সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০০৯

এলোমেলো বসে থাকা

এলোমেলো বসে থাকা- এরকম একটা উপমা শুনেছিলাম, বা পড়েছিলাম কোন এক গল্পে বা কবিতায় বা উপন্যাসে। অথবা আমাকে কেউ শুনিয়েছিলো শব্দ তিনটা কয়েক বছর নাকি কয়েক মাস আগে। শব্দ তিনটা অনেক সময় বলে সবাই, কিন্তু এভাবে একসাথে বলে না। এলোমেলো হয়ে যায় সবাই, এলোমেলো জীবন কাটায় অনেকেই, এলোমেলো দিনরাত পাড়ি দেয় কেউ কেউ। আবার চুপচাপ বসে থাকে, স্থির হয়ে বসে থাকে, নয়তো হয়তো কেবল বসেই থাকে সবাই বা কেউ কেউ। কিন্তু এলোমেলো বসে থাকে বিশেষ কোন মানুষ। এলোমেলো বসে থাকা কেমন সেটা আমি জানতাম না। আমাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। শ্লেটের ওপরে খড়িমাটির চক দিয়ে যেভাবে মাতামহী "স্বরে-অ" লেখা শিখাতেন, -এর গোল পেট টেনে টেনে আঁকতে হতো, কারণ তা প্রায়ই ভুল হতো আমার, মিশে যেতে চাইতো -এর কালো মাথার সাথে। তাই আমি ঈষৎ কাঁপাকাঁপা হাতে চক টেনে টেনে "অ" লিখতাম। এভাবেই শিখতে হয় অপরিচিত প্রণালী, নিয়মে, অধ্যবসায়ে, একাগ্রতায়। কিন্তু আমি কখনো এলোমেলো বসে থাকতে শিখি নি। এমনকি শব্দগুচ্ছটাও আমার অপরিচিত ছিল অনেকদিন। তবু শব্দজোড়া শুনেই আমার মাথায় একটা ছবি তৈরি হয়ে গেল।


আমি তারপর থেকে সেই ছবিটির মতো এলোমেলো বসে থাকার চেষ্টা করতাম। এখনও অবসরে করি। কেউ যদি আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে, তাহলে কি সে অবাক হবে? তার কি মনে হবে এটাকে এলোমেলো বসে থাকা বলে? নাকি তার মনে হবে আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই বসে আছি, আমার বসে থাকায় কোন নতুনত্ব নেই, নেই অগোছালো বিন্যাস। তাই আমি একা একাই নিবিড়ভাবে চেষ্টা করতে থাকি কতটা নিখুঁত করে এলোমেলো বসে থাকা যায়।


এভাবে বসে থাকলে আমার মাথায় বিচ্ছিন্ন চিন্তাগুলো আসতে থাকে। একেবারে গোছানো-চিন্তা কোন কাজের নয়, সেটা আমাকে পাগল করে দেয় না। পড়ার সময়ে, পরীক্ষায় আগে আমি গোছানো-চিন্তা করি। তাতে করে আমার লক্ষ্য স্পষ্ট থাকে। কিন্তু এলোমেলো বসে থাকার কোন উদ্দেশ্য তো নেই, কারো উদ্দেশেও এই বসে থাকা নয়। এ' শুধু আমার জন্যেই, একান্ত আপন। সেজন্যে আমি এভাবে বসে থেকে রাজ্যের কথা ভাবি। ফড়িঙয়ের মতো দুরন্ত হয়ে ওঠে মগজের কোষ, সিন্যাপ্স- যাবতীয় জৈব-রসায়ন। আমি তখন জুলফি বেয়ে ঘাম কেমন ধীরে ধীরে নেমে আসে সেই কথা ভাবি। আরও ভাবি, বুড়ো আঙুলে চটকে দিলে ঘামের কণার স্রোতটা থেমে যাবে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অবশিষ্ট-ঘাম লেপ্টে থাকবে। আর হাতের বুড়ো আঙুলেও কিছু কিছু চলে আসবে নির্ঘাত; আমি সেই হাত জামায় মুছে ফেলবো। ঘামের চলন কতো বিবিধ, বহুবিধ!


তারপরে আমি আরো কত কথা ভাবি এভাবেই বসে বসে। নিয়মবিহীন ভাবনার সুবিধা হলো কাঠবিড়ালির মতো ডালে ডালে লাফিয়ে চলে যাওয়া যায়। মাথা ব্যথা করছে, মাথার ভেতরে রক্তের নাড়ির মতো দপ্‌ দপ্‌ করে উঠছে এক একটা ধাক্কা। ব্যথাগুলো কি চিন্তার কারণে জন্ম নেয়? এই যে দুর্গম এলোমেলো ঘুরছি মগজের কোষে কোষে, তারা হয়তো নিউরনে খবর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। দৈনন্দিন পরিচিত চিন্তার বাইরে তারা বেশি যেতে চায় না। মানুষের মতোই তারা হয়তো অভ্যস্ততা ভালোবাসে! তাই আজ আমার অলস অত্যাচারে তারা বিরক্ত, নাজেহাল, ব্যথিত। এজন্যে এখন সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে স্নায়ুর রাজপথ দিয়ে, ব্যাপন একটা সুচারু প্রক্রিয়া। এলোমেলো বসে থেকে পায়েও ঝিঁঝিঁ ধরে গেলো। অসাড় হয়ে আসছে পায়ের আঙুল, আঙুলের ডগায় একটা কালো পিঁপড়া পিলপিল করে ঘুরছে- অস্থির! আমার চিন্তার মতোই এলোমেলো তার চলন। পিঁপড়াচলনের পথরেখা কেমন হবে? অমিত সম্ভাবনাময় সঞ্চারপথ। আগে থেকে তো বোঝার উপায় নেই পিঁপড়াটা ঠিক কোন দিকে যেতে পারে। আর বোঝা যায় না বলেই যে কোন দিকে চলাচলের এই বিপুল আশ্বাস নিয়ে নিশ্চয়ই পিঁপড়াটি ভাবনায় জর্জর। আবার নাও হতে পারে। হয়তো এমন কষ্টকর চিন্তা যাতে করতে না হয় এজন্যে পিঁপড়ার মগজ খুব কম। একদিকে কম পেলে আরেকদিনে বেশি থাকে। পিঁপড়ার পা অনেকগুলো, ছয়টা পায়ে তরতরিয়ে অসীম সম্ভাবনাময় পথে সে হাঁটছে, চারণভূমি আমার পায়ের নিঃসাড় বুড়ো আঙুল।


অনুভূতিশূন্য হতে পারাও একধরনের সক্ষমতা। এই গুণ সহজাত নয়, অনুশীলনজাত, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। আমি সেটার অনুশীলন করি না, অনেকে করে, আমি তাদের মুখের রেখার সরলীকরণ দেখে মুগ্ধ হই। দুঃখ-তাপে অবিচলতা দেখে আমার সমীহ জন্মায়। প্রচণ্ড বিপদে বা দূর্যোগে তাদের ইস্পাত-কঠিন স্নায়ু দেখে ভক্তিতে আমি প্রায় মাটিতে মিশে যাই। মাটিতে মিশে যেতে যেতেই আমি দেখি আমার শরীর কালো হয়ে উঠছে। রক্ত শুকিয়ে গেলে কালো হয়ে যায়? বোধহয়। শীতলপাটির মতো কালো মাটি সম্ভবত শুষে নিয়েছে রক্তকণা, শ্বেত, লোহিত ইত্যাদি। নিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, আমি ব্যবসা করতে চাই না তাই লাভের বা লোকসানের চিন্তা নেই। এই সকল নেই নেইয়ের মাঝেও মাথার ভেতরে সূক্ষ্ণ চিল-চিৎকার ব্যথা এখনও সরব! মাটিতে শুয়েই ঘাড় এদিক-ওদিক হেলিয়ে আমি ব্যথাপাচার করে দেয়ার চেষ্টা করি। মাটি সব নিলো, রক্ত-ঘাম-শ্লেষ্মা-ত্বক। খালি আমার এলোমেলো বসে থাকার ভঙ্গিটা নিলো না! আমার ক্রমচলনের মগজকীট নিলো না! আমার পায়ের ওপর ঘুরে বেড়ানো পিঁপড়া নিলো না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন