সময় পড়তে পারি না, অন্যজন বেশ লাস্যময়ী 'লুক' দেয়, 'হিন্ট' দেয়। তাই বই থেকে বইয়ে ভাসি। ছাপার অক্ষরগুলো বালিশের সাথে লেপ্টে যায়, আমার সাথেই রাত ফুরোলে ঘুমায়।

বোদলেয়ারের "ক্লেদজ কুসুম" পড়েছিলাম যৌবনের শুরুতে, টগবগে রক্তে আগুন আর মদ ঢুকে গিয়েছিলো কবিতার ছদ্মবেশে। আর এতোদিন পরে হাতে পড়লো "প্যারিস স্‌প্লীন"। বিষণ্ণ কবির মুক্তগদ্য, তথা গদ্য কবিতা। উপমা আর দৃশ্যকল্পে ঠাসা, ছাড়া ছাড়া বুনোটের বাক্য দিয়ে এক একটা লেখা। অনুবাদ পশ্চিম বঙ্গীয়, এবং বঙ্গদেশের বাজে অনুবাদের গৌরব বজায় রেখে এক্কেবারে যাচ্ছে তাই। পড়তে পড়তে ফরাসি ভাষা না জানার আফসোস কামড়ে কামড়ে ধরলো, শেষে ইংরেজি অনুবাদগুলো পড়লাম। বাংলা অনুবাদকারীকে শাপশাপান্ত করতে করতে অগত্যা রস খেলাম অন্যের হাতে, ভিন ভাষায়! তবে বোদলেয়ার-পাঠের আনন্দে এই ভাষা-পথের দূরত্বটাকে পাত্তা দিলাম না।

বোদলেয়্যারের সাথে বাতচিতে মজে আছি, এমন সময় ওপাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পর্দার আড়াল থেকে ডাক দিলেন। "অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়" বইটা কিনেছি। ডায়েরি - চিঠির যে জঞ্জাল মানিক ফেলে রেখে গেছেন, তার মাঝে নাক ডুবিয়ে দিলাম। বিয়িং জন ম্যালকোভিচের মতো মনে হলো নিজেকে। ডায়েরি পড়তে পড়তে হোঁচট খেতে হয়, দিন পরম্পরা নেই, বিষয় পরম্পরা নেই, গল্পের প্লটের পরেই বাজারের ফর্দ, তার পরেই ডাক্তারের কাছ থেকে 'কিনতে হবে' ওষুধের লিস্টি, পরের পাতাতেই তিন বছর পরের ঘটনা লিখে রাখা (সেদিন বোধহয় ধর্মঘট হয়েছিলো)! মানিকের লেখার সাথে পরিচয় প্রায় দশ বছর, কিন্তু এখন যেন আরেক মানুষকে চিনলাম। রক্তমাংসে গড়া, জ্বল জ্বল করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন, রোগে ভুগছেন, খকখক করে কাশছেন, ধুতির খুটে চশমা মুছছেন। আবার এসবের মধ্যেই দুর্দান্ত কোনো গল্পের প্লট লিখে রাখছেন তিন চার বাক্যে!! সুপারম্যান-ক্লার্ক কেন্ট, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ!!

বোদলেয়ার ততোক্ষণে রুষ্ট কিছুটা। ডেকে নিয়ে এক চোট বকলেন। তারপরে নিচের লেখাটা পড়লাম। থমকে গেলাম মানুষের বর্ণনায় - - - -

Le Chien et le Flacon
"— আমার সুন্দর সারমেয়, আমার কোমল কুকুর, আমার প্রিয় কুতুয়া, এগিয়ে এসে শোঁকো তো, শহরের শ্রেষ্ঠ আতরও'লার কাছ থেকে কেনা এই অপূর্ব আতর!"
কুকুরটা খুব লেজ নাচিয়ে এগিয়ে এলো, মনে হয় আদতে এটা এই অবলা প্রাণীদের স্মিত হাসি আর বক্রোষ্ঠীর প্রকাশ, কৌতূহলভরে এগিয়ে এসে ওর ভেজা নাকটা ডুবিয়ে দিল আতরদানির খোলা মুখে, তারপর হঠাৎই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়ে আমার দিকে চেয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো, যেনো নিন্দা করছে।
"— ওরে ও হতভাগা কুত্তা! তোকে যদি আমি একদলা বিষ্ঠা দিতাম তবে তো তুই মহানন্দে শুঁকতি, হয়তো গিলেও নিতি, তুই এমনই আমার বিষণ্ণ জীবনের অযোগ্য সঙ্গী। তুই ঠিক ভিড়ের মানুষগুলোর মতোন, যাদের কোন সুগন্ধি দিতে নেই, তাতে ওরা অতিষ্ঠ হয়, ওদের দিতে হয় বাছাই করা গু।"

মূল লেখা


আমি নিজেও ভিড়ের মানুষ। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কুকুরের মতো আমরা একে অপরের বগলে-ঘাড়ে ঘামের গন্ধ নিই। ওটাই আমাদের সয়। ফরাসি সৌরভে নাক জ্বালাপোড়া করে।

বোদলেয়ারের কথা শুনে মানিকও তার চশমা ঠিক ঠাক করে গলা খাকারি দিলেন। হাট করে খুলে গেলো নববর্ষের পাতা, ১৯৪৯ সালের, আজ থেকে ৬১ বছর আগের পহেলা জানুয়ারি...


১ জানুয়ারি, ১৯৪৯, শনিবার

এবারও কি সুরুতেই শেষ হবে? দেখা যাক। ডায়েরি রাখতে পারি না কেন? বোধ হয় এই ধারণা থেকে গেছে বলে যে ডায়েরি মানেই নিছক ব্যক্তিগত কথা! কয়েকদিন লেখার পর আর উৎসাহ পাই না।
ট্রামের প্রথম শ্রেণীর ভাড়া এক পয়সা বাড়লো! যাত্রীরা চটেছে মনে হলো না। বেশ খানিকটা হাল্‌কা ভাবেই বৃদ্ধিটা গ্রহণ করেছে। বরং যাত্রীদের এই উদাসীন ভাবে কণ্ডাক্টররা ক্ষুব্ধ — অশ্রদ্ধার সুরে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য শুনলাম দু'একটা, ভাবটা এইঃ কিছু হবে না এদের দ্বারা! মর তোমরা — আমাদের কি! ট্রাম ধর্মঘট ফেঁসে যাবার পর যাত্রীদের এভাবে ভাড়া বৃদ্ধি মেনে নেয়ার ফলে সংগ্রামী ট্রাম কর্মীদের এইরকম মনোভাবই স্বাভাবিক।
আসলে, বাবু যাত্রীদের তলিয়ে হিসার করা নেই — একবার টিকিট কাটতে মোটে এক পয়সা — আজকাল একটা পয়সা সামান্য! এই এক একটা পয়সা থেকে কোম্পানী যে গলা কেটে কতো মোটা লাভ করবে সেটা খেয়ালে আসে না। মনে পড়লেও গ্রাহ্য নেই — ভদ্রলোক তো — নিজের কথাই বড়োঃ আমাকে তো মোটে একটা করে পয়সা দিতে হচ্ছে — মরুক গে যাক! নীতিটা বড়ো নয় — অন্যায় করে একটা পয়সা কেউ আদায় করলে সেটা সহ্য করাও যে কতো বড়ো অন্যায় সে ধারণা নেই। ট্রামে ভীষণ ভীড়!

---০---


মানিক ঠিক ধরেছেন। ধ্বজভঙ্গ মধ্যবিত্তের নীতিবোধ দিনে দিনে আরো সুচারু এবং চালাক হয়ে গেছে। এখন আমরা নীতি নামক বস্তুটিকে জাদুঘরে তুলে রেখে দিয়েছি। ওটাতে তেল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়, মাঝে মাঝে সপ্তা-এন্ডে জাদুঘরে ঘুরতে গেলে ওটা শিশুদের দেখিয়ে বিস্মিত করে দিই আমরা বয়োজ্যেষ্ঠ মধ্যবিত্তেরা।




মানুষে মানুষে মিল বা অমিল নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও চিন্তা বরাবরই ভিন্ন। সেরকম একটা গল্পের প্লট লিখে রেখেছেন, সময়াভাবে হয়তো লিখে শেষ করেন নি, বা করতে পারেন নি। প্লটঃ


গল্পের প্লটঃ বিশ্বাসী নির্ব্বিকার পূজারী — কিছুতেই বিচলিত নন — সন্তানের মৃত্যুতেও নয় — ঈশ্বর অবিশ্বাসী অন্যজন ধর্ম্মের কোন ব্যাপারে বিচলিত নয় — বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় প্রথম জনের শোক — সন্তানের মরণে দ্বিতীয় জনের শোক — দুজনের শোক একরকম —


---০---


ডটডটঃ ভাবছি, বোদলেয়ার আর মানিক এই যুগে ব্লগ লিখলে কেমন বেসামাল অবস্থা হইতো?!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন