বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০০৯

শব্দ পরিচয়

আমি অনেকদিন ধরেই কিছু লিখতে পারছি না। লিখতে না পারার যন্ত্রণা বা অসহায়ত্বের সাথে আমার অনেকদিনের সখ্য। এমন অনেকদিন হয়েছে, আমি দিনের পর দিন লিখতে পারি নি। আমার চারপাশে যারা লেখেন, তারা খুব চমৎকার লেখা পাতার পর পাতা লিখে ফেলেছেন। আমার তেমন কিছু মনে হয় নি। অন্যের লেখা পড়েও আমি টের পেয়েছি আমার ভেতরে কোনো শব্দ নেই। কোন সুর নেই। তাই আমি চুপচাপ হয়ে গেছি। আরো কিছুদিন পরে একটা সময়ে অনেক অনেক কথা ঘুম ভেঙে আমার মাথায় চলে এসেছে। তখন আমি আবার লিখতে শুরু করেছি। লিখতে লিখতে আমি ভুলে গেছি যে মাঝে কিছুদিন আমি শব্দহীন হয়ে কাটিয়েছিলাম! এমন সময় আসলে তাই আমি এখন একেবারেই বিচলিত হই না। ভাবি, যে কিছুদিন পরেই এই সময়টা কেটে যাবে। কেটে গেলে আমি কী কী লিখবো সেটা নিয়েও অনেক সময়ে আমি চিন্তা করেছি। কিন্তু এবারে কেনো জানি সেই চিন্তাগুলোও হচ্ছে না! আমি টের পাচ্ছি আমার ভেতরে কোনো শব্দ আসছে না। শব্দহীন হয়ে গেলে আমার কানের ওপর কেমন যেনো একটা চাপ পড়ে। মনে হয় একগাদা তুলো দিয়ে কেউ আমার কানে ধুম ধুম হাতুড়ি পেটা করছে।


শীত এলেও আমার এই অনুভব শুরু হয়। মনে হতে থাকে যে মাথায় ড্রামের বাড়ি পড়ছে। বড়ো একটা বিগ-ড্রাম নিয়ে রিজওয়ান যেভাবে তালে তালে বাড়ি দিতো, সেভাবে কেউ একজন বাড়ি দিচ্ছে। আমি রিজওয়ানের পাশেই বাঁশি নিয়ে দাঁড়াতাম বলে টের পেতাম ড্রামের সেই বাড়িগুলো কেমন করে বুকে এসে লাগে। শব্দের শক্তি নিয়ে আমার সকল সংশয় কেটে যেতো! রিজওয়ান এখন ফাইটার প্লেন চালায়। শাঁশাঁ করে ও যখন ছুটে বেড়ায় ‘বাংলার আকাশ রাখিবো মুক্ত’ শ্লোগান নিয়ে, আমার তখন খুব হিংসা হয়। ছেলেটা সারাজীবন শক্তিশালী শব্দ তৈরি করেই গেলো! আমি তেমন পারি না। আমার তৈরি করা শব্দেরা মৃদুমন্দ, লাজুক ও বিনম্র। খুব বেশি চিৎকার করলেও, হা হা করে অট্টহাসি দিলেও, আমি লিখতে গেলে খুব সোচ্চার হতে পারি না। আমার মনে হতে থাকে খুব জোরে বললে হয়তো কথাটার জোর কমে যাবে। হয়তো আমি যা বললাম, তুমি বা তোমরা সেটা বুঝবে না। ধরতেই পারবে না আমি কী অসম-সম্ভব তুলনা বুনছিলাম, রূপকের কত নিখুঁত রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম! খুব জোরে বললে সেটা ঝাপসা হয়ে যায়।


এই শীত আর লেখাহীনতা তাই আমাকে অনেক কাবু করে ফেলছে। বুড়ো দাদুর মত আমি বেঁকে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। এগুলো অর্থহীন বিলাসিতা, আমি জানি। আমার অস্তিত্বের টিঁকে থাকার জন্যে একেবারেই বাতুল-চিন্তা। তাই কাউকে হয়তো বলা হয় না। খুব প্রিয় মানুষটাকেও বলা হয় না। আসলে বলার তেমন কিছু নেইও। এমন না যে বলার সাথে সাথে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বা কারো সাথে এটা আলোচনা করলে, শেয়ার করলে একটা সুরাহা বের হবে। এই সমস্যা এতই বালখিল্য যে এটার গুরুত্ব কেবল আমার নিজের কাছেই। নিজে নিজে বুঝে গেছি, হয়তো একদিন এমনি এমনিই ঠিক হবে, তবে কীভাবে আর কবে হবে এটা আমার জানা নেই। জানা নেই বলেই আমি অপেক্ষা করি। কারো আগমন নিশ্চিত জেনে যে রকম অপেক্ষা করা দরকার, ঠিক তেমন। কান সতর্ক, ইন্দ্রিয় সজাগ করে হিম হিম শীত আর চাপ চাপ নৈঃশব্দ্য পাশে বসিয়ে আমি অপেক্ষা করি। আমি খুব ভালো করেই জানি আমার এই অপেক্ষা খুব শিগগিরই শেষ হবে। তারপরে নানান শব্দ আর সুর, রঙ আর রূপ আমার কাছে চলে আসবে। আমি আবার লিখতে শুরু করবো। প্রতিবার এমন বিরতির পরে আমার লেখা বদলে বদলে যায়। এবারেও যাবে আর আর সেই বদলে যাওয়া লেখাগুলো আমার ভালো লাগবে!


প্রিয় শব্দেরা, তোমরা সশব্দে এসো আমার ঘরে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন